কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব-১৪+১৫

0
173

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_14
#Writer_NOVA

মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙলো ফুলের। গত সন্ধ্যায় তাড়াহুড়োয় খোয়ার আটকানোয় মোরগটা নিশ্চয়ই বাইরে রয়ে গেছে। তাই ঊষালগ্নে ডেকে উঠেছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সে। দূরের থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এক হাতে মাথা চেপে ধরলো৷ বা হাতটা টেনে কোলের উপরে রাখতেই ক্ষীণ শব্দ হলো। শব্দের উৎসের দিকে তাকাতেই চমকে গেলো। চেয়ারে বসে খাটের ওপর দুই হাত রেখে তার ওপর মাথা নুইয়ে রেখেছে কেউ। নিশ্চয়ই সে ঘুমোচ্ছে। ইতস্তততা নিয়ে অনেকটা ছিটকে সরে গেলো ফুল।

‘কে এটা? আমার কামরায় এলো কি করে?’

বিরবির করে বললো ফুল। অতঃপর ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মানুষটা শুভ বৈ অন্য কেউ হতেই পারে না। কিন্তু ছেলেটা এখানে কি করছে? কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারী রটে যাবে। এমনিতেই তার জীবনে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে মানুষ। নতুন করে কিছু চাইছে না সে।

মাথা কাজ করছে না। ধীরেসুস্থে ওড়নাটা টেনে নিঃশব্দে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো ফুল। বেরুবার আগে এক পলক শুভর পানে তাকালো। আবছা অন্ধকারে হালকা হালকা বোঝা যাচ্ছে।

‘তুমি গতকাল আমাকে কষ্ট দিছো শুভ ভাই। আমি অনেক কষ্ট পাইছি। এখন যতই পিছু পিছু ঘুরো কাজে দিবে না। আমি এতো সহজে তোমায় ক্ষমা করবোই না। তুমি আসলেই খারুশ।’

মনের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে ঝাটকায় বেরিয়ে গেলো। চুলে খোঁপা করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। গন্তব্য এখন কলপাড়।

বড় ভাই এসেছে শুনে দেরী করেনি নূরজাহান। গাট্টি বোচকা বেধে কয়েকদিনের সফরে চলে এসেছে। মিলন আসতে চায়নি। বউয়ের চোখ লাল করা দেখে মানাও করতে পারেনি। বসার ঘরে ছোটখাটো পারিবারিক সভা বসেছে। নেই শুধু শুভ। অভি কাঠের চেয়ারে বসে বোন জামাইয়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে। এর মধ্যে সুফিয়া বিবি বলে উঠলেন,

‘নূরজাহান এবার নাতিনের ঘরে পুতিন দেখতে চাই। আমার ইচ্ছাডা পূরণ কর। বিয়াও তো হইছে কম দিন না। এবার পোলাপাইন নিয়া হালা। তোরা যে কি করোস! তোর বয়সে আমগো মনোয়ার আছিলো তিন বছরের।’

‘আহ আম্মা কি শুরু করলেন! মাইয়াডারে কি সবার সামনে লজ্জা দেওনের দরকার আছিলো? একলা কথাগুলি কইতে পারতেন না?’

সোহেলী বেগম অসন্তোষের সুর টেনে বললো। মিলন, নূরজাহান পারলে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যায়৷ অভি ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো। আনোয়ার সর্দার মাথা নিচু করে ফেলছে।তবে সেও হাসছে। মনে মনে নূরজাহানের খানিকটা রাগ হলো। ভাই, বাপের সামনে এভাবে কেউ বলে? তার দাদী আসলেই ঠোঁট কাটা স্বভাবের। অভির একবার বলতে ইচ্ছে করছিলো,

‘দাদী তুমি আর দাদা তো পাকা খেলোয়াড় ছিলে। তাই বেশি সময় মাঠে ব্যয় করতে চাওনি। আগে আগেই উইকেট ফেলে দিছো।’

বাপ সামনে দেখে মুখের কথা মুখে রইলো। ঢোক গিলে কথাটাকে গিলে ফেললো। মিলন তড়িঘড়ি করে উঠে বোকার মতো মাথা চুলকে বললো,

‘আমি আহি। আমার কাম আছে।’

‘আরে নাত জামাই কই পলাও? খাড়াও, খাড়াও। আরো কথা আছে আমার। এহনো তো শুরুই করলাম না।’

আনোয়ার সর্দার বললেন,
‘ মা, কি শুরু করলা? সবার সামনে ইচ্ছা কইরা শরম দিলা।’

মিলন কিন্তু দাঁড়ালো না। লজ্জা মুখ লুকিয়ে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো। মিলন যেতেই বসার ঘরে হাসির রোল পরে গেলো। আনোয়ার সর্দার গলা উঁচিয়ে ফুলকে ডাকলো,

‘ফুল চা দিয়া যাইস।’

অভি ভ্রু কুঁচকে বাপের দিকে তাকালো। সবার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কাকে ডেকেছে সে। কিছু বলার আগেই ট্রে হাতে ফুলের প্রবেশ। সুফিয়া বিবি মুখ পানসে করে বললো,

‘এতোখন লাগে আইতে? পোলাডা আমার কহন চা চাইছে?’

ফুলের একবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো, “আমি তো মেশিন। বলার সাথে সাথে সব হাজির করবো। বানানোর সময়ও নিবো না”। কিন্তু অভিকে দেখে চুপ হয়ে গেলো। শাশুড়ীর সাথে গলা মিলালো সোহেলী বেগম।

‘প্লেন দিয়া আইছে না আম্মা। সময় তো লাগাবোই। এতো ডিলা কোম্পানি মাইয়া। কোন কাম সময়মতো করে না।’

আনোয়ার সর্দার ধমকে উঠলো,
‘আহ কি শুরু করলে তোমরা? চা বানাইতেও তো সময় লাগে।’

অভি চোখ তুলে ফুলের দিকে তাকালো। তাকিয়ে নিজেই বিমোহিত। চোখের সামনে যেনো সদ্য ফোটা, তাজা এক ফুল দাঁড়িয়ে আছে। ফুলের চোখের অস্থির চাহনি দেখে বুক সমানতালে ঢিপঢিপ করছে। নিচু স্বরে আনোয়ার সর্দারকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ও কে আব্বা?’

‘তোর মনোয়ার চাচার বড় মাইয়া ফুল।’

‘সেই ফুল, যার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিলো?’

চমকে জিজ্ঞেস করলো অভি। আনোয়ার সর্দার মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে ছেলের কাঁধের চাপর মেরে বললো,

‘হো সেই ফুল। যারে তুই বিয়া করতে রাজী হোস নাই। তহন কতবার কইছিলাম মাইয়াডারে একটু দেখ তোর পছন্দ হইবো। কিন্তু তুই আমার কথা হুনোসই নাই। তুই যদি ওরে তহন বিয়া করতে রাজী হইতি তাইলে এতো কাহিনি হইতো না।’

অভি অবাক চোখে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা তার বউ হতো। কি ভুল করেছে সে? গলায় মালা করে রাখা ফুলকে সে পায়ে ঠেলে দিয়েছে। মনে মনে আফসোস করে বললো,

‘অনেক বড় ভুল করে ফেলেছিস অভি। অনেক বড় ভুল। ভুলগুলো না হয় এবার ফুল হয়ে যাক।’

চেচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছেন সোহেলী বেগম। কারণ হলো পুষি। অভির জন্য জ্বাল করে রাখা এক কেজি দুধের অর্ধেক খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে।

‘হতচ্ছাড়া বিলাই। সামনে পাইলে এক কো’পে তোর ক’ল্লা ফালামু। আমার পোলাডায়ও আছে। জীবনে পালে নাই কোন কু’ত্তা, বিলাই। বুড়া বয়সে বিলাই পালনের শখ জাগছে। আধা কেজি দুধ খাইয়া ফালাইছে। এহন কি বিলাইয়ের মুখের দুধ পোলাডারে খাইতে দিমু? পুরা এক কেজি দুধ নষ্ট। আরেকদিন দেইখা লই। তাইলে বস্তায় বাইন্দা নদীতে হালায় দিমু।’

নূরজাহান মা কে শান্ত করার উদ্দেশ্য বললো,
‘চিল্লাচিল্লি করলে কি এহন দুধ ভালো হইবো? রমিজ চাচারে দিয়া গোয়াল গো থিকা দুধ নিয়া আহো। আর বিলাই লইয়া কথা কইয়ো না। শুভ বাড়িত আছে। হুনলে ঝামেলা করবো। এতোদিন পর বড় ভাই আইছে অশান্তি কইরা হেরে যাইতে গা বাধ্য কইরো না।’

‘কিন্তু বিলাইডা করলো কি দেখ? আমার মেজাজ বহুত খারাপ হইতাছে।’

‘ হাতের কাছে পাইলে বাঁশের কঞ্চি দিয়া কয়ডা কষাইয়া বারি দিও। তাও এহন চুপ থাকো।’

মপয়ের কথায় মুখে কুলুপ আঁটলেন সোহেলী বেগম। তবে এখনো ফোঁস ফোঁস করা অবধারিত রেখেছেন। শুভ উপরের কামরা থেকে সব শুনতে পারছে। সে জানে সামনাসামনি তার মায়ের কোন সাহস নেই। তাই নিচ থেকে চেচাচ্ছে। পুষির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,

‘কিরে পেট ভরেছে?’

পুষি বোধহয় শুভর কথা বুঝতে পারলো। ম্যাঁও করে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। পেট তার ফুলে ঢোল হয়ে আছে। কতদিন পর দুধের স্বাদ পেয়েছে। তাও শুধু মনিবের জন্য। নরম পায়ে হেঁটে শুভর পাশে ঘেঁষে বসলো পুষি।শুভ ওর পশমে আঙুল চালাতে চালাতে হেসে বললো,

‘ভালো কইরা চাইলে দিতো না। তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হইলো। এক ঢিলে দুই পাখি মারলাম। তোর পেটও ভরলো, অভি সর্দারের খাঁটি দুধ খাওয়া হলো না।’

পৈশাচিক আনন্দে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো শুভ। পুষি ফ্যাল ফ্যাল করে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো। ভালো-মন্দ কিছুই বুঝলো না।

মাথার ভেতরটা কেমন জানি করছিলো বলে দুপুরের পর ভাতঘুম দিয়েছিলো ফুল। আছরের আজানের আগে উঠে পরলো। নাকে সুগন্ধি জাতীয় কিছুর ঘ্রাণ পাওয়ায় চোখ খুলে পুরো কামরায় বুলালো। দক্ষিণের জানলার সামনে তাকাতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। শুভ সামনে মুখ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পরনে কালো শার্ট, লুঙ্গি। পেছনে হাত রেখে অনেকটা আরাম দাঁড়ানো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতের আঙুলের কোণায় লুঙ্গির কোণা। ফুল তাড়াহুড়ো করে উঠে পালাতে চাইলে খাটের পায়ার সাথে বেজে ব্যাথা পেলো। আউচ করে উঠতেই শুভ ঘুরে তাকালো। ফুলকে পা ধরে বসে থাকতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে ঝাড়ি মেরে বললো,

‘চোখে দেহোস না? এতো উড়ুউড়ু করোস কেন? চোখ কই লইয়া হাটোস? পালি তো ব্যাথা। এতে কার ক্ষতি হইলো? দেহি কই পাইছোত?’

ফুল চোখ কুঁচকে অভিমানী ভঙ্গিতে ঠোঁট ফুলালো। ছেলেটার মুখে রসকষ কিচ্ছু নেই। জন্মের সময় মুখে মধু না দেওয়ার কুফল এটা। কই ব্যাথা পেয়েছে ভালো করে জিজ্ঞেস করবে। তা না করে ঝাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। ফুল হাত দিয়ে পা আটকে ফেললো। তা দেখে শুভ রাগে দাঁত কটমট করে বললো,

‘হাত দিয়া আটকায় রাখছোত কেন? সরা হাত। আমারে দেখতে দে।’

ফুল সরালো না। শক্ত করে পায়ে হাত চেপে রাখলো। শুভও কম যায় না। জোর করে ওর হাত সরিয়ে দেখলো পায়ের পাতা লাল হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে জগের থেকে হাতে পানি নিয়ে ফুলের পায়ের কাছে বসলো। ব্যাথার জায়গায় পানি দিয়ে জোরে ডলতে লাগলো। অন্য সময় হলে ফুল চিৎকার করে উঠতো। কিন্তু এখন চোখ, মুখ কুঁচকে শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করতে লাগলো। ভাবখানা এই ব্যাথায় ম’রে যাবে তবুও শুভর সাথে কোন কথা বলবে না।

ফুলের চোখ দুটো আশেপাশে বিদ্যমান। তবুও শুভর দিকে এক পলক তাকাচ্ছে না। এই চোখের ভাষা শুভ বুঝে। অভিমান! তার কইতরির মা অভিমান করেছে। সব পুরুষ চোখ দেখে নারীর মনের খবর বুঝতে পারে না। যারা পারে তাদের হারিয়ে যেতে দিতে নেই। যত্ন করে রেখে দিতে হয়।শুভ আড়চোখে একবার ফুলের দিকে তাকিয়ে আড়ালে হাসলো। জব্বর অভিমান করেছে ফুল। এ অভিমান ভাঙাতে তার বহুত নাকানিচুবানি খেতে হবে।

#চলবে

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_15
#Writer_NOVA

‘ফুল একটু দাঁড়াও।’

অভির ডাকে ফুলের চলন্ত পা দুটো থেমে গেলো। তবে সে পিছু ঘুরলো না৷ অভি দৌড়ে ফুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু দৌড়ানের কারণে সে হাঁপাচ্ছে।

‘কিছু বলবেন?’

‘বলতেই ডেকেছি।’

‘জলদি বলুন। আমার কাজ আছে।’

ফুল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। অভি চোখের সরু ফ্রেমের চশমা খুলে আঙুল দিয়ে মুছে পুনরায় পরলো। ফুলের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললো,

‘চলো, হাঁটতে হাঁটতে বলি।’

‘আপনার কথা শোনার এতো সময় আমার নেই। তাই যা বলার দ্রুত বলেন।’

ফুল মুখ কঠিন করে বললো। অভিকে তার এতদিন ভয় করলেও এখন বিরক্ত লাগে। অভি গত কয়েকদিন যাবত ফুলের সাথে এমনভাবে চিপকে আছে যে ফুলের বিরক্তি চলে এসেছে। অভি, ফুল চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো৷ ফুলের অস্বস্তি লাগছে। কোথায় শুভর পাশাপাশি থাকলে তো এমনটা লাগে না। অভির সাথে থাকায় এতো অসহ্য লাগছে কেনো? মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলে অনেক ভালো লাগতো।

‘চুপচাপ কেনো? কিছু বলো?’

ফুল অভির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
‘আপনি কিছু বলতে আমাকে ডেকেছেন। আমি নই।’

‘ওহ, হ্যাঁ! চলো, পুকুরপাড়ের সিমেন্টের বেদিতে গিয়ে বসি।’

‘দেখুন, আপনার সাথে আজাইরা বকবক করার কোন সময় নেই আমার। তাই আপনার রাস্তা আপনি মাপুন।আমােে আমার মতো থাকতে দিন।’

‘তুমি কি আমার প্রতি বিরক্ত হচ্ছো?’

ফুল দাঁতে দাঁত চেপে ভেতর থেকে আসা দমকা রাত
রাগটাকে সংযত করে নিলো। বিরক্তি তার চোখে, মুখে ফুটে উঠেছে। অভি যেনো দেখেও দেখলো না। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ এসে ফুলের মুখে লুকোচুরি খেলছে। সামনে থাকা ছোট চুলগুলো হালকা বাতাসে চোখের সামনে এসে বারি খাচ্ছে। বিরক্তিতে কাউকে এতো সুন্দর লাগে ফুলকে না দেখলে জানতো না অভি। মনে মনে আবারো আরেকবার আফসোস করলো। কেনো যে সে ফুলকে না দেখে বিয়েতে মানা করে দিয়েছিলো? সেদিন রাজী হলে ফুল শুধু তার হতো। শুধুই তার!

বড় বটগাছের সামনে সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে বসার উপযুক্ত জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বসে আড্ডায় মেতেছে পলক, শুভ, হাসান, হানিফ। বাকি দুজন এখনো এসে পৌঁছায়নি। হঠাৎ হাসান বলে উঠলো,

‘হুনলাম তোর চাচতো বোইনের লগে নাকি তোর বড় ভাইয়ের বিয়া ঠিক হইছিলো।’

শুভ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। সেই প্যাকেট থেকে সবেই একটা সিগারেট দুই ঠোঁটে মাঝে চেপে ধরেছিলো। হাসানের কথা শুনে চোখ তুলে ঠান্ডা, শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হাসান তাতে দমলো না। সে দমবেও না। সেবার মেয়েটার কারণে শুভ তার গায়ে হাত তুলেছে। এতো সহজে ভুলে যাবে নাকি সব?

‘তোগো কি দুই ভাইয়ের কি সমস্যা রে? সবসময় একটা জিনিস লইয়া পরোস।’

পলক ধমকে উঠলো,
‘হাসান কি শুরু করছোত? পুরাইন্না কথা কেন তুলতাছোত?’

হানিফ মুখ পানসে করে বললো,
‘মা’ইর খাইবো তাই।’

শুভ দিয়াশলাই দিয়ে সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়ে বড় করে টান দিয়ে ধোঁয়া উপরে ছাড়লো। পলকের কথার রেশ ধরে বললো,

‘ওর হেইদিনের মা’ইরে পোষায় নাই।’

হাসান কোঁৎ করে উঠলো,
‘ঐদিন একবারে বেশি করছোত। নিজেরে মাইয়াডার সামনে সাধু প্রমাণ করোনের লিগা হুদাহুদি (শুধু শুধু) আমগো মা’রলি।’

‘পুনরায় হেই কথা কইলে আবার মা’রমু। বন্ধু, শত্রু মানমু না। ওরে নিয়া যে কথা কইবো তার কইলজা টাইন্না ছিড়া ফালাইতেও দুইবার ভাবমু না।’

শুভ হিমশীতল চাহনি ও হুমকিতে এবার ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো হাসান। পলক চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘মাইয়াডার প্রতি এতো টান কেনরে? আমগো ভাবী নাকি?’

শুভ কপাল কুঁচকে তাকালো। তা দেখে পলক আমতা আমতা করে বললো,

‘না মানে এমনে জিগাইলাম। কৌতুহল হইলো।’

‘ওরে নিয়া কারো কৌতুহল না থাকনোই নিজের লিগা ভালা। জানোসই তো আমার মুখের থিকা বেশি হাত চলে।’

হানিফ জিজ্ঞেস করলো,
‘মাইয়াডার মধ্যে কি এমন পাইলি শুভ? যার লিগা তুই এমন আজব ব্যবহার করোছ?’

শুভ উত্তর দিলো না। উদাস মনে বাটগাছের ডালের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো৷ গাছের ডালে একজোড়া শালিক বড্ড চেচামেচি করছে৷ একটা পাখি চেচাচ্ছে আরেকটা চুপ করে রয়েছে। শুভর মনে হলো চেচামেচি করা পাখিটা মপয়ে পাখি হবে৷ শাসন করার অভ্যাসটা তো তাদেরই। এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে শুভ কল্পনা করলো তাকে ফুল এভাবে শাসাচ্ছে সে চুপচাপ শুনছে৷

হানিফের কথার পিঠে শুভর বলতে ইচ্ছে করেছিলো, মেয়েটার মধ্যে আমি সব পেয়েছি। আমাকে শাসন করার, সামলে রাখার ক্ষমতা যে মেয়েটার মধ্যেই মজুত। কিন্তু কিছু বলবে না সে। শালারা, ভারী ধুরান্দাজ। একবার যদি বুঝে যায় শুভর দূর্বলতা ফুল তাহলে সুযোগ বুঝে কি যে করবে শুভ নিজেও জানে না। মানুষ যে বড় স্বার্থ সন্ধানী।

‘অভি বাজান আমার, তোর কি কিছু লাগবো?’

‘না, মা! আমি এভাবেই ঠিক আছি।’

‘চা খাবি?’

মায়ের প্রশ্নের উত্তরে অভি ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘একটু আগে ফুল বানিয়ে দিয়েছিলো।’

ফুল এক পলক অভির দিকে তাকিয়ে দেখলো না। মুখে গতকালের মতো কোন বিরক্তির ছাপ নেই। সে মন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করছে৷ ঝুমুর রুটি বানানোর জন্য কলসি থেকে পাতিলে পানি ঢেলে গরম বসিয়ে দিলো। সোহেলী বেগম ফুলকে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কতক্ষণ লাগবো আর? তহন থিকা দেখতাছি পিয়াইজ নিয়া বইয়া রইছোত।’

ফুলের উত্তরটা ঝুমুর দিলো,
‘আমরা কি মেশিন চাচী? কাম করতে একটু দেরী লাগেই। আপনি হুদাই খিটখিট শুরু করেন।’

ঝুমুরের উত্তরটা পছন্দ হলো ফুলের। একদম মোক্ষম জবাব। প্রকাশ্যে ঝুমুরকে বাহবা দিতে না পারলেও মনে মনে বাহবা ঠিকই দিলো। সোহেলী বেগম ঠিকই বলে। ঝুমুর তার সাথে থাকতে থাকতে প্রতিবাদী ভাষা শিখেছে। প্রথম প্রথম কারো মুখের ওপর কথা বলতো না ঝুমুর। আজকাল যেনো কাউকে ছাড়েই না। ফুল যেগুলো এড়িয়ে যায় সেগুলো সে নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নেয়।

‘মুখে খই ফুইট্টা গেছে। আগে বোমা মা’রলেও মুখ দিয়া কথা বাইর হইতো না। আর এহন কথার ফুলঝুরি ছুটে৷ কমামু নে। খাড়া, একটু দেরী কর।’

‘যুগ পাল্ডাইছে না চাচী। আগের মতো কি সব আছে কন? এর লিগা আমি পাল্ডাইলাম।’

সোহেলী বেগমের কথার পিঠে আবরো কথা বললো ঝুমুর। ফুল ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো। সোহেলী বেগম নীরবে ক্রুর দৃষ্টি ছুঁড়লেন ঝুমুরের দিকে। কিন্তু ঝুমুর আর ভুলেও সেদিকে তাকায়নি। সে চিকন বাঁশের কঞ্চি চুলোর ভেতরে গুঁজে দিলো। আগুনের খোরাক পেয়ে দাউদাউ করে শিখা উপরে উঠতে লাগলো৷ সোহেলী বেগম রাগটাকে মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখলো। ছেলের সামনে নিজের আসল রূপ খানা দেখাতে চাইছেন না।

ফুল পেঁয়াজ কাটা রেখে আটার ডিব্বা সামনে নিলো। অভি বই হাতে বাশের মোড়ায় বসে আছে। ভাবখানা এই যে সে পড়ছে। কিন্তু সে বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না৷ আড়চোখে বারবার ফুলের দিকে নজর দিচ্ছে। ফুল লক্ষ্য না করলেও দোতলা থেকে বিষয়টা চোখ এড়ালো না শুভর। সে বারান্দার সামনে মাটির চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অভির ভাবভঙ্গি খেয়াল করছিলো। পুরো বিষয়টা যখন তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো তখন হাতে থাকা কাপটা মেঝেতে ছুঁড়ে মা’রতে উদ্যত হলো। কিন্তু সামনে তার পায়ের কাছে পুষি বসে আছে। কাপটা ভাঙলে ভাঙা টুকরো এসে পুষির গায়ে লেগে যেতে পারে। পুষি তার বড্ড আদুরে। তবে ফুলের থেকে বেশি নয়। ফুলের সাথে কারো তুলনা হয় না। শক্ত করে কাপটাকে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখলো শুভ। সে তার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে ভেবে, নিজে নিজে অবাক হয়ে গেলো।

আনমনে হাঁটতে হাটতে কিছু ভাবছিলো ফুল। পাশের খুঁটির সাথে পা লেগে যেই মাত্র হেচোট খাবে সেই মাত্র একটা হাত এসে টেনে সরিয়ে নিলো। ফুল ভেবেছিলো অভি। তাই কিছু কড়া কথা শুনানোর জন্য ঠোঁট খুলেছিলো। কিন্তু মুখ উঠিয়ে দেখলো শুভ! মুহুর্তেই মেজাজটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।

‘তুই কিরে? কোনদিক চাইয়া হাটোস? এতবড় একটা খুঁটিও চোখে লাগে না তোর। তোরে নিয়া আর পারি না। এতো বেখায়ালে কেউ হাঁটাচলা করে?’

ফুলের বলতে ইচ্ছে করছিলো, ‘তুমি আছো না খেয়াল রাখার জন্য। তুমি খেয়াল রাখলে আমি হাজারবার বেখেয়ালি হবো। ইচ্ছে করে হবো।’ কিন্তু মুখে টু শব্দ করলো না। শুভ বুঝতে পারলো ফুলের অভিমান এখনো কমেনি। কমবে কি করে? সে কমার জন্য কিছু করেছে নাকি? যখনই দেখা হয়েছে ধমকি-ধামকি ছাড়া ভালো করে একটা কথাও বলিনি। ফুল পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে শুভ বাহু ধরে টেনে নিজের সামনে আনলো। গালে আলতো করে এক হাত ছুঁয়ে শান্ত গলায় বললো,

‘আমার লগে এহনো অভিমান কইরা আছোত কইতরির মা? তুই কথা কবি না? তুই কথা না কইলে আমার যে ভালো লাগে না। তোর মন চাইলে আমারে যা মন চায় শাস্তি দে। তাও আমার লগে ইট্টু কথা ক। আমার মনে হইতাছে কত জনম ধইরা তোর মুখে নিজের নাম হুনি না।’

শুভর আকুতিভরা কন্ঠে ফুল চমকে তাকালো৷ এ কোন শুভর দেখা মিললো তার সাথে? এতো নরম গলায় তো শুভ কথা বলে না। বিস্ময়ে ফুলের চোখের পলক পরছে না। শুভ সেটা বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো,

‘আমার ভুল হইছে। তুই যদি এর লিগা আমারে কানে ধইরা উঠবস করতে কস তাও করমু। তুই শুধু আমার লগে একটু কথা ক।’

শুভ দুই কানে হাত দিয়ে উঠবস করতে শুরু করলো৷ ফুলের চোখ দুটো এবার বোধহয় কোটর থেকে বেরিয়ে বলের মতো মাটিতে ড্রপ খাবে৷ এতো বিস্ময় সে নিতে পারছে না। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। জ্ঞান হারাবে নাকি?

#চলবে