কৃষ্ণাবতী পর্ব-৩৪

0
3670

#কৃষ্ণাবতী
#৩৪তম_পর্ব

– আমাদের টিমে সবাই এক থেকে দুই, কেউ কেউ তিন হচ্ছে বা হবে। তোর কথাটা এবার বল দামিনী!

রবিনের কথায় ঠোটের কোনায় একটা ম্লান হাসি দিয়ে দামিনী বললো,
– আমার দুই হওয়া নিয়ে তোরা বেশ চিন্তায় আছিস দেখছি।
– অবশ্যই, তোর বিয়ে খাওয়ার সুযোগ হারাতে চাই না। কবে করছিস বিয়ে?
– তাহলে তোর আশায় গুড়ে বালি
– কেনো?
– কারণ, আমার বিয়ে…..

কথাটা বলার পূর্বেই সৌদামিনীর ফোনে একটি ফোন আসে। ফোনটি রিসিভ করার মিনিট পাঁচেক পর ই একজন পুরুষ তাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। লোকটি দেশী মানুষ নয় সেটা চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। শ্বেত বর্ণের একজন পুরুষ, উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট, বাদামী চুল গুলো কপালে পড়ে রয়েছে, চোখ জোড়া ঘোলাটে। লোকটির বয়স দেবব্রতদের কাছাকাছি। সবাই অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সৌদামিনী ঠোঁটের কোনায় হাসি একে বলে,
– মিট মাই হাসবেন্ড পিটার।
– হাসবেন্ড?

অবাক কন্ঠে রবিন প্রশ্নটা ছুড়ে মারে৷ সৌদামিনী তখন ধীর কন্ঠে বলে,
– তোদের আশায় গুড়ে বালি, আমার বিয়ে তোদের আর খাওয়া হলো না। কয আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

পিটার মুচকি হেসে সবার সাথে হ্যান্ডসেক করে। দেবব্রতের অস্বস্তি বোধটা একটু হলেও কম হয়ে যায়। পিটারের সাথে ঘন্টা খানেক সবার জমিয়ে আড্ডা হয়। পিটারের জন্ম কানাডাতে, সেখানেই সে বড় হয়েছে, তার মা শতাব্দী দেবী বাঙালী যে কারণে তার বাংলাটা বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত। বিদেশে থাকাকালীন পিটারের সাথে পরিচয় হয় সৌদামিনীর। বিদেশে বাঙ্গালী হিন্দু পাওয়াটা খুব দুষ্কর ব্যাপার। তাই পিটার তার মার সাথে সৌদামিনীর পরিচয় করিয়ে দেয়। পিটারের বাবা ম্যাথিউ সাহেব মারা গিয়েছিন বছর পাঁচেক হবে তখন। তাই একাকীত্বের মাঝে বেশ সময় কাটানোর সঙী পেয়েছিলেন তিনি। দামিনী এবং পিটারের বন্ধুত্বটা ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে। গভীরত্বকে সম্পর্কের রুপ দিতেই পিটার তাকে তার মনের কথাগুলো বলে। সৌদামিনীও কোথাও না কোথাও পিটারের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। দুজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ, এটাই তাদের সম্পর্কের প্রধান ঝামেলা ছিলো। ঘোর ব্রাক্ষণ হওয়াতে অনুরাগ বাবু তার সম্পর্কের বিরোধিতা করেন। অনেক ঝামেলা হচ্ছিলো বলে দামিনী কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। সবার মতের বিরুদ্ধে পিটারের সাথে সে কোর্ট ম্যারেজ করে। বাংলাদেশে আসার মূল কারণটাই হলো বাবার সাথে বোঝাপড়া। ধর্ম ব্যাপারটা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো খুবই সেন্সিটিভ। তাই হয়তো অনুরাগ বাবু এখনো দামিনীকে মেনে নেন নি। পিটার এবং সৌদামিনী ভালো আছে দেখে দেবব্রতের চোখ আপনা আপনি কৃষ্ণাতে আটকে গেলো। এককোনায় ম্লান হাসি টেনে বসে রয়েছে। কেউ কথা বলতে চাইলে হাসিটা টেনে কথা বলছে। তার দৃষ্টিটা খুব ক্লান্ত। এক সপ্তাহ ধরে কোনো কথা হয় নি কৃষ্ণার সাথে। এই একটা সপ্তাহ না জানি কতটা কষ্ট দিয়েছে সে কৃষ্ণাকে। কথাটা ভাবতেই বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয় দেবব্রতের৷
– কেমন আছিস দেব?

সৌদামিনীর প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে দেবের। মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
– এইতো চলছে
– শুনলাম কৃষ্ণাকে নাকি জাপান থেকে স্টাডির অফার এসেছে?
– তুই কি করে জানলি?
– শুনলাম আর কি, তো কি প্লান? ওকে একাই পাঠাবি?
– ওর যাওয়াটা ক্যান্সেল করে দিয়েছি
– হঠাৎ?
– কৃষ্ণা প্রেগন্যান্ট

কথাটা শোনামাত্র একটু চুপ হয়ে যায় দামিনী। মানুষ খুব অদ্ভুত যতই হোক প্রাক্তনের জন্য কোথাও না কোথাও বুকের মাঝে হাহাকার হবেই, জীবনটা যদি রঙ্গিনও হয়ে যায় তবুও এই ব্যাপারটা হয়৷ দামিনী ম্লান হাসি হেসে বলে,
– বাহ! কংগ্রেচুলেশন
– হুম
– তুই কি ব্যাপারটায় অখুশী
– কেনো বলতো?
– মনে হলো, আসলে মানুষ বাবা হতে যাচ্ছে ব্যাপারটা যেভাবে প্রকাশ করে তুই সেভাবে প্রকাশ করিস নি। তাই বললাম আর কি? সব ঠিক চলছে তো?
– তোর কাছে কেনো যেনো কিছু লুকাতে পারি না। না সব ঠিক চলছে না। আসলে বাচ্চাটাকে নিয়ে আমাদের মাঝে মনোমালিন্য চলছে, কিছু কারণে আমি বাচ্চাটা চাইছি না। কিন্তু কৃষ্ণা তার জিদে বসে রয়েছে। ওর জিদ মেনে নেওয়াটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ওর এই বাচ্চামি
– মাতৃত্ব কখনো বাচ্চামি হয় না দেব। আমি ওর জায়গাতে থাকলেও আমিও একই বাচ্চামি একই জিদ করতাম। আমার এজ হয়েছে, বেবি নিতে অসংখ্য ডিফিকাল্টিস আছে। কিন্তু তবুও আমরা ট্রাই করে যাচ্ছি। আর পিটার আমাকে যথারীতি সাপোর্ট ও করছে। এই সময়টা খুব ক্রুশাল দেব, কৃষ্ণার এখন তোর সাপোর্টের দরকার। ওর মানসিক চাপের জন্য ও কিন্তু ওর হেলথ খারাপ হতে পারে।

সৌদামিনীর কথাটা দেবব্রত চুপ করে শুনলো। সৌদামিনীর কথাটায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কৃষ্ণাকে আজকাল প্রচুর ক্লান্ত লাগে। ওর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থাটা ভালো নয়। এবোর্শনের চাপ দেওয়টাই সকল সমস্যার সমাধান কখনোই হতে পারে না। একজন নারীর মনোবাঞ্চাটা বোঝাটাও একজন স্বামীর জন্য মাঝে মাঝে জরুরী হয়ে পরে। দামিনীর কথাগুলো শুনে দেবব্রতের ভেতরে খানিকটা হলেও গ্লানির উদ্ভব হয়।

রাত দশটা,
রুমে এসে বিছানায় পা মেলে দেয় কৃষ্ণা। পাটা খানিকটা ফুলে গেছে। শরীরটাও দূর্বল লাগছে। আজকাল একা একা থাকতে হয় তাকে। দেবব্রত সেদিনের পর থেকে স্টাডিতে থাকে। মাথায় হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলো কৃষ্ণা ঠিক তখনই দেবব্রত ঘরে প্রবেশ করে। কারোর আগমনের অনুভুতি হতেই উঠে বসে কৃষ্ণা। চোখ মেলে দেখে তার সামনে দেবব্রত দাঁড়ানো হাতে গরম পানির গামলা৷
– কিছু লাগবে মাষ্টারমশাই?

কৃষ্ণা তাড়ার কন্ঠে প্রশ্নটা করে৷ কোনো উত্তর না দিয়েই মাটিতে গামলাটা রাখে। অন্যদিকে ফিরে ধীর কন্ঠে বলে,
– গরম লবণ পানিতে পা ভিজিয়ে রাখলে আরাম পাবে। এতে পা টা ফোলাও কমবে আর ক্লান্তিও কাটবে।

দেবব্রতের কথাটা ঝড়ের বেগে বলে বেড়িয়ে গেলো। কৃষ্ণা এক নজরে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে রইলো। লোকটা তার কথা একেবারেই যে ভাবে না না নয়। কিন্তু কোথাও যেনো তাদের সম্পর্কের সুরটা মিলছে না। কৃষ্ণা সেই অমিলটুকু খুজে পাচ্ছে না। হয়তো সেটা সময়ের অপেক্ষা_________

২৮.
ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ। আকাশে তুলোর মতো সাদা মেঘ উড়ছে, আর ঢাকার বাতাসে ধুলো। ভ্যাবসা একটা গরম, সূর্যের তাপে গা পুড়ে যাবার দশা। এর মাঝে গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে দেবব্রত। কপালে চিন্তার ভাজ, চোখ জোড়া বুজে রয়েছে। তার ঠিক পাশেই ফাইল হাতে কৃষ্ণা বসে রয়েছে। কৃষ্ণার মুখে আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ জমেছে। কৃষ্ণার প্রেগ্ন্যাসির তিনমাস হতে চলেছে। কিন্তু বেবীর গ্রোথ কিংবা কৃষ্ণার শারীরিক অবস্থা আশানুরূপ ভালো নয়। কৃষ্ণা পেট আকড়ে বসে রয়েছে। ভয়ে গলা কাঁপছে৷ হঠাৎ দেবব্রত বললো,
– কৃষ্ণা, এবোর্শনটা করে ফেলি। তোর তো কিছুই অজানা নয়! প্লিজ এবার জিদ করিস না। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাবো।
– মাষ্টারমশাই তোমার পায়ে পড়ি এমনটা বলো না। ওকে হারালে আমি আর কখনো মা হতে পারবো না। প্লিজ মাষ্টারমশাই
– আমায় ক্ষমা কর, আমি আর পারছি না। তোকে হারালে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। আমাকে এর চেয়ে মেরে ফেল তুই। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। সব ব্যাবস্থা হয়ে গেছে।
– না, মাষ্টারমশাই আমি আমার বাচ্চা হারাতে রাজী নই।

কৃষ্ণার আকুতি যেনো কৃষ্ণার কান অবধি যাচ্ছে না। গাড়ি থেকে নেমে হাতটা টেনে দেবব্রত হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণাকে। তখনই……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি