গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-০৭

0
268

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_৭

“আমাকে কে কী করতে চায়? বিয়ে! বিয়ের কথা তিনি তোকে বলেছেন? ওনার সাথে দেখা হলো, কথা হলো আজই প্রথম। তাও মিনিট পনেরো বিশ মিনিটের জন্য। এর মাঝে তিনি কি দেখে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন? তাছাড়া ওনার এখনো বিয়ে হয়নি? ওনার তো বয়স হয়েছে, সামর্থ্যও আছে, ব্যবসায়ী মানুষ। আমি তো ওনাকে সংসারী লোক ভেবেছি। আমি শুনেছি তিনি দোকানের আরেকটা ছেলেকে বলছিলেন মেয়েকে কোচিং থেকে আনতে যাবেন। আশিক, তুই আমার সাথে ফাইজলামি করতেছিস তাই না?”

“আপা, রেগে যাচ্ছ কেন? মিসবাহ ভাই বিয়ের কথা বলেন নাই।”

“তাহলে তুই বললি কেন তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। আমাকে নিয়ে মশকরা করিস! আমি তোর খোঁজে দোকানে গিয়েছিলাম। তোদের কী মনে হয়, এখন আমি রাস্তা ঘাটে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে ফিরি! বিয়ের জন্য আমি এত পাগল হয়ে গিয়েছি যে একজনের বৌ বাচ্চা থাকলেও তার গলায় ঝুলে পড়বো! সেরকম হলে বহু আগেই করতাম। অনেক মানুষ প্রস্তাব দিয়েছে। আলাদা ঘর নিয়ে ওঠাবে বলেছে। কিন্তু আমি না সতীনের সংসার করবো, না কারও সতীন হবো। মনে কষ্ট পেলাম রে আশিক।”

“আরে তুমি তো কান্নাকাটি শুরু করলা। আসলে আমারই কথাটা গুছিয়ে বলা হয় নাই। শোন শোন, মিসবাহ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল ঠিক, কিন্তু তালাক হয়ে গিয়েছে। এরপর ভাইয়ের বিয়ের জন্য অনেকদিন থেকে ওনার পরিবার চেষ্টা করছিল। তিনি রাজি ছিলেন না। ওনার একটা মেয়ে আছে। মেয়েকে নিয়েই জীবন কাটাতে চান বলতেন। তোমার সাথে বিয়ের কথাটা মারুফ তুলেছে। মারুফ মিসবাহ ভাইয়ের ছোটোভাই, আমার বন্ধু। মিসবাহ ভাই নাকি মারুফের কাছে তোমার খোঁজ খবর নিয়েছেন। মানে কতদিন হলো বিধবা, সন্তান আছে নাকি। তোমাকে বিয়েশাদি আর দেয়নি কেন! এসব। মারুফের তাই মনে হলো মিসবাহ ভাইয়ের তোমাকে পছন্দ হয়েছে। আমাকে মারুফ জিজ্ঞেস করলো তোমার বিয়ের কথা ভাবি নাকি আমরা। ভাবলে সে বাড়িতে কথা বলবে।”

“তোরা দু’জন বাচ্চা বাচ্চা মানুষ কী কথা বললি না বললি তার উপর ভিত্তি করে এভাবে বলে ফেললি যে আমাকে বিয়ে করতে চায়! এমনিও তো কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বিধবা মহিলা, ডিভোর্সি মহিলা শুনলে মানুষের অনেক কৌতূহল হয়। কী করে, কিভাবে জীবন চলে এসব। কিন্তু ঐ আগ্রহ পর্যন্তই। তোর মিসবাহ ভাইও আলাদা কিছু না। বিয়ে করতে হলে সবাই কমবয়সী, সুন্দরী মেয়ে, অবিবাহিত মেয়ে খোঁজে। তা ছেলের যত নাম্বার বিয়ে হোক, আর বয়স যতই হোক। আর ওনার তো অবস্থা ভালো। নিজের ব্যবসা আছে। আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন!”

“তোর আগ্রহ থাকলে বল। মারুফ বাসায় কথা বলে দেখুক। না হলে না হবে। মিসবাহ ভাই লোক খারাপ না।”

“লোক খারাপ না হলে তালাক হলো ক্যান?”

“কেন মহিলাদের দোষে তালাক হতে পারে না। শুনেছি ওনার স্ত্রী অন্য একজনকে পছন্দ করে ঘর ছেড়েছেন। মেয়েকেও সাথে নেয়নি।”

না করে দিবে ভেবেও না করতে পারে না আতিয়া। লোকটাকে খারাপ মনে হয়নি। কিন্তু পনেরো মিনিটে কী আর কাউকে চেনা যায়! বহু জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছে। এখানে তো কোন কিছু আশা করাও হাস্যকর। কিন্তু হাতের বাজুতে বাঁধা তাবিজের কথা ভেবে কেন জানি মনে একটা শান্তি আর বিশ্বাস আসে। জমিলা আপা বলেছিলেন এই তাবিজে কপালের ফাঁড়া কেটে যাবে। দেখাই যাক না কী হয়।

“জানি না। দেখিস উল্টো পাল্টা কথা বলে তোর চাকরির না সমস্যা হয়। আমি দোকানে গিয়েছিলাম তোর সাথে কথা বলতে। এত রাত করে বাসায় আসিস কেন? শরীর খারাপ করবে। আর আমার উপর মনে কষ্ট রাখিস না। আমি জানতাম না বিরিয়ানির টাকা তোর দেওয়া। ভুল বুঝেছি। আসলে সকালে আম্মা পনেরো হাজার টাকা নষ্ট করছে সেই কথা শুনে গেলাম। তারপর হাসপাতালে গিয়ে দেখি ব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা নাই। এরপর অফিসে রোগীর লোক অভিযোগ করছে, সেখানে আবার স্যার কথা শোনালেন। সবমিলিয়ে মাথা খারাপ ছিলরে। মনে কষ্ট নিস না। আর বাসা ভাড়া, বাজার খরচ দিছিস বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

“ধন্যবাদের কী আছে! তুমি তো সবসময় দাও। এই টাকা তো খরচের জন্যই দিয়েছিলাম আম্মাকে। ভেবেছিলাম তোমাদের তিনজনের হাতেও এক হাজার করে করে দেব। কিন্তু এখন হাতে শুধু নিজের হাতখরচ আছে। আর টাকা নাই। তবে তোমার টাকা কই হারালো বুঝলাম না। আম্মা টাকা কাকে কী জন্য দিয়েছে আমিও জানি, তুমিও জানো। কিন্তু ব্যাগের তিন হাজার গেল কই!”

“সেটা তো আমারও কথা। বাসে নিলে তো চেইন খোলা, না হলে ব্যাগ কাটা থাকতো। টিস্যু পেঁচানো ছিল। টিস্যু আছে, টাকা নাই। আর আমাদের তুই কত দিতে পারবি। একটা মাত্র ভাই। বোনেরাই তো আগে নেব। তারপর ভাইয়ের বৌ।”

বহুদিন পর দুই ভাইবোন লম্বা সময় গল্প করে। দেলোয়ারা বেগম একবার এসে দেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু বলেন না। আতিয়ার সাথে আশিকের এত ভাব ভালোবাসা কেন জানি ওনার ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ আড়ি পেতে শুনলেন কী আলাপ করে দু’জন। আশিক আতিয়ার বিয়ের কথা ভাবছে দেখে রাগ হয়। আশিককে বেকুব মনে হয়। দুইটাকা ইনকাম করতে না করতে ছেলে ভাবছে ঘরের সব দায়িত্ব ও নিতে পারবে! আতিয়ার ত্রিশ হাজার বেতনেই যেখানে টানাটানি হয়। সেখানে আশিকের ষোল হাজারে কী হবে! ভেবেছিলেন আতিয়ার সাথে আশিকও আয় করা শুরু করলে একটু আরাম আয়েশের মুখ দেখবেন। কিন্তু তাও বোধহয় কপালে নেই!

না আতিয়া ওনার নিজেরই মেয়ে। তারপরও আতিয়ার প্রতি কেন জানি একটা ক্ষোভ দেলোয়ারা বেগমের। আতিয়ার জন্মের পর আরও দুই সন্তান হয়েছিল দেলোয়ারা বেগমের। একজন জন্মের তিনদিন পর মারা যায়। আরেকজন তিন বছর বয়সে হঠাৎ জ্বরে দুইদিনের মাথায় মারা গিয়েছিল। তখন আতিয়ার কোন দোষ ওনার মনেও আসেনি। কিন্তু বহুদিন পর ওনার মনে হয় আতিয়া অপয়া, তাই ওনার দুটো সুস্থ ছেলে মারা গিয়েছে। আশিকের জন্মের পর তাই চোখে চোখে রাখতেন। বড়ো আদরের ছেলে। আতিয়া যাকে ভালোবাসে, বা যে আতিয়াকে ভালোবেসে তার কাছাকাছি থাকে তারই কেন জানি ক্ষতি হয়। আতিয়ার নানী এত আদর করতেন আতিয়াকে। তিনিও দুম করে ঘুমের ভেতর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন। আতিয়া ওনার সাথেই ঘুমাতো। একদম সুস্থ সবল মানুষ ছিলেন। আতিয়াকে তাই বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। সেখান থেকেও দু’বছর না যেতে বিধবা হয়ে ফিরে আসলো। আতিয়া আসার পর আতিয়ার বাবা হামিদ আলী মারা গেলেন। কাউকে এসব বললে দেলোয়ারা বেগমকে খারাপ বলবেন। বলবেন মা হয়ে মেয়েকে এমন চোখে দেখেন। কিন্তু সবাই ই তো বলে আতিয়া অপয়া। এখন আতিয়ার আয়েই সংসার চলে তাই না চাইলেও আতিয়াকে চোখের সামনে মেনে নিতে হয়। কিন্তু মনটা ধুকপুক করে। আতিয়ার জন্য অন্য কোন সন্তানের ক্ষতি হয় তাই ভেবে ভয় পান। ছেলের ভালো চাকরি হয়ে গেলে আতিয়াকে কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে যেতে বলবেন ভাবেন। আতিয়ার একার আর কত টাকা লাগবে চলতে! মাসে মাসে ওনার হাতে বাকি টাকা দিয়ে যাবে আতিয়া। তিনি ছেলের সংসারে থাকবেন খাবেন। ছোটো মেয়েটাকেও একটা বিয়েশাদি দিবেন। তখন আয়েশাও জামাই নিয়ে যখন তখন বেড়াতে আসতে পারবে। সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার আগে আতিয়া বিয়ে করুক তা তিনি চান না। আতিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে বিপদে পড়বেন। তখন কী আর আতিয়া এই সংসার দেখবে! নিজের সংসারে ব্যস্ত থাকবে।

বহুদিন পর ভালো ঘুম হয় আতিয়ার। একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখে শাড়ি পরে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছে। ও একা নয়, তার সাথে একজন লোকও আছে। লোকটা আগে নৌকায় উঠেছে। স্বপ্নে চেহারাটা কার বোঝে না আতিয়া। কিন্তু নৌকায় ওঠার সময় লোকটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আতিয়াও সহজ ভাবে বাড়ানো হাত ধরে নৌকায় পা রাখে। ঘুমের ভেতরও হাসে আতিয়া। স্বপ্নের রেশ রয়ে যায় ঠোঁটের কোণে।

(চলবে)