গাঙচিল পর্ব-০১

0
5325

#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল||
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০১

১.
—”মিস অজান্তা অহি, আপনার বাবাকে ফাঁসির রায় থেকে বাঁচাতে চাইলে আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমাকে বিয়ে করতে হবে।রাজি?”
পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর রোদ্দুর হিম কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অহির দিকে তাকালো।অহি গুম হয়ে বসে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।এরকম প্রস্তাব পাবে তা তার মস্তিষ্কের জল্পনা কল্পনার ১০০ গজ তো দূরে থাক,এক আলোকবর্ষের মধ্যেও ছিল না।

মাথার অগোছালো ওড়নাটা টেনে টুনে সে পিঠ সোজা করে বসলো।তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে কাচের গোল টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা পাথরের তাজমহলটির উপর!ধবধবে শ্বেত পাথরের তৈরি মমতাজের প্রতি শাজাহানের প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রতিমূর্তির উপর!

টেবিলে নখের মাধ্যমে সৃষ্ট মৃদু টোকার শব্দে অহি চোখ তুলে তার সামনে সরকারি পোশাকে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো।সরাসরি মুখপানে নয়।ডানপাশের বুকের উপর খোদাই করা ‘রোদ্দুর হিম’ নামফলকটার উপর!ক’দিনই হলো বা মানুষটাকে সে চিনে!দেড় মাসের মতো হবে!অথচ কি অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে বসলো!

রোদ্দুর অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“আপনার বাবা খুনের কেসের আসামি।তাছাড়া বাদী পক্ষ ঢাকার নামকরা ব্যক্তি।প্রচুর ক্ষমতা তার!রাজনীতির বড় বড় ব্যক্তিবর্গের সাথে ইনভলভ!’রূপসা’ ব্যাংকের ওনার জনাব খালেকুজ্জামান ভিক্টিমের হয়ে লড়ছে।বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, আপনার বাবার কোর্টের শুনানিতে ফাঁসির রায় হবে?”

অহির বুকের ভেতর জ্বলে পুড়ে গেল।এসব দিনগুলো ফেস করার জন্যই হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।বাবাকে ছাড়া একটা সেকেন্ড যেখানে সে কল্পনা করতে পারে না, তার সেই বাবা দেড় মাস হলো জেলে।অথচ তারা কিছুই করতে পারছে না।এর আগে দু বার কোর্টে শুনানি হয়েছে।তৃতীয় বারের মতো আবার হবে!সে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বিক্ষিপ্ত মনটা লুকিয়ে প্রতিবারের মতো বললো,

—“স্যার,আমার বাবা খুন করেনি।আমার বাবার মতো ভালো মনের মানুষ পৃথিবীতে দুজন নেই!”

—“এটা শুধু আপনি আর আপনার পরিবার জানেন।আইন তো জানে না!তবে আপনার বাবার নির্দোষের পক্ষে আমি অনেকগুলো এভিডেন্স রেফারেন্স সহ খুঁজে পেয়েছি।আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেই সেগুলো কোর্টে বা আপনাদের পক্ষের উকিলের হাতে হস্তান্তর করবো।”

অহি আর ভাবতে পারছে না।তার মতো নগণ্য একটা মেয়ের জন্য রোদ্দুর হিম কি জঘন্য ট্রিকস অবলম্বন করছে।তার ঘেন্না হচ্ছে, নিজের প্রতি!রোদ্দুর একটু ধমকের সুরে বলল,

—“কি হলো চুপ যে?কিছু একটা বলুন!”

অহি এবার বেশ স্বাভাবিক ভাবে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।চিকন,সুতীক্ষ্ণ, মিহি স্বরে স্পষ্টভাবে বলল,

—“কয় রাতের জন্য?”

—“কি কয় রাতের জন্য?”

—“বলছি কয় রাতের জন্য বিয়ে করবেন?আপনি বেশ চালাক মানুষ।একটা কুৎসিত,নোংরা প্রস্তাবকে রঙ চঙ মাখিয়ে সুশীল করে আমার সামনে তুলে ধরলেন।আপনি কি মনে করেছেন আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা?আপনার এই সরকারি লেবাসের আড়ালের মানুষটাকে চিনতে পারবো না?আপনি সিনেমার আর দশটা পুলিশের মতো আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নোংরা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন।এর আগে আর কতগুলো মেয়েকে এভাবে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের নিঃস্ব করেছেন?”

তার কথা শেষ হতেই রোদ্দুর ঘর কাঁপিয়ে বলল,

—“স্টপ!একদম চুপ!আর একটা কথা বলবে তো এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো।”

রোদ্দুর উঠে দাঁড়িয়ে কাচের টেবিল থেকে শ্বেত পাথরের তাজমহলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।পাথরের প্রতিমূর্তিটি দক্ষিণের দেয়ালে লেগে বিকট একটা শব্দ সৃষ্টি করে মুহূর্তে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

অহির বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।সামনের মানুষটার হঠাৎ এত রেগে যাওয়া দেখে তার পিলে চমকে উঠলো।কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলো না।নির্ভয়ে, প্রচন্ড রাগে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো।রোদ্দুর হিম নামক মানুষটার শরীর কাঁপছে।ক্রমাগত কাঁপছে।চোখ দুটো থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা বের হচ্ছে।যার হল্কায় অহির জায়গা অন্য কেউ থাকলে সেকেন্ডে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেত!কিন্তু অহি পুড়লো না।সে অনেক আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।ছাইয়ে যতই তাপ দেয়া হয় না কেন ছাই রূপান্তর হয় না!ছাইয়ের কিচ্ছু আসে যায় না।

রোদ্দুর আবার নিজের রকিং চেয়ার টেনে বসে পড়লো।বসেই মাথা চেপে পেছন ঘুরে গেল।হয়তো রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।অহি তার পিঠের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“আমি কি চলে যাব স্যার?”

রোদ্দুর ঝট করে ঘুরে অহির দিকে মুখ করলো।উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে আরেকটা টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো।তারপর ঢকঢক করে পুরো গ্লাস এক নিঃশেষে খালি করে ফেলল।

পানি দেখেই অহির তৃষ্ণা পেল।স্বচ্ছ, চকচকে,ঝকঝকে পানি।জগ আর পানি দু’টোই শুভ্র! চট করে বোঝা যায় না জগে পানি আছে কি নেই!অহি ঢোক গিলল।সঙ্গে সঙ্গে তার পেটের ক্ষুধাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।গতকাল রাত থেকে তার কিচ্ছু খাওয়া হয়নি।এখন দুপুর হতে চলল!

—“কোথায় যাবে এই ভরদুপুরে?”

রোদ্দুরের গম্ভীর কন্ঠের প্রশ্ন শুনে অহি নড়েচড়ে দাঁড়াল।রোদ্দুর স্যার তাকে এতদিন আপনি করে বলতো।আজ তুমি করে বলা শুরু করেছে।কিছুদিন গেলে নিশ্চিত তুই তুকারি করবে।অবশ্য তার মতো তুচ্ছ মানুষকে তুই তুকারি করাই শ্রেয়।সে নরম গলায় বললো,

—“বাবার সাথে কি এখন দেখা করা যাবে?”

—“না!ভিজিটিং আওয়ার শেষ।সামনের শুক্রবার ছাড়া আর দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।”

—“বাবাকে কোর্টে উঠাবে কবে?”

—“আনুমানিক দুদিন পর!এখনো ডেট ফাইনাল হয়নি।তোমাদের পক্ষের উকিলের সাথে যোগাযোগ রেখো ভালো করে।”

—“আমি আসছি স্যার!”

অহি সামনের দিকে পা বাড়াতেই রোদ্দুর দ্রুত বলল,

—“আমার প্রস্তাবের কি উত্তর দিলে?আমি সহজ ভাষায় তোমাকে বিয়ের প্রোপোজাল দিলে তুমি রাজি হবে না তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না!তুমি আমাকে একপ্রকার বাধ্য করেছো তোমার বাবার টপিকটা টানতে!আমি নিরুপায়।তবে খবরদার!আমার পোশাকের বা এই পেশাকে অপমান করবে না।আমার এই ট্রিকসের জন্য স্যরি বলছি।আগেই বললাম,আমার বিকল্প উপায় জানা নেই , তোমাকে বিয়েতে রাজি করানোর!শুধু জানি,তোমাকে এট এনি কস্ট,আমার বিয়ে করতেই হবে!”

অহি ঘুরে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরের চোখে চোখ রাখল।মনে মনে বলল,

—“এখন প্লিজ এটা বলবেন না যে আমার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন!”

রোদ্দুর বেশিক্ষণ তার চোখের দিকে চেয়ে থাকতে পারলো না।চোখ সরিয়ে নিল।অহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—“আপনার কি মনে হয় এই মুহূর্তে আমি বিয়ের মুডে আছি?”

—“অকে।তোমার বিষয়টা কনসিডার করলাম।আজ সন্ধ্যার মধ্যে বিয়ে করতে হবে না।তোমার বাবার ঝামেলাটা মুক্ত হলে আমায় বিয়ে করলেই হবে।কিন্তু তোমায় আমি বিশ্বাস করি না।একটা পেপারে সই করতে হবে তাহলে।চুক্তিনামা আর কি!তোমার বাবা সুস্থ মতো জেল থেকে বের হলে তুমি আমায় বিয়ে করবে!”

অহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

—“আমার সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে।পরে জানাব আপনাকে!আপনি হয়তো কোনোভাবে টের পেয়েছেন যে আমি পুলিশ পেশাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করি!সেজন্য এই ভাবে আমায় নিজের জালে আটকাতে চাইছেন!”

রোদ্দুর ধীরপায়ে এগিয়ে এলো অহির দিকে।উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে অহির দিকে।এক সমুদ্র গভীরতা সে দৃষ্টিতে।অহি ধপ করে পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লো।মাথা নিচু করে ওড়নার এক প্রান্ত শক্ত করে চেপে ধরলো।

রোদ্দুর চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে অহির মুখটা সামনে আনলো।নিজে একটু ঝুঁকে বলল,

—“অজান্তা, আমার জানামতে তুমি অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন একটা মেয়ে।আশা করি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে হুমকির মুখে ফেলবে না।কোথায় যাবে এখন?পুলিশের গাড়ি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।”

অহির দমবন্ধ হয়ে আসছে।কি একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লো।সে নিচের দিকে চেয়েই বলল,

—“ধন্যবাদ, গাড়ি অফার করার জন্য।তবে গাড়ির প্রয়োজন নেই।আমি বাড়ি যাব এখন।রিকশা করে একাই যেতে পারবো।”

—“তোমাকে এই ভরদুপুরে রিকশা করে যেতে হবে না।”

এটুকু বলেই রোদ্দুর সোজা হয়ে দাঁড়াল।দু পা পিছিয়ে গলা ফাটিয়ে দু বার বলল,

—“কনস্টেবল বিদ্যুৎ!এদিকে আসো!”

প্রায় তৎক্ষনাৎ যুবক এক ছেলে দরজা ঠেলে বলল,

—“ইয়েস স্যার!”

রোদ্দুর এক নজর অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“বিদ্যুৎ,মিস অজান্তাকে আমার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে উনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসো!”

—“ইয়েস স্যার!আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

বলেই বিদ্যুৎ দরজা চাপিয়ে চলে গেল।

রোদ্দুরের কন্ঠের দৃঢ়তা দেখে অহি আর কিছু বলার সাহস পেল না।সে এখন এই মানুষটার হাতের গুটি।ইচ্ছে মতো তাকে নিয়ে ছক সাজাচ্ছে!

অহি সালাম দিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার হাতলে হাত রেখে ঘোরাতেই রোদ্দুর বলল,

—“থাক!বিদ্যুৎকে যেতে হবে না।চলো,তোমাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিবো।তার আগে দুজন একসাথে লাঞ্চ করবো!”

(চলবে)