ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-১৯+২০+২১

0
137

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ১৯
একটু বেলার দিকে রজত খানিকটা সুস্থ হলে অপর্ণারা রসূলপুর থেকে বেরিয়ে পড়লো, রমেন বাবু এবং সুপর্ণার জলভরা চোখ গাড়ি ছাড়ার পরেও অপর্ণা কে অন্য মনস্ক করে রেখেছিলো। সৌমিক গাড়ি চালাচ্ছিল, অনিন্দিতা এবং শ্বশুর, শাশুড়ি অপর্ণার সঙ্গে গাড়িতে বসেছিলো। অন্য গাড়িতে রজত কে একটু আরাম দায়ক ভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এই গাড়িতেই বেশি লোক ছিলো। ঘন্টা খানেক যাবার পরে সৌমিকের ফোন এলো, গাড়ি থামিয়ে কথা বলে সৌমিক উচ্ছসিত গলায় বললো,

মা! আমার নতুন ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে গেছে, ব্যাংক ম্যানেজার হয়ে! একদম বাড়ির কাছে, খুব বেশি হলে আধ ঘণ্টা মতো লাগবে!

রীনা খুশি হলেন,

তাই নাকি! খুব ভালো খবর! যাক বাবা, বাঁচা গেলো আর ছোটাছুটি করতে হবে না!

অনিন্দিতা পেছন থেকে বললো,

অপর্ণা! তুই তো খুব লাকি রে! দ্যাখ তুই বাড়ি ফিরছিস আর ঋজুর ট্রান্সফার হয়ে গেলো!

রীনা যদিও এই কথায় একটুও প্রীত হলেন না,

ও লাকি হলো কোথায়! আসল কাজ তো ঠাকুর মশাইয়ের! তিনিই তো বলেছিলেন আজ থেকে অপর্ণার দোষ কেটে যাবে!

অপর্ণা কিছু বললো না কিন্তু অপর্ণার শ্বশুর মশাই সামনের সিট থেকে মুখ ফিরিয়ে হেসে বললেন,

সে তোমার ঠাকুর মশাই বলেছেন ঠিকই তবে অপর্ণার কিন্তু লাক আছেই! ঋজু ট্রান্সফারের চেষ্টা করছিলো ঠিকই কিন্তু প্রমোশনের কথা কিন্তু ছিলো না! সেটা তোমার বৌমার লাকেই!

রীনা এর কোনো উত্তর দিলেন না, গম্ভীর মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কলকাতায় পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হলো, পরের দিন সকালেই অফিস, তাই সবাই মোটামুটি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো। রত্না রজতের শরীর খারাপ বলে বাপের বাড়িতেই থেকে গেলো সে রাত টা, সব মিটে গেলে অপর্ণা আর অনিন্দিতা ওপরে উঠে এলো। ওঠার সময় রীনা ডাকলেন,

অপর্ণা! কাল থেকে রাতের রান্না তোমার! এবার থেকে তুমি যখন এখানেই থাকবে তখন তোমার এই দায়িত্ব টাই থাকবে!

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

ঠিক আছে!

ঘরে ঢুকতেই সৌমিক অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো,

বাবা কি বললো শুনলে? তুমি নাকি লাকি!

অপর্ণা কপট রাগে সৌমিকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

ছাড়ো! তোমার মা তো বললো পুরুত মশাই লাকি! সেই তোমার সব কিছু করে দিয়েছে! আমি তো অপয়া, পুরুত মশাইয়ের ছোঁয়ায় আজই দোষ কেটে বেরোলাম!

সৌমিক হেসে ফেললো,

লাকি, আন লাকি এসব কথার কথা! যার যেটা মনে করে শান্তি হয়! এসব মেনে যদি কারো ভালো লাগে তো মানুক না! আমি, তুমি তো এসব মানিনা তাই না? যাকগে ছাড়ো এসব! কতদিন পরে এলে, এখন এই সব ভুল ভাল কথা ভালো লাগছে না! মন খারাপ হচ্ছে না তো বাড়ির জন্যে?

অপর্ণার মুখে কষ্টের ছাপ পড়লো,

খুব হচ্ছে জানো! আজ আসার সময় বাবার চোখেও জল দেখেছি! আর সৃজার জন্যেও খুব খারাপ লাগছে, ওর নাকি বিয়ের ঠিক হচ্ছে। কি জানি পরের বার গিয়ে আর দেখা হয় কিনা!

সৌমিক খাটে বসে পড়লো, অপর্ণার হাত ধরে পাশে বসাতে বসাতে মুচকি হেসে বললো,

আর তোমার ওই প্রেমিক? কি নাম যেনো? স্বপন, তাই না? ওর জন্যেও হচ্ছে নাকি?

অপর্ণা মুঠি শক্ত করে ঘুষি মারার ভঙ্গি করলো,

সারাক্ষন পেছনে লাগা তাই না? আমি ছিলাম না কার পেছনে লাগতে এতোদিন? এই জানো তো স্বপন না আমার সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলেছিলো, তোমাকে ও পুলিশ ভেবেছে! বলছিলো স্যার কে বলে দিও আমি গুন্ডা হতে পারি কিন্তু খুনি নই!

সৌমিক হাসলো,

আমাকে পুলিশ ভেবেছে! এই যাহ! রবিকে বলতে হবে তো! আগেই ব্যাটা ভয় পেয়ে গেছে, তাই স্যার বলছে! ওকে ফাঁসিয়ে দেবার কথায় কাজ হয়েছে মনে হচ্ছে!

অপর্ণা চিন্তিত মুখে তাকালো,

একটা কথা বলবো? জানিনা কেনো আমার ওর কথা শুনে মনে হলো ও সত্যি বলছে! মানে কোনো কারণ নেই কিন্তু কেমন যেনো ওকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো তখন! খুব ইনোসেন্ট লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো না যে মিথ্যে বলতে পারে!

সৌমিক হাসলো,

এরা জন্মগত ক্রিমিনাল! মুখ দেখলে বুঝতেই পারবে না সত্যি টা! তবে সত্যি হতেও পারে, কাউকে না চিনে তার ব্যাপারে কমেন্ট করা উচিত নয়! আমি ওকে একবারই দেখেছি, তুমি বেটার বলতে পারবে!

অপর্ণা একটু ইতস্তত করে বললো,

একটা রিকোয়েস্ট করবো রাখবে? জানিনা তুমি কিভাবে নেবে কথাগুলো তবু বলছি! আমার সত্যি টা জানতে ইচ্ছে করছে! দেখো না একটু রবি দা কে বলে যদি কিছু জানা যায়!

সৌমিক অবাক হয়ে তাকালো,

কি করবে এতদিন পরে সত্যি জেনে!

অপর্ণা করুন মুখে তাকালো,

সব সময় শুধু মনে হয় ওর কেউ নেই বলে ও ন্যায় বিচারটুকুও পেলো না! কি হলো, কে মারলো এটুকু জানতে পেরে যদি খুনি কে শাস্তি দিতে পারতাম তাহলে মনের মধ্যের আনচান ভাবটা কমতো বোধহয়! ও নিজেও বোধহয় শান্তি পেতো! ওর সম্বন্ধে যতো জানতে পারছি ততো মনে হচ্ছে খুনি কে শাস্তি দিই, এতো ভালো মানুষটা, যে সারাজীবন লোকের উপকার করার চেষ্টা করে গেছে সে নিজের বেলায় কোনো বিচার পাবে না!

অপর্ণার গলায় দুঃখের স্বর সৌমিক কেও স্পর্শ করলো,

কিন্তু কিভাবে জানবে সবটা? তোমার কাছে কি ডকুমেন্ট আছে কিছু? ফটো বা ঠিকানা? তাহলে নাহয় রবি কে দিয়ে চেষ্টা করে দেখতাম একবার! যদিও ওটা কলকাতা পুলিশের এরিয়া নয়, তবুও রবির চেনাশোনা ওসি তো আছে!

অপর্ণা সোজা হয়ে বসলো,

ফটো নেই, মায়ের ভয়ে কিছু রাখতাম না! কিন্তু ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা আছে একটা, ও নিজেই দিয়েছিলো রেজিষ্ট্রির আগে, ওটা এখনো আছে আমার কাছে! এখানেই!

সৌমিক চিন্তিত হলো,

শুধু ঠিকানায় কি হবে! আচ্ছা, দেখা যাক রবি কি বলে! আসুক ও, ফিরুক দিল্লি থেকে, তারপরে কথা বলছি!

রবি দা দিল্লি গেছে নাকি? মিতা দির সঙ্গে দেখা করতে?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো অপর্ণা, সৌমিক মাথা নাড়লো,

না, না, ওতো অফিসের কাজে গেছে! তবে গেছে যখন, তখন দেখা তো নিশ্চয়ই করবে!

অপর্ণা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো,

দাঁড়াও! তোমাকে ঠিকানাটা দিই! পরে ভুলে যাবো! আমারও সত্যি মনে হচ্ছে এটার একটা এসপার ওসপার হওয়া উচিত! আমি সারাক্ষন মনের মধ্যে অশান্তি নিয়ে থাকতে পারছি না!

অপর্ণার এগিয়ে দেওয়া ঠিকানার কাগজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে অন্য মনস্ক গলায় প্রশ্ন করলো সৌমিক,

সারাজীবন অনেকের উপকার করেছে বলছিলে! কিরকম শুনি দু একটা! আগে কখনো এসব বলো নি তো!

অপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়লো,

না, মানে আমি এগুলো নিজেই জানতাম না! এবার গিয়েই শুনলাম সব! অনেক মেয়েকে ও চাকরির জন্যে নাকি সাহায্য করেছে! একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলো, ওর কাছে শুনলাম!

সৌমিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

মেয়েটা কে আগে চিনতে না?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! কিন্তু আলাপ হয়ে বুঝলাম ও আমাকে চিনতো! ওই ওকে আমার কথা বলেছিলো! ওর কাছেই শুনলাম ওর বাবার অসুস্থতায় নাকি ও টাকা পয়সা দিয়ে হেল্প করেছিলো ওকে!

এটা কিন্তু একটু অদ্ভুত লাগছে, সত্যি কথা বলতে কি একটু অপমানের বিষয়ও! যে কথাগুলো তোমাকে ওর নিজেরই বলার কথা ছিলো, সেগুলো তোমাকে অন্যের মুখ থেকে শুনতে হচ্ছে! তাহলে ধরো যদি আজ ও বেঁচে থাকতো, তাহলে তো এগুলো তোমার অজানা ই রয়ে যেতো তাইনা? অথচ ওই মেয়েটি কিন্তু তোমার কথা জানতো!

অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বললো সৌমিক, অপর্ণা ম্লান মুখে তাকালো,

জানি সেটা! প্রথমে শুনে আমার নিজেরও খারাপ লেগেছিলো, পরে ভেবেছি হয়ত নিজের কথা ও নিজে প্রচার করতে চায় নি কোনো দিন, তাই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে! আরো একটা নতুন কথা জেনেছি, ওর নাকি ব্যবসায় পার্টনার ছিলো, যেটা আমাকে ও কখনো বলেনি!

সৌমিক একটু অবাক হলো,

তাই নাকি! এটা কিন্তু খুব খারাপ করেছে! ব্যবসাটা তার নিজের না পার্টনারশিপে, এই তথ্যটা হবু স্ত্রীর জানা টা কিন্তু সত্যি দরকার ছিলো। বিয়ের পরে যদি তুমি জানতে এটা তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তো খারাপ হতো তাই না? অনেক কিছু ধোঁয়াশা আছে তারমানে! ঠিক আছে দেখছি কি করা যায়!

অপর্ণা সৌমিক কে জড়িয়ে ধরলো, বুকে মুখ গুঁজে বললো,

একটা কথা বলবো? তুমি সত্যিই খুব ভালো! আমি তোমার জায়গায় হলে কিন্তু কিছুতেই পারতাম না! যখনই মিতা কে নিয়ে কিছু ভাবি তখনই আমার কেমন রাগ হয়ে যায়!

সৌমিক হাসতে হাসতে বললো,

কে বললো তোমাকে যে আমার জেলাসি হচ্ছে না? খুব হচ্ছে, সেই জন্যেই আরো বেশি করে ওর খুনি কে খুঁজতে চেষ্টা করবো। ওটা না হলে ওর ভুত তোমার মাথা থেকে নামবে না কখনো! সারাজীবন আমার পথের কাঁটা হয়ে থাকবে! আর মিতা কে তুমি যা খুশি বলতে পারো, কিন্তু আমি তো সেটাও পারবো না, মৃত মানুষের সঙ্গে তো আর ঝগড়াও করা যায়না!

আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে, তুমি মিতা কে যখন ছোটো থেকে ভালোবাসতে তখন শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হলো না কেনো?

সৌমিক একটু চুপ করে থেকে বললো,

আসলে সব কিছু তো জীবনে প্ল্যান মাফিক হয় না, অনেক কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধেও করতে হয়! তোমাকে তো বলেছি মায়ের সঙ্গে মিতার সমস্যা হয়েছিলো! মা ওর বাবাকে অপমান করেছিলেন বলে ও আমাকে বিয়ের জন্যে অনেক শর্ত দিচ্ছিলো তখন! সব কিছু কি মেনে নেওয়া সম্ভব হয় কখনো, মায়েরও তো একটা সম্মান আছে, ও সেদিকটা ভাবে নি!

অপর্ণা গভীর চোখে তাকালো,

জানিনা কার ভুল ছিলো, মায়ের নাকি মিতার! কিন্তু তুমি এটা ঠিক করো নি! মা যদি ভুল করে থাকেন তাহলে তুমি তাঁকে বোঝাতে পারতে, কিন্তু মিতার কথাটাও একবার ভাবা উচিত ছিলো!ও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে তোমার এই ডিসিশনে!

সৌমিক অপর্ণার চোখের দিকে তাকালো,

অপর্ণা! একটা কথা বলছি, এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করে করে গত দু বছর ধরে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আর ভালো লাগে না এখন! আজকের পরে আর কখনো এই ব্যাপারে কিছু জানতে চাইবে না আমার কাছে! আমার ডিসিশনে ও যতটা কষ্ট পেয়েছে তার থেকে অনেক বেশি টানাপোড়েন আমি ভোগ করেছি গত দু বছর! মায়ের আপত্তি সত্বেও আমি ওর বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছি, মা কে বাধ্য করেছি বাবাকে দিয়ে ওর বাবার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপার কথা বলতে, তারপরেও ও নিজের জেদে অটল থেকেছে! ও দিল্লিতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়ে আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলো এটা বলে যে ও নাকি সেদিন আন ব্লক করবে যেদিন আমি দিল্লিতে ট্রান্সফার নিয়ে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াবো! মায়েরও তো একটা সম্মান আছে, তুমি তর্কের খাতিরে বলতেই পারো যে মা হয়ত বাধ্য হয়েছে এটা মানতে কিন্তু মেনেছিল তো শেষ পর্যন্ত! সেই সম্মানটুকু কি মিতার দেওয়া উচিত ছিলো না? ও আসলে আমাকে চাপে রাখতে চাইছিলো, ও এটাই বোঝেনি যে বেশি চাপ দিলে হিতে বিপরীত হয়! গত দুবছরে যখন আমার ওকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো ও একবারের জন্যেও আমার কথা ভাবেনি, শুধু নিজের জেদ দেখিয়ে গেছে! একটা সময় পরে আমার নিজেরই ফ্রাস্ট্রেশন এসে গিয়েছিলো, সারাক্ষন অশান্তি, রাগারাগি, নিজে ব্লক করে রাখলেও প্রতি মুহূর্তে রবির মাধ্যমে চাপ দেওয়া, আমি আর নিতে পারছিলাম না! তারপরে ও আমাকে রীতিমত হুমকি দিলো বছর খানেক আগে, যদি আমি এক মাসের মধ্যে ওখানে ট্রান্সফার নিয়ে না যাই তাহলে সম্পর্কটা আর থাকবে না! সেদিন সারারাত ভেবেছিলাম, তারপরে এটা থেকে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম, জানিয়ে দিলাম আমি যাবো না!

অপর্ণার গলায় কষ্টের স্বর বেরোলো,

সেদিন তোমার খুব কষ্ট হয়েছিলো বলো, এতদিনের একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া খুব কষ্টের!

সৌমিক মাথা নাড়লো,

নাহ! আমারও প্রথম প্রথম মনে হতো যদি কোনোদিন এরকম একটা দিন আসে সেদিন আমি খুব ভেঙে পড়বো কিন্তু দেখলাম হলো না সেটা! বরং অদ্ভুত একটা রিলিফ ফিল হচ্ছিলো, লেবু বোধহয় বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়!

তোমার যে আমার সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছে, মিতা জানতো সেটা?

অপর্ণা কৌতুহলী হলো, সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

নাহ! রবিকে বলেছিলাম অনেক দেরিতে, তাই ও ও জানতে পারে নি!

আচ্ছা, আমি যে তোমাকে আমার কথা বলেছিলাম তাতে তুমি কোনো কিছু রিয়াকশন দেখাও নি কেনো? তোমার এটা জেনে খারাপ লাগেনি যে আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি?

সৌমিক হাসলো, অপর্ণার চোখে চোখ রেখে বললো,

একটা কনফেস করবো? প্রথম প্রেম কেউ ভোলে না, আমিও ভুলিনি! তাই তুমি অন্য কাউকে প্রথমে ভালোবাসতে এতে খারাপ লাগার কিছু নেই! শুধুই এটুকুই দেখার যে বিয়ের পরে সেই প্রেম যেনো নতুন করে ফেরত না আসে! তোমার ক্ষেত্রে তো সে সম্ভাবনা ছিলো না, তাই সেটা নিয়ে ভাবি নি!

অপর্ণার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো, করুন গলায় বললো,

তুমি মিতা কে এখনও ভালোবাসো? আমার ক্ষেত্রে ফেরার সম্ভাবনা না থাকলেও তোমার ক্ষেত্রে তো আছে! তাহলে?

ভালোবাসি বলিনি তো, ভুলতে পারিনি বলেছি! দুটো এক হলো নাকি? ছাড়ো এসব এখন, কতদিন পরে এলে, এখন এইসব কথা বলতে ইচ্ছে করছে না!

অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরে কাছে টানতে টানতে বললো সৌমিক, সৌমিকের ডাকে সাড়া দিলেও মনের মধ্যের অস্বস্তিটা কিছুতেই যাচ্ছে না অপর্ণার, শুধু মনে হচ্ছে যাকে ভালোবাসেনা তাকে ভুলতে কেনো পারবে না সৌমিক! ও সমর কে ভালোবাসতো বলেই তো আজও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি! তবে কি মুখে অস্বীকার করলেও মনের মধ্যে এখনও অনেকটা জায়গা নিয়ে রয়েছে মিতা, যেকোনো দিন কি সে এসে অপর্ণার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, ভেঙে ফেলতে পারে অপর্ণার একটু একটু করে সাজিয়ে তোলা নতুন জীবনটা!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২০
মানুষের যখন ব্যস্ততা থাকে তখন সময় খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে, কখন যে দিন কেটে রাত আসে মানুষ খেয়াল করতেই পারে না। অপর্ণার নতুন জীবনে তাই হচ্ছিলো, সারাদিন কাজকর্ম, জায়ের সঙ্গে গল্পগুজব, রাতে সৌমিকের সঙ্গ সব মিলিয়ে সময় যে কোথা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলো অপর্ণা বুঝতেও পারছিলো না। সৌমিক নতুন ব্রাঞ্চে যোগ দিয়েছে কিছুদিন আগে, সেটা বাড়ির অনেকটা কাছে হলেও বেশ ব্যস্ত অফিস, তার ওপরে ম্যানেজারের দায়িত্ব রীতিমত চাপে থাকছে সে। কিছুদিন আগে অপর্ণার রেজাল্ট বেরিয়েছে সেখানে অপর্ণা কে মামার সঙ্গে যেতে হয়েছিলো রেজাল্ট নিতে সৌমিক ছুটি পায়নি, তবে ফিরে আসার পরে অপর্ণার এম এ তে ভর্তি হবার ব্যবস্থা অবশ্য সেই করেছে সে ব্যাপারে অপর্ণার কোনো অসুবিধা হয়নি।

রীনা ছোটো বউয়ের পরবর্তী শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ান নি তবে জানিয়ে দিয়েছেন যে পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে তার কাজের দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে এ ব্যাপারে কারোর সাহায্য পাওয়া যাবে না, তাই সে ভেবেচিন্তে বলুক যে সে সব দায়িত্ব নিয়েও পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে কিনা। অপর্ণা অনিন্দিতা নয়, শাশুড়ির কথা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই জানিয়েছে,

হ্যাঁ! আমি পারবো, কোনো অসুবিধা হবে না! ওখানে তো আমরা ট্রেনে কলেজ যেতাম অনেক বেশি পরিশ্রমের ছিলো সেটা, এখানে তো খুব বেশি দূরে নয়!

রীনা কথা বাড়ান নি, শুধু বলেছিলেন,

ভবিষ্যতে এটা নিয়ে সমস্যা না হয় দেখো! তুমি সব কিছু করে নিজের পড়াশুনা চালাতে পারলে আমার কোনো সমস্যা নেই! এগুলো আমি অনিন্দিতা কেও বলেছিলাম, ও ও বলেছিলো পারবে, কিন্তু পারলো না তো! নিজেই কিছুদিন পরে ছেড়ে দিলো! আমি তো সব সময় চাই তোমরা নিজের মতো জীবন কাটাও, কিছু করো জীবনে! কিন্তু সংসার কে অবহেলা করে যেনো সেটা না হয়! দেখো তুমি পারো কিনা!

অনিন্দিতা আড়ালে মুখ টিপে হেসেছে, বলেছে,

সেই এক পুরনো টেকনিক! করো না সেটা কিছুতেই মুখে বলবে না, কিন্তু এমন পরিস্থতি করবে না, যে তুই করতে পারবি না! তখন বলবে সবাই কে, আমি তো বাধা দিই নি! ওই তো পারলো না!

অপর্ণাও হেসেছে,

অতো সোজা নাকি! আমি কিছুতেই পড়া ছাড়বো না, দেখবো কি এমন পরিস্থতি তৈরি করে!

সব মিলিয়ে অনেকটা টেনশন নিয়েই অপর্ণা ইউনিভার্সিটি তে যাওয়া শুরু করেছে মাস খানেক হলো, জায়গাটা প্রায় সৌমিকের অফিসের কাছেই। সৌমিক ইদানিং কাছাকাছি অফিস হওয়ায় বাইক নিয়ে অফিসে যায়, তাই বেশির ভাগ দিনই ও সৌমিকের সঙ্গেই বেরোয় সৌমিক ওকে যাবার সময়ে গেটে নামিয়ে দিয়ে যায়! তাতে বেশ খানিকটা সময় বাঁচে, ও একটু ধীরে সুস্থে বেরোতে পারে!

সমস্যাটা তৈরি হলো মাস খানেক পরেই, রজত বেশ কিছুদিন যাবৎ মাঝে মাঝেই অসুস্থ হচ্ছিলো, খাওয়া দাওয়ায় রুচি নেই, যা খাচ্ছে তাই হজম হচ্ছে না, বমি হয়ে যাচ্ছে। গত দুদিন আগে হটাৎ করে রাতে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা হওয়ায় রত্না মাঝরাতে বাড়িতে ফোন করলো, হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার আগেই অবশ্য ব্যথা থেমে গেলো দেখে রজত কিছুতেই হাসপাতালে যেতে রাজি হলো না। পরের দিন সন্ধ্যায় রত্না মায়ের কাছে এলো, মেয়েকে দেখেই রীনা খুব রাগারাগি করলেন,

কবে থেকে এসব হচ্ছে তোমরা কোনো কেয়ার করো না! ভালো ডাক্তার দেখাও একটা! একে বাড়িতে একটা দোষ ছিলো কতদিন ধরে, তার এসব খারাপ এফেক্ট তো থাকবেই!

রত্না বিরক্ত হলো,

আমাকে বলছো কেনো, আমি কি ওকে ডাক্তারের কাছে যেতে বারণ করেছি? কাল তো রাতে দেখলে ভাই কে ডাকলাম তাও গেলো না! আর তোমার বউয়ের দোষ ছিলো বলে যা হয়েছে তাতে আমার কি করার আছে? বিয়ের সময় এতো তাড়াহুড়ো করলে যে কিছু একটু মিলিয়েই দেখতে সময় পেলে না!

রীনা গলা নামালেন,

কি আর করা! আমার কপাল! চোর ঠেকাতে ডাকাতের পত্তন! তাড়াহুড় না করেই বা কি উপায় ছিলো বলো তো? বাড়িতে তো শত্রুর অভাব নেই! তোমার ভাই একাই একশো! রবির কানে গেলে কি আর রক্ষা ছিলো নাকি! সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়ে দৌড়ে আসতো, ভাই এর মাথা ঘোরানো তার কাছে এক মিনিটের ব্যাপার ছিলো! কতো চুপিসাড়ে কাজ হাসিল করতে হয়েছে তুমি তো জানো!

রত্না মুখ বেঁকালো,

কি জানি বাবা, তোমার ছেলের মতিগতি বুঝিনা কিছু! এই মিতা কে বিয়ে করবে বলে বাড়িতে ধুন্দুমার বাধিয়ে দিলো, আবার এখন তো দেখি একেও চোখে হারাচ্ছে! তুমি তখন পাশের বাড়ির মেয়ে কেনো বিয়ে করতে দিলেনা না সে নাকি প্রেমের বিয়ে! তোমার ছেলে কে নাকি হাতের মুঠোয় রাখবে মিতা! এতো দূরে বিয়ে দিয়েও বা লাভ কি হলো, এও তো তোমার ছেলে কে মুঠোয় নিয়েই রাখছে দেখছি!

রীনার মুখে দুঃখের ছাপ পড়লো,

ঋজু তো বরাবরই অবাধ্য, তাও চেষ্টা করেছিলাম! হলো না আমার কপালের দোষে! ঋষি কে নিয়ে এসব ঝামেলা পোহাতে হয়নি কখনো!

রত্না বিদ্রুপের হাসি হাসলো,

তুমি ওই আনন্দেই থাকো! তোমার বড়ো ছেলে আরো চালাক, মুখে কিছু না বলেই কাজ হাসিল করে চলেছে! এতো বড়ো হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ পায় কোথায় ওর শাশুড়ি, জিজ্ঞেস করেছ কখনো? আর এখন তো মনে হয় মিতা হলেই ভালো হতো, অন্তত এক মাত্র মেয়ে মানে পাশের বাড়িটা তো অন্তত হাতে আসতো, এখন তো দুই বউয়ের বাড়ির অবস্থাই যা কিছু হাতে আসার নেই আর!

রীনা গম্ভীর মুখে তাকালেন,

নাহ! অপর্ণার বাবার খুব খারাপ কিছু নেই,সেটা বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ দেখেই বুঝেছি। তবে বাড়ি ঘর তো নেই কিছু! কে জানে পরে কিছু করবে নাকি! যাকগে! ছাড়ো ওসব! রজত কে বলো ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে!

অপর্ণা দোতলার সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ন কথোপকথন শুনলো, রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছিলো,কিন্তু মুখে বলার কোনো উপায় ছিলো না তাহলে মিছিমিছি একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে। রীনা রাগারাগি করায় রজত শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে গেলো, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে জানা গেলো তার গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে, অপারেশন করতে হবে। অপারেশনের পরে রজত কে নিয়ে রত্না আগামী মাস তিনেক বাপের বাড়িতে এসে থাকবে বলে ঠিক হলো, রীনা নিজেই একদিন চায়ের টেবিলে সেই প্রস্তাব দিলেন।

আমি রত্নাকে এখানেই থাকতে বলেছি মাস তিনেক, ও রজত কে নিয়ে একা একা সব পারবে না!

ঋষি সমর্থন করলো,

খুব ভালো করেছো মা, এখানে থাকলে তোমার টেনশনটাও কম হবে! নাহলে তো তুমি সারাদিন চিন্তা করবে এসব আর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে!

রীনা খুশি হলেন, বড়ো ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের গলায় বললেন,

সব সময় এতো আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না তো! আমার কিছু হবে না! কিন্তু ঋজু, তুমি তো কিছু বললে না!

সৌমিক মাথা নিচু করে কাগজ পড়ছিলো, চোখ না তুলেই বললো,

হ্যাঁ, ঠিকই করেছো! ওরা এখানে থাকলেই সুবিধা নাহলে আমাদেরই ছোটাছুটি বাড়বে! দাদার অফিস তো অনেকটা দূরে, আমারও এখন ভীষণ চাপ এই অফিসে, অতো বারবার প্রয়োজন পড়লে তো যেতে পারবো না! এখানে থাকলে যেকেউ ব্যাপারটা সামলে দিতে পারবে।

রীনা একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন,

তুমি তোমার সুবিধার কথা ভাবছো, ওদের কথা ভাবছো না! রত্না ছেলে মানুষ, ও তো এসব কখনো করেনি, ওর এখানে থাকলে চাপ অনেকটা কম হবে! এমনিতেও ব্যাপারটা তো অপর্ণার দোষেই হয়েছে অনেকটা, আমি তো সেই কবেই বলেছিলাম সে কথা! তুমি শুনলে না বাড়িতে ফেরত নিয়ে এলে! তাই এখন তো আমাদের দায়িত্ব থেকেই যায় অনেকটা!

সৌমিক কাগজ থেকে মুখ তুললো না,

সে কে আর এসব করে কখনো! বিপদে পড়লেই তো শেখে! তবে আমি শুধু আমার সুবিধার কথা ভাবিনি সবার দিকটা ভেবেই বলেছি! এখানে থাকলে তো সত্যি ওকে কোনো দায়িত্ব নিতে হবে না! আর রজত দার গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে এতে অপর্ণার দোষ কোথায় হলো বুঝলাম না!

রীনা একটু চুপ করে থেকে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,

যাকগে! অহেতুক তর্ক করে তো কোনো লাভ নেই, তোমাকে ওসব বোঝাতে যাওয়া বৃথা! কিন্তু করবে কে এসব? অনিন্দিতার তো রান্নাঘরেই দিন কাটে, ওই কজনের একবেলার রান্না করতে সব সময় চলে যায়! আর অপর্ণার সকালে ইউনিভার্সিটি, রাতে রান্না! তার মধ্যেই আবার পড়াশুনা থাকে! এসব দায়িত্ব পালন করার তার সময় কোথায়?

অনিন্দিতা চায়ের কাপ তুলে নিয়ে যেতে এসেছিলো, ঋষি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো,

অনিন্দিতা! মায়ের কথা শুনলে তো? রজত আর রত্না এখানে থাকবে, তোমাকে কিন্তু ওদিকটায় একটু সময় দিতে হবে!

অনিন্দিতা কোনো কথা বললো না, কিন্তু সৌমিক কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালো, অবাক গলায় বললো,

কি যে বলিস দাদা! বৌদি রজত কে সময় দেবে? তাতে তো রজতেরই অস্বস্তি হবে! ওগুলো তো রত্নাই করবে!

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ভাবতাম! রজতের অপারেশনের সেবা করার কথা বলি নি আমি, যদিও সেসব কে করবে সেটা এখনো ঠিক করতে পারিনি! তবে রত্না ওসব পারবে না, রোগীর সেবা করা খুব কঠিন কাজ! আমি বলেছি দুজন অতিরিক্ত লোকের দায়িত্ব নেওয়ার কথা, বাড়িতে অসুস্থ রোগী থাকবে, তার হালকা পথ্য লাগবে, আমাদের আলাদা রান্না! তিনটে মাস কম কথা নয়, চলবে কি করে?

সৌমিক একটু চুপ করে থাকলো,

একজন কাউকে রেখে দাওনা, তাহলেই তো হয়ে যাবে! সে যদি এক্সট্রা কাজ গুলো করে দেয় আর বৌদি আর অপর্ণা কে একটু সাহায্য করে তাহলেই কোনো সমস্যা হবে না! মিনতি মাসি কে বলো ঠিক খুঁজে এনে দেবে!

রীনা বিরক্ত হলেন,

আজকাল বিশ্বাসী লোক পাওয়া খুব সমস্যা! আমি অন্য কথা ভাবছিলাম! যদি অপর্ণা মাস তিনেক ইউনিভার্সিটি তে একদিন করে যায় সপ্তাহে তাহলে এগুলো মিটে যেতো! এমনিতেও ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস না করলেও কোনো অসুবিধা হয় না!

অপর্ণা একটু দূরে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো, আগের দিনের শোনা কথায় তার মাথা গরম হয়ে ছিলো, সে সরাসরি মাথা নাড়লো,

না, আমার তো প্রতিদিন ক্লাস থাকে, একদিন গেলে কি করে চলবে?

রীনা গম্ভীর হলেন,

পরিস্থিতি বিচার করতে হবে! দেখতে হবে কোনটা জরুরি! বাড়ির বউ হয়ে যদি তুমি তোমার ইচ্ছে গুলোকেই প্রায়োরিটি দাও তাহলে তো সংসার করতেই পারবে না! দুটোই সমান জরুরি! এতদিন তো আমি তোমার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছি এখন তোমাকে আমাদের সুবিধা অসুবিধার কথাটা তো ভাবতে হবে!

অপর্ণা সৌমিকের দিকে তাকালো, সৌমিক কিছু বলছে না দেখে কোনো কথা না বলে দো তলায় নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। তাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে দেখে রীনা ছোটো ছেলের দিকে তাকালেন,

যখন পড়তে শুরু করেছিলো তখনই কিন্তু এসব বলে নিয়েছিলাম আমি! সব কিছু করে তবেই পড়াশুনা করতে হবে! বাড়ির বউ দুদিন বাড়ির সুবিধার জন্যে এটুকু স্যাক্রিফাইস করতে পারবে না? আমি তো বলিনি ওকে তিনমাস বাড়িতে বসে থাকতে, শুধু বলেছি একটু কম যেতে! সেটুকু না মানতে পারলে তো খুব মুশকিল! কিছু মনে করো না, তোমার প্রশ্রয়েই কিন্তু এই অবস্থা! আজ যদি ঋষি হতো তাহলে এতো অডাসিটি কিছুতেই সহ্য করতো না, কিন্তু তুমি একটা কথাও বললে না! ওকে বোঝাও, এই ভাবে সংসার হয় না!

সৌমিক একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বললো,

তুমিও কিন্তু জেদ দেখাচ্ছো মা! সত্যি কি এটা খুব জরুরি বলো? কাজের লোক বিশ্বাসী নাও হতে পারে এটা ভেবে নিয়ে অপর্ণাকে বাড়িতে বসিয়ে রাখতে চাইছো এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না! এটাই যদি কারণ হয় তাহলে মিনতি মাসি কে রেখেছিলে যখন তখনও তো একই কথা হতে পারতো তাই না? তখন তো তুমি একা বাড়িতে থাকতে, আমরা কেউ থাকতাম না! সবাই স্কুল, কলেজ বেরিয়ে যেতাম, বাবাও অফিসে থাকতো! তখন কিন্তু তুমি নিজের সুবিধার কথা ভেবেছিলে, মিনতি মাসি বিশ্বাসী হবে কিনা ভাবোনি! আজ বাড়িতে এতো লোক, বৌদি, তুমি, অপর্ণা কেউ না কেউ তো থাকবেই, তার সঙ্গে রজত, রত্না থাকবে! দেখো কোনো অসুবিধা হবে না! আমি জোর করলে হয়তো অপর্ণা বাধ্য হয়ে বাড়িতে থাকবে কিন্তু তাতে তোমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কিন্তু খারাপ হবে, সেটা তুমি নিশ্চয়ই চাও না!

সৌমিক চেয়ার সরিয়ে উঠে পড়লো, রীনা থমথমে মুখে তাকিয়ে থেকে বললেন,

তাহলে কাজের লোক না পাওয়া যাওয়া পর্যন্ত তো আর ওদের নিয়ে আসা যাবে না, আমি ওদের ফোন করে আসতে বারণ করে দিচ্ছি!

সৌমিক ঘুরে দাঁড়ালো,

আগে মিনতি মাসি কে বলে দেখো না, কাজের লোক পাওয়া অতোটা কঠিন নয়! আগেই বারণ করার কি আছে! আর যতদিন না পাওয়া যায় ততদিনে নাহয় অপর্ণা একটু ম্যানেজ করবে!

রীনা কোনো উত্তর দিলেন না, সৌমিক ওপরে উঠে এসে দেখলো অপর্ণা গম্ভীর মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখেও কোনো কথা বললো না। সৌমিক পাশে গিয়ে দাঁড়ালো,

অপর্ণা! মাকে নতুন লোকের ব্যবস্থা করতে বলেছি, যতদিন না পাওয়া যায় তত দিন একটু অ্যাডজাস্ট করে নাও প্লিজ!

অপর্ণা ম্লান হাসলো,

সে করে নেবো, কিন্তু আমার ক্লাস গুলোও যে জরুরি সেটা নিশ্চয়ই বোঝো তুমি? আমি জানি মা কোনোদিনও বিশ্বাসী লোক পাবেন না আর! কারণ তাহলে তো আমাকে যেতে দিতে হবে!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২১
গত কয়েকদিন ধরেই বাড়িতে একটা অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সৌমিক হাজার চেষ্টা করেও মাথা থেকে বার করতে পারছে না সেগুলো। বাড়িতে অশান্তি থাকলেই তার প্রভাব কাজের ক্ষেত্রেও পড়ে, আজ অফিসে এসে থেকেই একটা কাজও ঠিক মতো হচ্ছে না সৌমিকের, একই কথা ঘুরে ফিরে আসছে মনের মধ্যে আর মাথাটা দপ দপ করছে। মিনতি তিনজন কে এনেছিলো কাজের জন্যে, কিন্তু রীনার তাদের পছন্দ হয়নি। আরও দু একজায়গায় ভালো করে সে খোঁজ করার আগেই রীনা মেয়েকে ফোন করেছেন, বলেছেন,

তুমি এখন রজত কে নিয়ে এখানে এসোনা রত্না! আমার বাড়িতে করার মতো কেউ নেই! মিনতি কে বলেছি কাজের জন্যে লোক খুঁজতে, সারাদিন বাড়িতে থাকবে এমন কেউ না পাওয়া পর্যন্ত তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই!

ওখানেই সবাই বসেছিলো, সৌমিকের বাবা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রীনা হাত তুলেছিলেন, স্বামী কে থামিয়ে দিয়ে মেয়েকে বলেছিলেন,

অনিন্দিতার কাজের চাপ আছে, অপর্ণা র পক্ষে ক্লাস কামাই করা সম্ভব নয়! আমি তো ওদের জোর করতে পারিনা, সেই অধিকার আমার নেই! তুমি আমার মেয়ে, তোমার ওপরেই আমার জোর খাটানোর অধিকার আছে তাই তোমাকেই রিকোয়েস্ট করছি! যদি কোনো নতুন লোক পাই তোমাকে জানাবো তখন, তুমি রজত কে নিয়ে এসো এখানে! এখন রজত ফিরলে নিজেই কষ্ট করে চালাও একটু!

রীনার ক্ষোভ যে আসলে অপর্ণার ওপরে সেটা বুঝতে পারলেও সৌমিকের কিছু করার ছিলো না, কারণ সে মায়ের আড়ালে অপর্ণা কে বোঝানোর চেষ্টা যে করেনি তা নয়! অপর্ণা মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ ছিলো যদিও মুখে কিছু বলেনি প্রথমে, সৌমিকের কথাতে রাজিও হয়েছিলো মোটামুটি। কিন্তু রীনা যেহেতু মাঝে মাঝেই কথা প্রসঙ্গে জামাইয়ের এই অবস্থার জন্যে অপর্ণার থেকে যাওয়াকেই দায়ী করছিলেন, তাই বার বার একই কথায় অপর্ণা বিরক্ত হয়েছিলো, সৌমিক কে বলেছিলো,

আমি তো অপয়া, তাহলে রজতদার সামনে না থাকাই ভালো, আবার যদি কিছু হয় আমি থাকলে তাহলে তো দোষ সেই আমার ঘাড়েই পড়বে।

সৌমিক একটু অস্বস্তি তে পড়েছিলো,

ছাড়ো না! সব কথা ধরো কেনো? কটা দিনের তো ব্যাপার, একটা লোক পাওয়া গেলেই তো বেরোতে পারবে তুমি!

অপর্ণা বিরক্ত হয়েছিলো,

কটা দিনের ব্যাপার, সেটা তো আগেও বলেছিলে, কিন্তু লোক পাওয়া যাচ্ছে কই! মিনতি মাসি তিন তিনটে মেয়ে কে আনলো, একজনকেও দিদি বা মা কারোর পছন্দ হলো না! আমি জানতাম এটাই হবে, তোমাকে বলে ছিলাম আগেই, আমি যাতে বেরোতে না পারি তার জন্যেই এসব করছে মা! এখন দিদি থাকবে বলে আমি তিনমাস ক্লাস করতে পারবো না? তাহলে পরীক্ষা দেবো কি করে, একটা মিনিমাম অ্যাটেনডেন্স তো লাগবে! তাছাড়া ক্লাস না করলে তো আমার নিজেরই পড়তে অসুবিধা হবে, আমি কিছুই বুঝতে পারবো না! দিদিভাই একদম ঠিক বলেছিলো, যে এমন কিছু হবে যে তুই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হবি! তখন আমি বুঝতে পারিনি, আজ বুঝছি!

সৌমিক অবাক হয়েছিলো,

বৌদি বলেছে একথা তোমাকে? তুমি কখনো বলো নি তো আমাকে?

অপর্ণা রেগে গিয়েছিলো,

কি বলবো এগুলো? বললেই বুঝবে তুমি? তোমরা ছেলেরা তো ওপর থেকে দেখো সব, ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করো না! উনি আসলে আমার পড়াশুনাটা এই অজুহাতে বন্ধ করে দিতে চাইছেন, ঠিক যেমন দিদিভাই কে মুখে কিছু না বলে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছেন! দাদাও কিছু বলেনি তখন! কিন্তু আমি দিদিভাই নই, উনি বললেই আমি ক্লাস কামাই করবো না!

সৌমিক মনে মনে একটু চমকে ছিলো, ঠিক এই কথাগুলোই মিতা বলেছিলো ওকে! মা নাকি বৌদি কে ট্রিক করে চাকরি ছাড়িয়েছে এবং একই জিনিষ বিয়ের পরে এখানে থাকলে ওর সঙ্গেও করবে! কথাগুলো মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সৌমিকের মুখে বিরক্তির ছাপ পড়েছিলো,

সব ব্যাপারেই ট্রিক দেখো কেনো? সত্যি তো সেইভাবে কাউকে এখনও পাওয়া যাচ্ছে না সারাদিন থাকার জন্যে! আর বৌদি কে মোটেও মা চাকরি ছাড়ায় নি, বৌদি নিজেই ছেড়েছে!

অপর্ণা সামনে এগিয়ে এসেছিলো, রাগের গলায় বলেছিলো,

ট্রিক বলবো না তো কি? কি এমন অপারেশন হচ্ছে রজত দার যে তিন মাস শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবে? কোন অফিসে এই অপারেশনের জন্যে তিন মাস ছুটি দেয় গো? তোমার অফিস দেয়? আমি জানি রজত দাও কিছুদিন পরেই জয়েন করবে, কিন্তু এখানে তিন মাসই থেকে যাবে দিদি ওকে নিয়ে! যাতে আমাকে ঘরে বসে থাকতে হয়!

সৌমিক এর মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো, রাগে চিৎকার করে উঠেছিলো,

অপর্ণা প্লিজ! দিদি তার বাপের বাড়িতে থাকবে, কতোদিন থাকবে সেটা তার ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করবে! রজত দা সুস্থ হয়ে গেলেও সে থাকতে পারে, তার যতদিন ইচ্ছা! এ ব্যাপারে তোমার মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই! তুমি তোমার টুকু ভাবো, রজত দার অফিস ওকে কবে জয়েন করতে বলবে সেটা ওর অফিসের ওপরেই ছেড়ে দাও!

সৌমিক এর রাগের গলা অপর্ণার রাগও বাড়িয়েছিল, জেদ তারও কম ছিলো না, সেও চিৎকার করে উঠেছিলো,

আমি আমার টুকুই তো ভাবছি! তুমি ওই ভুল ধারণা নিয়েই থাকো! মায়ের ভুলগুলোকে তোমরা দুই ভাইই ভুল বলতে পারো না কিছুতেই! মাঝখান থেকে আমরা ঝামেলায় পড়ি! দিদিভাই নিজে রোজগার করতো, মায়ের সংসারে সম্মান নিয়ে খরচ দিতো, কিন্তু এখন দেখো দাদার কাছে হাত পেতে চাইতে হচ্ছে, তাও লুকিয়ে করতে হয় সাহায্য! তোমার মা জানতে পারলে অনর্থ ঘটিয়ে দেবেন! ওর যে কি ভীষণ খারাপ লাগে এটা, সেটা দাদা বোঝে না!

সৌমিক অবাক হয়েছিলো,

দাদা বৌদির বাড়িতে খরচ দেয়! সেতো ভালো কথা, দিতেই পারে, ওর মায়ের পক্ষে হয়ত সম্ভব হয়না, কিন্তু লুকিয়ে রাখে কেনো? এটা না বলারই বা কি আছে!

বাহ! কি বুদ্ধি তোমার! তোমার মা জানলে রক্ষা থাকবে আর! যেদিন মেজো মাসীরা জলির বিয়ের বাজার করতে এসেছিলো, সেদিন কি হয়েছিলো জানো তুমি? তুমি তো ড্রাইভারের খবর দিয়ে ওপরে চলে গিয়েছিলে, তার পরে দাদার মোবাইলে দিদিভাইয়ের মায়ের টেস্ট করানোর জন্যে হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিলো বলে মা কতো কথা শোনালেন! দিদিভাই যাবে বলছিলো, ওকে যেতে দিলেন না মাসী এসেছেন বলে! শেষে দাদা মিথ্যে বলে নিয়ে গেলো, তার এটুকু সাহস নেই যে বলবে আমি আমার শাশুড়ি কে হসপিটালে নিয়ে যাবো বলে বাড়ির গাড়ি নিয়ে বাজারে যেতে পারবো না!

ফুঁসতে ফুঁসতে বলেছিলো অপর্ণা, সৌমিক আর কোনো কথা বলেনি তার পরে। কিন্তু মনের মধ্যে সেই থেকে একটা খুঁতখুঁতে ভাব তৈরি হয়েছিলো, শুধু মনে হতো মিতার এতদিনের বলা কথাগুলোই যেনো অপর্ণার মুখে শুনতে পাচ্ছে ও। অদ্ভুত একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছিলো মনের মধ্যে, মনে হচ্ছিলো তাহলে মিতা কে ও কেনো দোষারোপ করছিলো মিছিমিছি এতদিন, অপর্ণাও তো মিতাই হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে!

স্যার, একটু ভেতরে আসবো?

সৌমিক অন্যমনস্ক ভাব থেকে বেরিয়ে এলো, চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো,দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একজন বছর বত্রিশ, তেত্রিশ এর মহিলা, চেহারায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট হলেও ভদ্র ঘরের বলেই মনে হচ্ছে! কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে উঠে বসলো সৌমিক, সামনে থাকা চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললো,

বসুন! বলুন, কি জন্যে এসেছেন?

ভদ্রমহিলা টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে সৌমিকের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন,

স্যার, আমার হাসব্যান্ড আজ থেকে প্রায় বছর দুয়েক আগে মারা গেছেন! যদিও ওনার সঙ্গে তার আগেই আমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু আমার মেয়ে আছে তাই সেই সব সম্পত্তি আমার প্রাপ্য, কিন্তু ব্যাংক আমাকে ওনার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে দিচ্ছে না!

সৌমিক একটু আশ্চর্য হলো, অবাক গলায় বললো,

সেতো অনেক আগে মারা গেছেন তাহলে! আপনি এতদিন ধরে কি করছিলেন? আপনি কি ওনার একাউন্টের নমিনি?

মহিলা মাথা নাড়লেন,

হ্যাঁ স্যার, আমিই নমিনি ছিলাম আগে, আসলে সত্যি কথা বলতে কি উনি মারা যাবার বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মেয়ের জন্যে আগে নিয়মিত টাকা পয়সা পাঠাতেন, পরে সেগুলো বন্ধ করে দেন! একটু রাগারাগি হয়েছিলো কিছু ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে, তাই আমিও আর যোগাযোগ করিনি অনেকদিন! আমি খুব নিডি স্যার, টাকার দরকার পড়ায় এতদিন পরে উপায় না দেখে বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখলাম, উনি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। যাঁরা কিনেছেন তাঁরা একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে শুনলাম উনি মারা গেছেন অনেকদিন আগে! হয়ত স্বার্থপরের মতো লাগছে শুনতে, কিন্তু বাধ্য হয়েই শেষে ব্যাংকে এলাম। ওনার সব কিছুই আমার নামে নমিনি ছিলো, যদি টাকাগুলো পেতাম তাহলে আমার খুব সুবিধা হতো! আমার না হলেও অন্তত মেয়েটার তো তার বাবার সম্পত্তি প্রাপ্য, তাই না?

সৌমিক একটু অবাক হলো,

এতো দিন পরে টাকার জন্যে খোঁজ নিচ্ছেন! সেই টাকা যে আদৌ ব্যাংকে আছে কিনা, বা নমিনি চেঞ্জ হয়েছে কিনা সেটাই তো জানেন না!

ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করলেন,

জানি স্যার! কিন্তু আমি নিরূপায়! একটু দেখুন না স্যার যদি কিছু করা যায়!

একটু বসতে হবে, আমি এখানে নতুন এসেছি, এখনও সব দায়িত্ব বুঝে উঠতে সময় পাইনি!

ভদ্রমহিলা ঘাড় নাড়লেন, সৌমিকের মহিলার জন্যে খারাপ লাগছিলো, বেল বাজিয়ে বেয়ারা কে ডেকে বললো,

রাজীব দা কে ডেকে দাও একটু!

রাজীব সেন এখানের অনেক পুরনো কর্মী, মোটামুটি সব কিছুই তাঁর নখদর্পণে। তাঁকে ঢুকতে দেখেই সৌমিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,

রাজীব দা! এই কেস টা একটু দেখুন না!

রাজীব মহিলার দিকে তাকালেন, বিরক্ত গলায় বললেন,

আপনি আবার এসেছেন! একেবারে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পড়েছেন! বলেছি না আমরা কিছু করতে পারবো না আপনার জন্যে!

সৌমিক অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকালো,

আপনি আগেও এসেছিলেন, বলেন নি তো আমাকে!

মহিলা কিছু বলার আগেই রাজীব মাথা নাড়লেন,

আর বোলো না! সেই কবে থেকে ঘুরছেন উনি! আমরা কি চেষ্টা করিনি আগে! নমিনি এখনো উনিই আছেন, কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়! উনি ওনার হাজব্যান্ডের কোনো ডেথ সার্টিফিকেট তো জমা দিতে পারেন নি! মুখে বললেই তো আর কেউ মৃত হয়ে যায়না! আর তার চেয়ে বড়ো কথা হলো উনি যে সময়ে ওনার স্বামী মারা গেছেন বলছেন তার পরেও বেশ কয়েকবার ওই একাউন্টে টাকা লেনদেন হয়েছে! ভদ্রলোকের চেক এ সইও আছে! তারমানে উনি নিশ্চয়ই মারা যান নি!

এতক্ষনে মহিলা উঠে দাঁড়ালেন,

আমি তো আগেও বলেছি স্যার, উনি মারা গেছেন অনেক আগেই! কিন্তু আমি তো জানিনা ঠিক কতো তারিখে! কারণ উনি যেখানে থাকতেন সেখানে কেউ ঠিক মতো ওনার মৃত্যুর দিন বলতে পারছে না! উনি সত্যি মৃত, অন্য কেউ ওনার চেক বুক ব্যবহার করে টাকা তুলেছে!

রাজীব বিরক্ত গলায় বললেন,

হ্যাঁ, বলেছেন, কিন্তু সেটার কোনো ভ্যালু নেই! আর তাছাড়া ওটাতে কে ওয়াই সি আপডেট করা নেই, অনেকদিন অপারেটও করেনি কেউ! আমরা আপনাকে ওইভাবে টাকা দিতে পারিনা কখনো! আমি আপনাকে কতোবার বলেছি আপনি পুলিশের কাছে যান, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ডেথ সার্টিফিকেট বার করুন, তা না করে আপনি বারবার ব্যাংকে আসেন কেনো?

মহিলা মাথা নিচু করলেন,

আমার খুব টাকার দরকার স্যার! পুলিশের কাছে গেলে নাকি ওরা অ্যাকাউন্ট সিজ করে দেবে, সবাই তাই বললো! তাহলে তো কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই পাবো না স্যার! আমার অনেক দেরি হয়ে যাবে!

সৌমিক মাথা নাড়লো,

আমি তো এতো কিছু জানতাম না, এই ঘটনার পরে আমাদের সত্যি কিছু করার নেই! আপনি বরং পুলিশের কাছেই যান, তাহলে দেরিতে হলেও কিছু অন্তত পেতে পারেন!

মহিলা ম্লান মুখে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সৌমিক রাজীবের দিকে তাকালো,

চেক গুলো কোথায় গিয়েছে দেখেছিলেন দাদা?

রাজীব মাথা কাত করলেন,

হ্যাঁ ভাই! কিন্তু সে তো অনেকদিনের আগের কথা, তারপরে সমস্যা হলো যেখানে গিয়েছে সেই অ্যাকাউন্টও অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গিয়েছে!

সৌমিক চিন্তিত হলো,

আচ্ছা! তাহলে তো সত্যি কিছু করার নেই!

তুমি কি বেরোবে এখন, না হলে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি!

রাজীবের কথায় সৌমিক চমকে উঠে ঘড়ি দেখলো,

কটা বাজে এখন! রাজীব দা বেরিয়ে যেতে চাইছেন! ও এতটাই চিন্তিত ছিলো বাড়ি নিয়ে যে কখন যে ছুটির সময় হয়ে গেছে খেয়ালও করেনি!

রাজীব বেরিয়ে গেলেন, টুকটাক জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে সৌমিকও বেরিয়ে পড়লো, ব্যাংকের পেছনে রাখা বাইকটাতে স্টার্ট দেবার সময় লক্ষ্য করলো, একটু আগের দেখা ওই মহিলা একটা গাছের তলার বাঁধানো বেদীতে চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। সৌমিক সামনে এগিয়ে গেলো, মহিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

শরীর খারাপ লাগছে নাকি আপনার? এখানে বসে আছেন কেনো?

মহিলা চোখ খুলে তাকালেন, অসহায় গলায় বললেন,

খুব খারাপ অবস্থায় আছি স্যার! কোনরকমে চালিয়ে নিচ্ছিলাম এতদিন, কষ্ট হলেও জেদ দেখিয়ে ও টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেবার পরও ওর কাছে টাকা নিজে থেকে চাইতে যাইনি! কিন্তু কিছুদিন আগে মেয়েটা খুব অসুস্থ হয়েছিলো তখন যেটুকু জমানো ছিলো, ওর পাঠানো ছিলো, সবটা বেরিয়ে গেলো, তখন বাধ্য হয়ে টাকার জন্যে ওর বাড়িতে গেলাম! গিয়ে দেখি এই অবস্থা! ও নাকি বাড়ি কবেই বিক্রি করে দিয়েছে! বাড়িতে একটা ছোটো মেয়ে আছে, প্রায় দুদিন ধরে কিছু না খেয়ে আছি স্যার! কোনো একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারেন যদি তাহলে খুব উপকার হতো! বেশি তো লেখাপড়া করিনি, অল্প বয়সে বিয়ে করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম, তাই বিরাট কিছু চাই না, কোনো রকমে মা, মেয়ের চলে গেলেই হলো, কারোর বাড়িতে আয়ার কাজ করতেও অসুবিধা নেই স্যার!

সৌমিক একটু ইতস্তত করলো,

আপনি কি সত্যি করতে চান? তাহলে আমার বাড়িতেই একজন দরকার ছিলো সারাদিন থাকার জন্যে!

মহিলা উঠে দাঁড়ালেন, নমস্কারের ভঙ্গিতে বললেন,

প্রমাণ দিতে পারবো না তবে আমি ভদ্র বাড়ির বউ স্যার, পাড়ায় যার কাছে খুশি খবর নিতে পারেন। খুব সমস্যায় আছি, ও অনেক টাকা রেখে গেছে জানি কিন্তু ওর টাকাগুলোও তো পাচ্ছি না আপাতত, তাই যদি কাজটা দেন, খুব উপকার হবে স্যার! যা করতে হবে সব করবো!

সৌমিক ওর ফোন নম্বরটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

জানিনা আপনি কোথায় থাকেন, তবে আমি খুব কাছেই থাকি! এখান থেকে মিনিট কুড়ি পঁচিশ লাগবে বাসে, যদি করতে চান তাহলে ফোন করে একটা কোনো আই ডি নিয়ে চলে আসবেন যেকোনো দিন! তবে তাড়াতাড়ি আসবেন, আমাদের একটু তাড়া আছে!

মহিলা হাত বাড়িয়ে নম্বরটা নিয়ে আধার কার্ড বাড়িয়ে দিলেন,

এক্ষুনি আসবো স্যার? আই ডি নিয়েই ব্যাংকে এসেছিলাম, আমিও কাছেই থাকি!

সৌমিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কার্ড টা দেখে নিয়ে বললো,

একটা জেরক্স নিয়ে আসুন তাহলে ঘন্টাখানেক পরে, আমি বাড়িতে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিই ততোক্ষনে! আচ্ছা আপনার এক্স হাসব্যান্ড কি করতেন? মানে উনি অনেক টাকা রেখে গেছেন এরকম মনে হলো কেনো আপনার?

ভদ্রমহিলা ম্লান হাসলেন,

টাকার জন্যে ওর খোঁজ করছি, সত্যি খুব খারাপ ভাবলেন বোধহয় আমাকে? কিন্তু কি করবো বলুন তো, মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচতে হবে তো! আমার স্বামী ট্রাভেল এজেন্সি তে চাকরি করতেন, সারা বছর ঘুরে বেড়াতেন টুরিস্ট নিয়ে। বিয়ে করেন নি আর ডিভোর্সের পরে, তাই মাইনের টাকা, বাড়ি বিক্রির টাকা সব মিলিয়ে অনেকটা হওয়াই তো স্বাভাবিক তাই না? আর একটা কথা কি জানেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও, একমাত্র সন্তান হিসাবে টাকা তো আমার মেয়েরই প্রাপ্য তাই না? তাই ভেবে দেখেছি রাগ, অভিমান করে লাভ নেই, ও না থাকলেও ওগুলো আমি নেবো!

সৌমিক একটু চুপ করে থেকে বললো,

ওনার অফিস থেকে পেয়েছেন কিছু? সেখানেও কি আপনিই নমিনি ছিলেন নাকি?

মহিলা মাথা নাড়লেন,

নাহ! কিছু পাইনি! শুনলাম উনি নাকি অনেকদিন আগেই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন! সব কিছুরই নমিনি আমিই ছিলাম কিন্তু জানিনা মাঝের এই কয়েক বছরে কি হয়েছিলো ওর, হয়ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না বলেই সব ছেড়ে, সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গিয়েছিলো কোথাও!

সৌমিক বাইক স্টার্ট করলো,

ঠিক আছে! আমি এগোলাম, আসুন তাহলে!
ক্রমশ