গোধূলির আলোয় রাঙা পর্ব – ০৮

0
357

#গোধূলির আলোয় রাঙা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৮

সবাই আদিবাসীদের পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করলেও সাদা রঙের একটা থ্রীপিস পরে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াসা, মুগ্ধ তাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো ঠিক সেদিনের মতো। সবাই আনন্দ করলেও তাকে অন্যমনস্ক লাগলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সকাল থেকে মনটা বড্ড অস্থির লাগছে অকারণে।

শুদ্ধ বললো, এখানে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস ?

মুগ্ধ কিছু না বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শুদ্ধকে। মুখে কোনো কথা নেই তবে চোখে নোনাজলের অস্তিত্ব ঠিকই আছে। শুদ্ধ প্রথমে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরক্ষণে নিজেও জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধ।

মুগ্ধ ধরা গলায় বললো, থ্যাংক ইউ ভাই।

শুদ্ধ কিছু বললো না, তার চোখেও আজ পানি দেখা দিচ্ছে। শেষ কবে মুগ্ধ তাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল ,ভাই বলে ডেকেছিলো মনে পরে না। খানিক বাদে মুগ্ধ ছেড়ে দিলো শুদ্ধকে আর মুখোমুখি দাঁড়ালো। শুদ্ধ ইশারায় যেতে বললো তিয়াসার কাছে। মুগ্ধ মুচকি হেসে চোখের পানি মুছে এগিয়ে গেলো তিয়াসার দিকে। শুদ্ধ সেদিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। আজকে একটু ঘুরাঘুরি করে আগামীকাল সকালেই চলে যাবে সে। মাত্র দু’দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে সে।

মুগ্ধ ধীর পায়ে গিয়ে তিয়াসার পেছনে দাঁড়ালো। তিয়াসা অন্যমনস্ক থাকায় টেরই পায়নি।

মুগ্ধ তিয়াসার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আমাকে বিরহের আগুনে পুড়িয়ে তুমি এখানে এসে মজা করছো ?

তিয়াসা চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে ঝোঁক সামলাতে না পেরে পরে যেতে নেয়। মুগ্ধ দ্রুত কোমর জড়িয়ে ধরে তিয়াসার। দুজন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুটা সময়। তিয়াসা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না মুগ্ধ তার এতো কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

১০.
শুদ্ধ নিজের বন্ধুর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো।

তুরাগ পেছনে ফিরে শুদ্ধকে দেখে জড়িয়ে ধরলো। শুদ্ধও মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো।

তুরাগ উৎসাহিত গলায় বললো, কেমন আছিস তুই ?

শুদ্ধ মুচকি হেসে বললো, আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক ভালো আছি। তুই কেমন আছিস সেটা বল ?

তুরাগও হাসি মুখে বললো, আমিও ভালোই আছি, আলহামদুলিল্লাহ।

শুদ্ধ তুরাগকে ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, তোর এই ঘুরাঘুরির অভ্যাস আর গেল না রে, এখন একদম পেইজ খোলে নিয়েছিস দেখছি। সারাবছর কী এই করিস নাকি ?

তুরাগ মুচকি হেসে বললো, একটা জব করি। ছুটি পেলেই এমন ট্যুরের প্ল্যান করে ফেলি। মা মারা যাওয়ার পর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেটা আর হয় না।

তুরাগের মা মারা গেছে বছর চার আগে। বাবা আরো অনেক আগেই মারা গেছে। বাড়িতে বড় ভাইয়ের পরিবার থাকলেও বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আর হয় না। তাই ছুটির দিনগুলো এমন ঘুরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেয়।

তুরাগ শুদ্ধর কাঁধে থাপ্পড় দিয়ে বললো, আমি না থাকলে আজ তোকে হেল্প করতো কে বলতো ?

শুদ্ধ ঠোঁটের কোণে হাসিটা প্রসারিত করে বললো, অসংখ্য ধন্যবাদ ইয়ার।

তুরাগ শুদ্ধর স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। জেদের বসে মুগ্ধ আর শুদ্ধ সবসময় আলাদা স্কুল কলেজেই পড়াশোনা করেছে তাই একে অপরের বন্ধুদের চেনে না। তিয়াসা যে গ্রুপের সাথে ট্যুরে এসেছে সেই গ্রুপের এডমিন তুরাগ। সব ব্যবস্থা সেই করে থাকে। সেদিন ছবিতে তুরাগকেও দেখতে পায় শুদ্ধ। তিয়াসার সব খবর তুরাগের কাছেই পায় আর ভিডিওটা তুরাগই করেছিলো আর শুদ্ধকে পাঠিয়েছিলো।

তুরাগ বললো, তোর ভাইয়ের বউ পেয়েছিস ?

শুদ্ধ মুচকি হেসে বললো, হ্যাঁ পেয়েছি।

মেয়েটাকে প্রথম থেকেই আমার কেমন অন্যরকম লেগেছে। সাজেকের মতো জায়গায় এসেছে একবার মন থেকে হাসতে দেখিনি। কেমন মনমরা থাকতো সবসময় আর গত সন্ধ্যায় সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যায়।

তুই ছিলি বলে কাজটা সহজ হয়ে গেছে আমার জন্য।

তুরাগ হাসিমুখে বললো, ফর্মালিটি ছাড় এবার।

শুদ্ধ বললো, আচ্ছা তোর কথা বল তাহলে। বিয়ে কবে করছিস ? বয়স তো কম হলো না।

তুরাগ হতাশ গলায় বললো, বিয়ে তো যেকোনো সময় করতে রাজি আছি আমি কিন্তু যাকে করতে চাই সে তো ফিরেও তাকায় না।

শুদ্ধ অবাক হয়ে বললো, মানে ?

তুরাগ তোরাকে দেখিয়ে বললো, মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিলাম দু’বছর আগে। আমাদের সাথেই ট্যুরে এসেছিলো। একবছর নিরবে ভালোবেসে গেলেও, একদিন মনের কথা বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর থেকে ও আমাকে এড়িয়ে চলে।

শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে, তোর মতো ছেলেকে রিজেক্ট করেছে ? কারণ জানতে চাসনি ?

তুরাগ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, হুম চেয়েছিলাম আর বলেছেও। সে আমার যোগ্য নয়, সেটাই আমাকে রিজেক্ট করার কারণ।

শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বললো, মানে কী এসবের ?

তোরা একজন ধর্ষিতা।

শুদ্ধ চকিত গলায় বললো, হোয়াট ?

তুরাগ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, হুম চার বছর আগে ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে মেয়েটা, ভালোবসে বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হয়েছে। পরিবার ওকে কাছে টেনে না নিয়ে দূরে ঢেলে দিয়েছে। তারপর নিজেকে রক্ষা করার মতো করে নিজেকে তৈরি করেছে। নিজের মতো করে জীবনযাপন শুরু করেছে। ও মনে করে কারো প্রয়োজন নেই ওর জীবনে।

কিছুটা সময় নিরবতায় কেটে গেলে শুদ্ধ বললো, নিজের মনের কথা ওকে বোঝানোর চেষ্টা কর। একদিন ঠিক বুঝবে সবাই এক নয়।

তুরাগ মুচকি হেসে বললো, সেদিনের অপেক্ষায় আছি।

১১.
আপনি এখানে কেনো এসেছেন ?

মুগ্ধ অসহায় গলায় বললো, তুমি বুঝতে পারছো না কেনো এসেছি আমি ?

তিয়াসা ঘুরে তাকালো মুগ্ধর দিকে। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। গোধূলির রাঙা আলোয় মুগ্ধর বিধস্ত চেহারা দেখে তিয়াসার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। তিয়াসা তো তাকে ছেড়ে এসেছিল যাতে সে ভালো থাকে কিন্তু এ কী হাল হয়েছে তার। সবসময় চকলেট বয় হয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটার চোখের নিচে ড্রাক সার্কেল পরে গেছে, অনেকটা শুকিয়েও গেছে, গায়ের শার্টটাও কেমন এলোমেলো হয়ে আছে।

তিয়াসা চোখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাকে তো ভালো থাকার জন্য মুক্ত করে দিয়ে এসেছিলাম।

মুগ্ধ নিজের চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে তিয়াসাকে দেখে, মনে হচ্ছে কত যুগ পর দেখছে। তিয়াসার অবস্থাও মুগ্ধর মতোই।

মুগ্ধ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ভালো থাকার কারণটাই যদি নিজের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাহলে কী কেউ ভালো থাকতে পারে ?

তিয়াসা অবাক হয়ে বললো, মানে ?

মুগ্ধ কিছু না বলে তিয়াসার দিকে এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে লাল টকটকে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করালো। মুগ্ধর স্পর্শে কেঁপে উঠলো তিয়াসা।

সে কিছু বলার আগেই মুগ্ধ বললো, একটু সময় চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকো তারপর তোমার প্রশ্নের উত্তর দিবো।

তিয়াসা আর কিছু না বলে মুগ্ধর বাহুবন্ধন উপভোগ করতে লাগলো।

মুগ্ধ তিয়াসার কাঁধে থুতনি রেখে বললো, তুমি আমার জীবনে ঠিক এই গোধূলির রাঙা আলোর মতো। যেমন এই আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ এই প্রকৃতি থাকবে অপরুপা। তেমনই তুমি যতদিন আমার জীবনে থাকবে ততদিন আমার জীবনটা হবে ঠিক এই প্রকৃতির মতোই অপরুপ।

আবার কিছুটা সময় চুপচাপ থেকে সূর্যাস্ত দেখতে লাগলো। ধীরে ধীরে লাল টকটকে সূর্যটা যেনো লুকিয়ে পড়লো পাহাড়ের আড়ালে। অপরুপ সুন্দর প্রকৃতি হারিয়ে যেতে লাগলো নিকষকালো অন্ধকারের মাঝে।

এবার মুগ্ধ বললো, তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমার জীবনটাও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে ঠিক এমন করে।

একটু দম নিয়ে বললো, সরি তিয়াসা।

তিয়াসা নিজের কাঁধে গরম তরল অনুভব করলো হঠাৎ করে। পেছন ঘুরে মুগ্ধর দিক তাকাতে চাইলে মুগ্ধ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে যাতে তিয়াসা আর নড়াচড়া করতে পারে না।

মুগ্ধ ধরা গলায় বললো, বিশ্বাস করো তোমাকে ছাড়া এই কয়েকটা দিন আমার প্রত্যেকটা নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়েছে। রুমের আনাচকানাচে তোমার স্মৃতি আমাকে পাগল করে তুলেছিল। তোমার শূন্যতা আমাকে পুড়িয়ে ছাই করছিলো প্রতিটা মুহূর্ত।

তিয়াসার চোখের বাঁধ ভেঙে গেলো এবার। গাল বেয়ে গড়িয়ে যেতে লাগলো গরম নোনাজলের স্রোত। তবে আজ কষ্টের নয়, আনন্দের অশ্রু এটা।

মুগ্ধ আবার নাক টেনে বললো, তোমার কী মনে হয় তুমি একাই ভালোবেসে গেছো আমাকে ? আমি কখনো ভালোবাসিনি তোমাকে ?

তিয়াসা এবার অবাক হলো মুগ্ধর কথা শুনে তাই বলে উঠে, মানে ?

কর্পোরেট দুনিয়া মানে টাকার পিছনে ছুটে চলা। আমিও ছুটছিলাম টাকার পেছনে, নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টায় প্রতিটা সেকেন্ড এগিয়ে চলেছি। মায়ের কাছে প্রমাণ করতে চাইছিলাম আমি অপদার্থ নই। সেই ব্যস্ততম জীবনে এক বিন্দু স্বস্তি নিয়ে এলো একটা মেয়ে। শুভ্র সাদা রঙের একটা ড্রেসের সাথে, মাথায় হিজাব, হাতের ফাইলটা বুকের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অফিসে ঢুকছে। ভয়ে মুখটা শুকিয়ে গেছে, সেই ভীত মুখখানা আমার মনে দাগ কেটে গেলো। মেয়েটাকে দেখেই আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠেছিলো অজানা কারণে। মেয়েটাকে বাবার এক বন্ধুর কথায় জব দেওয়া হয়েছিলো। যত দিন যেতে থাকে মেয়েটার হাত নাড়িয়ে কথা বলার ধরণ, মুচকি হাসি, চলাফেরা সবই আমাকে মুগ্ধ করতে থাকে। ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নেয় একসময় কিন্তু তাকে নিজের মনের কথা জানানোর আগেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। মেয়েটা কে জানতে চাও ?

তিয়াসা হেঁচকি তুলে কেঁদে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে জানতে চায় না। কারণ তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি মেয়েটা যে সে নিজেই। তিয়াসা কখনো বুঝতেই পারেনি অপরদিকের মানুষটাও তাকে ভালোবেসে গেছে। সেও তো প্রথমদিন অফিসে ঢুকে রিসিপশনের সামনে কালো ফর্মাল ড্রেসে অ্যাটিটিউড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো।

মুগ্ধ বললো, মেয়েটা বড্ড বোকা। সে যদি একবার আমাকে সবটা বুঝিয়ে বলতো। আমি নিজেই তাকে সেই পরিস্থিতি থেকে হাত ধরে বের করে আনতাম। তা না করে মেয়েটা সব এলোমেলো করে দিলো। আমার এতোদিনের চেষ্টা সব নষ্ট করে মায়ের চোখে আমাকে আরো নিচে নামিয়ে দিলো। তাই তো বড্ড বেশি রাগ হয়েছিলো, রাগ থেকেই কষ্ট দিয়েছি। তাকে কষ্ট দিয়ে আমি কী ভালো ছিলাম ?

তিয়াসা আর সহ্য করতে পারলো না, পেছন ফিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধকে।

কাঁদতে কাঁদতে বললো, সরি।

মুগ্ধ মুচকি হেসে বললো, আমিও সরি। আর কখনো তোমার চোখে পানি আসতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।

অনেকটা সময় এভাবে থাকার পর মুগ্ধ আবার তিয়াসার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আই লাভ ইউ।

তিয়াসা মুগ্ধর বুকে মুখ লুকিয়ে মুচকি হাসলো তবে মুখে কিছু বললো না।

মুগ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো, উত্তর কে দিবে ?

তিয়াসা কিছু না বলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুগ্ধকে আর মুগ্ধ মুচকি হাসলো।

১২.
মায়ের সাথে কথা বলতে বড্ড ইচ্ছে করছে উৎসার। অনেক ভেবে কল করলো মায়ের নাম্বারে।

বার কয়েক রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে বিরক্তিমাখা গলায় ভেসে আসে, বারবার কল দিচ্ছ কেনো ?

উৎসা ভেবেছিলো এতোদিন পর কল পেয়ে মা হয়তো তার খোঁজ খবর নিবে। কিন্তু বরাবরের মতোই তাকে ভুল প্রমাণ করলো তার মা নামক মানুষটা।

উৎসা নিচু গলায় বললো, কেমন আছো মা ?

উৎসার মা বিরক্ত গলায় বললো, দেখো তোমার সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার সময় নেই আমার। তাই দরকারী কথা থাকলে বলো, টাকা লাগবে ? তোমার ছোটলোক বাবা টাকা দেয়নি এ মাসে এখনো।

উৎসার চোখ টলমল করে উঠলো পানিতে। মেয়ের খোঁজ নেওয়াও তার মায়ের কাছে অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয়। বাবা-মায়ের কাছে কল করলে একে অপরকে ছোট করতে ব্যস্ত হয়ে উঠে তারা এখনো। কেউ একটু মেয়ের খোঁজ নিতে রাজি নয় তারা।

উৎসা কান্না আঁটকে বললো, না টাকা লাগবে না।

উৎসার মা বললো, প্রয়োজন ছাড়া আমাকে বিরক্ত করবে না। আমার সংসার আছে, ছেলে মেয়ে আছে। তোমার জন্য অবচয় করার মতো ফালতু সময় নেই আমার। মেয়েটা রাত জেগে পড়াশোনা করছে, নুডলস খেতে চেয়েছে সেই কখন, ফোন রাখো আমি রান্না করছি।

উৎসা কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো। উৎসার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পরলো। তার খুব জানতে ইচ্ছে করে এতটাই যখন অবহেলা তবে তাকে জন্ম কেনো দিয়েছিলো। তারা তো নিজেদের জীবন নিয়ে বেশ আছে, তবে সে ছিটকে পরেছে অপ্রয়োজনের খাতায়। উৎসার বলতে ইচ্ছে করে মা আমিও তোমার হাতের নুডলস খেতে চাই, বাবা আমিও তোমার কাছে ছোট ছোট বায়না করতে চাই। কিন্তু উৎসার ইচ্ছেগুলো গলার দিয়ে আর আসতে পারে না। চাওয়ার আগেই সে পেয়ে যায় তার প্রতি মাসের খরচের টাকা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই। তবে চেয়েও পায়না একটু ভালোবাসার ছোঁয়া। সে মারা গেলেও হয়তো তার বাবা-মা বলবে তাকে জানাযা দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। উৎসা হঠাৎ করেই চিন্তায় পরে গেলো। কোনোদিন যদি সে এক্সিডেন্ট করে মারা যায়, তবে কী বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে কোনো হসপিটালের মর্গে পরে থাকবে সে ? দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্না করে দিলো উৎসা। একটু ভালোবাসা চাই তার, একটু হলেও চাই। ফোনটা আবার কেঁপে উঠলো উৎসার। একবার রিং হয়ে কেটে গেলে আবার বেজে উঠলো। সামনে ধরতেই ঝাঁপসা চোখে আননোন নাম্বার দেখে পাশে ফ্লোরে রাখলো। এবার বিরতি না দিয়ে বাজতেই থাকলো।

চোখ মুছে রিসিভ করে ভেজা গলায় বললো, হ্যালো কে ?

শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে ফেললো উৎসার গলা শুনে। কল রিসিভ করছে না দেখে চিন্তিত হয়েই বারবার কল দিচ্ছিলো। নাম্বারটা সেদিন নিয়েছিলো যেদিন উৎসা তাকে তিয়াসার ছবি দেখিয়েছে। হঠাৎ করেই ইচ্ছে করলো উৎসার সাথে কথা বলতে, কারণ সে এখন রিসোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আর উৎসার কথা মনে পরছে তার।

শুদ্ধ চিন্তিত গলায় বললো, উৎসা তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো ?

শুদ্ধর গলা চিনতে অসুবিধা হলো না উৎসার। এই মুহূর্তে শুদ্ধকে বড্ড আপন মনে হলো উৎসার কাছে। তাই চেয়েও কান্না আটকাতে পারলো না। শুদ্ধ কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। শুদ্ধ বিচলিত গলায় বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কী হয়েছে কী হয়েছে ? উৎসা কান্নার জন্য আর কথাই বলতে পারলো না, তাই কল কেটে ফোন বন্ধ করে দিলো। শুদ্ধ আবার কল করে ফোন বন্ধ পেলো। হঠাৎ করেই শুদ্ধর খুব অস্থির লাগতে শুরু করলো। এতো ভালোলাগা অশান্তিতে রুপ নিলো, উৎসার কান্নার আওয়াজ বুকে ব্যাথার সৃষ্টি করছে।

চলবে,,