পদ্ম ফুলের অভিমান পর্ব-০১

0
476

#সূচনা পর্ব
#পদ্ম_ফুলের_অভিমান
#লেখনীতে_নাফিসা_আনজুম

ভাবতেই খুব অবাক লাগছে,যাকে নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলাম,আজ তার মেয়ে আমার কোলে। তার বউকে ওয়াশরুমে নিয়ে গেছে জন্য আমি তার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আছি।
আমি পদ্ম। বাবা মায়ের আদরের একমাত্র কন্যা পদ্ম। আমার একটা ছোট ভাই আছে সবে মাত্র ক্লাস ফাইবে। আর যার কথা এতোক্ষন বলছিলাম সে আমার মামাতো ভাই অভ্র। নিজের মামাতো ভাই না। আম্মুর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে অভ্র।আমি যখন ক্লাস নাইন এ পরি তখন স্কুলের পথ আটকিয়ে অভ্র ভাইয়া আমাকে প্রপজ করে,তখন অভ্র ভাইয়া অনার্স ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র , দেখতে মাশাআল্লাহ হিরো,ফর্সা গালে টোল পরতো,গোলাপি ঠোঁটে ছিলো বাঁকা হাসিঁ, রাগলে নাক,চোখঁ যেনো লাল হয়ে যেতো, মামাতো বোনদের মূখে সবসময় অভ্র ভাইয়ার নাম থাকতো,আমিও যখন থেকে বুঝতাম তখন থেকে অভ্র ভাইয়াকে আমারো ভালো লাগতো,হয়তো ভালোবাসা কি সেটা বুঝতাম না কিন্তু অভ্র ভাইয়াকে দেখতে পেলেই যেনো মনের মধ্যে একটা শান্তি অনুভব হতো যা অন্য কোনো ছেলেকে দেখে হতো না,অভ্র ভাইয়ার সাথে কথা বললে যেনো মনটা ফুরফুরে হতো,একবার কথা হলে সারাদিন সেই মূহূর্তটাই মনে পরতো,,ক্লাস নাইনের শেষের দিকে পথ আটকিয়ে লাল গোলাপ আর এক বক্স চকলেট দিয়ে অভ্র ভাইয়া আমাকে প্রপজ করেছে, বান্ধবীদের সাথে সাথে আমিও অবাক হয়ে গেছিলাম অভ্র ভাইয়ার এই কান্ডে,কিন্তু সেদিন যে কি খুশি লাগছিলো সেটা বলে প্রকাশ করার মতো না। ভালোলাগার মানুষ যখন নিজে থেকে আপন হতে চায় তার থেকে খুশি বা আর কি হতে পারে,তারপর থেকে শুরু হলো অভ্র ভাইয়ার পাগলামি,কখনো ছিনেমা দেখতে যাওয়া,কখনো ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে অভ্র ভাইয়ার সাথে কত ঘুরতে গেছি। চুরি করে ফোন চালিয়ে প্রেম করেছি,একবছর বেশ ভালোভাবেই কেটে গেলো, সব থেকে ভালো লাগতো অভ্র ভাইয়ার কোনো বাজে রিপোর্ট আমি কখনই শুনি নি,এমনকি আমার সাথে কথা বলার সময় বা দেখা করে এমন কিছু বলে নি বা করে নি যে ওনার ওপর আমার রাগ হবে,একবছর পর হটাৎ একদিন ,,

অভ্র :পদ্ম ফুল

পদ্ম: হুমম অভ্র ভাইয়া বলো

অভ্র:শোন না পদ্ম ফুল,তোকে বলেছিলাম না আমি একটা জবের জন্য আবেদন করেছি,সেইখানে আমাকে ডেকেছে তিনমাসের জন্য, আমি খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোনে কথা বলতে পারবো না,আর তুই তো জানিস মা কেমন,দূরে গেলে একদিন কথা না বলে থাকতে পারে না,তাই বলছি কি,,

পদ্ম: কিন্তু অভ্র ভাইয়া আমি তো তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবো না

অভ্র: তিনমাস পর আমি আবার ফোন হাতে পাবো তখন আমি সবসময় কথা বলবো তোর সাথে,,

পদ্ম:তুমি একদিন আমার সাথে কথা বলবা আর একদিন মামির সাথে বলবা।

অভ্র: পদ্ম পাগলামি করিস না,আমি যা বলছি তাই শোন,এই তিন মাস যোগাযোগ না হলে আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে হবে না, আমি তোর আছি তোর থাকবো, তিনমাস পর এসে ধুমধাম করে তোকে আমাদের বাড়িতে বউ করে নিয়ে আসবো বুঝেছিস।

পদ্ম:কিন্তু অভ্র ভাইয়া আমি একদিন কথা না বলে থাকতে পারি না সেখানে তিনমাস কিভাবে থাকবো

অভ্র: আমি যদি এখনি ম*রে যাই তাহলে কি করবি পদ্ম

পদ্ম: ছি ছি এসব কি বলছো অভ্র ভাইয়া

অভ্র: যা বলছি একদম ঠিক,আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তিনমাস কথা না বললে কিছুই হবে না।সেটা তোকে বুঝতে হবে,নাকি তুই চাস না আমি প্রতিষ্ঠিত হই,,

সেদিন অভ্র ভাইয়ার কথার জবাব আমি দিতে পারি নি কারন সেদিন তার ব্যবহার আর কথাবার্তা একদম অন্যরকম ছিলো।কিন্তু সেদিনের পর থেকে আজ অবদি আর কথা হয় নি অভ্র ভাইয়ার সাথে।কোনো কারন ছিলো না কথা না বলার,তবুও অভ্র ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে নি,আমি তো চেষ্টা করেছিলাম কথা বলার,কিন্তু সে চায় নি হয়তো । আমি এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে চলে গেছি ঢাকায়,সেখান থেকে এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছি, আর এবার মেডিকেল এ চান্জ পেয়েছি, এর মধ্যে অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম অভ্র ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু আমার বাড়িতে তো এসব কথা কেউ জানতো না, আম্মুর সাথে কথা বলার সময় নানু বাড়ির কথা উঠলে ইনিয়ে বিনিয়ে অভ্র ভাইয়ার কথা তুলেছি,কিন্তু কোনোরকম খবর পাই নি,স্যাররা বলতো আমি নাকি এস এস সি তে গোল্ডেন পাবো সেই আমি এস এস সি তে 4.92 পেলাম,বাড়িতে সবাই রাগারাগি করলো রাগে দুঃ*খে চলে গেলাম ঢাকাতে।

আমি বাবা মায়ের আদরের হলেও আমার মনের অবস্থা কেউ বুজতে চায় নি, আমি যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি,জামাকাপড়,খাওয়াদাওয়ার কোনো অভাব আমি পাই নি, আমি পেয়েছি নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বতা,আমি আমার মনের কথা কাউকে বলতে পারি নি,আমার বাবা মা আমাকে সবটা দিলেও দেয় নি সময়, কখনো পাশে বসে বুঝতে চায় নি আমার রেজাল্ট খারাপের কারন, তাদের কথা ছিলো আমরা টাকা দিচ্ছি,টিউটর দিচ্ছি তবুও রেজাল্ট কেনো খারাপ হচ্ছে, তাদের চাপ ছিলো এটাই যে রেজাল্ট ভালো হতেই হবে।
বয়সটা যে চোখেঁ শরষেফুল দেখার সেটা বুঝতে চায় নি তারা,তাই এস এস সির পর আর বাড়িতে মন টেকে নি।ফুপির সাথে এসেছি ঢাকায় ফুপির বাড়িতে। আম্মু ফোন দিয়ে কান্নাকরে বলতো, আমাদের এতোকিছু থাকতে তুই কেনো দূরে থাকবি, আমাদের একমাত্র মেয়ে দূরে থাকে আমাদের কি খারা*প লাগে না। আম্মুর কথায় আমারো খারাপ লাগতো কিন্তু আমি আর ফিরতে চাই নি, কাছে থাকতে যে মানুষগুলো মূল্য দেয় না তাদের বুঝতে হবে আপন মানুষ দূরে গেলে কতো কষ্ট হয়।

তিনবছর পর আজ মামার বাড়িতে এসেছিলাম, এসে শুনি অভ্র নাকি কয়েকদিন আগে বউ রেখে গেছে, কাল সেই বউয়ের মেয়ে বাচ্চা হয়েছে,আমি ঘরে আসতেই মামি বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিয়ে বললো কোলে নে তোর মামাতো বোন, এখনো নাম রাখা হয় নি অভ্রের নামের অক্ষর দিয়ে একটা নাম ঠিক কর আমি ততক্ষণে তোর ভাবিকে ওয়াশরুম থেকে নিয়ে আসি, অভ্র রাতে আসবে বাড়িতে।

অভ্র ভাইয়া রাতে আসবে শুনে বুকটা কেমন ধুক করে উঠলো,এই মানুষটা এমনভাবে ঠকাতে পারলো আমাকে,মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে আমার কিশোরী মনকে ভেঙে চুরে শেষ করে দিলো,তবুও আজ এতোদিন পর তাকে দেখার স্বাদ আমাকে খুব করে আকৃষ্ট করছে, বার বার মন বলছে একটিবার ঐ মুখখানা যদি চোখেঁ পরতো,মন ভরে দেখতাম ঐ মায়াভরা মুখটা। চোখেঁ চোখঁ রেখে জিজ্ঞেস করতাম কি দোষ ছিলো আমার।কেনো এতো বড় শা*স্তি দিলে আমাকে,ভূল যদি করতাম ধরিয়ে দিতে,প্রয়োজনে আমাকে মারতে কিন্তু এভাবে সম্পর্কটা কেনো ভেঙে দিলে।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন রে অভ্রের বউ আর মামি এসেছে খেয়ালি করি নি,,মেয়ে বাঁচ্চা,দেখতে পুরাই বাবার মতো হয়েছে,, বাবা মা দুইজনেই সুন্দর বাচ্চাও তো সুন্দর হবে।

মামি: কি রে পদ্ম এতোদিন পর মামা,মামির কথা মনে পরলো

পদ্ম: না মামি মনে তো সবসময় পরেছে, পড়াশুনার চাপে আসা হয় নি।

মামি:এইচ এস সি দিয়ে অনেকদিন বন্ধ ছিলো না,তোর নানি সবসময় তোর মাকে বলতো পদ্মকে যেনো আসতে বলে,খুব দেখতে ইচ্ছে করে,তখনো আসিস নি। আমিও কতো বলতাম পদ্মটা এইভাবে চলে গেলো একটু ঘুরতেও আসে না।

পদ্ম: তখন ভার্সিটির জন্য কোচিং করছিলাম মামি তাই আসা হয় নি।

মামি:অভ্রটা নাকি বাড়ি থেকে গিয়ে কয়েকদিন পরেই বিয়ে করেছে, আমি রাগ করবো, মেনে নেবো না এজন্য কাউকে বলে নি, এখন বউয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় হয়েছে বউয়ের বাড়ি থেকে চাপ দিয়েছে বাড়িতে বলার জন্য তাই বলেছে। প্রথম অনেক কষ্ট পেয়েছি জানিস মা,কতো আদরের সন্তান আমার অভ্র, এইভাবে না জানিয়ে বিয়ে করলে কষ্ট তো লাগবেই, বউমা এসে একদম মন ভালো করে দিয়েছে,খুব ভালো মেয়েটা সারাক্ষণ মূখের ওপর পরে পরে ডাকতেই থাকে,তোর মামার কখন কি লাগবে সবসময় রেডি করে রাখে এই অবস্থায়।

এইভাবে ভালোবাসার মানুষটার বউয়ের গুনগান কতজন এমন মন দিয়ে শুনবে। আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছে,অভ্র ভাইয়া বাড়ি থেকে যাওয়ার কিছুদিন পরেই বিয়ে করেছে তবুও রিলেশন করে, আর সেই বউয়ের গুনগান চুপচাপ শুনে যাচ্ছি আমি। যেখানে অভ্র ভাইয়ার পাশে অন্য কারো নাম ও লিখতে দেই নি সেই মানুষটাই আজ অন্য একজনের স্বামী, তার সন্তানের বাবা। আমি কোন দিক দিয়ে কম ছিলাম। যে আমার জায়গায় আজ এই মেয়েটা আছে। এই ঘরটা তো আমার হওয়ার কথা ছিলো তাহলে ঐ মেয়েটা কেনো হলো।

চলবে,,