#গোধূলি_বিকেলে_তুমি_আমি❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫৩ #অন্তিম_পর্ব
________________
রাতের জোৎসা ভরা আলো। নিরিবিলি চারপাশ। মস্ত বড় আকাশটায় তাঁরার ভিড়ে চাঁদ উঠেছে একটা। বাড়ির সামনের বড় গাছটা বাতাসের সংস্পর্শে নড়ছে কিছুক্ষন পর পর। মানুষের আনাগোনা খুব কম। রাস্তার সামনে আলোকিত ল্যামপোস্টটা দাঁড়িয়ে আছে নির্ঘুম হয়ে। আর এসবের ভিড়েই নিশ্চুপে নিজের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। দৃষ্টি তাঁর আলোকিত ল্যামপোস্টের দিকে। এমন সময় হঠাৎই পিছন থেকে বলে উঠল আদ্রিজা,
‘ আপনি আমায় বিশ্বাস করেন অভ্র?’
হুট করেই বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নটা কানে আসতেই খানিকটা চমকে উঠলো অভ্র। পিছন ফিরে তাকালো সে। তারপর নীরবেই বললো,
‘ মানে,
‘ মানেটা খুব সোজা আইথিংক আমি আপনায় এমন কিছু বলি নি যে আপনি বুঝতে পারেন নি। অনেকগুলো দিন হয়েছে আমরা একসাথে আছি, অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। এতদিনে আপনার মনে কি আমার জন্য বিশ্বাসের শক্ত দেয়াল তৈরি হয়েছে। নাকি,
আদ্রিজা আর কিছু বলার আগেই আদ্রিজার ঠোঁটে হাত দিলো অভ্র। তারপর বললো,
‘ হুস চুপ থাকো কিছুক্ষন।’
আদ্রিজা অবাক হলো, চরম অবাক হলো। এমন একটা সিরিয়াস বিষয়ে অভ্রের কান্ডে থমথমে চেহারায় তাকালো সে অভ্রের মুখের দিকে। অভ্রের হাবভাব ঠিক বুঝতে পারছে না আদ্রিজা। এরই মাঝে আদ্রিজাকে ঘুরিয়ে বেলকনির দিকে ধরলো অভ্র। তারপর পিছন থেকে আদ্রিজাকে জড়িয়ে ধরে আকাশ পথে তাকিয়ে বললো সে,
‘ আজকের চাঁদ খুব সুন্দর তাই না ব্ল্যাকবেরি?’
অভ্রের হুট করা কান্ডে অনেকটা বিস্মিত হয়ে আদ্রিজা পিছন ঘুরতে যাবে তাঁর আগেই বলে উঠল অভ্র,
‘ হুস পিছন ঘুরে না তুমি চাঁদটা দেখো,
আদ্রিজা আর ঘুরলো না আকাশ পথে তাকালো। মস্ত বড় আকাশে জ্বল জ্বল করা তাঁরার ভিড়ে থাকা চাঁদটাকে দেখলো সে পুরো সাদা হয়ে আছে। আদ্রিজা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘ হুম সুন্দর।’
‘ হুম শোনো আমাদের যদি ছেলে হয় তাহলে ওর নাম রাখবো চাঁদ আর যদি মেয়ে হয় তাহলে নাম রাখবো তাঁরা। সুন্দর না বলো।’
আদ্রিজা আবারও অবাক হলো চরম অবাক হলো। আবারও পিছন ঘুরে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই অভ্র বলে উঠল,
‘ হু তোমায় বললাম না পিছন ঘুরবে না। সামনে তাকাও,
আদ্রিজা সামনে তাকালো। আদ্রিজা সামনে তাকাতেই অভ্র বলে উঠল,
‘ আমি জানি তুমি কেন কিছুক্ষন আগে বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন করেছো। তুমি এটা ভাবছো তো তোমার প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে আমি তোমায় ভুল বুঝবো। বাকি সব ছেলেদের কথা জানি না কিন্তু আমি তো জানি আমার বউ কেমন। আর তাঁর চেয়েও বড় কথা সেদিন রুহুলের এনগেজমেন্টের পার্টির রাতে কি হয়েছিল আমার কিন্তু সব মনে আছে। এটা ঠিক প্রথমে মনে ছিল না কিন্তু পড়ে মনে পড়েছিল আর আজ তো। আমার একটা খারাপ লাগা ছিল সেটা হলো তুমি সেদিন আমায় মিথ্যে বলেছিলে। কিন্তু তুমি এটা কি করে ভুললে সেদিন ড্রিংক তোমার থেকে আমি কম করেছিলাম। সেদিন তোমায় হুট করে কোলে তুলে নেওয়া, তোমায় নিয়ে রুমে যাওয়া, তোমার ঠোঁটে..
অভ্র আর কিছু বলার আগেই আদ্রিজা নড়েচড়ে উঠলো। খানিকটা আমতা আমতা করে বললো,
‘ আর কিছু বলতে হবে না।’
অভ্র হাসলো। বললো,
‘ আমায় ভালোবাসবে আদ্রিজা। দেখো লাবণ্যকে নিয়ে আর ভেবো না। আমি জানি ওর খারাপ লাগছে তবে কি বলো তো দুনিয়ায় সবাই তো সবার জন্য জন্ম নেয় না আবার সবার ভালোবাসাও পূর্ণতা পায় না। তাই বলবো লাবণ্য, শ্রাবণকে ভুলে আমরা স্বাভাবিক দুজন স্বামী স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করতে পারি কি? ওঁরা অতীত ছিল। এখন তুমি আমার জন্য আর আমি তোমার জন্য বর্তমান। আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না ব্ল্যাকবেরি? আমি নিজেও জানি না আমি তোমাতে এতটা আসক্ত কি করে হলাম। তোমার গর্ভে আমাদের সন্তান আসতে চলেছে এটা যেমন একটা খুশির সংবাদ তেমনই আমার জন্য খানিকটা আতংকের। আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবো না আদ্রিজা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি তোমার কিছু হয়ে গেছে আমি যে পাগল হয়ে যাবো।’
বলতে বলতে আদ্রিজাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো অভ্র। এক অজানা ভয় এসে গ্রাস করলো তাঁকে। খানিকটা অস্থিরতাও ফিল হচ্ছে, অভ্র ঘামছে। আদ্রিজা যেন বুঝলো অভ্রের অবস্থাটা হুট করেই পিছন ঘুরে তাকালো সে, তাকালো অভ্রের মুখের দিকে। কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে অভ্রের মুখটা। আদ্রিজা অভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আপনি এত ঘামছেন কেন? আর এতো ভয় পাওয়ারও বা কি আছে। আমি আপনায় ছেড়ে কোথাও যাবো না অভ্র কারন আমিও যে আপনায় ভীষণ ভালোবাসি। নিজ অজান্তেই আপনায় আমি ভালোবেসে ফেলেছি।’
আদ্রিজার কথা শুনে অভ্রের প্রচন্ড খুশি লাগছে। তবে সেটা বাহিরে প্রকাশ করতে পারছে না। কারন দুশ্চিন্তায় মাথায় ঝেঁকে বসেছে তাঁর আর এই দুশ্চিন্তার কারনেই আদ্রিজার প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে থমথমে হয়ে ছিল অভ্র। আদ্রিজা নিজেই এবার জড়িয়ে ধরলো অভ্রকে। বললো,
‘ এখনো ভয় পাচ্ছেন কেন আমি আপনি ছেড়ে কোথাও যাবো না।’
অভ্র আদ্রিজাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
‘ আমার এক প্রিয় আন্টি ছিল আদ্রিজা, আমার বয়স তখন খুব বেশি নয়। আন্টি আমায় ভীষণ ভালোবাসতো নিজের থেকেও বেশি। আমিও বাসতাম। কিন্তু ওনার প্রথম বেবির ডেলিভারির সময় উনি মারা যান। আমি সেদিন খুব কেঁদেছিলাম আদ্রিজা। আমি সেই প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রনাটা আর পেতে চায় না। আন্টি চলে যাওয়াতে কষ্ট পেয়েছিলাম খুব কিন্তু নিজেকে সামলাতে পেরেছি কিন্তু তুমি তোমার কিছু হয়ে গেল আমি তো মরেই যা,
আর কিছু বলার আগেই অভ্রের ঠোঁটে হাত রাখলো আদ্রিজা। অভ্র থেমে গেল। অভ্র থামতেই অভ্রের বুকে মাথা রেখে বললো আদ্রিজা,
‘ আগেই নেগেটিভ ভেবে রাখছেন কেন আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন দেখবেন কিছু হবে না।’
অভ্র শুনলো আদ্রিজার কথা। আদ্রিজাকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। ঠিকই তো অাগেই ওসব নেগেটিভ চিন্তা ধারা কেন আসে মাথায়। অভ্র আদ্রিজার কপালে চুমু কাটলো। বললো,
‘ তোমায় খুব ভালোবাসি ব্ল্যাকবেরি, কখনো ছেড়ে যেও না।’
আদ্রিজাও শুনলো অভ্রের কথা। পুরনো সব ভুলে মুচকি হেঁসে বললো,
‘ আমিও ভালোবাসি আপনায় আমার প্রিয় কমলা লেবু।’
মুচকি হাসলো অভ্র। তবে কিছু বললো না।’
____
মাঝখানে কেটে গেল কয়েকটা দিন।’
এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভ্রের মা বাবা, আরু, তুষার, অভ্র, আদ্রিজা সহ লাবণ্যের বাবা মা সাথে অভ্রদের কিছু ফ্রেন্ড। আজ লাবণ্য দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যাচ্ছে তাঁর স্বপ্নের দিকে। আমেরিকায় তাঁর ভার্সিটির টিচার হওয়ার স্বপ্ন পূরনের উদ্যাগেই এগিয়ে যাচ্ছে লাবন্য। সাথে নিজের দেশ আর নিজের সেই প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে বহুদিনের জন্য। ভিতর থেকে কষ্ট হচ্ছে তবে নিজেকে সামলে নিচ্ছে লাবণ্য যতই হোক অভ্র আদ্রিজাকে ভালোবাসে তাই ওদের মাঝখানে থাকা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। লাবণ্য সামলালো নিজেকে চোখের পানি মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। এমন সময় পিছন থেকে বলে উঠল আদ্রিজা,
‘ আপু,
লাবণ্য ঘুরে তাকালো সামনেই আদ্রিজাকে দেখে নিজেকে সামলে বললো,
‘ হুম বলো,
‘ আমার খুব খারাপ লাগছে আপু, তুমি ইচ্ছে করেই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছো তাই না? আমি জানি আপু তুমি অভ্রকে ভীষণ ভালোবাসো। মাঝখান থেকে আমি এসে,
বলতে বলতে কেঁদে উঠলো আদ্রিজা। আদ্রিজার কান্ডে লাবণ্য এগিয়ে এসে আদ্রিজার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
‘ দূর পাগলী মেয়ে এভাবে কাঁদছো কেন? তুমি এতটা ইমোশনাল জানতাম না তো। আর কে বলেছে তুমি আমাদের মাঝখানে এসেছো। জানো সেদিন অভ্রের অফিসে যখন আমি গিয়েছিলাম আমি সত্যি ভাবি নি তুমি ওখানে থাকবে? অভ্রকে হুট করে জড়িয়ে ধরেছিলাম বলে তোমার হয়তো খারাপ লেগেছিল যাইহোক তুমি জানো সেদিন অভ্র আমায় কি বলেছিল? এটা ঠিক অভ্রও একটা সময় আমাকে পছন্দ করেছিল কিন্তু আমায় ভালোবাসে নি তাই তুমি আমাদের মাঝে এসেছো এটা ভেবে কষ্ট পেও না অভ্র তোমায় ভীষণ ভালোবাসে আদ্রিজা কখনো ওকে দুঃখ দিও না। ভালো থেকো তোমরা। আমি হয়তো এখানে আর ফিরবো না তবে তোমাদের জন্য দোয়া করবো সবসময়।’
লাবণ্যের কথা শুনে বেশ আগ্রহ নিয়েই বলে উঠল আদ্রিজা,
‘ সেদিন অফিসে অভ্র কি কিছু বলেছিল তোমায় আপু?’
উওরে লাবণ্যও বলে উঠল,
‘ হুম বলেছিল তো,
ফ্ল্যাসবেক,
সেদিন অফিসে খাবার খাওয়ার শেষের দিকে অভ্র বলে উঠেছিল হঠাৎ করে,
‘ তুই নিয়তিকে বিশ্বাস করিস লাবণ্য?’
আচমকাই নিয়তি নামক উক্তিটি শুনে খানিকটা ভরাট গলায় অভ্রের দিকে তাকিয়ে বললো লাবণ্য,
‘ নিয়তি,
‘ হুম নিয়তি। আদ্রিজা হলো আমার একটা নিয়তি জানিস। ওর সাথে হুট করে যেখানে সেখানে দেখা হয়ে যাওয়া। ওকে বিয়ে করা সম্পূর্ণটাই বলতে পারিস আমার আর আদ্রিজার নিয়তি বা ভাগ্য। আমার শুরু থেকেই আদ্রিজাকে ভালো লাগতো। ওর হাঁটা চলা, শান্ত স্বভাব, ওর স্টাইল সবকিছুই ভালো লাগতো আমার। আর এই ভালো লাগার জন্যই হয়তো বিয়ের দিন ওকে বিয়ে করতে গিয়ে খারাপ লাগে নি। আমার একবারও ওর ওপর রাগ আসে নি। উল্টো ভালো লেগেছিল। তুই হয়তো জানিস না একটা সময় তোর এই ভালোবাসি শব্দটা শোনার জন্য আমি কতটা ব্যাকুলতার শীর্ষে ছিলাম। কারন আমিও ভেবেছিলাম আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু আজ যখন তুই আমায় ভালোবাসি বললি আমার মাঝে কোনো ফিলিংসই ছিল না। এই দেখ না তুই সেই কবে আমার জন্য চিঠি লিখে গিয়েছিলি আমি আজও পরে দেখি নি। আমি তোকে কখনো ভালোবাসি নি লাবণ্য। আমি আদ্রিজাকেই নিজ অজান্তেই শুরু থেকে ভালোবেসে এসেছি অথচ বুঝতে পারি নি। আমি জানি লাবণ্য তোর হয়তো আমার কথাগুলো শুনে এখন খুব খারাপ লাগছে কিন্তু একটা সময় দেখবি তুই আমার চেয়েও ভালো কাউকে পাবি যে তোকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে। আমায় ভুলে যা দোস্ত আমি তোর সাথে সারাজীবন ভালো বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। কারন আমি যে আদ্রিজাকে নিয়েই ভালো আছি। আর ওর সাথেই কাটাতে চাই সারাজীবন। আশা করি তুই বুঝতে পেরেছিস আমি কি বলতে চাইছি। তুই আমার বন্ধু, তাই তোর কাছে কিছু গোপনীয় রাখতে চাই নি। তাই তোকে যে আমি ভালোবাসি ভেবেছিলাম একটাসময় সেটাও বলে দিলাম।’
ফ্লাসবেক অভার!
সেদিন অভ্রের প্রতিটা কথাই মন দিয়ে শুনেছে লাবণ্য আর সামলেও নিয়েছে। সেদিন পাল্টা তেমন কিছুই বলেনি লাবন্য শুধু এতটুকুই বলেছিল,
‘ ভালো থাকিস তোরা দুজন।’
হয়তো সেদিন লাবন্যও ভেবে নিয়েছিল। সত্যি তাঁর জন্যও কোথাও না কোথাও কেউ একজন আছে। যে সত্যি তাঁকে ভালো বাসবে।’
আচমকাই আদ্রিজার ডাকে হুস আসলো লাবণ্যের সাথে নিজের ভাবনা থেকেও বেরিয়ে আসলো সে। আদ্রিজা লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ কি হলো আপু তুমি কিছু বলছো না কেন?’
লাবণ্য মুচকি হাসলো। বললো,
‘ অভ্র আমায় এটাই বলেছে ও আমায় নয় তোমায় ভালোবাসে। অভ্রের ভালোবাসা হারিয়ে যেতে দিও না কখনো যত্নে রেখো সবসময়। এখন আমায় যেতে হবে।’
বলেই একে একে সবাইকে বিদায় জানিয়ে চললো লাবন্য নিজের গন্তব্যের দিকে। হঠাৎই তুষার বললো,
‘ ললিতা সুন্দরী তোকে খুব মিস করবো রে,
উওরে লাবণ্যও পিছন ফিরে মুচকি হেঁসে বললো,
‘ আমিও।’
অতঃপর লাবণ্য লাস্টবারের মতো অভ্রের দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যায় এয়ারপোর্টের ভিতরে। নতুন গন্তব্যের নতুন জীবনের দিকে, সাথে সেই ভালোবাসার মানুষটিকেও তো পেতে হবে।’
লাবণ্যের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো সবাই। মুহূর্তের মাঝেই চোখের আড়ালে চলে গেল লাবণ্য।’
”
হাতে টিকিট পাসপোর্ট নিয়ে নিজের সিটের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে লাবন্য হঠাৎই মাথায় টুপি দিয়ে তার উইন্ডো সিটে কাউকে বসে থাকতে দেখে হতাশ হলো লাবন্য। খানিকটা বিরক্ত নিয়ে বললো,
‘ এক্সকিউজ মি মিস্টার আপনি আমার সিটে বসে আছেন?’
কোনো মেইলি ভয়েস কানে আসতেই নিজের মাথার টুপিটা মুখ থেকে সরিয়ে সামনে ঘুরে তাকলো কাব্য। সামনেই একটা মেয়েকে দেখে বললো,
‘ ইয়েস,’
‘ আপনি আমার সিটে বসে আছেন উঠুন জলদি। (খানিকটা রাগ দেখিয়ে)
লাবণ্যের রাগ দেখে নিজের জায়গা থেকে উঠতে উঠতে বললো কাব্য,
‘ কুল ডাউন মিস ভুল করে বসে ফেলেছি এত রাগ দেখানোর কি আছে আর আপনার পাশের সিটটাই আমায়।’
‘ তো নিজের সিটে বসছেন না কেন?’
‘ বাবা এই দেখি পুরোই ধানি লঙ্কা।’
কাব্যেরর কথা শুনে চোখ মুখ শক্ত করে বললো লাবন্য,
‘ কি বললেন আপনি?’
‘ না না কিছু বলি নি বসুন আপনার সিটে।’
বলেই কাব্য উঠে গেল। কাব্য উঠতেই নিজের সিটে বসে পড়লো লাবণ্য। আর কাব্যও সরে এসে বসলো লাবণ্যের পাশ দিয়ে। হঠাৎই কাব্য বলে উঠল,
‘ তা আপনিও বুঝি আমেরিকা যাচ্ছেন?’
বিরক্ত হলো লাবণ্য। বললো,
‘ কেন আমেরিকার প্লেন কি আমাদের লন্ডন নিয়ে যাবে।’
‘ না সেটা নয় যাই হোক। আপনি কি সিঙ্গেল?’
চোখ গরম করে তাকালো লাবণ্য। সঙ্গে সঙ্গে কাব্য চুপ হয়ে গেল। আর কিছু বললো না। তবে আবার বলবে সে, কারন পাশের মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই কোনো কারন ছাড়াই ভালো লেগেছে তাঁর। কে বলতে পারে এই ভালো লাগা থেকেই হয়তো ভালোবাসা হয়ে যাবে লাবণ্য আর কাব্যের।’
_____
গোধূলি বিকেল চলছিল তখন। এয়ারপোর্টের উল্টোদিকের রাস্তাটা ছিল নির্জন। আর এই নির্জন প্রকৃতির ভিড়েই পাশাপাশি হাঁটছিল অভ্র আর আদ্রিজা। নীরবতা চলছিল দুজনের মাঝে। হঠাৎই অভ্র বলে উঠল,
‘ গোধূলি বিকেলে তুমি আমি দুজন’
নির্জন এই প্রকৃতির ভিড়ে হাঁটছি নীরব হয়ে বিষয়টা খাপছাড়া নয় কি?’
উওরে আদ্রিজা বললো,
‘ তাহলে কিভাবে হাঁটবো?’
‘ হাত ধরে হাঁটবে পাশাপাশি কাছাকাছি হয়ে হাঁটবে।’
হাসলো আদ্রিজা। আনমনেই অভ্রের হাত ধরে বললো সে,
‘ এবার হয়েছে,
‘ উফ! বড্ড লেগেছে।’
আদ্রিজা চমকে গিয়ে বললো,
‘ কোথায়?’
উওরে নিজের বুকের বাম দিকটা দেখিয়ে বললো অভ্র,
‘ এখানে,
হেঁসে ফেললো আদ্রিজা। যা দেখে বললো অভ্র,
‘ কোনো এক ‘গোধূলি বিকেলে তুমি আমি’ একসাথে বের হবো। তুমি পড়বে শাড়ি আমি পড়বো পাঞ্জাবি। নির্জন বিকেলের কোনো এক নির্জন জায়গায় পাশাপাশি বসবো দুজন। হাতে হাত রেখে বলবো শুধু একটি কথা,
‘ তোমায় ভালোবাসি, ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।’
শুনবে কি?’
উওরে আদ্রিজাও মুচকি হেঁসে বললো,
‘ হুম শুনবো।’
মুচকি হাসলো অভ্র। এরই মাঝে আকাশ পথ বেয়ে ছুটে চললো মস্ত বড় প্লেন যেই প্লেনে ছিল লাবণ্য। আদ্রিজা অভ্র দুজনেই তাকিয়ে রইলো সেটার যাওয়ার পানে। হঠাৎই আদ্রিজা বললো,
‘ দোয়া রইলো আপু তুমিও ভালো থাকো তোমার জীবনেও নতুন কেউ আসুক। যে তোমায় সত্যি সত্যিই ভীষণ ভালোবাসবে।’
অভ্র শুনলো অাদ্রিজার কথা আনমনে মুচকি সে। সাথে নিজেও প্রার্থনা করলো সত্যি সত্যিই লাবণ্যের লাইফে কেউ আসুক। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো অভ্র আদ্রিজা। তারপর বেশি না ভেবে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েই চললো নিজেদের গন্তব্যের দিকে।’
আর প্লেনে চড়েই পাশাপাশি বসে ছুটে চলছিল কাব্য আর লাবণ্য। লাবণ্যকে বিরক্ত করছে সে, আর লাবণ্য শুধু চোখ গরম করে তাকাচ্ছে তাঁর দিকে। বিষয়টা সুন্দর না।’
____
মাঝপথে কেটে গেল পুরো ১০ মাস। এই ১০ মাসে বদলে গেছে অনেককিছু আদ্রিজা অভ্রের সম্পর্কটাও হয়ে গেছে গভীরত থেকে আরো গভীরত। রোজ অফিস থেকে ফিরে আদ্রিজাকে খাইয়ে দাইয়ে, ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো,ওর সেবা করাই যেন অভ্রের একটা ডেইলি রুটিন। ডেলিভারির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল টেনশনটাও যেন ততই বাড়ছিল অভ্রের। প্রতিদিন আল্লাহর দরবারে মাঝরাতে উঠে নামাজ পড়ে আদ্রিজার জন্য কাঁদে সে। আদ্রিজা ঘুমের ঘোরে প্রায় দেখেছে সেটা তবে অভ্রকে বুঝতে দেয়নি। মনে মনে ভীষণ খুশিও হতো, সাথে ভাবতো কতটা ভাগ্যবতী সে। অভ্র তাঁকে সত্যি ভীষণ ভালোবাসে।’
পরিশেষে ডেলিভারির দিনটা চলে আসলো। এই ১০ মাসে আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল সেটা হলো আরু আর আশিকের সম্পর্কটা সবাই জেনে গেছে। আদ্রিজাদের বন্ধুমহল তো পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল শেষে কি না আরু সেই থার্ডক্লাস কবিতার কবিরই প্রেমেই পড়লো। বিষয়টা জানার পর অভ্রের বাবা, আশিকের মা একটু কিন্তু কিন্তু করলেও পরক্ষণেই মেনে নিয়েছে সবটা। যতই হোক ছেলেমেয়েদের সুখের বিষয় নিয়ে কথা। তবে ওদের বিয়েটা, আশিক আর আরু যেহেতু সেইম এইজের তাই আপাতত সরা কাবিন করে রেখেছে সবাই। কনে বিদায়টা ওদের পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়ার পরই হবে। আরু আশিকও মেনে নিয়েছে সবটা। প্রচন্ড খুশি তাঁরা।’
”
হসপিটালের অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে চিন্তিত মাখা মুখ নিয়ে আছে অভ্রসহ সবাই। তুষারও বসে আছে। বেশ ঘন্টাখানেক আগেই আদ্রিজাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। আদ্রিজার চিৎকার শোনা যাচ্ছে, আদ্রিজার চিৎকারে অভ্রের বুকটা ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে অপারেশন থিয়েটার ভেঙে আদ্রিজাকে বাহিরে বের করতে। কষ্ট হচ্ছে তাঁর ভীষণ কষ্ট। এরই মাঝে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল সাথে সাথে উপস্থিত সবার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। তাঁর কিছুক্ষনের মধ্যেই একজন নার্স একটা ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে বাহিরে আসলো। অভ্র তক্ষৎনাত এগিয়ে গেল। অভ্রকে দেখেই নার্সটি খুশি হয়ে বললো,
‘ কনগ্রেস মিস্টার অভ্র আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন।’
নার্সের কথা শুনে সবাই আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে আলহামদুলিল্লাহ বললো।’
অভ্র খানিকটা নিচু হয়ে মেয়ের কানের সামনে মুখ নিয়ে আযান দিলো। সে ছিল এক মধুর মুহূর্ত। আযান দেওয়া শেষ হতেই অভ্র কোলে তুলে তাঁর মেয়েকে চুমু আটলো কয়েকবার। প্রথমবার মেয়ের বাবা হওয়ার অনুভূতিটা যেন সত্যি দারুণ। অভ্র মেয়েকে কোলে নিয়ে খানিকটা চিন্তিত স্বরে বললো,
‘ মেয়ের মা কেমন আছে নার্স?’
উওরে মুচকি হেঁসে বললো নার্সটি,
‘ সুস্থ আছে ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার অভ্র।’
সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে আর একটু শক্ত করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো অভ্র,
‘ এবার আমার সবাই খুব আনন্দে থাকবো মাই প্রিন্সেস।’
___
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আদ্রিজা। কতক্ষণ আগেই জ্ঞান এসেছে তাঁর। একে একে সবাই দেখা করে গেছে তাঁর সাথে। শুধু অভ্র আর তাঁর মেয়ে বাকি। আদ্রিজা বুঝচ্ছে না অভ্র এখনও আসছে না কেন? সেই কখন থেকে অভ্র আর মেয়েকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে আদ্রিজার। এমন সময় মেয়েকে কোলে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো অভ্র। বললো,
‘ ব্ল্যাকবেরি,,
সেই চিরচেনা কন্ঠে প্রিয় মানুষটির মুখে সেই প্রিয় নামটি শুনতেই সামনে তাকালো অাদ্রিজা। খুশি হয়ে বললো,
‘ আপনি এসেছেন?’
উওরে অভ্রও তাঁর মেয়েকে কোলে নিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
‘ হুম।’
অভ্র এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে আদ্রিজার কোলে দিলো। আদ্রিজাও কোলে নিলো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু আটলো কয়েকবার। আদ্রিজার খুশি দেখে অভ্র আদ্রিজার কপালে চুমু এঁটে দিয়ে বললো,
‘ থ্যাংক ইউ।’
খুশি হলো আদ্রিজা। সেও অভ্রের হাতটা ধরে চুমু দিয়ে বললো,
‘ ভালোবাসি।’
উওরে আদ্রিজার পাশে বসে বললো অভ্র,
‘ জানি তো।’
বুকে মাথা রাখলো আদ্রিজা। অভ্রও জড়িয়ে ধরলো আদ্রিজাকে। তবে আজ কিছু বললো না নীরব থাকলো দুজন।’
ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দে ছুটছিল তখন। বাহিরে হিম শীতল, গোধূলি বিকেলের বাতাস বইছিল চুপচাপ। সূর্যটা চলে যাওয়ার আভাস আসছিল সাথে। হসপিটালের জানালা টপকে আসছিল সেই বাতাস। সাথে প্রকৃতি যেন বলছিল তাদের,
শোনো সবাই,
আজ গোধূলি বিকেল চলে যাচ্ছে আবার। সাথে দিয়ে যাচ্ছে দুজন মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসার একটা নতুন ফুলের ছোঁয়া। জানো তো সেই ফুলের নামটা কিন্তু রোজ রাতে আকাশের মাঝে ভেসে ওঠে বার বার। ভুলো না আবার। মনে রেখো সবসময় অনুভূতির বিশাল দেয়াল নিয়েই এই,
‘গোধূলি বিকেলে তুমি আমি’ উপন্যাসটিকে!’❤️
#সমাপ্ত…🌹