গোধুলীর শেষ প্রহরে পর্ব-২১+২২

0
187

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ২১
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

সারাফ কে আই সি ইউ তে নেওয়া হয়েছে একটু আগে। সাহিরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মুহু কে কুহু সামলাতে ব্যস্ত। থেকে থেকে মেয়েটা বুবুকে ধরে ডুকরে কাঁদছে। শাম্মীকে প্রিতি সামলাতে পারছিলেন না জন্য ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়েছে। এতো বছর পর ছেলেটা কে পেয়েছেন তিনি। অথচ তার এরকম শোচনীয় অবস্থা। কোনো মা ই কি মেনে নিতে পারবে? ঘন্টা দুয়েক এভাবেই কেটে গেছে। এ-র মধ্যে শৈবালের জ্ঞান ফিরে আসে। সাহিরা একবার দেখা করে এসেছে। শৈবাল মুখ অন্য দিকে ফিরে ছিলো। এখনো কি রাগ? নাকি অন্য কোনো কারণ? শৈবালের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া দেখে সাহিরা বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসার সময় শৈবাল শুধু সারাফের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্তু তিনি উত্তর দিতে পারেনি। ছুটে চলে আসেন মুখে কাপড় চেপে। প্রান প্রিয় ভাইয়ের কথা যদি জানতে পারে তবে কে জানে শৈবাল আবার কোন পাগলামি শুরু করে?

সারাফের অপারেশন চলছে। কি হয়েছে এখনো সকলের কাছে পরিষ্কার না। যতক্ষণ না সাহিরা কিছু বলছেন ততক্ষণ সবকিছুই ধোঁয়াসা থাকবে। সবকিছু কেমন নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে গেছে। কারোর মুখেই কথা নেই। মুহুর বাঁধনহারা কাঁন্না থামাতে সক্ষম হয়নি কুহু। ওর মুখ টা এর মধ্যেই শুকিয়ে মলিন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি বসে গেছে। চোখ গুলো কোটরে চলে গেছে। তার ছোট্ট বোন টাও যে এভাবে কারোর জন্য দিশেহারা হবে সে ভাবতে পারেনি। কত বড় হয়ে গেছে মুহুটা। সে যথেষ্টই শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু কোনো কিছু তেই আটকানো যাচ্ছে না। কুহু সহাস্যে অনুনয় করে বলে,

‘মুহু বোন আমার আর কাঁদিস না। সারাফ ঠিক হয়ে যাবে একদমই চিন্তা করিস না তুই! ওর কিছুই হবে না। আল্লাহ সহায় হবেন নিশ্চয়ই! অনেক হয়েছে এবার চুপ কর বোন আমার!’

মুহুর কান্নার বেগ বাড়লো বয় কমলো না। বুবুকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করে দিলো সে। এতক্ষন কান্নার শব্দ ছিলো না। কিন্তু এখন কষ্ট গুলো শব্দ আকারে বেরিয়ে এলো। হতে পারে সারাফের সঙ্গে তার অল্প দিনের পরিচয় কিন্তু ভালোবাসা টা তো মিথ্যা না। মনে হয় যেনো ভালোবাসা টা বহুদিনের। এই ভালোবাসা টা যেনো হওয়ার ই ছিলো। শব্দ করে কাঁন্নার জন্য কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। এখন শব্দ হচ্ছে না কান্নার। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে কান্নায়। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে আর মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে। যাতে তার ফুলবাবুর কিছু না হয়। সে যেনো সুস্থ হয়ে যায় খুব তারাতাড়ি।

শাম্মীর ঘুম ভেঙেছে। ঘুমের ওষুধ কড়া ছিলো না জন্যই তারাতাড়ি ঘুম ভেঙেছে তার। হসপিটালের ক্যাবিনের ব্যাড থেকে নেমে তিনি আলতো পায়ে হেঁটে আসলেন দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে। উদ্ভ্রান্ত হয়ে সাহিরার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলেন। চাহনি তার সু’চে’র মতো ধারালো! তিনি ক্রূর্ধ নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আমার ছেলের এই অবস্থা কেন হয়েছে সাহিরা? ওর কি হয়েছে যার জন্য ওর নাক থেকে র’ক্ত পরছিলো? বলো আমাকে! আমিও একজন ডক্টর। বড় কিছু না হলে তো এরকম টা হওয়ার কথা নয়?’

প্রিতি এগিয়ে এলেন অস্থির হয়ে বলেন, ‘একি! শাম্মী আপা আপনি কেন এগিয়ে এলেন? আপনার রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন। প্লিজ আপনি শান্ত হোন। উত্তেজিত হবেন না!’

শাম্মী কিছু টা চাপা, খড়খড়ে আওয়াজ,
‘আপনি বুঝবেন না প্রিতি। একজন মায়ের মনে এই মুহুর্তে কি হচ্ছে আপনার ধারণা হবে না। আপনি ততক্ষণ কারোর মনের দুঃখ পুরো পুরি বুঝবেন না যতক্ষণ না সেইম ঘটনা আপনার সাথে ঘটছে। আপনি হইতো আমার কষ্ট টা উপলব্ধি করতে পারছেন কিন্তু পুরো পুরি না। আঠাশ বছর পর পেয়েছি আমি আমার ছেলেকে তাও এই অবস্থায় দেখতে হচ্ছে আমার ছেলেটা কে। এরকম একটা সময় একজন মায়ের কি অবস্থা হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’

কথা গুলো বলেই কান্নায় বিজড়িত হয়ে পরলেন শাম্মী। প্রিতি দুহাতে আগলে নিয়ে সামলানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছেন। সারাফ তো তার হবু জামাতা হতে যাচ্ছে। তার কি কষ্ট হচ্ছে না! তার বাচ্চা মেয়েটা কেঁদে টেদে বুক ভাসাচ্ছে। এতে কি তার কষ্ট হচ্ছে না? জীবনে যে মেয়ের চোখে এক ফোঁটা জল দেখেন নি তিনি সেখানে তার মেয়েটা আধ ম’রা হয়ে গেছে কেঁদে কেঁদে।

সাহিরা মেঝেতে থেকে উঠে শাম্মীর মুখোমুখি হলেন। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি মুছে বলেন,

‘আমি সব বলছি। তুমি তো সারাফ কে জন্ম দিয়েছো কিন্তু ওঁকে মানুষ তো আমিই করেছি আপা। আমার যে বক্ষস্থল অজানা ব্যথায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে গো আপা। তার আভাস কি তুমি পাচ্ছো? নাহ পাচ্ছো না। একমাত্র ওঁদের জন্য আমি কখনো মা হওয়ার সাধ নেইনি। যেনো ওঁদের মনে না হয় আমি ওঁদেরকে ভালোবাসি না।’

‘ওতো কিছু জানতে চাই না। কি হয়েছে বলো সাহিরা। মুল ঘটনা কি? আমি তোমার কাছে আমার ছেলে মাহেত কে দিয়ে জরুরি একটা অপারেশনে গেছিলাম। তুমি ছিলে আমার বাসার ভাড়াটিয়া। তোমাকে বিশ্বাস করে আমার ছেলেকে রাখতে দিলাম আর তুমি তাকে নিয়ে পালালে! তোমার বিবেকে বাঁধলো না!এরকম একটা নিচু কাজ করার আগে মনে হয়নি ওই টুকু বাচ্চা ছেলে মাকে ছাড়া কীভাবে থাকবে? তোমার মন সায় দিলো একজন মায়ের কোল শুন্য করতে?’

‘আমি তোমার ছেলেকে নিয়ে পালাই নি আপা। সেদিন তোমার কথা মতো আমি তোমার ছেলে মাহেত কে নিয়ে তোমার বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎই দরজায় টোকা পরে। আমি জিজ্ঞেস করি কে? কিন্তু জবাব আসেনি। পরে আমি দরজা না খুলে ঘরে চলে আসি। পুরো বাড়ি টা ছিলো ফাঁকা। কোনো একজন মানুষ নেই। ভয় পাচ্ছিলাম খুব। সন্ধ্যার পর! রাত বাড়ছে। একা এতো বড় বাড়িতে ভয় করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি মাহেত কে দোলনায় শুইয়ে রেখে ওর জন্য খাবার বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ অনতিপ্রবল ভাবে কেউ তীক্ষ্ণ আঘাত হানে আমার মাথায়। কোনো রকমে পিছনে ঘুরে দেখি একটা পরিচিত মুখ। আমি জানতাম ওর কাজ কি। ছোট বাচ্চাদের কে পাঁ’চা’র করা। তার কূ-কীর্তির প্রমাণ ছিলো আমার কাছে। তাছাড়া ওর উদ্দেশ্য শুধু আমার কাছ থেকে প্রমাণ নেওয়ার ছিলো না। মাহেত কেও নেওয়ার ছিলো ওর। আমি আমার প্রান থাকতে মাহেতকে ওর হাতে পরতে দিতে চাই নি। আমার মাথায় উড়না বেঁধে দুই বছরের মাহেত কে নিয়ে ছুটলাম। রাস্তায় অন্ধকারে দিক বেদিক হয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে পুলিশের গাড়ির সামনে পরি আমি। তাদের কে যেনো খবর দিয়েছে আমি বাচ্চা পাঁ’চা’র-কারীদের সঙ্গে যুক্ত আছি। তাই সেদিন পুলিশ আমাকে ধরে নিলো। আমি না করলেও তারা শুনেন নি আমার কথা। কারণ সে সময় মাহেত ছিলো আমার কোলে। সেটা দেখেই পুলিশ ধরে নিলেন আমি সত্যিই বাচ্চাদের কে পা’চা’র চক্রে যুক্ত আছি। তাছাড়াও আমার বিরুদ্ধে নাকি তাদের কাছে অনেক প্রুফ আছে। আদালত থেকে আমাকে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
বাড়ির সবাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। আব্বা, চাচারা, মামারা, সবাই আমার মুখ দেখা তো দূর কথাও বলেনি। আম্মা আসতেন মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে। জ্বেল থেকে বেরোনোর পর খোঁজ খবর নিতে থাকলাম মাহেতের। মাহেতকে হন্নে হয়ে খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না৷ এরপর সাইফের সাথে দেখা হলো। ওর থেকে জানতে পারলাম ও নাকি জানে মাহেতকে কোথায় রাখা হয়েছে। সাইফকে দেখেই পুরনো রাগ মাথা চেপে বসেছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ছিলাম আমি।’

এতটা বলে সাহিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চোখ থেকে নির্গত পানির ছটা কাপড় দিয়ে মুছলেন। সবাই কেমন আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেনো এরপর কি হবে সেটা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। শাম্মী ধপ করে ব্রেঞ্চে বসে পরলেন। প্রিতিও শাম্মীর পাশেই বসলেন। এতো কিছু ঘটে গেছে অথচ সে কি না সমানে ভুল বুঝে যাচ্ছিলেন সাহিরাকে। এরপর কি হয়েছে জানার জন্য উৎকন্ঠায় হৃদয় টা ছলাৎ করে উঠছে। শাম্মীর দিকে তাকালো কুহু। এরপর সাহিরা কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,

‘তবে সারাফ মানে মাহেতের নাক দিয়ে রক্ত পরার কারণ কি খালা মনি? কি হয়েছিলো ওর সঙ্গে?’

সাহিরা লম্বা দম ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন,

‘এরপর আমাকে শৈবালের বাবা জোর করে বিয়ে করলো। যদি ওঁকে বিয়ে না করি তবে মাহেতের খবর পাবো না। বিয়ের পর জানলাম মাহেত কে একটা এতিম খানায় রাখা হয়েছে। আমি সাইফকে বন্ধু ভাবতাম কিন্তু ওই আমার পিঠে ছু’ড়ি টা বসিয়েছিলো। সেদিন কিন্তু আমার মাথায় আঘাত টা আর কেউ করে নি সেটা ছিলো শৈবালের বাবা। ওর বিশ্বাস ঘাতকতা মানতে পারিনি আমি। ওঁকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেও পারিনি। যে-কোন ভাবে মাহেতের খোঁজ আমার জানার ছিলো। আরও হুমকি দিলো ওঁকে যদি বিয়ে না করি তবে সে আমাকে আবার ফাসিয়ে দেবে শিশু পা’চা’র চক্রে। বিয়ের পর জানতে পারি আমাদের বিয়ের কয়েক মাস আগেই শৈবালের মা আ’ত্ম-হ’ত্যা করে মারা গেছে। এরপর শৈবালকে অনাথ আশ্রম রেখে আসা হয়েছিলো। সেই অনাথ আশ্রম থেকে শৈবাল আর সারাফ মানে মাহেত কে নিয়ে এলাম একই বাড়িতে। আমাদের মধ্যে এটাই ডীল হয় যে মাহেত কেও নেওয়া হবে। সাইফ রাজি ছিলো না কিন্তু ওর ছেলে শৈবাল জেদ ধরে বসে মাহেত কে ছাড়া যাবে না সেখান থেকে। বাধ্য হয়ে ওঁকেও সাথে নিলো সাইফ।’

‘এরপর কেন জানালে আমাকে সবটা? এরপর তো তুমি সবটা জানাতেই পারতে।কোনো বাঁধা তো ছিলো না?’

‘শাম্মী আপা জানানোর কোনো স্কোপই ছিলো। সেখান থেকে নিয়ে আসার আগে জানতে পারলাম মাহেত একবার পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলো মাথায়। সেখান থেকে ব্রেইনে ফ্র‍্যাকচার হয়েছে। মাথার যখম টা সারবে দিন দিন ওর বয়স বাড়ার সাথে সাথে। ওঁর ব্রেইন রক্ত জমাট বেঁধে আছে এখনো। মাথার আঘাত টা ছাড়লেও সেটা ঠিক হয়নি। ওতো অল্প বয়সে যদি ফ্র‍্যাকচার টা অপারেশন করা হতো তবে আরও ক্ষতি হতো ওর। ডক্টর বলেছেন যদি কোনো দিন মানসিক ভাবে বা কখনো আকস্মিক কোনো ঘটনা জানতে পারে এতে ওর অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। মানসিক ভারসাম্যহীন হতে পারে। কিংবা কোমায় চলে যেতে পারে। এই জন্য আমি ওঁকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে দিতে চাইনি। এরপর বড় হওয়ার পর স্কলারশিপ পেয়ে জার্মানিতে পড়তে চলে গেলো। ওঁকে আমি জিজ্ঞেস করতাম যে ওর মাথা ব্যথা করে কি না। ও বলতো একটু আধটু মাথা করে ওষুধ খেলেই সেরে যায়। এতো বছরেও যে ওর মাথার সমস্যা টা দূর হয়নি পুরো পুরি সেটা জানতাম না। আজ ওর এই অবস্থা শুধু মাত্র আমার জন্য। ওর তো মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা করতো আমি গুরুত্ব দেইনি। আবার যদি দেখাতাম ডক্টর তবে হয় তো ঠিক হয়ে যেতো। ডক্টর বলেছে মাথা ব্যথা হবে টুকটাক এতে চিন্তা করার কিছু নেই। তাই আমি চিন্তা করিনি। এখানে আসার পর তেমন ভাবে ওর মাথা ব্যথা ও দেখা যায়নি। তাই আমি ভাবলাম হইতো প্রব্লেম টা সেরে গেছে।’

‘পেশেন্টের বাড়ির লোক কে আছেন?’

ডক্টরের আগমনে সবার ধ্যান ফিরলো। এতক্ষনে গোগ্রাসে গিলছিলো সাহিরার সব কথা। সাহিরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু শাম্মী তার আগে গিয়ে বলেন,

‘আমি পেশেন্টের মা। আমার ছেলের কি অবস্থা ডক্টর?’

ডক্টর মাথা নত করে নিলেন। উনার চোখ মুখে দুঃখের আভাস পাচ্ছে শাম্মী। ডক্টর এর মাথা নত করতে দেখেই কলিজা কেপে উঠলো মুহুর। ডক্টর কোনো দুঃসংবাদ দেবে না তো। সত্যিই যদি তার ফুলবাবু মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরে তখন কি করবে সে?

‘আল্লাহ আপনি আমার ভালোবাসা কে রক্ষা করুন।’ (মনে মনে)

‘কি হলো ডক্টর কথা বলুন। কি হয়েছে আমার ছেলের?’

‘স্যরি মিসেস শাম্মী আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু****!’

মুহু আলতো পায়ে এগিয়ে এসে ডক্টর এর মুখো পানে তাকিয়ে বলে,

‘কিন্তু কি ডক্টর? বলুন। বলুন না?’


কুহুলতার বাড়ি তে তালা দেখে তৌহিদ চিন্তিত হলো। এদিকে আজ সারাদিনে একবারও কুহুলতা তাকে ফোন করেনি। ভেবেছিলো দুপুরে হইতো কল করবে কিন্তু সেটাও করেনি। তাই ভাবলো অফিস থেকে ফেরার সময় দেখা করে যাবে একবার। তাছাড়া সে ভেবে নিয়েছে যে আজ বলবে তার আর কুহুলতার সম্পর্কের কথা। সবাই মেনে নিলে ভালো না হলে পালিয়ে নিয়ে যাবে কুহুলতাকে। কিন্তু কুহুলতাকে অন্য কারোর হতে দেবে না। সাহস নিয়েই এসেছে সব কথা বলবে বলেই। কিন্তু এখানে এসে হতাশ হলো সে। সে আসার সময় দাড়োয়ান চাচাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘চাচা কুহুলতা রা সবাই কোথায় গেছে?’

‘স্যার আপা মনি তো হাসপাতাল গেছে। ওই যে ছোট আপার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার ভাই আবার বড় আপাকে বিয়ে করতে চাইছিলো। কিন্তু বাড়ি থেইকা মানে নাই। এরপর সেই পোলা নাকি বাড়ি গিয়া সু’ইসা’ই’ড করতে নিসিলো। কি এক যুগ আইলো কিছু একটা হইলেই ম’র’বা’র যায়। আল্লাহ রে ভয় পাই না এরা।’

তৌহিদ চিন্তিত হলো। এটা কেমন কথা? কুহুলতাকে কেন বিয়ে করতে চাইবো সে ছেলে। সে দারোয়ান চাচাকে ফের প্রশ্ন করলো,

‘চাচা কিন্তু আমি তো জানতাম কুহুলতার বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ তা তো হইছেই। কিন্তু কে জানতো এরুম অঘটন ঘটবো।’

‘ যে আত্ম’হত্যার চেষ্টা করেছে তার নাম কি?’

‘তা তো জানি না স্যার!’

দারোয়ান এর থেকে বিদায় নিলো তৌহিদ। চিন্তা আরও দ্বিগুন হলো। কোন ছেলে আবার কুহুলতার জন্য সু’ই’সা’ই’ড করার চেষ্টা করলো। কুহুলতার ফোন টাও বন্ধ দেখাচ্ছে। কিন্তু শান্তিও পাচ্ছে না সে। একটু যদি খোঁজ পাওয়া যেতো। সে ভাবলো একবার হসপিটালে যাবেই কি না। কিন্তু তানহা তো একা বাড়িতে। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে। দু-টানার মধ্যেও সে সিদ্ধান্ত নিলো হসপিটাল যাবে। তানহাকে ফোন করে বলে দিলো আজ তার আসতে লেইট হবে। ঘরের দরজা, জানালা যেনো ভালো ভাবে আটকে বসে থাকে। সে কল দিয়ে দরজা খুলতে না বলা অব্দি যেনো ঘরের দরজা না খোলে। তানহাও তাই করলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইলো বই সামনে নিয়ে। তৌহিদ চললো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। না জানি কি অবস্থা হয়েছে কুহুলতার। তাকে দেখে কে কি বলবে সেটা নিয়ে আপাতত মাথা ব্যথা নেই তার। কিন্তু এই মুহুর্তে তার মনে হ’য়েছে কুহুলতাকে দেখবে ব্যস দেখেই ছাড়বে। মনের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না আর। না দেখা অব্দি শান্তি মিলবে না সেটা ও বুঝতে পেরেছে। এটাই বোধহয় ভালোবাসা! এতোটা এগ্রেসিভ কবে হলো ও। নিজেই যেনো নিজেকে চিনতে পারছে না সে। সে বিরবির করে বলে,

‘ভালোবাসা সুন্দর! ভালোবাসা সুন্দর না হলে এমন সুখ সুখ অনুভূত হতো না আপনাকে দেখতে যাচ্ছি বলে। এই আপনাকে না দেখতে পেয়ে আমার বক্ষস্থলে যে অজানা দহনক্রিয়া হয়েছে সেটাও সুন্দর কুহুলতা। আপনি শুধুই এই আমি, মানে এই তৌহিদের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন। উই আর মেইড ফর ইচ আদার!’

#চলবে

#গোধুলীর_শেষ_প্রহরে
#পর্বঃ২২
#রাউফুন (ছদ্মনাম)

‘পেশেন্ট আর কোনো দিন কথা বলতে পারবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছি না ডক্টর শাম্মী!’

‘এসব কি বলছেন ডক্টর? আমার ছেলে আর কথা বলতে পারবে না? না না ডক্টর আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই কথা বলতে পারবে ও। আমাকে মা ডাকবে আমার ছেলে। আমি যে কত বছর থেকে অপেক্ষায় আছি ওর মুখ থেকে মা ডাক টা শুনবো বলে! নিশ্চয়ই কথা বলতে পারবে। আমার মাহেত কথা বলবে।’

‘দেখুন ডক্টর শাম্মী, আপনি শান্ত হোন। আমরা চেষ্টা কম করিনি। উনার মাথায় যে ফ্র‍্যাকচার টা হয়েছিলো সেটা ছোট হলেও সমস্যা টা ছিলো বড়। সব ডক্টর এই ছোট সমস্যা থেকে যে বড় কিছু হতে পারে বুঝতে পারবে না সহজেই। আপনারা আগে কেন এর চিকিৎসা করান নি। আমার যেটুকু মনে হলো এটা অনেক পুরনো ক্ষত। এই ক্ষতের জন্য মাথা ব্যথাটা কম হবে কারণ এক জায়গায় র’ক্ত জমাট বেঁধে ছিলো। বড় হওয়ার সাথে সাথে এটা ছোট আকার ধারণ করেছে ঠিকই কিন্তু ব্রেইনের মেইন স্থানে এসে বসেছে আস্তে আস্তে। আমরা সেই র’ক্তের ছাঁ’চ টা সরাতে সক্ষম হয়েছি ঠিকই কিন্তু ব্রেইনের সঙ্গে তো গলা, নাক, কান, এসব কানেক্টেড। যেহেতু র’ক্তে’র ছাঁচ টা সরাসরি মাথার উপরের দিকে সেহেতু সোজা ওর কণ্ঠনালীর সঙ্গে এফেক্টেড হয়ে গেছে। তাই র’ক্তের ছাঁচ সরানোতে পেশেন্টের কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। উনি যে একেবারেই আর কথা বলতে পারবেন না তা নয়। যখন তখন উনি কথা বলে উঠতে পারেন। আবার সারাজীবন বো’বা ও হয়ে থাকতে পারেন। আমরা এর গ্যারান্টি দিতে পারছি না। স্যরি ডক্টর শাম্মী। আপনিও তো একজন ডক্টর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বুঝাতে চাইলাম। আর পেশেন্ট কে চিন্তা মুক্ত রাখবেন। খেয়াল রাখবেন উনি যেনো আবার বড় কোনো শকট না পাই। পেশেন্ট এর জ্ঞান ফিরলে দেখা কর‍তে পারবেন।’

বলেই ডক্টর চলে গেলেন। শাম্মী দু হাতে মাথা চেপে বসে পরলেন। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। সবার চোখ জলে টইটম্বুর। গাল গলিয়ে টপটপ করে পরছে। মুহুর যখনই ডক্টর এর কথা গুলো কর্নপাত হলো সে হতভম্ব হয়ে দু কদম পিছিয়ে এলো। শরীর অবস হয়ে আসছে তার। ফুলবাবু যে তার অস্তিত্ব,মন, প্রান সবটা। তার মাঝেই নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে সে। তার নিজের অস্তিত্বের এমন বেহাল অবস্থা কি করে মানবে সে। আস্তে আস্তে ওর চোখ বন্ধ হয়ে এলো। লুটিয়ে পরতে নিলো সে তার আগেই কেউ একজন দু হাতে আগলে নিলো। সবাই মুহুকে পরে যেতে দেখে বিচলিত হয়ে চিৎকার করে উঠলো মুহুর নাম ধরে। পরক্ষণেই সবাই তাকালো মুহুকে আগলে রাখা মানুষ টির দিকে।

তৌহিদের বাড়ি থেকে অটো বা টেক্সিতে হসপিটাল আসতে দশ মিনিট সময় লাগে। অবশ্য হসপিটালের মধ্যে ঢুকে কুহুকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছে ওঁকে। অতঃপর রিসিপশন থেকে জেনে নিয়েছে আজকের সুই’সাই’ডের পেশেন্ট কোন ক্যাবিনে ভর্তি। প্রথমে রিসিপশনিস্টের একটু সমস্যা হয়েছে। কারণ পুরো হসপিটালের শুধু মাত্র একজন সু’ইসা’ইডাল ক্যাস তো আর হয়নি। আরও অনেকে এই রকম বোকা লোক আছে। যারা নিজেকে ভালোবাসতে জানে না। আবার অন্যের জন্য নিজের জীবন দিতে বসে। আগে নিজেকে ভালোবাসো বোকারা তারপর না অন্যকে ভালোবাসবে। এভাবে সে কুহুকে খুৃঁজে পাবে না তাই সে পরবর্তীতে ভাবলো প্রিতির নাম বললে হইতো চিনবে। প্রিতির নাম বলতেই চিনে ফেলেছে। এরপর সে খুঁজে পেয়েছে কুহুকে। কুহুকে দেখেই তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিলো। আনন্দের সেই হাসি মুহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়। পরক্ষণেই দেখলো মুহু শরীর ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পরছে মাটিতে৷ কোনো রকমে এগিয়ে এসেই ধরে ফেলে সে মুহুকে। সবাই তৌহিদ কে দেখে অবাক হয়ে গেছে। কুহু দুই ভ্রু সংকুচিত করে প্রশ্ন করলো,

‘তৌহিদ আপনি এখানে?’

‘আমি এখানে কেন সেটা পরে বলছি। আগে মুহুকে ধরুন।’

প্রিতি এই পর্যায়ে কান্না করে দিলেন শব্দ করেই। কুহু কথা বাড়ালো না। জ্ঞান শুন্য মুহুকে একটা ব্যাডে শুইয়ে দিলো তৌহিদ।
এরপর প্রিতিকে অপ্রসন্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

‘আন্টি মুহুর এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে ওর?’

প্রিতি কিছু বলতে পারলেন না। একবার তৌহিদ কে দেখলেন তিনি। অফিসের ফর্মাল ড্রেস এখনো অব্দি ওর পরনে। অফিস ব্যাগ কাধে ঝুলানো। নিশ্চয়ই অফিস থেকে সরাসরি এসেছে এখানে। কেন এসেছে মনে প্রশ্ন জাগলেও চুপ রইলেন তিনি। চোখের পানি মুছে ইনজেকশন নিয়ে এলেন। ইনজেকশন এ জ্ঞান ফেরার লিকুইড ভরে পুশ করলেন মুহুর হাতে। তৌহিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বুঝালো, ‘কি হয়েছে সব ঠিক আছে তো?’

কুহু আস্তে আস্তে বলে , ‘বাইরে আসুন বলছি সবটা!’

ওরা বাইরে এলো। বাইরে এসে কুহু দুই ক্যাবিনের দুজনকে দেখালো। প্রথমে সারাফ কে তারপর শৈবাল কে। তৌহিদের ক্ষোভের উদ্রেক হলো শৈবাল কে দেখেই। তার সামনে তার বোনকে এই ছেলেটা কতটা জঘন্য, কতটা নগন্য ভাবে স্পর্শ করেছিলো। সে শুধু স্পাইনলেসের মতো সব টা দেখেছে সেদিন। কিছুই করতে পারে নি সে। নিজের উপর এবং শৈবালের উপর আজ প্রচন্ড রাগ হলো। শক্ত চোয়ালে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

‘কুহুলতা শৈবাল এখানে?’

‘হ্যাঁ শৈবাল ই সেই ছেলে যাকে আমি রিজেক্ট করার পর সু’ই’সা’ই’ড করার চেষ্টা করেছে।’

‘কিহ? শৈবাল? শৈবাল আপনার জন্য সু’ই’সা’ইড করেছে?’

‘হ্যাঁ!’

তারপর সে বাকি সব কিছু খুলে বললো যা কিছু হয়েছে। সারাফের সব টা শুনে তৌহিদের খারাপ লাগলেও শৈবালের জন্য ভেতর থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। হাইরে দুনিয়া। নিয়তি কখন কাকে কোথায় এনে দাড় করাই বুঝা মুশকিল! একদিন তার বোনের সাথে যে অন্যায়, জঘন্য অপরাধ শৈবাল করেছিলো সেটা সে এখন ফিরে পাচ্ছে গুনে গুনে। একদিন যে আমার বোনের সাথে অন্যায় করেছে আজ তার শাস্তি সে নিজেই নিজেকে দিয়েছে নিজের অজান্তেই। শক্ত দেয়ালে লেগে একদিন না একদিন নিজের ছুরা তী’র নিজের গায়েই লাগে। প্রকৃতি সব টা সময়ের সাথে সাথে ফিরিয়ে দেই। শুধু একটা অপেক্ষা!

শাম্মীও ক্যাবিনের বাইরে বসে আছেন। একদিকে তার ছেলের চিন্তা আর অন্য দিকে মুহু মেয়েটা। তিনি বুঝতে পারছেন মুহু মাহেত কে কতটা ভালোবাসেন। তিনি অনড়ভাবে অপলক নয়নে সাহিরার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টির সম্মুখে সাহিরাও অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শাম্মীর দিকে। কিছু বলার মতো ভাষা তিনি খুজে পাচ্ছেন না। সে যত যায় হোক অপরাধী শাম্মীর কাছে। একজন মায়ের চোখে তার অপরাধ কোনো অংশে কমে যাবে না। একজন মা তার সন্তানের জন্য কতটা ডেস্পারেট হতে পারে সেটার বাস্তব প্রতিচ্ছবি শাম্মী। সাহিরা কিছুই মনে করেনি শাম্মীর এরকম ভাবে তাকে একিউস করাই। বরং এটা ভেবে কষ্ট হচ্ছে যে এতো বছর পর ছেলেকে পেয়েও তার মুখ থেকে মা ডাক টা শুনতে পারবে না। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলেন সাহিরা। দুচোখ বন্ধ করে ভেতর টা কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু না শান্তি নেই।কোথাও এতো টুকুও শান্তি নেই।

সুপ্রিয় সেই কখন থেকে তানহার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ভাবেই একটি বারের জন্যও তানহা বারান্দায় বেরোই নি। ওঁদের বাড়ি টা একতলা বিশিষ্ট। চারটি রুম বোধ হয়। এখন কথা হচ্ছে দরজা তো লক। এরপর জানালাও বন্ধ। সন্ধ্যার পর সাত টার দিকে রোজ তানহা বারান্দায় কাপড় তুলতে আসে। আজ কাপড় ও নেই। রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় তানহার বারান্দার সবকিছু। সে উপায় না পেয়ে দেয়াল টপকে তানহাদের বাগানে আসে। শব্দ না করে তানহার রুমের জানালার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকলো,

‘তানহা!’ একবার দুবার তিনবার। এরপরে জানালার কাচে টোকা দিলো সুপ্রিয়।

এতক্ষন তানহা সটকা মেরে চুপচাপ পরছিলো। একটা ধুপধাপ শব্দ সে পেয়েছে।একা একা বাড়িতে ভয় করছে তার। সন্ধ্যার পর সে আজই প্রথম একা রয়েছে। এর আগে তার বাবা ছিলো তখন বাবার রুমে গিয়ে পড়তো। কিন্তু এখন তো আর বাবা নেই। বাবা নেই ভাবতেই ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে তার। এরপর তার ভাই নিয়মিত সন্ধ্যা সারে ছয়টাই বাড়ি আসে। ভয় পাওয়ার কোনো কারন থাকে না। কিন্তু আজ ভয়ে শেটে আছে সে। চার বারের বার তার নাম ধরে কেউ ডাকছে তাও তার জানালার কাছ থেকে। এইবারে তানহার টনক নড়লো। হ্যাঁ স্পষ্টই তাকে কেউই ডাকছে। ভু’ত টু’ত নয় তো? সে ছোট বেলাই শুনেছে ভুত কখনো তিন বারের বেশি ডাকে না। যদিও ভু’ত প্রে’তে ওর বিশ্বাস নেই। তবুও এখন ভয়ে ভয়ে উঠলো টেবিল থেকে। কারণ এখন তাকে যে ডেকেছে সে চার বার ডেকেছে। তার মানে কোনো মানুষ! সে ভীত স্বরে বলে,

‘কে আছো ওখানে? ক-ক-কে?’

অস্পষ্ট উত্তর এলো, ‘তানহা আমি! ‘

‘আমি কে?’

‘আরে আমি সুপ্রিয়! জানালার কপাট টা খুলো প্লিজ!’

সুপ্রিয় নাম টা শুনেই ধড়াস করে উঠলো তার অন্তস্থলে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। যেনো মনে হচ্ছে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ তার হৃদয়ে। দুরুম দুরুম করছে ভেতর টা!

অপাশ থেকে আবার আওয়াজ এলো,

‘কি হলো তানহা জানালা টা খুলো?’

তানহা দ্বিতীয় বার চমকালো। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুধাই,

‘আপনি? আপনি এখানে কেন?’

‘প্রেমিকা কে দেখতে এসেছি! এবার জানালো খুলো!’

তানহা বিরাগ নিয়ে বলে, ‘অসম্ভব! আমি জানালা খুলবো না!’

সুপ্রিয় তেছড়া ভাবে বলে, ‘ওহ আচ্ছা বুঝেছি। জানালা থাক তবে। দরজা খুলে দেও ভেতরে আসি। কি বলো?’

তানহা বেশ বুঝলো সুপ্রিয়ের ব্যাঙ্গাত্মক বানী। সে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলে,

‘আশ্চর্য আমি দরজা খুলে দিতে যাবো কেন?’

‘তাহলে ভালোই ভালোই জানালার কপাট খুলে দেও!’

‘আপনার লজ্জা করে না! আপনি অন্য নারীকে বিয়ে করছেন কিছু দিন পর। আর এখন আপনি এসেছেন পর নারীর সঙ্গে দেখা করতে?’

‘না লজ্জা কেন করবো। হবু বউকেই তো দেখতে এসেছি।’

‘মানে?’

‘মানে কিছু না। জানালা টা খুলো। একটু দেখি তোমাকে। এখানে প্রচুর মশা। কামড়ে শেষ করে দিলো বাবারে!’

তানহা বিরাগ নিয়েও ঠোঁট চেপে হাসলো।সে আলতো হেসে বলে,

‘বেশ হয়েছে মশা কামড়েছে! পর নারীকে দেখতে চাওয়ার এইটাই শাস্তি।’

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো আওয়াজ এলো না। বেশ কিছুক্ষন কোনো সারা শব্দ না পেয়ে তানহা ভাবলো হইতো সুপ্রিয় চলে গেছে। আস্তে করে জানালার কপাট খুলতেই ওর মুখে আলোর ঝলকানি লাগলো। সুপ্রিয় ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে ওর মুখো পানে ধরেছে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করলো তানহা। সুপ্রিয় অপলক নয়নে দেখলো তার প্রেয়সীকে। চোখ বন্ধ অবস্থায় ওর রুপের ছঁটা যেনো আরও ছঁলকে পরছে। প্রান ভরে দেখতে লাগলো সে তার প্রানেশ্বরী প্রিয়তমাকে। তার চোখে রয়েছে একরাশ মুগ্ধতা। মহাআকাশ সম এক আকাশ ভালোবাসা। এই মেয়েটাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ছিলো সে। কিন্তু এতো ঘুরেও পাত্তা মেলে নি মেয়েটার থেকে। ফোস করে দম নিলো সে। হঠাৎ ওর ফোন টা ভাইব্রেট হলো। সে ফোন টা বের করে দেখলো ‘মা’
লেখা। সে এক পলক তানহা কে দেখে হাসলো। তারপর একটু দূরে গিয়ে ফোন টা রিসিভ করলো।

তানহা এখনো বিমুঢ়। জানালার কপাট এখনো খোলা। এভাবে যে সুপ্রিয় তার সাথে ট্রিকস করবে সে আন্দাজ করে নি। বুকের দপদপ শব্দ টা বেড়েছে আরও। এই বুঝি পাম্প হতে হতে ফেটে যাবে হৃদপিণ্ড টা। আবারও নিস্তব্ধতা। কোনো আওয়াজ নেই। চারপাশে ঝিঝি পোকা উদ্ভট আওয়াজ দিচ্ছে। সে চোখ মেলে চাইলো। কিন্তু না কেউই নেই। সে ভালো ভাবে লক্ষ্য করেও কারোর ছাঁয়াও দেখতে পেলো না।

‘তাহলে কি সত্যিই এবার চলে গেলেন উনি!’

অভিমানে নাক ফুলালো সে। কেন যেনো অভিমান হলো তার। এভাবে এসে না বলে চলে যাওয়ার মানে টা কি? গাল ফুলিয়ে অগ্রসর হলো খাটের দিকে। বাতাসে জানালার কপাট টা জোরে তাল দিলো। বিকট শব্দ হলো তাতে। তানহা বিরক্ত হয়ে অনিচ্ছা সত্তেও জানালার কপাট লাগিয়ে দিলো।

#চলবে