গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৩

0
327

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৩

জমিলা আপাকে এগিয়ে আসতে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করে আতিয়া। জমিলা দাঁড়িয়ে যায়। খাতায় নাম সাইন করে ঘড়ি দেখে আতিয়া। সাতটা পঞ্চাশ বাজে। ডিউটি শুরু হতে এখনো দশ মিনিট বাকি।

“আপা, চলেন ছাদে যাই। এখানে কথা বলতে পারবো না।”

“চল।”

ছাদের সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ব্যাগে হাত দেয় আতিয়া। ব্যাগে তিন হাজার আছে। গতকাল ডিউটি থেকে যাওয়ার সময় টাকাগুলো তুলে একটা টিস্যুতে পেঁচিয়ে নিয়েছিল। আজ এত সকালে টাকা তোলার সময় পাবে না বলে টাকা গতকাল তুলেছে। গত ছয় মাস ধরে একটু একটু করে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাচ্ছে। এই টাকা জমিলা আপার ধারের টাকা না। এই টাকা অন্য কাজের। ধারের বিশ হাজারের বারো হাজার আর সুদের বারোশত টাকা এই ছয়মাসে শোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা আগামী চার মাসে নিয়ম করে দিয়ে দিবে।

জমিলা আপার আরেক পরিচয় তিনি সাংগঠনিক লোক। মানে বারো রকম কাজে আপা আছেন। ইউনিয়ন করেন, ইনচার্জ, আবার বিয়ে-শাদির ঘটকালিতেও আছেন। এই হাসপাতালের অনেকেরে বিয়ের পাকা কথাতে আপার হাত আছে। আতিয়ার জন্য এর আগের বারও পাত্র আপা ঠিক করেছিলেন। দুর্ভাগ্য বিয়ের আগেই ছেলে মারা যায়। লজ্জা, সংকোচ ভেঙে আবার আপার কাছেই বিয়ের জন্য পাত্র দেখে দিতে বলে আতিয়া। নিজের মাকে বলতে কেমন জানি লাগে। যে মা নিজেই বোঝে না যে মেয়ের একজন সঙ্গী দরকার, তাকে নিজ থেকে কী বলবে!

হাসপাতালে আতিয়ার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। কোন এক আজব কারণে সবাই আতিয়াকে এড়িয়ে চলে। যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো, তারাও কেউ বন্ধু শ্রেণির নয়। তাদের সাথে দৈনন্দিন কথা শেয়ার করা যায়, কিন্তু মনের কথা নয়। এই যে আতিয়া বিয়ে করতে চায়, এই কথা শুনলে কিছু সহকর্মী মহিলা আর পুরুষ যে তামাশা করবে! আতিয়া তাই আপাকে অনুরোধ করেছে কাউকে কিছু না বলতে। রোজকার ঘন্টা আটেকের ডিউটিতে নানা রকম রোগীর ঝামেলা, রোগীর আত্মীয় স্বজন সামলানো, কর্মক্ষেত্রের পলিটিক্স, রোস্টার নিয়ে সমকর্মীর সাথে মান অভিমান কথা কাটাকাটি আর বাড়িতে গিয়ে মা, ভাই বোনের ঠান্ডা শীতল আচরণে আতিয়া অস্থির। মানুষ কত কথা বলে যে, নারী কামাই করলে তার আর সঙ্গী লাগে না। যে নারী মানসিক ভাবে শক্ত হয় তাদের জন্য একা একা জীবন পাড়ি দেওয়া কঠিন কিছু না। কিন্তু সব নারীর কঠিন মন কি পাথর হয়! কিছু কঠিন মন তো শুধু সময়ের আঘাতে আর পৃথিবীর শীতলতায় জমে যাওয়া মোম মাত্র। যে মোম কারও ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে আবারও গলে যেতে অস্থির থাকে। কামাই করার জন্য বাড়তি একটা হাত পেতে নয়, একটু ভালোবাসার স্পর্শ পেতেই মরিয়া আতিয়া। ইদানীং শফিকের সাথে কাটানো সেই দুই বছর বড়ো পীড়া দেয়। বালিশে এপাশ ওপাশ করতে করতে শফিকের চওড়া বুকের ওমে কাটানো সেই রাতগুলো ভীষণ রকম মনে পড়ে। কী হতো যদি শফিক সেদিন মারা না যেত। কত সুন্দর একটা জীবন ছিল আতিয়ার। কোল জুড়ে হয়তো এতদিনে দুটো সন্তান থাকতো। চাল, ডাল তেল, নুনের হিসেবের বাইরে আর কোন চিন্তা থাকতো না। রাতে শফিক যখন দোকান থেকে ঘরে ফিরতো, ভাত বেড়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসতো। রাতে দু খিলি পান মুখে নিয়ে দু’জন বাচ্চাদের ভবিষ্যতের আলাপ করতো। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় চিন্তা করতো। কখনো একটু খুনসুটি হতো, কখনো আদর সোহাগ। এসব ভাবলে রাতগুলো বড়ো দীর্ঘ আর নিঃসঙ্গ মনে হয় আতিয়ার। যে শরীর একবার পুরুষের ছোঁয়া আর ভালোবাসা পেয়েছে, তার জন্য এসব ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়।

সময় ঘড়ি টিকটিক করে জানাচ্ছে আতিয়ার বয়স হয়ে যাচ্ছে। নিজের একটা সংসার, একটা মায়াবী পুতুল কোলে পেতে হলে এখন নিজেকেই সঙ্গীর খুঁজে নিতে হবে। আতিয়া তাই লজ্জা ভেঙে জমিলা আপার দারস্থ হয়। এই তিন হাজার টাকা আপার ফিস। পুরোটা না অবশ্য। দুই হাজার ফিস, আর এক হাজার টাকা খোনারের তাবিজের জন্য। জমিলা আপার বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলে। সেই অঞ্চলে যারা তাবিজ, পানি পড়া, জাদু টোনা কাটানোর জন্য বিভিন্ন উপায় হাতে নেন তাদের খোনার বলা হয়। জমিলা খালা আতিয়ার দোষ কাটানোর জন্য খোনারের কাছ থেকে তাবিজ এনে দিচ্ছেন। এই তাবিজের গুণে আতিয়ার মন্দ ভাগ্য কেটে যাবে! তবে স্বামীর দীর্ঘায়ু পেতে চাইলে আরও শক্তিশালী উপায় লাগবে। তারজন্য খরচ বেশি। সেই টাকাও আতিয়া জমাচ্ছে। আপাততঃ তাবিজ নিয়ে কপালের দোষ কাটুক! মানুষের মন বড়ো বিচিত্র জিনিস। যখন মন দুর্বল হয়ে যায়, তখন এমন তাবিজ কবজ, পানি পড়ার মতো জিনিসে শক্তি খুঁজে বেড়ায়। কুফরি, শিরক, অন্ধবিশ্বাস সবকিছুর উর্ধ্বে চলে যায়। না হলে আতিয়া অশিক্ষিত মেয়ে নয়। ডিগ্রি পাস করেছে, নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফ বিষয়ে আলাদা করে তিনবছর ডিপ্লোমা করেছে। কথাবার্তায় পরিষ্কার শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করে। পরিপূর্ণ রুচিশীল মহিলা মনে হওয়া আতিয়ার মনেও রয়েছে অন্ধবিশ্বাসের বসবাস।

“আতিয়া, আটটা বেজে গেলরে। দেরি করাইস না। সাত তালায় উঠতে আরও পাঁচ মিনিট লাগবো আমার।লিফটে যে ভীড়। তুই বললি সকালে টাকা নিয়া যাইতে, তাই সকাল সকাল আইসা হাজির হইছি।”

“আপা, ব্যাগের ভেতরের চেইনে টিস্যু দিয়ে পেঁচিয়ে রাখছি টাকা। এমন তো হওয়ার কথা না। টিস্যু আছে, টাকা নাই।”

“চুরি হইছে?”

“কাল টাকা তুলে সোজা বাড়িতে গিয়েছি। তখনও টাকা ছিল। সকালে ব্যাগ সাবধানে কাঁধে নিয়ে হাসপাতালে আসলাম।”

“চুরি খালি বাসে, রাস্তায় হয় নাকি রে। একসময় ঘরের বাস্তুসাপও কালসাপ হইয়া যায়। দুধ দেওয়া মালিকেরে দংশন করে। সকালে বাইর হওয়ার সময় টাকা গুইনা বাইর হইছস?”

“না। সময় পাই নাই। বাসা ভাড়া নিয়ে আম্মার সাথে লাগলো। বাসা ভাড়া, কারেন্ট বিল, আর বাজারের টাকাসহ পনেরো হাজার টাকা কী করছে জবাব দেয় না। এলোমেলো কথা কয়। আর তো আছে চোখের পানি। সবকথার শেষ কথা এই চোখের পানি। মায়ের চোখের এক এক ফোঁটা পানি নাকি একা একটা কবরের আজাব হবে দোজখে। আচ্ছা আপা সন্তানের চোখের পানির জন্য এমন কোন কিছু নাই। মাঝেমাঝে কিছু মানুষ যে সন্তানের চোখ দিয়ে পানি না রক্ত বাহির করে, তার কোন বিচার নাই।”

“থাক আতিয়া থাক। এসব কথা কইছ না। আল্লাহ নারাজ হইবো। মায়েরে নিয়া এমনে কইতে হয় না। হামিদ আলী চাচা আসলে চাচীরে বেশি তোলা তোলা রাখছিল। তখন টাকা পয়সা হাতে আছিল। ইউনিয়ন করতো, রাজনীতির বাড়তি পয়সা আছিল হাতে। রোগীদের কাছ থেকে ডেইলি বকশিস পাইতো। চাচীও খরচ কইরা অভ্যাস। এখন বুঝে না। মনে করে তুই চাইপ্পা চুইপ্পা টাকা দেস। তোর যে খালি ত্রিশ হাজার টাকা বেতন। এইটা বুঝে না।”

“তোমার কাছেও নালিশ করছে না? কবে ফোন দিছে?”

“এই তো এক মাস আগে। কইলো তুই হিসাব কইরা টাকা দেস। সেই টাকার আবার হিসাব নেস। থাক, বাদ দে। তোরে কইতে চাই নাই। মনে কষ্ট পাবি কইরা। আইজ কথায় কথায় মুখ থেইক্কা বাহির হইয়া গেল।”

“আপা, দশ হাজার বাসা ভাড়া। চারজন মানুষের খাওয়া খরচ হিসাব কইরা বিশ হাজার খরচ করি। আর দশ থেকে তোমার ধার শোধ দেই দুই হাজার একশো। সমিতিতে দেই এক হাজার। বাকি বোনের বেতন, আম্মার ঔষধ খরচ, আর বাস ভাড়া দিয়ে কী থাকে বলো? নিজের জন্য এতদিন একটা টাকা জমাই নাই। একটা ভালো জামা কিনি না ছয় মাসে একবার। কাজ করি, বেতন নিয়ে বাড়িতে যাই। কোন শখ নাই, কোন আহ্লাদ নাই। এরপরও যদি মানুষের কাছে গিয়ে গিয়ে এসব বলে তাহলে কই যাই। আল্লাহ আমার চোখের পানি শুকিয়ে ফেলছে। কাঁদতে জানলে এই জীবনের দুঃখে এক সাগর চোখের পানি হতো।”

“আমি যাই, ফোন আসতেছে ওয়ার্ড থেইক্কা।।নে তাবিজ রাখ। টাকা পরে দিস যা। দুধে ধুইয়া তাবিজটা কোমরে বাঁধবি, না হইলে গলার চেইনে দিবি। বালা মুসিবত কাটবো। যাই, মন খারাপ করিস না।”

হাতের মুঠোয় তাবিজটা নিয়ে এই একাকি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেঁদে দেয় আতিয়া। মানুষের সামনে নিজেকে বেশ শক্তিশালী দেখায়। অথচ একাকী হৃদয় তার আপনজনদের দেওয়া আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। চোখের কোল ঘেঁসে নেমে আসা পানির স্রোত ওড়নার আঁচল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। কান্না গিলে পা বাড়ায়। মেট্রোন ফোন দিচ্ছে। এখনি ওয়ার্ডে যেতে হবে। সময় নেই। আজ বাসায় গিয়ে একটা বোঝাপড়া করতে হবে।

(চলবে)