খেলাঘর পর্ব-১২

0
3338

#খেলাঘর
লেখকঃ শাওন
পর্বঃ১২

লাজ চোখ খুলে যা দেখলো তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। গুলিটা ফারাজের গায়ে লাগার আগেই ঐ মহিলাটি সামনে চলে আসে। মহিলাটি পরে যাওয়ার আগেই ফারাজ ওনাকে ধরে ফেলে, আর মুখটা দেখতেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। এটা সে কি দেখছে?এতদিন পর সে তার এত প্রিয় একটা মানুষ’কে দেখছে যাকে দেখা মাত্রই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো,”মা!”
লাজ দৌড়ে গিয়ে মহিলাটির পাশে গিয়ে বসে যখন ফারাজের মুখে কথাটা শুনলো তখন সে একবার তার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।ফারাজ পাগলের মতো করছে,”মা,তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? মা তুমি এটা কি করলে?কেন করলে তুমি এমন? আমার জন্য কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিলে মা!”
মহিলা টি ওনার রক্তাক্ত কাঁপা হাতে ফারাজের গালে হাত দেবার আগেই চোখ বন্ধ করে নিলো।লাজ তারাতাড়ি ওনার নাড়ি পরীক্ষা করে বলে,” তোমাকে আমি পরে দেখে নিবো আগে ওনাকে বাঁচাতে হবে।”
লাজ কথাটা বলে মহিলার শরীরে হাত দিতে নিলে ফারাজ হাত ধরে ফেলে।তারপর চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,” তুমি হাত দিবে না আমার মায়ের গায়ে, আজকে তোমার জন্য আমার মায়ের এই অবস্থা।তুমি আমাকে কি দেখবে আমি তোমাকে দেখবো যদি আমার মায়ের কিছু হয় তো।”
ফারাজ মহিলাকে কোলে করে নিয়ে যেতে লাগলো। লাজ বোঝতে পারলো না ফারাজ ওনাকে মা মা কেন ডাকছেন?তাহলে কি সত্যি ওনি ফারাজের মা ছিলেন,তারমানে এজন্যই তিনি সকালবেলা ফারাজকে নিয়ে এত জোর দিয়ে কথা বলছিলেন।লাজও পিছু পিছু গেল, ফারাজ গাড়িতে তার মাকে শুয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে নিবে তখনই লাজ গাড়িতে উঠে বসে।ফারাজ কিছু বলতে নিবে তাঁর আগেই লাজ বলে,”এখন আমাদের ঝগড়া করার সময় নেই, দেরী হয়ে যাচ্ছে ওরে হয়তো আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।”
ফারাজ বোঝতে পারলো লাজের কথায় যুক্তি আছে তাই সে কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো। হসপিটালে আসতেই ফারাজের মা কে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফারাজ বাহিরে বসে থেকে চোখের পানি ফেলছে, আর একা একাই বলে যাচ্ছে…
-“কোথায় ছিলে মা তুমি এতদিন? তুমি আমার এতকাছে থেকেও কেন ধরা দাওনি? তুমি কেন আজকে আমার জন্য এমন করতে গেলে? মা গোআমি তোমাকে এতদিন পর পেয়ে হারাতে পারবো না।আল্লাহ দয়া করে তুমি আমার মাকে সুস্থ করে দাও!”
লাজ ফারাজের কান্না দেখছিল,সে ফারাজের সামনপ গিয়ে বলল,
-“খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না! আমারও এমন লেগেছিল যখন আমি শুনেছিলাম আমার বাবা মা আর এই পৃথিবীতে নেই।”
-“তার মানে তুমি ইচ্ছে করেই মাকে গুলি করেছো?”
-“আমি তোমাদের মতো এতটাও খারাপ মানুষ না যে একটা মাকে গুলি করবো। এতটুকু মন আমার আছে,তোমার মতো না!”
-“আমি তোমার মা বাবা’কে খুন করিনি।”
-“খোদার দুহায় লাগে আর মিথ্যা বলো না,আজকে তোমার মিথ্যার জন্য তোমার মায়ের এই অবস্থা। বর কত মিথ্যা বলবে তুমি,ওহ সরি তোমরা?”
-“আমি সত্যি বলছি খুন আমি করিনি,খুন করেছে আমার বাবার লোকেরা!হ্যা,আমি আজকে সব সত্য জেনেই তোমাকে বলতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি আমার কোনো কথায় শুনোনি।”
লাজ চমকে উঠলো সে ফারাজের সামনে গিয়ে বলে,”তোমার বাবা-র লোকেরা মানে?তুমি ছিলে না তাদের সাথে?”
-“নাহ,আমি সেখানে থাকা তো দূর এসব কিছু জানতামও না আর জানলে এসব কখনোই হতে দিতাম না।”
-“তাহলে আমাকে আয়েরা মিথ্যা কেন বলবে?”
-“আয়েরা মিথ্যা বলেনি!”
-“কি শুরু করছো তুমি? একবার বলছো তুমি ঐখানে ছিলে না আরেকবার বলছো আয়েরা মিথ্যা বলছে না।তাহলে কি হয়েছিল সেদিন?”
-“একটু শান্ত হয়ে বসো আমি তোমাকে সবটা খুলে বলছি।”
——-অতীতে——
ফারাজ লাজের সাথে রাগ দেখিয়ে কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসলো। নিজের বাবা’র প্রতি আনা মিথ্যা অভিযোগের বদলা নিবে ভেবে সে ভিতরে যায়। ভিতরে এসে দেখে কতগুলো লোক মাস্ক পরে মুখ ঢেকে আছে, লাজের বাবা’কে কতগুলো ঘুষি মারা মুখে দাগ হয়ে আছে, মায়ের গালে থাপ্পড়ের দাগ আছে।ফারাজ এতে কিছুটা রেগে গেল, সে আর যায়হোক বয়স্ক ব্যক্তিদের গায়ে হাত তুলা পচ্ছন্দ করে না। সে একে একে সবকটাকে রাম ধুলায় দিতে লাগলো, এক পর্যায় যখন ফারাজের সাথে পারলো না তখন লাজের বাবা মা’কে গুলি করে দেয়।যাতে করে বলতে না পারে তারা কে ছিলো?আর কে পাঠিয়েছিল তার কারণ যদি ফারাজ তার বাবার এসব কর্মকান্ড জানতে পারে তাহলে ফারাজ সরে আসবে। পর পর দুটি গুলিতে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে লাজের বাবা ও মা। ফারাজ হাতের পাশে থাকা ফুলদানি দিয়ে ঢিল মারে,সাথে সাথে লোকটির হাত থেকে গুলি পরে যায়। ফারাজ দৌড়ে গিয়ে গুলি ধরার আগে আগেই লোকগুলো জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। ফারাজ জানলার পাশে গিয়ে দেখে লোকগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না।পিছনে ফিরতেই দেখে আয়েরা দাড়িয়ে আছে। আয়েরা লাজের বাবা মা’কে নিচে পরে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠে।ফারাজ গুলিটা নিজের পিছনে রেখে বলে,” আয়েরা প্লিজ যা হয়েছে,তুমি কাউকে কিছু বলবে না।”
-“মেরে ফেললেন আঙ্কেল আন্টিকে?”
-“আয়েরা, সময় হলে সবটা জানতে পারবে কিন্তু প্লিজ এখন ওনাদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো ওদের এখনো দম আছে। আমি ততক্ষণে লাজকে নিয়ে আসছি,আর হ্যা কাউকে কিছু বলবে না।”
—–বর্তমানে—–
লাজ সবটা শোনার পর ফারাজের দিকে তাকালো, সে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। ফারাজ বলে,”ওহ আরেকটা কথা, তুমি হয়তো এটা জানতে চাচ্ছো আমি কি করে জানলাম ওরা আমার বাপের লোক ছিলো? তাহলে শোনো, তোমাকে আমি বলেছিলাম না আংটি টা আমার কেমন চিনা চিনা লাগছে,আজকে সকালেই আমার মনে হলো আমি আংটি টা কোথায় দেখেছিলাম। তোমাকে যেদিন প্রথম গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচায় ঐদিন এই আংটিটা দেখেছিলাম আমার বাপের খাস লোক রানা’র হাতে। আজ সকালেই গিয়েছিলাম তার বাসায় কিন্তু খুঁজে পায়নি। অনেক খুঁজাখুজির পর পেলাম তাকে তার গ্রামের বাড়িতে। প্রথমে সোজা ভাবে কিছু বলতে চাচ্ছিল না কিন্তু যখন দু চার ঘা পরলো তখন পটপট করে সব বলে দিলো।”
-“তো এখন বিশ্বাস হলো তো?তোমার বাবা ঠিক কতটা ভালো মানুষ?ওনি কি করতে পারেন আর কি করতে পারেন না?”
লাজের কথার কোনো উত্তর ফারাজের কাছে নেই। সে নির্বাক, সে এতদিন যে বাবাকে নিয়ে গর্ব করে এসেছিল সেই বাবার মুখোশ আজকে খুলে গেছে। সে লজ্জায় লাজের দিকে তাকাতে পারছে না, যেই বাবা-র জন্য সে এত এত কাজ করেছে সেই বাবা এতটা খারাপ সে কল্পনাও করতে পারেনি। লাজ তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,” তারমানে সত্যি তুমি এসব কিছু জানতে না।”
-“আমি তোমাকে আর কতবার বলবো আমি এসব সম্পর্কে কিছু জানতাম না,তাও তুমি আমার কোনো কথা বিশ্বাস করছো না বার বার একই কথা বলে যাচ্ছো?”
-“তুমিও তো আমার কথা বিশ্বাস করছিলে না,আজ বিশ্বাস হলো তো তোমার বাবা কতটা ভালো? সেদিন কারখানার কথাটাও সত্য ছিলো, ওনি আমাকে সহ আরো কতগুলো মেয়েকে পাচার করতে চেয়েছিলেন। আর এই মহিলা তোমার মা হয়?”
-“হুম!”
-“তোমার বাবাই ঐ মহিলাকে তোমাদের কারখানায় বন্ধি করে রেখেছিল, চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছিল।”
-“মিথ্যা কথা,ওনি নিজের ইচ্ছেই আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল!”
-“কে বলেছে?তোমার বাবা!এখনো তুমি তোমার বাবার কথায় বিশ্বাস করছো? ঐদিন তোমাদের কারখানায় একটা মেয়ে এসেছিল এত্ত বড় ঘোমটা দিয়ে?একটা কাজের জন্য পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছিল?”
ফারাজ একটু চিন্তা করতেই মনে পরলো ঐদিনের মেয়ের কথা। সে তারাহুরো করে বলল…..
-“হ্যা,এসেছিল।তুমি কি করে জানলে?”
-“আমি জানলম কারণ আমিই ছিলাম ঐ মেয়ে!”
ফারাজ অবাক চোখে লাজের দিকে তাকালে লাজ বলে…..
-“হুম,তুমি তো আমার কথায় বিশ্বাস করছিলে না তাই প্রমান যোগাড় করতে এই ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম। কারখানা পুরো টা দেখছিলাম কোথাও কিছু পায় কিনা, তখনই এই তালা লাগানো রুমটা চোখে পরলো,যে রুমটা থেকে কয়েকদিন আগে আমি কান্নার আওয়াজ আসতে শুনেছিলাম।”
লাজ ধীরে ধীরে ফারাজ সবকিছু খুলে বলল, রুমে কিভাবে ঢুকলো? কি কি দেখলো? কিভাবে ঐ রুম থেকে বের হলো? একের পর এক সবকিছু বলল। সবটা শুনার পর ফারাজ জিজ্ঞেস করলো….
-“এই কয়েকদিন মা তোমার কাছে ছিলো?তোমাদের বাসায়?”
-“হুম, তোমার বাবা-র ভয়ে আমি ওনাকে একা ছাড়তে পারিনি। কখন কি করে বসে ওনার সাথে তাই ছাড়িনি।”
-“তুমি আমাকে আরে কেন বলো নি এসব?”
-“বললেই কি আমাকে বিশ্বাস করতে তুমি? আর তাছাড়া আমিও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি, ভেবেছিলাম তুমিও হয়তো তোমার বাবার সাথে জড়িত আছো।”
-“লাজ!তুমি কি করে ভাবলে আমি আমার মা’কে এভাবে বেঁধে রাখবো?”
-“আমি কি করে জানতাম ওনি তোমার মা?”
-“কেন ঐদিন ডায়েরিতে ছবি দেখোনি?”
-“ডায়েরীতে আমি ছবি দেখেনি মাত্র লেখাগুলো দেখেছিলাম।আর তাছাড়া…..”
আর কিছু বলার আগেই অপারেশন থিয়েটার থেকে নার্স বেড়িয়ে আসলো। ফারাজ আর লাজ দৌড়ে ওনার কাছে গেল।ফারাজ অস্বস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”মা কেমন আছে?”
নার্স বলল,”অবস্থা খুবই জটিল, খুব তারাতাড়ি ২ ব্যাগ o- রক্ত লাগবে,আপনারা তারাতাড়ি রক্ত বের করেন।নয়তো আমাদের কিছু করার থাকবে না।”
ফারাজ বলল,”এত তারাতাড়ি o- রক্ত আমি কোথায় পাবো?”
লাজ বলল,”চিন্তা করো না,আমার রক্তের গ্রুপ o-, নার্স আমি রক্ত দিবো আমাকে নিয়ে চলেন।”
-“চলুন আমার সাথে।”
লাজ ফারাজের হাতটা একবার ধরে ইশারা করলো কোনো চিন্তা না করতে। লাজ নার্সের পিছু পিছু চলে গেল।ফারাজ লাজকে যতক্ষণ দেখা গিয়েছে ততক্ষণ দেখলো।চোখের অগোচর হয়ে গেলে থপ করে বসে পরে।মাথায় হাজারো চিন্তা যেমন হচ্ছে তেমনি হাজারটা প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। তার বাবা এমন কেন করলো? কেন তার মা কে এভাবে আটকে রেখেছিল? এসব কিছু কেন লুকিয়ে গেল? কালো ব্যবসা কবে থেকে শুরু করেছে এসব হাজারো প্রশ্নের মাঝেও মায়ের টেনশন যেন যাচ্ছেই না। যাবে কি করে? এতদিন মাকে দেখতে পেলতাও এমন একটা অবস্থায়!

#চলবে!