ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
155

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৬
আজ বিকেলে রীনার মেজদি আর জামাইবাবু কলকাতায় আসবেন তাঁদের মেয়ের বিয়ের কেনো কাটা করতে, তাই সকাল থেকেই রীনা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আরো এক দিদি থাকলেও প্রায় পিঠো পিঠি হওয়ায় এঁর সঙ্গেই তাঁর ভাব বেশি। অনিন্দিতা সকাল থেকে বিভিন্ন রান্নায় ব্যস্ত, অপর্ণা কেও আজ বড়ো জায়ের সঙ্গে থাকার দায়িত্ব দিয়েছেন শাশুড়ি। রীনা নিজেও টুকটাক হাত লাগাচ্ছেন এসে, দুই ছেলেকেই পই পই করে বলে দিয়েছেন আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে, ঋষি তাতে সম্মতি জানালেও ঋজু কথা দিতে পারে নি কারণ তার আগামী কাল থেকে ছুটি নেওয়া আছে রসূলপুরে যাওয়ার জন্যে।

একটু সন্ধ্যের দিকে তাঁরা এলেন, চা, জলখাবারের পর্ব মেটার মধ্যেই ঋষিও অফিস থেকে ফিরে এসেছিলো, খুব তাড়াতাড়ি না হলেও অন্য দিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ফিরে ছিলো সৌমিকও। জমিয়ে গল্প হচ্ছিলো ড্রইং রুমে, বিয়ের বাজার করতে আসা নতুন বউ হতে চলা বোন কে নিয়ে দুই দাদা মজা করছিলো। গল্পের মধ্যেই রত্না ঢুকলো, তাকে দেখেই সৌমিকের মাসতুতো বোন জলি হৈ হৈ করে উঠলো,

রত্না দি তোকে কিন্তু কাল যেতে হবে আমাদের সঙ্গে! তোর চয়েজ খুব ভালো!

রত্না হাসলো,

যাবো ভেবেছি তো, কিন্তু অতো লোকের গাড়িতে জায়গা হবে কি করে! রজতের তো শরীরটা ভালো নেই, মাঝে মাঝেই অসুস্থ হচ্ছে, নাহলে তো আমাদের গাড়িটাও সঙ্গে নিতে পারতাম! তোরা তিনজন, আর মা হলেই তো আর জায়গা নেই, চালাবে কে ঋষি নাকি? ভাই তো থাকছে না, কালই অপর্ণার যাওয়া তো, ও তো সঙ্গে নিয়ে যাবে বোধহয়!

ঋষি মাথা নাড়লো,

না, আমি তো কাল কিছুতেই পারবো না, এখন খুব চাপ ছুটি নেওয়া সম্ভব নয়!

রীনা বিরক্ত মুখে তাকালেন,

ঋজু থাকবে না এটা তো তুমি জানতে, আগে বলো নি কেনো? তোমার পক্ষেও থাকা সম্ভব যদি না হয়, তাহলে গাড়ি নিয়ে যাবে কে!

ঋষি অপরাধীর মতো মুখ করে তাকালো,

একদম মাথায় ছিলো না মা! দাঁড়াও কিছু একটা ব্যবস্থা করছি!

এখন শেষ মুহূর্তে তুমি আর কি ব্যবস্থা করবে?

বিরক্ত স্বরে বললেন রীনা, রাগারাগি হতে দেখে সৌমিক উঠে দাঁড়ালো, দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বললো,

আরে, আমাদের পাড়ায় একটা ড্রাইভার সেন্টার আছে, ওখান থেকে আমার অনেক বন্ধুরা ড্রাইভার নেয়, ওদের বলে দ্যাখ না দাদা! ওদের সার্ভিস খুব ভালো!

ঋষি কিছু বলার আগেই অপর্ণার শ্বশুর হাত তুললেন,

ব্যাস! তাহলে তো হয়েই গেলো! ঋষি তুই ওখানেই বলে দে, আর কোনো ঝামেলা থাকবে না!

কে বললো ঝামেলা থাকবে না? সেন্টারের ড্রাইভারের কতো সমস্যা তুমি জানো?

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন রীনা, অনিন্দিতা তখন দ্বিতীয় বার চা নিয়ে আসছিলো, তাকে ট্রে হাতে সামনে দেখেই রীনার মুখে বিরক্তির ছাপ পড়লো,

তুমি তো জানতে কাল ঋজু থাকবে না, ঋষি কে একটু মনে করিয়ে দিতে পারো নি! সেন্টারের ড্রাইভার কোনো দিনও তো নিই নি, জানি না এরা কেমন হয়! বাড়িতে বসে থাকো, সারা দুপুর তো ঘুমাও, কোনো ব্যাপারে নিজে থেকে দায়িত্ব নাও না! সংসারটা কে নিজের বলে মনে করতে পারলে না এতদিনেও! যেটুকু বলে দেবো তার বাইরে কিছু করবে না!

পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে দেখে অপর্ণার মাসী শাশুড়ি বোন কে থামালেন,

ছাড় না! ঋষি ব্যবস্থা করছে তো! তবে সেন্টারের ড্রাইভার দের সমস্যা একটাই ওরা তো গাড়ি কে নিজের মনে করে চালায় না, তাই প্রায় গন্ডগোল হয়! তবে অনিন্দিতা রীনা কিন্তু ঠিক বলেছে এটা, এবার তো তোমার ছোটো জা এসে গেছে, এবার তোমার কিছু দায়িত্ব নেওয়া উচিত!

অনিন্দিতা মুখ নিচু করে থাকলো, সে উত্তর না দিলেও অপর্ণার মুখ নিশপিশ করছিলো, সে আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো না,

মেজোমাসী! মা আসলে কাউকে দায়িত্ব নিতে দেন না তো! নিজে থেকে কিছু করতে গেলে খুব বিরক্ত হন, বলেন প্রত্যেকের নিজের দায়িত্ব আছে, সেটা তাকেই করতে হবে! তাই দিদিভাই এটা কার দায়িত্ব সেটা বুঝে উঠতে পারে নি! থাকতে পারবে না এটা বলাটা মনে হয় দাদার দায়িত্ব ছিলো, তাই না দাদা?

ঋষি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, আমারই ভুল হয়েছে! আমি করছি ব্যবস্থা!

রীনা আর তাঁর মেজদি থমথমে মুখে বসে রইলেন, অপর্ণার কথায় যথেষ্ট অপমানিত হলেও যেহেতু কথাটা সত্যি ছিলো, তাই প্রতিবাদ করার কোনো জায়গা ছিলো না। ঋষি কিছুক্ষন পরে ফোন হাতে ফিরে এলো, টেবিলের ওপরে ফোন রেখে বললো,

সেন্টারে বলে দিয়েছি, ড্রাইভার কিছুক্ষন পরেই ফোন করবে!

রত্না পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় কথা ঘোরালো,

সবাই আমাকে ধন্যবাদ দাও, আমি না বললে তো ড্রাইভার পেতেই না তোমরা!

ঋষি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে হাসলো,

আর আমাকেও! শেষ পর্যন্ত তো আমিই করলাম।

আবার টুকটাক গল্প শুরু হয়েছিলো, যদিও ঋষি, অপর্ণা বা অনিন্দিতা সেখানে ছিলো না! কথাগুলো বলেই অপর্নাও অনিন্দিতার পেছনে পেছনে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিলো তখনই। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঋষির ফোন বাজলো, ঋষি তখনও বাইরে থেকে ফেরেনি, রত্না দু একবার চিৎকার করে ডাকার পরে হাল ছেড়ে দিলো। রীনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন,

মিছিমিছি চিৎকার করছিস কেনো? ও তো বাইরে বেরিয়ে গেলো, ওখান থেকে শুনতে পাবে নাকি! ফোন টা ধর, ঠিক ড্রাইভার ফোন করেছে!

একটু ইতস্তত করে রত্না ফোন ধরলো, হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিকের মহিলা কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলো,

অতসী রায়ের বাড়ির লোক বলছেন? পেশেন্ট কে কাল সকালে দশটার মধ্যে এম্পটি স্টমাকে হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছে যাবেন কিন্তু! আপনাদের দু নম্বরে নাম আছে, এর পরেও আর চারজন আছেন, তাই টাইম টা মেনটেন করবেন প্লিজ!

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, রত্না গম্ভীর মুখে হুঁ বলে ফোন নামিয়ে রেখে মায়ের দিকে তাকালো, রীনার মেজদি অবাক হয়ে বোন কে জিজ্ঞেস করলো,

রং নম্বর হলো নাকি? অতসী রায় আবার কে?

রত্না মাথা নাড়লো,

নাহ! ঋষির শাশুড়ি! কাল তারমানে হসপিটালে টেস্ট আছে ওনার, তাই ঋষি গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে না বললো!

রীনা গম্ভীর গলায় ডাক দিলেন,

অনিন্দিতা! এদিকে এসো!

অনিন্দিতা রান্নাঘরে ছিলো ফলে তার পক্ষে কিছুই শোনা সম্ভবপর হয়নি, শাশুড়ির চিৎকারে সে ভীত মুখে অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, পেছন পেছন অপর্ণা। ইতিমধ্যেই ঋষি ফিরে এলো, তাকে দেখেই রীনা ছেলের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,

তোমার শাশুড়ির হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিলো, কাল সকাল দশটায় খালি পেটে নিয়ে পৌঁছাতে হবে, তুমি আশাকরি সেই জন্যেই কাল যেতে পারবে না বললে? অফিস থেকে ছুটি নিয়েছো অথচ বাড়িতে বলছো না!

মুহূর্তে অনিন্দিতার মুখ পাংশু হয়ে গেলো, ঋষি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই অনিন্দিতা বললো,

না, না ও তো কোনো ছুটি নেয় নি! ও তো যেতে পারবে না ওর অফিসে চাপ আছে! আমিই আসলে যাবো ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে!

রীনা ছেলে, বউ দুজনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন,

তুমি যাবে ভেবেছিলে! তুমি কি করে যাবে? বাড়িতে এতো কাজ, অপর্ণাও চলে যাচ্ছে কাল! মেজদিরা রয়েছে বাড়িতে। তোমার বোন কে বলো নিয়ে যেতে, ও তো কলেজে পড়ে, যথেষ্ট বড়ো মেয়ে!

অনিন্দিতা মাথা নিচু করলো,

ওর কাল পরীক্ষা আছে!! পরীক্ষার পরে করবো ভেবেছিলাম কিন্তু ডেট পেতে অসুবিধা হচ্ছিলো তাই নিয়ে নিয়েছি! তখন জানতাম না মেজো মাসীরা আসবেন!

ঋষি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

আচ্ছা ঠিক আছে, অনিন্দিতা বাড়িতেই থাক, ওকে যেতে হবে না! আমি দেখছি কি করা যায়! কটায় বললো দশটায় তো? দেখছি ওটা করে নিয়ে যদি একটু দেরীতে অফিসে ঢোকা যায়, একবার ঢুকলে আর বেরোতে পারবো না!

রীনা বিরক্ত হলেন,

সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নাও কেনো! ওনাকে বলবে উনি ওনার ছোটো মেয়ের সময় অ্যাডজাস্ট করে যেনো এগুলো করেন! যত দায়িত্ব কি বড়ো মেয়ের নাকি? বিবাহিতা মেয়েরা সব সময় বাপের বাড়ি নিয়ে পড়ে থাকলে চলে না! আমাকে দেখে তো ওনার শেখা উচিত! আমি কখনো রজত কে আমার কোনো ব্যাপারে জড়াই না!

ঋষি কোনো উত্তর না দিলেও অপর্ণার মাসি শাশুড়ি এ ব্যাপারে সহমত হলেন না, কারণ তাঁর নিজের মেয়ে আছে। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন,

এটা কিন্তু ঠিক কথা নয় রীনা, তোর দুই ছেলে তোর সঙ্গে থাকে তাই তোর রজত কে দরকার পড়ে না, কিন্তু যদি ওরা এখানে না থাকতো তাহলে?

মেজদির স্বামীও স্ত্রী কে সমর্থন করলেন,

এটা ঠিক কিন্তু! এই আমাদের কথাই ধরো তুমি, আমাদের বিপদে তো মেয়ে জামাই কেই ডাকবো নাকি! এগুলো একটু মেনে নিতেই হবে তোমাকে।

রীনা উঠে দাঁড়ালেন, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,

অনিন্দিতার বাবা বহু বছর আগে মারা গেছেন, এতোদিন তো উনি দু মেয়ে কে নিয়ে নিজেই সব করে এসেছেন। এখনই শুনি আর কিছু নাকি পারেন না, সব বড়ো মেয়ে জামাইয়ের ওপরে ছেড়ে দেন! আর তোমাদের কথা আলাদা, তোমাদের জলি ছাড়া কেউ নেই, কিন্তু ওনার বাড়িতে আরো একটা বড়ো মেয়ে আছে, সে নিয়মিত কলেজে একাই যাতায়াত করে অথচ কোনো দায়িত্ব নেবার বেলায় দিদির ঘাড়ে ঠেলে দেয়! সারাজীবন তো এইভাবে চলতে পারে না, সেটা ওনাকে বুঝতে হবে! এতো যদি অসুবিধা থাকে তো মেয়ের বিয়ে না দিলেই হতো, সব সময় দুই মেয়েকেই দরকারে সঙ্গে পেতেন!

রীনা গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাবার পরে আড্ডার তাল কেটে গেলো, অনিন্দিতা রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে মুখ নিচু করে কড়া তে খুন্তি নাড়তে লাগলো। অপর্ণা পাশেই দাঁড়িয়েছিলো, মৃদু গলায় বললো,

দিদিভাই তুমি আমাকেই বলতে পারতে, তাহলে আমি দুদিন পরে যেতাম! তোমার যাওয়া তো হলো না, মাঝখান থেকে দাদার খুব অসুবিধা হয়ে গেলো। এদিকে অফিস ওদিকে হসপিটাল কোনটা ছেড়ে কোনটা করবে বলো দেখি!

অনিন্দিতা মুখ তুললো না, নিচু গলায় বললো,

বলিস না কাউকে, তোর দাদা কাল আসলে ছুটি নিয়েছে ওই জন্যেই! কিন্তু মা জানতে পারলে রাগ করবেন বলে ভয়ে বলছে না! ও তো ভাবে নি ওই ভাবে ফোনটা এসে যাবে হটাৎ! ওর কোনো অসুবিধা হবে না!

অপর্ণা খানিকক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো,

সত্যি দিদিভাই, কি কান্ড!

অনিন্দিতা মুচকি হাসলো,

হাসিস না আর তুই! আমার এখনও ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে!

এই সন্ধ্যে বেলায় ঠান্ডায় ছাদে এসে দাঁড়াস কেনো প্রতিদিন, তুই কি নিজের ভালো মন্দ কিছুই বুঝিস না!

ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিতা ঘুরে তাকালো, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে একবার দেখে নিয়ে আলসে থেকে সরে রাস্তার দিকের আলসের দিকে এগোতে এগোতে বললো,

তোমাকে কতো বার বলেছি মা আমি বাচ্চা নই! সব সময় আমাকে বাচ্চার মতো ট্রিট করো না! বিরক্তিকর লাগে এগুলো! কেনো বোঝনা তুমি?

মিতার মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে পাশের বাড়ির দোতলা়র খোলা অন্ধকার জানলার দিকে তাকালো, বললো,

তুই বাচ্চা নোস বলেই তো চিন্তা হয়! খালি মুখে বলিস তুই জীবনে এগিয়ে গেছিস, পুরনো দিনকে পেছনে ফেলে এসেছিস, কিন্তু আমি তোকে বুঝি! জানি এগুলো কোনোটাই সত্যি নয়!

মিতা মুখে বিরক্তি নিয়ে ঘুরে তাকালো,

কি বোঝো তুমি? কিচ্ছু বোঝো না! দুদিনের জন্যে এসেছি শান্তিতে থাকতে দাও! এমন কোনো সিচুয়েশন তৈরি করো না যে আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হয়!

মিতার মা রাগের গলায় বললো,

তুই যে কেনো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকিস সেটা সবাই বোঝে! কাল ওদের বাড়ির মিনতি রানু কে বলেছে! তুই নাকি ঋজুর বউয়ের সঙ্গে কথা বলেছিস যেচে? রানু এসে বলছিলো আমাকে, ঋজুর মা নাকি মিনতি কে রানুকে বলে দিতে বলেছে যে ওর বউয়ের সঙ্গে যেনো তুই কথা না বলিস!

মিতা ফিরে তাকালো, আক্রোশের গলায় বললো,

তো তোমার রানু এতো ন্যাকা কেনো? ও কিছু বলতে পারলো না? অসভ্য মহিলা একটা, আমি আমার ছাদে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলবো সেটাও উনি ঠিক করবেন নাকি!

ছেড়ে দে না এবার এসব, অনেক তো হলো! ঋজু র বিয়েও হয়ে গেছে, এখন আর ওইসব মনে রেখে কষ্ট পেয়ে লাভ কি! তোর বাবা বলছিলো ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে খুব ভালো দু একটা প্রোফাইল দেখেছে, একবার দেখতে পারিস তো!

মিতার মা কথা শেষ করার সময় পেলো না, মিতা রাগের গলায় বললো,

মা! প্লিজ! বাবা কে এসব বন্ধ করতে বলো! নিজের শরীর খারাপ সেদিকে যত্ন নিতে বলো তাহলে আমার অন্তত কিছুটা চাপ কমবে! দুদিন ছাড়া আর ছুটে আসতে হবে না! আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমিই নিতে পারি, তাতে অন্য কারো মাথা গলানোর প্রয়োজন নেই!

মিতার মায়ের গলায় দুঃখের ছাপ পড়লো,

আমরা তোর ভালোই চাই!

মিতা হাত তুললো,

হ্যাঁ! সেটা আমার থেকে আর কে বেশি জানে! তোমাদের আর ভালো করতে হবে না আমার!

কি বলছিস তুই! ঋজু কতোটা জেদ দেখালো তুই ভুলে গেছিস? তুইও তো নিজের জেদেই দিল্লি চলে গেলি!

বিস্মিত গলায় বললো মিতার মা, মিতা মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, সব দোষ আমার! সবাই তাই বলে, ঋজুও ! আমি আর সহ্য করতে পারছি না! তুমি যাও আমাকে নিজের মতো থাকতে দাও একটু! আর জেনে রেখো, ঋজুর জন্যে আমি বিয়ে করেছি না এটা একটুও নয়, যখন মনে হবে তখন ঠিক করবো!

কবে মনে হবে তোর? কবে একটু শান্তি দিবি তুই আমাদের?

মায়ের রাগের গলাকে মিতা একটুও ধর্তব্যের মধ্যেই আনলো না, তাচ্ছিল্যের গলায় বললো,

ঠিক করবো, আগে ঋজুর মাকে একটু টাইট দিই! মহিলা আমার জীবনটা জ্বালিয়ে দিয়েছে একদম, এবার বউটাকে দিয়ে ওনাকে জ্বালাই একটু!

মিছিমিছি কেনো এসব করতে চাইছিস! নিজের মতো থাক না!

নিজের মতো থাকতে দিলো না তো ওই মহিলা, ছেলে কে কিছুতেই আসতে দিলো না আমার কাছে! একমাসের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিল, পাছে জানতে পেরে আমি এসে কিছু করি!

কিন্তু তখন তো ঋজু কে তুই পাত্তাই দিলি না, ওর নম্বর ব্লক করে দিলি! ও তো অনেক চেষ্টা করেছিলো তখন! যদি ওকে বিয়ে করার ছিলোই তাহলে তো তখনই রাজি হয়ে যেতে পারতিস! দু বছর ধরে এসব করার কি দরকার ছিলো!

বিস্ময়ের গলায় বললো মিতার মা, মিতা ম্লান হাসলো,

আমি ভেবেছিলাম তাতে ও দিল্লি ট্রান্সফার নিয়ে আসবে ঠিক, কিন্তু ও যে এরকম কিছু করবে ভাবিনি! সব ওর মায়ের চাল! কিন্তু আমি ওনাকে ছাড়বো না, শেষ দেখে ছাড়বো এর!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৭
অপর্ণা গত পরশু এসেছে রসুলপুরে, সৌমিক অপর্ণা কে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে, যাওয়ার আগে বলে গেছে সামনের সপ্তাহে আসবে। অপর্ণা যদিও বারণ করেছে,

তুমি এখন এসো না তো! তুমি এলে আমার পড়াশুনার ক্ষতি হয়!

সৌমিক কপট রাগ দেখিয়েছে

তাই নাকি! ঠিক আছে আর আসবো না তাহলে!

জামাই ফিরে যাবার আগে সুপর্ণা জানতে চেয়েছিলেন,

আবার কবে আসবে বাবা?

সৌমিক অপর্ণা কে শুনিয়ে বলেছিলো,

এখন আর আসবো না! পরীক্ষার সময় তো, পড়াশুনার ক্ষতি হতে পারে! পরীক্ষা মিটে গেলে নিয়ে যাবো এসে!

মেয়ে জামাইয়ের খুনসুটি বোঝা সুপর্ণার পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তিনি একটু অবাক হয়েছিলেন,

ওমা! তুমি তো একদিনের জন্যে আসবে তাতে আবার পড়ার কি এমন ক্ষতি হবে! না,না, তুমি অবশ্যই এসো, আমরা একা একা থাকি, আমাদের খুব ভালো লাগবে!

অপর্ণার ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে সৌমিক শাশুড়ির কথায় সম্মতি জানিয়েছে, কথা দিয়েছে সে প্রত্যেক সপ্তাহে কষ্ট করে হলেও একদিনের জন্যে অবশ্যই আসবে!

চা নে, আটটা বেজে গেছে! ওঠ এবার!

কম্বল থেকে মুখ বার করে ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েই আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো অপর্ণা, কতো দিন এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় নি ও! সুপর্ণা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়েছিলেন, মেয়ের ভঙ্গি দেখে মুচকি হেসে বললেন,

এই তো কাল শুনলাম তুই নাকি মাঝে মাঝে ভোর বেলা উঠে তোর জা কে রান্নায় সাহায্য করেছিলি! এই তার নমুনা!

অপর্ণা উল্টোদিকে ফিরেই জবাব দিলো

হ্যাঁ, করেছি তো! বিশ্বাস না হয় তুমি দিদিভাই কে জিজ্ঞেস করে দেখো! তবে এখানে এসে একটু ঘুমাবো না! এখন তো পরীক্ষার দেরি আছে প্রায় এক মাস!

রমেন বাবু ইদানিং অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন, টুকটাক বাইরে বেরোতে অসুবিধা হয়না এখন। মাত্র কিছুক্ষন আগেই বাগানে হাঁটাহাঁটি করে ঘরে ঢুকেছিলেন, মা মেয়ের কথোপকথন শুনে উঁকি দিয়ে বললেন,

আহা! ঘুমাক একটু! এতদিন কতো ভোরে উঠেছে, আবার ফিরে গিয়েই তো ভোরে উঠতে হবে হয়তো!

সুপর্ণা হাসলেন,

ওই যে এলেন! কেউ তোমার মেয়েকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে দিচ্ছে না!

অপর্ণা পাশ ফিরে খাটে উঠে বসলো,

বাবা এসোনা! গল্প করি একটু!

আজ অনেকদিন পরে বাড়িতে খুশির হওয়া বইছিল, রমেন বাবু সেই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। স্বামী কে খাটে বসতে দেখে সুপর্ণা নিজেদের চা এখানেই নিয়ে এলেন। মেয়ের পাশে চায়ের কাপ নিয়ে বসে বললেন,

হ্যাঁরে, ওই বাড়িতে সব ঠিক আছে তো? আর সৌমিকের বাবার পড়ে যাওয়া নিয়ে তোকে কেউ কিছু বলে নি তো?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

না! এবার যে দিন কুড়ি ছিলাম তাতে তো কিছু গন্ডগোল হয় নি তাই আপাতত কেউ কিছু বলেনি আর! দু একবার সৌমিকের জামাইবাবুর শরীর খারাপ হয়েছিলো বলে ওর মা বলছিলো তবে সেরকম কিছু নয়! তবে তোমাকে তো বলেছিলাম, আমার ফিরে যাওয়া নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে! সৌমিক আর ওর মায়ের কথা বন্ধ ছিলো অনেক দিন! শেষ পর্যন্ত ওর মাসি যাওয়ার আগে ভাব করিয়ে গিয়েছিলো!

সুপর্ণা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

শোনো তুমি কিন্তু বেশি জেদ দেখাবে না ওখানে, যেটুকু তোমার শাশুড়ি বলবেন সেটুকু মানিয়ে নেবার চেষ্টা করবে বুঝলে! সব সময় মনে রাখবে যে সয় সে রয়! তোমার যা জেদ, আমি তোমাকে নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে থাকি সব সময়!

অপর্ণা বিরক্ত হলো,

দেখেছো বাবা! মা সব সময় এক কথা বলে! আচ্ছা তুমি বলতো অন্যায় এর প্রতিবাদ করা কে কি জেদ বলে? দিদিভাই তো আমার থেকে খুব বেশি বড়ো নয়, ওর কি প্রতিদিন ভোরে উঠতে ভালো লাগে? আমার একটু হেল্প করতে ইচ্ছে হতো কিন্তু উনি কিছুতেই সেটা করতে দেবেন না! প্রত্যেকের কাজ নাকি আলাদা! সামান্য চা করেছিলাম বলে কতো রাগারাগি করলেন সেদিন, আমাকেও বকলেন, দিদিভাই কেউ বকলেন!

সুপর্ণা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,

তোর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াই ঝকমারি! এই জেদের জন্যে কতো বিপদে পড়িস তাও তোর শিক্ষা হয়না কিছুতেই!

রমেন বাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন,

তুমিও তো বড্ড কথা ধর! ঠিকই তো বলেছে ও, অনিন্দিতাও তো একটা বাচ্চা মেয়ে! ওর কি সব সময় কাজ করতে ভালো লাগে নাকি!

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই অপর্ণার বন্ধু সৃজা এসে ঢুকলো, তাকে ঢুকতে দেখে অপর্ণা উঠে পড়লো,

মা, আমরা বেরোচ্ছি একটু, বাজারের দিকে যাবো, ওর কিছু কেনাকাটা আছে!

সুপর্ণা অবাক হলেন,

ওমা! এই সাতসকালে বাজারে যাবি খালি পেটে! মুখে কিছু দিয়ে যা অন্তত!

অপর্ণা ঘরের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো ওখান থেকে তৈরি হতে হতে উত্তর দিলো,

নাহ! ওখানে কিছু খেয়ে নেবো, তুমি চিন্তা করো না!

সুপর্ণা আর কিছু বলার আগেই অপর্ণা ছুটে বেরিয়ে গেলো, মেয়ের জন্যে মেখে রাখা লুচির ময়দা ফ্রিজে তুলতে তুলতে সুপর্ণা বিরক্ত হলেন,

মেয়েটা আর বড়ো হলো না, কি করে যে শ্বশুর ঘর করবে কে জানে! ওকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয় আমার, কোনো কথা শোনে না একদম! কে জানে স্বপন টা আবার বাজারে আছে নাকি!

রমেন বাবু নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে খাটের ধারে গা এলিয়ে দিলেন,

তুমি মিছিমিছি দুশ্চিন্তা করো সব সময়! সৌমিক তো ওর বন্ধু কে দিয়ে স্বপন কে ভয় দেখিয়েছে! আর জেনেশুনে ও অপর্ণার পেছনে লাগবে কখনো, ওর কি প্রাণের ভয় নেই! তুমি জানো না সৌমিকের ওই বন্ধুটি কতো বড়ো পোস্টে আছে পুলিশে!

বাজার পর্ব শেষ হলো, দু হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফেরার সময় অপর্ণার সঙ্গে স্বপনের দেখা হলো, সে তখন একটা চায়ের দোকানের সামনে বাইকের ওপরে বসে ছিলো। দূর থেকে তাকে দেখেই সৃজা অপর্ণা কে কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো,

ওই দ্যাখ! তোর একনিষ্ঠ প্রেমিক বসে আছে! বেচারা তোর বরের ভয়ে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না তোর দিকে!

অপর্ণা মুচকি হাসলো,

রবি দা বেশ ভালোই ডোজ দিয়েছে মনে হচ্ছে!

সৃজা হটাৎ করেই সামনে এগিয়ে গেলো, অপর্ণা আটকানোর আগেই স্বপনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দোকানদার কে উদ্দেশ্য করে বললো,

দাদা! দু কাপ চা দিন তো!

সৃজার গলা শুনে স্বপন পেছন ফিরে তাকিয়ে অপর্ণা কে দেখেই চমকে গেলো, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বললো,

কেমন আছো?

অপর্ণার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

ভালো! তুমি কেমন আছো?

স্বপন মাথা হেলালো,

ভালো! তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো অপর্ণা, একটু কথা বলা যাবে?

অপর্ণা কিছু বলার আগেই সৃজা এগিয়ে এলো,

হ্যাঁ, হ্যাঁ! কেনো বলা যাবে না? বলো না কি বলবে?

স্বপন চায়ের দোকান থেকে একটু সরে এলো,

তোমার হাজব্যান্ড কি পুলিশে চাকরি করেন? এখানের থানায় ওনার চেনাজানা আছে?

অপর্ণা কি উত্তর দেবে ঠিক করতে পারছিলো না, সৌমিক নয় ওর বন্ধু পুলিশে চাকরি করে জানলে কি স্বপনের সাহস আবার বেড়ে যেতে পারে! ওর অন্য মনস্ক ভাবের মধ্যেই সৃজা কোনো কিছু না জানার ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ করে তো! তুমি কি করে জানলে?

স্বপন একটু থতমত খেলো,

ওই এখানকার ওসি সাহেব বলছিলেন সেদিন, উনি আমার পরিচিত তো!

অপর্ণা স্বপনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,

কি বলতে চাও, সেটা বললে না তো!

স্বপন তড়িঘড়ি উত্তর দিলো,

হ্যাঁ, যা বলছিলাম! স্যার কে বলো আমি সমর কে মারিনি! উনি মিছিমিছি আমাকে ফাঁসাতে চাইছেন! আমি ভদ্রলোক না হতে পারি, তবে খুনি নই!

সৌমিক কে স্যার বলতে শুনে অপর্ণার হাসি পেয়ে গেলো, তাও নিজেকে সামলে নিয়ে সে গম্ভীর গলায় বললো,

আচ্ছা, ঠিক আছে, বলে দেবো!

বাজার ছাড়িয়ে স্টেশনের পথে ঢুকে দুই বন্ধু হেসে গড়িয়ে পড়ছিলো, কিছুক্ষন হাসাহাসি চলার পরে অপর্ণা হটাৎ করেই চুপ চাপ হয়ে গেলো। তাকে চুপ করে যেতে দেখে সৃজা অবাক হলো,

তোর কি হলো হটাৎ? কি ভাবছিস?

অপর্ণা অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে বন্ধুর দিকে তাকালো,

আচ্ছা! ওকি সত্যি কথা বলছে বলে মনে হয় তোর? যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে সমরের এতো বড়ো ক্ষতি কে করলো বলতো?

সৃজাও দাঁড়িয়ে পড়লো, চিন্তিত গলায় বললো,

এটা না আমারও মনে হচ্ছিলো তখন থেকে! যদি ও না করে থাকে তবে করলো কে! একটা কাজ করলে হয় না, সৌমিক দা কে বলনা ওর বন্ধু কে দিয়ে খোঁজ খবর করতে!

অপর্ণা কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে বললো,

আগেও ভেবেছি বলবো ওকে, কিন্তু কেমন যেনো অস্বস্তি হয় জানিস তো! মনে হয় ওর যদি খারাপ লাগে!

ধুস! খারাপ লাগার কি আছে! যদি সমর বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো খারাপ লাগার ব্যাপার ছিলো! কোনো বর কি তার বউয়ের পুরনো প্রেমিকের খবর নিতে পারে! কিন্তু এটা তো সেই রকম ব্যাপার না! জানতে তো ইচ্ছে হতেই পারে তাই না?

অপর্ণা আর কিছু বললো না, হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলো ঘটনাটা। আজ যদি ও সৌমিকের জায়গায় হতো, মিতার কোনো ঘটনায় মাথা ঘামাতে পারতো তো! সৌমিক কি রাগ করবে ওর ওপরে! এমনিতেই সেদিনের স্বপ্ন দেখার পরে সৌমিক কে বলাতে সৌমিক বিরক্ত হয়েছিলো একটু! হটাৎ করেই সেদিনের স্বপ্ন টা মনে পড়লো, রসুলপুরের দৃশ্যই তো দেখেছিলো স্বপ্নে! দাঁড়িয়ে পড়ে সৃজা কে বললো,

এই চল না, স্টেশনের পাশ দিয়ে ঘুরে যাই! জানিস কদিন আগেই আমি স্বপ্নে দেখেছি জায়গাটা কে!

সৃজা হাসলো,

স্বাভাবিক! এতো বছর যেখানে কাটিয়েছিস, সেটা তো স্বপ্নে আসবেই! তো কি দেখলি?

অপর্ণা অন্য মনস্ক হয়ে তাকালো,

সমর কে! ও বলছিলো আমি ওকে ভুলে গেছি!

সৃজা মাথা নাড়লো,

ছাড় ওসব! সৌমিক দা খুব ভালো ছেলে, সমরের থেকেও আমার ওকে অনেক বেশি ভালো লেগেছে! তোকে একটা কথা বলিনি কখনো, তুই দুঃখ পাবি বলে, আমি সমর কে তুই না থাকলে ট্রেনে অন্য মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছি!

অপর্ণার হটাৎ করেই রাগ হলো,

ফালতু কথা বলিস না, সমর ওরকম ছেলে ছিলো না! আর আমি না থাকলেও ও তোর সামনেও কখনো এরকম কাজ করতো না, কারণ ও জানতো তুই আমাকে বলে দিতে পারিস!

সৃজা ম্লান হাসলো,

এই জন্যেই তোকে বলিনি কখনো, জানতাম তুই বিশ্বাস করবি না! সমর আমার সামনে করেনি কখনো, কিন্তু আমি লেডিজ কামরার নেট দিয়ে ওকে পাশের কম্পার্টমেন্টে দেখতে পেয়েছি বেশ কয়েক বার! ও খেয়াল করেনি আমাকে!

অপর্ণার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো, সমর ও বাদেও অন্য আরো মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করতো এটা জেনে ওর খারাপ লাগছিলো। একটু চুপ করে থেকে বললো,

তুই ওই মেয়েগুলো কে চিনিস?

সৃজা ঘাড় নাড়লো,

নাহ! তবে ট্রেনেই যাতায়াত করে দু একজন এখনও, আমাদের দু একটা স্টেশন আগে থেকে ওঠে মনে হয়! কোথায় নামে সেটাও জানিনা! বোধহয় ওদের মধ্যে একজন চাকরি করে কারণ তাকে আমি শুধু সোমবার যেতে আর শুক্রবার ফিরতে দেখেছি! অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি না আর তাকে!

আর বাকি মেয়েগুলো?

অপর্ণা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, সৃজা হাসলো,

এখন আর জেনে কি করবি? এখন তো আর সমর নেই! তবে একজন কে মাঝে মাঝে বাজারের বাস স্ট্যান্ডে নামতে দেখি এখনও, তুই চাইলে দেখাবো একদিন!

পাড়ায় ঢুকে সৃজা নিজেদের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পরে অপর্ণা ঘরে ঢুকে এলো, সুপর্ণা তখন লিস্ট তৈরি করেছিলেন, মেয়ে কে দেখেই বললেন,

এখানে একটু বস তো মা! দেখতো সব ঠিক আছে কিনা!

অপর্ণা মায়ের পাশে বসে পড়লো, নাম লেখা কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে বললো,

এটা কিসের লিস্ট মা?

সুপর্ণা হাসলেন,

ওই সকালে মনার মা এসেছিলো! সেই কবে থেকেই তো সব বিয়ের খাওয়া বাকি থেকে গিয়েছে বলে পেছনে পড়ে আছে! তাই ভাবলাম এখন তো কোনো অসুবিধা নেই, পরীক্ষা মিটে গেলে ওদের একটু খাইয়ে দি! সৌমিক তো প্রতি সপ্তায় আসবে মোটামুটি, তোর পরীক্ষা শেষ হলে, ওর বাড়ির লোকেদের নিয়েও আসতে বলবো একেবারে! তোর শাশুড়ি কে ফোন করে বলে দেবো আগে থেকে, অনুষ্ঠান হয়ে গেলে একেবারে তোকে নিয়েই না হয় ফিরে যাবেন!

অপর্ণা হাসলো,

ও আচ্ছা! কিন্তু আমার ননদ কেউ বলতে হবে কিন্তু! আমি সৌমিক কে বলে দেবো তাহলে!

রমেন বাবু এতক্ষন খাটে বসে শুনছিলেন এবার তাড়াতাড়ি মেয়ে কে বাধা দিলেন,

না, না, তোমাকে এখন কিছু বলতে হবে না, আগে তোমার মা ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলুক! আগের বার উনি বিরক্ত হয়েছিলেন তুমি আগে বলেছিলে বলে, এবার আর কোনো বিতর্ক তৈরি করো না!

অপর্ণা অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলো, সৌমিকের সঙ্গে যখন বিয়ের ঠিক হয়েছিলো তখন তার বিয়ের কোনো ইচ্ছে ছিলো না, তাই সেই সময় বিয়ের আনন্দ সে উপভোগ করতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য রকম, নতুন করে আর একটা অনুষ্ঠানের সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাইছিলো না, সে তাড়াতাড়ি নিজের হাতের ফোনটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিলো,

মা! এক্ষুনি বলো না! এখন তো সবাই অফিসে বেরিয়ে গেছে, শাশুড়ি ফ্রি আছেন নিশ্চয়ই!

সুপর্ণা মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে ডায়াল করলেন, বেয়ানের গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র বিনীত গলায় বললেন,

দিদি! ভালো আছেন তো? দাদা কেমন আছেন এখন?

রীনার কাছে সকলের কুশল সংবাদ নেবার পরে সুপর্ণা কাজের কথা পাড়লেন,

যাক! দাদা ভালো আছেন শুনে নিশ্চিন্ত হলাম! শুনেছেন নিশ্চয়ই অপর্ণার পরীক্ষা সামনের মাসের দশ তারিখে শেষ হয়ে যাবে? ও তো বলেছে নিশ্চয়ই আপনাকে! সৌমিক তো সপ্তাহে সপ্তাহে আসবেই তাই আমি ভাবছিলাম যদি এই সুযোগে আপনারা সবাই আসতেন তাহলে রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হতো! সৌমিক অপর্ণার বিয়ের খাওয়া টা পাড়া পড়শী দের খাইয়ে দিতাম একটু!

রীনা কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে বললেন,

হ্যাঁ, শুনেছি অপর্ণার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমি ওর আসার দিনের ব্যাপারে এখনও পুরুত মশাইয়ের সঙ্গে কিছু আলোচনা করিনি! তবে আপনি আপনার মতো অনুষ্ঠান করতেই পারেন, ওর আসা না আসার সঙ্গে তো এর কোনো যোগ নেই!

সুপর্ণা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন,

তাহলে দিদি দশ তারিখের পরের সপ্তাহেই করে ফেলি? সৌমিক তো প্রতি শনিবার আসবেই বলেছে ওকে আর আলাদা করে ছুটি নিতে হবে না তাহলে।

রীনা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন,

আমার অনুমতি নেওয়ার কি কোনো প্রয়োজন আছে আর? ছেলের সঙ্গে তো সব আলোচনা করেই ফেলেছেন বোঝা যাচ্ছে!! আমার ছেলের মত ছেলে তো একটাও ছিলো না, যেকোনো ব্যাপারে ওর থেকে দায়িত্বশীল আর কেউ ছিলো না। তার ওপরে আমি চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারতাম! কিন্তু এখন যা বুঝছি আপনার মেয়ে এখানে না ফেরা পর্যন্ত তো তাকে আর কোনো কাজে পাওয়া যাবে না!! তাই সে কবে ছুটি নেবে সে ব্যাপারে নাহয় তার সঙ্গেই আলোচনা করে নিন!

ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিলো ফলে রীনার কথা সবার কানেই পৌঁছলো, রমেন বাবু তাড়াতাড়ি স্ত্রীর হাত থেকে ফোন টেনে নিয়ে বললেন,

এরকম ভাবে বলবেন না দিদি, আপনিই তো সব! আপনার অনুমতি ছাড়া কি কিছু হতে পারে কখনো? আর সৌমিক ছেলে মানুষ, ও হয়ত অতো ভেবে কিছু বলেনি, ওকে বুঝিয়ে বললেই বুঝবে! ওর আসাটা যতোটা জরুরি, আপনাদের আসাটাও ঠিক ততটাই জরুরি আমাদের কাছে, তাই আপনার সুবিধামতই দিন করতে চাই আমরা।

রমেন বাবুর নরম গলায় রীনা প্রীত হলেন, গলায় গাম্ভীর্য এনে বললেন,

সেসব তো ঠিক আছে বেয়াই মশাই কিন্তু ঋজুর বাবা তো এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি সেটা আপনি জানেন নিশ্চয়ই! তাই তার পক্ষে তো যেখানে সেখানে রাত কাটানো সম্ভব নয়, আপনারা থাকার জন্যে কি ব্যবস্থা করছেন? কোনো হোটেল বুক করছেন কি?

রমেন বাবু অসহায় বোধ করলেন,

হোটেল? আসলে জায়গাটা তো খুব ছোটো আপনি জানেনই, এখানে থাকার মতো কোনো হোটেল নেই!

তাহলে আপনারা কোনো অনুষ্ঠানে গেস্টদের কিভাবে রাখেন? আপনাদের তো শুনেছি রেলের কোয়ার্টার?

রীনার গলায় হালকা তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া রমেন বাবুর কানে পৌঁছালেও তিনি সেটা না শোনার ভান করে বললেন,

এখানে আমরা সবাই রাতে অতিথিকে এর ওর বাড়িতে রাখতেই অভ্যস্ত দিদি, সবারই তো ছোটো ছোটো ঘর তাই এসব নিয়ে এখানে কেউ মাথা ঘামায় না, এই তো বছর তিনেক আগেই আমার কয়েকটা বাড়ি পরেই একজনের মেয়ের বিয়ে হলো, আমি তো নিজেই বরযাত্রীর জন্যে আমার সম্পূর্ন বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যের বাড়িতে ছিলাম। এগুলো কোনো সমস্যাই নয় দিদি, আপনারা আসুন তো, থাকার কোনো সমস্যা হবে না!

এর ওর বাড়িতে থাকতে হবে! কি যে বলেন বেয়াই মশাই, এসব আবার আজকের দিনে হয় নাকি! কিছু মনে করবেন না আমরা এভাবে কখনো থাকিনি তো তাই আমাদের পক্ষে এরকম ভাবে থাকা সম্ভব নয়! আপনি বরং আপনার মেয়ে, জামাই কে নিয়েই অনুষ্ঠান করুন, আমাদের বাদ দিয়ে দিন! তাছাড়া আমার ছেলেও যে কি করে ওখানে ওই টুকু জায়গার মধ্যে রাত কাটায় কে জানে, এখন বুঝতে পারছি ওরও তো তারমানে যথেষ্টই অসুবিধা হয়, হয়ত মুখে প্রকাশ করে না!

কথাগুলো বলেই রীনা ফোন নামিয়ে রাখলেন, রমেন বাবু হতভম্ব হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। সুপর্ণা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মেয়েকে বললেন,

সৌমিক তোকে কখনো বলেছে নাকি এসব নিয়ে? ওর কি এখানে থাকতে অসুবিধা হয় নাকি?

অপর্ণা রাগে ফুঁসছিলো, মাথা নাড়িয়ে বললো

না তো! কখনো কিছু বলেনি!

সুপর্ণা স্বামীর দিকে তাকালেন,

ওনারা না এলে কি ব্যাপারটা ভালো দেখাবে? তার থেকে বরং অনুষ্ঠান বাতিল করে দিই!

রমেন বাবু কিছু বলার আগেই অপর্ণা উঠে দাঁড়ালো,

না, যার ইচ্ছে হবে না আসবে না, তাই বলে আমরা বাতিল করবো কেনো? আমি সৌমিক কে বলছি ও এলেই হবে অনুষ্ঠান!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৮
অপর্ণা যদিও বলেছিলো শ্বশুরবাড়ি কে বাদ দিয়েই অনুষ্ঠান হবে কিন্তু সেটা করা রমেন বাবুর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ইতিমধ্যেই প্রায় দিন কুড়ি কেটে গেছে, সৌমিক এসে ফিরে গেছে বার দুয়েক। অপর্ণার পরীক্ষা শুরু হয়ে প্রায় শেষের পথে, প্রথম দিন সৌমিক সঙ্গে ছিলো, তারপর থেকে অপর্ণা সৃজার সঙ্গেই যাতায়াত করছে। মাত্র কিছুদিন হলো রমেন বাবুও কাজে যোগদান করেছেন, অস্থায়ী স্টেশন মাস্টার অন্য জায়গায় চলে গেছেন। অপর্ণা বা সুপর্ণা তাদের সুবিধা মতো স্টেশনে খাবার পৌঁছে দিয়ে যায় প্রতিদিন।

আজ অপর্ণা ছিলো না, তার পরীক্ষা ছিলো, সে পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সুপর্ণা খাবার নিয়ে স্টেশনে পৌঁছলেন। তিনি যখন স্টেশনে পৌঁছলেন তখন সবে মাত্র ট্রেন বেরিয়েছে, স্টেশনে মোটামুটি একটা ছোটো খাটো ভীড়, সেই ভীড়ের পাস দিয়ে বেরোনোর সময় পরিচিত গলায় বৌদি শুনে সুপর্ণা থমকে দাঁড়ালেন, তাকিয়ে দেখলেন সামনেই রবীন বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন বাবুর বাজারে জামা কাপড়ের চালু দোকান আছে, তিনি এবং তাঁর বাবা দুজনেই সেখানে বসেন। মাঝে মাঝেই সুপর্ণা সেই দোকান থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন। রবীন কে দেখে সুপর্ণা হাসলেন,

কি খবর দাদা, অনেকদিন পরে দেখলাম!

রবীন ঘাড় কাত করলেন,

এই চলে যাচ্ছে বৌদি, দাদার খাবার নিয়ে এলেন নাকি? দাদা এখন জয়েন করেছেন?

সুপর্ণা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন,

হ্যাঁ, এখন একদম সুস্থ! ভালোই হলো আপনার সঙ্গে দেখা হলো, মেয়ের বিয়েতে তো নিমন্ত্রণ করতে পারিনি, এখানে একটা ছোটো করে অনুষ্ঠান করছি দিন পনেরো পরে তাই আপনাকে বলতে যেতাম। বাবা, মা, স্ত্রী সবাই কে নিয়ে আসবেন কিন্তু! আর আমারও মেয়ের জন্যে একটা শাড়ি কেনার আছে যাবো একদিন, সেদিন কাকাবাবু কেও বলে আসবো নিজে!

রবীন ঘাড় কাত করলেন,

নিশ্চয়ই আসবো বৌদি, তবে বাবার পক্ষে তো আসা সম্ভব নয়, বাকিদের নিয়ে আসবো সঙ্গে!

সুপর্ণা একটু অবাক হলেন,

কাকা বাবু অসুস্থ নাকি! জানতাম না তো! আসলে আমিও তো মেয়ের বিয়ে, স্বামীর অসুস্থতা নিয়ে যা ব্যস্ত ছিলাম, বাজারের দিকে যাওয়া হয়েই ওঠে নি!

তাঁদের কথা বার্তার মধ্যেই রমেন বাবু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, রবীন কে দেখে বললেন,

রবীন! ভালোই হলো তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে! আমার একটা দরকার ছিলো! এসো একটু ঘরে এসে বসে যাও, তাড়া আছে নাকি?

রবীন মাথা নাড়লেন,

নাহ! চলুন!

সুপর্ণা রবীন এর পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

কাকাবাবু নাকি অসুস্থ, আমরা তো জানতেই পারিনি!

রমেন বাবু অবাক হলেন,

তাই নাকি! এ হে! তাহলে তো তোমাকে আটকে রাখা আমার উচিত হচ্ছে না!

রবীন চেয়ার টেনে বসতে বসতে হাসলেন,

আরে না, না! সেতো বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে, এখন তো ওই ভাবেই আছে আর তো নতুন করে কোনো কিছু করার নেই, দু ঘন্টা পরে গেলে কোনো ক্ষতি হবে না! আপনি বলুন না কি জন্যে খুঁজছিলেন আমাকে?

রমেন বাবু চিন্তিত গলায় বললেন,

বুঝলে তো মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো অনুষ্ঠানে আসবে, ওদের রাখার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছি না। ওরা কলকাতার মানুষ, আমাদের মতো বিভিন্ন লোকের বাড়িতে রাত কাটানো ওদের পক্ষে সম্ভব নয়! এখানে তো থাকার মতো কোনো হোটেল বলেও কিছু নেই, কি যে করি!

রবীন খানিকক্ষন ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন, তারপর বললেন,

হোটেল তো এখানে পাবেন না দাদা, তবে একটা বাড়ি আছে, ঠিক আমার বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই। বাড়িটার এক তলায় একটা কম্পিউটার সেন্টার চলে, তার ওপরে নতুন দোতলা উঠেছে, ওটাও ভাড়াই দেবে মনে হয় তবে এখনো কিছু হয়নি! দুটো ঘর, বাথরুম আছে দু একদিন থাকতে অসুবিধা হবে না, দেখতে পারেন একবার গিয়ে!

রমেন বাবু এবং সুপর্ণা দুজনেই উৎসাহিত হলেন, রমেন বাবু আর দেরি করতে চাইলেন না,

ঠিক আছে, কালই যাবো তাহলে, তুমি মালিক কে বলে রেখো একটু!

পরের দিন অপর্ণার পরীক্ষা ছিলো না, সুপর্ণা তাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি দেখতে গেলেন। বাড়ি সবারই যথেষ্ট পছন্দ হলো, নতুন ঝকঝকে একবারও ব্যবহার না করা ঘর, বাথরুম হোটেলের থেকে কোনো অংশে কম ছিলো না! পাশেই দোকান থেকে খাট, বিছানা ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন রবীন, কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পরে সুপর্ণা কে নিজের বাড়িতে ডাকলেন। সুপর্ণা নিজেও যেতে ইচ্ছুক ছিলেন, রবীন বাবুর বাবাকে আসতে না পারলেও গিয়ে নিমন্ত্রণ করার ইচ্ছে ছিলো তাঁর।

বাড়িতে ঢুকে শয্যাশায়ী ভদ্রলোক কে দেখে অপর্ণার খারাপ লাগলো, মাত্র কিছুদিন আগেই ওঁকে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা সামলাতে দেখেছে সে। কথা বন্ধ, একটা দিক প্যারালাইসিস হয়ে গেছে, কোনো রকমে বাম হাতটা নাড়াতে পারেন। সুপর্ণা সামনে চেয়ার নিয়ে বসলেন, কিভাবে হলো, কখন হলো, এসব কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। পাশেই রবীন বাবুর স্ত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন, এইসব কথা বার্তা চলা কালীন গম্ভীর হয়ে বললেন,

আর কি! একটাই তো লোক! নিজেও গেছে, আর কতো লোক কে যে পথে বসিয়ে গেছে!

অপর্ণা চমকে তাকালো, সুপর্ণা বুঝতে না পেরে বললেন,

কার কথা বলছেন?

রবীন বাবু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

ওই সমর চৌধুরী! আর কে! ছেলেটা ভালো ছিলো, কিন্তু শুধু মাত্র নিজের মূর্খামির জন্যে নিজেও গেলো, অন্যকেউ পথে বসিয়ে গেলো। লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছিলো মাল আনার জন্যে, দু একজন কে দিতে পেরে ছিলো, বাকিদের দেবার আগেই তো খুন হয়ে গেলো!

পাছে আবার নিজের মেয়ের প্রসঙ্গ এসে পড়ে তাই সুপর্ণা কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন,

হ্যাঁ, সেতো শুনেছি! কি আর করা! আপনাদেরও কিছু গেছে নাকি?

রবীন বাবুর স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

কিছু? অনেক! তাও শুধু টাকা গেলে একরকম ছিলো, বাবার অবস্থা টা কি হলো দেখুন! অতগুলো টাকা যাওয়ার চিন্তায় স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো একদম!

রবীন মাথা নাড়লেন,

আমরা তাও কিছুটা সামলে নিয়েছি, বাকিদের অবস্থা খুব খারাপ। দুজন কে তো ব্যবসা বন্ধই করে দিতে হলো বাধ্য হয়ে! আমি অবশ্য আর ওই সব বরাত দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, এখন নিজেই কলকাতায় গিয়ে মাল তুলে আনি। পরিশ্রম খুব বেশি হয়, কিন্তু লাভের গুড় তো আর পিঁপড়ে তে খেয়ে যায়না!

রমেন বাবু চিন্তিত গলায় বললেন,

টাকা পয়সা শুনেছি কিছুই পাওয়া যায়নি, সব বার করে নিয়েছে বোধহয়!

রবীন ঘাড় নাড়লেন,

নেবে না? অতো টাকা কেউ সঙ্গে নিয়ে যাতায়াত করে একা? কতো বার বলেছি যেদিন টাকা সঙ্গে থাকবে সেদিন কাউকে সঙ্গে নিয়ে এসো! তা ছেলের এক কথা, পার্টনার নাকি অসুস্থ, আসতে পারে না! তাই ওকেই লেনদেন করতে হয়!

অপর্ণা মনে মনেই চমকালো একটু,

পার্টনার! সমরের ব্যবসার পার্টনার ছিলো! ওকে তো কখনো বলেনি সমর! সব সময় বলতো অপর্ণা চাকরি পেলেই ও ব্যবসা ছেড়ে দেবে! অপর্ণার অন্য মনস্কতার মধ্যেই রমেন বাবু প্রশ্ন করলেন,

তা সেই পার্টনারের কাছ থেকেই তো টাকাটা পেতে পারতেন আপনারা, খোঁজ নেননি তার?

রবীন মাথা নাড়লেন,

আর কি বলি দাদা কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি! সেই পার্টনার তো বরাবরের অসুস্থ ছিলো, তার কেউ ছিলো না, সমরই তো দেখাশোনা করতো শুনেছিলাম! সমর মারা যাবার মাস দুয়েক আগে সেও মারা গিয়েছিলো। নিজেই একদিন এসে বলেছিলো সেকথা, আমি উল্টে বলেছিলাম সব কিছু ঠিকঠাক করে নেবার কথা! ও তো নিজের নামে ব্যবসাটা করে নেবার চেষ্টা করছিলো তখন, আমি আমার চেনা এক উকিলের সন্ধানও দিয়েছিলাম, গিয়েছিলো তো সেখানে। তবে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে, এতো ভালো ছেলেটার এতটা ক্ষতি কে যে করলো! খুব পপুলার ছিলো ছেলেটা, কলকাতার যেকোনো দরকারে ওই তো এগিয়ে আসতো! কতো লোকের কতো প্রয়োজনের জিনিস যে সপ্তায় সপ্তায় নিয়ে আসতো কলকাতা থেকে! টাকাগুলো গেছে দুঃখ নেই দাদা, কিন্তু ছেলেটার জীবনটা যে চলে গেলো ওটাই খুব দুঃখের!

অপর্ণা মনে মনে দুঃখিত হচ্ছিলো, এতো কথা সমর ওকে কখনো বলেনি! এগুলো কি ভাবি স্ত্রী হিসেবে ওর জানার অধিকার ছিলো না! মনে মনে অভিমানও হচ্ছিলো খুব, কোথায় সেই মেয়েগুলো যাদের সঙ্গে সমর ও না থাকলেই কথা বলতো! সমর কি ওকে অনেক কিছু লুকিয়ে গিয়েছে তাহলে, যেগুলো ও জানতে পারেনি কিছু!

বাড়ি ফিরে আসতে আসতে অপর্ণা এসব মন থেকে বার করে দিলো, যে নেই তাকে নিয়ে ভাবার চেয়ে পরীক্ষা নিয়ে ভাবা এই মুহূর্তে অনেক বেশি জরুরি ছিলো। কয়েকদিনের মধ্যেই পরীক্ষা পর্ব শেষ হলো, সুপর্ণা রীনা কে ফোন করলেন, বাড়ির খবর জানিয়ে বললেন,

দিদি! হোটেল ব্যবস্থা না করতে পারলেও যা করেছি তাতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না! আপনারা অনুষ্ঠানে না এলে আমরা খুব দুঃখ পাবো, আর আপনার ছেলে, আপনি না এলে কি হয়!

সমস্ত কিছু ভালো করে শুনে রীনা প্রীত হলেন, বললেন,

তাহলে একটু অপেক্ষা করুন, আমি ঠাকুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিই! সেই মতো অনুষ্ঠান করবেন যাতে অপর্ণা পরের দিন আমাদের সঙ্গেই ফিরতে পারে!

সুপর্ণা সহমত হলেন, সেই মতো পুরুত মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানের দিন গাড়ি নিয়ে অপর্ণার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলো, কথা হলো পরের দিন তাঁদের সঙ্গেই অপর্ণা ফিরে যাবে! রমেন বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের বাজারের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করলেন। বাড়ি দেখে তাঁদের পছন্দ হওয়ায় এই নিয়ে আর কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকলো না।

সন্ধ্যে বেলায় মুখে ছোটো বললেও ওখানে যতটা করা সম্ভব ছিলো রমেন বাবু তার কোনোটাই বাদ দিলেন না, বিয়ের সময় নিজের অসুস্থতার জন্যে করতে না পারা সব শখই পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। অপর্ণাও আগের বারের বাকি থাকা সব শখ পূরণ করার চেষ্টা করলো। রাতে খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পরে অপর্ণা শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে বাজারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো, এমনিতেও তার মামা মামী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে আসায় বাড়িতে এতলোকের থাকার জায়গা ছিলো না। পরের দিন সকালে তাদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আগের দিন অতোটা গাড়ি চালিয়ে আসার ধকলে রত্নার বর রজত আবার অসুস্থ হয়ে পড়লো। রীনা বিরক্ত হলেন,

এই জন্যেই আমি চাইনি রজত ড্রাইভ করুক! কবে থেকে বেচারার শরীর খারাপ, কিন্তু ঋজু শুনলে তো!

সৌমিক রীনার কথা না শুনে দুদিন আগেই ট্রেনে শ্বশুর বাড়ি চলে এসেছিলো, তাই রীনা তার ওপরে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সৌমিক তার স্বভাব মতোই মায়ের বিরক্তি গ্রাহ্য করলো না, উল্টে বিরক্তির গলায় বললো,

রজত দার তো কবে থেকেই শরীর খারাপ, না ডাক্তার দেখায় না রেস্ট নেয়! এরকম তো হবারই ছিলো! কি দরকার ছিলো ড্রাইভ করে এতদূর আসার, একটা ড্রাইভার নিলেই পারতো! এ বেলাটা রেস্ট নিক ঠিক হয়ে যাবে! একটু বেলার দিকে বেরোলেই তো হবে! আর আমি তো চালাবো ওর রেস্ট নিতে অসুবিধা হবে না!

অনিন্দিতা এবং ঋষি অন্য ঘরে ছিলো তাই এক্ষুনি যে ফিরে যাওয়া হবে না এটা তাদের জানা ছিলো না। অনিন্দিতা যাবার জন্যে তৈরী হয়ে নিচে নেমেই শুনলো আজকের যাওয়া কিছুক্ষনের জন্যে পেছানো হয়েছে। অপর্ণা তাকে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,

চলো দিদিভাই তোমাকে আমাদের রসুলপুর দেখিয়ে আনি!

অনিন্দিতা সানন্দে রাজি হলো, ইতিমধ্যে সৃজা এসেছিলো অপর্ণা কে বিদায় জানাতে, যাওয়ার দেরি আছে শুনে সেও সঙ্গী হলো তাদের। রাস্তায় যেতে যেতে অপর্ণা সৃজার সঙ্গে অনিন্দিতার পরিচয় করালো,

দিদিভাই! ও আমার বন্ধু! কিছুদিন পরেই ওর বিয়ে!

অনিন্দিতা হাসলো,

দারুন খবর তো! আমাকেও নেমন্তন্ন করবে কিন্তু!

ছোটো বাজারে খুব কিছু দেখার ছিলো না, তাই হাসি ঠাট্টায় সময় কাটিয়ে ঘণ্টা খানেক এদিক ওদিক ঘুরে যখন তারা ফিরছিলো তখন নিচের কম্পিউটার সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসা একটা মেয়ে কে দেখে সৃজা নিচু গলায় অপর্ণা কে ইশারা করলো,

ওই দ্যাখ! ওই মেয়েটার কথা বলছিলাম! বাস থেকে নেমে তারমানে এখানে কম্পিউটার শিখতে আসে!

অপর্ণা চমকে তাকালো, লম্বা, দোহারা একদম সাধারণ চেহারার মেয়েটির মধ্যে খুব বেশি আকর্ষণীয় কিছু ছিলো না! এই মেয়েটা কে কি সমর ভালোবাসতো! অপর্ণার প্রবল কৌতূহল হচ্ছিলো, ও অনিন্দিতার দিকে ফিরলো,

দিদিভাই তুমি ওপরে ওঠো, আমি আসছি!

অনিন্দিতা কে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে অপর্ণা আর সৃজা মেয়েটির সামনে এগিয়ে গেলো, মেয়েটি রাস্তার এক পাশে সম্ভবত বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলো। অপর্ণা সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হাসলো,

তুমি অপর্ণা না? আমি তোমাকে চিনি!

অপর্ণা বিস্মিত হলো,

তুমি আমাকে চেনো! কি করে?

মেয়েটা চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামালো,

তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে এখন তাই না? শুনেছিলাম আমি! কি বা আর করতে বলো! যে নেই তার জন্যে তো অপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই! তবে সমর দা কিন্তু সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসতো, দেখা হলেই শুধু তোমার কথাই বলতো! খুব ভালো ছেলে ছিলো!

অপর্ণার বুকের ভেতরটা অনেকদিন পরে মোচড় দিয়ে উঠলো, একটু আগেই ও সমরের সঙ্গে মেয়েটা কে জড়িয়ে কতো বাজে কথা ভাবছিলো, নিজেকে খুব ছোটো লাগছে এই মুহূর্তে! অপর্ণা নিজেকে সামলে নিলো, হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা সৃজার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরে বললো,

তুমি সমর কে চিনলে কি করে?

মেয়েটা হাসলো,

সমর দা কে তো সবাই চিনতো এখানে! কতো মেয়ের উপকার করেছে! কলকাতায় চাকরি করে দিয়েছে কতো জনের! আমারই কপালটা খারাপ, কম্পিউটার টা শিখছিলাম, সমর দা বলেছিলো করবে কিছু, কিন্তু তার আগেই তো চলে গেলো!

অপর্ণা অবাক হলো, সমরের এতো ভালো গুণগুলো ওর কাছে সমর কখনো বলেনি! ও ভাবতো ও সমর কে সবচেয়ে ভালো চেনে, আসলে সমর তো ওর কাছে অধরাই থেকে গিয়েছে সারাজীবন! এতো পরিচিতি ছিলো ওর, এতো লোক ওকে ভালোবাসতো! অপর্ণার দু চোখ জলে ভরে আসছিলো, ওকে চোখ মুছতে দেখে মেয়েটা হাসলো, নরম গলায় বললো,

যারা খুব ভালো মানুষ হয় তারা পৃথিবীতে বেশিদিন থাকেনা, ভগবান তাদের নিজের কাছে ডেকে নেন! যারা চলে যায় তাদের জন্যে চোখের জল ফেললে তারা মরেও শান্তি পায় না, যে চোখের জল ফেলে তাকে ছেড়ে যেতে ওদের কষ্ট হয়! তুমি যতো কষ্ট পাবে সমর দা ততো কষ্ট পাবে, কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না! তুমি ওকে ভুলে যাও, নিজেও ভালো থাকবে ও ও ভালো থাকবে তাতে দেখো!

অপর্ণা চোখের জল মুছে হাসলো,

তুমি বুঝি সমর কে খুব ভালোবাসতে?

মেয়েটা এবার নিজেই কেঁদে ফেললো,

খুব! নিজের দাদার থেকেও বেশি ছিলো! আমার মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্যেও টাকা দিয়েছে সমর দা! কোনো দিনও ভাবিনি এরকম হতে পারে ওর সাথে!

বাস আসতে দেখে মেয়েটা এগিয়ে গেলো, অপর্ণার দিকে হাত তুলে বললো,

আসি গো! পরে আবার দেখা হবে কখনো!

মেয়েটা বাসে উঠে পড়ার পরে অপর্ণার খেয়াল হলো এতক্ষন মেয়েটার নামটাই জানা হয়নি! অপর্ণা চিৎকার করলো,

এই তোমার নামটা কি? জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি!

মেয়েটা চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো,

শান্তা!

মেয়েটা চলে যাবার পরে অপর্ণা সৃজার দিকে কড়া চোখে তাকালো,

দেখলি? কিছু বল এবার! কিছু না জেনেই অহেতুক মানুষের নামে দুর্নাম করা! ট্রেনের মেয়েগুলোর খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, তাদের কতজনকে এরকম চাকরি করে দিয়েছে ও!
ক্রমশ