ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-৭+৮+৯

0
156

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৭
সৌমিক যখন বাড়ি ফিরলো তখন সকাল হয়ে গেছে, মিনতির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা অপর্ণার,

ছোটো বৌমা! উঠে পড়, ঋজু এসে গেছে! আর তোমাকে বাইরে বসে থাকতে হবে না!

তাড়াতাড়ি উঠে জড়োসড়ো হয়ে এক পাশে দাঁড়ালো অপর্ণা, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিধ্বস্ত চেহারার সৌমিকের দিকে তাকিয়ে একটু খারাপ লাগলো, বেচারা সারারাত হাসপাতালে কাটিয়েছে! একটু পরেই শাশুড়ি বরণ ডালা নিয়ে বেরিয়ে এলেন, বরণ পর্ব অল্পের ওপর দিয়ে মিটে যাওয়ার পরে ঘরে ঢোকার ছাড়পত্র পেলো অপর্ণা।

ঘরে বসে থাকতে থাকতেই মিনতি এসে অপর্ণার হাতে জলখাবারের থালা ধরিয়ে দিয়ে গেলো, প্রায় সারারাত অভুক্ত অপর্ণার পেটে খাবার পড়তেই চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো, যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। চারিদিকে লোকজনের হৈ চৈ এর মধ্যে অপর্ণা তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই মাসি শাশুড়ি উঠে দাঁড়ালেন,

আহা! আজকের দিনে আবার ঘরের বাইরে বেরোলে কেনো! আজ তো কাল রাত্রি, ঋজু তো আসে পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, মুখোমুখি হয়ে যেতে পারো কখনো! আজ তুমি ঘরেই থাকো!

অপর্ণা একটু থতমত খেলো, সে ঘরে ঢোকার আগেই নিচু গলায় মাসি শাশুড়ির মন্তব্য শুনতে পেলো,

যা ঘটছে দুদিন থেকে! ওর ঘর থেকে না বেরোনোই ভালো! আবার ঋজুর মুখ দেখে আরো কোনো বড়ো বিপদ না ঘটে! কুষ্ঠী টা দেখিয়েছিলি রীনা বিয়ের আগে?

রীনা ঘাড় নাড়লেন,

না গো মেজদি! ঐটাই তো বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে! তাড়াহুডোতে আসল কাজটাই করা হয় নি আর!

অপর্ণা দাঁতে ঠোঁট চেপে ঘরে ঢুকে পড়লো, পরের দিন সকালের আগে আর ঘরের বাইরে পা দিলো না। বলা যায় না যদি সত্যি সৌমিকের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে তো দায় ওর ঘাড়েই পড়বে!

ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান একটু আগেই মিটে ছিলো অপর্ণার, সৌমিক কোনো রকমে বউয়ের হাতে থালা তুলে দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলো, ননদের মুখে শুনছিল তাকে নাকি হাসপাতালে যেতে হবে। আজ দুদিন ধরেই সৌমিকই তার বন্ধু কে নিয়ে বাবা কে দেখতে ছোটাছুটি করছে, বড়ো ভাসুরের যাওয়ার কথা শুনেছে মাত্র বার দুয়েক!

মনে মনেই একটু ক্ষুব্ধ হচ্ছিলো অপর্ণা, এতো লোকজন বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত, কেউ কি একটু যেতে পারে না! রত্নার বর রজত কেও দেখছে দুদিন ধরে, সে শুধু ঘুরছে, ফিরছে কিন্তু কোনো কাজে হাত লাগাচ্ছে না! নিজের মধ্যেই একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো অপর্ণার, ও সৌমিক কে নিয়ে এতো ভাবছে কেনো! ওকে সামনে দেখলেই বরং অস্বস্তি হয় অপর্ণার, একদিক থেকে ও থাকছে না সেটা ভালোই হয়েছে! আবার মনে হচ্ছে একটা মানুষ হিসেবেও তো তার কিছু রেস্ট পাওয়া উচিত, সেটুকু কি কেউ বুঝছে না! অপর্ণা চুপ করে বসে ভাবছিলো, এর মধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা চিৎকার করলেন,

কিরে ঋষি বউ কই তোর? এতো বড়ো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাকে তো এক মুহূর্তের জন্যেও চোখে দেখলাম না! কোথায় আছে সে? সেই থেকেই তো শুনছি রান্নাঘরে আছে, এখনও রান্নাঘর থেকে বেরোতে পারে নি নাকি?

ভদ্রমহিলার কথায় অপর্ণা অন্য মনস্ক ভাব কেটে বেরিয়ে এসে তাকালো, এই প্রথম ওর ভাসুর কে দেখলো ও! ঋষি মহিলার কথায় একটু অপ্রস্তুত হলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বললো,

না, না তা কেনো হবে? আছে কোথাও এদিক ওদিক! আছো তো এখন, দেখতে পাবে ঠিক!

রত্না সামনেই ছিলো গলায় উষ্মা এনে বললো,

তোমার কি কথার ছিরি কাকিমা! তাকে কি আমরা রান্না ঘরে আটকে রাখি নাকি?

মহিলা হটাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলেন,

কি জানি! তোদের বাড়ি তো আর অনুষ্ঠান ছাড়া কখনো আসা হয়না, না তোরা কখনো অনুষ্ঠান ছাড়া যাস কারো বাড়ি! যেটুকু দেখা সাক্ষাৎ সেতো এরকম কোনো অনুষ্ঠানেই হয়! এর আগে কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতেই তো তোদের সঙ্গে ওকে দেখিনি কখনো, আর ঋষির বিয়েতে আমি আসিনি। তাই আগে কখনো দেখিনি ওকে, আজও এসে থেকেই শুনছি ও রান্না ঘরে আছে, সেই জন্যেই বললাম! যদি জানতাম কথাটা এতোটা গায়ে লাগবে তোর, তাহলে বলতাম না!

রত্না ভীষণ বিরক্ত হলো,

তুমি যদি ঋষির বিয়েতে না আসতে পারো, সে দোষ কি আমাদের বলো! যারা এসেছে সবাই দেখেছে, আমরা তো তাকে আর লুকিয়ে রাখিনি কোথাও! তোমার যখন অতো ইচ্ছে, আমিই তাকে ডেকে দিচ্ছি, এতে এতো কথার কি আছে!

মহিলা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন,

না, বাবা থাক লাগবে না! তোরা এতো কথা ধরিস না, কোনো কথাকে সাধারণ হিসেবে নিতে জানিস না!

রাতে অপর্ণার বাড়ি থেকে যখন সবাই এসে পৌঁছালো ততোক্ষনে অনুষ্ঠান বাড়িতে বেশ ভীড় হয়ে গেছে, সবাই মোটামুটি সৌমিকের বাবার খবর জেনে গেছেন আগেই, তাঁরা বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন। মেয়ের বাড়ি থেকে তত্ত্ব হাতে ঢুকতে দেখে হৈ চৈ শুরু হলো, সবাই তত্ত্ব দেখতে উৎসাহী হলো সুপর্ণা তাঁর সাধ্য মতো জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন তত্ত্বতে ফলে অপর্ণার শাশুড়ির মুখের মধ্যে খুশির ছাপ স্পষ্ট হলো।

কিছুক্ষন পরে রত্না সুপর্ণার হাত ধরে অপর্ণার কাছে নিয়ে এলো,

দেখুন মাসীমা, আপনার মেয়েকে কেমন লাগছে?

অপর্ণা কে বাস্তবিকই সুন্দর লাগছিলো, সুপর্ণা মাথা নাড়লেন,

ভালো! দাদা এখন কেমন আছেন? কবে ছাড়বে হাসপাতাল থেকে? সুস্থ মানুষ কি উটকো বিপদ বলুন তো!

তাঁর পরের প্রশ্ন অপর্ণার শাশুড়ির উদ্দেশ্যে ছিলো, শাশুড়ি আঁচলে চোখের জল মুছে দীর্ঘ্শ্বাস ফেললেন,

সেই তো! ছেলের বিয়েতে কতো আনন্দ করবে ভেবেছিলো, কিছুই হলো না! উল্টে তাঁর জীবন নিয়েই টানাটানি! কি জানি কি যে হচ্ছে এসব, যবে থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে তবে থেকেই একটার পর একটা ঘটনা হয়েই চলেছে! এই সময় এতো বৃষ্টি কেউ দেখেছে কখনো! পুরুত মশাই কে বললাম, একটা স্বস্তি স্বস্তয়নের ব্যবস্থা করতে, এই বিয়েটা মিটে গেলেই করবো সব!

সুপর্ণা অস্বস্তিতে পড়লেন, অপর্ণা একটু অবাক চোখে তাকালো, তার ভাবনার মধ্যেই বাণী এগিয়ে এলেন,

এগুলো তো অ্যাকসিডেন্ট, যেকোনো সময় হতে পারে! এসব নিয়ে অতো ভাববেন না!

অপর্ণার ননদ রত্না মাথা নাড়লো, সে আগের দিনের বাণীর করা অপমান একটুও ভোলেনি, তাড়াতাড়ি বললো,

তাই নয় কিন্তু, আপনি নিজেই ভেবে দেখুন! এতদিন ধরে এসব কিছু হয়নি, আর বিয়ের সময় থেকেই সব শুরু হয়েছে! আসলে আমাদের একটু ভুল তো হয়েছে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সেই ভাবে মেয়ের কুষ্টি টা মেলানো হয়নি তখন! আমার মেজো মাসি বলছিলেন, অপর্ণার হয়ত কিছু দোষ আছে কুষ্টি তে!

বাণী এর উত্তরে বলতে যাচ্ছিলো,

তাড়াহুড়ো তো আপনারাই করলেন….

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিলেন,

দিদি! মেয়ের আমার কুষ্ঠি খুব ভালো, কোনো দোষ কখনো পাওয়া যায়নি! আপনি যাকে খুশি দেখিয়ে নেবেন, আর একটা পুজো করে নেবেন আপনার মনের মতো করে!

অপর্ণার শাশুড়ি রীনা গলা নামালেন,

কিছু সমস্যা তো আছে নিশ্চয়ই, না হলে বিয়েতে এতো বিভ্রাট কারো হয় বলুন তো! যাইহোক, ওসব ভেবে তো আর লাভ নেই এখন, কিভাবে এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেটাই দেখতে হবে। পাড়ার লোকের মুখ তো বন্ধ করা মুশকিল, তারা তো বউয়ের কথা বলবেই! পয়া, অপয়া বলেও তো কিছু হয়, সেটা নিশ্চয়ই আপনিও মানেন!

অপর্ণা চমকে উঠে মায়ের দিকে তাকালো, লক্ষ্য করলো মায়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে! সুপর্ণার মুখ অপমানে থমথম করছিলো, বাণী কিছু বলবে বলেই ভাবছিলেন, সুপর্ণা তাড়াতাড়ি ভাই বউ কে সামলে নিলেন, মেয়ের শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

জানি দিদি, পর পর অনেকগুলো ঘটনা একসাথে ঘটে গিয়েছে, কিন্তু তাতে আমার মেয়ের কোনো দোষ নেই, এটুকু ভরসা রাখতে পারেন! আজ পর্যন্ত ওর জন্যে এমন কারো কোনো ক্ষতি হয়নি যাতে আমার মেয়ে অপয়া এটা বলা যায়! হটাৎ করেই দাদার এরকম হলো তাই হয়ত আপনাদের এসব মনে হচ্ছে কিন্তু দেখবেন এগুলো সাময়িক, কদিন পরেই সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে!

অপর্ণার শাশুড়ির মুখ শক্ত হলো, সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন,

সেই! সব ভালো তার শেষ ভালো যার! শেষ পর্যন্ত ভালো হলেই তো ভালো, আমরাও তো তাই চাই! নিজের ছেলের ভালো থাকা ছাড়া কোনো মা আর কিই বা চাইতে পারে বলুন! তবে ভালো তো আর ইচ্ছে করলেই থাকা যায় না, কিছুটা মেয়েদের ভাগ্যের ওপরেই নির্ভর করে! দেখা যাক আপনার মেয়ের ভাগ্য আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যায়! অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদেরই বা কি করার আছে! তাই না?

ভদ্রমহিলার কথা শুনে বাণী বা সুপর্ণা কেউ কোনো সমর্থন জানালেন না দেখে ভদ্রমহিলা একটু অস্বস্তিতে পড়লেন। এগিয়ে এসে অপর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,

মন খারাপ কোরো না বুঝলে, কতো আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শী আসবে, কতো কথা হবে, সবার মুখ তো আর বন্ধ রাখতে পারবো না! ওসব পয়া, অপয়া জানিনা, তবে শুধু এটুকু জানি বিয়ে যখন একবার হয়ে গেছে তখন তো আর ওসব বিচার করে এখন বউ কে ফেরত দিয়ে আসতে পারবো না, তার চেয়ে বরং একটা পুজো করে নেবো, পুরোহিত মশাই নিশ্চয় কিছু পথ বলে দেবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে!

অপর্ণা চোখের জল লুকিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো, সুপর্ণা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আরো দু একটা কথার পরে মহিলা অন্য দিকে চলে গেলেন, তিনি চলে যেতেই আশে পাশে খুব বেশি লোকের উপস্থিতি নেই দেখে সুপর্ণা মেয়ের সামনে এগিয়ে এলেন,

ওরা তোকে কিছু বলেছে নাকি? ওদের আত্মীয় স্বজন?

অভিমানে অপর্ণার চোখে জল আসছিলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

নাহ! কেউ কিছু বলেনি! আর বললেও তোমার কিছু জানার দরকার নেই! আমার বিয়ে হয়ে গেছে আর তো তোমার কোনো সমস্যা থাকলো না, এবার আমি বাঁচলাম কি মরলাম তোমার আর দেখার দরকার নেই!

সুপর্ণার মুখে কালো ছায়া পড়লো, ননদের মুখ দেখে বাণী এগিয়ে এলো,

ছিঃ বাবু! এই ভাবে মায়ের সঙ্গে কেউ কথা বলে! মা কি তোর খারাপ চেয়ে এসব করেছে! আর এসব কি কথা, বাঁচা, মরার কথা আসছে কেনো এখানে? বিয়ে কি কেউ মরার জন্যে দেয় নাকি, বিয়ে দেয় ভালো থাকার জন্যে!

হ্যাঁ! সেই তো! সেই জন্যেই তো সারারাত ছেলে বাড়িতে নেই, বরণ হলো না বলে আমিও ঢুকতে পারলাম না। এই ঠান্ডায় ভিজে কাপড়ে বাইরের প্যান্ডেলের চেয়ারে বসে ছিলাম! অসুস্থ হয়ে মরলে তবে তোমাদের শান্তি হতো!

ভাঙা গলায় উত্তর দিলো অপর্ণা, বাণী চমকে তাকালো,

এ আবার কি! বরণ হলো না বলে শীতের রাতে বাইরের প্যান্ডেলে বসে থাকতে হবে! ছিঃ! সত্যি এটা তো খুব খারাপ দিদি!

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি ভাই বউয়ের হাত ধরে ফেললেন,

বাণী তুমি চুপ করো, ওর তালে আর তাল দিও না! ওরকম কতো ছোটো খাটো ব্যাপার হয়, আমার তোমারও হয়েছে, ওসব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়! একটু ধৈর্য্য ধরতে হয় এসবে!

বাণী বিরক্ত হলো,

কি বলছো দিদি! তোমার মেয়ে ঠান্ডায় সারারাত বাইরে বসে থাকলো, আর তুমি কিছু বলবে না! অদ্ভুত তো! আমার মেয়ে হলে কিন্তু ছাড়তাম না!

সুপর্ণা উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই অপর্ণার ননদ রত্না ফিরে এলো,

চলুন মাসিমা, খেয়ে নেবেন! রাত অনেক হয়েছে!

সুপর্ণা বাণীর হাতে চাপ দিলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ যাচ্ছি! তোমার মা কই? একটু অষ্ট মঙ্গলায় যাবার ব্যাপারে কথা বলতাম!

রত্না মাথা নাড়লো,

জানিনা! কোথাও আছে আশেপাশেই! সে ঠিক আছে পরে ফোনে বলে নেবেন না হয়! আসলে বাবা তো হাসপাতালে তাই সব দায়িত্ব মায়ের ঘাড়েই এসে পড়েছে!

কিছুক্ষন পরে কনে যাত্রী চলে যাওয়ার পরে বাড়ি মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেলো, আশে পাশের নিমন্ত্রিত লোকজনও ফিরে গেলেন, সব কিছু মিটে যাওয়ার পরে রত্না হাত ধরে অপর্ণা কে তার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো। গত কাল রাতেও সে এই ঘরেই শুয়েছিলো একাই, সৌমিক সম্ভবত নিচে কোথাও ছিলো। কালকের দেখা ঘরটার সঙ্গে আজকের ঘরের অনেক ফারাক, ফুলে সাজানো খাটের দিকে তাকিয়ে অপর্ণার খুব অস্বস্তি হতে লাগলো, এই খাটে আজ তাকে সৌমিকের সঙ্গে শুতে হবে! সে যে সৌমিকের কাছে সময় চেয়েছিলো সে কথা সৌমিকের আদৌ কি মনে আছে! যদি তাকে সময় দিতে না চায় সৌমিক তাহলে কি তার কিছু করার আছে, মনে মনে টেনশন হচ্ছিলো অপর্ণার।

অপর্ণার ভাবনার মধ্যেই ঘরের দরজায় আওয়াজ হলো, চোখ তুলে তাকিয়ে অপর্ণা দেখলো সৌমিক ঘরে ঢুকে এসেছে। অপর্ণা তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসলো, একটু উঠে থাকা শাড়ি কে যতদূর টেনে নামানো যায় সেই চেষ্টা করতে করতে সৌমিকের দিকে তাকালো, সৌমিক ততোক্ষনে খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে খাটের ফুল ছড়ানো চাদরের দিকে ইঙ্গিত করলো,

এইভাবে শুতে পারবো না, চাদরটা তুলে ফুল গুলো ফেলে দাও!

অপর্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, চাদর তুলে ফুলগুলো ফেলে আবার চাদর পাতার সময় সৌমিক এগিয়ে এলো,

এদিকটা আমাকে দাও, একা ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে!

অপর্ণার ভালো লাগলো, এক মুহূর্তের জন্যে বাবার কথা মনে পড়লো, মা ওকে অনেক কাজ দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হওয়ার জন্যে বাবা ওর সঙ্গে হাত লাগাতো! চাদর ঠিক করে খাটে বসতে যাওয়ার আগেই সৌমিক সামনে এগিয়ে এলো, পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা আংটি বার করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

এটা দিদি কিনেছে তোমার জন্যে, রেখে দাও!

অপর্ণা হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিলো, কিছু বলতে যাবার আগেই সৌমিক বালিশ টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো,

আলোটা নিভিয়ে দাও!

আলো নিভিয়ে দিয়ে অপর্ণা সোফায় বসে পড়লো, সারাদিনের ক্লান্তির পরে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, সামনে থাকা খাটটা ওকে টানছে, কিন্তু খুব অস্বস্তি হচ্ছে, সৌমিকের পাশে শুতে হবে!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৮
বৌভাতের দুদিন পরে অপর্ণার শ্বশুর মশাই হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন, তিনি ফিরে আসার আগেই মোটামুটি আত্মীয় স্বজন চলে গিয়েছিলো, রয়ে গিয়েছিলেন একমাত্র অপর্ণার মেজো মাসি শাশুড়ি। অপর্ণা যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, এই দু দিনের মধ্যেই তার কাছে এই বাড়ির অনেক কিছু বোঝা হয়ে গিয়েছিলো, তার শাশুড়ির সঙ্গে মেজো দিদির হৃদ্যতা তার নজর এড়ায় নি। বাকিরা ফিরে গেলেও একমাত্র ওনার ফেরার ক্ষেত্রেই আপত্তি জানিয়েছিলেন তার শাশুড়ি, অনেকটা বোনের জেদ এর জন্যেই তিনি থেকে গিয়েছিলেন।

শ্বশুর মশাই বাড়িতে ফিরে আসার পরে বাড়িতে স্বস্তি স্বস্তয়নের ব্যবস্থা করা হলো, পুজোর দিন সকালে স্নান সেরে অপর্ণা কে পুজোয় বসতে হলো, যদিও সৌমিকের বসার কোনো প্রয়োজন হলো না। মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও অপর্ণা মুখে প্রকাশ করলো না, যতটা সম্ভব ছোটখাট বিতর্ক এড়িয়ে চলার যে মন্ত্র মা তাকে বৌভাতের দিন দিয়ে গিয়েছিলো সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা করলো সে।

সেসব পর্ব মিটে গেলে অপর্ণার অষ্ট মঙ্গলাতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলো। এতদিন শ্বশুর মশাই বাড়িতে ফেরেন নি বলে অপর্ণার দ্বিরাগমনে যাওয়া সংক্রান্ত কোনো আলোচনা করা হয়নি, এমনকি সুপর্ণাও এ ব্যাপারে নীরব ছিলেন, বেয়াই মশাই বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত এ ব্যাপারে আলোচনা করতে তাঁরও অস্বস্তি হচ্ছিলো। আজ সকালে চায়ের টেবিলে বসে প্রথম এ ব্যাপারে আলোচনা শুরু হলো, প্রসঙ্গ প্রথম রত্নাই তুললো, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

মা, ভাইরা কবে রসুলপুর যাবে? আমি তো কাল চলে যাবো ভাবছি, রজতের আমি না গেলে খুব অসুবিধা হয়!

মফস্বলের ছেলে রজতের সঙ্গে রত্নার প্রেমের বিয়ে, বিয়ের আগে থেকেই রজত অবশ্য কলকাতার মেসেই থাকতো, বিয়ের পরে পাশের পাড়ায় ফ্ল্যাট কিনে থাকছে। রজত বৌভাতের পরের দিনই ফিরে গিয়েছিলো, বাবা বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত থেকে গিয়েছে রত্না। রত্না কে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে দেখে মাসি শাশুড়ি বললেন,

কেনো? তুই আবার এতো তাড়াতাড়ি ফিরে যাবি কেনো, রজত তো এখান থেকে খেয়েই যাচ্ছে! কটা দিন থাক, ঋজু ঘুরে আসুক তার পরে যাস না হয়! মায়ের একটু সুবিধা হবে!

রত্না তাড়াতাড়ি হাত তুললো,

ওরে বাবা! আমাকে আর আটকে রেখো না, রজত খুব রেগে যাবে, তোমরা দু বোন মিলে যা করার কর! আর আমার এখন যাওয়া যা, ভাই ফিরে এলে যাওয়াও তা, অপর্ণা তো আর ফিরছে না, তাহলে ভাই ফিরে এলেও মায়ের আর কি সুরাহা হবে!

অপর্ণা চমকে উঠলো, ও কি অষ্ট মঙ্গলায় গিয়ে আর ফিরবে না সৌমিকের সঙ্গে! সৌমিক কি জানে সেটা! তাড়াতাড়ি সৌমিকের মুখের দিকে তাকালো অপর্ণা, সৌমিক টেবিলে খবরের কাগজে চোখ রেখে একমনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে, এই কথাতেও তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলো না! অপর্ণার ভাবনার মধ্যেই শাশুড়ি মেয়ের দিকে তাকালেন,

না, না, তুই যা! নিজের সংসার ফেলে রেখে এখানে তোকে থাকতে হবে না! আমি মেজদি কেই আটকে রাখবো! আর অপর্ণা তো পরীক্ষার আগে ফিরছে না, সে পরীক্ষা শুরু হতে যা ওর মায়ের মুখে শুনলাম দু মাস দেরি আছে! তারপরে সেই পরীক্ষা নিশ্চয়ই মাস খানেক তো চলবেই, সব মিলিয়ে প্রায় মাস তিন চারেকের ব্যাপার, অতো দিন কাউকেই আমি আটকে রাখতে পারবো না! নিজের টা নিজেকেই করতে হবে!

স্ত্রীর কথার মধ্যেই অপর্ণার শ্বশুর মশাই হটাৎ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

ঋজু কি কোথাও বেড়াতে যাবি নাকি? টিকিট কেটেছিস কিছু?

সৌমিক খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই উত্তর দিলো,

নাহ! আমার ছুটি নেই অতো!

অপর্ণার শাশুড়ি কিছু বলার আগেই মেজো মাসি শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন,

কি যে বলো তুমি আশুতোষ! তোমার শরীরের এই অবস্থা, মা অসুস্থ, এই অবস্থায় কেউ আবার বেড়াতে যায় নাকি! ঋজু আমাদের ওরকম ছেলে নাকি যে বাবা, মার কথা চিন্তা করবে না? ওর মতো দায়িত্ববান, বিবেচক ছেলে কটা পাওয়া যায় বলোতো আজকের দিনে?

রত্না সহমত পোষণ করলো,

ঠিক বলেছো মাসি! আমার দুই ভাইই কিন্তু ভীষণ রিজনেবল! ঋষিও কিন্তু এসব ব্যাপারে খুব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে! আর তাছাড়া বাবা, অপর্ণারও তো পরীক্ষা সামনে, এখন ওসব হনিমুনে কেউ যায় নাকি! নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে!

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই সৌমিক টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো, তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে তার মা তাকে থামালো,

ঋজু, তাহলে কালকে যাবি নাকি? ওদের বাড়িতে বলে দিই তাহলে!

সৌমিক ঘাড় কাত করলো,

দেখো সেটা! তুমি যা ভালো বোঝো করো!

অপর্ণার মনের মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছিলো, ও নিজেও সৌমিকের সঙ্গে হনিমুনে যেতে একটুও ইচ্ছুক নয় সেটা ঠিক, তাই সেই ডিসিশনটা ওর খুব একটা খারাপ লাগে নি, তবে ও যে দ্বিরা গমনে গিয়ে ওখানেই থেকে যাবে এটা কি ওর সঙ্গে আলোচনা করার কথা ছিলো না! পরীক্ষার এখনও প্রায় দু মাসের বেশি দেরি আছে, ও তো এতদিন ওখানে থাকার কথা ভাবে নি! ও বরং এখানে থেকেই পড়বে বলে মনে করছিল, কি ভাবে বাড়ির কাজের মধ্যে নিজের জন্যে সময় বার করে পড়াশুনা করা যাবে, তার একটা প্ল্যানও করে ফেলেছিলো মনে মনে! এরা নিজেরাই সব ঠিক করে নিলো, ওকে একবারও বলার প্রয়োজনও মনে করলো না!

অপর্ণা! ভাইয়ের ছুটি নেই শুনলে তো, ওকে কিন্তু ওখানে গিয়ে আটকে রাখবে না! পরের দিনই ও চলে আসবে কিন্তু!

অপর্ণা চমকে ননদের দিকে তাকালো, অন্য মনস্ক ভাব কাটিয়ে বেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে ঘাড় কাত করে বললো,

হ্যাঁ, ও চলে আসবে দিদি, কিন্তু মা আসলে ওখানে একটা ছোটো অনুষ্ঠান করবে বলেছিলো, ওখানের কেউ তো কলকাতায় আসতে পারে নি তাই! তাই যদি সেটা হয় তাহলে তার জন্যে হয়ত দু এক দিন দেরি হতে পারে!

অপর্ণার শাশুড়ি অবাক গলায় বললেন,

এ আবার কি কথা! তোমার মা ওখানে অনুষ্ঠান করবেন, সেটা আমাদের বলেন নি তো! আমার ছেলের ছুটি অতদিন আছে কিনা সেটা অন্তত জানতে চাইবেন তো?

অপর্ণা একটু থতমত খেলো,

মা নিশ্চয়ই বলতো আপনাকে! আমি ঠিক জানিনা!

এদিকে বলছো জানিনা, এদিকে বলছো অনুষ্ঠান করবে মা, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝা মুশকিল! তোমার মা কেও বলিহারি যাই, মেয়ে, জামাই কে অষ্টমঙ্গলায় পাঠানোর কথা কেউ ফোনে বলে দায় সারে? কেনো বৌভাতের দিন তো উনি এসেছিলেন, একবারও বলে যেতে পারলেন না!

অপর্ণা রত্নার দিকে তাকালো, রত্না কোনো কথা বলছে না দেখে বললো,

আসলে মা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আপনি তখন ওখানে ছিলেন না! দিদি বললো, আপনি ব্যস্ত আছেন, তাই পরে ফোনে বলে নিলেই হবে!

রত্না একটু থতমত খেলো,

ঠিক তাই নয়, ইচ্ছে থাকলে উনি আবার মাকে খুঁজে নিয়ে বলতেই পারতেন, কিন্তু উনিও সেটা করেন নি! ছেড়ে দাও, মিছিমিছি কথা বাড়িয়ে লাভ কি! তুমি একটা ফোন করো না ওর মাকে! জিজ্ঞেস করো সবটা!

নিজের হাতের ফোনটা ডায়াল করে মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো রত্না, অপর্ণার শাশুড়ি ফোন হাতে নিলেন। উল্টো দিকে সুপর্ণার গলা পাওয়া মাত্র একটু রাগের গলায় বললেন,

বেয়ান! মেয়ে জামাই কে অষ্ট মঙ্গলায় নিয়ে যেতে চান না নাকি? ফোন তো করলেন না, সেদিন বৌভাতে এলেন তাও কিছু বললেন না!

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি বললেন,

না, না, দিদি সেদিন আপনি ব্যস্ত ছিলেন তাই আর বলা হয়নি! তাছাড়া অপর্ণার বাবাও বললেন আগে দাদা বাড়িতে আসুন তার পরে এই বিষয়ে কথা বলতে তাই আর বলিনি!

রীনা বিরক্ত হলেন,

আপনার কাছে একটু সামান্য সৌজন্য আশা করেছিলাম! আপনার মেয়ের কাছে শুনলাম আপনি ওখানে নাকি মেয়ে জামাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করবেন? এগুলো আমাদের কিছু বলেন নি তো আগে!

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি ভীত গলায় বললেন,

না না দিদি, আপনাকে না বলে কেনো কিছু করবো! মেয়ে জামাই কে অষ্ট মঙ্গলায় পাঠানোর জন্যে যখন কথা বলবো আপনার সঙ্গে, তখন বলবো ভেবেছিলাম! আর তাছাড়া দাদা এখন অসুস্থ, সৌমিক আদৌ পারবে কিনা এটাও তো জানতে হবে নাকি! আমি সেই ভাবে কিছু ঠিক করিনি এখনও!

অপর্ণার শাশুড়ি প্রীত হলেন, নরম গলায় বললেন,

আচ্ছা, আচ্ছা! আমারই বোঝার ভুল হয়েছে তাহলে! আসলে অপর্ণা এমন ভাবে বললো, যে আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! তাই ভাবি আপনি এতো বিচক্ষণ, আমাদের সমস্যা বুঝবেন না তাই হয়! আমি বলি কি এখন ওসব বাদ দিয়ে দিন। ছেলের অফিসে ছুটি কম, তাছাড়া ওর বাবা তো জানেন এতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন যে বলার নয়! এইসবের মধ্যে আনন্দ অনুষ্ঠান করার মতো মনের অবস্থা আমার ছেলের নেই!

সুপর্ণা নিরুপায় হয়েই সম্মতি জানালেন,

ঠিক আছে দিদি, ওসব আমি পরে করবো না হয়! আপনি চিন্তা করবেন না আমি ওদের পরের দিনই পাঠিয়ে দেবো!

রীনা সুপর্ণা কে থামিয়ে দিলেন,

এক মিনিট ভাই! ওদের নয় শুধু আমার ছেলে ফিরবে পরের দিন, আপনার মেয়ে আপনার কাছেই থাকবে! পুরুত মশাই বলেছেন অপর্ণার কিছু দোষ পাওয়া গেছে সেগুলো কাটানোর জন্যে ওকে এখন আপনার কাছেই থাকতে হবে। তাই আমি ঠিক করেছি, একদম পরীক্ষা মিটলে ওকে দিয়ে যাবেন, এখন ও ওখানে থেকেই পড়াশুনা করুক! তার মধ্যে ওই সময়টাও পেরিয়ে যাবে, আর খুব বেশি বিপদের আশঙ্কা থাকবে না!

সুপর্ণা অবাক হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই রীনা ফোন কেটে দিলেন। অপর্ণার চোখে জল আসছিলো, ভীষণ অপমানিত লাগছিলো নিজেকে, ও সত্যিই ওখানেই থেকে যাবে মনে মনে ঠিক করলো অপর্ণা!

দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়া পর্যন্ত কোনো রকমে নিজেকে সংযত করে রেখে ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লো অপর্ণা, যত টুকু জিনিস পত্র বার করা হয়েছিলো এই তিন চার দিনে সব গুলো কে গুছিয়ে সুটকেসে ভরতে লাগলেন এক এক করে। খুব অভিমান হচ্ছিলো ওর, কিন্তু ঠিক কার ওপরে অভিমান সেটা ও নিজেই বুঝতে পারছিলো না! সৌমিক কে হানিমুনে না যেতে চাওয়ার জন্যে খুব বেশি দোষ দিতে পারছিলো না অপর্ণা, ও তো নিজেই দূরে থাকতে চেয়েছে, সমর কে ভুলতে পারার জন্যে সময় চেয়ে নিয়েছে! কিন্তু ওর খারাপ লাগছে যে, ওকে যে রসুলপুরে গিয়ে থাকতে হবে সেটাতে সৌমিক কোনো আপত্তি জানালো না কেনো! সৌমিক কি একবারও ওকে জিজ্ঞেস করতে পারতো না যে ও এখন থেকেই ওখানে আদৌ থাকতে চায় কিনা! নাকি সৌমিক নিজেও ওর থেকে দূরেই থাকতে চায়!

অপর্ণা এক অদ্ভুত দোটানায় ভুগছিল, সৌমিক ওর রসুলপুরে গিয়ে থাকার কথায় কোনো আপত্তি না করার জন্যে ওর নিজেকে অপমানিত লাগছে কেনো! ওর তো বরং খুশি হবার কথাই ছিলো যে এই সুযোগে ওকে অনেকদিন সৌমিকের সঙ্গে থাকতে হবে না! কিন্তু তাও ওর কেনো সৌমিকের কাছে জবাবদিহি চাইতে ইচ্ছে করছে! সৌমিক অনেক আগেই খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল, অপর্ণা সোফায় বসে বসেই খাটে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত সৌমিকের মুখের দিকে তাকালো, মনে হচ্ছে ডেকে তুলে দেয় ও সৌমিক কে, জিজ্ঞেস করে অপর্ণাকে এতটা অপমান করার মতো সাহস ওকে কে দিলো!

ছোটো বৌমা! ঋজুর চা!

অপর্ণা চমকে উঠে দেখলো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে, সোফায় বসে বসেই ও কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ও নিজেই জানে না! ও তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললো, অন্ধকারে ওকে সুইচ হাতড়াতে দেখে মিনতি ওর পাশ দিয়েই চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে পড়লো, অভ্যস্ত হাতে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে ট্রে টা অপর্ণার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

কই! তাড়াতাড়ি ডাকো তাকে, শীতের সন্ধ্যে চা একেবারে জুড়িয়ে যাবে! ঋজু একদম ঠান্ডা চা খেতে পারে না!

অপর্ণা একটু থতমত খেলো, মিনতির সামনে সৌমিক কে আপনি বলা উচিত নয় ভেবে নিয়ে ট্রে টা হাতে ধরে সামনে গিয়ে আস্তে করে ডাকলো,

তোমার চা!

সৌমিক ততোক্ষনে মিনতির গলার আওয়াজে নিজেই উঠে পড়েছিলো, অপর্ণার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলের দিকে ইশারা করলো,

রাখো ওখানে!

মিনতি চলে যাওয়ার পরে অপর্ণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জামা কাপড় দ্রুত হাতে সুটকেসে ভরতে লাগলো, দুপুরে সব নিয়ে বসেছিলো গোছাবে বলে কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারে নি! সৌমিক চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে অপর্ণা পিছু ডাকলো,

কাল নিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনার কিছু গুছিয়ে দিতে হবে?

সৌমিক দাঁড়িয়ে পড়লো, পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,

নাহ! আমি গুছিয়ে নেবো! আর একটা কথা আমি ডুপ্লিকেসি পছন্দ করিনা! যদি সবার সামনে তুমি বলতে চাও তাহলে তুমিই বলবে, আড়ালে আপনি বলার দরকার নেই!

অপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লো, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে শক্ত গলায় বললো,

আচ্ছা! তাহলে আমি কিছু কথা বলতে চাই! তুমি এসব স্বস্তি স্বস্তয়নে বিশ্বাস করো? তুমি মনে করো যে আমার দোষেই তোমার বাবা পড়ে গেছেন?

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

নাহ! করিনা! কিন্তু অন্য কেউ যদি সেটা বিশ্বাস করে তাতে আমার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না! তোমার ইচ্ছে না থাকলে পুজোয় না বসতেই পারতে, বলতে পারতে তোমার আপত্তির কথা!

অপর্ণা শ্লেষের হাসি হাসলো,

সেটা যে কোনো নতুন বউয়ের পক্ষে বলা সম্ভব নয় সেটা তুমিও জানো! আর একটা কথা পুরোহিত মশাই যে আমাকে রসুলপুরে গিয়ে থেকে যাওয়ার নিদেন দিয়েছেন, এটা আমাকে বলা হয়নি আগে! অথচ তোমার এক্সপ্রেশন থেকে মনে হয়েছে তুমি আগে থেকেই সব জানতে! আমার মনে হয়েছে এ ব্যাপারে কিছু ডিসিশন নেওয়ার আগে আমার সঙ্গে তোমার আলোচনা করা উচিত ছিলো!

সৌমিক ঘুরে এসে খাটে বসে পড়লো, সোফায় বসে থাকা অপর্ণার দিকে সোজা চোখে তাকিয়ে বললো,

আমি আমার কাজের জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিই না, অন্যের কাজের কৈফিয়ত চাইও না! আমার মনে হয়েছিলো সেটা তোমার পড়াশোনার জন্যে সুবিধাই হবে তাই আপত্তির কোনো কারণ দেখিনি! যদি তোমার মনে হয়ে থাকে তুমি এখানে ফিরে আসবে আমার সঙ্গে, তুমি আসতে পারো, সেটা তোমার ডিসিশন, তাতেও আমার বলার কিছু নেই!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ৯
রসুলপুরের দুরত্ব কলকাতা থেকে এতটাই বেশি যে সকাল সকাল বেরোনো সত্বেও অনেকটা রাতের দিকে সৌমিক আর অপর্ণা রসুলপুরে পৌঁছলো, টুকটাক অনুষ্ঠান পর্ব মিটে যাওয়ার পরে রমেন বাবু ব্যস্ত হলেন, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন,

ওদের খেতে দিয়ে দাও সুপর্ণা, অনেকটা রাস্তা এসেছে ওরা! নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত, আবার তো সকালে উঠেই সৌমিক কে বেরোতে হবে!

সুপর্ণা টেবিল গুছিয়ে তাড়াতাড়ি খাবার বন্দোবস্ত করছিলেন, তাঁর ডাকে সৌমিক টেবিলে এসে খেতে বসলো। খেতে খেতে টুকটাক কথার পরে সুপর্ণা ধীরে ধীরে অপর্ণার থেকে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললেন,

বাবা! দিদির মুখে শুনলাম অপর্ণার নাকি কিছু দোষ পাওয়া গেছে! তাই উনি ওকে কয়েক মাসের জন্যে এখানে থেকে যেতে বলেছেন, কিন্তু বাবা আমরা তো ছোটো খাটো জায়গায় বাস করি, এসব জায়গায় মেয়ে অষ্ট মঙ্গলায় এসে থেকে গেলে নানা রকম কথার সৃষ্টি হয়। তুমি যদি একটু তোমার মা কে বুঝিয়ে বলতে, যদি দোষ কাটানোর জন্যে অন্য কিছু করা সম্ভব হতো তাহলে খুব ভালো হতো!

সৌমিক খেতে খেতে মাথা নাড়লো,

বুঝিয়ে বলার কিছু নেই! মা মায়ের কথা বলেছেন কিন্তু অপর্ণা যদি ফিরতে চায় তাহলে আমার সঙ্গে ফিরতেই পারে, আমি অপর্ণা কে বলেছি সেটা! তবে এটকু বলতে পারি ওখানে থাকলে ওর পড়াশুনা করতে সমস্যাই হবে, যদি সত্যি ও ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে চায় তাহলে এখানে থাকলেই ওর সুবিধা হবে!

অপর্ণা নিজের ঘরে বসে সম্পূর্ন কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলো, তার নিজের ওপরেই অসম্ভব রাগ হচ্ছিলো। ও তো বুঝতেই পারছে সৌমিক ওকে নিয়ে যেতে চায় না, তবে তাতে অপর্ণার সত্যি কিছু এসে যায়না! কিন্তু মা যেভাবে ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করছে সেটা ও সহ্য করতে পারছে না আর, অপর্ণা ঘরের পর্দা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো, খাওয়ার টেবিলে বসে থাকা সৌমিক কে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

বাবা! এটা কিন্তু ঠিক কথা যে ওখানে পড়াশোনার সময় আমি পাবো না, তাই আমিও চাই পরীক্ষা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকি! আর মা চিন্তা করছে কেনো, আমার শাশুড়ি যখন নিজেই থাকার কথা বলেছেন তখন অন্যেরা কি বলবে তাতে কি আসে যায়?

আড়চোখে সৌমিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সৌমিক মুখে স্বস্তির ছাপ নিয়ে একমনে খেয়ে যাচ্ছে! রমেন বাবু কিছু বলার আগেই সুপর্ণা মেয়ে কে থামিয়ে দিলেন,

থাম তুই! আমাকে সৌমিকের সঙ্গে কথা বলতে দে! তুই কতো টুকু জানিস এখানের ব্যাপারে? এটা কলকাতা নয়, আমাকেই তো সব প্রশ্নের জবাব দিতে হয়!

অপর্ণা উত্তর দিতে যাওয়ার আগেই বাইরে থেকে পাশের বাড়ির যতীন দত্তর বউ এর গলা পাওয়া গেলো, তিনিই সবার আগে এই বাড়িতে কথোপকথনের আওয়াজ পেয়েছিলেন। তিনি চিৎকার করে অপর্ণার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকলেন,

কি রে অপর্ণা, এসেছিস নাকি? অনেকক্ষন ধরে তোর গলার আওয়াজ পাচ্ছি!

অপর্ণা জোর করে মুখে হাসি টেনে এগিয়ে এলো,

হ্যাঁ জ্যেঠিমা এই তো একটু আগেই এলাম! এসো ভেতরে এসো!

দত্ত গিন্নী ঢুকে এলেন, চারিদিকে তাকিয়ে বললেন,

কই নতুন জামাই কই! নেমন্তন্ন তো খেতে যেতে পারিনি, চোখের দেখাটুকু অন্তত দেখি!

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন,

আর বোলো না দিদি, ওর শ্বশুর মশাইয়ের যা হলো! উনি সুস্থ থাকলে তো এখানেও একটা ছোটো করে অনুষ্ঠান করবো বলেই ভেবেছিলাম, কিন্তু উপায় নেই আর! দেখা যাক কবে তোমাদের খাওয়াতে পারি!

সৌমিক ততোক্ষনে খেয়ে উঠে রমেন বাবুর পাশে সোফায় বসেছিলো, তার দিকে তাকিয়ে সুপর্ণা ইশারা করলেন, যদিও অপর্ণার সন্দেহ হচ্ছিলো আদৌ সে ইশারার মানে সৌমিক ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করবে কিনা! কিন্তু অপর্ণার ভাবনা কে ভুল প্রমাণিত করে সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে পায়ে হাত দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললেন,

থাক, বাবা থাক! আর প্রণাম করতে হবে না! এখনও মেলা লোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, কতো লোক কে আর প্রণাম করবে! আমাদের অপর্ণা কিন্তু খুব ভালো মেয়ে, দেখো তুমি খুব ভালো থাকবে!

সুপর্ণা মনে মনে খুশি হলেন, তবে তাঁর এইটুকু আশা ছিলো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর প্রতিবেশীরা সেই বিয়েতে কোনো বাগড়া দেবেন না! সেই ভরসাতেই তিনি অনুষ্ঠান করবেন বলে ভেবেছিলেন। তিনি মনে মনেই জানেন, নিতান্ত সাধারণ এই মধ্যবিত্ত মানুষগুলো তাঁদের জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যে কিছু পরচর্চায় সময় কাটায় ঠিকই, তবে খুব বেশি ক্ষতি করার মানুষ এঁরা নন! এদের ভরসাতেই তো তিনি অসুস্থ স্বামী কে নিয়ে এখানে আছেন!

কিছুক্ষনের মধ্যেই মোটামুটি গোটা কলোনি অপর্ণাদের বাড়িতে ভেঙে এলো, জামাই কে দেখে, এবং মেয়ে জামাইয়ের সুখ্যাতি করার পর তাঁরা যখন মিষ্টি খেয়ে বিদায় নিলেন তখন রাত প্রায় দশটা! রসুলপুরে শীতের রাতের দশটা মানে অনেক রাত, তাই নতুন করে অপর্ণার ফেরার প্রসঙ্গ আলোচনা করার মতো সময় আর ছিলো না। পরের দিন ভোর বেলা উঠেই সৌমিক রমেন বাবু কে জিজ্ঞেস করলো,

পরের ট্রেন কটায়? আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে!

রমেন বাবু ট্রেনের সময় বলার আগেই সুপর্ণা অসহায় চোখে জামাইয়ের দিকে তাকালেন,

এক্ষুনি বেরোবে বাবা! জলখাবার টুকু অন্তত খেয়ে যাও! আর অপর্ণার তাহলে কি হবে? ও কি এখানেই থাকবে?

সৌমিক খবরের কাগজ টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে উত্তর দিলো,

হ্যাঁ, তাই তো কথা হলো কাল! অপর্ণা তো নিজেও এখানেই থাকতে চাইলো!

সুপর্ণা জামাইয়ের সঙ্গে কথোপকথন বন্ধ রেখে তাড়াতাড়ি মেয়ের ঘরে ঢুকে এলেন, অপর্ণা তখন থমথমে মুখে খাটে বসেছিলো, বাইরে থেকে আসা কথোপকথনের আওয়াজ তার কানেও পৌঁছেছিল। মাকে ঢুকতে দেখে সে চোখ তুলে তাকালো, সুপর্ণা তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ে জামাইয়ের খাটের দিকে তাকালেন, তাঁর অভিজ্ঞ চোখে ঘটনার অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ছিলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে সুপর্ণা নিচু অথচ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,

সৌমিক এর কি হয়েছে? তুই কি ওকে সমরের কথা বলেছিস নাকি?

অপর্ণা মনে মনে চমকে উঠলো, ও তো এই দিকটা ভাবেনি একটুও! সৌমিক কি ওর ওপরে রেগে আছে! কিন্তু তাহলে বিয়ে করতে গেলো কেনো, ও তো কিছু লুকিয়ে করেনি! তখনই তো তাহলে না বলতে পারতো বিয়েতে!

মেয়ে কে চুপ করে থাকতে দেখেই সুপর্ণা দাঁতে দাঁত চাপলেন,

বুঝলাম! এতবার করে বারণ করেছিলাম তাও শুনলি না! তোরা বাবা মেয়ে মিলে আমাকে একেবারে শেষ করে দে! ভগবান যে কেনো আমাকে তুলে নেন না কে জানে!

তিনি আর দাঁড়ালেন না, দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এসে জামাইয়ের দিকে তাকালেন,

আমি জানিনা বাবা তোমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে কিনা! শুধু একটাই অনুরোধ করবো তুমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও, আবার সেরকম হলে কালই দিয়ে যেও, আমি তখন আর কিছু বলবো না!

সৌমিক কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে উঠে দাঁড়ালো, সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে বললো,

ঠিক আছে, ওকে তৈরি হতে বলুন তাহলে! আমি কিন্তু এখনই বেরোবো!

অপর্ণার অপমানে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, মা নিজেকে এতো ছোটো করছে কেনো! সুপর্ণা মেয়ের ঘরে আসছিলেন, তার আগেই নিজেকে শক্ত রেখে অপর্ণা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

কেনো আমাকে জোর করে পাঠাতে চাইছো মা, তুমি কি বুঝতে পারছো না যে এখানে থাকলে আমার আসলে ভালোই হবে! আর পরীক্ষা পর্যন্তই তো তারপরে তো আমি ফিরেই যাবো, যদি কেউ তোমাকে জিজ্ঞেস করে তুমি এটাই বলবে! বলবে মেয়ে তার পরীক্ষার জন্যে এখানে আছে!

রমেন বাবু এবং সুপর্ণা দুজনেই দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকালেন, অপর্ণা সেই সুযোগে সৌমিকের দিকে তাকালো,

আধ ঘন্টার মধ্যেই একটা ট্রেন আছে, ওটা ধরতে পারলে তুমি সন্ধ্যের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে! তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দেবো!

সৌমিক সুপর্ণার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো, রমেন বাবু একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন,

মেয়ে আমার একটু জেদী বাবা, আসলে ওকে ছোটো থেকেই বড্ড আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছি তো! ওর মা যতোই জোর করুক, তোমার মা যখন একবার ওকে এখানে থেকে যেতে বলেছেন ও কিছুতেই তোমার সঙ্গে ফিরবে না! আর আমিও ওকে জোর করতে পারবো না!

অপর্ণা ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার পরে সুপর্ণা স্বামীর দিকে তাকিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বসে রইলেন, রমেন বাবু বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে স্ত্রী কে বললেন,

তুমি বসে আছো কেনো! ছেলেটা কে কিছু খেতে দাও, ওতো বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি!

সুপর্ণা চমক ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ! এই যে দিই!

সৌমিক মিনিট দশেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেলো, শুধু মাত্র এক কাপ চা খেয়ে শ্বশুর, শাশুড়ি কে প্রণাম করে অপর্ণার সঙ্গে স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। রেল কলোনির মধ্যে দিয়েই স্টেশনে যাবার পথ, রাস্তায় বিভিন্ন পরিচিত মানুষ জনের সঙ্গে দেখা হতে লাগলো। যেহেতু গত কাল রাতে সবার সঙ্গেই সৌমিকের দেখা হয়েছিলো তাই প্রায় সবাই তাকে দেখে টুকটাক কথা বলতে এগিয়ে এলো। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে স্টেশনে পৌঁছালো অপর্ণা এবং সৌমিক, তাদের দেখেই বর্তমান স্টেশন মাস্টার এগিয়ে এলেন। ইনিও কাল রাতে সৌমিকের সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছিলেন, সৌমিক কে দেখেই একগাল হাসলেন,

সেকি জামাই! এক্ষুনি চলে যাচ্ছো নাকি? এখানে দাঁড়িয়ে কেনো, চলো আমার ঘরে বসবে চলো, ট্রেনের এখনও তো বেশ খানিকটা দেরি আছে!

সৌমিক অস্বস্তি এড়াতে মাথা নাড়লো,

একটু পরে আসছি! আমি আসলে স্টেশনটা একটু ঘুরে দেখবো ভেবেছি!

ভদ্রলোক হাসলেন,

আচ্ছা, আচ্ছা! দেখো দেখো! যদিও দেখার মতো সেরকম কিছু নয়!

সৌমিক আর দাঁড়ালো না, জোর পায়ে স্টেশনের শেষ প্রান্তের দিকে হাঁটা শুরু করলো, পেছন পেছন অপর্ণা। স্টেশনের শেষ প্রান্তে একটা মোরাম বেছানো রাস্তা ছোটো একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গঞ্জের দিকে চলে গিয়েছে, যদিও একটু ঘুর পথ বলে ওদিকে মানুষজনের আনাগোনা কম। বেশিরভাগ মানুষই রেল কলোনির সামনে দিয়েই যাতায়াত করে, তার আর একটা কারণ ওই কলোনির ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাতে আলো জ্বলে। স্টেশনের শেষ প্রান্তে রাখা বেঞ্চটার এক প্রান্তে বসে পড়লো সৌমিক, অপর্ণা একটু দুরত্ব রেখে বসে উল্টোদিকের জঙ্গলটার দিকে তাকালো। এই জঙ্গলটা থেকেই সমরের দেহ উদ্ধার হয়েছিলো সেকথা মনে পড়তেই নতুন করে চোখ জলে ভরে আসছিলো অপর্ণার, এমন সময় একটা কালো রঙের বাইক চালিয়ে স্বপন ওই মোরামের রাস্তাটা ধরে স্টেশনের গায়ে এসে দাঁড়ালো।

বাইক ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে স্বপন হাতের তালু তে খৈনি ডলতে ডলতে স্টেশনে উঠে এলো, অপর্ণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেঞ্চে বসে থাকা সৌমিকের দিকে ইশারা করে বললো,

বিয়ে হয়ে গেছে শুনেছিলাম, এটাই বর নাকি? তা বেশ, ভালোই তো! তবে তোমার নাগরের খবর বলেছিলে তো, নাকি ওই রূপ দেখিয়ে কাত করে ফেলেছ?

অপর্ণা হতবাক হয়ে গেলো, সে কিছু বলার আগেই সৌমিক স্বপনের দিকে তাকালো,

কে আপনি? এই ভাবে কথা বলছেন কেনো?

স্বপন কাঁধ ঝাঁকালো,

আমি কেউ স্পেশাল নই স্যার, তবে আপনার ভালোই চাই! একটু খবর টবর নিয়ে বিয়ে করতে হয় তো! এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বিয়ে করলেন, কোনো খবর না নিয়েই, আপনি তো বিরাট মুরগী স্যার!

আপনাকে আমার ভালো করার দায়িত্ব কে দিয়েছে? নিজের চরকায় তেল দিন না! অন্যের ব্যাপারে অযথা নাক গলাতে আসেন কেনো?

কড়া গলায় বললো সৌমিক, স্বপন হাত তুললো,

ঠিক আছে, এলাম তাহলে! বউ কে রেখে যাচ্ছেন নাকি?

সৌমিক উত্তরে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, অপর্ণা বাধা দিলো,

ছেড়ে দাও, প্লিজ!

স্বপন চলে যেতে যেতে অপর্ণার দিকে হাত তুললো,

কাল থেকে কলেজে আসছো তো? দেখা হবে তাহলে! আর বর তো চলে যাচ্ছে, কোনো দরকার হলে বোলো আমাকে!

স্বপনের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সৌমিক অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করলো,

কে এটা? এতো কথা যেচে বলছিলো কেনো?

অপর্ণা দূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অন্য মনস্ক গলায় বললো,

ওর নাম স্বপন, অসভ্য ছেলে, গুন্ডা একটা! সারাদিন লোকজন কে চমকে ধমকে, তোলাবাজি করে দিন কাটায়!

সৌমিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

তোমার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক? আমাকে এসব কথা বলছিলো কেনো?

অপর্ণার মুখে বিরক্তি ফুটলো,

ও আমাকে প্রপোজ করেছিলো, আমি রাজি হইনি! তাই সুযোগ পেলেই আমাকে অপমান করতে চায়! ও ভেবেছে আমি তোমাকে আমার সম্বন্ধে কিছু জানাই নি তাই এসব বলছে!

আচ্ছা!

সৌমিক এর মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটলো,

ও কি ভাবছিলো এই কথা গুলো বললে বিয়ে ভাঙিয়ে দিতে ওর সুবিধা হবে! কি সুবিধা হবে বলে ভাবছে? বিয়ে ভেঙে গেলে ও চান্স পাবে এরকম ভাবছে নাকি?

অপর্ণা বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো,

জানি না! ও আগেও এরকম করেছে! ওর ভয়ে অন্য কোনো ছেলে আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতো না! যে ছেলেটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিলো তাকেও মাঝে মাঝেই হুমকি দিতো, আমার তো মনে হয় ওর মৃত্যুর জন্যে ওই দায়ী! ওই ওকে মেরেছে, কিন্তু কোনো প্রমাণ তো নেই!

সৌমিক অবাক হয়ে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালো,

ওই ছেলেটি খুন হয়েছিলো নাকি!

অপর্ণা মাথা কাত করলো, জলভরা চোখে দূরের জঙ্গলের দিকে হাত দেখিয়ে বললো,

ওই জঙ্গলে বস্তায় লাশ পাওয়া গিয়েছিলো, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে মুখ খুলবে কে! অথচ সবাই মনে করে ওই কাজটা করেছে কিন্তু পুলিশের সামনে কেউ একটা কথাও বলেনি! যে বলবে সেই তো মরবে!

সৌমিক হটাৎ করে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো,

চলো, বাড়ি ফিরে রেডী হয়ে নাও, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবো!

অপর্ণা চমকে তাকালো,

কিন্তু এটা নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি হবে নিশ্চয়ই, মা রাগ করবেন!

সৌমিক এগিয়ে যেতে যেতে ঘুরে তাকালো,

ওসব আলোচনা পরে ট্রেনে বসে করবো! এখন তাড়াতাড়ি চলো, নাহলে পরের ট্রেনটাও মিস হয়ে যাবে!
ক্রমশ