কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব-৪+৫

0
180

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_04
#Writer_NOVA

গোটা দুদিন ধরে ছোট ভাই জ্বরে পরে আছে শুনে দেরী করেনি নূরজাহান। স্বামী মিলনকে সাথে নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিয়েছে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসার পর থেকে শুভর শিউরে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। বার কয়েক শুভ ধমক দেওয়ার পরেও কাজে দেয়নি। বউয়ের কান্নায় বিরক্ত মিলনও। তবে বিরক্তি প্রকাশ করতে পারছে না। তাহলে নূরজাহানের রোষানলে পরতে হবে।

‘তুই আমার সামনের থিকা কি যাবি? ভালো চাইলে সর নূরজাহান। আমার মাথা ধরায় ফেলতাছোস। মনে হয় আমি ম’ইরা গেছি। আরে ছেমরি এহনো বাঁইচা আছি। ম’রলে কান্দিস।’

‘চুপ কর। খালি আজাইরা কথা তোর। দুই দিন ধইরা জ্বরে পইরা রইছোত। আমি খবর পাই ভোরে। আমারে কেউ কওনের দরকার মনে করে না। বিয়া দিয়া পর কইরা দিছে।’

বউয়ের কথা শুনে মিলন মুখ ম্লান করে ফেললো। স্ত্রী যে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছে তার কোন সন্দেহ নেই। একটু নড়েচড়ে বসলো সে। এখন কথা বলা মানেই বউয়ের তোপের মুখে পরা। হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ালো। ততক্ষণে শুভ আরেকদফা ধোলাই দিয়ে ফেলেছে নূরজাহানকে।

‘ম’রা কান্দন আমার সামনে দেহাইস না। দুদিন পর মাথাডারে খাড়া করতে পারছি। আমার মনে হইতাছে তোর চিল্লাচিল্লিতে আবারো ভেটকি মাছের মতো চিত কাইত হইয়া পইরা থাকমু।’

‘এমনে কথা কস কেন? আমি কি নিজের লিগা কানতাছি?তোর লিগাই তো কানতাছি। আমার ভাইয়ের শরীর খারাপ হইছে তার লিগা আমি দুক্কে কি কানতেও পারমু না?’

‘পারবি না কেন? তোরা কানলে আমি ভালো হইয়া যামু তো। যা গিয়া বাড়িসুদ্ধ সব মাইনসেরে ডাইকা নিয়া আয়। একসাথে গলা ছাইরা কানবি।’

শুভর কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো মিলন। নূরজাহান চোখ লাল করে তাকাতেই মিলন বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। দ্রুত মাথা নিচু করে রাখলো। তবে এখনো মুখ টিপে হাসছে সে। মেজাজ তুঙ্গে উঠছে শুভর। জ্বরের কারণে মুখ চিরতা পাতার রসের মতো তিতা হয়ে আছে। এর মধ্যে কানের সামনে মাছির মতো ভনভন করছে নূরজাহান। ভাঙা গলায় ফুলকে ডাকলো। শুভর এই মিনমিনে স্বরের ডাক ফুলের কানে পৌঁছালো না।

‘এহন কেমন লাগে শালাবাবু?’

‘এতক্ষণ ভালোই আছিলাম। কিন্তু এহন আপনার বউয়ের জ্বালায় মাথা ধরছে। ওরে একটু এইহান থিকা নিয়া যান তো। কহন জানি থা’প্পড় দিয়া থোঁতা ব্রেক কইরা দেই।’

মিলন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,

‘নুরু চলো এইহান থিকা। আম্মার লগে দেহা কইরা আহো।’

নূরজাহান ধমকে উঠলো।
‘তুমি চুপ থাকো।’

‘কেন দুলাভাই চুপ থাকবো কেন? তুই আমার কানের সামনে বইয়া বইয়া কানবি আর আমি হেইডা সহ্য করমু।’

‘এমন করোস কেন ভাই? তোরে আমি কত ভালোবাসি। তুই বুঝোস না।’

‘তোর ভালোবাসা পান-চুনের লগে মোড়াইয়া খাইয়া ফেলগা যা।’

ভাইয়ের তিরিক্ষি মেজাজে কথা শুনে নূরজাহান এবার চুপ করলো। শুভর রাগ উঠলে সত্যি যদি থাপ্পড়-টাপ্পড় মেরে বসে। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই।

মিনিট চার পর ফুল ট্রে হাতে কামারার ভেতর ঢুকলো। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে খাটের ওপর ট্রে রাখলো। দুই কাপ চা, এক পিরিচে বেকারি থেকে আনা ঘিয়েভাজা টোস্ট বিস্কুট, আরেক পিরিচ ভর্তি নিমকি। চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান মুখটাকে চৌদ্দ রকম করে চায়ের কাপ ধরলো। মায়ের মতো সেও ফুলকে দেখতে পারে না। বাসায় এলে শুধু কথা শোনানোর কারণ খুঁজে। আরেক কাপ চা মিলনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। সবার অলক্ষ্যে মিলন খোপ করে ফুলের হাত ধরতে চাইলে ফুল কিছুটা পিছিয়ে যাওয়ায় ধরতে পারলো না। ফুল সাবধানী ভঙ্গিতে সরে গেলো। চোখ তুলে মিলনের দিকে তাকাতেই দেখলো একজোড়া হায়না চোখের লোভাতুর চাহনি।

‘আমার লিগা চা আনোস নাই কইতরির মা?’

শুভর গম্ভীর কণ্ঠস্বর পেয়ে ফুল এগিয়ে এসে চোখের পাতা নাচিয়ে বললো,

‘তুমি তো চা খাও না।’

‘খাই না তো কি হয়েছে? এহন কি খাইতে মন চাইতে পারে না?’

‘আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।’

ফুল চলে গেলো। শুভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার মিলনের দিকে তাকিয়ে রইলো। যে কোন সময় ভস্ম করে দিতে পারে তাকে। যা দেখে মিলন শুকনো ঢোক গিললো। এসবে হুশ নেই নূরজাহানের। সে পরমানন্দে চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে মুখে পুরছে।

বিকেল দিক থেকে শুভর শরীরটা একটু ভালো লাগছে। দুদিন পর সাবান ঘষে গোসল করায় মাথা ও শরীর দুটোই পাতলা লাগছে। যদিও মুখের তিতকুটে ভাবটা এখনো যায়নি। দুপুরে অল্প একটু খেয়ে উঠে পরেছে। নাগ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে নজর দিলো শুভ। নূরজাহান ও সোহেলী বেগম একসাথে বসে শাক বাছছে।মিলন দুপুরের খাবারের পর বাসায় চলে গেছে। পাশের গ্রামের মেম্বার সে। শ্বশুর বাড়ি বসে থাকার সময় নেই। ছেলেকে দেখেই সেহেলী বেগম মুখের হাসি চওড়া করে জিজ্ঞেস করলো,

‘শরীর এহন কেমন লাগে বাপ?’

‘ভালো।’

‘উডলি কেন? আরেট্টু হুইয়া থাকতি। শরীর ভালা থাকতে তো সারাদিনেও তোর চেহারা দেহা যায় না। অসুখের কারণে দুই দিন দেখলাম।’

শুভ উত্তর দিলো না। তার অস্থির চোখ জোড়া কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত। মায়ের সাথে গলা মিলালো নূরজাহান।

‘চেহারার কি হাল হইছে দেখছো? তাকান যায় না। দুইদিন শুকায় চেংটা হইয়া গেছে। মুখ, চোখের কি অবস্থা। আমি তো প্রথম দেইখা ডরায় গেছিলাম।’

সোহেলী বেগম মুখটাকে তাতিয়ে প্রায় চেচিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বললো,

‘আমার কথা কি হুনে? বাড়িতে একটা কালসাপ আইনা লইছি। হেই মাইয়া তাবিজ কইরা তোর বাপেরে আর ভাইয়েরে বশ কইরা রাখছে৷ আমার কথার থিকা ঐ মাইয়ার কথা ভালো হুনে।’

‘তাড়াইতে পারো না? ঘাড়ে উডায় রাখছো কেন? আমি হইলে এতোদিনে গলা ধাক্কা দিয়া বাইর করতাম। এরে দিয়া বিশ্বাস নাই। কহন কি করে কে জানে? চোখে চোখে রাইখো।’

‘দুইদিনের লিগা বাপের বাড়ি আহোস। চুপচাপ থাকবি, খাবি তারপর যাবিগা। আমগো বাড়ির পোদ্দারি করতে হইবো না।’

চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো শুভ। নূরজাহান অবাক হয়ে মা কে হাত দিয়ে ঠেলা দিয়ে বললো,

‘হুনছো মা হুনছো, কি কয়? আমি যে ওর বড় বোইন তাও মানে না।’

‘তুই হোন। আমি নিত্যি দিন হুনি। তাবিজ করছে আমার পোলাডারে। হারাদিন ওর নাম জপে। বাড়িতে আইয়া ওরে ডাকবো।’

শুভ দাঁড়ালো না। অসময়ে ক্যাচাল তার ভালো লাগে না। এর জন্য বাসায় থাকতে চায় না সে। সারা বাড়িতে একটা চক্কর মেরেও পেলো না। ঘাটের দিকে যেতে নিয়েও গেলো না। গেলে হয়তো কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে যেতো।

সন্ধ্যার পর শুভর বন্ধু-বান্ধবরা দেখা করতে এসেছে। সাথে হরেকরকম ফলমূল, পথ্য। খন্টা খানেক গল্প করলো তারা। রাতের খাবারের সময় হতেই ফুল মাথায় ওড়না টেনে ইতস্তত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করলো।

‘চাচী সবাইকে খেতে যেতে বলছে।’

মেয়ালি রিনরিনে কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো সবাই। একসাথে দৃষ্টি দিলো দরজার দিকে। ফুল তখন নতমুখে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে ওড়না পেঁচাচ্ছে। হানিফ আবাক চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাইয়াডা কেডা রে শুভ?’

গলা মিলালো হাসানও।
‘তোদের আত্মীয় নাকি? আগে কখনো দেহি নাই তো।’

শুভর চোখ দুটো নিষ্পলক।ধীরে ধীরে কঠিন হচ্ছে। সে কঠিন চোখের ভাষা বোঝা কারো পক্ষে এখন সম্ভব নয়। মুখের বলিরেখাগুলো ফুটে উঠেছে। ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললো,

‘তুই এইহানে আইছোত কেন? ঝুমুররে পাঠাইতে পারলি না?’

শুভর ধমকে সবার পিলে কম-বেশি চমকে উঠলো। হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ কেউ খুঁজে পেলো না। ফুল হাত মুষ্টি করে দুই পাশের জামা শক্ত করে ধরে কিছুটা তোতলানো সুরে বললো,

‘ঝুমুর আপা কাজ করছে।’

‘তাইলে নুরজাহানকে পাঠাতি।’

‘সে রুমে বসে আছে।’

‘এক্ষুনি এইহান থিকা যাবি। তোরে যেন আর না দেহি।’

ফুল নীরবে বেরিয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এতগুলো মানুষের সাথে এভাবে অপমান করার কি কোন দরকার ছিলো? হ্যাঁ, ছিলো। কারণ শুভ জানে তার বন্ধুরা কেমন। তাই ফুলকে সে আড়াল করে রেখেছে তাদের থেকে। সেই ফুল নিজে এসে ধরা দেওয়ায় বেশ রাগ হয়েছে তার। তাদের নজর যে এখন সর্বক্ষণ চেয়ারম্যান বাড়িতে থাকবে তাও জানে শুভ। তাই মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। হাতের কাছে থাকলে ফুলের গাল দুটো চড় মেরে ফাটিয়ে ফেলতো।

পলক বিব্রত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে রে মাইয়াডা? এমন কইরা কথা কইলি কেন ওর লগে?’

শুভর ফটাফট উত্তর,
‘তোর জাইনা কাম নাই।’

হাসান কৌতুকতার সহিত ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘আমার জাইনা কাম আছে। তোগো বাড়িতে এমন একটা পরী আছে আমগো কইলি না কেন শালা? তাইলে তো এতদিনে অনেক কিছু হইয়া যাইতো।’

হাসানের কথার ইঙ্গিত কোনদিকে ছিলো তা বুঝতে পেরে শুভর চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। এক ঝাটকায় হাসানের শার্টের কলার ধরে শাসিয়ে বললো,

‘কু*** বাচ্চা, নজর দিবি না ওর দিকে। চোখ তুইল্লা ফালামু।’

শুভর এমন অগ্নিগিরি রূপ আগে কখনো দেখিনি তার বন্ধুরা। সবাই ভয়ে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কারো মুখ দিয়ে টুঁশব্দ বের হলো না।

#চলবে

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_05
#Writer_NOVA

সেদিনের পর থেকে ফুল আজকাল শুভকে বেশ এড়িয়ে চলে। নূরজাহান দুদিন থেকে চলে গেছে। এই তো কিছু সময় আগে রান্নাঘরে শুভ কয়েকবার চক্কর দিয়ে গেলো। তবুও ফুল ঘুরে তাকায়নি। সুফিয়া বিবি একবার হাতের লাঠি উঁচিয়ে মা’রার ভয় দেখিয়ে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন।

‘এইহানে কি তোর? পাকের ঘরের সামনে ঘুরঘুর করতাছোত কেন? লক্ষ্মণ ভালা ঠেকে না। শরীর ভালা থাকলে সারাদিন বাড়িত থাকে না। এহন অসুস্থ তো। তাই বাড়ির বাইরে যাইতে পারো না।’

‘বুঝোই যহন বুড়ি, এতো কথা কও কেন?’

‘ঐ তুই কারে বুড়ি কস? এহনও তোর থিকা বহুত জুয়ান আছি। রোগে ধরতে পারে না। তুই তো একটু জ্বর আইলে কাইত হইয়া যাস। আবার আমার লগে টক্কর দেস।’

শুভ বেতের মোড়াটা টেনে বসলো। আড়চোখে একবার ফুলের দিকে তাকালো। ফুল বটি দিয়ে লাউয়ের খোসা ছাড়াচ্ছে। দাদীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘হইছে বাড়ায় কথা কইয়ো না। আমার মতো জ্বরে পরলে তোমারে খুইজা পাওয়া যাইতো না। পটল তুলতে যাইতা গা।’

‘ঐ ছেমরা কি ভাবোস তুই আমারে? এহনো তোর মতো পুচকের লগে লড়নের শক্তি আছে আমার।’

‘হাহ আইছে। বাতের ব্যাথায় উটলে বইতে পারে না, বইলে উটতে পারে না। হেয় নাকি আমার লগে লাগবো৷ কৌতুক ভালোই পারো।’

নাতি-দাদির কথা শুনে ঝুমুর রান্না রেখে ফিক করে হেসে উঠলো। তা দেখে সুফিয়া বিবি চোখ পাকালো। তবে ফুলের কোন হেলদোল নেই। সে যেনো পণ করে বসে আছে সারা দুনিয়া উল্টে গেলোও শুভর দিকে ফিরে তাকাবে না। ফুলের এড়িয়ে যাওয়া স্বভাবটা শুভর ভালো লাগছে না। ভেতরটাকে অস্থির করে দিচ্ছে।

সকালের পর ফুলকে আর দেখিনি শুভ। সকালের খাবার খাওয়ার পর ভালো লাগছিলো না। কামরায় এসে ঘুমিয়ে পরেছিলো। সোহেলী বেগম একবার এসেছিলো ডাকতে। ছেলে ঘুমিয়ে আছে দেখে ডাকেনি। শুভর ঘুম ভেঙেছে যোহরের পর। উঠে কলপাড়ে গোসল করে নিয়েছে। অন্য সময় ফুল কল চেপে বালতি ভরে দিলেও আজ সেই কাজটা ঝুমুর করেছে।

‘ফুল কই ঝুমুর আপা?’

‘কইতে পারি না। রান্ধনের পর আর দেহি নাই। কি জানি হইছে ওর। কারো লগে বেশি কথা কয় না।’

‘তোমার লগেও না?’

‘না!’

উত্তরে আশাহত হলো শুভ। ক্ষীণ শ্বাস টেনে মগ দিয়ে শরীরে পানি ঢালতে লাগলো। খাবারের সময় ফুল লাপাত্তা। ভাতের প্লেটে হাত দিয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই সোহেলী বেগমের তিরিক্ষি মেজাজী স্বর শোনা গেলো।

‘খাইতে বইছোত চুপচাপ খাবি। এদিক-সেদিক তাকাস কেন? কারে খুঁজোস এতো? শরীর সুস্থ থাকতো তো তোর টিকিটাও দেহা যায় না। এহন অসুস্থ গামলা ভইরা ভাত খাবি। তইলে না তাড়াতাড়ি সুস্থ হবি।’

‘হো আমি তো গরু। গামলা ভইরা ভাত খামু।’

‘গরুই, নইলে ঐ অপয়া মাইয়ার কথায় কি উঠতি বইতি নাকি?’

বিরক্তিতে নাক কুঁচকে গেলো শুভর। সবকিছুতে ফুলকে টানা পছন্দ করে না সে। অথচ তার মা প্রতি মিনিটে মিনিটে সেই কাজটাই করে।

‘আমারে যা খুশি কও। তার মধ্যে ফুলেরে টানো কেন?’

‘ঐ তো লাইগা গেলো? মাইয়ারে কিছু কইলেই গায়ে ফোস্কা পরে। আমারে যহন কয় তহন তোরা বাপ বেটা তো কিছু কস না। যত দোষ আমারই।’

‘ধ্যাত! খামুই না। দুইডা খাইতে বইছি হেও শান্তি নাই।’

শুভ উঠে হাত ধুয়ে চলে গেলো। সোহেলী বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে তেজী বাঘিনীর মতো করে চেচিয়ে বললো,

‘হো খাইবা কেন? আইজকা তো তোমগো ভালোবাসার ফুল ভাত বাইরা দেয় নাই। আমি দিছি না! মায়ের থিকা অন্যের মাইয়ার সেবাযত্ন ভালো লাগে। বিয়ার আগেই এই পরিবর্তন। বউ আইলে তো বোধহয় আমারে দেখতেই পারবি না।’

শুভ শেষ সিড়িতে পা রেখে বিরক্তিতে একবার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর যথারীতি পা চালিয়ে নিজের কামরায় চলে গেলো।

খাটের ওপর বসে যাতি দিয়ে সুপারি কাটছেন সুফিয়া বিবি। সোহেলী বেগম তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে পান সাজাচ্ছেন। দুজনে নিরব। হঠাৎ সুফিয়া বিবি প্রথম কথা বলে উঠলো।

‘ছোট পোলাডারে এট্টু চোখে চোখে রাখিস অভির মা। ওর হাবভাব ভালো ঠেকে না আমার কাছে। সারাক্ষণ দেহি ঐ ছেমরির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। কওন তো যায়না কহন আবার মায়ের মতো আমার নাতীডারে নিয়া পোলায়।’

‘এই চিন্তা কি আমার হয় না মা? আমারো হয়। আপনের পোলার ওপর মাঝে মধ্যে বহুত রাগ উডে আমার। বাড়িতে বিয়ার উপযুক্ত একটা পোলা থাকা সত্ত্বেও হেই কেমনে পারে ভাইয়োর মাইয়ারে ঘরে তুলতে? কান্ডজ্ঞান হের আসলেই লোপ পাইছে। এহন ঐ অপয়া মাইয়া যদি ছলেবলে, ফুসলাইয়া আমার পোলাডারে নিয়া ভাগে তাইলে কার ক্ষতি হইবো কোন তো? নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। কিন্তু আপনের পোলায় বুঝে না৷ আমি কিছু কইলে ধমক দিয়া কয় তুমি চুপ থাকো। বেশি বুইঝো না।’

‘ছোট পোলাডারে আমিও ভালোবাসতাম। বিয়ার লিগা দশ গেরাম খুইজা একখান পরীর মতো মাইয়া পাইছিলাম। হেই হারামজাদায় কি করলো? পরী হালায় থুইয়া কামের বেডির মাইয়া নিয়া ভাগলো। আমগো মান-সম্মান সব শেষ কইরা দিলো। তোর শ্বশুর তো রাইগা তাজ্য পুত্র কইরা দিলো। কিন্তু বড় পোলাডার তার ভাইয়ের প্রতি টান কমলো না।’

‘এই টানই তো বিপদে হালাইবো আম্মা। হেইডা হেয় বুঝে না। আমার কি মনে হয় জানেন আম্মা? এই মাইয়ারে তার মায় ইচ্ছা কইরা পাডাইছে।যাতে কইরা বাপের সয় সম্পত্তি হাত করতে পারে।’

‘কি জানি বাপু! তোমগো মন মতলবি বুঝি না।’

শাশুড়ীর হেয়ালি উত্তর পছন্দ হলো না সোহেলী বেগমের। মুখ পানসে করে ফেললো। অপরদিকে সুফিয়া বিবির বুকের বা পাশটা চিনচিন করে উঠলো৷ ছোট ছেলে মনোয়ার তার ভীষণ প্রিয় ছিলো।ছেলের কাজে সেও অসন্তুষ্ট ছিলো। কিন্তু সে তো মা! মায়ের মন তো ছেলের জন্য কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। কত বছর ধরে ছেলেটাকে দেখে না। এক পলক দেখার জন্য মনটা তার বড় আনচান করে।

মাগরিবের আজান দিয়েছে বহু আগে। এশারের আজানের সময় হয়ে গেছে। ওজু করার জন্য কলপাড়ে যেতে হবে ফুলের। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং হয়েছে। অজপাড়া গাঁয়ে বিদ্যুৎ আছে এটাই বেশি। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ৫-৬ ঘন্টা থাকে। কোণার দিকে টিমটিমে আলোতে জ্বলছে হারিকেন। তুরকুলা পোকার ঝি ঝি ডাকে পরিবেশটাকে ভুতুড়ে করে দিয়েছে। হারিকেন হাতে নিয়ে আশপাশটা তে ভীতু নজর দিলো ফুল। গতরাতে ঝুমুরের থেকে জ্বীন-ভূতের গল্প শুনেছিলো। একা থাকায় সেগুলো এখন মনে পরছে৷ একবার ভাবলো ঝুমুরকে ডাকবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। এখন ঝুমুরকে ডাকলে ঝুমুর নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে মজা নিবে। সেটা ফুলের ভালো লাগবে না।

‘ভাউ!’

‘বাবা গো!’

পেছন থেকে কানের কাছে কেউ ভাউ বলতেই ফুল ভয়ে চেচিয়ে উঠলো। হো হো হাসির শব্দ শুনে হারিকেন উঁচিয়ে দেখলো শুভ পেট ধরে হাসছে।

‘এতো ভীতু তুই?’

‘এভাবে ভয় দেখালে কে না ভয় পাবে?’

‘কহন থিকা দেখতাছি তুই হারিকেন নিয়া এইহানেই দাঁড়ায় রইছোত। কলপাড়ে যাওনের সাহস পাইতাছোত না।’

নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে ভাব নিয়ে বললো,

‘হুম বলছে তোমাকে?’

‘বলবি কেন? আমি তো উপরের থিকা সবই দেখলাম।’

‘ভালো করছো। সরো এবার।’

ফুল কপট রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে কলপাড়ে চলে গেলো। এখন যেহেতু শুভ আছে তার কোন ভয় নেই। হারিকেন পাশে রেখে কল চেপে মগ ভরে পানি নিলো দ্রুত হাতে ওজু করতে লাগলো।

‘আরে আস্তে কর। আমি পলাইতাছি না।’

‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’

‘হো দেখলামই তো। সামন্য ভাউ কইতেই আত্মা কাইপা গেছে।’

‘চোখের ডাক্তার দেখাও। ভুল দেখছো তুমি।’

ওজু সেরে ফের এক মগ পানি পায়ে ঢেলে নিলো ফুল। শুভ মুখ টিপে হাসলো। যাক, এই ভয় দেখানোর কারণে হলেও ফুল তার সাথে কথা বলেছে। পরক্ষণেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। চেচিয়ে বললো,

‘ঐ দেখ ফুল তোর পিছনে কি!’

‘আল্লাহ গো!’

ফুল হারিকেন নিয়ে দৌড়ে চলে এলো। তাড়াহুড়োর ঠেলায় বারান্দায় থাকা সিমেন্টের খুঁটির সাথে ধরাম করে বারি খেলো। তা দেখে শুভ আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। ফুল কপাল ডলতে ডলতে মুখ ঝামটা মেরে বললো,

‘তুমি আসলেই খাটাশ, শুভ ভাই।’

#চলবে