কোন কাননে ফুটিবে ফুল পর্ব-১৬+১৭

0
160

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_16
#Writer_NOVA

শরৎ এর আকাশটা দেখতে চমৎকার লাগে৷ সাদা তুলোর পাজার মতে শুভ্র মেঘগুলো সারা আকাশ জুড়ে ছোটাছুটি করে। মাঝে মধ্যে সকালের রোদের সাথে সেই মেঘগুলো পাল্লা দিয়ে কোথায় জানি হারিয়ে যায়। সেটা আরো বেশি আকৃষ্ট করে ফুলকে৷ চোখ ডলে খাট থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়ালো। জানালা খুলে দিতেই এক ঝাটকায় সকালের বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করলো। বাতাসের ছটা গায়ে লাগতেই ফুলের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। শ্বাস টেনে অক্সিজেন নিলো৷ চুল ঠিক করতে করতে এদিক সেদিক তাকাতেই চোখ পরলো টেবিলের ওপর। ওমনি তার কপাল কুঁচকে গেলো। আপনমনে বললো,

‘এগুলো এখানে কে রাখলো?’

সদ্য গাছ থেকে তুলে আনা তাজা শিউলি ফুলের ভীষণ পছন্দের। ফুলগুলোকে যে কেউ একটু আগেই কুড়িয়ে এনেছে তার প্রমাণ গায়ে লেগে থাকা শিশির বিন্দু। দূর্বা ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো ফুলের গায়ে লেপ্টে আছে। ফুল অবাক হলো। এতো সকালে শিউলি তার কামরায় কে রেখে গেলো? সাথে ছোট এক টুকরো চিরকুট। চিরকুট হাতে নিয়ে ভাজ খুললো।

❝আমার ফুলের জন্য উপহার হিসেবে ফুল ছাড়া অন্য কিছু পেলাম না।❞

ইতি~~
তোমার……..

ডট ডটের জায়গায় কিছু নেই দেখে ফুলের রাগ হলো। মন বলছে এটা অভির কাজ। অভি ছাড়া কেই বা করবে? অভি না থাকায় আগে তো কখনে এমনটা হয়নি। আজ হয়েছে তার মানে অভির কাজ। ফুল ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে চিরকুটটাকে দলা মোচড় করে টেবিলের কোণায় ছুঁড়ে মা’রলো। এই ছেলের চিরকুট সে কিছুতেই রাখবে না। ফুলগুলো ছুয়েও দেখলো না। অযত্ন, অবহেলায় টেবিলের কোণায় পরে রইলো। ফুল দাতা যদি এই অবহেলা দেখতো তাহলে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেতো।

‘তুই ফুলের আগেপিছে এমন ঘুরাঘুরি করোস কেন?’

শুভর কন্ঠে ভ্রু যুগল কুঁচকে ঘাড় কাত করে তাকালো অভি। হাতে থাকা দূর্বা ঘাসগুলো হাতে পিষে দূরে ছুঁড়ে মারলো। হালকা হওয়ায় বাতাসে তা নিজের শরীরে এসেই পরলো। অভির এই হেয়ালিপনা শুভর ভালো লাগলো না। পূর্বের থেকে দ্বিগুণ গলায় চেচিয়ে বললো,

‘তুই ওর পিছনে ঘুরবি না।’

অভিও কম যায় না। ত্যাড়ামি করে উত্তর দিলো,
‘একশ বার ঘুরবো।’

‘না।’

‘কেন?’

‘আমি কইছি তাই।’

‘তোর কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’

‘আমারে রাগাইস না অভি। তাইলে ভালো হইবো না।’

অভি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তা দেখে শুভর মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠলো। এগিয়ে এসে অভির শার্টের কলার ধরে হাত উঠিয়ে ঘুষি দেওয়ার ভঙ্গি করে ভয় দেখিয়ে বললো,

‘আমি কউছি ওর থিকা দূরে থাকবি। তার মানে দূরে থাকবি। আর কোন কথা কবি না।’

‘তোকে ভয় পাই নাকি আমি? দূরে যা৷ আমার যা মন চায় তা করবো। তুই বলার কে?’

অভির কথা বলতে দেরী। ওর নাক বরাবর ঘুষি পরতে দেরী নয়। অভির মাথাটা ঝিঝি করে উঠলো। আচমকা আক্রমণে তার মস্তিষ্ক মিনিট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মাথা ঝাড়া দিয়ে নিজের অস্তিত্বে ফিরে এসে হাসতে হাসতে বললো,

‘আমার ফুলকে পছন্দ হয়েছে তার মানে ওকেই আমার লাগবে৷ তুই যতই মা’রিস, কা’টিস আমি দমবো না। ভুলে যাস না আব্বা ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো।’

‘ঠিক করছিলো৷ কিন্তু তুই না কইরা দিছোত। তুই আর ওর দিকে চাবিও না। ও এখন আর তোর না। আমার জিনিসে নজর দেওয়া বন্ধ কর।’

‘তুই সবসময় আমার জিনিসে নজর দিস।’

‘তোর কাছে একটা সুযোগ আছিলো। তুই নিজে ঐটা হারাইছোত। এহন আমি তোরে কোন সুযোগ দিমু না।’

‘আমি তোর কোন কথা শুনবো না। দরকার পরলে গাছ থেকে ফুলকে ছিঁড়ে হলেও নিজের কাছে রেখে দিবো।’

শুভ রেগে পরপর দুটো ঘুষি অভির নাকে বসিয়ে দিলল। অভির নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পরলো। তবুও অভির মুখে হাসির রেশ লেগে আসছে। জিদে আরো দুটো দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই ফুল এসে টেনে অভির থেকে সরিয়ে দিলো। চিৎকার করে বললো,

‘কি করছো শুভ ভাই? পাগল হয়ে গেছো? বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দিছো কেনো? তুমি কি ভালো হবে না? নাক দিয়ে রক্ত পরছে।’

অভির নাকে বরফ ধরে শুভকে ইচ্ছেমতো বকছেন সুফিয়া বিবি। অভি সুন্দর হওয়ায় নাকের ডগাটা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। সোহেলী বেগম চুপ করে থাকলেও ছোট ছেলের প্রতি তারও রাগ লাগছে৷ অদূরে বাটি ভর্তি বরফ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমুর।

‘তোর ছোট পোলার কাম দেখছোত বড় বউ? পোলাডার নাক ফাডায় হালাইছে। কই গেছে, কই গিয়া পলাইছে? আইতে ক আমার সামনে৷ দেহি গায়ে কত শক্তি হইছে।’

সুফিয়া বিবির কথায় মুখ বাকালো ঝুমুর। চিবিয়ে চিবিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

‘শখ দেইখা বাঁচি না। হুহ, বুড়ি নিজে হাটে লাঠি দিয়া।অথচ ভাবখান দেহো। মনে হইতাছে একলাই শুভ ভাইরে কাইত কইরা হালাইবো।’

‘ঐ ছেমরি কি বিরবির করোস?’

ধমকে উঠলো সুফিয়া বিবি। ঝুমুর দ্রুত তটস্থ হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘কিছু না দাদী।’

সুফিয়া বিবি এদিকে খেয়াল দিলেন না। অভির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো,

‘ব্যাথাডা কি কমছে ভাই?’

‘একটু কমেছে।’

‘বরফডা ধইরা রাখ। রক্ত পরা কমবো৷ অমানুষ হইতাছে৷ বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলে৷ আহুক আজকে আনোয়ারে৷ ওর নাক যদি না ফাডাইছে আমার নাম ফিরা নাম রাখমু।’

সোহেলী বেগম ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

‘আম্মা, বাদ দেন না। ওর বাপেরে এসব জানানোর দরকার নাই। তাইলে আবার ঝামেলা লাগবো। জানেনই তো শুভ কেমন! এহন যদি আবার ঝগড়া কইরা দুই পোলার মধ্যে কেউ যায় গা। আমার ভাল্লাগবো না।’

সুফিয়া বিবি হুংকার দিয়ে উঠলেন।

‘তোর প্রশ্রয়ে কুট্টিডায় মাথায় উডছে। ছোড বেলা থিকা টাইট দিয়া রাখলে আজকে এই দিন দেখতে হইতো না। কতবড় সাহস দেহাইছে তুই ভাবতে পারোস? বড় ভাইয়ের গায়ে হাত তুলছে৷ শুধু গায়ে হাত তোলা অব্দি থাকলেও মানোন যাইতে৷ ও তো নাক ফাডায় হালাইছে। দেখতো চাইয়া। পোলার নাকের কি অবস্থা!’

‘জিদ আমারো উঠতাছে আম্মা।কিন্তু আমার বাড়িতে অশান্তি ভাল্লাগে না। এতদিন পর পোলাডা আইলো। এহন কি আবার অশান্তি কইরা ওরে হারাইতে চামু?’

‘তোর ঘরে কি দিলো আল্লায়? দুইডায় সাপ বেজি। কারো লগে কারো মিলে না। আমার আনোয়ার, মনোয়ার কহনও এমন করে নাই। দুইজন কি মিইলা মিইশা থাকছে৷ এহন দুই ভাইয়ের কি মিল! আর এই দুইডায় পারলে মিনিটে মিনিটে দাও নিয়া কোপাকুপি লাগে।’

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন সোহেলী বেগম। শাশুড়ী মিথ্যে বলেনি। আনোয়ার, মনোয়ার সর্দার দুজনের মধ্যে ভীষণ ভাব। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। একজন অপরের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। আর অভি, শুভ যেনো একে অপরের জান নিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এর পরিণাম দাঁড়াবে কি? নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। মনটা তার কু’ডাকছে। আগাম বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে কেঁপে উঠলেন সোহেলী বেগম।

মাথায় ঠান্ডা বস্তুর সংস্পর্শ পেতেই মাথা উঠালো শুভ। ফুল ওর মাথায় বরফ ধরে রেখেছে। ক্ষীণ শ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে রাখলো।

‘তোমরা মাত্র দুইটা ভাই। নিজেরা মিলেমিশে থাকবে বাবা, চাচার মতো। তা না করে ষাড়ের মতো এমন গুতাগুতি করো কেন?’

‘আমি ষাঁড়?’

‘অবশ্যই, উন্নতি প্রযুক্তির অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড় গরু।’

শুভ চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফুল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। শুভর চোখ দুটো নিস্তেজ হয়ে এলো। আগের জৌলুশ হারিয়ে দেখা দিলো একরাশ মুগ্ধতা। অবশেষে তার কইতরির মায়ের অভিমান ভেঙেছে। আজকাল ফুলকে যেনো চোখের আড়াল করতেই মনন চায় না। শুভর ইচ্ছে হয় ফুলকে চব্বিশ ঘণ্টা ওর সামনে বসিয়ে রেখে মন ভরে দেখতে৷ এর জন্য শুভর বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এখন আরো কমাতে হবে৷ অভির নজর থেকে রক্ষা করতে।

‘কি দেখো?’

‘তোরে!’

‘কেন?’

‘ভাল্লাগে।’

‘ভাল্লাগে কেন?’

‘জানি না।’

ফুল ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকালো। শুভ হাত দুটো কোলে রেখে দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ করলো। ফুল শুভর মাথা থেকে হাত সরিয়ে দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। এতে শুভর মাথার ওপরে থাকা বরফ দুটো শব্দ করে মেঝেতে পরে টুকরে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো। তাতে শুভর হেলদোল নেই।

‘শুভ ভাই!’

‘হু!’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘হুম কর।’

‘তুমি আমার এতো যত্ন করো কেন?’

শুভ চট করে ফুলের চোখে চোখ রাখলো। ফুল দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। শুভ চুলে চিরুনির মতো করে আঙুল চালিয়ে শান্ত গলায় স্পষ্ট, শুদ্ধ ভাষায় বললো,

‘সব বাগানে ফুল ফুটে না। যে বাগানের মালি ফুল গাছকে অনেক যত্ন করে, আগলিয়ে রাখে, সকল ঝড়ঝাপটা থেকে বাচিয়ে রাখে। সেই বাগানেই ফুলের অস্তিত্ব দেখতে সুন্দর লাগে।’

দিন যত যাচ্ছে ফুল তত অবাক হচ্ছে। আজও হলো। শুভ যে এতো সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে তা ফুল ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি। শুভর বলা প্রতিটা শব্দ ফুলের কানে মোহনীয় লাগছে। শুভ এক পলক ফুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘ফুলকে অনেক যত্ন করে আগলে রাখতে হয়। যা সব মালি পারে না। যত্ন, ভালোবাসার অভাব হলে অবহেলায়, অনাদরে ফুলের পাপড়ি অকালে ঝড়ে পরে। যত্ন করলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা সতেজ, প্রাণোচ্ছল থাকে। ফুল বাগানেই সুন্দর। সেটাকে ছিড়ে হাতে তুলে নিলে ভালো লাগে না।হাতে তুলে নেওয়া ভালোবাসা নয়। সাময়িক সময়ের মোহ। ফুলের স্থান বাগানে৷ যা যত্ন নেওয়ার অধিকার একমাত্র সেই বাগানের মালির।’

কত সুন্দর করে মনের ভাব প্রকাশ করলো! ফুলের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। ফুল বলতে কি শুভ তাকেই বুঝালো? ভেতর থেকে মন সায় দিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তোকেই বুঝিয়েছে৷ তুই অবুঝ নস।’

#চলবে

#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_17
#Writer_NOVA

সকাল সকাল ছোট ছেলেকে নিজের কামরায় দেখে অবাক হলেন আনোয়ার সর্দার। সাথে ললাটে চিন্তার ভাজে কুঞ্চিত হলো। ছেলে তার কোন বড় উদ্দেশ্য ছাড়া এই কামরায় পা রাখে না। পরিষদের অধিবেশনের কাগজগুলো সরিয়ে চশমা ঠিক করলেন। আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন উদ্ভ্রান্ত চেহারা। উসখুশ চাহনি মনে হচ্ছে কিছু বলবে। গম্ভীর সুর টেনে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু কইবা ছোট সর্দার?’

শুভ চমকে তাকালো বাবার মুখশ্রী পানে। দৃষ্টি স্থির। কতদিন পর চেনা মানুষের মুখে অচেনা ডাক। ভেতরটাকে কেমন জানি নাড়িয়ে দিলো। মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।

‘কইয়া ফালাও। কাহিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা আমি বুঝতে পারছি। তুমিও ভণিতা না কইরা কইয়া ফালাও।’

‘হো কিছু জরুরি কথা আছিলো।’

শুভর কন্ঠ টানা টানা। কাগজগুলো গুছিয়ে সামনের ছোট টেবিলে রাখলো। সেগুন কাঠের টি-টেবিল। আনোয়ার সর্দারের দাদার আমলের। রংটা মলিন হলেও শক্তপোক্ত বেশ। এখনকার কাঠের জিনিসপত্রের সাথে তুলনা করলে এই টেবিল সেরা। এতোটা শক্ত, মজবুত যে এর সাথে কোন মানুষ বারি খেলে ব্যাথায় টনটন করবে। বহুদিন স্টোর রুমে ছিলো। পরে আনোয়ার সর্দার বাপ-দাদার স্মৃতিকে নিজের কামরায় নিয়ে এসেছে। শুভ ছোটবেলায় এটার সাথে বেজে ধুপুসধাপুস পরে যেতো। ব্যাথাও পেতো প্রচন্ড। তাই এটাকে দেখে চোখ দুটো বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে। ছেলে যাতে ব্যাথা না পায় মূলত সেই কারণে আনোয়ার সর্দার টেবিলটাকে স্টোর রুমে তুলে রেখেছিলেন।

‘চটপট বইলা ফেল। আমার আবার দক্ষিণগঞ্জে যাইতে হইবো। সামনে পূজার মেলা। মেলার দিকনির্দেশনা দিতে হইবো। নয়তো গজামিল হইয়া গতবারের মতো মারামারি লাইগা যাইবো।’

‘ফুলের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?’

আনোয়ার সর্দার চশমা ভাজ করে পাঞ্জাবীর বুক পকেটে রেখে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘কি ভাবমু?’

‘ওরে এই বাড়িতে কেন আনছেন?’

‘আমার বাস্তি (ভাতিজী) আমার বাড়ি আইতে পারবো না?’

‘আপনে চেয়ারম্যান হইলে আমিও কিন্তু চেয়ারম্যানের পোলা। রাজনীতি আপনি করলেও সেই খবর আমি রাখি। হুদাহুদি যে আপনে ওরে বাড়িতে রাখেন নাই এডা আমার ভালো কইরা জানা আছে। রাজনৈতিক নেতারা সবকিছুতেই রাজনীতি খুঁজে।’

‘তাইলে তুই স্বীকার করলি তুই আমার পোলা।’

‘স্বীকার না করলে কি আমার বাপের নাম বদলায় যাইবো নাকি?’

উত্তরে প্রসন্ন হলেন না আনোয়ার সর্দার। কড়া চোখে ছেলের দিকে তাকালো। শুভর কোন হেলদোল নেই। সে দুই হাত বুকোর ওপর গুঁজে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ার সর্দার ক্ষীণ শ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘যা কইতে আইছোত তা কইয়া ফেল।’

‘ফুলরে আমি ভালোবাসি। বিয়া করলে ওরেই করমু। প্রেম-ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসী না। যারে ভালবাসমু তারেই বউ কইরা ঘরে তুলমু। আমার ফুলরে চাই। যদি ওরে আমার লগে বিয়া না দেন তাইলে ওরে নিয়া পলায় যামু। মান-সম্মান গেলে আপনের যাইবো। এমনি আমার মান-সম্মান কম। ঐটুকুর চিন্তা আমি করি না। তাই নিজের ভালো চাইলে ভাইয়ের লগে আমার বিয়ার কথা কন। যত তাড়াতাড়ি ওর লগে আমার বিয়া হইবো ততই আপনের ভালো।’

একদমে কথাগুলো বলে শুভ প্রস্থান করলো। বাপের কি মতামত তা শোনার প্রয়োজন মনে করলো না। আনোয়ার সর্দার বিস্মিত নয়নে ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। লাজ শরম সব খেয়ে ফেলেছে এই ছেলে। বাপের কাছে নিজের বিয়ের কথা বলতে একটুও মুখে বাঁধলো না। পরমুহূর্তেই মনে পরলো, এই ছেলের লজ্জা ছিলো কবে? এটা তো এমনি লাজহীন, বেশরম।

‘কি কুড়াও?’

অভির স্বর শুনে বিরক্ত ঘিরে ধরলো ফুলকে। এক দৃষ্টি ময়নার দিকে তাকিয়ে শিউলি ফুল কুড়ানো বন্ধ করলো। ওড়না টেনে বড় ঘোমটা দিয়ে অভির দিকে তাকালো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

‘দেখছেন না ঘোড়ার ডিম কুড়াচ্ছি।’

অভি বিষম খেলো। একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিলো শুভর সাথে থাকতে থাকতে কি এই মেয়েরও ত্যাড়ামি করার অভ্যাস চলে এসেছে নাকি? এই কথা জিজ্ঞেস করলো ফুল যে তাকে আরেকটু নাকানিচুবানি খাওয়াবে তা বুঝতে পেরে অভি চুপ হয়ে গেলো। তবে ময়না মুখ চেপে হাসছে।

‘কেমন আছো ময়না?’

‘ভালাই অভি ভাই। আপনে কেমন আছেন?’

হতশার সুর মিশ্রিত করে অভি বললো,
‘কিভাবে ভালো থাকবো বলো? এই বয়সে কি একটা বউ না হলে চলে? বউ ছাড়া কেমন থাকতে পারি ভাবো।’

ময়নাও কম যায় না। ফুলের বান্ধবী তো। আড়চোখে ফুলের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললো,

‘শহরে কি মাইয়ার আকাল পরছিলো? একটা ধউরা লইয়া আইতেন। চাচায় ঠিকই বিয়া দিয়া দিতো।’

‘না, আমার গ্রামের মেয়ে পছন্দ। একদম ফুলের মতো।’

ফুল চোখ লাল করে তাকাতেই অভি ইতস্তত করে দ্রুত পায়ের কাছ থেকে শিউলি ফুল তুলে নিলো। বেআক্কেল মার্কা হাসি দিয়ে বললো,

‘এই শিউলি ফুলের মতো আরকি।’

ফুল চোখ নামালো। অভিকে তার ইদানীং এতো বিরক্ত লাগে যে বলার বাহিরে। শুভর সাথে আকাশ-পাতাল তফাত। এই যে এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। যা ফুলকে অস্বস্তিতে ফেলছে। এমন অস্বস্তিতে শুভ কখনো ফেলেনি। শুভ সবার আগে খেয়াল করে ফুলের স্বস্তির বিষয়টা। সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর। এতোটা যত্ন, নজর যদি শুভ নিজের নিতো তাহলে অগোছালো ছেলে হিসেবে কারো কাছে পরিচিতি পেতো না।

‘চল ময়না, ঘাট পাড়ের দিকে যাই।’

‘তুই না কইলি ফুল টোকাইয়া (কুড়াইয়া) মালা গাঁথবি।’

‘না এখন আর ইচ্ছে করছে না।’

ফুল ময়নার হাত টেনে ঘাট পাড়ের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। অভি চোখ ছোট করে নিজের হাত দুটো পকেটে পুরে বিরবির করে বললো,

‘কতদিন আর আমার থেকে পালাবে ফুল? তোমাকে তো আমার করেই ছাড়বো।’

ফুল এই কথা শুনলে হয়তো প্রতিত্তোরে বলতো, ”আপনার মতো মানুষের জন্য জন্ম হয়নি আমার। যে আমাকে পায়ে ঠেলে দেয় আমি তার হই না। যে যত্ন করে মাথায় গেঁথে রাখে ফুল তাকেই পছন্দ করে।”

গোধুলির লগ্ন! ধরণী অপরূপ রূপে সাজে। শরতের আকাশটা এই সময় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। পাখপাখালিদের নীড়ে ফেরার তাড়া। কৃষক মাথাল হাতে বাড়ির পথে হাঁটছে। নিশাচর পাখিদের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠে। সবারই ঘরে পৌঁছানোর তাড়া।

ঘরে পৌছানোর তাড়াটা মাস খানিক আগেও শুভর ছিলো না। রাত দশটা, আগারোটার আগে বাড়িতে তাকে পাওয়া যেতো না। আর এখন যেনো সন্ধা হওয়ার আগেই বাড়ি যাওয়ার জন্য মন আনচান করে। মোটরসাইকেলের চাবি ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। রাস্তায় দেখা হলো বহু দিনের পুরনো বন্ধু ফয়সালের সাথে। গল্পগুজব, টং দোকানে চা-সিগ্রেট খেতে গিয়ে দেরী হয়ে গেলো। বাড়ি যখন পৌঁছায় তখন রাত আটটা। শুভর মোটরসাইকেলের শব্দ শুনে বারান্দা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ফুল। শুভর ছায়াটা দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে ছুটলো সদর দরজার দিকে। নুপুরের রুনুঝুনু শব্দে চারিদিকে বারি খাচ্ছে। সুফিয়া বিবির কানে যেতেই সে চেচিয়ে উঠলো,

‘রাত-বিরেতে দৌড়ায় কেডারে?’

‘তোমার সতিনে।’

মৃদু শব্দে উত্তর দিয়ে জিভে কামড় দিলো ফুল। উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলো বুড়ি শুনলে আস্ত রাখবপ না। কথা শুনাতে শুনাতে নানীবাড়ি পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনবে। দৌড়ের গতি কমিয়ে দিলো ফুল। এখন মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে সদর দরজার দূরত্ব চাঁদ থেকে পৃথিবীর দূরত্ব। যখুনি তাড়াহুড়ো থাকে তখুনি যেনো দেরী হয়। হলো তাই। সিঁড়ির গোড়ায় অভির সম্মুখে পরলো ফুল। অভিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে অভি হাত দুটো ছড়িয়ে পথ আটকিয়ে বললো,

‘এভাবে ছুটে কোথায় যাও?’

‘ম’রতে! যাইবেন?’

‘তুমি আমার সাথে এমন করো কেন?’

‘কেমন করলাম আবার?’

‘সবসময় কেমন ত্যাড়ামি করো।’

‘একে ত্যাড়ামি বলে?’

‘অবশ্যই।’

‘জ্বি না। ত্যাড়ামি কাকে বলে আপনার ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করেন। উদাহরণসহ দেখিয়ে দিবে।’

‘তুমি….

অভির কথা শেষ হওয়ার আগে সদর দরজায় কড়া নড়লো। ফুল অস্থির চিত্তে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো। এরপর অভিকে সরিয়ে দৌড়ালো সেদিকে।

‘কি হলো? কে এসেছে? এতো ছোটাছুটি করছে কেনো মেয়েটা?’

অভি আহাম্মক বনে গেলো। তাকে যেনো পাত্তাই দেয় না মেয়েটা। সে তো শুভর থেকে দেখতে শুনতে সবদিক দিয়ে এগিয়ে। তবুও তার প্রতি কোন আগ্রহ নেই ফুলের। অভি প্রথমে ভেবেছিলো গ্রামের সাধারণ মেয়ে। পটাতে কতক্ষণ লাগবে? এখন দেখছি সে ফুলকে চিনতে একটু ভুল করেই ফেলেছে।

‘এতক্ষণ লাগে গেইট খুলতে? কহন থিকা বাইরাইতাছি। কানে কালা হইয়া গেছত?’

ফুল হাঁটুতে হাত রেখে বড় করে দম টানলো। এতটুকু দৌড়ে আসতে গিয়ে হয়রান হয়ে গেছে।

‘আসতে কি সময় লাগে না? আমি কি উড়োজাহাজ যে উড়ে চলে আসবো। সবসময় এমন ঝাড়ি মা’রো। এরকম ঝাড়ি মারলে বউ পালাবে তোমার।’

শুভ সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
‘এত সহজনি? আমার বউ পালাইতে জীবনেও দিমু না। কইলজার ভিতরে ঢুকায় রাখমু।’

‘ইশ, কি প্রেম!’

‘প্রেম না ভালোবাসা।’

ফুল মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘ভালোবাসা না ছাই। আমি সহ্য করি দেখে। তোমার বউ ভুলেও সহ্য করবে না।’

‘করবো করবো। না কইরা যাইবো কই?’

শুভর কথায় মন খারাপ হয়ে গেলো ফুলের। সে অন্য কিছু আশা করেছিলো। ভেবেছিলো শুভ বলবে, “তুই ছাড়া আমারে কেউ যহন সহ্য করতে পারে না। তাইলে আমার বউ তুই হইয়া যা”। নিজের মনকে কড়া করে ধমক দিলো ফুল। বড্ড বেশি ভাবে। শুভ কি তেমন ছেলে যে মুখ ফসকে এসব কথা বলে ফেলবে। সে তো ভীষণ চাপা স্বভাবের। তবে কথার থেকে কাজে বিশ্বাসী। কাজে তার পরিচয় দেখিয়ে দেয়। ফুলের আনমনা ভাব দেখে শুভ চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

‘কিরে কই হারালি?’

‘কোথাও না। তুমি কলপাড়ে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।’

ফুল দাঁড়ালো না। ভেতরে যাওয়ার জন্য ঘুরে গেলো। চোখ দুটো কেমন জ্বলছে। শুভ পিছন থেকে মমতা মাখা গলায় ডাকলো,

‘কইতরির মা!’

ফুল থেমে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সামনে ঘুরলো।

‘হুম বলো।’

শুভ পিছন থেকে হাত সামনে আনলো। দুটো হাওয়ায় মিঠাই। অন্ধকারে হাত পিছনে থাকায় ফুল তা খেয়াল করিনি। এখন দেখে মুহুর্তের মধ্যে ফুলের মুখে হাসি খেলে গেলো। অবিশ্বাস্য চোখে শুভর দিকে তাকাতেই শুভ চোখ দিয়ে আশ্বাস্ত করে বললো,

‘হুম তোর।’

ফুল খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠলো৷ শুভর থেকে হাওয়ায় মিঠাই দুটো এক প্রকার কেড়ে নিয়ে খুশিতে দাঁত বের করে বললো,

‘তুমি কি করে জানলে আমার হাওয়ায় মিঠাই পছন্দ?’

শুভ চোখ নাচিয়ে বললো,
‘আমি তোর ব্যাপার সব জানি।’

ফুল অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘সব?’

‘হো সব।’

ফুল কথা বাড়ালো না। হাওয়ায় মিঠাই এর পকেটের ওপর হামলে পরলো। এক মুখে এক প্যাকেট শেষ। আরেক প্যাকেট ছিঁড়তেই খেয়াল হলো শুভকে একবারো সাধা হয়নি। না খাক, একবারের জন্য তো সাধা উচিত। মিঠাই একটু খানি ছিঁড়ে শুভর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘নাও খাও।’

শুভ ভ্রু কুঁচকে চোখ সরু করে বললো,
‘এতটুকু দিয়ে বড় উপকার করলেন।’

ফুল খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে আরেকবার সাধলো।

‘খাবা?’

‘না।’

‘তাহলে বসে থাকো। আমি এটা কারো সাথে ভাগ করি না। তবুও তোমাকে সেধেছি, এটাই অনেক বেশি।’

ফুল সেটুকু মিঠাই থেকে একটু নিয়ে মুখে পুরলো। বাকিটুকু মুখে দেওয়ার আগে শুভ এক কান্ড করে বসলো। ফুলের হাত টেনে আঙুলসহ মিঠাইটুকু নিজের মুখে পুরে নিলো। ফুল হালকা কেঁপে উঠলো। নিজের হাত টেনে নিয়ে শাসনের সুরে বললো,

‘কি করলে এটা? আগে সাধলাম তখন খেলে না। এখন আমার মুখের এঁটোটা টেনে নিয়ে খেলে।’

‘ঐটা এঁটো আছিলো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কে জানে খেয়াল করি নাই।’

শুভ শিস বাজাতে বাজাতে কলপাড়ের দিকে রওনা দিলো। ফুল স্তব্ধ হয়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ যে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। হঠাৎ হঠাৎ এহেন কান্ডে ফুল বুঝে উঠতে পারে না কি রিয়েকশন দিবে। যেমন এখন বুঝতে পারছে না। বেশি সময় ভাবতে পারলো না। শুভ কলপাড় থেকে চেচিয়ে উঠলো,

‘কইতরির মা, কল চাপ দিয়া যা।’

ফুলও কম যায় না। উচ্চ স্বরে বললো,
‘পারবো না। নিজেরটা নিজে করে নাও।’

‘তুইল্লা রাখলাম। পরে সুদ-আসলে ফেরত দিমু। মনে রাখিস কথাডা কইতরির মা।’

শুভর কথা ফুল গায়ে মাখলো না। ফুল ভেংচি কেটে হাওয়ায় মিঠাই মুখে পুরতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। পরেরটা পরে দেখা যাবে। আগে সে হাওয়ায় মিঠাই খেয়ে নিক।

#চলবে