কে পর্ব-০৪

0
989

#কে!!
#৪র্থ_পর্ব

ডিপার্টমেন্টাল হেডের রুমে গিয়ে দেখতে পায় একজন সিভিল ড্রেসে লোক বসা। তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে লোকটি হাসি মুখে বলেন,
– হ্যালো, আই এম আহসান হাবীব। আমার সাথে তোমাদের দুজনকে একটু থানায় যেতে হবে।
– থানায় কেনো?

অবাক হয়ে নির্ভীক জিজ্ঞেস করলে লোকটি বলে,
– খুন হয়েছে, তার প্রাইম সাসপেক্ট তোমরা। তাই
– মানে?

এরপর যা বললো তাতে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় নীতি এবং নির্ভীকের। লোকটি মুখে হাসি রেখেই বললো
– দু দুটো খুন হয়েছে, একই সময়। মজার ব্যাপার হলো দু দিন আগে তাদের সাথেই আপনাদের ঝামেলা হয়েছিলো। ভিক্টিমের বন্ধুরা আপনাদের প্রাইম সাস্পেক্ট দাবি করছেন। এখন থানায় চলুন সব জেনে যাবেন।

লোকটার কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো নীতি এবং নির্ভীক। মাথায় কিছুই আসছে না তাদের। খুন হয়েছে, তারা প্রাইম সাসপেক্ট।
– কিন্তু আমরা খুন করি নি, কেনো আমাদের নিয়ে যাবেন?

বেশ উত্তেজিত ভাবেই নির্ভীক জিজ্ঞেস করে। নীতির মাথায় যেনো কিছুই কাজ করছে না। রীতিমতো ঘামছ সে। হাত পা যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে। মাথা একেবারেই ফাঁকা হয়ে গেছে। লোকটি এখনো হেসে বলে,
– ইন্টারোগেশন করতে হবে যে৷ এখন কলেজে তো আছে ইন্টারোগেশন হয় না। তাই

কথাটি বলেই পেছনে ফিরে হেড স্যারকে বললেন,
– স্যার, আসছি। আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালোই লাগলো।

বলে হ্যান্ডসেক করেই বেরিয়ে গেলো। ডিপার্টমেন্টাল হেড তাদের আশ্বস্ত করলেন সে তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাই নীতি এবং নির্ভীক পুলিশের গাড়িতে উঠলো।

দুপুর ১২টা,
একটা রুমে দুজনকে বসিয়ে রেখেছেন হাবীব। লোকটা দেখতে একেবারেই পুলিশের মতো নয়। রোগাপোটকা চেহারা, তার উপরে শুধু পিত্তি জ্বালানো হাসি হাসে। লোকটা সারাক্ষণ হাসে, খুন হয়েছে তাও হেসে বলছে। খানিকটা বিরক্তকরও। এতোক্ষণ যাবৎ খালি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কিছু ভেবে বাঁকা হাসি দিচ্ছে। যেনো কেস সলভ হয়ে গেছে। এবার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গতে লাগলো নির্ভীকের। বেশ হিনহিনে গলায় বললো,
– আমাদের মুখ দেখার জন্য নিশ্চয়ই আপনি এখানে আনেননি। প্লিজ একটু খোলসা করে বলবেন কি?

নির্ভীকের কথা শুনে আবারো পিত্তি জ্বালানো হাসি দিয়ে দুটো ছবি এগিয়ে দিলেন হাবীব। ছবি গুলো দেখে বেশ আতকে উঠে নীতি। এই ছেলে দুটো সেই ছেলে দুটো যাদের একজনকে নীতি থাপ্পড় মেরেছিলো হাত ধরার জন্য, আর একজন যে নির্ভীককে মেরেছিলো। দুজনকে খুব নৃসংসভাবে খুব করা হয়েছে। দুজনেরই বা-হাত কাঁটা, চোখ উপরে ফেলা হয়েছে। বুকের উপর ক্রমাগত ক্ষত এর দাগ। নীতির বমি পাচ্ছে, মাথাটা ভন ভন করছে। হঠাৎ চুপ হয়ে বেশ ধারালো কন্ঠে বললেন হাবীব,
– দুটো খুন একই সময়ে, দুটো আলাদা জায়গায়। এখনো ফরেনসিক রিপোর্ট আছে নি, তবে আমার এস্যাম্পশন এদেরকে কোনো ধাঁরালো অস্ত্র দিয়েই খুন করা হয়েছে। এবং খুনির এদের প্রতি ঘৃণাটাও বেশ বেশি।
– কিন্তু আমাদের কি সম্পর্ক এই খুনের সাথে?

বেশ ঠান্ডাভাবেই নির্ভীক বললো। হাবীব এবার একটু এগিয়ে এসে বললো,
– সম্পর্ক আছে বা নেই এটা তো ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে পরশুদিন রাতে তোমরা দুজন কোথায় ছিলে।
– কিন্তু সেটা কেসের সাথে কি সম্পর্ক?
– কারণ যেদিন তোমাদের সাথে এই দুজনের ঝামেলা হয়েছিলো, সেই রাত ৯টায় এদের খুন হয়। এবার বলো।

নির্ভীকের কপালে চিন্তার দাগ। নীতির শরীরটা ভালো লাগছে না। গা গুলোচ্ছে। পানির গ্লাসের চুমুক দিয়ে পানিটুকু খেয়ে নিলো সে। ভীত কন্ঠে বললো,
– আমি বাসায় ছিলাম।

নীতির শরীরটা ভালো লাগছে না এটা নির্ভীক বুঝতে পারছে। সে বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমি ক্লাবে ছিলাম, আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে। চাইলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। কিন্যু আমার কথাটা হলো আমরাই কেনো প্রাইম সাসপেক্ট। ঝামেলার সময় তো অনেকেই ছিলো।
– কারণ ওদের বন্ধুরা বলেছেন, তুমি নাকি এই ছেলেটাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিয়েছো। তোমরা যদি তোমাদের এলিবাই জোগাড় করতে পারো, আমি তোমাদের জোর করে তো আটকে রাখবো না তাই না?
– এখন কি আমরা যেতে পারি? নীতির শরীরটা খারাপ লাগছে।

হাবীব খানিকটা চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বললেন,
– ঠিক আছে, তবে আবার দরকার হলে আমি তোমাদের ডাকবো। এবং তোমরা কো-অপারেট করতে বাধ্য থাকবে। জামাল, ওদের বাড়ি পৌছে দাও।

পুলিশ স্টেশন থেকে বের হতেই গরগর করে বমি করলো নীতি। শরীরটা একদম ছেড়ে দিয়েছে তার। নির্ভীক কোনো মতে নীতিকে বাড়ি পৌছে দেয়। হাবিব এখনো সেখানেই বসে আছে। ছবিগুলোকে দেখে যাচ্ছে। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন খুনটা কে করলো, কে!!

কলেজের বটতলার নিচে বসে রয়েছে নীতি। মনটা তার ভালো নয়, কালকে বাসায় যেয়ে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ খেয়েছে সে। কাল রাতে কোনো স্বপ্ন, ভুত কিছুই দেখে নি। তবুও মনটা অস্থির হয়ে আছে। বইয়ের পাতা অন্যমনস্ক হয়ে পাল্টাচ্ছিলো, তখন কানে এলো,
– মাথায় এতো প্রেসার দিলে সেটা হ্যাম্পার্ড হয়ে যাবে।

মাথা তুলে দেখে সামনে পকেটে হাত দিয়ে স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোকটার নামের মতো লোকটাকেও বেশ স্নিগ্ধ লাগছে নীতির কাছে। মনটা বড্ড একা ছিলো। মা-বাবা কেউ ই তাকে কালকের ঘটনার পর সঙ্গ দেয় নি। নির্ভীক ও ওর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যাস্ত৷ নীতির কথা ভাবার সময় আছে কি তার? একটা মানুষের সঙ্গ খুব দরকার ছিলো নীতির। স্নিগ্ধকে দেখে চটজলদি দাঁড়িয়ে মলিন হাসি হেসে বললো,
– স্যার, আপনি এখানে?
– আজ ক্লাস নেই, এখান থেকে যাচ্ছিলাম তোমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তোমার চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছি বেশ ডিসটার্বড তুমি। কালকের ইন্সিডেন্টটা নিয়ে ভাবছো, তাই তো?
– না আসলে, মাথায় আসছে না। কেউ কাউকে এভাবে মারতে পারে। আর ওই অফিসার তো ভাবছেন আমরাই জড়িত। তাই সেটা নিয়ে ভাবছিলাম।
– নদীর পাড়ে যাবে?
– জ্বী?

স্নিগ্ধ এর কথা শুনে হা করে তাক দিয়ে তাকায় নীতি। লোকটা এমন কোনো কথা বলবে কল্পনাও করে নি সে। মুখ এখনো হা হয়ে আছে। স্নিগ্ধ তার মুখ টা অফ করে কোমল কন্ঠে বললো,
– মশা ঢুকবে, অন্য কিছু মনে করো না। এজ ইউর টিচার, আমার কিছু দায়িত্ব আছে তোমার দুশ্চিন্তা দূর করার। আমি কিন্তু ব্যাকডেটেড টিচার নই। সো ইউ ক্যান শেয়ার এনিথিং উইথ মি। যাবে? মন ভালো লাগবে।

লোকটার কথাগুলো সম্বোহনের মতো কাজ করছে। নীতির ইচ্ছে হচ্ছে লোকটার সাথে ছুটে যেতে। খুব কি ক্ষতি হবে তাতে!!

নির্ভীক ক্যাম্পাসে ফিরে কোথাও নীতিকে পেলো না। নীতির মনের অবস্থা তার অজানা ছিলো না। সকাল সকাল এসেই নীতিকে সঙ্গ দিতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু কালকের ঘটনা নিয়ে বাসায় বিশাল এক ঝামেলা হয়েছে। সেটা শেষ করে আসতে আসতেই দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু নীতি তো ক্যাম্পাসে নেই। ওকি আসেই নি? আফরাকে জিজ্ঞেস করলে ও বলে, সে জানে না। মেয়েটা কোথায় গেলো!!

নদীর পাড়ে বসে রয়েছে নীতি, পাশে স্নিগ্ধ। নীতির দৃষ্টি পানির উত্তালতার দিকে। চোখ বুজে এই শীতল হাওয়া অনুভব করতে ব্যাস্ত সে। অপরদিকে স্নিগ্ধ এর নজর নীতির দিকে। নিপুণ নজরে তাকে দেখে যাচ্ছে সে। বাতাসে তার চুল উড়ছে, পুতুলের মতো মুখখানি রোদের শীতল রশ্নিতে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। যেনো কোনো শিল্পীর আঁকা বনলতা সেন। ঠোঁটের তিলটাকে ছুয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছে বুকে ঝেকে বসেছে। মেয়েটাকে দেখলেই মনের মাঝে ইচ্ছে হয় বেধে ধরে নিজের কাছে রেখে দিতে। একটা খাঁচায় আটকে রাখতে। যে খাঁচায় শুধু সে তাকে দেখতে পারবে। নির্ভীকের ছিটাফোঁটা ও থাকবে না। খুব রাগ হয় স্নিগ্ধ এর যখন কেউ নীতির আশেপাশে থাকে। খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। যেমন খুন করেছে ওই ছেলেটাকে। আরোও কঠিন শাস্তি দিতো ছেলেটাকে কিন্তু তার আগেই মরে গেছে।
– কি ভাবছেন?

নীতির সরল প্রশ্নে ভাবনার কালো অধ্যায় থেকে বের হয় স্নিগ্ধ। মুখের কোনায় হাসি টেনে বললো,
– কিছু না। মন ভালো হয়েছে?
– হুম ধন্যবাদ। ঋণ রইলো, সুদে আসলে ফেরত দিবো

কথাটা শুনে মুখে হাসি একে নীতির চোখের উপরের চুলগুলো কানের নিচে গুজে দিতে দিতে বললো,
– লাগবে না, আমি নিয়ে নিতে পারবো। সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না।

স্নিগ্ধ এর এমন কাজে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো নীতি। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্নিগ্ধ এর কথা শুনতে খুব ভালো লাগে নীতির। কানে যেনো মধুর ধ্বনির মতো লাগে। সে কি স্নিগ্ধ এর উপির ক্রাস খেলো? হতেই পারে।

বিকেল ৪টা,
নীতির বাসার নিচে তাকে পৌছে দিতে এসেছে স্নিগ্ধ। নীতি কোনো কথা বললো না, শুধু শুকনো ধন্যবাদ দিয়েই ছুটে পালিয়ে যেতে গেলে স্নিগ্ধ পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। পেছনে ফিরতেই বলে,
– যদি আমার কোনো কাজে অস্বস্তি লাগে তবে

কথাটা শেষ করতেই পারে নি তার আগেই ভুতের মত পেছনে হাজির হয় হাবীব। হাবীবকে দেখেই হাত ছেড়ে দেয় স্নিগ্ধ। তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে হাবীবের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠে,
– সরি মিস নীতি। আপনাকে জ্বালানোর জন্য। কিন্তু আমাদের সাথে যে আপনার আবার থানায় যেতে হবে।

হাবীবের কথায় অবাক হয়ে নীতি জিজ্ঞেস করে,
– কেনো?
– খুন করে এতো সহজে পার পাওয়া যে অসম্ভব মিস নীতি। সেদিন যে আপনি বাসায় ছিলেন না সেটা যে আমার জানা হয়ে গেছে। আর খুনের স্পটেও আপনার উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছি। এবার কি যাবেন? নাকি হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে যাবো?

হাবীবের কথা শুনে নীতির মাথা যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। তখন……

চলবে