গাঙচিল পর্ব-০৬

0
2528

#গল্পের_নাম: ||গাঙচিল ||
#লেখিকা: অজান্তা অহি
#পর্ব_____০৬

৯.

অহি অন্ধকারে হাতড়ে দরজার কাছে আসলো।তার ইচ্ছে করছে রোদ্দুর হিমকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বাড়ির বাহির করতে।এসব কোন ধরনের পাগলামি?হুট করে এত রাতে চলে আসবে?কোন ধরনের ছেলেমানুষী এগুলো?

দরজায় কান পেতে সে বাইরের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করলো।

—“বাবা,ভেতরে এসে বসো তাহলে?”

জলিলের এই কথাটির অপেক্ষাতেই যেন ছিল রোদ্দুর।এক লাফে বারান্দায় উঠে গেল।জলিল কোথায় বসতে দিবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে।তার বাড়িতে বসার ঘর নেই।এরকম আধো পরিচিত একটা মানুষকে সরাসরি শোবার ঘরে নিয়ে যাবে?তার শোবার ঘরটাও তো বড্ড অগোছালো।অহির রুমটা তুলনামূলক ভাবে একটু গোছানো।কিন্তু অহি তো ঘুমিয়ে পড়েছে।ওকে কি জাগিয়ে দিবে?

বাবার অস্থিরতা হয়তো শফিক বুঝতে পারলো।সে রোদ্দুরকে বলল,

—“আপনি আমার সাথে আমার রুমে আসুন।রুমে এসে বসুন।”

রোদ্দুর হাসিমুখে শফিকের পেছনে গিয়ে তার রুমে বসলো।শফিকের দিকে চেয়ে বলল,

—“হেই ব্রো!পড়াশোনা কেমন চলে?”

শফিক বেশ বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘাপলা আছে।এই এসআই তার বুবুর প্রেমে পড়েনি তো?সর্বনাশ!সে থমথমে মুখে বলল,

—“ঘোড়ার গাড়ির মতো!ঠেলে ঠেলে চালাচ্ছি।”

—“ঠেলার জন্য কাউকে হেল্পার বানালেই তো হয়!তেমন কেউ আছে নাকি?”

শফিক উত্তর দিল না।মানুষটা আজ অহেতুক বেশি কথা বলছে মনে হচ্ছে!সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে।সে কি প্লানমাফিক এ বাড়িতে পা রেখেছে? নাকি সত্যি সত্যি মোটরসাইকেলের তেল শেষ?তেল শেষ হলে কি মোড়ের দোকান থেকে তেল কেনা যেত না?জিজ্ঞেস করলে নিশ্চিত বলবে তার কাছে টাকা ছিল না।

শফিক নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে শেষ মেষ বলেই ফেলল,

—“আপনার বাইকের তেল শেষ, তাই না?”

—“আরে হ্যাঁ ভাই!কি মুসিবতে পড়লাম দেখেছো?প্রচুর টেনশন হচ্ছে।আমার আবার টেনশনে ঘাম হয়।এই দেখো,কপাল ভিজে গেছে।”

এই বলে রোদ্দুর তার ঘামহীন শুকনো কপাল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দু বার মুছলো।শফিক সন্দিহান চোখে বলল,

—“এসআই!আপনাকে দেখে কিন্তু মোটেই মনে হচ্ছে না আপনি টেনশনে আছেন!”

—“তুমি তো বোকাদের মতো কথা বলছো ব্রো!টেনশন কি কারো কপালে,হাতে, মুখে লেখা থাকে নাকি?আমি ভেতরে ভেতরে প্রচুর টেনশিত।তোমারে এখন কেমনে আমার কলিজা কেটে দেখাই বলো তো?আমার তো টেনশনে কলিজা রীতিমতো কাঁপছে!”

—“টেনশনে মানুষের কলিজা কাঁপে জানা ছিল না।”

রোদ্দুর কিছু বলল না।সে একটু পর পর বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে।সে তো যথেষ্ট লাউডে কথা বলছে।অনেকটা অহিকে শুনিয়ে শুনিয়ে।তাহলে এই মেয়ে এখনো বের হচ্ছে না কেন?এরে দেখার জন্যই তো কতগুলো মিথ্যা বলতে হলো!মেয়ে তো নয় যেন সাক্ষাৎ হৃদয় হীন রাক্ষসী!এই মেয়ে কেন তার মন বোঝে না?

শফিক রোদ্দুরের দিকে এক নজর তাকিয়ে লম্বা করে হাই তুলল।অনেকটা হেলাফেলার সাথে বলল,

—“আপনার এটিটিউডের সাথে এসব যাচ্ছে না মি. এসআই!”

—“কোনসব?”

—“এই যে খাপছাড়া মিথ্যে বলা!মিথ্যে সবাই বলতে পারে না।সত্যের মতো গুছিয়ে মিথ্যে বলার মতো মানুষ পৃথিবীতে রেয়ার।আপনার মিথ্যে দু বছরের শিশুও বুঝতে পারবে।এসব আপনার স্বভাবের সাথে, পেশার সাথে, সেই প্রথম দিন দেখা মানুষটার এটিটিউডের সাথে একদমই যাচ্ছে না।”

রোদ্দুর মনে মনে বলল,

—“আর কিসের এটিটিউড!প্রেমে পড়ে জীবনের সব শেষ!এটিটিউডের ঝুড়ির সবগুলো ঘুড়ি ছেঁড়া বেঁড়া হয়ে এলোমেলো উড়ে গেছে।এর জন্য তোমার বোন দায়ী!হুঁহ!একমাত্র অজান্তা অহি দায়ী!”

সে মুখে তোতলানো স্বরে বলল,

—“এটিটিউড দিয়ে কি হবে রে ভাই!এত এটিটিউড নিয়েও যার কাছে পাত্তা চাই,সে পাত্তা দেয় না।আমাকে হেলাফেলা করে,যা তা মনে করে!বুঝতে পারছো তুমি?একবার মাঝরাতে ফোন দিয়েছি!আমাকে ফোনে বলে কি জানো?বলে যে,আমার থেকে নাকি রাস্তার নেড়ি কুত্তার দাম বেশি।এবার তুমিই বলো,কিভাবে আমার এটিটিউড দেখাব!আমার এটিটিউডের বেলুন ফুস!ফুস!”

শফিকের হাসি পেলেও সে হাসলো না।রোদ্দুর হিম নামক মানুষটা তার চেয়ে বয়সে বেশ বড়।এরকম মানুষের সাথে হাসি তামাশা করা সাজে না।সে গম্ভীর হয়ে বলল,

—“আপনি কি অফিসেও এমন খাপছাড়া আচরণ করছেন?তাহলে তো অনেক প্রবলেম ফেস করতে হবে!কেউ আর আপনাকে মান্য করবে না।”

রোদ্দুর এক পলক পুরো রুমে নজর বুলিয়ে বলল,

—“নাহ!অফিসে আমি একদম পার্ফেক্ট।সেই আগের মতো।শুধু অফিসের সময়টুকু বাদে কেমন এলোমেলো হয়ে যাই।একটিমাত্র কাঙ্ক্ষিত মানুষের কথা ভাবলেই সব অগোছালো হয়ে যায়।তার সামনে পড়লে বা মুখোমুখি হলে আমার ভেতর যে কি ভয় কাজ করে সেটা শুধু আমি জানি।তাকে দেখলেই বুকের বা পাশে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।অন্য রকম সুখের ব্যথা।মনে হয়,সুখেই হার্ট অ্যাটাক করে মরে টরে যাব।কি যে এক নাম না জানা অসুখ!প্রেম প্রেম অসুখ!”

শফিক এবার মৃদু হেসে ফেলল।কয়েক সেকেন্ড পরেই তার হাসির বেগ বেড়ে গেল।তার হাসিতে শরীর কেঁপে উঠছে।হাসির প্রতিটি শব্দ যেন জীবন্ত হয়ে চারপাশের রঙ চঙ উঠা দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে।রোদ্দুর মুচকি হেসে শফিকের দিকে তাকাতেই ছিটকে উঠলো।শফিক নয়,তার সামনে অহি বসে আসে।সে বাঁকা ঠোঁটে হাসছে। মাতাল করা সে হাসিতে রোদ্দুরের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল।উঠে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—“ও মাই গড!তুমি এখানে কখন এলে?আমি তো শফিকের সাথে কথা বলছিলাম।”

শফিকের হাসি থেমে গেল আচমকা।সে ভারী গলায় বললো,

—“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?কিছু একটা বলছিলেন বোধ হয়?”

রোদ্দুর চোখের পলক ফেলে ফের তাকাতে চমকে উঠলো।সে কি!তার সামনে তো শফিকই বসে আছে।তাহলে এক্ষুণি যে হঠাৎ অহিকে দেখলো?সে সব কি চোখের ভুল?মনের ভুল?হয়তো!কি সাংঘাতিক! এভাবে আর কিছুদিন চললে তো সে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে।

সে অনিচ্ছা নিয়ে শফিকের শক্ত চৌকিতে বসলো আবার।খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

—“তুমি বিষয়টা সিরিয়াসলি নিচ্ছো না শফিক!বিষয়টা খুবই সিরিয়াস।আমি একজনকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি।কিন্তু সে কিছুতেই আমার হাতে ধরা দিচ্ছে না।সবসময় পালাই পালাই করে।আমি ভেবে রেখেছি,দুদিনের মধ্যে তাকে আমার ঘরের বউ করবো।তারপর তার সব ডানা কেঁটে দিবো।দেখি,তখন কিভাবে এই রোদ্দুর হিম থেকে দূরে থাকে।”

জলিল মোল্লা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।রোদ্দুর মাথা তুলে তাকালো।এ কয়েকদিনে যেন তার বয়স আরো একটু বেড়ে গেছে।এই থমকে যাওয়া পরিবার টাকে বাঁচানোর জন্য অদৃশ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।কিন্তু তা সবার অগোচরে।তার প্রাণ প্রেয়সীর কষ্ট, চিন্তা কিছুটা লাঘব করতে হবে।

জলিল ভেতরে না ঢুকে বলল,

—“তুমি কি রাতের খাবার খেয়েছো গো বাবা?”

শফিক তার বাবার কথায় কথায় ‘গো বাবা’ ডাকটাতে প্রচুর বিরক্ত হলো।কিন্তু কিছু বললো না।জেল থেকে ফেরার পর কেমন যেন উদ্ভট আচরণ করছে তার বাবা।থানায় তার সামনের কারাগারে নাকি একটা পাগল ছিল।তার থেকে হাওয়া লেগে বাবাও পাগল হয়ে যায় নি তো?

—“চাচাজী!আমার একটু ফ্রেশ হতে হবে।ওয়াশরুম দেখিয়ে দিন প্লিজ!’

রোদ্দুরের কথায় শফিকের ভাবনায় ছেদ পড়ে।সে বেশ বুঝতে পারছে রোদ্দুর যে কোন ভিত্তিতে তার বুবুকে আজ দেখেই ছাড়বে।রোদ্দুরের দুষ্ট মিষ্টি পাগলামি গুলো তার বেশ ভালো লাগছে।নাহ!মানুষটা সত্যি সত্যি তার বুবুকে ভালোবাসে।একমাত্র সত্যিকার প্রেমিরাই হুটহাট, মাঝ রাতে,এসব পাগলামি করতে পারে।অবশেষে কি তার বুবুর রাজ্যহীন রাজ্যে রাজকুমার আসলো?

শফিকে উঠে দাঁড়ালো।বারান্দায় গিয়ে অহির দরজায় টোকা দিল।মৃদু স্বরে বলল,

—“বুবু দরজা খোল তো!দরকার!ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

অহি উত্তর দিল না।শফিক আরো কয়েকবার দরজায় টোকা দিল।তাদের বাড়িতে একমাত্র বুবুর রুমের ওয়াশরুম পরিষ্কার।বাইরে দক্ষিণ দিকে দেয়াল ঘেঁষে আরো একটা ওয়াশরুম আছে যেটা একদম নোংরা!কয়েক মিনিট দরজায় বিরতিহীন ভাবে টোকা দেয়ার ফলস্বরূপ অহি দরজা খুলল।

মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে বলল,

—“মাঝ রাতে বিরক্ত করছিস কেন শফি?ঘুমাতে দিবি না?”

—“বুবু,আমি বিরক্ত করছি না।তোর ওয়াশরুম একটু ব্যবহার করতে হবে।”

—“বাইরের ওয়াশরুম কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে?”

—“বুবু আস্তে!বাড়িতে মেহমান!”

অহি জানা সত্ত্বেও চেঁচিয়ে বললো,

—“এত রাতে কোনো স্বাভাবিক মানুষ মেহমান হয়ে আসে?কে সে?”

জলিল সাহেবের পেছন পেছন রোদ্দুর হেঁটে এসে বলল,

—“মিস অজান্তা অহি!কেমন আছেন?অনেকদিন পর দেখা হলো!”

অহি ঢোক গিলল।কি সাংঘাতিক!মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে না দেখা হলো!অবলীলায় মিথ্যে বলে যাচ্ছে।আপনি আপনি করছে!কি ড্রামাবাজ!ইয়া মাবুদ!

আবছা অন্ধকারে অহিকে পুরো রহস্যপুরীর মায়াবতী লাগছে।বাইরের ছিঁটে ফোঁটা আলো মুখে পড়েছে।বড় বড় চোখ,বিস্ময় মিশ্রিত মুখ!কি ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।রোদ্দুর দ্রুত চোখ সরিয়ে বুক চেপে ধরলো।

অহি দরজা থেকে সরে গিয়ে রুমের লাইট অন করলো।এক নজর সারা রুমে নজর বুলালো।বিছানার আধ ছেঁড়া কাঁথাটা চৌকির নিচে রাখলো।চাদরটা টান টান করলো।টেবিলটা একটু গুছিয়ে বাইরে বের হলো।

রোদ্দুর রুমের ভেতর ঢুকে গেল।শফিক চেঁচিয়ে বললো,

—“নিজের বাড়ি, নিজের সব মনে করে সবকিছু ব্যবহার করুন স্যার!কোন কিছু লাগলে বলবেন।”

সবাই সরে আসতেই রোদ্দুর বলল,

—“চাচাজী সাবান খুঁজে পাচ্ছি না তো!”

অহি রুমের ভেতর ঢুকলো।ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

—“আমার বাপ কি আপনার জন্য সাবানের কারখানা খুলে বসে আছে?খালি পানি হাতে মুখে দিয়ে বেরিয়ে আসুন।যখন তখন পানি আসা বন্ধ হয়ে যাবে।”

অহি পেছন ঘুরে সরে আসতে নিতেই খট করে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ কানে আসলো।অহির বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।ওয়াশরুম থেকে বের হলো কেন?সে পেছন ঘুরে তাকানোর সাহস পেল না।সামনে থেকে সরে যাবে সেটাও পারছে না।পা নড়ছে না।শরীর জমে পাথর হয়ে গেছে যেন।

রোদ্দুর এগিয়ে এসে পেছন থেকে শীতল হাতে অহির ডান হাতটা চেপে ধরলো।ক্ষীণ সম্মোহিত কন্ঠে বলল,

—“রাগ করবে না প্লিজ!মিস করছিলাম তো!”

অহির তীব্র ইচ্ছে হলো এক্ষুণি ঘুরে মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।সে দাঁত চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।রোদ্দুর অহির ডান হাতটা নিজের মুখের সর্বত্র ছুঁইয়ে বলল,

—“আমি আমার বুকটা তোমার জন্য সবসময় পেতে বসে আছি।যখন তখন এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো।”

তারপর অহির হাতটা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।অহি ধীরগতিতে রুম থেকে বের হলো।নিজেকে ঠিক করে মায়ের রুমে ঢুকলো।তার বাবা আর শফিক রুমেই ছিল।অহি এসে একপাশে দাঁড়ায়।

অহির মা তীক্ষ্ণ চোখে অহির দিকে চেয়ে আছে।মায়ের চোখে চোখ পড়তে অহির ভেতর যে ভালো লাগা কাজ করছিল তা উবে গেল।সে যেন বাস্তবে ফিরল।যেখানে তার আর রোদ্দুর স্যারের এক অস্তিত্ব হওয়া কোনোদিন সম্ভব নয়।

রেখা শক্ত কন্ঠে বলল,

—“ওই ছেলে এ বাড়িতে কেন পা রেখেছে?”

জলিল বিস্মিত কন্ঠে বলল,

—“এ আবার কেমন প্রশ্ন রেখা?এ বাড়িতে আসার জন্য ওই ছেলে এ বাড়িতে পা রাখবে না?পা না রেখে আসবে কিভাবে?হাত দিয়ে উল্টো হেঁটে হেঁটে?”

—“একদম চুপ।আজকের পর থেকে যেন ওই ছেলের মুখ আমি এ বাড়িতে না দেখি।”

—“তাহলে নেক্সট টাইম থেকে মুখটা অন্য কোথায় রেখে আসতে বলবো!কি বলো বাবা?কিন্তু মুখ ছাড়া শুধু বডি দেখে তো তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে মা।”

রেখা এতটা শক্ত ধমক দিয়ে সবাই কে বের করে দিল।লাইট বন্ধ করে মশারির ভেতর নিঃশব্দে মিশে গেল।অহি রান্নাঘরে ছুটলো।কিছু খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।মানুষটা নিশ্চিত না খেয়ে রয়েছে।

১০.

অহি নিজের রুমে ঢুকলো ছটফট করা মন নিয়ে।তার হাত পা কাঁপছে ক্রমাগত।তার বুক ধড়ফড়ানির অনলি কারণ,হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়া, স্বপ্নে হুটহাট জড়িয়ে ধরা,মস্তিষ্কে জলজ্যান্ত সংসার সাজানোর একমাত্র কারণ যেই মানুষটা,সেই মানুষটা তার বাড়িতে।তার থেকে কয়েক হাত দূরে।ভাবতেই অহির শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে।অনুভূতি গুলো যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ছুটছে।সে আর কিছুতেই রোদ্দুরের সামনে যাওয়া যাবে না।গেলেই ধরা পড়বে।সবাই তার লুকিয়ে রাখা অনুভূতির গল্প জেনে যাবে।

সে দরজা বন্ধ করে তার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।রোদ্দুরের খাওয়া দাওয়া শেষ।শুকনো মরিচের আলুভর্তা আর ডিমভাজি অনেক মজার কনে চেটেপুটে খেয়েছে মানুষটা।এখন কয়েক হাত দূরে শফিকের সাথে ঘুমায়!

অহি দরজা থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে!চৌকির নিচ থেকে কাঁথা টান দিতে একটা চকচকে সাদা বস্তা চোখে পড়লো।এখানে বস্তা আসলো কোথা থেকে?একটু আগেও তো ছিল না!

কৌতূহল নিয়ে বস্তা টেনে বের করলো সে।বস্তার গলার কাছে বাঁধা।শক্ত বাঁধন।অহি হাত দিয়ে খুলতে পারলো না।দ্রুত টেবিল থেকে কেঁচি নিয়ে দড়ি কেটে ফেলল।বস্তার মুখ খুলতেই তার মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেল।

এক বস্তা জুতো শুধু।ছোট,বড়,মেঝো,সেজো,উঁচু, নিচু সব ধরনের জুতোয় ভর্তি।অহির বুক কেঁপে উঠলো।এটা কার কাজ তা বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না।মানুষটা এত পাগল কেন?দুপুরে খালি পায়ে দেখেছে বলে এক বস্তা জুতো কিনতে হবে?এই জুতোর খবর কি শফিক জানে?শফিক আর রোদ্দুর, দুজন মিলেই তো মোটরসাইকেল বাড়ির ভেতরে ঢুকালো।

অহি বস্তার মুখ আটকে বিছানার তলায় ঢুকিয়ে দিল।তার রাগ উঠছে মানুষটার উপর!এসব কোন ধরনের পাগলামি?

সে বাটন ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ লিখলো,

“আপনাকে আমি খুন করবো।”

সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো,

“প্লিজ করো না!তুমি এত কাছে থেকেও দূরে দূরে থাকলে আমি এমনিতেই মরে যাব।”

অহি কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না।ফোন হাতে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করলো।দ্বিতীয় বার মেসেজ আসতেই সে চেক করলো।রোদ্দুর লিখেছে,

“তোমার রুমে কেমন মাতাল করা একটা গন্ধ।’তুমি নামক’ গন্ধ।তোমার এই গন্ধে কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম।তোমার বিছানা থেকে শুরু করে তোমার রুমের প্রতিটি দেয়ালে চুমু খেয়েছি।তোমার কাপড় শুঁকেছি।ওড়না দিয়ে মুখ মুছেছি।তোমার ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেছি।আরো কত্তো কিছু করেছি।সবকিছুতে কেমন তুমি তুমি গন্ধ।এই গন্ধটা আমি গায়ে মাখতে চাই।এই গন্ধটা বুকে জড়িয়ে সারাজীবন বাঁচতে চাই।”

অহি উত্তর দিল,

“ছি!এসব কি ধরনের কথাবার্তা?”

রোদ্দুর কিছুক্ষণ পর উত্তর দিল,

—“তোমার রুমের দরজা খুলে রাখ।”

মেসেজ পড়েই অহির নাক,মুখ রক্তিম হয়ে গেল।রাগান্বিত হয়ে লিখল,

—“এক ঘুষিতে আপনার নাক ফাটাব।”

রোদ্দুর রিপ্লাই দিল,

—“রেগে যাচ্ছো কেন মিসেস রোদ্দুর হিম!রাতের বেলা আমার ওয়াশরুমের দরকার পড়লে কি করবো?বুঝতেই পারছো,প্রাকৃতিক কর্মকান্ডে আমার হাত নেই।”

অহি লজ্জা মিশ্রিত মুখে উত্তর দিল,

—“বিছানায় করবেন।”

অহি আর সময় ব্যয় করলো না।লাইট বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।

সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই ফ্রেশ হয়ে নিল অহি।জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।বাহির একদম ফর্সা হয়ে গেছে।ইশ!বেশ বেলা হয়ে গেছে।সকালের নাস্তা বানাতে হবে তো!

ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুললো সে।সামনে তাকিয়ে কয়েক হাত উঠোনে চোখ পড়তে তার পিলে চমকে উঠলো।তার বিস্ময় ভাব কাটছে না।

উঠোনে রোদ্দুর টুলে বসে তার বাবার মাথা ন্যাঁড়া করে দিচ্ছে।অর্ধেক মাথা টাক বানানো শেষ অলরেডি।মাটিতে গোছা গোছা চুল পড়ে আছে।তার বাবাকে কেমন সুখী সুখী মনে হচ্ছে।রোদ্দুরও যেন বেশ আয়েশ করে চুল কাটছে।

অহি ক্ষীপ্র পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাজখাঁই গলায় বললো,

—“কি করছেন কি?আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?”

রোদ্দুর হাসিমুখে অহির দিকে তাকালো।সিরিয়াস ভাবে বলল,

—“আমি আর চাচাজী নাপিতের দোকান দিবো ভাবতেছি।আপাতত ঘর ভাড়া নিবো না।ফুটপাতে বসবো।অল্প টাকায় ছেলে মেয়ে সবার চুল কাটবো।ন্যাঁড়া প্রতি মাথা দশ টাকা, সুপারস্টার শাকিব খান স্টাইল কুড়ি টাকা!তারপর মাথার চতুর্পাশ ন্যাঁড়া,শুধু টিকিতে চুল!এমন গুলো হবে পনেরো টাকা!শাহরুখ খানস……..”

—“একদম চুপ!”

অহি প্রচন্ড রাগে হসপিটালের পাগলটার মতো মনে মনে বলল,

—“মর হারামজাদা মর!”

(চলবে)