কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব-২+৩

0
216

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_02
#Writer_NOVA

লম্বা লম্বা পা ফেলে উপরের কামরায় চলে এলো ফুল। শুভ তখনও পুরো রুম ওলট-পালট করে ফেলেছে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটার জন্য। ফুলের বেশ রাগ হলো৷ এই মানুষটার লাজলজ্জা বলতে কিছু নেই। নয়তো নিজের গোপনীয় জিনিসকে কেউ মাইকের মতো হাঁক-ডাক ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে। মনে মনে বললো, লোকটা আস্ত একটা খাটাশ। মানুষের পর্যায় পরে না।

‘কি হয়েছে এমন ষাঁড়ের মতো চেচাচ্ছো কেনো?’

‘তোর নানীর হা’ঙ্গা লাগছে তাই।’

‘ছিঃ তোমার মুখের কি ভাষা শুভ ভাই! তোমার আচার-ব্যবহার, কথা বলার ধরনে ছাতকুরা পরছে। এমন এমন কথা বলো যে রাগ উঠয়ি দাও। আক্কেল বুদ্ধি কি মাথা থেকে গলে পরেছে? সাবধান করে দিচ্ছি আমার নানীকে নিয়ে কিচ্ছু বলবে না।’

‘একশবার কমু। তুই জলদী আমার আন্ডারওয়্যারটা খুঁইজা দে। আমার দেরী হইয়া যাইতাছে।’

‘এমন করে বলছো যেনো তোমার ঐ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা আমি পরে বসে আছি।’

শুভ চেয়ারের জামাকাপড় ভুড়ের থেকে শার্ট বের করে পরতে পরতে বললো,

‘বসে থাকবি কেন দাড়ায় আছিস তো।’

‘ছিঃ বেশরম! মুখে কিছু আটকায় না।’

মুখ ভোঁতা করে ফুল চলে যাওয়ার পথ ধরলো ফুল।শুভ পেছন থেকে ডাকলো,

‘আরে আরে কোথায় যাস? খুঁজে দিয়ে যা।’

‘পারবো না। তোমারটা তুমি খুঁজে নাও।’

নাক ফুলিয়ে বললো ফুল। পেছন থেকে হু হা করে হাসির শব্দ পেয়ে একবার দাঁত কটমট করে তাকিয়ে প্রস্থান করলো সে।

মাটির উনুনের পাশে বসে রান্না করছে ফুল। মোটামুটি সব কাজ সে পারে। তবুও চাচীর কাছে সময়ে-অসময়ে কথা শুনতে হয়। সময়তে চুপ থাকে তো সময় তে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দেয়। আনোয়ার সর্দার ভাতিজিকে ভীষণ ভালোবাসে। আর শুভ সে তো সুযোগ পেলেই ফুলের সাথে লাগবে। তবে ফুলের সবদিকে তার তীক্ষ্ণ নজর থাকে। মাঝে মধ্যে বাড়ির জন্য মন কাঁদে ফুলের। কিন্তু তার বাবা বলেছে আরো কিছু মাস এখানে থাকতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তবেই নিয়ে যাবে তাকে৷ ছোট ভাই-বোনদের জন্য রাতের আঁধারে ডুকরে কেঁদে উঠে। জ্বলন্ত আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে কতকি ভাবছিলো ফুল। হঠাৎ দাদীর গলা পেলো।

‘ঐ ছেমড়ি হা কইরা কি দেহস? লাড়কি ঠেলা দে। একটা কামও করতে পারে না। সব কাম দেহায় দিতে হয়। মায় শিগাইছে কি? পারোস খালি মায়ের মতো বড় ঘরের পোলা পটাইতে।’

বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পরেছে সুফিয়া বিবি। তবুও রোগ-বালাই তাকে ধরতে পারেনি। এখনো লাঠিতে ভর করে টুকটুক করে সারা বাসায় হাটে। সবকিছু তার নখদর্পনে থাকা চাই। আগাগোড়া সবদিকে নজর তার। এখনও পরিবারের সবাই তাকে কম-বেশি মান্য করে। শুধু শুভ, ফুল তাকে এক প্রকার সহ্য করতে পারে না। কুটনামির করার কারণে।

ঝুমুর ছোট টেপের পানিতে ঝাঝড়ি দিয়ে ভাজি ধুচ্ছিলো। একবার সুফিয়া বিবির দিকে তাকিয়ে মুখ বাকালো। তারও ইচ্ছে করছিলো বুড়িকে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে বাড়ির কাজের মেয়ে বলে সাহস পায় না। তবে সোহেলী বেগম ও সুফিয়া বিবিকে দেখলে তার রাগে পিত্তি জ্বলে যায়। বিশেষ করে যখন তারা দুজন মিলে ফুলকে অপমান করে তখন।

লাঠি দিয়ে খোঁচা মেরে ফের জিজ্ঞেস করলো,
‘ঐ ছেমরি কি কই হুনোস না? ভালো কইরা কথা কইলে হুনবো না। যহন ধাওয়ানি দিমু তহন ভালো লাগবো।লাড়কি ঠেলা দে।’

ফুল ঠান্ডা দৃষ্টিতে দাদীর দিকে তাকালো। তাতে সুফিয়া বিবির কোন হেলদোল দেখা দিলো না। দন্তহীন মাড়িতে পান চিবুতে লাগলো। ফুল উঠে রান্নাঘরের বাইরে যেতে যেতে বললো,

‘এতই যখন কাজের তাড়া তাহলে নিজেই করুন। আমি পারবো না। যদি মন চায় নিজে বসে বসে জ্বাল করুন।’

তিরিক্ষি মেজাজে কথাগুলো বলে নিজের রুমের পথ ধরলো। উঠোনের মাঝে সোহেলী বেগমের সাথে দেখা হলেও সে কথা বললো না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।

‘হে কতবড় সাহস, আমারে কয় চুলার জ্বাল ঠেলা দিতে। কিছু কই না দেইখা ও খালি বাড়তাছে। আমার বাড়িত থাইকা আমারে কামের হুকুম করে।’

‘কি হইছে আম্মা?’

‘কি হইবো আবার? ফকিন্নির নাতনীরে ঘরে তুলছি না। আর কি হইবো?’

ঝুমুর মুখ টিপে হেসে চেচিয়ে বললো,
‘আল্লাহ, দাদী আপনে ফকিন্নি?

‘আমি ফকিন্নি হমু কেন? খান বংশের মাইয়া আমি।’

‘ফুল তো আপনেরি নাতনী। তাইলে কি দাড়াইলো?’

হাতে থাকা লাঠি উঁচিয়ে রাগী গলায় সুফিয়া বিবি বললেন,

‘ঐ ছেমরির লগে থাকতে থাকতে তোরও মুখের খই ফুটছে দেহি।’

সোহেলী বেগম চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠলো,
‘চুপ কর। নিজের কামে মন দে। যদি আজকে ভাজিতে বালি কিচকিচ করে তাইলে তোরে ভাজি করমু।’

বিকালের তপ্ত আলোয় পুরো গ্রামটাকে অপরূপ লাগে। শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশটা ফুলকে ভীষণ কাছে টানে। প্রতি বিকালে তার বের হওয়া চাই। কখনো ময়নার সাথে বসে পুকুর ঘাটে গল্প জমায় নয়তো কখনো একা একা এদিক সেদিক হেঁটে বেড়ায়। আজও চুল আঁচড়ে বাইরে যাওয়ার পথ ধরলো ফুল।

আজকে তেমন কাজ নেই আনোয়ার সর্দারের। যা আছে শাগরেদরা সামলে নিতে পারবে। সামনের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে বই নিয়ে বসেছেন। অবসর সময়ে বই পড়া তার নেশা। ফুল তখন বেণী নাচিয়ে নাচিয়ে সেদিকে আসছিলো। দেখেই কাছে ডাকলেন।

‘ফুল মা এদিকে আয়।’

‘কিছু লাগবে চাচা?’

‘না, আমার কাছে বয়।’

পাশের টুলটাকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো আনোয়ার সর্দার। ফুল ভদ্র মেয়ের মতো বসে উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু বলবেন?’

‘তোরে দেখলে দিলডা শান্তি লাগে। মনে হয় নিজের ভাইডারে দেখতাছি। তুই একটু পাশে বইয়া থাক। আমি তোরে দুই চোখ ভইরা দেখি।’

‘বই পড়বেন না?’

‘না, ভালো লাগতাছে না।’

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আনোয়ার সর্দার। ফুল নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। ঠিক বসে নেই। চাচার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। চাচার শরীর থেকে বাবার শরীরের মতো ঘ্রাণ আসছে। এটাই বোধহয় আপন রক্তের ঘ্রাণ। নিজের মাথাটা অনেকটা পাতলা লাগছে ফুলের। কতদিন ধরে বাবার স্পর্শ পায় না সে। প্রায় সময় সে ঘুমিয়ে থাকলে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে যেতো তার বাবা। ঘুমের ঘোরেও সে টের পেতো।

‘বাড়ির লিগা অনেক খারাপ লাগে না?’

‘এতটুকু তো লাগবেই চাচা।’

‘চিন্তা করোস কেন? তোর চাচা আছে না?’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি চাচা?’

হাত বুলানো থামিয়ে নড়েচড়ে বসে বললো,
‘হুম কর।’

‘আপনি গ্রামের চেয়ারম্যান। লেখাপড়া জানেন। তবুও এভাবে কথা বলেন কেন?’

আনোয়ার সর্দার বইয়ের পাতা উল্টে সযত্নে বন্ধ করে দিলো। মুচকি হেসে ফুলের দিকে তাকালো। ওর চোখে উত্তরটা জানার আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে।

‘আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যেই শান্তি পাওয়া যায় তা শুদ্ধ ভাষায় নাই। আমার ভাল্লাগে নিজের গ্রাম্য ভাষায় কথা বলতে। এমনে কথা কইলে মনে হয় খেতের কৃষক, নদীর জেলে, কামার-কুমোর সব আমরা একি সমান। নিজে গো মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। একই গাঁয়ের সন্তান আমরা। বিভেদ কেন করমু?’

বিকেলে বাইরে যাওয়া হলো না ফুলের। সামনের বারান্দায় বসে চাচার সাথে ঘন্টাখানেক গল্প করলো। মাঝে চা বানিয়ে আনলো ফুল। চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে একদফা হাসিঠাট্টা হয়ে গেলো। তখন সোহেলী বেগম ও সুফিয়া বিবি দুজনো ভাতঘুম দিয়েছেন। নয়তো আবার এক পশলা খিটমিট করতো।

হাঁস, মুরগী আটকে কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুলো ফুল। মাগরীবের আজান দিয়ে দিবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো ধীরে ধীরে আধার নামছে৷ ওজু সেরে নিলো। নিজের কামরার দিকে পথ ধরতেই স্টিলের সদর দরজাটা বারি পরলো। এই ভরসন্ধ্যায় কে এলো তা বুঝলো না ফুল। তার সাহসে কুলাচ্ছে না একা গিয়ে দরজা খুলতে।গতবার এভাবেই ভরসন্ধ্যা বেলা মকবুল মেম্বারের বাড়ি ডাকাতি হয়েছিলো। একা মেম্বারের বউ দরজা খুলে দিতেই বেশ মেরেছিলো। ঝুমুরের মুখে বহুবার শুনেছে সেই গল্প। তারপর থেকে সে ভরসন্ধ্যা বেলা কিংবা রাতের বেলা একা দরজা খুলতে আসে না। গলা ছেড়ে ঝুমুরকে ডাকলো,

‘ঝুমুর আপা, এই ঝুমুর আপা! দেখে যাও তো কে এসেছে?’

ঝুমুরে সাড়াশব্দ নেই। এদিকে দরজায় একের পর এক কষাঘাত পরছে৷ বুকে থুথু দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভীরু পায়ে সামনে এগুলো ফুল। আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে দরজা খুললো। দরজা খুলে হতভম্ব। শুভ এক হাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলকে দেখে ধমকে উঠলো,

‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?’

টলতে টলতে ভেতরে ঢুকলো। ফুল ভালো করে শুভর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে তোমার? আজ এতো জলদী ফিরলে যে?তোমার নাক-মুখ লাল কেনো শুভ ভাই? তুমি কি আজও মা’রামা’রি করে এসেছো?

#চলবে

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_03
#Writer_NOVA

‘কি হয়েছে তোমার? আজ এতো জলদী ফিরলে যে?তোমার নাক-মুখ লাল কেনো শুভ ভাই? তুমি কি আজও মা’রামা’রি করে এসেছো?

শুভ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। বিপদাপন্ন হরিণ শাবক যেমন একটু সাহায্যের আশায় চোখ তুলে তাকায়। শুভর দৃষ্টি ফুলের কাছে তেমন ঠেকলো। এগিয়ে এসে পায়ের পাতা উঁচু করে শুভর সামনে দাড়ালো। শুভর থেকে উচ্চতায় বেশ খাটো সে। ফুলের এহেন কান্ডে শুভর ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। ফুল কপালে হাত রাখতেই আৎকে উঠলো।

‘শুভ ভাই, তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।’

শুভ তাচ্ছিল্যের সুর টেনে বললো,
‘তাতে তোর কি? আমারে নিয়া আদিখ্যেতা দেখাবি না। কারোর যহন আমারে নিয়া চিন্তা নাই তোরও করতে হইবো না। সামনের থিকা সর। আমি ভিতরে যামু।’

‘এভাবে কথা বলছো কেনো?’

‘আমি চোখ মেইলা চাইতে (তাকাতে) পারতাছি না কইতরির মা। কথা কইয়া মেজাজ গরম করিস না।’

‘আমি ধরে নিয়ে যাই আসো।’

ফুল এগিয়ে এসে শুভর হাত ধরতে নিলে শুভ ঝাটকা মেরে দূরে সরে গেলো। ফুল এবার অবাক হলো। শুভ তো কখনো এমন করে না। হঠাৎ হলো কি? তারপর ভাবলো জ্বরের ঘোরে মাথা ঠিক নেই। শুভ টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে নিয়ে ধপ করে পরে গেলো। ফুল কিছুটা কড়া গলায় বললো,

‘কি হাঁটতে পারছো? দুই কদম দিতেই পরে গেলে। খামোখা জিদ দেখাচ্ছো।’

নিজের কাঁধে শুভর হাত তুলে ধীর পায়ে এগুতে লাগলো ফুল৷ শুভ কয়েকবার নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে পারলো না। জ্বরে শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। নয়তো পুঁচকে ফুল ঝাড়া দিয়ে ফেলতে তার দুই মিনিট লাগতো না। শুভ হার মেনে ফুলের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা ধরলো। মাগরিবের আজান হচ্ছে। এক হাতে কোনরকম মাথায় ওড়না টেনে হাঁক ছেড়ে সবাইকে ডাকতে আরম্ভ করলো।

‘চাচী, ঝুমুর আপা, দাদী! কোথায় তোমরা জলদী এদিকে আসো।’

এই নিয়ে বড় তিন বালতি পানি শুভর মাথায় ঢালা হয়ে গেছে। কিন্তু জ্বর কমার লক্ষ্মণ নেই। এতক্ষণ ফুল মাথায় পানি ঢাললেও এখন ঝুমুর ঢালছে৷ শুভর শিউরের পাশে বসে তবজী জপছেন সুফিয়া বিবি। সোহলী বেগম মাঝে মাঝে ছেলের মুখ মুছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের চোখ মুছছেন। ফুল দূর থেকে শুভর কাঁপা কাঁপা শরীরের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। দুটো লেপ দেওয়ার পরেও শুভ প্রচন্ড পরিমাণে কাঁপছে। আনোয়ার সর্দারকে খবর পাঠানো হয়েছে। মগরিবের আগে সে বেড়িয়েছিলো। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। শুভর কামরায় এসেই রুষ্ট গলায় বললো,

‘কতবার কইছি দিনকাল ভালা না। এহন একটু বাইছা বাইছা চল। কিন্তু আমার কথা কি হুনে? কিইন্না দিছি একটা বটবটি হেইডা নিয়া সারা গেরাম চক্কর মারে। ভাদ্দর মাসের দিন কি ভালো? এহন যদি একটা কিছু হইয়া যায়?’

সোহেলী বেগম এগিয়ে এসে স্বামীর বাহুতে হাত রেখে নরম গলায় বললো,

‘আল্লাহর দোহাই লাগি চুপ করেন। পোলাডা অসুস্থ। এর মধ্যে কি শুরু করলেন? রোগ-বালাই কি কাউরে কইয়া আহে?’

‘তোমার পোলায় দাওয়াত দিয়া আইলে কি না আইবো? রাইত নাই, দিন নাই সারাক্ষণ বাইরে থাকবো। আমার কথা হুনলে কি এই অবস্থা হয়?’

‘আপনি কি মানুষ নূরজাহানের বাপ? আপনের পোলায় অসুস্থ। এর মধ্যে বকাবাজি শুরু করছেন। একটু রহম করেন। এসব রাইখা ডাক্তার ডাকেন।’

‘কোনকিছু ডাকমু না আমি। আজাইরা বইয়া বইয়া খাইয়া কয়দিন পরপর অসুখ ডাইকা আনবো৷ আমি সব হালায় থুইয়া হের সেবা-যত্ন করমু। এতো ঠেকা পরে নাই।’

সুফিয়া বিবি হাতের তবজি রেখে ছেলেকে বললো,
‘কথা কইস না বাপ। কেমনে কাঁপুনি দিতাছে দেখ। ভাদ্দর মাসের জ্বর ভালা না। আল্লাহ না করুক যদি কিছু হইয়া যায় তহন পোলা পাবি কই?’

‘ওর মতো পোলার দরকার নাই আমার। বাঁইচা থাকলে আমার মান-সম্মান, নাম সব ডুবাইবো। হের থিকা মইরা যাওন ভালো।’

স্বামীর কথায় আৎকে উঠলো সোহলী বেগম।
‘আল্লাহ গো! কি কন এসব? চুপ করেন।’

সবার নজর এখন আনোয়ার সর্দারের দিকে। যার মুখটা কঠিন আস্তরণে ঢাকা পরেছে। কেউ যদি শুভর দিকে তাকাতো তাহলে হয়তো দেখতে পেতো তার পাষাণ্ড চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরেছে অবহেলা ও অনাদরের দরুন।

‘কিরে ঝুমুর তুই হা কইরা কি দেহস? মাথায় পানি দে।’

সুফিয়া বিবির ধমকে হুশ ফিরলো ঝুমুরের। হাত চালিয়ে শুভর মাথায় মগ দিয়ে পানি ঢালতে লাগলো। ফুল ধীর পায়ে চাচার দিকে এগিয়ে এলো। মুখোমুখি হয়ে অনুনয়ের সুরে বললো,

‘চাচা, শুভ ভাইয়ের শরীরের অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। এখন রাগ, গোস্বা করার সময় নয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খবর দাও। সেখানকার ডাক্তার ডাকো। আমার ভয় করছে। তুমি দয়া করে এই সময় অন্য সবকিছু ভুলে ছেলের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করো।’

ফুলের কথা ফেললেন না আনোয়ার সর্দার। দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে কাকে যেনো গলা ছেড়ে ডাকলো। নিচ থেকে প্রায় ছুটে এলো রমিজ মিয়া।

‘জলদী কইরা ডাক্তার ডাইকা লইয়া আয়। দেরী জানি না হয়।’

ডাক্তার এসে কিছু ঔষধপত্র লিখে দিলো।জানালো ভয়ের কিছু নেই। পাশাপাশি তাকে বিশ্রাম নিতে বলে গেলো। ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চলে গেলো। ঝুমুর রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে। সুফিয়া বিবি, সোহেলী বেগম চলে গেলেন এশারের নামাজ পরতে। ফুল শুভর পাশে বসে আছে।ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়েছে। তবে চোখ, মুখ লাল হয়ে রয়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুভকে পর্যবেক্ষণ করছে৷ হুট করে শুভ চোখ মেলে তাকিয়ে অসুস্থ গলায় বললো,

‘আমি ম’রে গেলে সবার লিগা ভালো হয় তাই না রে কইতরির মা? আমার ওপর সবাই বিরক্ত।’

ধমকে উঠলো ফুল।
‘আজাইরা কথা বলো না।’

‘বিশ্বাস কর মাঝে মধ্যে নিজেরে শেষ কইরা দিতে মন চায়। কিন্তু পারি না।’

‘চাচার কথায় কষ্ট পেয়ো না শুভ ভাই। সে তোমাকে অনেক ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ করে না। বাবার ভালোবাসা এমনি।’

‘আর ভালোবাসা!’

শুভর কথায় স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের সুর ছিলো। সাথে এক আকাশ দুঃখ ও কষ্টের আভাস। ফুল এখন শুভকে কি সান্ত্বনার বাণী দিবে তা জানে না। তাই চুপ হয়ে গেলো। শুভ আকুতিভরা কন্ঠে বললো,

‘আমার চুলগুলো একটু নেড়ে দিবি ফুল?’

ফুল স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুভ কখনো তাকে নাম ধরে ডাকে না। হঠাৎ নাম ধরে অনুনয় করায় সে ভড়কে গেছে। তবে মানা করলো না। শুভর মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো হালকা করে টেনে দিতে লাগলো। আচানক শুভ ফুলের কোলে মাথা তুলে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ফুল। ইচ্ছে করতেছে তোরে জড়ায় ধইরা কানতে। আমি যদি এহন দাঁড়ানোর শক্তি পাইতাম তাইলে তোরে শক্ত কইরা জড়ায় ধইরা ইচ্ছামতো কানতাম।’

মনে কতটা কষ্ট থাকলে কেউ এভাবে বলতে পারে তা ফুলের জানা নেই। তবে ফুল এতটুকু বুঝতে পারছে শুভর মনে অনেক বড় চাপা দুঃখের পাহাড় আছে। যা সে একা বয়ে বেড়াচ্ছে। ফুলের ইচ্ছে করছিলো শুভর কাছ থেকে ছিটকে সরে যেতে। কিন্তু পারলো না। কারণ আচমকা শুভর শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল বুঝতে পারলো শুভ সব জ্বরের ঘোরে বলছে। তবে তার কপালে চিন্তার ভাজ পরলো। ঔষধ খাওয়ার পর তো জ্বর কমে গিয়েছিলো হঠাৎ আবার বাড়ছে কেনো?

ঘুলঘুলি দিয়ে সকালের রোদ আছড়ে পরছে। ফুলের মুখে তারা এসে লুকোচুরি খেলছে। মিষ্টি রোদের আলোয় ফুলের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো। ধরফরিয়ে উঠে জিভে কামড় দিয়ে ফেললো। সকালে ফজরের নামাজ বাদ পরে গেছে। সারারাত জেগে এতোটা ক্লান্ত ছিলো যে আজান শুনতে পায়নি। দ্রুত উঠে শুভর কামরায় গেলো। শুভ ঘুমাচ্ছে দেখে দেরী করলো না। নিচে চলে গেলো। এখনো কেউ উঠেনি। ঝুমুর কলপাড়ে চাল ধুচ্ছে। ফুল খোঁয়াড় থেকে হাস, মুরগী ছেড়ে দিয়ে খাবার দিলো। হাতের তালুতে ছাইয়ের মাজন দনিয়ে দাত ডলতে ডলতে কলপাড়ে এলো।

‘বাসার কেউ উঠেনি?’

‘সারা রাইত সব জাইগা থাকলে উঠবো কেমনে?’

‘তুমি উঠলে কিভাবে?’

‘আমি মাইনসের বাড়ি কাম করি। আমার কি বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমানোর সময় আছে?’

‘তোমার চোখ ফোলা দেখা যাচ্ছে। রাতে ঘুমাতে পারোনি। এগুলো রেখে ঘন্টা খানিক ঘুমিয়ে নাও। নয়তো শরীর খারাপ করবে।’

‘করলেও কিছু করার নাই।’

‘তুমি যাও। সকালের খাবার আমি রান্না করে নিবোনি।’

চাল ধোয়া রেখে ঝুমুর চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি একলা পারবা না। আমার অভ্যাস আছে। সারাদিন কাম করতে পারমু।’

‘বেশি কথা বলো না তো ঝুমুর আপা।’

‘তুমি এতো তাড়াতাড়ি উঠলা কেন?’

‘আলোতে আমার ঘুম আসে না। ঘুলঘুলি দিয়ে রোদ এসে চোখে লেগেছে। তাই উঠে পরেছি। খারাপ লাগছে জানো৷ সকালের নামাজটা পরতে পারিনি।’

মন খারাপ করে বললো ফুল। ঝুমুর হালকা হেসে বললো,

‘কাজা পইরা নিও।’

‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তুমি এবার যাও তো।’

জোরজবরদস্তি করে ঝুমুরকে পাঠিয়ে দিলো ফুল। সেও মানুষ, তারও ক্লান্ত লাগে। এটা মানুষ বুঝে না। কাজের মানুষদের যেনো কোন খারাপ লাগা থাকতে নেই। ফুল ঝুমুরকে নিজের বোনের চোখে দেখে। তাই ওর প্রতি আলাদা টান তার। চাল ধুয়ে উনুনের ওপর রেখে কোমড়ে ওড়না গুঁজে সামনের উঠোন ঝাঁট দিতে লেগে পরলো। কিছু সময় পর বাইরের থেকে কেউ জোরে হাঁক ডেকে বললো,

‘চেয়ারম্যান সাব বাড়িতে আছেন নি?’

ফুল শলার ঝাড়ু ফেলে দরজা খুলে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলো,

‘কে?’

‘আমি ডাকবক্সের থিকা আইছিলাম।’

‘ডাকপিয়ন?’

‘হো, চেয়ারম্যান সাবের একটা চিঠি আইছে।’

‘কে পাঠিয়েছে?’

‘হের বড় পোলায়।’

কাছেই বড় মোরগটা কুকুরকুক করে চেচিয়ে উঠলো। যার কারণে ডাকপিয়নের কথাটা ফুলের কর্ণগোচর হলো না। বিরক্তিতে এক হাতে কান চেপে ধরে আরেক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘জ্বি, আমার কাছে দিন।’

‘আপনে কেডা?’

‘চেয়ারম্যানের ভাতিজী।’

‘ওহ ভাস্তি!’

‘জ্বী।’

একটা হলুদ খামের চিঠি এগিয়ে দিলো ফুলের দিকে। হাতের একটা ছোট কাগজ ও কলম দিয়ে বললো,

‘এইহানে একটা সই কইরা দিয়েন।’

ফুল সই করে কাগজ, কলম ডাকপিয়নের দিকে বাড়িয়ে দিলো। লোকটি চলে যেতেই হাতের চিঠির দিকে তাকিয়ে প্রেরকের নাম দেখে থমকে গেলো। কাঁপা গলায় উচ্চারণ করলো,

‘অ অ অভি সর্দার!’

#চলবে