গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব-১৭+১৮

0
241

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

নিজের ঘরের দরজা খুলে একটু বের হয়ে আশপাশটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে রাগিনী। পুরো করিডরের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত বেশ ভালোভাবে দেখে নেওয়ার পর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। কোহিনূর সোফায় বসে ঘুমে ঢুলছে। চোখটা বন্ধ করছে আবারও খুলছে। মাথাটা ঘুমে নিচু হয়ে আসছে আবারও হুঁশ এলে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করছে। অতঃপর নিজের বিরক্তির শ্বাস ফেলে একহাতে নিজের চোখেমুখে হাত দিয়ে ডলে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলছে। রাগিনী আশ্চর্য হয়ে সব কাহিনী দেখছে। এতো ঘুম কই থেকে আসছে তার? সারারাত কি ঘুমাতে পারে নি? রাগিনী একটু ফিসফিস করে ডাকার চেষ্টা করল,
“চলে আসুন। রাস্তা ফাঁকা আছে। আপনাকে বাড়ির বাহিরে বের করতে পারলে তবেই আমার শান্তি।”

“কিন্তু আমার শান্তি হয় তোমায় অশান্তি দিয়ে মিস. রাগের রানী!”

কোহিনূরের নির্লিপ্তভাবে স্বীকার! চকিতে তাকায় রাগিনী। লোকটা যে তাকে ইচ্ছে করে জ্বালায় সেটা বুঝতে পেরেছে সে এর আগেই। কিন্তু এই জ্বালা যে তার আনন্দের সেটা হয়তবা কোহিনূর সাহেব এখনো বুঝতে পারেন নি। পারার দরকারও নেই। রাগিনী মুখে রাগের ছাপ এনে বলে,
“বের হন আমার ঘর থেকে।”

ঠোঁট বাঁকিয়ে কোহিনূর থমথমে গলায় উত্তর দেয়,
“যাচ্ছি যাচ্ছি। আমার এখানে আসারও কোনো ইচ্ছে ছিল না। নেহাতই আমার জন্যই তোমার…”

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে নিজের জবান বন্ধ করল কোহিনূর। হাই তুলতে তুলতে হেলেদুলে ঘর থেকে বের হলো। রাগিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাকি কথা শোনার জন্য। কী বলতে চাইলো লোকটা? পিছু পিছু বেরিয়ে এলো রাগিনী। হাঁটতে লাগল কোহিনূরের পেছন পেছন। কোহিনূর তার প্যান্টের দুই পাশের পকেটে হাত দিয়ে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে যাচ্ছে। রাগিনী হতবাক তার কর্মকান্ডে। হঠাৎ করে কোহিনূর ঠোঁট দিয়ে শিষ বাজিয়ে ওঠাতে ধড়ফড়িয়ে উঠল রাগিনী। লোকটার হাবভাব যেন এমন যে সে তার নিজের বাড়ির করিডোর দিয়ে যাচ্ছে। শিষের শব্দ যেন কারোর কান অবধি না পৌঁছে তাই দ্রুত ছুটে গেল রাগিনী কোহিনূরের পিছু। কাছাকাছি আসতেই কোহিনূরের পরনের জামা টেনে ধরে পায়ের তালুতে ভর করে একটু উঁচু হয়ে ঝাঁপিয়েই পেছন থেকে কোহিনূরের মুখে হাত রেখে তার শিষ বাজানো বন্ধ করার চেষ্টা করল সে। আতঙ্কে নিজেরও যেন বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। এই মূহুর্তে কোহিনূরকে বাড়িতে দেখলে কাহিনীর শেষ হবে না। তা নিয়ে বেশ ভয়ে আছে রাগিনী। সে ধীরে ধমকে বলে ওঠে,
“চুপ, চুপ! নিজের বাড়ি পেয়েছেন নাকি? আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি লুকিয়ে এসেছেন আর লুকিয়েই বের হতে হবে।”

বলা শেষে দূরে সরে আসে রাগিনী। তারপর ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলে,
“আমার পেছন পেছন আসুন।”

“এজ ইউর উইশ।”

রাগিনী কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করে। আশপাশ নজরে রাখে। দোতলার করিডোরে কেউ নেই। তাই সিঁড়িতে পা রাখে সে। কিছুটা নেমে খেয়াল করে নিচের হলরুমে সৈয়দ কাজ করছে। প্রতিটা শোপিচ, সোফার হ্যান্ডেল সযত্নে মুছতে ব্যস্ত সৈয়দ। তা দেখে ফট করে পিছু ফিরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা কোহিনূরের দিকে তাকায় রাগিনী। আর চোখ গরম করে বলে উঠল,
“আর আসবেন না। নিচু হন। নয়ত আপনাকে দেখতে পেয়ে যাবে।”

“এতো মহা মুশকিল!”

“আপনিই তো ডেকে এনেছেন মুশকিল। নিচু হন।”

খানিকটা জোরে ঝাড়ি দেওয়ায় নিজেই থতমত খেয়ে সৈয়দের দিকে তাকায় রাগিনী। সৈয়দ রাগিনীর আওয়াজ পেয়ে সবে সিঁড়ির দিকে তাকিয়েছেন। তৎক্ষনাৎ কোহিনূর নিচু হয়েছে। রাগিনী অপ্রস্তুত হেঁসে নিচে চলে আসে। এসেই সৈয়দের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“কাকা, আসলে হয়েছে কি! বাবার রুমটার ফার্নিচারগুলোতে অনেক ময়লা পড়েছে। তুমি তো এখানকার জিনিস মুছে নিচ্ছো। তাহলে যদি সেখানকার জিনিসও মুছে নিতে। জানোই তো, বাবার অপরিষ্কার জিনিসপত্র পছন্দ না।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনি যাইতেছি তাহলে পরিষ্কার করতে। এখন শরীর কেমন তোমার? ঠিক আছো তো?”

বেশ বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল সৈয়দ। রাগিনী মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করল,
“হ্যাঁ, আমি এখন একদম ঠিক আছি।”

“যাক ভালো! আমিই ভয় পেয়ে গেছিলাম তোমার অবস্থা দেখে। ভালো মেয়েটা বাড়ি থেকে বের হয়ে এমন অবস্থায় ফিরলো! না জানি তোমার বাবা কতটা ভয় পেয়েছিল।”

বলতে বলতে রাশেদ সাহেবের রুমের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরের দিকে চোখ যায় রাগিনীর। সেখানে সাহানা রান্না করছে। সাহানা এখানে না থাকলেও রান্না করার জন্য আসেন শুধুমাত্র। রান্না করে দিয়ে চলে যান। চোখে একটু কম দেখেন বয়স হওয়ায়। তাই রাগিনী পিছু ফিরে সিঁড়ির দিকে চেয়ে কোহিনূরকে ইশারা করে আসতে বলতেই কোহিনূর দ্রুত নেমে পড়ে। রাগিনী ফিসফিস করে বলে,
“এদিকে পেছনের দরজা। গিয়ে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

কোহিনূর দ্রুত পেছন দিকে এগোতেই সাহানা রান্না করতে করতে হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলেন,
“কে? কে ওখানে?”

হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। তার হয়েছে জ্বালা! যেদিকে যায় সেদিকেই বিপদ। রাগিনী সাহানাকে সামলাতে বলে ওঠে,
“খালা, আমি! এখানে আমি আছি।”

“তুমি না। মনে হইলো কোনো বেডা মানুষ দৌড়াইয়া পেছন দিকে গেল।”

“কই না তো। আমি তো এখানেই আছি। আমি তো কাউকে দেখলাম না। খালা! দিন যাচ্ছে তোমার দৃষ্টি এতোই প্রখর হচ্ছে যে তুমি ভুলভাল জিনিস দেখছো।”

সাহানার যেন বিশ্বাস হয় না। সে তো কিছুটা স্পষ্টই দেখেছে। তার উপরে শহরে এসেছে আত’ঙ্কবাদী। সাহানা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকেন। এসব নিয়ে তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা! তিনি জলদি গ্যাসের চুলো অফ করে দিয়ে গরম খুন্তি নিয়ে এগিয়ে আসেন। রাগিনী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না! রাগিনীর নিকট এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে সাহানা আদুরে ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
“তুমি জানো না মণি! আজকাল আত’ঙ্কবাদীর উপদ্রব হইছে। আমার সত্যিই মনে হইতেছে কেউ ছুটে গেল চোরের মতো। তুমি দাঁড়াও আমি গিয়া দেখি।”

বলেই বাড়ির পেছন দিক ধরে হাঁটা শুরু করলো সাহানা। হাতে সাবধানে ধরে রেখেছেন গরম খুন্তি। পিছু পিছু ভয়ে ভয়ে হাঁটছে রাগিনী। মিনমিন করে বলে,
“খালা! তুমি ভুল কিছু দেখেছো। তোমার চোখে তো সমস্যা! যাও না রান্না করো।”

সাহানা রাগিনীর কথা কানেও তুলল না। বরং সামনে এগিয়ে গিয়ে পেছনের ছোট দরজার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল। কাউকে দেখতে না পেয়ে আশ্বস্ত হয়ে ফিরতে লাগলেন উনি। রাগিনীও কিছুটা ক্ষ্যান্ত হলো এই ভেবে যে কোহিনূর হয়ত বেরিয়ে গার্ডেনের পেছনের দিকে রয়েছে। কিন্তু তার ধারণা ভাঙলো। কোহিনূর নিচতলার বারান্দা শুরু হওয়ার দিকে যেই দরজা রয়েছে তার ফাঁকে লুকিয়ে। তা দেখে আপনাআপনি হেঁচকি উঠে যায় রাগিনীর। কাঁদো কাঁদো হয়ে সাহানার পানে চাইলো সে। উনি সোজা দৃষ্টি রেখে হাঁটছেন। নজরে আসেনি কোহিনূর। হেঁটে এসে হঠাৎ করেই বারান্দার কাছের দরজায় দাঁড়াল সাহানা। এই মূহুর্তে সাহানা দরজার এপাশে, কোহিনূর দরজার ওপাশে। আর কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে রাগিনী দুজনকেই দেখছে। হঠাৎ করেই সাহানার গরম খুন্তিটা দরজার ওপাশে থাকা কোহিনূরের বাম হাতে ঠেকল। শিরদাঁড়া যেন নড়ে উঠল কোহিনূরের। চোখমুখ লাল হয়ে এলো। হাতটা জ্বলে উঠল। চিৎকার দিতে নিল। কিন্তু সামনে থাকা রাগিনীকে দেখে আর চিৎকার করাটা হয়ে উঠল না তার। মেয়েটা আস্তে করে ইশারা করে তাকে মানা করছে চিল্লিয়ে উঠতে। হাতটা তৎক্ষনাৎ সরিয়ে আলতো করে ফুঁ দিতে লাগল কোহিনূর। সাহানা এবার তেমন না পেয়ে চলে গেল। হাফ ছাড়ল রাগিনী। দমটা যেন আঁটকে ছিল ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে। কোহিনূরের হাতটা টেনে দরজার আড়াল থেকে বের করে বলল,
“একটু হলে কী ঘটে যাচ্ছিল জানেন? আপনাকে আর এক মূহুর্তও বাড়িতে রাখা যাবে না। বের হন! বের হন এক্ষুনি।”

কোহিনূর মুখটা কাঁচুমাচু করে বের হবার গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর!”

রাগিনী ধুপধাপ করে হেঁটে এসে দরজার লক খুলে বলে,
“আমি চুরি করা জিনিস পছন্দ করি না। তাই চুরি করতে হবে না। দয়া করে চুরি করা বন্ধ করুন।”

বলে কিছুক্ষণের জন্য থামে রাগিনী। আর বাহিরের দিকে ইশারা করে ক্ষেপে উঠে বলে,
“এখন বাহিরে যান।”

কোহিনূর সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখভঙ্গি বদলায়। কেমন যেন ছড়িয়ে যায় মলিনতা। রাগিনীর ভ্রু উঁচিয়ে এমন পরিবর্তনের কারণ জানতে উৎসুক হয়। লোকটা কী তার কথায় রাগ করল? তবে রাগিনীকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কোহিনূর একটু ঝুঁকে রাগিনীর কপালে আঙ্গুল রেখে মলিন সুরে বলে ওঠে,
“আই এম সরি, রাগিনী! এগেইন আই এম সরি।”

নড়চড় নেই রাগিনীর। কোহিনূর তাকে সরি কেন বলছে হঠাৎ? কারণটা রাগিনীর মাথায় এলো না কিছুতেই। পরক্ষণেই সোজা হয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কোহিনূর। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল রাগিনী কিছুক্ষণ। মনে হলো, লোকটা বোধহয় লুকিয়ে এসে তার সমস্যা বাড়িয়েছে সেটা বুঝতে পেরে সরি বলল। এটা ভেবে নিয়েই রাগিনী দ্রুত পেছনের দরজা দিয়েই বের হয়।

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসেছে রাগিনী। মনোযোগটা সামনের দিকে রাস্তায়। খুব সিরিয়াস মুখের ভাব। পাশে কোহিনূর বসে বসে একবার আশেপাশে আরেকবার রাগিনীর দিকে চেয়ে রয়েছে। দৃষ্টির ধরণটা অন্যরকম। রাগিনী ড্রাইভিং করছে। সেটা দেখে কিছুটা হতবাক কোহিনূর। রাগিনী কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায়নি। সে চায়নি ড্রাইভারকে নিয়ে যেতে কারণ রাশেদ সাহেবকে জানিয়ে দিতে তার সময় লাগবে না। কোহিনূর কন্ঠে বাচ্চা বাচ্চা ভাব এসেছে এবার।
“তুমি গাড়িও চালাতে পারো রাগের রানী?”

“উঁহু! শিখেছিলাম এর আগেরবার বাড়িতে এসে। কিন্তু এভাবে ড্রাইভ করা হয়নি। এখন আপনার জন্য সব করতে হচ্ছে। এখন যদি ভুলভাল কিছু হয়ে যায় আমার অদক্ষতার কারণে দায়ি থাকবেন আপনি বুঝলেন?”

“আমাকে কেন দোষারোপ করছো? কী করেছি আমি?”

রাগিনী চোখ বাঁকিয়ে আঁড়দৃষ্টিতে দেখে কোহিনূর মুখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় করেছে। রাগিনী বলে,
“আপনি আবার কী করবেন? কিছুই না। এই শুধুমাত্র আমার বাড়িতে গিয়ে ছোটখাটো ব্লান্ডার করে এসেছেন।”

“আচ্ছা! মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে ড্রাইভিং করতে হয়?”

কোহিনূরের উদ্ভট প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাগিনী। স্টিয়ারিং থেকে আপনাআপনি এক হাত চলে যায় তার মাথায়। আসলেই তো! এখনো কোহিনূরের বেঁধে দেওয়া টাওয়াল তার মাথাতেই আছে। এতো টেনশনে সবটা গুলিয়ে গেছে তার। অমনোযোগী রাগিনীর হুঁশ ফেরে সামনে থেকে আসা তীব্র হর্ণের শব্দে। পাশ থেকে উশখুশ করছে কোহিনূর। মিনমিন করে বলছে,
“রাগের রানী, রাগের রানী! সামনে বড় গাড়ি। ধাক্কা দিয়ে দেবে তো।”

রাগিনী সামনে থাকা বড় ট্রাক দেখেই যেন সমস্ত শক্তি বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। অনেকটা কাছে চলে এসেছে। মৃত্যু যেন অনেক কাছে। চোখ খিঁচে বন্ধ হয়ে আসে তার। স্টিয়ারিং ঘোরানোর শক্তি আর নেই। তখনি তার অনুভূত হলো একটা শীতল স্পর্শ। একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া। কানে এলো উত্তেজনার সাথে বলা দুটো কথা,
“ওহ শিট!”

নেত্রপল্লব আপনাআপনি খুলে গেল রাগিনীর। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে স্টিয়ারিংয়ে আরো একটা হাত দেখল। তাকে আগলে রাখা অন্যহাতটাও নজরে এলো ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতেই। অন্যপাশে ফিরে তাকাতে তাকাতে ততক্ষণে গাড়ি থেমে গেছে। কোহিনূরের দৃঢ় দৃষ্টি রাগিনী উপেক্ষা করতে পারে না। লোকটির মুখে টান টান উত্তেজনা। কোহিনূর এবার রাগ দেখিয়ে গাড়ির সামনে থাবা মে’রে বলল,
“যেটা করতে পারো না করতে যাও কেন রাগিনী? জানো এখনি কী হতে পারতো?”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাগিনী। আঁখির পলক থমকেছে। এ কোন কোহিনূর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভেতরে প্রশ্বাস ও নিশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। দুটো সরু ঠোঁটের দূরত্ব বেড়ে গিয়ে হা হয়ে গিয়েছে। কোহিনূরও নিজেও স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। ঢক গিলে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“এক্ষুনি আমরা ম’রে যেতে পারতাম। ভালো করে গাড়ি চালাও।”

রাগিনীর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। অতি দ্রুত কোহিনূরের পরিবর্তন দেখে আরেক দফা অবাক হয়। তবে প্রকাশ করে না। রাগিনী মাথা নাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় আবারও।

মেন্টাল হসপিটালের সামনে পৌঁছে চুলের থেকে টাওয়াল খুলে ফেলে রাগিনী অতি দ্রুত। চুলগুলো একটু ঝেড়ে নিয়ে খেয়াল করে তার পাশে থাকা মানবটি চোখমুখ খিঁচে বসে রয়েছে। চোখেমুখে ফোঁটা ফোঁটা পানি দৃশ্যমান। তা দেখে তাড়াতাড়ি করে চুল ঝাড়া থামিয়ে বলে,
“সরি আমি খেয়াল করিনি।”

কোহিনূর চোখ খুলে ঠোঁট উল্টিয়ে চোখটা নরম করে রাগিনীর কাছে অনুনয়ের সাথে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে,
“কালকে আবার আসবে তো আমার কাছে?”

“হ্যাঁ আসব।”

কথা শেষ হতে না হতে আজিম আসে। কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলে,
“আবার পালাইছিলি? বের হ বলতেছি।”

কোহিনূর আর দেরি করে না। নেমে পড়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়ির দরজা খুলে বের হয়। রাগিনীর নজর এড়িয়ে যায় না এবার কোহিনূরের খুব অভিজ্ঞতার সাথে দরজা খোলার ব্যাপারটা। যেন সে ব্যাপারটায় অভ্যস্ত! রাগিনী এবার দৃষ্টি সরিয়ে আজিমের উদ্দেশ্যে বলে,
“দোষটা আপনাদেরই। উনার খেয়াল রাখবেন ভালো করে। এতো ইরেসপন্সিবলের মতো কাজ করলে আমি বাবাকে বলে আপনাদের কাজে রাখব না। এখানে পেশেন্টদের তো সেফটি নেই।”

“সরি ম্যাডাম। আর এমন হবে না।”
মাথা নুইয়ে বলল আজিম। আর কোহিনূরকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। কোহিনূর হেলেদুলে ভেতরে যেতে গেলে আজিম তার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে চলে গেল। রাগিনী একধ্যানে শুধু চেয়েই রইল যতক্ষণ না মানুষটা তার দৃষ্টির অগোচর হলো!

সন্ধ্যা হয়েছে। নিজের বাম হাতটা নিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেখছে নির্জন। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠছে সে। বাম হাতের তালুর রঙ লাল টকটকে হয়েছে। কেমন যেন ফুলে উঠেছে। তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে হুড়মুড়িয়ে মেহরাজ কেবিনে ঢোকায়। চোখ তুলে তাকাতেই মেহরাজ দাঁড়িয়ে যায়। দাঁত কেলিয়ে হাসে। নির্জন ঘাড় বাঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে,
“গেট আউট!”

মেহরাজ থতমত খেয়ে বলে,
“ইয়েস স্যার। কিন্তু কেন স্যার?”

“আই সেইড গেট আউট। গিয়ে বাহিরের দরজায় টোকা দিয়ে সম্মানের সহিত বলবে, মে আই কাম ইন স্যার? তারপর আমি পারমিশন দিলেই ঢুকবে।”

হতাশা ভরা মুখে চেয়ে রয় মেহরাজ। বলার চেষ্টা করে,
“কিন্তু স্যার কথাটা অনেক জরুরি তাই…”

“যাবে নাকি লাগাব দুইটা?”

মেহরাজ দমে গিয়ে বলে,
“জি স্যার যাচ্ছি।”

বাহিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টোকা দেয় মেহরাজ। গলা খাঁকারি দিয়ে নরম সুরে বলে,
“মে আই কামিং স্যার?”

“ইয়েস কাম ইন।”

মেহরাজ এবার সুরসুর করে ভেতরে আসে। টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই মনে পড়ে কীভাবে নির্জন তার পেটে গুঁতো মেরেছিল তৎক্ষনাৎ সরে গিয়ে দাঁড়ায় সে। আর বলে,
“স্যার, মিস. আহমেদের খোঁজ পাইনি এখনো।”

“পাবে কি করে? ফ্লাইট মিস করেছে। নিশ্চিত এখনো কোনো লন্ডনের হোটেলে আছে।”

“এতো কিছু আপনি কি করে জানলেন স্যার?”

এবার বাম হাতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহরাজের দিকে তাকায় নির্জন। হালকা মোটা গোলাপি এবং ধূসরের সংমিশ্রণের ঠোঁটে আসে বাঁকা হাসি। একদিকের দাড়ি সহ গাল ফুলে ওঠে। নির্জন বেশ নির্বিঘ্নে বলে,
“সী ইজ মাই সিস্টার! ওকে রগে রগে আমার চেনা। ও লন্ডনের বাড়িতে ফিরবে না। কারণ গার্ডরা ওখানে এখনো আছে। সমস্যা নেই তবে দেশে ফিরে ও আমার কাছেই আসবে। কারণ ওর সমস্ত ব্যাংকের কার্ড আমি ব্লক করে দিয়েছি।”

হা হয়ে যায় মেহরাজ। বিস্ময়ের সুরে বলে,
“ইউ আর সো স্মার্ট স্যার!”

নির্জন হাসি বজায় রেখে বলে,
“আই নো ইট। আর নতুন কিছু বলার থাকলে বলো।”

মেহরাজ জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে দ্রুত একটা মোটা ফাইল এগিয়ে বলে,
“জি স্যার। একটা ইম্পরট্যান্ট ইনফরমেশন পেয়েছি। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে জানা যায় যে রাগিনী তাজরীন নামে একটা নয় স্যার। দুটো টিকিট কাটা হয়েছিল। তাও দুটো টিকিট ভিন্ন ভিন্ন কোচের।”

নির্জন অবাক হয়। হাসি মুখটা জড়িয়ে আসে। চুল এলিয়ে থাকা ফর্সা কপালে জমে প্রগাঢ় ভাঁজ। ফাইল খুলতেই টিকিট বুক করা সব ব্যক্তিদের নাম চোখে ভাসে। এক পৃষ্ঠায় রাগিনী তাজরীনের নাম দেখলো নির্জন। তাও কোচ নম্বর ‘ছ’। আরেক পৃষ্ঠাতে গিয়ে অন্য রাগিনী তাজরীন নামটাও চোখে পড়ল। সেখানকার কোচ নম্বর ‘গ’। আসলে কি হচ্ছে? বুঝে উঠতে বেগ পেতে হলো নির্জনের।

চলবে…

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

কপালে পড়ে থাকা ঘন চুলের ফাঁকে একটা ছোট লম্বা দাগে হাত বুলিয়ে তার হাতে থাকা ফাইলের দিকে একমনে চেয়ে রয়েছে নির্জন। তার হলুদ ফর্সা চেহারায় হালকা গাঢ় দাগটা সর্বদা চুলে নিচে ঢাকা থাকে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে ফাইলটা ঠেলে দিয়ে চেয়ারে ঠেস দিয়ে নির্জন বলল,
“অনেক ভাবলাম। মাথায় তেমন কিছুই আসছে না। যা আসছে সব কনফিউশানের ভেতরে। রাগিনী কেন দুটো টিকিট কাটবে? তাও নিজের নামে? আই উইকনেসের কথা অনুযায়ী রাগিনী একা ট্রেনে আসছিল। তাও ‘ছ’ কোচের আশেপাশে। তাহলে ‘গ’ কোচে কেন আরেকটা টিকিট কাটলো? এক্ষেত্রে দেখতে গেলে রাগিনীকেই ভিক্টিম মনে হচ্ছে। কারণ কোনো চালাক ক্রি’মিনাল নিজের নামে টিকিট কেটে ফাঁসতে চাইবে না। হতে পারে রাগিনীকেই উল্টো ফাঁসানো হচ্ছে? কিন্তু রাগিনীকে কেন ফাঁসানো হবে? এটা কোনো শত্রুতার খেলা নয়। এটা আ’তঙ্ক ছড়ানোর খেলা! আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে এটাও হতে পারে যে রাগিনী আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করছে। আমাদেরকে ভুল বোঝানোর চিন্তা করছে। আই ডোন্ট নো, এর মধ্যে কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল! দুটোরই পসিবিলিটি আছে। আই রিয়েলি ডোন্ট নো। এই প্রথম কোনো কেসের ঘটনা আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।”

“স্যার, সবে আপনার মাথা কাজ করা বন্ধ করল? আমার জানামতে আপনি যেদিন রাগিনী তাজরীনকে দেখেছিলেন সেদিনই মস্তিষ্কের কাজ থেমে যাওয়ার কথা! যাক, তাও যে এতোদিন পর হলেও মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। নয়ত আপনাকে রোবটই ভেবে ফেলতাম।”

গভীর ভাবনায় মত্ত নির্জনের কানে মেহরাজের বলা কথাগুলো পৌঁছালেও বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিছু বললে?”

মেহরাজ মনে মনে খুশি হলো। সে খুব মুক ফস্কে কথা বলতে ভালোবাসে। মুখে কোনো ব্রেক ট্রেক নেই বোধহয়। এটা তার কোনো জন্মেই ছিল না। ফলে অদ্ভুত সব কথাগুলো বলার সাথেই তার উপর দিয়ে ছোটখাটো ঝড় বর্ষিত হয়। মেহরাজ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না স্যার! কিছু না। বলছিলাম যে আপনার হাতে কী হয়েছে স্যার? এমন লাল দেখাচ্ছে কেন?”

হাতের দিকে তাকায় নির্জন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আজকাল কারোর চিন্তায় পড়ে তার ভালো চাইতে নেই মেহরাজ। ফলাফল আমার মতো হতে পারে।”

মেহরাজ কিছুটা বুঝতে পারলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসিটা আঁটকে বলল,
“স্যার আপনার কি মনে হয় না? আপনি যাকে পরাজিত করতে চাইছেন সে নিজেই আপনাকে ঘায়েল করে উল্টো পরাজিত করে দিচ্ছে?”

চোখজোড়া সরু হয়ে আসে নির্জনের। ঘাড় কাঁত করে জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”

“অফিসার নির্জন আহমেদের সাথে আমি অনেকদিন কাজ করেছি। সে এমন কখনোই ছিল না স্যার। তার চোখে আমি কখনো কারোর প্রতি ব্যাকুলতা দেখতে পাইনি। সেই চোখে কখনো কোনো নারীর জন্য অস্থিরতার চিহ্ন ছিল না।”

নির্জন তখন স্তব্ধ। হয়তবা মেহরাজের বলা কথাগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। মেহরাজ আবারও বলে,
“কখনো দেখিনি, আপনি যাকে দৃঢ় সন্দেহ করছেন তাকেই রক্ষা করে নিজে আঘা’ত পেতে। সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল না স্যার?”

থম মেরে বসে রইল নির্জন। চোখ জুড়ে রয়েছে বিস্ময়। নিজের প্রতি হয়তবা নিজেই অবাক। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“অযথা কথার বলার সময় নেই মেহরাজ। লেট ইট গো! যেই টপিকটার কোনোরকম লজিক নেই সেটা নিয়ে এখানে কথা হবে না। তুমি কাজ এক করো! চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশনের সব সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করো। আই ওয়ান্ট দিস!”

মেহরাজের উত্তর শুনতে পেলো না এবার নির্জন। দৃষ্টিটা তার দিকে নিয়ে যেতেই তার হাসি হাসি মুখটা নির্জনের চোখে পড়ল। মেহরাজের চোখ নির্জনের দিকে পড়তেই নির্জন ভ্রু উঁচিয়ে তার হাসির কারণ জানতে চাইলে মেহরাজ আরেক দফা মুচকি হেঁসে বলল,
“স্যার, আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? আমার সামনে লজ্জা না পেলেও চলবে স্যার। আমি তো আপনার…”

কথাটুকু অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। নির্জন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মেহরাজের গলা শুঁকিয়ে এলো। আর অন্যকোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা দরজার দিকে ছুট লাগালো। যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় ততই ভালো। মেহরাজের কাছে নির্জন আহমেদ স্বয়ং একটা বো’ম! যেটা যেকোনো সময় ফে’টে যায়। তাই তার উপরে ফেটে যাওয়ার আগে কেটে পড়াই উত্তম।

মেহরাজ যাওয়ার পরপরই চোখ বুঁজে ধপ করে বসে পড়ল নির্জন। চোখে রাজ্যের ঘুম। সারারাত ঘুমোতে পারেনি। দুচোখের পাতা এক হয়নি। বিরবির করে বলে,
“এখন না ঘুমোতে পারলে আমি সত্যিই পাগল হয়ে যাব। আই নিড টু স্লিপ!”

চোখ মেলে তাকায় নির্জন। ইতিমধ্যে ঘুমের অভাবে লাল হয়েছে চোখ। চোখ উপর ঘষে উঠে দাঁড়ায় সে। হাতে তার লং কালো কোট নিয়ে ঘাড়ের উপর তুলতেই কোটের পকেট থেকে পড়ে যায় একটা কাগজ। একটু ঝুঁকে কাগজটা তুলে ভাবতে থাকে এটা আসলে কীসের কাগজ? স্মরণে আসে না তার। কাগজের ভাঁজ খুলতেই বেরিয়ে আসে এক মানবীর স্কেচ। তৎক্ষনাৎ নির্জনের চোখমুখের রঙটাই যেন পরিবর্তন হয়ে যায়। ঝলকে ওঠে তার নেত্র। নেত্রপল্লবে দৃশ্যমান হতে থাকে বাস্তব নারীটির মুখশ্রী। সেই দৃঢ় দৃষ্টির কথা মনে পড়লেই গলা শুঁকিয়ে আসে নির্জনের। ঢক গিলে দেয় সে। না চাইতেও বলে ফেলে,
“যুদ্ধ ময়দানে যদি অ’স্ত্রের বদলে সেই ধারালো এবং দৃঢ় দৃষ্টি থাকে তবে যে কেউ পরাজিত হতে বাধ্য। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।”

নির্জন দ্রুত গুটিয়ে নেয় সেই কাগজ। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর শক্ত কন্ঠে বলে,
“কিন্তু আমিও দেখতে চাই তুমি কতক্ষণ আমাকে পরাস্ত করতে পারো। আমি পরাস্ত হয়েই জিতে যেতে চাই এবার।”

তখন রাত ঘনিয়ে এসেছে। দিনশেষে ঘনিয়ে এসেছে কালো মেঘ এবং তার মাঝখানে একটা চিকন চাঁদ। অমাবস্যার পরের রাত আজ। চাঁদকে বেশিই চিকন দেখা যাচ্ছে। বাহিরের বাতাসে নড়ছে গাছের পাতা গুলো। শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার দৈনন্দিনের কন্ঠ। রাশেদ সাহেব বাড়ি ফিরেছেন। খাবার টেবিলে খেতে বসে রাগিনীর জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু মেয়েটা আজ এখনো নিচে নামলো না। রাগিনীর জানা রয়েছে রাশেদ সাহেব নিয়ম করে রাত নয়টার দিকেই খেতে বসেন। আর রাগিনী বাড়িতে থাকলে তাকে নিয়েই বসেন খেতে। আজ নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। তবুও রাগিনী আসছে না। সৈয়দ এবার রান্নাঘর থেকে এসে জুসের একটা জগ রেখে দিল। আর বলল,
“স্যার, রাগিনী মাকে ডেকে দিই?”

“আর পাঁচ মিনিট যাক। হয়তবা কোনো কাজে ব্যস্ত আছে। তখন না এলে ডেকে দিও।”

“ঠিক আছে।”

কথাটুকু বলেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল সৈয়দ। মুখে নেই কোনো কথা। তবে তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে রাশেদ সাহেব গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
“আরো কিছু বলতে চাও সৈয়দ? এনি প্রবলেম?”

“একটা কথা বলার ছিল স্যার।”

“হ্যাঁ বলো।”

সৈয়দ উশখুশ করতে থাকলো। যেন বলতে চেয়েও তা বলতে পারছে না। কোনো অস্বস্তি তার উপর ভর করেছে। রাশেদ সাহেব এসব খুব সহজেই ধরতে পারেন। সৈয়দকে আশ্বস্ত করে বলেন,
“কোনো সমস্যা হলে সংকোচবোধ করতে নেই সৈয়দ।”

“বিষয়টা আমার সমস্যার না স্যার। আসলে কথা হইতেছে, আজকে আবার এখানে ওই পাগলটা আসছিল।”

এবার টনক নড়ে রাশেদ সাহেবের। গাম্ভীর্যের সাথেই সৈয়দের দিকে তাকান এবং জিজ্ঞেস করেন,
“মানে? কোন পাগল?”

“ওইতো! কোহিনূর না কি যেন নাম। রাগিনীর সাথে লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিল। রাগিনী আমাদের বিষয়টা জানায় নি। কিন্তু আমি দেখে ফেলেছিলাম।”

“রাগিনী জানায় নি?”

সৈয়দ মাথায় ঝাঁকান। এবার রাশেদ সাহেবের চোখেমুখে দেখা যায় চিন্তার ছাপ। সৈয়দ একটু কেশে সংকোচবোধ করেই বলে,
“ছোটমুখে হয়ত বড় কথা হয়ে যায় স্যার। কিন্তু রাগিনীকে তো ছোট থেকে আমিও দেখে আসছি। আমার মেয়ের মতোই মনে করি। সেখান থেকেই বলতেছি রাগিনী হয়ত ওই পাগলটার উপর একটু বেশিই মনোযোগ দিয়ে ফেলতেছে। আর এই বয়সটা ভালো না। আর একটা সামান্য পাগলের জন্য এতো চিন্তাভাবনা আমার চোখে ঠিক লাগল না।”

রাশেদ সাহেব মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে বলেন,
“আমি বুঝতে পারছি। হয়ত রাগিনী তাকে অতিরিক্তই মনোযোগ দিচ্ছে এই ভেবে যে সে তার প্রথম পেশেন্ট এবং সে ভাবে কোহিনূরকে তার যেকোনোভাবেই ঠিক করে তুলতে হবে! হয়ত এজন্যই তার এতো চিন্তা। তুমি যাও জগে পানি নেই। পানি নিয়ে এসো।”

সৈয়দ মাথায় নুইয়ে চলে গেল রান্নাঘরে হাতে জগ নিয়ে। রাশেদ সাহেবের মস্তিষ্কে ঝেঁকে বসল সৈয়দের বলা কথাগুলো। নিজেকে শান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে কথাগুলো সৈয়দকে বললেন ঠিকই তবে মাথা থেকে চিন্তা গেল না। হঠাৎ করেই সিঁড়ির কাছ থেকে রাগিনীর কন্ঠস্বর পাওয়ায় চোখ তুলে তাকালেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী কোলে ছোট্ট রিওকে নিয়ে নামছে। বেশ আদুরে ভঙ্গিতে বলছে,
“তুমি তো দেখছি বেশ দুষ্টু রিও! আজ সারাদিন কিন্তু দুষ্টুমি করেছো।”

রিও যেন রাগিনীর কথা বুঝে মিউ করে ডেকে ওঠে। রাশেদ সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না আজ ছোট্ট বিড়াল ছানাকে নিয়েই রাগিনীর ব্যস্ত দিন কেটেছে। উনি মনে মনে খুশি হন। মেয়েটা সারাদিন একা বাড়িতে থাকে। বিড়াল ছানা থাকায় সময় কাটানো সুবিধা হবে। রাগিনী রিওকে সোফার উপর ছেড়ে দিয়ে খাবার টেবিলের সামনে রাশেদ সাহেবের সামনের চেয়ারে বসে নম্র সুরে বলে উঠল,
“বাবা, অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছিলে না? আসলে রিও কে খাওয়াতে গিয়ে লেট হয়ে গিয়েছে।”

“সমস্যা নেই। আমিও কেবলই এসে বসেছি।”

রাগিনী সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রাশেদ সাহেবকে আগে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে খেতে আরম্ভ করে। রাশেদ সাহেবও একবার খাবার মুখে নিয়ে বলেন,
“একটা কথা জানার ছিল তোমার থেকে। কাল তুমি অসুস্থ ছিলে তাই আর কথা বলা হয়নি। হঠাৎ করে তোমার জ্বর এলো আর কোহিনূরের আ’ঘাত লাগলো কী করে? তুমি কি কোনো বিষয়ে ভয় পেয়েছিলে?”

রাগিনীর খাওয়া বন্ধ হলো। গতকালকের ঘটনা মনে পড়তেই চোখে ভেসে উঠল গো’লাগু’লির দৃশ্য। রাশেদ সাহেব লক্ষ্য করলেন রাগিনীর হাত কাঁপছে। রাগিনী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
“গতকাল একটু গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম। ছোটখাটো এক্সিডেন্ট ছিল। তেমন কিছুই না।”

“ছোটখাটো এক্সিডেন্ট? তোমার হাত কাঁপছে! আমি তোমার বাবা হওয়ার সাথে সাথে একজন সাইকোলজিস্ট। আমি বুঝি কার মনে কী চলে। কি হয়েছিল গতকাল?”

“বাবা তেমন কিছুই না। গাছের ডাল লেগে উনার কাঁধে আ’ঘাত পায় আর তুমি তো জানো যে আমি র’ক্ত দেখতে পারি না। সেকারণেই প্যানিক এট্যা’ক করে।”

বলেই মাথা নিচু করে জোরে জোরে খাওয়া শুরু করে রাগিনী। সে কখনোই চায় না তার বাবা তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ুক। কোনোরকম হার্টে কোনো গুরুতর সমস্যা হক। তাই তো এতো মিথ্যে বলা। রাশেদ সাহেব আর কিছু বলেন না রাগিনীর অস্থির হওয়া দেখে। নিজেও খেতে শুরু করেন।

খাওয়া তখন শেষদিকে। রাগিনী উঠে যেতে লাগে। রাশেদ সাহেব ডেকে শান্ত গলায় বলেন,
“আরো একটা কথা ছিল রাগিনী! তুমি যেহেতু আমার মেয়ে তাই এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিত। তাই সোজাসুজি বলছি কোহিনূর বা ওর সম্পর্কে এতো স্ট্রেস বা চিন্তা নেওয়ার দরকার নেই। তোমার হাতে আর দেড় মাসের মতো সময় আছে। তারপর আবার চট্টগ্রাম যেতে হবে। আশা করছি তোমাকে আমি কোহিনূরের সুস্থতার দায়িত্ব দিয়ে কোনো ভুল করিনি।”

রাগিনী বুঝে উঠতে পারল না তার বাবা হঠাৎ করে এমন কথা কেন বলল। শুধু বুঝল তার বাবা অনেক কিছুই ভেবে নিয়েছে। তবে তা জানতে চেয়ে আর কথা বাড়াল না সে। মাথা দুলিয়ে বলল,
“জি বাবা।”

ঘরে এসে দরজা লাগালো রাগিনী। মাথায় একদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে বাবার বলা কথাগুলো। অন্যদিকে কোহিনূরের কিছু অদ্ভুত ব্যবহার যা রাগিনীর চোখে লেগেছে। রাশেদ সাহেবের মুখে এমন ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত নয় রাগিনী। তাই তার অস্বস্তি লাগছে। আর কোহিনূর আজ যেভাবে গাড়ির দিকটা সামলে নিল তাতে রাগিনী সবথেকে বেশি অবাক হয়েছে। আর তার রাগটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। যেন সেই মানুষকে চিনতোই না রাগিনী। আর কোহিনূরের গাড়ির দরজা খোলার ব্যাপারটাও রাগিনীর চোখে পড়েছে। যেন সে গাড়ির দরজা খুলতে মেলতে বেশ অভ্যস্ত। খুব সহজেই এক টানে গাড়ির দরজা খোলার দৃশ্য রাগিনীর মস্তিষ্ক থেকে বের হচ্ছে না। মাথায় আসছে আজেবাজে চিন্তা। মাথায় হাত রেখে চুপ থাকে কিছুক্ষণ রাগিনী। সে কি বিশ্বাস হারাচ্ছে তবে? মানুষটার প্রতি থেকে বিশ্বাস উঠিয়ে নিতে মন চায় না একদম। কেন মানুষটা তার বিশ্বাস ভাঙবে? একদমই ভাঙতে পারে না।

তবুও অনেক ভেবে বালিশের নিচ থেকে নিজের ফোনটা বের করে রাগিনী। ফোন অন করে তার কললিস্টে গিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করে কল করে ফোনটা কানে ধরে সে। ঘড়ির দিকে তাকায় অতঃপর। ঘড়িতে দশটা বাজতে চলেছে। ফোনটা ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই রাগিনী তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“হ্যালো! আমি রাগিনী তাজরীন বলছি।”

ওপর পাশ থেকে বিনয়ের সাথে একটা মেয়েলি সুর ভেসে আসে,
“ইয়েস ম্যাম, আমরা কীভাবে আপনাকে হেল্প করতে পারি?”

“হসপিটালের এক পেশেন্ট। যার দায়িত্বে আমি নিজে রয়েছি। কোহিনূর! টাইটেল আমি জানি না। উনার সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই। উনাকে কে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তার ফোন নম্বর বা তারও কোনো ডিটেইলস হলে ভালো হয়। এক কথায় যত ইনফরমেশন আছে কোহিনূরের ব্যাপারে সব আমার লাগবে।”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]