কৃষ্ণাবতী পর্ব-১৭+১৮

0
1814

#কৃষ্ণাবতী
#১৭ম_পর্ব

কৃষ্ণার মুখের সবথেকে আকর্ষণীয় তার গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ঠোঁট জোঁড়া। দেবব্রত কি করছে নিজের ও জানা নেই। কৃষ্ণার বুক রীতিমতো ঢোল বাজাচ্ছে। কি করবে বুঝছে না। সে বুঝতে পারছে দেবব্রত তার মাঝে নেই। কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজের অধরে দেবব্রতের উষ্ণ ঠোঁটজোড়ার পরশ পেলো কৃষ্ণা। তৃষ্ণার্ত দেবব্রত তখন তার তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত। কৃষ্ণার হৃৎপিণ্ড যেনো বুক চিরে বেরিয়ে যাবে। এই অনুভূতির সাথে তার পরিচয় নেই। এ যেনো অন্য জগতের অনুভুতি, ভয় হচ্ছে, রাগ হচ্ছে আবার কোথাও না কোথাও একটা ভালোলাগাও কাজ করছে। উপন্যাসে লেখকেরা এই অনুভূতিকে সুখময় অনুভূতির কাতারে ফেলতেন। দেবব্রতের আচারণকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলে তারা দাবি করতেন। তবে কি কৃষ্ণার মাষ্টারমশাই তাকে ভালোবেসে ফেললো! দেবব্রতের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া থেকে তার যেনো নিস্তার নেই। কৃষ্ণার চোখ আবেশে বন্ধ হয়ে আসে। চোখজোড়া থেকে মুক্তাদানার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কৃষ্ণার অশ্রু দেবব্রতের গালে স্পর্শ হতেই দেবব্রত তাকে ছেড়ে দেয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলে,
– তুই কাঁদছিস কেনো? আমি তো তোকে ব্যাথা দেই নি।
– আপনার কি খুব খারাপ লাগছে মাষ্টারমশাই?

জড়ানো কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে কথাটা বলে কৃষ্ণা। দেবব্রত তখন ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কৃষ্ণার কানে মুখ লাগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
– উহু, এখন শান্তি লাগছে।

কৃষ্ণাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে সে। তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পারছে কৃষ্ণা। হাত পা ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। দেবব্রতের উষ্ণ শরীর তাকে জড়িয়ে রয়েছে। এই উষ্ণতার মাঝেও একরকম মাদকতা আছে। কৃষ্ণা তার মাষ্টারমশাই এর গায়ের সেই মাতাল করা গন্ধ পাচ্ছে। অজানা আবেশে তার হাত দেবব্রতের পিঠে চলে যায়। চোখ বুঝে চুপ করে শুয়ে তাকে কৃষ্ণা। দেবব্রত তখন শান্তির নিদ্রাতে। আর কৃষ্ণার চোখের ঘুম যেন হাওয়া হয়ে গেছে। এই অনুভুতি যেনো অজানা সুখের অনুভূতি, যা থেকে কৃষ্ণা অবগত নয়______

সকাল ৮টা,
সূর্যের তীর্যক রশ্নি চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙ্গে যায় দেবব্রতের। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। এখনো জ্বরটা পুরোপুরি নামে নি। শরীরটা ঘেমে আছে। বুঝা যাচ্ছে কাল রাতে খুব ধকল গেছে শরীরের উপর। সূর্যের আলো রুমটাকে পুরো আলোকিত করে রয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো তার গায়ের সাথে কেউ মিশে আছে৷ চোখে খুলতেই দেখলো তার বুকের সাথে বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে কৃষ্ণা। শাড়ির আঁচল এলোমেলো। সিঁদুরখানা লেপ্টে আছে। টিপটি প্রায় মুছেই গেছে। মেয়েটি জড়ো হয়ে তার বুকে ঘুমিয়ে আছে। দেবব্রত খানিকটা চমকে গেলো। চোখটা বুঝতেই কাল রাতের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। কতোবড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলো সে৷ তখন যদি নিজেকে না আটকাতো তাহলে খুব বড় অহিত হয়ে যেতো। এই ভুলটা চাইলেও শুধরাতে পারতো না। খুব অপরাধ বোধ হচ্ছে, যাকে ভালোইবাসে না তার সাথে এভাবে আচারণ করাটা অনৈতিক। কৃষ্ণা যদি এখন কাল রাতকে কোনো ভুল ইঙ্গিত হিসেবে ন্যায় তাহলে তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবে দেবব্রতের। কি বলবে সে কৃষ্ণাকে! জ্বরের ঘোরে তার দ্বারা ভুল হয়ে গেছে। এটা তো বাচ্চা মেয়েটার হৃদয়কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিবে! মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে। শোয়া থেকে উঠে বসলো দেবব্রত। মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলো সে। কি করবে সে! কিভাবে বুঝাবে কৃষ্ণাকে তাদের মধ্যে যা ঘটেছে তা কেবলই ঘোর, ভুল
– মাথাটা কি খুব ব্যাথা করছে মাষ্টারমশাই?

কৃষ্ণার কথায় ঘোর ভাঙ্গে দেবব্রতের। পাশে ফিরে দেখে কৃষ্ণা গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি মায়াবী মুখখানা! মেয়েটার সাথে কিভাবে এতোটা খারাপ কাজ করলো সে! নিজের উপর মারাত্নক রাগ হচ্ছে তার। নিজেকে কোনোমতে সামলে ধীর কন্ঠে বললো,
– কখন উঠলি? আমি কি তোকে জাগিয়ে দিয়েছি?
– নাহ, কেবল ই ঘুম ভাঙলো। এখন শরীরটা কেমন?
– হু ভালো৷
– দেখি জ্বর আছে কি না

বলেই কপালে হাত দিতে যাবে তখনই বাধা দেয় দেবব্রত। কৃষ্ণা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাল রাতে যে ব্যাক্তি ভালোবেসে তাকে আলিঙ্গন করেছে, আজ তার শরীর স্পর্শ করতে দিচ্ছে না। অবাক না হবার তো কোনো কারণ ই খুজে পাচ্ছে না কৃষ্ণা। দেবব্রত কৃষ্ণার চাহনী বুঝতে পেরে শান্ত কন্ঠে বলে,
– জ্বর নেই। তুই চিন্তা করিস না। আমরা আজ দুপুরে বের হবো কিন্তু।

বলেই বিছানা ছাড়ে দেবব্রত। একটু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। কৃষ্ণার চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু হচ্ছে না। কৃষ্ণা অবাক চোখে তার মাষ্টারমশাই এর যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনের মাঝে এক অজানা হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। এই হাহাকারের উত্তর তারও জানা নেই_____

বটতলায় বসে রয়েছে অর্জুন৷ চোখ কলেজ গেটের দিকে। হাতে চায়ের প্লাস্টিকের কাপ। কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শীতের সকালে এই এক কাপ চা যেনো সবচেয়ে উপাধেয় পানীয়। কিন্তু এখনো এক চুমুক ও দেয় নি সে কাপে। কারণ তার চোখ একজোড়া চোখকে অধীর হয়ে খুজছে। আজ চারদিন হলো এই চোখজোড়াকে দেখতে পায় নি সে৷ মনটা আনচান করছে। খুব বড় অসুখে পড়েছে সে এটা বুঝতে পারছে। এই কৃষ্ণাবতী সাহাকে একদিন না দেখলেই তার বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়। আজ তো চারদিন। সেই জানে তার কি অবস্থা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে তার। এই চারটা দিন ছ ঘন্টাও ঘুম হয় নি তার। চোখ বুঝতেই কৃষ্ণার মুখখানা চোখের সামনে ভাসে। ঘুমানো যে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো কলেজ গেট দিয়ে অন্না ঢুকছে। অধীর হয়ে অর্জুনের চোখ জোড়া কৃষ্ণাকে খুজতে থাকে। আশেপশে কোথাও কৃষ্ণাকে না দেখতে পেয়ে মনটা আবার হু হু করে উঠে তার। এবার আর বসে থাকতে পারে না অর্জুন। ছুটে যায় অন্নার কাছে। হঠাৎ অর্জুনকে নিজের সামনে দেখে অবাক হয়ে যায় অন্না। কিছু বলার আগেই অর্জুন প্রশ্ন করে উঠে,
– কৃষ্ণা আসে নি অন্না?

অর্জুনের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে অন্না। ছোট হলেও অর্জুনের চাহনী,ব্যকুলতা বুঝতে বেশি সময় লাগে না অন্নার। মুখে হাসি টেনে বলে,
– কৃষ্ণা আসে নি অর্জুন দা।
– ওর কি শরীর খারাপ? চারদিন হয়ে গেছে আসে নি।

অর্জুন বেশ আকুল হয়ে প্রশ্নটা করে অন্নাকে৷ অন্না নিজেকে শান্ত রেখে খুব ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয়,
– ও সুস্থ আছে, মামা বাড়িতে ঘুরতে গেছে। আর ফিরবে। কাল থেকে আসবে কলেজে।
– অহহ

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্জুন। আরো একদিনের অপেক্ষা। গোবেচারা মুখখানা করে চলে যেতে নিলে অন্না গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– আগুন নিয়ে খেলছো অর্জুনদা। দেখো হাতের সাথে সাথে মনটা ও না জ্বলে যায়। তখন শুধু জ্বলতে হবে তোমাকে। সেই জ্বলন কাউকে বুঝাতেও পারবে নি। কিন্তু তুমি জ্বলবে। বিরহ জ্বালা খুব কষ্টের।

অন্নার কথাটা অর্জুনের পা জোড়া আটকে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলো সে অন্নাকে। অন্না আর কথা বাড়ালো না। গটগট করে ক্লাসের দিকে রওনা দিলো। অর্জুন এখনো অন্নার কথার জালের মর্মার্থ খুজছে। সত্যি কি আগুন নিয়ে খেলছে সে!!

১৪.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। দেবব্রতের অদ্ভুত আচার-আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে। লোকটা এখনো তার সাথে অস্বাভাবিক আচারণ করে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার সময় সারাটা রাস্তা কোনো কথা বলে নি সে। কেমন যেনো এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। কৃষ্ণা বুঝে উঠতে পারছে না তার দোষটা কি! ভেবেছিলো এবার হয়তো মাষ্টারমশাই এর ঘরে তার ঠায় মিলবে। কিন্তু হলো কই! মাষ্টারমশাই তার ট্রাংক অন্নার রুমেই দিয়ে গেলো। কৃষ্ণার মনে অন্ধকার ছেয়ে আছে। খুব কান্না পাচ্ছে। দেবব্রতের আচারণ তাকে ব্যাথিত করছে। কিন্তু দেবব্রত কি জানে সেটা! না সে জানে না। না আর চুপ থাকবে না কৃষ্ণা। প্রশ্ন করবে দেবব্রতকে। যদি এভাবে এড়িয়েই যায় তবে কেনো তাকে ভালোবেসে কাছে টেনেছিলো সে। চোখের অশ্রু মুছে দেবব্রতের রুমের দিকে রওনা দেয় সে। রুমের কাছে যেতেই……

চলবে

#কৃষ্ণাবতী
#১৮ম_পর্ব

চোখের অশ্রু মুছে দেবব্রতের রুমের দিকে রওনা দেয় সে। রুমের কাছে যেতেই পা জোড়া আটকে যায় কৃষ্ণার। নিজের কানকে বিশ্বাস করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। ভেতর থেকে দেবব্রতের কথোপকথন কানে আসে তার।
– যাকে ভালোইবাসি না তাকে শুধু কামনার তাড়ণায় আপন করার মানেই হয় না রবিন। আমার রিয়েক্ট করাটা কি অস্বাভাবিক কিছু? আমার অপরাধবোধ হচ্ছে। মেয়েটাকে একটা মিথ্যে আশা দিয়েছি আমি। আমি কৃষ্ণাকে ভালোবাসি না, আমাদের মাঝে যা হয়েছে সেটা শুধু ঘোরের টানে। ঘোরের বশে আমার দ্বারা ভুল হয়ে গেছে

আর কিছু শুনতে ইচ্ছে হলো না কৃষ্ণার, তার যেনো জগতের খেয়াল ই নেই। মাথায় একটা কথাই ঘুরছে “আমাদের মাঝে যা হয়েছে সেটা শুধু ঘোরের টানে। ঘোরের বশে আমার দ্বারা ভুল হয়ে গেছে”। সম্বিত যখন ফিরলো খেয়াল করলে টের পায় তার গালজোড়া ভিজে আছে। সে কাঁদছে। বুকে অসম্ভব ব্যাথা করছে। এ ব্যাথা অসহনীয় যন্ত্রণা। স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা। আশাহীন হবার যন্ত্রণা। কৃষ্ণা তার ঘরের পানে রওনা দেয়। তার আর ইচ্ছে হলো না সেখানে দাঁড়াতে। দাঁড়ালে হয়তো বুকের ক্ষতটা গাঢ় হবে। কি দরকার____

অপরদিকে,
দেবব্রত এখনো তার বন্ধুর সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। দেবব্রতের খুব ভালো বন্ধু রবিন। যখনই চারিদিকের পরিবেশ তাকে বেদনা দেয় তখনই সে রবিনের সাথে মনের কথা বলে মনটাকে হালকা করে। দেবব্রতের কথার যুক্তি রবিনের বুঝার বাহিরে। যতই বুঝাতে চাচ্ছে ততই দেব তার যুক্তি দেখাচ্ছে। এটা যেনো কোনো গণিতের সূত্র। যেখানে দুই যোগ দুই কখনোই পাঁচ হবে না। রবিন শান্ত কন্ঠে তাকে বলে,
– কাউকে কাছে টেনে তাকে সেটাকে ঘোরের অজুহাত দেওয়াটা কাপুরুষত্ব নয় দেবব্রত? এই দেবব্রতকে তো আমি অন্তত চিনি না!
– আমি কাপুরুষ নই, শুধু সময় নিচ্ছি। আমি তোকে বোঝাতে পারবো না। আমি ঘেটে আছি। কি করবো কিছুই বুঝছি না। তুই বল একজন মানুষ কি শতজনকে ভালোবাসতে পারে? পারে না একজনকেই সে শতবার ভালোবাসে। কৃষ্ণাকে আমার ভালো লাগে, মানুষ হিসেবে। এর বেশী কিছুই নয়। এটাকে ভালোবাসার নাম দেওয়াটা মিথ্যাচার ব্যাতীত আর কিছুই নয়। আমার তো আমার ব্যক্তিত্বের উপর সন্দেহ হচ্ছে। আমি তো দামিনীকে ভালোবাসি অথচ ঘোরের বশে আমি কৃষ্ণাকে কাছে টেনেছি। একজনকে ভালোবেসে অন্য একজনের মাঝে কামনা মিটানো কি কাপুরুষত্ব নয়!
দেবব্রতের যুক্তিতে বিদ্রুপের হাসি হাসে। বিদ্রুপের স্বরে দেবব্রতকে বলে রবিন,
– তাহলে তুই বলছিস এটা কৃষ্ণার দোষ? তার তোর প্রতি কোনোই অধিকার নেই। তোর সেবা করাটাই তার ভুল ছিলো। দেবব্রত তোরা স্বামী স্ত্রী, আজ হোক কাল হোক তোর আর কৃষ্ণার কাছে আসা টা খুব স্বাভাবিক, তাই নয় কি?
– জানি কৃষ্ণার এটা অধিকার, তার আমার কাছে আসাটা কোনো অন্যায় নয়। আমি তাকে কথাও দিয়েছি আমি তাকে নিজের স্ত্রীর অধিকার দিবো। দিবো অবশ্যই দিবো। দায়িত্ব এড়াতে আমি পারবো না, তবে আমিও তো মানুষ। আমার সময় দরকার। আমার ভাবনা গুলো বড্ড এলোমেলো হয়ে আছে। আমার সময় লাগবে।

এবার নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না রবিন। রবিন এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,
– যদি এই বিয়েটা তোকে এতোই বেদনা দিচ্ছে, এতোই যখন তোর অপরাধবোধ, তবে কৃষ্ণাকে ছেড়ে দে। বিয়ে করে নে সৌদামিনীকে। একটা কথা তোকে স্পষ্ট ভাবে বলে দি, অতীত অতীত হয়। দামিনী তোর অতীত। কৃষ্ণা তোর বর্তমান । বর্তমানকে অতীতের মোহে পায়ে ঠেলে দিস না। আর কিসের দায়িত্ববোধের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলছিস। এখন তোর দায়িত্ববোধ কোথায়? মেয়েটিকে এড়িয়ে চলছিস। কাপুরুষের মতো নিজেকে নিজে ডিফেন্ড করছিস। দামিনী তোর প্রেমিকা ছিলো স্ত্রী নয়, আর তুই তোর প্রেমিকার কাছে অপ্রতারক হতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে কাপুরুষ হয়ে যাচ্ছিস। তুই কৃষ্ণাকে স্ত্রীর অধিকার দিতে নারাজ। কি অদ্ভুত। আমি বলি কি ওকে ছেড়ে দে, মুক্তি দে। নতুন জীবন করুক সে। অন্তত এমন কাউকে বেছে নিক সে তাকে ভালোবাসবে। অন্তত তাকে কাছে ডেকে নিজের অনুভূতিকে অস্বীকার করবে না।

কৃষ্ণাকে মুক্তি দেবার কথাটা শুনতেই দেবব্রতের বুক কেঁপে উঠে। কেনো এমন অনুভূতি হচ্ছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে দেবব্রতের। দম আটকে আসছে তার। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা করছে। কেনো হচ্ছে জানা নেই। কিন্তু নিজের অনুভূতি একেবারেই রবিনের কাছে প্রকাশ করলো না সে। শান্ত গলায় বললো,
– ভেবে দেখছি।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো সে, ফোনটা ছুড়ে ফেললো বিছানায়। এরপর গা এলিয়ে দিলো বিছানাতে। বুকে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, কৃষ্ণাকে মুক্তি দেবার কথা ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠেছে মন। সে কি অসুস্থ, সৌদামিনীর প্রতি কখনো এমন অনুভূতি হয় নি, তবে আজ কেনো; কেনো কেনো কেনো! দেবব্রতের মাথার রগ ফুলে উঠেছে। সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে বারান্দায় যাওয়াটাই হয়তো ভালো হবে। দেবব্রত উঠে দাঁড়ালো, ধীর পায়ে হেটে এগিয়ে গেলো বারান্দায়।

১৫.
আজ কৃষ্ণার কলেজের এন্যুয়াল ফেস্ট। স্টেজে সবাই কাজ করছে, পার্টিসিপেন্টরা রিহার্সাল হলে রিহার্স করছে। অর্জুন তার পাশে বসে রয়েছে। কৃষ্ণার সাথে কথা বলবার জন্য তার মন উৎসুক। কিন্তু কৃষ্ণার সাথে কোনো ভাবেই কথা বলা হয়ে উঠছে না। কিভাবে শুরু করবে সেইটাই বুঝে উঠছে না অর্জুন। কৃষ্ণাবতী তার থেকে অনেক ছোট, তাই ছ্যাবলার মতো কিছু বলাটা হয়তো শোভা পাবে না। লান্স টাইমে সবাই খাবার খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে যাবে বলে রিহার্সাল বন্ধ করা হয়। সেই সুযোগে অর্জুন কৃষ্ণাকে বলে,
– তুমি খাবে না?
– অন্না আসুক, ওর সাথেই তো খাই। আজ ওকে ছাড়া খেলে ও রাগ করবে।
– ও হয়তো আসতে পারবে না
– কেনো?
– ও তো নাচের দলের সাথে অলরেডি নিচে চলে গেছে।
– ওহ, আমি খেয়াল করি নি।

আজকাল কৃষ্ণার মন কিছুতেই স্থির থাকে না, বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছে। কখন অন্না খেতে চলে গেছে সেটাই তার খেয়াল নেই। কৃষ্ণা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কারণ রিহার্সাল হলে কেবল সে এবং তন্ময় বসে রয়েছে। অর্জুনের চাহনী খুব ভয়ংকর। তার চোখের দিকে তাকালে হারিয়ে যায় কৃষ্ণা। মনে হয় লোকটা তাকে শুধু চাহনী দিয়ে তার মনকে নিজের বশে নিয়ে আসছে। বলাই বাহুল্য লোকটার প্রেমে মানুষ হাবুডুবু খায়। কিন্তু কৃষ্ণা তো জানে না এই রহস্যময়ী লোক তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কৃষ্ণার অস্বস্তিবোধ হচ্ছে বুঝতে পেরে অর্জুন মুচকি হাসি দিয়ে উঠলো। কৃষ্ণা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি হাসছেন কেনো?
– আমাকে কি দেখতে এতোই ভয়ংকর? সে তুমি এতোটা মিয়ে আছো। মনে হচ্ছে আমি তোমাকে গিলে খাবো
– সে রকম কিছু নয়।
– আচ্ছা কৃষ্ণাবতী, আমার প্রতি কৌতুহল হয় না?
– কিসের কৌতুহল?

অর্জুনের নিজের উপর হাসি পাচ্ছে, এই পিচ্চি মেয়েটার প্রেমে যে কিভাবে পড়লো। তাকে ভেঙে বললে হয়তো সে বুঝবে, তার সামনে বসে থাকা ছেলেটা তাকে পাগলের মতো চায়। অর্জুন মুচকি হেসে বললো,
– এই যে আমার তোমার প্রতি কৌতুহল হয়, জানতে ইচ্ছে হয় তোমাকে। তোমার হয় না?
– সত্যি বলবো?
– বলো শুনি
– হয় না বললে ভুল হবে, হয়। এই যে আপনাকে প্রায় আমার কোচিং এর বাহিরে দেখতে পাই, আপনি কিভাবে জানেন তখন আমার কোচিং? তারপর ধরুণ কোনো সিনিয়রেরা আমাকে বকে না। আমাকে দেখলেই কেমন যেনো অন্যরকম আচারণ করে। একজন তো সেদিন আমাকে বৌদি বলে উঠেছে। কেনো? আমার এ সব নিয়ে কৌতুহল হয়। আমাকে কারণটা কি বলা যাবে?

অর্জুন আবারো মুচকি হাসি দেয়। কৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আজ সন্ধ্যার অপেক্ষা। তোমার সব চিন্তার অবসান করবো। অপেক্ষা করো আমার।
বলেই উঠে দাঁড়ায় অর্জুন। কৃষ্ণার বুক টিপটিপ করছে। লোকটা কি করবে? সন্ধ্যায় তো অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মাঝেই কি কিছু করবে লোকটা।

সন্ধ্যা ৭টা,
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। স্টেজের লাইট জ্বলছে। একে একে এক একটা পার্ফোমেন্স হচ্ছে। অডিয়েন্সের প্রথম সারিতেই দেবব্রত এবং সৌদামিনী বসে রয়েছে। সৌদামিনীর সাথে এখনো কথা বলে নি দেবব্রত। তার আজকাল কিছুই ভালো লাগছে না। রবিনের বলা কথা গুলো খুব ভাবাচ্ছে। কৃষ্ণা ও একটা সপ্তাহ কেটে গেলো অথচ তার সাথে কোনো কথা কইছে না। তার কাছে পড়তেও আসে না সে। কৃষ্ণার চাহনী যেনো বড্ড উদাসীন। এই উদাসীনতা তার কিশোরী বউ এর মুখে একেবারেই মানাচ্ছে না। যেই কৃষ্ণা দেবব্রতের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো সেই কৃষ্ণা এখন নিজেকে একরকম বাক্স বন্দি করে নিয়েছে। যা একেবারেই সহ্য হচ্ছে না দেবব্রতের। হঠাৎ একটি মেয়ে মাইকে বলে উঠে,
“ এখন আপনাদের সামনে গাণ এবং নাচের যুগল বন্দী পেশ করবে আমাদের কলেজের কৃতি ছাত্রছাত্রী”

মাইকে ঘোষনার পর স্টেজে অর্জুন এবং কৃষ্ণা উঠে আসে। এবং একদল নাচের ছাত্রছাত্রীও উঠে আসে। কৃষ্ণা এবং অর্জুন গাণ গাইবে সেই সাথে তারা নৃত্য পরিবেশন করবে। প্রথমে কৃষ্ণাই গাণটা ধরে,
“আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
তুমি সুখ যদি নাহি পাও যাও সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চায় গো
আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায় “

কৃষ্ণার গলায় বেদনা আর্তনাদ স্পষ্ট। দেবব্রত তার দিকে এখনো কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেবব্রতের অপরাধবোধ তাকে ভেতর থেকে দূর্বল করে দিচ্ছে। কৃষ্ণা কি তার এই দোটানার কথা টের পেয়েছে? তাই নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে তার থেকে। একের পর এক গাণ গেয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণা অর্জুন। তাদের যুগলবন্দীর প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ। দুজনকে পাশাপাশি মানিয়েওছে। দেবব্রতের একেবারেই তা সহ্য হচ্ছে না। হাতমুষ্টিবদ্ধ করে বসে রয়েছে সে। শেষ গাণটি গাওয়া শেষ হলে কৃষ্ণা প্রস্তুতি নেয় স্টেজ থেকে নেমে যাবার জন্য। তখনই অর্জুন আরেকটি গাণ ধরে,
“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী– তোমার
কনককঙ্কণে॥“

গাণটি আজ গাবার কথা ছিলো না। পাতায় কোথাও গাণটা নেই। অথচ অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে গাণটা গেয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত না! একটা গাণের মাধ্যমে অর্জুন তার মনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে উঠলো। কৃষ্ণার বুঝতে বাকি রইলো না অর্জুনের রিহার্সাল হলে বলা কথার মর্মার্থ। দেবব্রত বিস্ফোরিত চোখে অর্জুন কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অর্জুনের গাণে আবেগের অভাব নেই। কৃষ্ণার হৃদয়ে তার কথাগুলো পৌছাতে সময় লাগলো না। কৃষ্ণা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অর্জুনের দিকে। স্টেজে থাকতে তার ভালো লাগছে না। পারলে এখনি ছুটে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেটা অর্জুনের জন্য অপমানের চেয়ে কম কিছু হবে না। দেবব্রতের চোখ কৃষ্ণাতে স্থির। কৃষ্ণার স্থিরতা তাকে খুব অস্থির করে তুলছে। তখন সৌদামিনী মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
– আমি তাহলে ঠিক ই ভেবেছিলাম। ছেলেটা কৃষ্ণাকে ভালোবাসে। ভালোই হলো। এবার হয়তো দায়িত্বের সম্পর্ক থেকে তুই মুক্তি পাবি। কৃষ্ণাও হয়তো ছেলেটাকে পছন্দ করে। তাই তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দূর্গা মা যা করে, ভালোর জন্যই করে। তাই না দেব?

দেবব্রত রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে আছে অর্জুনের দিকে। কেনো যেনো খুব রাগ হচ্ছে তার। একেবারেই সহ্য হচ্ছে না তার কৃষ্ণার পাশে তাকে। ইচ্ছে করছে এখনই কৃষ্ণাকে টেনে স্টেজ থেকে নামিয়ে আনতে। আর চিৎকার করে সবাইকে জানাতে এই মেয়েটা তার স্ত্রী, শুধু তার। শুধু তার। হঠাৎ দেবব্রত খেয়াল করলো সে কি ভাবছে। তার দোটানা কেটে গেছে, তার সন্দেহ কেটে গেছে। তার শুধু কৃষ্ণাকে ভালোলাগে না, এর থেকেও বেশি কিছু অনুভব করছে সে কৃষ্ণার প্রতি। এই অনুভূতিটা খুব অন্যরকম। এই অনুভূতি তাকে পাগল করে ফেলছে। এই অনুভুতি তাকে কৃষ্ণাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করছে। কখন যে এই কিশোরী মেয়েটা তার হৃদয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছে এটা দেবব্রত নিজেও জানে না। এতোদিন সে অহেতুক নিজের সাথে লড়াই করেছে। সেদিন ভালোবেসেই কৃষ্ণাকে কাছে ডেকেছিলো সে। হ্যা এটাই সত্যি। নিরন্তন সত্যি। অর্জুনের গাণ শেষে কৃষ্ণা কোনো কথা না বলেই স্টেজ থেকে নেমে পড়ে। অর্জুন ও তার পিছু পিছুই নামে। কৃষ্ণা কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিলো বিধায় অর্জুন তার হাতটি টেনে ধরে,
– কোথায় যাচ্ছো কৃষ্ণাবতী?
– অনুষ্ঠান শেষ বাড়ি যাবো আমি
– আর আমার প্রশ্নের উত্তর? সেটার কি হবে? আমি তো তোমাকে সব বলে দিয়েছি। এর পড়েও কি আমি উত্তর পাবো না?
– কিসের উত্তর বলুন তো?
– তুমি এখনো বুঝো নি?

অর্জুনের গলায় আকুলতা, অস্থিরতা। কৃষ্ণাকে আরোও অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে এই আকুলতা। কৃষ্ণা চোখ বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শান্ত গলায় বলে,
– একজন বিবাহিত মেয়ের পক্ষে আপনার এরকম প্রেম নিবেদনের কি উত্তর হতে পারে অর্জুনদা। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বিবাহিত। আমার কাছে এসব কেবলই পাপ।
কয়েক মিনিটের জন্য অর্জুন শান্ত চোখে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তারপর……………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি