ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-১০+১১+১২

0
156

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১০
স্টেশন থেকে ওদের কে ফিরে আসতে দেখে সুপর্ণা অবাক হলেন, শঙ্কিত মুখে তাকিয়ে বললেন,

কি হয়েছে? সৌমিক গেলো না কেনো? ট্রেন বন্ধ নাকি?

অপর্ণা কিছু বলার আগেই সৌমিক উত্তর দিলো,

না, মনে হলো ওকে রেখে যাওয়ার কথায় আপনারা খুব দুশ্চিন্তা করছেন, তাই ওকে নিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম! চিন্তা করবেন না, আমি পরীক্ষার আগে দিয়ে যাবো।

তৎক্ষণাৎ সুপর্ণার মুখ উজ্জ্বল হলো, রমেন বাবু কাঁপা কাঁপা হাতে জামাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলেন, নরম গলায় বললেন,

তুমি যখন নিজে ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছো তখন ও নিশ্চয়ই যাবে! কিন্তু ও খুব অভিমানী, ওখানে গিয়ে যদি কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় তাহলে কিন্তু ও বিপদে পড়বে! এতদূরে তো কখনো একা একা যাতায়াত করেনি তাই চলে আসতেও পারবে না! তুমি সেদিকটা ভেবে দেখেছো তো বাবা?

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

কোনো সমস্যা হবে না! বাবার হটাৎ এক্সিডেন্ট হওয়াতে মা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তাই এসব বলেছেন! বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবেন, আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না!

সুপর্ণা চোখের জল মুছে হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন,

ও তৈরি হতে হতে তোমাকে দুটো লুচি ভেজে দিই বাবা, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে খিদে পেয়ে যাবে!

সৌমিক মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। দুজনে তৈরি হয়ে পরের ট্রেন ধরতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেলো, অপর্ণার মধ্যে ট্রেনে ওঠার পর থেকেই নতুন করে অস্বস্তি ফিরে এলো, শাশুড়ি কি বলতে পারেন ভেবে বুকের মধ্যে ভয় ভয় ভাব হচ্ছিলো। কিছুক্ষন পরে অপর্ণা অস্বস্তি চেপে রাখতে না পেরে বলে ফেললো,

যদি মা খুব রাগারাগি করেন, তাহলে?

সৌমিক জানলার বাইরে তাকিয়েছিলো, গম্ভীর গলায় বললো,

জাস্ট দুদিন আগেই তো বলছিলে ডিসিশন নেওয়ার আগে তোমার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিলো! এখন রাগারাগি করলে কি হবে ভেবে কি লাভ? তুমি তো থাকতে চেয়েছিলে যখন তখন এটা ভেবেই বলেছিলে নিশ্চয়ই!

অপর্ণা গম্ভীর হয়ে গেলো,

তখন বলেছিলাম হয়ত, কিন্তু এখন আমি এখানে থেকে যেতেই চেয়েছিলাম, তুমিই যেতে বলেছো!

সৌমিক ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, বলেছি তো! আর বলেছি যখন, তখন মা রাগারাগি করলে কি হবে সেটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও!

অপর্ণা মুখ ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকালো, একদিকে আনন্দ হচ্ছিলো যে সৌমিক ওকে স্বপনের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অন্য দিকে আগামী এক মাস সৌমিকের সঙ্গে এক ছাদের তলায় কাটাতে হবে এটা ভাবলেই ওর মনের মধ্যে একটা খারাপ লাগা ফিরে আসছিলো।

আগের ট্রেনটা ধরতে না পারায় কলকাতায় ফিরতে ওদের দেরি হয়ে গেলো অনেকটাই। বেল টেপার কিছুক্ষন পরে শ্বশুর মশাই দরজা খুলে অপর্ণা কে সৌমিকের সঙ্গে দেখেই চমকে গেলেন, কোনো কথা বলার আগেই ভেতর থেকে অপর্ণা শাশুড়ির গলা শুনতে পেলো,

কে? ঋজু ফিরলো নাকি?

শ্বশুর মশাই দরজা খুলে সরে দাঁড়ালেন, তিনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সৌমিক ঘরে ঢুকে পড়লো,

হ্যাঁ, মা আমরা!

রীনা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন, অস্বস্তি নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন,

এ কি! তুমি ফিরলে কেনো? তোমার মাকে তো বললাম সেদিন সবটা! তুমিও তো শুনলে পুরুত মশাই বারণ করেছেন তোমায় এখন এখানে থাকতে! তারপরেও ফিরে এলে! একবারও সংসারের মঙ্গল অমঙ্গলের কথা ভাবলে না!

অপর্ণা কিছু বলার আগেই সৌমিক উত্তর দিলো,

কিছু অসুবিধা ছিলো তাই ফিরতে বাধ্য হয়েছে, আমিই নিয়ে এসেছি এতে ওর মায়ের কোনো দোষ নেই!

রীনা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

বেশ! আমি তো আমার সংসারের মঙ্গলের কথা ভাববো, অন্য কেউ ভাবুক বা না ভাবুক! তুমিই যখন নিয়ে এসেছো সঙ্গে করে তাহলে তুমিই দায়িত্ব নিয়ে কাল পৌঁছে দিয়ে আসবে আবার। ওর মা যখন কথার দাম রাখতে পারেন নি তখন আমি এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে আর একটা কথাও বলবো না!

সৌমিক ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মায়ের দিকে ফিরে তাকালো,

অবুঝের মতো কথা বলো না! আমি কালই অফিসে জয়েন করবো আর এক মাসের আগে ছুটি নিতে পারবো না, সামনের মাসে গিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

তার মানে! এক মাস ধরে ও এখানে থাকবে! এতে যদি কিছু অমঙ্গল হয় তাহলে কে দায়ী হবে? তুমি তো বলেই খালাস!

সৌমিক মাকে হাত দেখিয়ে থামালো,

তুমি বরং পুরুত মশাই কে খবর দাও একবার, আপাতত এক মাসের জন্যে কি উপায় বার করা যায় সেটা দেখো! উনি নিশ্চয়ই কিছু বলে দেবেন তোমাকে!

রীনা রাগে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন,

সে না হয় দেবেন, কিন্তু তুমি ওকে কেনো নিয়ে এলে সেটা বলো আমাকে? কি এমন অসুবিধা হলো যে তুমি আমার কথাটুকুও রাখতে পারলে না?

সৌমিক এবার বিরক্ত হলো, কড়া গলায় বললো,

তুমি তো জানো মা আমার কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগে না! তবু কেনো বারবার একই জিনিষ করো! আমার যেটা ভালো মনে হয়েছে, প্রয়োজন মনে হয়েছে, আমি করেছি, এবার তুমি যেভাবে এটাকে আপাতত মিটিয়ে নিতে পারো সেই চেষ্টা করো। আমি আগামী মাসের আগে কিছুতেই ছুটি নিতে পারবো না!

অপর্ণার শাশুড়ি রাগে ফুঁসছিলেন, অপর্ণা অপমানিত মুখে দাঁড়িয়েছিলো, পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে এবার সোফায় বসে থাকা সৌমিকের মাসি উঠে দাঁড়ালেন, বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

রীনা চুপ কর, ঘরে যা তুই! মিছিমিছি তর্ক করিস না! ওরা অনেক দূর থেকে ফিরছে এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় নয়! অনিন্দিতা কোথায়? ওকে চা বসাতে বল!

সৌমিক এর মা সম্ভবত ছেলের ওপর রাগেই ঘরে ঢুকে গেলেন, সৌমিক কে ঘরে না ঢুকে বেরিয়ে যেতে দেখে মাসি এগিয়ে এলেন,

এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? চা খাবিনা?

সৌমিক এর কোনো উত্তর শোনা গেলো না, শুধু দরজা টেনে বন্ধ করার আওয়াজে অপর্ণা বুঝলো সৌমিক বেরিয়ে গেলো। ও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খাটে বসে পড়লো, সব কিছু কিরকম অদ্ভুত লাগছে! বাড়িতে ফিরে যে এতোটা অপমানিত হতে হবে সেটা ও একবারও ভাবে নি!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রবি কে ফোন করলো সৌমিক,

বাড়িতে আছিস নাকি থানায়? যদি বাড়ি থাকতিস তাহলে আসতাম, একটু দরকার ছিলো!

না, বাড়িতেই আছি, একটু আগেই ফিরেছি, চলে আয়,

রবির উত্তরে সৌমিক পা চালালো, মোড়ের মাথাটা ঘুরে গিয়েই রবিদের বাড়ি, সেই ছোটো থেকে যে কতো বার এসেছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বাড়িটার প্রতিটা কোন সৌমিকের মুখস্থ, দোতলার শেষ প্রান্তের ঘরটা রবির, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সোজা ঘরে ঢুকে এলো ও। ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে রবি খুশি হলো,

সব মিটলো? বউ কে রেখে এসেছিস তো?

সৌমিক এগিয়ে এসে খাটে বসে পড়লো,

নাহ! সঙ্গে নিয়ে আসতে হলো! সেই জন্যেই তোর কাছে এলাম, একটু দরকার ছিলো!

কি রকম হলো ব্যাপারটা?

রবি একটু অবাক হয়ে তাকালো,

বলছি দাঁড়া! ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলতে হবে!

প্রথমে তো থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনা শোনার পরে রবি মাথা নাড়লো, চিন্তিত গলায় বললো,

তাহলে ভালোই করেছিস নিয়ে এসে! কিন্তু আমার কাছে তুই কি হেল্প চাইছিলি?

আমি ভাবছিলাম তোর যদি ওখানের থানায় কিছু চেনা জানা থাকতো, তাহলে একটু ধমকে দিতিস ওকে! এমনিতে চুনোপুঁটি, ছোটো জায়গার মস্তানরা যেমন হয় আর কি! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অপর্ণা কে এখন নিয়ে এলেও পরীক্ষার জন্যে বেশ কিছুদিন ওখানে থাকতে হবে, তখন যদি একা পেয়ে কোনো গোলমাল করে! তাই তার আগেই একটু সমঝে দিতে হবে বুঝলি তো!

বন্ধুর কথায় রবি হাসলো,

বুঝলাম! ঠিক আছে ব্যবস্থা করছি! কি নাম বললি যেনো ছেলেটার?

সৌমিকও হাসলো,

স্বপন!

রবি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

একটু সময় দিতে হবে বস, ওটা কলকাতা পুলিশের এরিয়া নয়, দেখছি কেউ চেনা শোনা আছে কিনা!

সৌমিক হাসলো,

এক মাস সময় আছে তোর হাতে, তার মধ্যেই যা করার কর, সামনের মাসে আমি ওকে দিয়ে আসবো।

ইতিমধ্যে রবির মা চা দিয়ে গিয়েছিলেন, চা খেতে খেতে রবি সৌমিকের দিকে তাকালো,

তোর মায়ের রিয়াকশন কি? রেগে যায়নি তো অপর্ণা কে ফিরতে দেখে?

সৌমিক চায়ের কাপ সরিয়ে রেখে বন্ধুর দিকে তাকালো, গলায় তাচ্ছিল্য এনে বললো,

স্বাভাবিক! মায়ের কথার বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই তো রিয়াকশন হবেই! এগুলো কি তুই এতদিনেও জানিস না?

রবি হাসলো,

হ্যাঁ, জানি বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম! জেদ তো ওনারও প্রবল! আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় এই জেদ ব্যাপারটা না তুই ওনার কাছ থেকেই পেয়েছিস! মনে আছে তুই মিতার বাবার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়েছিলি বলে উনি কি কান্ড করেছিলেন তখন?

হুমম! কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনি তো! আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছিলো আমি করেছিলাম! মা নিজেই তো মিতার বাবা কে অপমান করেছিলো প্রথমে, তাই ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত ছিলোই! আমি সেটাই করেছিলাম!

সৌমিক এর কথায় রবি দুঃখিত হলো,

সত্যি কাকিমা অতোটা বাড়াবাড়ি না করলে আজ তোর জীবনটা অন্য রকম হতে পারতো! তুই আর মিতা দুজনেই কতো ভালো থাকতিস আজ!

সৌমিক মাথা নাড়লো, উত্তেজিত হয়ে বললো,

নাহ! সম্পর্ক ভাঙার জন্যে পুরোপুরি মায়ের দোষ ছিলো না! বাড়াবাড়িটা মিতা করেছিলো, বেশি চাপ দিলে যে ক্ষতি হয়ে যায় ও এটা বোঝেনি, অন্যায় দাবি কি মেনে নেওয়া সম্ভব হয় কখনো? ও ভাবলো দিল্লী চলে গিয়ে ও আমাকে জব্দ করবে, ওর সব অন্যায় শর্ত আমি মেনে নেবো, তাই কখনো হয় না! আমি তো যতটা সম্ভব মেনে নিয়েছিলাম, ওকে কোনো ব্যাপারে ফোর্স করিনি, কিন্তু ও চাইছিলো আমার ব্যক্তিগত ডিসিশনগুলোও ওই নেবে! সেটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব! আমি ওর কোনো কাজের জন্যে কৈফিয়ত চাই নি যখন তখন আমিও আশা করতেই পারি যে ও আমার ডিসিশনের জন্যে কৈফিয়ত চাইবে না!

বন্ধু কে উত্তেজিত হতে দেখে রবি কথা ঘোরালো,

থাক ওসব পুরনো কথা, ওই এপিসোড ক্লোজ হয়ে গেছে এখন! মিতা দিল্লীতে সেটেল করে গেছে আজ বছর দুয়েক হয়ে গেলো প্রায়, এখন আর ওসব আলোচনা করেই বা কি হবে!

সৌমিক মুখ শক্ত করে তাকালো,

আলোচনা করতে চাই না কিন্তু তাও প্রসঙ্গ ওঠে বারবার, কেনো যে ওঠে সেটা নিজেও বুঝিনা! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুইও মিতার পক্ষেই থাকতে চাস সব সময়।

সরাসরি আঙুল উঠতে দেখে রবিও উত্তেজিত হয়ে উঠলো,

আমি কারো পক্ষেই নই ভাই শুধু দুজনের কমন ফ্রেন্ড হিসেবে নিজের মত প্রকাশ করেছি মাত্র! যেহেতু এক সঙ্গে বড়ো হয়েছি ছোটো থেকেই, স্কুল, কলেজ, বাড়ি সব জায়গাতেই এক সঙ্গে থেকেছি তাই তোদের দুজনকেই ভালো করে চিনি! শুধু তোদের বললে ভুল হবে তোদের ফ্যামিলিকেও চিনি! তোর মা যেভাবে তোদের সম্পর্কের কথা জানার পরে মিতা আর ওর বাবা কে বাড়ি বয়ে গিয়ে অপমান করে এসেছিলেন সেটা ঠিক হয়নি! দোষ তো তোরও ছিলো, এক হাতে তো আর তালি বাজে নি!

সৌমিক হাত তুললো,

আমি কি সেটা কখনো অস্বীকার করেছি? আমি তো সেই জন্যেই মায়ের হয়ে ওদের বাড়ি ক্ষমা চাইতে গিয়েছিলাম, তাতে ওর বাবার কাছে আমিও কিন্তু কম অপমানিত হই নি! উনি আমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন! তাতেও আমি কিছু মনে করিনি, কারণ আমার মনে হয়েছিলো মা যা করেছে এটা হওয়ারই ছিল! কিন্তু তারপরে যখন মা রাজি হলো, মেনে নিলো সবটা, তখন তো মিতাই বেঁকে বসলো তাই না?

তোর মা মেনে নিলো, নাকি মেনে নিতে বাধ্য হলো শুধু এই কারণে যে ছেলে পাছে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়?

বিদ্রুপের গলায় বললো রবি, সৌমিক মাথা কাত করলো,

হ্যাঁ সেটা ঠিক! কিন্তু যে কারণেই হোক না কেনো রাজি হয়েছিলো তো? শুধু তাই নয় বাবা ওর বাবা কে ফোনও করেছিলো! কিন্তু মিতা কি বললো তখন? ও ওই বাড়িতে বিয়ের পরে কিছুতেই থাকবে না, কারণ ওর বাবা কে মা অপমান করেছিলো! যদি তাই হয় তাহলে তো ওর বাবাও আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছিলেন কিন্তু আমি তো বলিনি যে ওদের বাড়ির সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখবো না! এতো জেদ ওর যে আমাকে চাপে রাখার জন্যে ও দিল্লিতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেলো, একবারও জানানোর প্রয়োজনও মনে করলো না! ওকে বিয়ে করতে গেলে নাকি আমাকে দিল্লি তে ট্রান্সফার নিতে হবে!

রবি হাত তুললো,

ছেড়ে দে! ওর দিক থেকেও অনেক কিছু বলার ছিলো হয়ত! এটা ঠিক কথা যে বিয়ের পরে এখানে থাকলে কাকিমা ওকে যথেষ্ট কথা শোনাতেন সব সময়! তোর বৌদি তো চাকরি ছেড়েছে, ওকেও হয়ত ছাড়তে হতো!

নাহ! বৌদি কে কেউ চাকরি ছাড়ার কথা বলে নি, ও নিজেই ছেড়েছে! আর মিতা কে চাকরি ছাড়তে হতো এটা যে ঘটবেই সেটা আগে থেকেই কি তোরা প্রেডিক্ট করে নিলি? যদি চাকরি ছাড়ার কথা উঠতো, যদি মা কথা শোনাতো তখন তো এগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হতো, তখন না হয় আলাদা থাকার প্রশ্ন উঠতো! ঘটনা ঘটার আগেই ঘটতে পারে ভেবে বিয়ের পরেই আলাদা থাকার ডিসিশন নেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের মতো কাজ নয়! আর মিতা কিন্তু এগুলো নিয়ে কখনো আলোচনা করতে চায় নি শুধু নিজের ডিসিশন জানিয়েছে! ও বলেছিলো ওকে বিয়ে করতে হলে দিল্লিতে এসে রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ করে ওর সঙ্গে থাকতে হবে, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না, সেটা কখনো সম্ভব নয়! আমি তো কখনো ওকে এরকম কোনো শর্ত দিই নি, ওর বাবাও তো আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছিলেন!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১১
দোতলা বাড়িটার একতলায় ঘরের সংখ্যা দুই, একটায় শ্বশুর, শাশুড়ি থাকেন অন্য টা গেস্ট রুম। তা বাদে রান্না ঘর, বাথরুম, বসার এবং শোওয়ার ঘর। দোতলায় দুটো ঘর, বাথরুম একটাই। সিড়ি দিয়ে উঠে এসে মাঝে একটা বড়ো জায়গার দুপাশে দুটো ঘর, একটা সৌমিকের অন্য টা ওর দাদার।

অপর্ণার যখন ঘুম ভাঙলো তখনও চারপাশে অন্ধকার, উঠে এসে বাথরুমে গিয়েছিলো ও। ঘর লাগোয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সবে মাত্র টেবিল থেকে জলের বোতল টা মুখে তুলেছিলো অপর্ণা এমন সময় নীচের থেকে বাসন পড়ার আওয়াজ পাওয়া গেলো। শব্দটা খুব জোরালো না হলেও এই ভোরে এতো নিস্তব্ধতার মধ্যে সেটা অপর্ণার কানে যথেষ্টই জোরালো শোনালো। অপর্ণা দু ধাপ সিঁড়ি নেমে এসে নীচের দিকে উঁকি মারলো, সম্পূর্ন অন্ধকার ড্রয়িং রুমের এক প্রান্তে যেখানে রান্না ঘর সেখান থেকে একটা সরু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।

এতো ভোরে রান্না ঘরে আলো জ্বলতে দেখে নিতান্তই কৌতূহল বসে অপর্ণা নিচে নেমে এলো। সিঁড়ি থেকে নেমেই বাঁপাশে শ্বশুর, শাশুড়ির ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তার পাশ দিয়ে রান্না ঘরে ঢুকেই চমকে গেলো অপর্ণা, চারিদিকে ছড়ানো কাটা সবজি, মাখা আটা, গ্যাসে বসানো কড়া তে তরকারি, সব কিছুর মধ্যে দ্রুত গতিতে হাত চলছে অনিন্দিতার!

দিদিভাই! এতো ভোরে তুমি রান্না করছো!

অপর্ণার কথায় অনিন্দিতা চমকে ফিরে তাকালো, পেছনে ফিরে অপর্ণা কে দেখেই তার মুখে মৃদু হাসি ফুটলো,

ভোর কোথায়, চারটে বেজে গেছে কখন! এখন থেকে না করলে সাড়ে আটটার মধ্যে ওরা কেউ মেট্রো ধরতে পারবে না তো!

অপর্ণা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো,

তুমি একা সব করো? মিনতি মাসি কি তোমাকে হেল্প করে না দিদিভাই?

অনিন্দিতার হাত চলছিলো, কাজ করতে করতেই জবাব দিলো,

না গো, মিনতি মাসীর কাজ আলাদা! মা সবাই কে কাজ ভাগ করে দেন! তোমার তো এখন এখানে থাকার কথা ছিলো না, তাই বোধহয় তোমাকে কোনো দায়িত্ব দেন নি!

অপর্ণা কে তাও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনিন্দিতা হাসলো,

তুমি নিচে নেমে এলে কেনো! যাও ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ো! সেদিন তো শুনলাম তোমার নাকি কদিন পরেই পরীক্ষা, পড়াশুনা শুরু করেছো তো?

অপর্ণা হাসলো,

হ্যাঁ করবো এবার! তোমাকে কিছু হেল্প করি দিদিভাই?

অনিন্দিতা ঘাড় নাড়লো,

না, না আমার হয়ে এসেছে প্রায়, আর হেলপ লাগবে না!

আরো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরে অপর্ণা নিজের ঘরে ফিরে এলো, কিছুক্ষনের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে অপর্ণা উঠে পড়লো, ওর বরাবরই ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। ওদের মফস্বল এলাকায় দিন শুরু হয় ভোর বেলা, আর রাতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, এতো দিনের অভ্যেস থেকে বেরোনো এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়।

ঘুম থেকে বাড়ির অভ্যাস মতো বন্ধ রাখা জানলা গুলো খুলতে শুরু করলো অপর্ণা, ঘরটা কে একটু গুছিয়ে রাখবে আজ! গত কয়েকদিনের ব্যস্ততায় কখনোই সব জানলা খোলা হয়নি। মনের মধ্যে খানিকটা জমে থাকা অভিমানও ওকে এগুলো করতে বাধা দিয়েছিলো এতদিন, মনে হতো কি লাভ ঘর গুছিয়ে ও তো এখন অনেকদিন এখানে থাকবেই না আর! এমনকি গত পরশু এখানে সৌমিকের সঙ্গে ফিরে আসার পরেও সে কথাই মনে হচ্ছিলো বাড়ির সবার ব্যবহার দেখে, তারপরে অপর্ণা নিজেকেই বুঝিয়েছে বারবার।বাড়িটা তো সৌমিকেরও, ও যখন নিজে নিয়ে এসেছে তখন অন্যের কথা আর গায়ে মাখবে না ও ।

পায়ের দিকের জানলাটা খুলতেই সকালের রোদ সরাসরি এসে পড়লো সৌমিকের চোখে, সৌমিক বিরক্ত হয়ে চোখে হাত দিলো, পাশ ফিরে শুতে শুতে বললো,

ওই জানলাটা দিয়ে রোদ আসে সকালে, চোখে লাগে, ঘুমের অসুবিধা হয়! ওটা খুলিনা কখনো, খোলার দরকারও নেই!

অপর্ণা থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করে দিলো, কিন্তু এই টুকুর মধ্যেই ওর বেশ পছন্দ হলো জানলার বাইরেটা। এইদিকের পাশের বাড়ি তিনটে পরপর একতলা, একদম পাশের বাড়িটার ছাদে সারি সারি করে আলসে তে টব বসানো, অনেকটা জায়গা ফাঁকা হওয়ায় বেশ খানিকটা দুর পর্যন্ত খালি দেখা যাচ্ছে আর রোদ একদম সরাসরি জানলা দিয়ে খাটে এসে পড়েছে।

অপর্ণা জানলা বন্ধ করে দিয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো, সৌমিকের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো তাকে এপাশ ওপাশ করতে দেখে বললো,

চা নিয়ে আসবো?

সৌমিক বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো,

হুঁ!

অপর্ণা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলো, তাকে ছুটে রান্না ঘরে ঢুকতে দেখে অনিন্দিতা তাকালো,

কিছু লাগবে তোমার?

অপর্ণা হাসলো,

চা করবো, একটু জিনিসগুলো দেখিয়ে দেবে?

অনিন্দিতা পেছন ফিরে শাশুড়ির বন্ধ দরজার দিকে তাকালো, মুচকি হেসে বললো,

ঋজু খেতে চেয়েছে বুঝি? তাহলে তো তোমাকেই করতে হবে! বউয়ের হাতের প্রথম চা বলে কথা, আমি করলে রাগ করবে। তুমি চা করতে পারো নাকি আমি শিখিয়ে দেবো?

অপর্ণাও হেসে ফেললো,

কি যে বলো দিদিভাই! বাবার ডিউটি তে বেরোনোর সময় চা তো আমিই করতাম, আমি সবারটাই করছি, আমার হাতের চা খেয়ে দেখো একবার তোমারও দারুন লাগবে!

আচ্ছা তাই নাকি! বসাও তাহলে সবার জন্যেই, কিন্তু মা আবার রাগ না করেন!

অনিন্দিতা একটু চিন্তিত মুখে আবার বন্ধ দরজার দিকে তাকালো, অপর্ণা ফুৎকারে উড়িয়ে দিলো, মুচকি হেসে বললো

ধুস! তুমিও না! চা করলে রাগ করার কি আছে! তবে হ্যাঁ আমি ভালো চা তখনই কাউকে খাওয়াই যখন সে আমাকে আপন ভাবে! এই যেমন তুমি আমাকে তুমি বলছো মানে একটুও আপন ভাবছো না!

অনিন্দিতা হেসে ফেললো,

মানে ভালো চা খেতে গেলে তুই বলতে হবে তাই তো? ঠিক আছে তাই সই, তুইই বলবো! সকাল বেলা বাজে চা খাওয়ার একটুও ইচ্ছে আমার নেই!

এতো তাড়াতাড়ি কেউ ওঠেনি তাই সবার চা ফ্লাস্কে রেখে সৌমিকের আর অনিন্দিতার চা কাপে ঢাললো অপর্ণা, অনিন্দিতা চায়ে চুমুক দিয়ে হাসলো,

সত্যি রে, তুই খুব ভালো চা বানাস! কিন্তু তুই খাবি না?

অপর্ণা সৌমিকের চা ট্রে তে রাখতে রাখতে হাসলো,

নাহ! এতো সকালে খেতে ইচ্ছে করছে না! জানো দিদিভাই বাবাও আমার হাতের চা খুব পছন্দ করেন, আগে যখন ছোটো ছিলাম তখন তো খুব বাজে বানাতাম তাও বাবা কখনো খারাপ বলতেন না! তোমার বাবা কেমন মানুষ দিদিভাই?

অনিন্দিতার মুখে কালো ছায়া পড়লো, মুখ ফিরিয়ে কড়া তে খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললো,

আমার বাবা নেই রে, অনেক বছর আগে মারা গেছেন, আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি!

অপর্ণা চমকে তাকালো,

এমা! আমি জানতাম না গো সরি!

অনিন্দিতা মাথা নাড়লো,

আরে না না, ঠিক আছে! তুই কি করে জানবি? যা চা নিয়ে যা ওপরে ঋজু অপেক্ষা করছে!

অপর্ণা চা নিয়ে ওপরে এসে দেখলো, সৌমিক ঘর লাগোয়া বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাশের বাড়িটার ছাদের একটা অংশ এদিক থেকেও খানিকটা দেখা যাচ্ছে।। অপর্ণা চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালো, সৌমিক হাত বাড়িয়ে কাপ নিতে নিতে ওর দিকে তাকালো,

তোমার চা কই?

অপর্ণা হাসলো

আমি এখন চা খাবো না। ওই বাড়িটা কাদের? কি সুন্দর ফুল গাছ লাগিয়েছে! বাড়িটার গাছ গুলো একটু ঝিমিয়ে পড়েছে, জল দেওয়া হয়নি বোধহয় কদিন!

সৌমিক ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললো,

ওরা বাড়িতে নেই!

ইসস! যদি একটু জল দেওয়া যেতো, গাছগুলো তো মরে যাবে!

নিজের মনেই কথাগুলো বললো অপর্ণা, হটাৎ করেই সৌমিকের গলা কেমন যেনো কর্কশ হয়ে গেলো,

ওই ভাবনাটা ওই বাড়ির লোকদেরই ভাবতে দাও! তুমি আমি ভেবে কি করবো!

কথাগুলো বলেই আচমকা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো সৌমিক, অপর্ণা মনে মনেই একটু অবাক হলো! ও যে সৌমিকের বিরক্ত হওয়ার মতো কি এমন বললো ও নিজেই ভেবে পাচ্ছিলো না! জায়গাটা কলকাতা হলেও গাছ গাছালি ঘেরা এই অঞ্চলটা অনেকটা পরিকল্পনা করে বানানো, পর পর প্লট করে বানানো পাশা পাশি বাড়ি গুলোর প্রত্যেকটার মধ্যে নির্দিষ্ট দুরত্ব রেখে তৈরি করা। এই কদিনেই জায়গাটা বেশ ভালো লেগে গিয়েছে অপর্ণার। সৌমিক ঘরে ঢুকে যাওয়ার পরে ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশে পাশে তাকিয়ে দেখছিলো, এতো সকালে রাস্তায় লোক চলাচল যথেষ্টই কম।

এটা তো তোমার দায়িত্ব ছিলো! ওকে দিয়ে চা করানোর আগে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো নি কেন?

নিচের থেকে আসা শাশুড়ির তীক্ষ্ণ আওয়াজে অপর্ণা দ্রুত ঘরে ঢুকে এসে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। নিচে এসে দেখলো, টেবিলে সবাই চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে, আর অনিন্দিতা মাথা নিচু করে কিছু বলার চেষ্টা করছে!

অপর্ণা কিছু বলার আগেই ওর শাশুড়ি অনিন্দিতার দিকে তাকালেন,

কি বললাম তোমাকে? উত্তর দিলে না!

অনিন্দিতা কে করা প্রশ্ন অপর্ণা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনতে পেয়েছিলো তাই অনিন্দিতা কিছু বলার আগেই বললো,

আমিই আসলে জোর করে সবার চা করতে চেয়েছিলাম, দিদিভাই বারণ করেছিলো, ওর কোনো দোষ নেই!

এবার রীনা ওর দিকে ফিরে তাকালেন,

বারণ করেছিলো তাও তুমি শোনো নি! কেনো? আমি কি তোমাকে চা করতে বলেছি? তুমি যেকোনো দিন এখান থেকে চলে যাবে, তাই এখনই কোনো দায়িত্ব তো দিইনি তোমাকে! এখানে প্রত্যেকের দায়িত্ব আলাদা, কেউ কারোর কাজ করে দেয় না! যখন তোমাকে কিছু দায়িত্ব দেবো তখন সেটা করবে, আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাবে না কখনো!

অপর্ণার মুখে কালো ছায়া পড়লো, ওর ভাসুর ঋষি চায়ের কাপ রেখে টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে সেদিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,

অপর্ণা! মা একটু সব ব্যাপারেই কিছু সিস্টেম মেনে চলেন! তুমিও কদিন থাকলেই বুঝে যাবে সব টা! তখন আর অসুবিধা হবে না!

অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, একটা সাধারণ চা করতে গেলেও যে অনুমতির দরকার পড়ে সেটা তার জানা ছিলো না আগে! বরাবরের স্বাধীনচেতা অপর্ণার কাছে এরকম কথার উত্তরে মুখ বন্ধ রাখা খুব শক্ত কিন্তু মায়ের মানিয়ে চলার আপ্তবাক্য মনে রেখে সে নিজেকে সংযত করলো, তাকে আবার ওপরে উঠে যেতে দেখেই মাসি শাশুড়ি পরিস্থিতি সামলানোর জন্যে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,

অপর্ণা চা টা খুব ভালো খেতে হয়েছে! তুমি কিন্তু সত্যি খুব ভালো চা করো!

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে যেতে অপর্ণা মৃদু হাসলো, তার সেই হাসির মধ্যে কোনো প্রাণ ছিলো না। অনিন্দিতার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছিলো সেও অপর্ণার পেছন পেছন উঠে গেলো, দুই বউ কে উঠে যেতে দেখে অপর্ণার মাসি শাশুড়ি বোনের দিকে তাকালেন, চাপা গলায় বললেন,

তোকে কতোবার বলেছি নিজেকে একটু সংযত কর! ঋজু আর ঋষির মধ্যে যে অনেক ফারাক আছে সেটা তুই ভালোই জানিস! বজ্র আঁটুনি দিতে গেলে ফস্কা গেরো হয়ে যাবে সেটা বোঝ! ঋজু ঋষির মতো নয়, কখনো বউয়ের সামনেই তোকে কিছু বলে দেবে তখন ঐ বউ আর তোর একটা কথাও শুনবে না!

রীনা চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন,

তাই বলে খারাপ কে খারাপ বলা যাবে না! একে তো কথার অবাধ্য তার ওপরে সকালে এই জঘন্য চা, মুড টাই বিগড়ে গেলো একদম! আর ঋজু র ভয়ে চুপ করে থাকতে গেলে তো অনিন্দিতাও হাত থেকে বেরিয়ে যাবে! এখনই তো শক্ত করে ধরার সময়, এর পরে আর কথা শোনানো যাবে বলে তোর মনে হয়? আজকাল তো আর আগেকার সময় নয় যে ছোটো মেয়েকে গড়েপিটে নেবো, এখন সব তৈরি হয়েই আসে! আমার বাড়িতে এসে নিজে নিজেই চা করে নিলো, একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না! কি সাহস!

সকালের দিকে সবার তাড়া থাকে, সৌমিকও আজ অফিসে জয়েন করলো, তাই এই প্রসঙ্গ বেশিক্ষন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সময় কারো কাছে ছিলো না। সবাই অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে একটু বেলার দিকে রত্না এলো, মায়ের কাছে আগে থেকেই সে অপর্ণার ফিরে আসার খবর শুনে ছিলো তাই তাকেই দরজা খুলতে দেখে খুব বেশি অবাক হলো না। অপর্ণা কে দেখে সে হাসলো,

মায়ের কাছে শুনেছি তুমি ফিরে এসেছো! খুব ভালো করেছো, আমিও মাকে বলছিলাম আজকাল কেউ এসবে বিশ্বাস করে না! মা আসলে এতগুলো ঘটনা পর পর ঘটায় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে! যা হয় আর কি! বয়স হয়েছে তো সবাই কে নিয়ে খুব চিন্তা করে! মা আসলে কিন্তু তোমাদের ভালোর কথা ভেবেই সবটা করেছিলো, তোমরা যাতে ভালো থাকো সেটাই আমাদের সবার চাওয়া!

রত্নার আন্তরিক কথায় অপর্ণার অস্বস্তি অনেকটাই চলে গেলো, সংসার জীবনের ঘোরপ্যাঁচ না বোঝা অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

জানি দিদি, কিন্তু হটাৎ করেই একটা এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো না যে চলে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না! আমিও তো মায়ের কথা মেনে থেকে যাওয়ার চেষ্টাই করেছিলাম!

রত্না কৌতুহলী হলো, সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো,

হ্যাঁ, তাই শুনলাম মায়ের কাছে! মাও বলছিলো ভাই নাকি বলেছে নিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না! কি হয়েছিলো গো?

অপর্ণা হাসলো,

আর বোলো না! ওখানে একটা গুন্ডা মতো ছেলে আছে! বিয়ের আগে আমাকে খুব বিরক্ত করতো! তোমার ভাই কে যখন ট্রেনে তুলতে আসছিলাম তখন ওর সাথে দেখা হলো, তোমার ভাইয়ের সামনেই আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলছিলো, তাই তোমার ভাই আমাকে রেখে আসতে চাইলো না! আসলে ওর মনে হচ্ছিলো আমাকে একা পেয়ে যদি ও আরো কিছু বদমাইশি করে!

রত্না মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, ইতিমধ্যেই মেয়ের গলার আওয়াজে রীনা আর তাঁর দিদি দুজনেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন, অপর্ণার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রীনা তীর্যক গলায় বললেন,

এতদিন ধরে ওখানে আছো, সেই ছেলে তোমার কোনো ক্ষতি করলো না, আর দুটো মাস বেশি থাকলেই ক্ষতি করে দিতো! আর ভদ্রলোকদের বাড়ির মেয়েদেরকে যে কোনো গুন্ডা বিরক্ত করে এসব তো কখনো শুনি নি! আমার মেয়েও তো কলকাতার মতো জায়গায় বড়ো হয়েছে তাও তো এসব সমস্যা কখনো আসে নি!

অপর্ণা একটু থতমত খেলো, সংসারের জটিলতা না বুঝলেও এটুকু বুঝলো যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া জরুরি নয়, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

সেটা ঠিক বলেছেন! ও হয়ত কিছুই করতো না, আর ওরকম অসভ্য ছেলেদের নিয়েই তো আমরা এতকাল কাটিয়েছি, কিন্তু আপনার ছেলে সেটা বিশ্বাস করলো না! ও জোর করে নিয়ে এলো!

অপর্ণার মাসি শাশুড়ি পাশের সোফায় বসলেন, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,

সেতো ঠিকই! ঋজু কে তো ছোটো থেকে দেখছি, ওর নিজের ইচ্ছে না থাকলে ও কখনো তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো না, এতে তোমার কোনো দোষ নেই। তবে কি বলতো ও তো এখনো ছেলে মানুষ তাই সব ব্যাপারেই একটু জেদ দেখিয়ে ফেলে, তাই তোমাকেই সতর্ক থাকতে হবে! ঋজুর সব কথায় তাল না দিয়ে রীনা যেগুলো বলবে সেগুলো মেনে চলবে দেখবে তোমার এখানে কোনো অসুবিধা হবে না।

অপর্ণা আর কথা বাড়ালো না, সে যতক্ষন এখানে থাকবে ততক্ষণ যে এই আলোচনাই চলবে সেটা বুঝতে পেরেই ওখান থেকে উঠে গেলো। অপর্ণা চলে গেলেও প্রসঙ্গ কিন্তু বদলালো না, বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পরে ওখানে উপস্থিত সবাই একমত হলো যে অপর্ণার ইন্ধন না থাকলে কোনো ছেলের পক্ষে তাকে বিরক্ত করা কখনোই সম্ভব ছিলো না! সারাদিন ধরে চলতে থাকা এই আলোচনার টুকরো টুকরো কথা অপর্ণার কানেও পৌঁছালো যদিও তাতে উপস্থিত কারোরই কোনো হেলদোল হলো না।

সৌমিক অফিস থেকে ফিরে আসার পরে চায়ের টেবিলে বসে এই আলোচনা নতুন করে শুরু হলো, রত্না নিচু গলায় বললো,

ভাই! অপর্ণা কে তোর ফিরিয়ে আনার কারণ শুনলাম রে! আমার তো ভয়েই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে শুনে! মা তো ভীষণ চিন্তা করছে, বলছে তুই তো আবার ওকে পৌঁছে দিতে যাবি, নিয়ে আসতেও হবে তোকেই তোর যদি কোনো বিপদ হয়! তার থেকে বল না ওর মাকে যদি উনিই নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন!

সৌমিক অবাক হলো,

ওর মা কি করে ব্যবস্থা করবেন! ওর বাবা তো অসুস্থ! আর তার তো এখন অনেক দেরি আছে, তার মধ্যে এমনই ওই ছেলেটা ঠিক হয়ে যাবে, আমি রবি কে বলে দিয়েছি।

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

এর মধ্যে আবার রবি কেনো? তুমি এতো বুদ্ধিমান কিন্তু মাঝে মাঝেই একটা এমন বোকামি করে ফেল না! বাড়ির বউ তার ব্যাপারে এই সব কথা জানাজানি হলে কি আমাদের সম্মান বাড়বে? সত্যি অদ্ভুত লাগছে, এই বিয়েটার শুরু থেকেই যেনো একটার পর একটা গন্ডগোল হয়ে চলেছে! এসব কি কাউকে বলবার মতো বিষয়! ভদ্রঘরের মেয়ে, তাকে কিনা গুন্ডার ভয়ে বাপের বাড়িতে রেখে আসা যাচ্ছে না!

সৌমিক উত্তর না দিয়ে উঠে পড়লো, কিছুক্ষন পরে সে বেরিয়ে যাওয়ার পরে অপর্ণা নিজের ঘরের জানলায় জলভরা চোখে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার বলা সাধারণ একটা কথা যে এতটা অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিলো না।

নতুন বউয়ের চোখে জল কেনো? বাড়ির জন্যে মন খারাপ নাকি শাশুড়ির কাছে বকুনি?

অপর্ণা চমকে তাকালো, এতক্ষনে লক্ষ্য করলো, পাশের বাড়ির ছাতের দরজাটা খোলা, সেখান দিয়ে আলো এসে পড়েছে ছাতে। সেই আলোয় একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, সে আলসে তে হেলান দিয়ে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে অপর্ণার দিকে। অপর্ণা একটু থতমত খেলো, তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললো,

কই নাতো! কিছু হয়নি তো!

মেয়েটা হাসলো,

উঁহু! না বললে তো হবে না! এখান থেকে তোমার ঘরের ভেতরে স্পষ্ট দেখা যায়! তোমার চোখে জল দেখতে পাচ্ছি কিন্তু! তোমার শাশুড়ির যা গলা সেতো আমাদের বাড়ি থেকেই শুনতে পাচ্ছি! পাড়ায় সবাই জানে উনি ওনার বড়ো বউ কে কিভাবে রাখেন!

একদম অচেনা কারোর সঙ্গে শাশুড়ির নিন্দে করা যে তার শোভা পায়না সেটা বুদ্ধিমতি অপর্ণার জানা ছিলো, সে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,

আপনি কি এই বাড়িতে থাকেন? আগে দেখিনি তো, সকালেও তো বন্ধ দেখলাম! আপনার নাম?

মেয়েটা হাসলো,

থাকতাম, এখন দিল্লী তে থাকি! আমার বাবা, মা থাকে এখানে! এই তুমি আমাকে তুমি বলবে বুঝলে! আপনি শুনতে একটুও ভালো লাগে না! আমার নাম পারমিতা, তুমি মিতাদি বলে ডাকতে পারো!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১২
দেখতে দেখতে প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেলো, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে অপর্ণা পরীক্ষা দিতে রসুলপুরে ফিরে যাবে এই রকমই শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো। অপর্ণার ফিরে যাওয়া নিয়ে সৌমিক এবং তার মায়ের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন জেদাজেদি অপর্ণার চোখ এড়ায়নি, কিন্তু রীনার হাজার বিরক্তি এবং জেদ সত্বেও সৌমিক তার নিজের জায়গায় অটল ছিলো। দিন কয়েক এই পরিস্থিতি চলার পরে অপর্ণা একটা সময় নিজেই ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলো, প্রতিদিন সৌমিক অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বাড়িতে যে একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিলো, এবং আগামী তে কোনো বিপদ বা সমস্যা দেখা দিলে তার দায়ভার যে অপর্ণার ওপরেই আসবে এটা বুঝে অপর্ণা মনমরা হয়ে ছিলো।

রীনা অপর্ণাকে রান্নাঘরে ঢোকার অনুমতি দেন নি, ফলে টুকটাক এর ওর ফরমাস খাটা ছাড়া সারাদিন অপর্ণার কিছু করার থাকতো না, কিন্তু তাই বলে যে সে নিজের ঘরে বসে থাকবে এই অনুমতিও তার ছিলো না। এই কদিনে অপর্ণা কোনো বিশেষ দায়িত্ব পায়নি, যাদের যখন যখন কিছু প্রয়োজন হয়েছে তখন তখন সেখানে অপর্ণা কে হাত লাগাতে হয়েছে। তবে মাসি শাশুড়ির কথা মনে রেখে অপর্ণা চুপচাপই থেকেছে ফলে নতুন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি।

অপর্ণা ফিরে আসার দিন কয়েক পরে মাসী শাশুড়ি চলে গেলেন, ফলে বাড়ি আরো খালি হয়ে গেলো। দুপুরের দিকটা বাড়ি একদম ফাঁকা থাকে, নিচের তলায় শ্বশুর, শাশুড়ি এবং দোতলায় অপর্ণা আর অনিন্দিতা! খুব ভোরে উঠতে হয় বলে এই সময়টা অনিন্দিতা ঘুমিয়ে পড়ে, অপর্ণাও তখন বই নিয়ে পড়তে বসে! খেয়ে দেয়ে ওপরে এসে অপর্ণা পায়ের দিকের জানলাটা খোলে, এখন দুপুরের দিকে এদিকের জানলায় কোনো রোদ থাকে না!

আজও জানলাটা খুলে রেখেই খাটের একধারে বই পত্র ছড়িয়ে বসেছিলো অপর্ণা, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি দ্রুত সেরে নিচ্ছিলো। সকালের দিকটা একদমই সময় পায়না, বিশেষ কিছু কাজ না থাকলেও তাকে নিচেই বসে থাকতে হয়, তাই এই সময়টা কেই ভীষণ ভাবে কাজে লাগায় ও।

কি গো কেমন আছো?

অপর্ণা চমকে উঠে জানলা দিয়ে তাকালো, পেছনের ছাতে সেদিনের দেখা মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে! সেদিনের পর থেকে ওদিকের ছাদে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখেনি ও, নিজেকে সামলে নিয়ে অপর্ণা ঘাড় নাড়লো,

ভালো আছি, আপনি ছিলেন না নাকি? সেদিনের পর থেকে আর দেখলাম না তো?

মেয়েটা একদম গায়ে গায়ে লাগানো অপর্ণার ঘরের জানলার দিকে এগিয়ে এলো, নিজেদের ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো,

আবার আপনি! বলেছি না তুমি বলবে! তুমি আমার থেকে অনেক ছোটো, আমি আর ঋজু বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম! একসঙ্গে খেলেছি, একসঙ্গে পড়েছি, একসঙ্গে বড়ো হয়েছি! বলতে গেলে সব কিছুই একসঙ্গেই ছোটো থেকে!

অপর্ণা একটু অবাক হলো, এতো যার সঙ্গে সৌমিকের বন্ধুত্ব তাকে তো বিয়েতে দেখতে পেলো না একবারও! নিজের অবাক হওয়া গোপন না রেখে ও সরাসরি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে ফেললো সে কথা,

তাই নাকি! কিন্তু তোমাকে তো বিয়ের সময় দেখতে পেলাম না একবারও, বন্ধুর বিয়েতে এলেনা?

মেয়েটা নিজের মুখটা আরো এগিয়ে নিয়ে এলো,

না গো! বললাম না আমি এখন দিল্লিতে থাকি! বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে কিছুদিন যাবৎ, তাই মা আর বাবা আমার কাছে গিয়েছিলো ওখানে চিকিৎসার জন্যে! বিয়ের সময় ছিল না কেউ এখানে, তাই তোমার বিয়েতে আসতে পারে নি, নাহলে বাবা মা অবশ্যই যেতো!

অপর্ণাও খাট থেকে নেমে জানলার সামনে এগিয়ে এসে গ্রীলে মুখ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো,

ও আচ্ছা! কিন্তু তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? সেদিনের পর থেকে আর দেখিনি তোমাকে!

মিতা হাসলো,

অফিস কাছারি নেই নাকি! বাড়িতে বসে থাকলে এমনি এমনি মাইনে দেবে! আমি তো দিল্লী ফিরে গিয়েছিলাম তার পরের দিনই, বাবা মাকে পৌঁছে দিতে এসেছিলাম এখানে!

অপর্ণাও হেসে ফেললো,

এ বাবা! তুমি এতদিন ছিলেই না এখানে! আমি তো বুঝতেই পারিনি! কবে এলে?

এই তো কালই! বাবার শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না, কতোবার করে বলছি আমার ওখানে এসে থাকতে তাও থাকবে না! মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এখানে তো দেখার কেউ নেই তাই আমাকেই ছুটে ছুটে আসতে হয়! এদিকে বাবা ওদিকে অফিস কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি বলো তো!

অপর্ণার নিজের বাবার কথা মনে হলো, তারও তো একই অবস্থা! মা যদি শক্ত না হতো তাহলে সেকি ছোটাছুটি করতে পারতো! অপর্ণা কে চুপ করে থাকতে দেখে মিতা অবাক হলো,

কি ভাবছো?

অপর্ণা নিজেকে সামলে নিলো,

কিছু না! তোমার কথা শুনে আমার বাবার কথা মনে হলো, বাবাও খুব অসুস্থ জানো তো! তুমি তবু দায়িত্ব নিয়ে করছো, আমার এরকম হলে কি হবে কে জানে!

মিতা হাসলো,

যার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছে সে খুব দায়িত্ব বান ছেলে, তোমার বাবার কিছু সমস্যা হলে ঋজুই সব দায়িত্ব নিয়ে নেবে তোমাকে কিছু ভাবতেই হবে না! সমস্যা তো আমার, আমার কেউ নেই!

অপর্ণা হাসলো, বরাভয়ের ভঙ্গিতে বললো,

একটু আগেই যে বলছিলে ঋজু তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো! তাহলে তোমার বাবার দায়িত্ব সে নেবে না এটা তুমি কি করে ভাবলে! আর আমিও তো আছি এখন, তোমার বাবা তো আমারও বাবার মতনই, যেকোনো বিপদে ফোন কোরো আমাকে! আমার নম্বরটা সেভ করে রাখো!

মিতা নম্বরটা সেভ করতে করতে বললো,

অপর্ণা! তুমি খুব ভালো মেয়ে, আর ভালোদের সঙ্গে সব কিছু ভালো হয়। তুমি খুব লাকি ঋজুর মতো হাসব্যান্ড পেয়েছো! ও একদম আলাদা, ওদের বাড়ির অন্যদের মতো নয়!

অপর্ণা অবাক হলো,

তুমি আমার নাম জানলে কি করে?

মিতা হেসে ফেললো,

তুমি একদম দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারো না, বড্ড বেশি সরল! আরে বাবা ঋজু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল মানেই তো রবিও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই না? রবি বলেছে! বুঝতে পারছো এবার?

সত্যি তো! নিজের বোকামির কথা ভেবে অপর্ণা হেসে ফেললো, লজ্জিত গলায় বললো,

সত্যি গো! আমি একদম তলিয়ে ভাবিনি সবটা! সৌমিক কে বলছিলাম, তোমাকেও সেদিনই বলবো ভেবেছিলাম বলা হয়নি, তোমাদের ছাদের গাছগুলো খুব সুন্দর!

মিতা অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

থ্যাংক ইউ! কিন্তু এর মধ্যে অনেকগুলো মরে গেছে! মাঝে কিছুদিন জল দেওয়া হয়নি তো তাই!

হ্যাঁ, ছিলে না তো! আমিই বলছিলাম যে গাছগুলো মরে যাচ্ছে! সৌমিক বলেছিলো তোমরা এখানে নেই!

অপর্ণার কথায় মিতা কৌতূহলী হলো,

তাই! ঋজু বলেছে তোমাকে? আর কি কি বলেছে ঋজু?

অপর্ণা একটু অবাক হলো,

আর কিছু তো বলেনি! কেনো আর কিছু বলার ছিলো বুঝি?

অপর্ণার মনে হলো মিতা যেনো তাড়াতাড়ি কথা ঘোরালো, মুচকি হেসে বললো,

তুমি তো বেশ ভালো দেখতে গো, পছন্দ করলো কে? ঋজু নাকি?

অপর্ণা হেসে ফেললো, মাথা নেড়ে বললো,

না, না সবাই গিয়েছিলো তো! কিন্তু তুমি বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে বললে কেনো? এখন আর নও নাকি?

নিচের দিক থেকে এক মহিলা কণ্ঠের ডাক শোনা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিতা হটাৎ করেই কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো,

চলি এখন মা ডাকছে আমাকে! আবার পরে কথা হবে! ঋজু কে বলো আমি নিজেই তোমার সঙ্গে আলাপ করে নিয়েছি!

মিতা ছাদের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢোকার সময় পর্যন্ত অপর্ণা তাকিয়ে রইলো, তারপরে বই খুলে বসলো নতুন করে।দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, কিছুক্ষন পরেই নিচে বেলের আওয়াজ হলো, অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো, নিশ্চয়ই মিনতি মাসি এসেছে! ওকে দরজা খুলতে দেখেই মিনতি গলা নামালো,

তুমি ওই পাশের বাড়ির মিতার সঙ্গে কি গল্প করছিলে ছোটো বউ মা? ওর সঙ্গে কথা বলো না বেশি, দিদি রাগ করবে!

অপর্ণা অবাক হলো,

কেনো গো! পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না!

মিনতি ঝাঁটা হাতে তুলে নিয়ে দোতলার দিকে হাঁটা লাগালো,

ওপরে চলো বলছি!

অপর্ণা পা তুলে খাটে বসলো, মিনতি ঝাঁটা হাতে ধরেই পাশের বাড়ির দিকে ইশারা করলো,

এ বাড়ির সঙ্গে ও বাড়ির মুখ দেখাদেখি বন্ধ একদম! ওই মিতা কে দিদির একটুও পছন্দ নয়! বড্ড চ্যাটাং চ্যাটাং কথা মেয়েটার!

অপর্ণা অবাক হলো,

সেকি গো! আমার তো বেশ ভালই লাগলো, এই যে বললো ও নাকি ঋজুর বেস্ট ফ্রেন্ড!

মিনতি মুখ বেঁকিয়ে হাসল,

সে বলে দিলেই হলো, বলতে আর কে আটকাচ্ছে! ঋজু তো কথাই বলে না ওর সঙ্গে!

অপর্ণা একটু চমকে গেলো, মনে মনেই ভাবলো সৌমিক কে জিজ্ঞেস করবে ফিরলে! সৌমিক এর ফিরতে একটু রাত হয়, ওর ব্যাংকের ব্রাঞ্চ বেশ দূরে, শাশুড়ির মুখে শুনেছে ও নাকি চেষ্টা করছে কাছাকাছি আসার! মিনতি ঘর ঝাঁট দিয়ে চলে যাওয়ার পরেও ওখানেই বসে ছিলো অপর্ণা, বেশ কিছুক্ষন পরে সৌমিক অফিস থেকে ফিরে এলো, ঘরে ঢুকেই মিতাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

এই জানলাটা খুলে রেখেছো কেনো! বলেছি না এটা আমি খুলি না!

অপর্ণা অবাক হলো,

কিন্তু তুমি তো বলেছিলে চোখে সকালে রোদ লাগে তাই! এখন তো সন্ধ্যে বেলা এখন খুললে কি অসুবিধা! আর জানতো ভাগ্যিস খুললাম নাহলে তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপই হতো না!

সৌমিক ব্যাগ নামিয়ে রেখে সবে মাত্র সোফায় বসেছিলো, চমকে তাকিয়ে বললো,

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! কে? কার কথা বলছো?

অপর্ণা হাসলো,

কেনো মিতাদি! তোমার বন্ধু নিজেই বললো সব, বললো তোমাকে জানিয়ে দিতে যে আমাদের আলাপ হয়ে গেছে!

সৌমিক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

তোমার মিতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে! ও নিজে থেকে কথা বললো!

অপর্ণা হাসলো, জানলার দিকে ইশারা করে বললো,

হ্যাঁ, ওই দিকের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলো, বললো এখন নাকি দিল্লিতে থাকে! আচ্ছা তোমরা নাকি ওদের সঙ্গে কথা বলো না, মায়ের সঙ্গে নাকি রাগারাগি হয়েছে তাই! মিনতি মাসি বললো!

সৌমিক কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, নিজেই এগিয়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসে বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

বৌদি কি চা করেছে? একটু ওপরে নিয়ে এসো তাহলে! মাথাটা খুব ধরেছে, নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না!

অপর্ণা লজ্জিত হলো, ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,

এমা! তোমার মাথা ধরেছে, আর আমি তখন থেকে বকে যাচ্ছি! তুমি বাথরুমে যাও আমি এক্ষুনি চা নিয়ে আসছি!

অপর্ণা দ্রুত নিচে নেমে এলো, এবাড়ির নিয়ম মতো অনিন্দিতার করা চা রান্নাঘরে ফ্লাস্ক এ রাখা ছিলো। ইচ্ছে থাকলেও নতুন করে চা করার কোনো উপায় না থাকায় সেই চা কাপে ঢেলে ট্রে হাতে বেরোনোর সময় অপর্ণা রীনার মুখোমুখি হলো, তিনি অপর্ণা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

আমাদের বাড়িতে চা সবাই এক সঙ্গে নিচে বসে খায়, এটা তোমাকে আগেও বলেছি! ঋজু কে নিচে আসতে বলো!

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

জানি! কিন্তু ও বললো ওপরে নিয়ে আসতে, ওর মাথা ধরেছে তাই নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না!

রীনার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো,

তাই নাকি! দিয়ে এসো তাহলে! এক মিনিট! একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে! তোমার সঙ্গে পাশের বাড়ির মিতার আলাপ হলো কি করে? কে পরিচয় করালো?

অপর্ণা থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বললো,

কেউ করায় নি! ও নিজে থেকেই কথা বললো! আমি ঘরে বসেছিলাম, তখন ছাদ থেকে ডাকলো!

রীনা মিনতির দিকে তাকালেন,

কাল ওবাড়ির কাজের মাসীর সঙ্গে দেখা হলে বলে দিও আমার বউয়ের সঙ্গে যেনো ভবিষ্যতে কোনো কথা না বলে! সারা জীবনের গায়ে পড়া লোকজন সব! বেছে বেছে আমার পাশেই জমি কিনে থাকতে হলো!

রীনা আরো কিছু বলছিলেন মিনতিকে, অপর্ণা দাঁড়ালো না, কাপের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। ওপরে উঠে এসে দেখলো সৌমিক বাথরুম থেকে বেরিয়ে খাটে এসে বসেছে, ট্রে টা নামিয়ে রেখে অপর্ণা বেরিয়ে যাচ্ছিলো সৌমিক হাত দেখালো, খাটের সামনেটা দেখিয়ে বললো,

বোসো!

অপর্ণা খাটে হেলান দিয়ে সৌমিকের মুখোমুখি বসে পড়লো, সৌমিক চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলো,

একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে!

অপর্ণার খারাপ লাগলো, মনে পড়লো মিনতি বলেছিলো সৌমিক ঠান্ডা চা খেতে পারেনা। ও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো,

দাঁড়াও আমি আরেক কাপ করে নিয়ে আসছি! আসলে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেরি হয়ে গেলো!

সৌমিক মাথা নাড়লো,

থাক, লাগবে না! এমনিতেও খেতে ইচ্ছে করছে না! মা কি বলছিলো? কিছু নিয়ে রাগারাগি করছে মনে হলো?

অপর্ণা একটু চুপ করে থেকে বললো,

হ্যাঁ, ওই তোমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা নিয়ে বিরক্ত হয়েছেন! উনি চাননা আমি ওর সঙ্গে কথা বলি! আমি নিজে থেকে কথা বলিনি, ওই আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলো। ও তো আমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি তাহলে তোমার মায়ের পছন্দ নয় বলে আমি কথা বলবো না কেনো? আমার কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে ওকে, আমি যদি কথা বলি তাহলে কি তুমি রাগ করবে?

সৌমিক চায়ের কাপটা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো,

তোমার ইচ্ছে হলে বলবে, তাতে আমার রাগের কি আছে! আলোটা নিভিয়ে দাও, মাথাটা খুব ব্যাথা করছে!

আলো নিভিয়ে দিয়ে অপর্ণা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি হচ্ছে! সৌমিক তো নিজেই ওকে বসতে বলেছিলো একটু আগে, তাহলে এখন আলো নিভিয়ে দিতে বললো কেনো! তাহলে কি মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে ও বিরক্তই হলো জোর করে মিতার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার জন্যে, নিজের মনেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে লাগলো বুদ্ধিমতি অপর্ণা।
ক্রমশ