#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_12
#Writer_NOVA
সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে আকাশে পাখির মিলনমেলা দেখা দেয়৷ বৃষ্টিময় আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও পেটের দায়ে নীড় ছেড়ে বেরিয়েছে বহু পাখি। সন্ধ্যার আগে নীড়ে ফেরার তাড়া তাদের। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘের গুড়ুম গুড়ুম কমেনি। বিদ্যুৎ নেই দুদিন ধরে। বৃষ্টি দেখে তিল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদ্যুৎ পালিয়েছে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চারিদিকে আধার নেমেছে।
হাতের কুপিটা উঁচু করে চৌকির নিচ থেকে হারিকেনটা বের করলো ঝুমুর। চিমনি উঠিয়ে সলতে তে আগুন ধরিয়ে দিলো। ফু দিয়ে কুপি নিভিয়ে বুক ভরে নিঃশাস নিয়ে কেরোসিনের গন্ধ টানলো। কেরোসিনের গন্ধ তার বেশ লাগে। কেমন নেশা নেশা লাগে।
‘কি করো ঝুমুর আপা?’
হঠাৎ ফুলের গলার স্বর পেয়ে চমকে উঠলো ঝুমুর। ইতস্ততা নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ালো। বেআক্কল মার্কা হাসি দিয়ে নিজের বলদামি আড়াল করে বললো,
‘হারিকেনে আগুন ধরাইলাম।’
‘আমি দেখেছি তুমি কেরোসিনের ঘ্রাণ নিচ্ছিলো।’
বেকুবের মতো মাথা চুলকে হাসলো ঝুমুর। এতক্ষণ নিজেকে গম্ভীর করে রাখলেও হঠাৎ করে হেসে উঠলো ফুল।
‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমারো কেরোসিনের গন্ধ ভালো লাগে। যাও হারিকেনটা নাগ বারান্দার খুঁটির মধ্যে ঝুলিয়ে দিয়ে আসো। সেখানে আলো না দেখলে বুড়ি খিটমিট শুরু করবো।’
‘বুড়িটা ম’রে না কেন গো?’
‘আমি কি জানি? আল্লাহকে জিজ্ঞেস করো।’
‘জীবনডা ভাজা ভাজা কইরা ফালাইলো বুড়ি।’
ফুল ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তখুনি উপরের তলা থেকে হাঁক ডাক ছাড়লেন সুফিয়া বিবি।
‘ঐ ঝুমুর, কুপিতে আগুন ধরায় দিয়া যা৷ কই গেছোস? কালি সন্ধ্যা নামলো।’
ঝুমুর বিরক্তিতে গাল ফুলিয়ে বাতাস ছাড়লো। ঘাড় হেলিয়ে ফুলকে বললো,
‘কইতে না কইতে বুড়ির ডাক। হায়াত আছে৷ এতো তাড়াতাড়ি ম’রবো না। দেহো না নাম লইতেই চিল্লান দিয়া উঠলো।’
ফুল সাবধানী দৃষ্টি দিয়ে নিচু গলায় উত্তর দিলো।
‘জলদী যাও। নয়তো বুড়ির পিনিক উঠে যাবে।’
দুজনে একসাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সোহেলী বেগম হাতে ধরে রাখা ক্ষীণ আলোর টর্চ লাইট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন। হাসির শব্দ পেয়ে গর্জে উঠলো,
‘হারা সন্ধ্যা কি গল্প কইরা পার করবি তোরা? ইট্টু পর আজান দিবো। এহনো সব ঘরে বাতি দিতো পারলো না। হারাক্ষণ গল্প, গল্প। গল্প ছুটায় ফালামুনে।’
এক মিনিট দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে সোহেলী বেগম কলপাড়ে চলে গেলেন। ঝুমুর মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘এই হলো আরেকটা। জীবনডা অতিষ্ট কইরা হালাইলো। মাঝে মাঝে মন চায় না হেনে আর থাকি।’
ঝুমুরের কন্ঠে চাপা ক্ষোভ। ফুল কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস্ত সুরে বললো,
‘মন খারাপ করো না। ভালো সময় নিশ্চয়ই আসবে।’
‘হো হের লিগা এহনও আশায় বাঁচি।’
ঝুমুর দাঁড়ালো না। হারিকেন উঁচু করে শব্দ করে পা ফেলে নাগ বারান্দার দিকে চলে গেলো। ফুল স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ক্ষীণ শ্বাস ছাড়লো।
অনেকক্ষণ যাবত দরজায় কড়াঘাত করে বিরক্তি ফুটে উঠেলো তার চোখে। এক হাতে ছাতা, খাবারের প্যাকেট সামলে আরেক হাতে দরজা কষাঘাত করার কাজটা আসলেই বিরক্তিকর। সেই কখন খেয়া পার হয়ে এসেছে। গ্রামের বাজার থেকে ফলমূল, বিস্কুট, চানাচুর কিনতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। এতোদিন পর বাড়ি এসেছে কিছু না নিয়ে ফিরলে কেমন দেখায়। মিনমিনিয়ে নিজে নিজে বললো,
‘সব গেলো কোথায়?’
একটু থেমে আবারো পরপর কতগুলো বারি দিলো সে। ধৈর্য্যের বাঁধ বোধহয় এবার ভেঙেই যাবে।
‘ঐ ফুল, ঝুমুর কই তোরা? ম’রছোতনি রে? কহন থিকা ডাকতাছি কেউ হুনে? একটা কাম ভালো মতো করে না।’
সোহেলী বেগম বিরক্ত গলায় বললো। ফুল নামাজের সালাম ফিরিয়ে দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
‘কি হয়েছে চাচী?’
‘হাজার বছর পর নবাবজাদির হুশ ফিরছে। কহন থিকা ডাকতাছি হেই খেয়াল আছে?
‘কি দরকার তাই বলেন।’
‘সদর দরজা কে জানি বাইরাতাছে দেখতো কে।’
ফুল মুখ পানসে করে ফেললো। নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ফুলকে হুকুম করছে কে এসেছে দেখার জন্য। অথচ পাঁচ কদম এগুলো সে নিজে দেখতে পারে। ফুলের রাগ হলো৷ আরো দুই রাকাআত নামাজ বাকি আছে তার। মনে মনে জেদ চেপে গেলো। না সে যাবে না।
‘যতক্ষণে ডাকছেন ততক্ষণে নিজে খুলেই দেখতে পারতেন। আমি নামাজ পরতেছি। আসতে পারবো না। নিজে একটু কষ্ট করে গিয়ে দেখুন।’
কথাগুলো বলে ফুল দাঁড়ালো না। দাঁড়ালে চাচীর তোপের মুখে পরতে হবে। কি প্রয়োজন ঝামেলা বাড়ানোর। সোহেলী বেগম ফুলের ঠাটবাট উত্তর শুনে রাগে গজগজ করে উঠলেন।ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে।
কিন্তু দরজা খুলে ভুত দেখার মতো চমকে গেলেন সোহেলী বেগম। হাতে থাকা টর্চটা উঁচু করে অপর পাশে থাকা ব্যক্তিটার মুখের ওপর মা’রতেই সব রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে আবেগে আপ্লূত হয়ে পরলেন। চোখ দুটো টলমল করে উঠলো। কতদিন পর দেখা! ঝাপিয়ে পরলেন তার বুকে।
‘আমার অভি! কই আছিলি তুই বাপ? কত খুঁজছি তোরে। এমনে বাপ-মা রে পর কইরা দিলি।’
অভির চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। কতদিন পর মায়ের সন্নিধি পেলো। অভিমানের আস্তর গলে গলে পরতে লাগলো। এক হাতে মা কে জড়িয়ে ধরে অভিমানী গলায় বললো,
‘ভেতরে ঢুকতে দিবে না? তুমি এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি আবার নিরুদ্দেশ হবো।’
‘না না বাপ। ঐ কথা মুখেও আনিস না। লো ঘরে লো।’
প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের টান থেকে আলাদা। সে যদি বছর দুই নিরুদ্দেশ থাকে তাহলে মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয়? হঠাৎ সেই ছেলে ফিরে এলে যেনো খুশির বন্যা বয়ে যায়। সেই খুশির ছটা মনের উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে এসে বারি খাচ্ছে। কি থেকে কি করবে দিশেহারা অবস্থা সোহেলী বেগমের। গলা ছেড়ে চেচিয়ে উঠলো,
‘কই গো তোমরা? দেইখা যাও কেডায় আইছে।’
সারা বাড়িতে হৈহৈ রব। বাড়ির প্রথম ছেলে ফিরে এসেছে। এতে যেনো সবার আনন্দ ধরে না। আনোয়ার সর্দারকে খবর পাঠানো হয়েছে। ঝুমুরকে কিছু সময় পরপর তাগাদা দিচ্ছেন সোহেলী বেগম। এতোদিন পর ছেলে ফিরেছে ভালোমন্দ রান্না করতে হবে তো। সুফিয়া বিবির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অভি। দাদীর ভীষণ পছন্দের নাতী। হবেই তো! শুভর মতো নয় অভি। তার সব কথা শুনে, সম্মান করে, দাদী যেনো তার জানপ্রাণ। এমন নাতির জন্য অন্তর পুড়তো তারও। সেই যে বছর দুই আগে রাগারাগি করে বাড়ি ছেরেছিলো। আজ ফিরলো। লোকে তো বলেই দিয়েছিলো এই ছেলে আর ঘরে ফিরবে না। সবার কথা মিথ্যে প্রমাণ করে বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় অবশেষে অভির আগমন হলো।
‘কইছিলাম না বড় বউ আমার সোনার টুকরা নাতি ফিরা আইবো। দেখলা তো আমার কথা ঠিক ফললো।’
‘আমার মনও কইছিলো আমার অভি ফিরা আইবো। দেখছেন মা চেহারার কি সুরত করছে। হাড্ডিচারা বাইরায় গেছে। ঠিকমতো না খাইয়া শরীলের কি অবস্থা করছে।’
‘বছর পর আইছে। এবার আর ছাড়বি না। মাস খানিক বাড়িতে রাইখা ভালোমন্দ খাওয়াইয়া মোটা তাজা কইরা ভালো মাইয়া দেইখা বিয়া করায় দিমু। এরপর বউয়ের টানে প্রতি সপ্তাহে বাড়িত আইবোনে।’
খিকখিক করে হেসে উঠলেন সুফিয়া বিবি। অভি কোল থেকে মাথা তুলে এক চোখ মেরে বললো,
‘তুমি থাকতে অন্য কাউকে লাগে নাকি আমার?’
‘আমি তো পুরান হইয়া গেছি। এর লিগা আর ভালো লাগে না। বুড়িরে কি কারো ভালো লাগে? নতুন টশটশা জুয়ান মাইয়া আইনা দিমু। তহন তার আঁচলের তল থিকা বাইর হইতে চাইবি না।’
‘আমার অন্য কাউকে দরকার নেই। তুমি হলেই চলবে।’
সুফিয়া বিবি নাতির উত্তরে প্রসন্ন হয়ে পিঠের ওপর সাবাসীর চাপড় মা’রলেন। ছেলের বউকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘তুই হেনো কি করোস? যা গিয়া দেখ রান্ধা কতদূর। যাগো কাম করতে দিছোস জানোসই তো কি ডিলা কোম্পানি। হেনে দাঁড়ায় থাকলে নাতিডা কহন খাইবো? আমি আর নাতি গল্প করি। তুই গিয়া ঐদিক সামলা। ঝুমুররে দিয়া আমগো লিগা দুই কাপ চা পাডায় দিস।’
অন্য দিন হলে সোহেলী বেগম শাশুড়ীকে ধোয়ানি দিয়ে দিতো। আজ ছেলে ফিরে আসার খুশিতে বাক-বাকুম মন। তাই খুশি মনে মাথা হেলিয়ে বললো,
‘আইচ্ছা আম্মা।’
সোহেলী বেগম বের হতেই সুফিয়া বিবি অভিকে ঠেলা দিয়ে বললো,
‘যা গিয়া হাত-পা ধুইয়া আয়। ভিজা কাপড়চোপড়ে এহনো হুইয়া রইছে। ঠান্ডা লাইগা যাইবোনে।’
অভি উঠলো না। নড়েচড়ে আগের ন্যায় উল্টো হয়ে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। শরীর তার ভীষণ ক্লান্ত। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটো ভার হয়ে আসছে। যেকোনো সময় হারিয়ে যাবে ঘুমের রাজ্যে। চেনা পরিচিত ঘ্রাণে নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সাথে মনে কাজ করছে প্রশান্তি। আহ্ নিজের বাড়ি! এখানেই যেনো সব সুখ বিদ্যমান।
#চলবে
#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_13
#Writer_NOVA
রসুইঘরে ঝিম মেরে বসে আছে ফুল। একটু আগে অভি আসার খবরটা ঝুমুর তার কানে দিয়েছে। এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত তা সে জানে না। তবুমনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো অভির মুখোমুখি সে কিছুতেই পরবে না। অভি তার জীবনের কোন অংশে নাই। আসলে কি নেই? মন সায় দিলো না কথাটায়। অভি হলো তার জীবনে কোণ ঠাসা হয়ে অযত্নে পরে থাকা মলিন অধ্যায়। যেখান থেকে তার এলোমেলো দিনের শুরু। পুরো অংশ জুড়ে না থাকলেও সূচনায় তো সেই আছে। যার দরুন শত কাহিনীর জন্ম। যার জন্য দ্বিধাদ্বন্দের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সে।
‘কি হইছে তোমার ফুল?’
হঠাৎ কথায় চমকে উঠলো ফুল।নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
‘কিছু না। তুমি রুটি কয়টা বেলে দাও। আমি ততক্ষণে মুরগীর গোস্ত কষিয়ে ফেলি।’
ঝুমুর স্থির দৃষ্টিতে ফুলের মুখপানে তাকিয়ে শ্বাস ফেলে ভীতু স্বরে বললো,
‘জানো আমার না ডর করতাছে?’
‘কেন?’
‘তুমি জানো না?’
ঝুমুরের চোখ, মুখ ঠিকরে অবাকের ছটা। ফুল প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। ঝুমুর চাপা স্বরে ফিসফিস করে বললো,
‘বড় ভাই আর শুভ ভাইয়ের লগে ঝামেলা লাগাইন্না। তারা একে অপরের লগে কথা কওয়া তো দূরে থাক কেউ কারো মুখ দেহে না।’
ফুল ছোট করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘জানি।’
‘হেইবার দুই ভাই যে কি লাগোন লাগছিলো গো। একটুর লিগা খু’নাখু’নি হয় নাই। এরপর তো রাগ কইরা অভি ভাই গেলো গা।’
‘কিসের জন্য লেগেছিল?’
ফুলের প্রশ্নের উত্তর দিতে সবেই মুখ খুলেছিলো ঝুমুর। এর মধ্যে পেছনে থেকে সোহেলী বেগমের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা গেলো।
‘হারাক্ষণ গল্প কইরা বেরায়। আমার পোলাডা এত বছর পর আইছে কারো কোন হুশ আছে? একটা কাম দিয়া গেছি কোন সময়। এহনো করে নাই৷ বইয়া বইয়া গল্প করতাছে। রুটিগুলা পর্যন্ত বানায় নাই। ঐ তোরা এতক্ষণ কি করলি?’
‘আমরা কাম করতাছি চাচী। চাচারে কন না কেন রান্ধন ঘরের চাল ফুটা হইয়া গেছে। ফুটা দিয়া বৃষ্টির পানি পইরা চুলার মুখ ভিইজা রইছে। মাটির চুলা ভিজা থাকলে আগুন ধরে? আগুন ধরাইতে কত সময় লাগলো।’
ঝুমুরের কথায় ঢেঢ় অসন্তুষ্ট হলেন সোহেলী বেগম। রাগে ফুলের দিকে তাকিয়ে ঝুমুরকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
‘এহন দেহি তুইও কথা শিইখা গেছোত। এই ছেমরির লগে থাইকা এসব শিখছোত না? ছাইদানি দিয়া যহন পিডে দুইডা দিমু তহন দেখবি কেমন মজা লাগে।’
‘সবকিছু তে আমাকে টানবেন না চাচী।’
ফুলের কথায় স্পষ্ট প্রতিবাদের আভাস। সোহেলী বেগম চোখ কুচকে রাগী কিন্তু বললো,
‘আইছে জমিদারের নাতনী। কি পাকাল দেহো! আমারে হুমকি দেয়।’
‘জমিদারের নাতনি না হলেও চেয়ারম্যানের ভাতিজী আমি। কথাবার্তা সাবধানে বলাই ভালো।’
সোহেলী বেগম তেতে উঠলেন। তার ইচ্ছে করছে পাশের চেলাকাঠ তুলে ফুলের পিঠে দুম করে একটা বসিয়ে দিতে৷ কিন্তু এখন ভেজাল করা মানে রান্না তার করা। তাই নিজের ইচ্ছাকে দমন করে নিলো।
আনোয়ার সর্দার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছেন। আদরের ছেলে ফিরেছে বলে খুশিতে আত্মহারা। ইতিমধ্যে সারা গ্রামে অভি আসার খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজেই। বৃষ্টি-বাদল না মেনে ভিজে ভিজে চলে এসেছেন।
‘কই আমার অভি কই?’
‘দাদীর ঘরে ঘুমাইতাছে।’
‘যাও গিয়া ডাকো। কতদিন ধইরা আমার বাজানডারে দেহি না। দেইখা পরাণ জুড়াই।’
‘পোলাডা একটু ঘুমাইছে নুরজাহানের বাপ। এহনই ডাকমু?’
‘তুমি অভির মা কোন কথা কইয়ো না। জলদী গিয়া পোলারে ডাকো। আমার তর সইতাছে না।’
‘আপনি তাইলে ভিজা জামা-কাপড় পাল্ডান। আমি ডাকতাছি।’
সোহেলী বেগম উপরের তলায় চলে গেলেন। আনোয়ার সর্দার খুশিতে ঘনঘন চোখের পাতা নাড়াচ্ছেন। ছেলে আসবে এই কথা সে আগের থেকে জানতেন। মাস খানিক আগেই চিঠি পাঠিয়েছিলো অভি। সেই চিঠিতে আসার কথা বলেছিলো। তবে নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ করে দেয়নি। হুট করে এসে এভাবে ভড়কে দিবে বলে হয়তো বলেনি। চিঠি পাওয়ার পর থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন আনোয়ার সর্দার। অবশেষে তার অবসান ঘটলো।
মাথার চুল হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে গলা ছেড়ে ডাকলেন আনোয়ার সর্দার।
‘ফুল মা কই রে? আমারে একটা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি দিয়া যাইস।’
ফুলের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো ডাকলেন।
‘ফুল কই তুই?’
উপরের কামরা থেকে ফুল উচ্চস্বরে জবাব দিলো।
‘আসতেছি চাচা।’
তবে সে এলো না। তার বদলে ঝুমুরকে পাঠালো। তার ভয় করছে যদি অভির সম্মুখে পরে যায়। ছোট সেই ঘটনা নিশ্চয়ই অভির মনে থাকার কথা নয়। কত বছর আগের কথা। তারপরও ফুলের মন খচখচ করছে। অভির চোখে চোখ মিলাতে পারবে না সে।
ছেলেকে দেখেই বুকে টেনে নিলো আনোয়ার সর্দার। অভি প্রথমে মন খারাপ করে থাকলেও একসময় বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ছেলের কান্নায় চোখের পাতা ভিজে গেলো বাবার। শেষ পর্যন্ত মান-অভিমানের পাট চুকে গেলো।
‘কই আছিলি তুই বাপ? তোরে কত খুঁজছি। এতবড় শাস্তি দিলি আমগো? আমরা কেউ হয় না তোর। রাগ, গোস্বা করলে কি বাড়ি থিকা যাইতেগা হয়? তোর কলেজে কতবার গেছি। কেউ কইতে পারে না তুই কই আছোত। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতেছিলো।’
‘আমি অন্যায় করেছি আব্বা। আমাকে মাফ করে দিও। তোমাদেরকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতি পদে পদে আমি শাস্তি পেয়েছি। আসলেই কাজটা আমার ঠিক হয়নি৷ আমার কাজের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে মাফ করে দিও।’
অভি হাত জোর করে কান্নায় ভেঙে পরলো। আনোয়ার সর্দার ছেলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
‘তুই আমার সন্তান। তোর লগে কি আমি রাগ কইরা থাকবার পারি? তোরা শুধু আমার কঠিন রূপটা দেহোস। আমার ভালোবাসা দেহোস না?’
অভিকে আবারো জড়িয়ে ধরলেন। অভি শক্ত করে বাবাকে ধরে রাখলো। বহু দিনের অভিমান, অভিযোগ এক নিমিষেই হারিয়ে গেলো অন্য ভুবনে৷ নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকে বেশ ধমকি-ধামকি দিলো অভি৷ কেনো ঝোকের বশে বাড়ি ছেড়েছিলো সে? এই সহজ-সরল মানুষগুলোকে কষ্ট দিলো।
দরজার আড়াল থেকে সবটা দেখে চোখ মুছলো শুভ। পুরোনো দিনগুলো ফিরে এসেছে। নিজের চোখের সামনে বাবা-মায়ের বৈষম্য দেখবে সে। কিছু সময় তার মনে হয় সে বোধহয় পালক সন্তান। যাকে খাওয়ানো, পরানো ছাড়া এই পরিবারের আর কোন দায়িত্ব নেই। কই কোনদিন তো তাকে এভাবে বুকে জড়ায়নি তার বাপ৷ হ্যাঁ, সে একটু বেপরোয়া, জেদি, রাগী, কারো কথা শুনে না। তাই বলে তার কি অধিকার নেই নিজের বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার? তাকে সবসময় সবাই দূরে ঠেলে দেয় কেনো? সে কি এক চিমটি ভালোবাসার দাবি রাখতে পারে না? বড্ড ইচ্ছে হয় প্রশ্নগুলো নিজের পরিবারকে করতে। কিন্তু কোথায় জানি বিবেকে বাঁধা দেয়। তাই চুপচাপ সব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
চোখের পানি আলগোছে মুছে ভেতরে প্রবেশ করে শুভ। বুকের ভেতরটায় অসহ্য যন্ত্রণা করছে। মাথার ভেতরটায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। শুভকে দেখে অভি এগিয়ে এসে দুই হাত মেলে বললো,
‘কেমন আছিস শুভ?’
শুভ, অভির হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেলো। রাগী গলায় অনেকটা চেচিয়ে বললো,
‘একদম ভালোমানুষি দেখাবি না। যাগো লগে ঢং করলে মাথায় তুইল্লা রাখবো তাগো কাছে যা। আমার লগে পিরিত করতে আহিস না। বাড়িতে আইছোত ভালো কতা। আমার থিকা দশ হাত দূরে থাকা তোর লিগা মঙ্গলজনক। গতবার বাঁইচা গেছোত দেইখা ভাবিস না এবারও বাইচা যাবি।’
শুভ দাড়ালো না। প্রায় দৌড়ে স্থান ত্যাগ করলো। আনোয়ার সর্দার রেগে চেচিয়ে উঠলেন,
‘দেখছোত এহনো বেয়াদবই আছে। এডারে আমি মানুষ করতে পারলাম না। অমানুষের জাতটা আমার পোলা কেমনে হইলো?’
অভি তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘থাক বাবা কথা বলো না। এতদিন পর বাড়ি এসে কোন ঝামেলা চাইছি না আমি।’
কামরায় গিয়ে শক্ত করে নিজের চুলগুলো টেনে ধরলো শুভ। চোখ দুটো রাগে, ক্ষোভে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখের পুত্তলী ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরবে। টেবিলের ওপর থাকা চিনামাটির ফুলদানিটা হাতে তুলে মেঝেতে সজোড়ে আছাড় মারলো। মনে মনে কল্পনা করলো ফুলদানি নয় যেনো অভিকে আছাড় মেরেছে সে।
‘কি হয়েছে শুভ ভাই?’
কাঠের চেয়ারটা সবেমাত্র হাতে নিয়েছিলো দেয়ালে বারি মেরে ভাঙতে। ফুলের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো শুভ। না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো ফুল৷ হঠাৎ ঝুমুর ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললো শুভর রুমে যেতে। একটু আগে সে ভাঙাচোরার শব্দ পেয়েছে। শুভকে যদি কেউ থামাতে পারে সেটা একমাত্র ফুল। ফুল পূর্বের ঘটনা কিছুই জানে না। ঘুমে সে এখনো দুলছে। শুভ ফুলের দিকে অগ্নিচক্ষু করে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
‘তুই এইহানে কি করোস?’
শুভর বাজখাঁই চিৎকারে ফুলের ঘুম এক দৌড়ে পালালো৷ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বললো,
‘কি হয়েছে তোমার?’
‘তোর জানতে হইবো না। যা হেন থিকা।’
‘আশ্চর্য, তুমি এমন ব্যবহার করছো কেন আমার সাথে?’
‘তুই আমার সামনের থিকা না গেলে তোরে আঘাত করতেও আমি দুইবার ভাবমু না। আমার মেজাজ অনেক গরম আছে ফুল৷ ভালো চাইলে নিজের ঘরে যা। আমার সামনে থাকিস না।’
শুভ যে অনেক রেগেছে তা ফুল টের পেলো আরেকবার। খুব বেশি না রাগলে শুভ ফুলের নাম ধরে ডাকে না৷ দমলো না ফুল। শেষ চেষ্টা অব্যহত রাখলো।
‘সমস্যা কি আমাকে বলো! তুমি সবকিছু আমাকে বলো। আজ কি হলো?’
‘আমার কাউরে কিছু কই না। সব আমার মনের মধ্যে দাফন দিয়া রাখি। ফুল আমারে আর রাগাইস না। এট্টু একলা থাকতে দে।’
‘কিন্তু বলবা তো….
পুরো কথা শেষ করার আগে শুভ ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে উঠলো।
‘কইতাছি না আমার সামনের থিকা যাইতে। তুই আমার কথা হুনতাছোত না কেন? কাউরে আমারে নিয়া চিন্তা করতে হইবো না। এতো আদিখ্যেতা ভাল্লাগে না আমার৷ আমি মরি, বাচি কারো কিছু আহে যায় না। তুইও আমারে নিয়া ভাবা বন্ধ কর। কেউ যহন ভাবে না তোরেও দয়া দেহাইয়া ভাবতে হইবো না।’
‘আমি কোন দয়া দেখাচ্ছি না। আমি তো শুধু জানতে চাইলাম। তুমি এমন করছো কেনো?’
‘তোরে যাইতে কইছি আমি। আর কোন কথা শুনমু না। বের হো ঘর থিকা।’
শুভ এগিয়ে এসে ফুলের বাহু শক্ত করে ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেলো৷ ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে মুখের ওপর ঠাস করে দরজা আটকে দিলো। এবার ফুলের চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।অভিমানে মন ভারী হয়ে গেলো। শুভর এই আচরণের সাথে পরিচিত নয় সে৷ গাল বেয়ে চোখের পানি পরছে। শেষ পর্যন্ত শুভও তাকে দূরে সরিয়ে দিলো।
#চলবে