গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০২

0
380

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_২

আতিয়া হাঁটতে শুরু করেছে। কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এই চিকন গলি থেকে সেগুনবাগিচা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া সহজ নয়। কম করে হলেও চল্লিশ মিনিট হাঁটতে হবে। আতিয়া গলি থেকে কাঁটাবনের অপজিট পর্যন্ত হেঁটে আসে। তারপর বাসে করে মৎস ভবনের সামনে এসে নামে। দশ টাকা দশ টাকা বিশ টাকায় যাতায়াত। সকাল আটটায় ডিউটি শুরু। সাড়ে সাতটার ভেতর না বের হলে দেরি হয়ে যায়। সকালের খাবারটা তাই টিফিন বক্সে নিয়ে নেয়।

নাস্তা বলতে ঠান্ডা ভাত, আর আগের দিনের তরকারি। হসপিটালের ওভেনে বক্সটা গরম করে ডিউটির এক ফাঁকে খেয়ে নেয়। মিলিনিয়াম জেনারেল হাসপাতালে নার্স হিসেবে আতিয়ার চাকরির বয়স সাত বছর হতে চললো। আতিয়ার বাবা হামিদ আলী এই হাসপাতালেরই এমএলএস পদে কর্মরত ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হওয়ায় হাসপাতালের ইউনিয়ন লিডারদের সাথে ওনার ভালো পরিচয় ছিল। শুনতে হাস্যকর শোনালেও সক্রিয় ইউনিয়ন করা কর্মকর্তা কর্মচারীরা এসব হাসপাতালে সবচেয়ে প্রভাবশালী। তাদের কাছে ডাক্তাররাও নস্যি। কোন রোগীর সিট প্রয়োজন! কেবিন লাগবে! ভর্তি হতে হবে! এই সবকিছুই একসময় তারা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এই চাকরিটা আতিয়া বাবার চেষ্টাতেই পেয়েছে।

আতিয়া বিয়ের আগে ডিগ্রি পাস করেছিল। বিয়ে হয়েছিল খুচরা ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসায়ী শফিকের সাথে। পুরান ঢাকার নববাপুরে দোকান ছিল শফিকের। আয় রোজগার ভালোই ছিল। আতিয়াকে তখন বাইরে কোন কাজ করতে হয়নি। জীবন তখন অনেক বেশি সুন্দর ছিল। নবাবপুরের গলির ভেতর দুই কামরার সেই সংসারে আতিয়ার স্বর্গ ছিল। শফিক ভালো স্বামী ছিল। আতিয়ার যত্ন করতো। যদিও শফিকের বাবা মা আর ছোটো ভাই আতিয়াদের সাথেই থাকতো। তবু তা আতিয়ার নিজের সংসার মনে হতো। সেই সংসারের কর্ত্রী যে ছিল আতিয়া। আজ যখন মায়ের বাড়ির সিংহভাগ খরচ সেই বহন করে। তবু যেন এই সংসার তার নয়! পরিবারের ভালোমন্দ কোন বিষয়ে মতামত দিতে গেলে মা বিরক্ত হয়। বোন ঝগড়া করে। ভাইতো থেকেও নেই। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। সময়ে সময়ে ঘরে ফিরে দুটো খেয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে কাজ খুঁজে। যদিও অনার্স শেষ করেছে দুইবছর হতে চললো। এখনো কোন কাজকর্ম করে না। কী কাজ খোঁজে আতিয়া বোঝে না। আতিয়া চেষ্টা করেছিল হাসপাতালে ঢুকিয়ে দিতে। কিন্তু অনার্স শেষ করা ভাই পিয়নের পদে কাজ করবে না। ইদানীং আতিয়ার বড্ড ক্লান্ত লাগে। নিজেকে একটা মেশিন মনে হয়। তাদের হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এটিএম মেশিন যেন। মাস শেষে যে যার প্রয়োজন মতো টাকা বের করে নিয়ে চলে যায়। মেশিন দাঁড়িয়ে থাকে একাকী!

বিয়ের সময় আতিয়ার বয়স ছিল বিশ বছর। বিয়ের দুই বছরের মাথায় গর্ভবতী হয়েছিল আতিয়া। গর্ভের সন্তানের যখন সাত মাস বয়স, তখন স্বামী শফিক নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এই হাসপাতালেই এসেছিল আতিয়া। সে সময় আতিয়া বাসে উঠতে পারতো না। বাসে উঠলেই বমি আসতো। যাওয়ার সময় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সিএনজি পায় না শফিক। বাধ্য হয়ে আতিয়াকে নিয়ে রিকশায় ওঠে। অর্ধেক পথ ভালোভাবেই এসেছিল। রাস্তায় জ্যাম থাকায় রিকশাওয়ালা উল্টো পথে রিকশা ঘুরিয়ে দেয়। আতিয়া বারবার মানা করছিল। কিন্তু রিকশাওয়ালা বলছিল, কিছু হবে না। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে একটা বাস এসে রিকশায় ধাক্কা মারে! শফিক বাসের দিকেই বসা ছিল। শেষ মুহূর্তে আতিয়াকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেয় শফিক। আতিয়া প্রাণে তো বেঁচে যায়। কিন্তু সেই এক দুর্ঘটনায় ওর সাজানো জীবন একমুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়।

শফিক আর রিকশাওয়ালা স্পট ডেড। বিস্ময়কর ভাবে আতিয়া অন্য কোথাও আঘাত পায়নি। শুধু পেটে প্রচন্ড আঘাত লাগায় অনাগত সন্তান পেটেই মারা যায়। সাতটা মাস যাকে একটু একটু করে নিজের ভেতর বড়ো করছিল, তাকে একটু ছুঁয়ে দেখার ভাগ্যও হয় না আতিয়ার। দুর্ভাগ্য যেন সেদিন থেকেই আতিয়াকে একটু একটু করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এখন শফিকের সেই দোকান আতিয়ার শ্বশুর আর দেবর চালায়। শফিকের মৃত্যুর পর ওনারা আতিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন আগ্রহ আর দেখাননি। আতিয়ার বাবা চেষ্টা করেছিল দেবরের সাথে আতিয়ার বিয়ে দিয়ে ও বাড়িতে পাঠানোর। কিন্তু আতিয়া রাজি ছিল না। তারপরও হামিদ আলী আতিয়ার শ্বশুরের কাছে এই প্রস্তাব রাখেন। বিনিময়ে শাশুড়ি আতিয়াকে ফোন দিয়ে শাপশাপান্ত আর গালিগালাজ করেন। এক ছেলেকে খেয়ে আরেক ছেলের দিকে হাত বাড়ানোর জন্য ডাইনি অপবাদও জুটে যায়। শ্বশুর বাড়ি ফেরার পথ চিরতরেই বন্ধ হয়ে যায় আতিয়ার। এরপর কিছুদিন দুই পরিবারের বেশ ঝগড়াঝাটি চলে। আতিয়ার মা দেলোয়ারা বেগম আর বাবা হামিদ আলী শফিকের দোকানের কিছু অংশ, আতিয়ার বিয়েতে দেওয়া তিন ভরি গয়না, ব্যবহারের ফার্নিচার, কাপড়চোপড় আর নগদ এক লাখ টাকা ফেরত আনার চেষ্টা দফায় দফায় করেন। অবশেষে অবস্থা হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেলে দুই পরিবারকে নিয়ে গণ্য মান্য ব্যক্তিরা বসেন। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হয়, দুই বছর আতিয়াকে খাইয়েছে, পড়িয়েছে শফিকের পরিবার। তার খাওয়া খরচ বাবদ ঐ এক লাখ খরচ হয়ে গিয়েছে! আতিয়ার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে। আর সেই যে দুই বছর আতিয়া সংসারের সমস্ত কাজ করলো, রেঁধে বেড়ে খাওয়ালো। সেই বাবদ কতটা টাকা জমেছে। একটা কাজের লোক রাখলেও মাসে পাঁচ হাজার করে লেগে যায়। দুই বছরেও কী লাখ টাকার কাজ আতিয়া করেনি!

অবশেষে বাবার বাড়ির তিন ভরি গয়না, ব্যবহারের কিছু কাপড়, একটা মেলামাইন বোর্ডের ওয়ারড্রব ও আয়না ফেরত আসে আতিয়াদের বাড়ি। বিয়ের শাড়ি যেহেতু শফিকের পরিবার দিয়েছে, তাই সেগুলো আর ফেরত আসে না। গয়নাগুলো দেলোয়ারা বেগমের কাছেই ছিল। এবার আয়েশার বিয়েতে সেই গয়না থেকে দেড়ভরির গলার চেইন আর কানের দুল জোড়া দেলোয়ারা বেগম বের করে দিয়েছিলেন। আতিয়া তখন কিছু বলে পরিস্থিতি খারাপ করেনি ঠিকই, কিন্তু বিয়ের আয়োজন শেষে ওর হাতের দেড় ভরির চুড়ি জোড়া কই তা দেলোয়ারা বেগমকে জিজ্ঞেস করেছিল। সেই একই রকম বিলাপ, আর এলোমেলো কথায় সেই চুড়ি জোড়ারও আর কোন হদিস পায়নি আতিয়া। তবে আয়েশার বিয়েতে মায়ের গলার মোটা চেইন দেখে চুড়িগুলো কই গিয়েছে তা অবশ্য আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি।

আজ যেন আতিয়াকে অতীত পেয়ে বসেছে। বাবা হামিদ আলী একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন আতিয়াকে নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিয়ে। হামিদ আলীর ইউনিয়ন লিডার পরামর্শ দেয় ডিগ্রি পাস দিয়ে মেয়ে কোন ভালো কাজ পাবে না। হাসপাতালে চাকরি পেতে হলে তিনবছরের ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্স থাকতেই হবে। পরে বিএসসি করে নিবে। আতিয়ার বয়স বাইশ না হওয়ায় আতিয়া তখন প্রাইভেটে ডিপ্লোমা কোর্সো ভর্তি হতে পারে। তিনবছর পর বাবা ইউনিয়ন লিডারদের ধরে বেঁধে, অনুরোধ করল আতিয়ার চাকরির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই তিন বছরে আতিয়া বুঝেছে জীবন কত কঠিন। মানুষ অবিবাহিত মেয়েকে মাথায় করে রাখে। কিন্তু বিধবা, ডিভোর্সি মেয়ের উপর যেন চরম বিরক্তি ভর করে। চাকরিতে না ঢুকে আতিয়ার উপায় ছিল না। আতিয়ার বিয়ের চেষ্টা যে হামিদ আলী আর দেলোয়ারা বেগম করেননি তা নয়। কোথাও যৌতুকে হতো না। কোথাও বরের আগের ঘরের স্ত্রী সন্তান সব বর্তমান আছে। কোন কোন পাত্রের বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তারপরও একসময় একজন পাত্র মোটামুটি সবমিলিয়ে ভালো মিলে যায়। হাসপাতালেরই অন্য এক এমএলএসের ছেলে। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় তালাক হয়েছে। বয়সও বেশি ছিল না। আতিয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার একসপ্তাহের মাঝে এই সুস্থ পাত্র মারা যায় একদম হঠাৎ করেই। কাজ থেকে ফিরে শরীর খারাপ লাগছিল বললো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে সব শেষ। আতিয়ার নাম বদনাম হয়ে যায়। এরপর হামিদ আলী বিয়ের চেষ্টা বাদ দিয়ে মেয়ের চাকরির চেষ্টায় মন দেন। আতিয়া চাকরিতে ঢোকার আগেই মৃত্যু বরণ করেন হামিদ আলী। অবধারিতভাবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আতিয়ার উপর। হামিদ আলীর মৃত্যুর কারণে তার পরিবারের প্রতি কর্তৃপক্ষের মায়া হয়। তাই আতিয়ার চাকরিটা সহজেই হয়।

বাবা মারা যাওয়ার পর আতিয়া সত্যিই তার মাথার উপরের ছাদখানা হারিয়ে ফেললো। আতিয়া বুঝতে পারে পরিবারের কেউই তাকে খুব একটা পছন্দ আর করে না। একমাত্র ছোটো বোনটা একটু আধটু মায়া করে। আর সবাই কেমন দূরত্ব বজায় রাখে। এমনকি মা দেলোয়ারা বেগম পর্যন্ত! ভীত, নরম সরম ধরনের মেয়ে আতিয়া কখনোই ছিল না। পরিবারের বড়ো মেয়ে বলে মায়ের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সংসারের কাজকর্ম ধরেছে সেই বারো তেরো বছর বয়সে। তেল, লবনের হিসেবে সে মায়ের চেয়েও পাকা ছিল। গুছিয়ে ঘর করার মতো ঘরণী মেয়েই আতিয়া। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় তো সন্তানদের নিয়ে অতি আহ্লাদ নেই। আতিয়া কলেজের পড়ালেখার পাশাপাশি তাই বাজার করা শিখেছে। দৌড়ে লোকাল বাসে উঠতে তার কখনোই কারও হাত প্রয়োজন হয়নি। রাস্তা পার হওয়ার সময় ভীত হরিণীর মতো কারও বাহু জড়িয়ে ধরার আকাঙ্খা হয়নি। তবু একজন সঙ্গী তো বীরপুরুষেরও লাগে। হাত ধরে রাস্তা পার হতে নয়। জীবন পাড়ি দিতে গিয়ে একা একা মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। এই যেমন এই রাস্তাটুকু। একা হাঁটতে গেলে যেন শেষ হয় না। মনে হয় সঙ্গে যদি কেউ থাকতো। কথা বলতে বলতে বহুদূর চলে যেতে আতিয়ার ক্লান্ত লাগতো না।

হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে চলে আসে। এই সময় বাসে ফাঁকা সিট পাওয়া মুশকিল। দাঁড়িয়ে যেতে হবে। অফিসগামী মানুষদের ভীড়ে বাসে তিল ঠাঁই নাই অবস্থা। আতিয়া হিজাব পরে থাকতে পারে না। মাথা ব্যথা করে। বোরখার সাথে তাই লম্বা ওড়ানা গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে নেয়। এরপরও বাসের ধাক্কাধাক্কির এই সময়টুকু নিজেকে পুরোপুরি বাঁচিয়ে চলতে পারে না। ভীড়ের ভেতর সুযোগ পেলেই কেউ না কেউ ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আগে প্রতিবাদ করতো। কিন্তু দেখে কেউ এগিয়ে আসে না। এমনকি বাসের মহিলারও না। একদিন তো এক বয়স্ক মহিলা নিজের ছেলের পক্ষ নিয়ে ঝগড়াই লাগিয়ে দিলেন। ওনার কথার সারমর্ম ছিল, ভালো মহিলা হলে মুখ ফুটে গায়ে হাত দেওয়ার কথা বলতে পারতো না। ভালো মহিলারা এসব বলে না, বরং নিজেকে সামলে রাখে। আতিয়া ভালো মহিলা হতে পেরেছে কিনা জানে না। তবে এখন নিজেকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে চলে। রাস্তাঘাটের এসব ছোঁয়াছুঁয়ি তো কিছু না। আসল লড়াই তো চলে পরিচিত মন্ডলে।

হাসপাতালে ঢোকার মুখে জমিলা সিস্টারের সাথে দেখা আতিয়ার। আয়েশার বিয়ের সময় এই সিস্টারের কাছ থেকেই বিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা আসল আর একশো করে সুদ টানতে হয়। জমিলাকে দেখেই আতিয়া বুঝে যায় কী চায় জমিলা।

(চলবে)