কে পর্ব-০২

0
1608

#কে!!
#২য়_পর্ব

সুইচের কাছে দিতেই কেউ পেছেন থেকে ঝাপটে ধরলো। চিৎকার করার আগেই মানুষটি তার মুখ চেপে ধরে। নীতির হাতদুটো মুড়ে পেছনে লোকটির এক হাতে আবদ্ধ, মুখটাও চেপে ধরেছে। নড়াচড়া করার মতো সুযোগ ও হচ্ছে না। না দেখতে পেলেও এটা খুব করে বুঝতে পারছে, লোকটির গায়ে অনেক শক্তি। মাথাটা একেবারে হ্যাং হয়ে আছে নীতির। হচ্ছেটা কি!! একে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার উপর থেকে একটা অচেনা অজানা মানুষ তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে। ব্যাপারটা ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। না না এভাবে হতে দিলে চলবে না, কিছু একটা করতেই হবে। এতো ভয়ার্ত সিচ্যুয়েশন এও মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো নীতির। ইচ্ছে মতো পেছনের আক্রমণকারী মানুষটির পায়ে পা দিয়ে লাথি মারতে লাগলো। প্রথমে লোকটি সহ্য করলেও এক পর্যায়ে নীতি ছাড়তে বাধ্য হয় সে। পায়ের ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে যখন পিছিয়ে যায় লোকটি তখন সেই সুযোগ নিয়ে নীতি লাইটটা অন করে ফেলে। লাইট অন করে যা দেখতে পেলো তাতে তার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। লোকটি পায়ের ব্যাথায় এক পায়ে লাফাচ্ছে। অবাক কন্ঠে বলে উঠে নীতি,
– তুই? এখানে?
– তুই কি মারকুটে রে, পা টা ছেচে দিলি একেবারে।

ব্যাথায় আহত সৈনিকের মতো নির্ভীক বলে উঠে। এতোক্ষণ তাকে পেছন থেকে আকড়ে ধরে ভয়ের সর্বোচ্চ লেভেলের পরিচিতি দেওয়া মানুষটি আর কেউ নয় নির্ভীক। কিন্তু নীতি এখন একটা জিনিস ভেবে পাচ্ছে না তাহলো, তার কি এখন খুশি হওয়া উচিত নাকি রাগ হওয়া উচিত। আর নির্ভীক ঘরের ভেতরে ঢুকলো কি করে এই ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না। আর শালুক ই বা কোথায়? আর নির্ভীকের তো এখন আর নতুন প্রেমিকার কাছে থাকা উচিত। নাহ আর ভাবতে গেলে বাদামের সাইজের ব্রেইনটা ব্লাস্ট হয়ে যাবে নীতির। ভ্রু কুচকে হিনহিনে গলায় নীতি প্রশ্ন করলো,
– তুই এখানে? কি কাজ? আর শালুক কোথায়? এভাবে আমাকে ভয় দেখানোর কি মানে?
– আরে আরে, এতো প্রশ্ন কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর দিবো?
– এক এক করে প্রতিটার
– আচ্ছা আচ্ছা, তবে শোন আমি পৌনে একঘন্টা আগে এখানে এসেছি। আমার ডেট হয়ে গেছে, সারাদিন তোর সাথে দেখা হয় নি বিধায় ইচ্ছে হলো তোকে দেখে যেতে। বাসায় আসার পর শালুক জানালো তুই বাড়ি নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম, অপেক্ষা করবো না। পরে ভাবলাম উহু, এসেছি যখন তোর সাথে দেখা করে তবে যাবো। শালুকের দোকানে কাজ ছিলো তাই ও বাহিরে গেছে। তুই যখন ডোর বেল বাজাচ্ছিলি তখন আমার মাথায় এই খোরাফাতি প্লান আসে। একারণেই আমি লাইট অফ করে রেখেছিলাম, দরজা খুলি নি। তারপর কি হয়েছে তোর জানা। তবে বলতে হবে, হেব্বি ভীতু তুই। কি ভয়টাই না পেয়েছিস। রীতিমতো কাঁপছিলি,হাহহা

নির্ভীকের হাসিতে যেনো গা জ্বলে যাচ্ছে নীতির। সত্যি সে বেশ ভয় পেয়েছে। কেনো ভয় পেয়েছে এটা ঠিক জানে না। কালরাতের স্বপ্নের পর থেকে এই ভয়টা দলা পেকে আছে। সব সময় কেনো যেনো একটা শুকনো ভয় মনের ভেতর কাজ করছে।
– কি রে? ভাবনার কোন ট্রেনে উঠে পড়লি আবার?

তুড়ি বাজিয়ে কন্ঠে কৌতুহলের দানা নিয়ে প্রশ্নটি করে নির্ভীক। ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে ঠোঁটের কোনায় হাস্যার রেখা টেনে নীতি বলে,
– ভাবছি, আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে যে এভাবে আমাকে দেখার ইচ্ছে হলো তোর? ৪৫ মিনিট আমার অপেক্ষাতে কাটালি?
– বারে বন্ধু তুই আমার দেখতে আসতেই পারি, ভাবটা এমন যেনো আমি কোনো পাপ করে ফেলেছি
– না সেটা না, তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি এভাবে আমার সাথে ফাযলামি করবি না। খবরদার বলে দিচ্ছি। আর যদি এরকম কিছু করেছিস তো দেখবি কি করি।

নীতির কথা শেষ হতে না হতেই ডোর বেল বাজে। দরজা খুলতেই দেখে শালুক দাঁড়িয়ে আছে। নীতি কিছু বলার আগেই ফট করে ঘরে ঢুকে পড়ে। শালুক মেয়েটি বেশ ফটফট করে, মাত্রাতিরিক্ত কথা বলাটাই ওর স্বভাব। খুব হাস্যজ্জ্বল এবং চটপটে। কিন্তু আজ তার চখমুখ অন্য কথা বলছে। কিছু একটা বিষয় তাকে বেশ চিন্তিত করছে। ব্যাপারটা নীতির চোখ এড়ালো না। নীতি যখন রান্নাঘরে গিয়ে তাকে কিছু নাস্তা বানিয়ে দিতে বলে নির্ভীককে তখন যেনো কেমন দায়সাড়াভাবে উত্তর দেয় সে। আর বারবার জিজ্ঞেস করে,
” ভাইয়া যাইবো না? কখন যাইবো?”

মেয়েটির এরকম আচারণটা বেশ খটকা লাগে নীতির কাছে। কেননা, নির্ভীক এই প্রথম তাদের বাসায় এসেছে ব্যাপারটা এমন নয়। তবুও শালুক যেনো চাইছে না নির্ভীক বাসায় থাকুক। শালুককে কিছু জিজ্ঞেস করলেও হুম, হ্যা তে উত্তর দিচ্ছে। একটা সময় নীতি বলেই বসে,
– এই শালুক, কি হয়েছে রে তোর
– কে…কেন আফা

নীতির এরুপ প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ায় বেশ ঘাবড়ে যায় শালুক। নীতির সন্দেহ চোখে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে,
– তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস?
– হ…হ্যা?
– আমার তুই কিছু লুকিয়ে খেয়েছিস তাই না? নয়তো চুরি করেছিস? সত্যি করে বল তো, কি চুরি করেছিস?
– আফা কিছু চুরি করি নাই
– সত্যি তো?

শালুকের মুখে ভয়ের ছাপ, এই বুঝি ধরা পড়ে গেলো। বড় সড় ঢোক গিলে বলে,
– হ…হো
– কানের দুলটা সুন্দর। তোকে খারাপ লাগবে না। নাস্তা নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বসার রুমে আয়। নির্ভীক খেয়েই চলে যাবে।

বলেই নীতি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। শালুক মেয়েটার একটু হাত চলে। না বলে জিনিসপত্র নিয়ে নেওয়াটা নতুন কিছু না। এটা নীতির বেশ ভালো করেই জানা আছে। আগেও এমন অনেকবার করেছে। শালুকের কানের দুলটা নীতির এটা নীতি জানে। তবুও কিছু বললো না। শালুক এই হাতটানের স্বভাব আদনান সাহেব কিংবা ফারহানা বেগম জানেন না। জানলে মেয়েটিকে আর কাজে রাখবে না। এটা নীতি চায় না। শালুক তার খুব ভালো সঙ্গী তাই শালুক এবাড়ি থেকে চলে যাক তা সে একেবারেই চায় না। নীতি যাবার পর শালুক যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে, যেনো চুরিটা একটুর জন্য ধরা পড়ে নি। কি এমন লুকাচ্ছে শালুক!!

ড্রয়িং রুমের ব্যালকনির চেয়ারে মুখোমুখি বসে আছে নির্ভীক আর নীতি। কেনো যেনো নির্ভীক ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে নীতির। শতভাগ পারফেক্ট নয় তবে আশিভাগ পারফেক্ট এর কাতারে পরে ছেলেটি। যেমন দেখতে, কথাও বলে বেশ চমৎকার করে, গুছিয়ে। ছেলেটি হাসলে মনে অন্যরকম দোলা খেলে যায়। ছেলেটি কথা বললে খালি শুনতে মন চায়। টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম কথাটি নির্ভীকের ক্ষেত্রে টল, ফেয়ার, হ্যান্ডসাম। হেয়ার কাটিং, মুখের দাড়ির স্টাইল সব মিলিয়ে সাউথের হিরো হিরো একটা ভাব আছে। কলেজের সব মেয়েদের হার্টড্রপ। হয়তো একারণেই তার গার্লফ্রেন্ডের অভাব হয় না। হয়তো একারণেই নীতিকে তার চোখেও পড়ে না।
– তোর কি ভাবা রোগ হলো নাকি? যখন কথা বলতে যাই শুধু ভাবনার সাগরে থাকিস

নির্ভীকের কথাটা কানে যেতেই নীতি নিজের চিন্তার অবসান ঘটায়। নির্ভীকের চোখ সে কেবলই একজন ভালো বন্ধু। হয়তো এটাই তার পরিচয়। বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয় নীতির। থাক না সম্পর্কগুলো সরলভাবে, জটিল করতে গেলে ভালোর চেয়ে খারাপ হবার সম্ভাবনাই বেশি।

রাত ৯টা,
নির্ভীককে বিদায় নিয়ে নিজ রুমে এলো নীতি। সারাদিনের ক্লাস করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। এখন লম্বা শাওয়ার নিয়ে ঘুমাতে গেলে খারাপ হবে না। কিন্তু সেটার উপায় নেই, এই স্নিগ্ধ নামক নতুন টিচারটি প্রথম ক্লাসেই এসাইনমেন্ট দিয়ে দিয়েছে। ক্লাস নিতে পারলো না অমনি এসাইনমেন্ট। তবে লোকটির পড়ানোর ধরণ বেশ ভালো লেগেছে নীতির। শুনলে শুনতে ইচ্ছে করে টাইপ। অনেকটা যেনো সম্মোহনী শক্তি দিয়ে নিজের দিকে আকর্ষণ করে ফেলে সবাইকে। মাথাটা ঝাকিয়ে স্নিগ্ধ চিন্তা বাদ দেয় সে। এখন লম্বা একটি শাওয়ার নিবে। যেই কাজ সেই ভাবা, আধা ঘন্টা পর শাওয়ার থেকে বের হয় নীতি। আয়নার সামনে যখন চুল মুছতে ব্যাস্ত নীতি তখন মনে হতে থাকে কেউ যেনো নিপুন ভাবে তাকে দেখে চলেছে। অনুভূতিটা অন্যরকম, গা ছমছম একটা অনুভূতি। নীতি টাওয়েল রেখেই আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে। নাহ ঘরে তো সে আর শালুক ব্যাতীত কেউ নেই। এটা কেবলই নিজের মনের ভুল। সব চিন্তা বাদ দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নীতি। আজ অনেক ক্লান্ত সে একটু ঘুমালে মন্দ হবে না। এসাইনমেন্ট কালকে ক্যাম্পাসে যেয়ে না হয় করবে। চোখ বুজতেই বেশ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় নীতি। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখতে পায়…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি