কে!! পর্ব-০৭

0
1901

#কে!!
#৭ম_পর্ব

নির্ভীকের কথাগুলো কানে বাজছে। এতোদিনের বন্ধুত্বের পর ও এভাবে কথা বলবে নির্ভীক এটা তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। নিরিবিলি বসে যখন ভাবনার গহীনে তার বিচরণ তখন হঠাৎ কেউ পেছন থেকে নীতির ঘাড়ে হাত রাখে। হতচকিয়ে পেছনে ফিরতেই দেখে স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে দেখে যেনো মনে একটা প্রশান্তি কাজ করছে। এমন ও কি হয় যে চেনা মানুষগুলো ধীরে ধীরে অচেনা হয়ে যায় আর অচেনা মানুষগুলো বড্ড বেশি চেনা চেনা লাগছে। মুখে শান্ত হাসি একে পাশে বসতে স্নিগ্ধ বলতে লাগলো,
– ওগো নারী পাড়ি দিলে অক্ষির
সীমানা,
হৃদয়েতে এঁকে দিলে এ কোন ভাসনা?
ভালোবাসা কত যে,
মনে আশা বেধেছে,
হিয়া তারে চেয়েছে,
তারই গীতি গেয়েছে।
তারে ছাড়া দিগহারা ভাষা হারা অন্তর,
ভেবে তারে মনে মনে চলা মোর মন্থর।

স্নিগ্ধ এর ঠান্ডা গলার কবিতাটা চুপ করে শুনছিলো নীতি। স্নিগ্ধ এর গলায় যেনো অন্যরকম কোমলতা আছে। তার প্রতিটি লাইন যেনো মনে যেয়ে গাথছে নীতির। সেই সাথে এক আকাশ সমান সংশয় ও মনে বাসা বাধছে। কিসের এতো টান তার প্রতি স্নিগ্ধ এর। তাদের পরিচয় তো দু সপ্তাহ ও হয় নি তবে? অন্যমনস্ক হয়েই বলে উঠে সে,
– আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কেমন? ছাত্রী- শিক্ষকের সম্পর্ক থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। আমরা কি তবে বন্ধু?

নীতির কথাটা শুনে বেশ শব্দ করেই হেসে উঠে স্নিগ্ধ। অবাক নয়নে স্নিগ্ধ এর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে নীতি। কোনো প্রুরুষের হাসি কি এতোটা সুন্দর হয়? কে জানে হয় বুঝি!! নিজের হাসি থামিয়ে মুখটাকে বেশ সিরিয়াস করেই স্নিগ্ধ বলে,
– তোমার দিক থেকে যদি সেটা বন্ধুত্ব হয় তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমার দিক থেকে এটা বন্ধুত্ব নয়। দেখো যদি একজন পূর্ণবয়স্ক ছেলেমেয়ের কথা চিন্তা করি তবে আমার আচারণ গুলো তোমার কাছে খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিয়ে দিবে। আমি যে তোমার থেকে অনেক বড় তাও নই। তোমাকে আমি কখনোই আমার স্টুডেন্ট হিসেবে দেখি নি। অনেকটা কাকতালীয় ব্যাপার, তোমাকে আমি প্রথম দেখেছি যখন তুমি অনার্সে পড়। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যদি কিছু থাকে তবে সেটা তোমাকে দেখেই হয়। এর পর বাহিরে চলে যাবার কারণে তোমাকে খুজে পাওয়াটা আর হয় নি। যখন তোমাকে পেলাম তুমি তখন অলরেডি আমার স্টুডেন্ট। মানুষের মনটা বড্ড বেশি চঞ্চল, না পাওয়া জিনিসের প্রতি আকর্ষণ তাদের মারাত্নক। ঠিক তেমন তোমার প্রতি আমার ভালোলাগা এট্রাকশনটা দিন দিন বাড়তে বাড়তে মোহের রুপ নিয়েছে। এখন যদি তুমি এটাকে ভালোবাসা বলো তবে তাই।

মাথা নিচু করে স্নিগ্ধ এর কথাগুলো শুনছিলো নীতি। কি বলা উচিত ভেবে পাচ্ছিলো না। মেয়েদের চোখে নাকি কিছুই এড়ায় না। নীতি পাত্তা না দিলেও প্রথম দিন থেকেই স্নিগ্ধ এর চোখে তার প্রতি আকর্ষণ দেখতে পেয়েছে সে। আজ এভাবে সোজাসাপটা কথায় যেনো আরো দ্বিধার মাঝে পরে গেছে নীতি। নীতির নিস্তব্ধতা স্নিগ্ধ এর একদম ভালো লাগছে না। নীতির মস্তিষ্ক কিংবা মন নিজের আয়ত্তে সম্পূর্ণ আনতে এখনো সময় লাগবে। মানুষের মনের উপর নিজের কতৃত্ব ফলাতে হলে ধীরে ধীরে সেটাকে নিয়ের আয়ত্তে আনতে হয়। মন দূর্বল হলেও মস্তিষ্ক তখন যুক্তি দাড় করায়। সেই যুক্তির দেয়াল ভাঙ্গতে গেলে মনকে বশীকরণ প্রয়োজন। নীতির মন এখনো তার বশে আসে নি, শুধু দূর্বল হয়েছে কেবল। এবার আর প্রতিবারের মতো তাড়াহুড়ো করবে না স্নিগ্ধ। ধীরে ধীরে নীতিকে নিজে আয়ত্তে আনবে। মুখে হাসির রেখা টেনে কোমল কন্ঠে স্নিগ্ধ বলতে লাগলো,
– জরুরি নয় আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে তোমাকেও আমায় ভালোবাসতে হবে। আমি না হয় তোমার বন্ধু হয়েই থাকলাম। তুমি সময় নেও।

বলেই পানিতে দৃষ্টি তাক করলো স্নিগ্ধ। নীতি এখনো নিজের সংশয় দূর করতে পারছে না। এটা ঠিক যে স্নিগ্ধ এর প্রতি এক রকম ভালোলাগা কাজ করছে তার। তবে সেটাকে ভালোবাসার নাম দিলে নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। উফফ আর ভাবতে পারছে না। অনুভূতিগুলোর দাবানলের মাঝে বেশ ঘেটে ঘ হয়ে গেছে নীতি। বুক থেকে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো নীতির। স্নিগ্ধ নিপুণ দৃষ্টিতে নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। এবার খেলার গতি আরো বাড়াতে হবে। গন্তব্য সদূরে না হলেও খুব কাছেও নয়। খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে নীতির অগোচরে, সূক্ষ্ণভাবে সকল কাজ করতে হবে তাকে। ধীরে ধীরে নীতির সকল সুতো তার হাতে চলে আসবে। তখন তার হাতের মুঠোয় থাকবে নীতি। নিজের খাচায় রেখে দিবে তার বাবুইপাখিকে। কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তার মোহকে।
– হাসছেন যে, নিজে তো বেশ সোজা সাপটা কথা বলে দিলেন, মাঝে আমার মাথায় ঝট পাকিয়ে দিলেন। এখন হেসে যাচ্ছেন।

নীতির কথায় নিজের সাজানো মস্তিষ্ক থেকে বের হয় স্নিগ্ধ। মেয়েটি ডাগর ডাগর চোখে তার দিকে তালিয়ে আছে। খুব ভালো লাগে এই চোখ জোড়া স্নিগ্ধ এর। ইচ্ছে করে সারাদিন দেখতেই থাকতে। যেদিন নিজের প্রাসাদে নিয়ে যাবে তখন পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবে তাকে। মেয়েটাকে কেনো এতো ভালো লাগে নিজেও জানে না স্নিগ্ধ। মুচকি হাসি হেসে বললো,
– এভাবে নাক ফুলিয়ে থেকো না। খুপ করে খেয়ে নিবো

স্নিগ্ধ এর কথা শুনে চোখ সরিয়ে নিলো নীতি। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। লোকটার মুখে কি কিছুই বাধে না। ব্যাগটা কাধে নিয়ে উঠতে গেলেই স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করে,
– কোথায় যাচ্ছো?
– ওমা বাড়ি যাবো না?
– একা যাবা? সন্ধ্যা হয়ে আসছে?
– আপনার সময় আছে? মাষ্টার মানুষ বলে কথা
– তোমার জন্য আমার সময় অহরহ
– হাহা

নীতি খিলখিল করে হেসে উঠেছে। স্নিগ্ধ মোহ চোখে দেখে যাচ্ছে তাকে। কি অদ্ভুত লাগছে তার বাবুইপাখিকে।
” নারী কে জাদু করিলে গো যতই দেখি ততই আরো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে”

মনে মনে কথাগুলো বলেই হাসিটা আরো প্রসস্থ হলো স্নিগ্ধ এর।

রাত ৮টা,
কেসটা যত ইজি ভেবেছিলো ততই পেছাচ্ছে। হাবীব মাথায় হাত দিয়ে বসে আসে। খুন হয়েছে অথচ খুনি যেনো হাওয়া হয়ে গেছে। ছেলে দুটোকে একই সময় খুন করা হয়েছে। অথচ কেনো যেনো মনে হচ্ছে দুটো খুন আলাদা আলাদা মানুষ করেছে। খুনের পদ্ধতি আলাদা। বুকে ছোড়া যখন মারা হয়েছে সেটা হাইট টা ভিন্ন। একজন খুন করার পর টর্চার করেছে মরার আগ অবধি তো। আরেকজন টর্চার করতে করতে খুন করেছে। অবাক ব্যাপার দুটো খুনের জায়গাতেই নীতির ব্লাড স্যাম্পল পাওয়া গেছে। কিছুতেই যেনো হিসেব মিলাতে পারছে না হাবীব। অবাককর ব্যাপার এইটা যে, নীতি তখন স্নিগ্ধ এর সাথে ছিলো। এবার শুরু থেকেই কেস টা নিয়ে ভাবতে হবে হাবীবকে। নতুন করে যদি কোনো সুত্র খুজে পাওয়া যায়। স্নিগ্ধ লোকটাকে কেনো জানি না সুবিধার মনে হচ্ছে না হাবীবের। এর কি কোনো সম্পর্ক আছে এই খুন গুলোর সাথে!! একজন টিচার কেনো খুন করতে যাবে? উফফ আর ভাবতে পারছে না হাবীব।

রাত ১১টা,
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নির্ভীক। কেনো যেনো বিরক্ত লাগছে খুব। মনটা অশান্ত। নীতিকে স্নিগ্ধ এর গাড়িতে উঠতে দেখে বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছু করতেও পারছে না। নীতিকে তখন যা তা বলাটা ঠিক হয় নি। নীতি কষ্ট পেয়েছে এটা বুঝা যাচ্ছিলো। একবার চেয়েছিলো ক্ষমা চাইবে কিন্তু কি মনে করে সেটা চাওয়া হয় নি। এখন মনটা বেশ অসুস্থ অসুস্থ লাগছে। আগে কখনোই নীতির সাথে এমন ঝামেলা হয় নি। কেনো যেনো মনে নীতি তার থেকে বেশ দূরে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা সে কি নীতিকে হারিয়ে ফেলবে!!

অপরদিকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো নীতি। স্নিগ্ধ এর কথা গুলো যেনো মাথায় ঘুরছে। লজ্জাও লাগছে। কেনো লাগছে সেটা জানা নেই। তবুও লজ্জা লাগছে। এক মনোযোগে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে কিছু একটা চোখে পড়লো নীতির। অনেক খেয়াল করে দেখলে যা নজরে পড়লো…….

চলবে