ঘষা কাঁচের দেওয়াল পর্ব-২২+২৩+২৪

0
139

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২২
গ্যারেজে বাইক ঢুকিয়ে দিয়ে সৌমিক দৌড়ে বাড়িতে ঢুকলো, ভদ্র মহিলা আসার আগেই যে করেই হোক মা কে রাজি করাতে হবে। রীনা টিভি দেখছিলেন, ছেলে কে দেখেও তাকালেন না। তিনি যে যথেষ্ট রেগে আছেন সেটা বুঝেই সৌমিক মায়ের পাশে গিয়ে বসলো, জুতো খুলতে খুলতে বললো,

রজত দা কবে ফিরবে হসপিটাল থেকে? ওদের সোজাসুজি এখানেই আসতে বোলো, আমি একজন কে থাকার জন্যে খুঁজে পেয়েছি।

রীনা রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে দিলেন, ছেলের দিকে ঘুরে বসে ভ্রু কুঁচকে বললেন,

তুমি খুঁজে পেয়েছো? কোথা থেকে? বলো নি তো আগে আমাকে!

সৌমিক হাসলো,

কি করে বলবো, আমি তো আজই পেলাম! জানি তুমি টেনশন করছো, তাই আমিও তো চেষ্টা করছিলাম সেই থেকে! শুধু মিনতি মাসীর ভরসায় বসে থেকে লাভ আছে?

রীনার কোঁচকানো ভ্রু সোজা হলো, ছেলে তাঁর জন্যে চিন্তিত জেনে খুশি হলেন,

সেটা ভালো করেছো, জানি তোমার দায়িত্ববোধ সব সময় অন্যের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু কার কাছে খোঁজ পেলে? বিশ্বাসী হবে তো? ভালো করে খোঁজ খবর নিয়েছো?

সৌমিক হাত তুললো,

অতো ভেবে লাভ নেই, আই ডি কার্ড দেখে নিয়েছি আর রবি কে একটু বলে রাখবো, তাহলেই হবে! আর সত্যি বলতে কি মা এই মুহূর্তে আমাদের অতো ভাবার সময় নেই, রজত দার এখানে সোজাসুজি আসাটাই জরুরি! বারবার করে তো ওকে এদিক ওদিক করা যাবে না, তাহলে সেটা ওর শরীরের জন্যে আরো খারাপ হবে।

রীনা একটু ভাবলেন, তাঁর জেদের জন্যে যে আসলে তাঁরই দু কূল যাচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন। অপর্ণা তার ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করছিলো না এদিকে রজতের আসাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। সব দিক ভেবে তিনি সম্মতি দিলেন,

ঠিক আছে আসুক তাহলে, দেখা যাক কেমন হয়।

সৌমিক খুশি হলো,

আমিও ঠিক এটাই বলছি মা, কদিন দেখো না, আমার ধারণা ভালোই হবে। আজই ব্যাংকে এসেছিলেন ওই ভদ্রমহিলা একটা অন্য দরকারে, তো নিজে থেকেই করতে চাইলেন। আমার কিন্তু নিডি হলেও ওনাকে বেশ ভদ্র ঘরের বলেই মনে হয়েছে।

একটু পরেই মহিলা এলেন, রীনার প্রশ্নের উত্তরে নিজের নাম জানালেন দীপা। কিছুক্ষন কথাবার্তার পরে সব কিছু ঠিক হয়ে গেলো, আপাতত সমস্যা মিটলো বুঝে বাড়ির সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। রীনা মেয়েকে ফোন করে বলে দিলেন রজত কে হসপিটাল থেকে এখানে নিয়ে আসতে এবং তার জন্যে গেস্ট রুমে সব ব্যবস্থা করতে লাগলেন। নির্দিষ্ট দিনে রত্না এবং রজত এলো, তার সঙ্গে দীপা, ফলে নতুন করে কারো ওপরে আলাদা চাপ তৈরি হওয়ার আর প্রশ্ন ছিলো না। অপর্ণা নিয়মিত ক্লাস করতে শুরু করলো, অনিন্দিতা বা তার রজতের থাকার জন্যে আর কোনো সমস্যা রইলো না।

দেখতে দেখতে আরো মাস খানেক কেটে গেলো, এর মধ্যে একদিন ফোন করে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সুপর্ণা জানালেন সৃজার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে এবং সৃজার বাবা তাঁর কাছ থেকে অপর্ণার ঠিকানা নিয়েছেন। দু একদিনের মধ্যেই সৃজার বাবা ফোন করলেন, শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ায় অপর্ণা রীনা কে ফোন দিলো, সব শুনে রীনা অপর্ণার যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আপত্তি জানালেন না, বললেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, নিশ্চয়ই যাবে, তবে আমার ছেলে তো খুব ব্যস্ত ও যেতে পারবে না বোধহয়। তবে আপনার আমাকে বলার দরকার ছিলো না অপর্ণা কে বললেই হতো।

সৃজার বাবা বিনীত গলায় বললেন,

তাই কখনো হয়? আপনি গুরুজন, আপনি থাকতে ওকে বলা আমার কখনো উচিত নয়।

রীনা বাধা দিলেন,

না, না, আমরা এসব ব্যাপারে খুব লিবারাল, এখন আবার অতো কেউ মানে নাকি! ওরা বাচ্চা মেয়ে হাসবে, ঘুরবে, এতে আপত্তির কিছু থাকতেই পারে না। এই তো দেখুন না বিয়ের পরে আবদার করলো ও আরও পড়বে বলে, আমি তো তখনই বললাম আমার ছেলে কে ওকে ভর্তি করে দিতে। আমি আমার বৌমাদের মেয়ের মতো নয়, মেয়েই ভাবি, আমার মেয়ের থেকে একটুও আলাদা ভাবি না, ওদের কোনো আনন্দে বাধা দিই না কখনো।

সৃজার বাবা ফোন নামিয়ে রাখার পরে আড়ালে দাঁড়িয়ে অপর্ণা আর অনিন্দিতা দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। বন্ধুর বিয়ের সেই খবর রাতে সৌমিক কে দিয়ে অপর্ণা খুব উৎসাহের গলায় বললো,

চলো না, দুজনেই যাই, আগের বার তো রেজাল্টের সময় তুমি যেতে পারো নি, তাই মাও বলছিলো তোমাকে আসতে।

সৌমিক ঘাড় নাড়লো,

অসম্ভব! এখানে আমার খুব চাপ, একদম ছুটি নেই, তুমি একাই যাও।

অপর্ণা একটু দুঃখ পেলো,

একা যাবো! কোনোদিনও তো যাইনি আগে! আচ্ছা একদিনের জন্যে চলো নাহয়! আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে!

সৌমিক রাজি হলো না,

সত্যি পারবো না, নাহলে যেতাম ঠিক! এখন তো একটা ট্রেনেই যাওয়া যায়, আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দেবো, তুমি ঠিক যেতে পারবে। একবার দেখো না চেষ্টা করে।

অগত্যা অপর্ণা একাই ট্রেনে উঠলো এই প্রথম বার, সৌমিক হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে তুলে দিয়ে চলে যাওয়ার পরে যদিও একটু ভয় ভয় লাগছিলো তবু অপর্ণা নিজের মন কে প্রবোধ দিলো, কতো লোক তো একা যায়, ও নিশ্চয়ই পারবে। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে উঠলেন রবীন বাবু, তাঁকে দেখে অপর্ণা র ধড় এ প্রাণ এলো, চিৎকার করে ডাকলো,

রবীন কাকু! এদিকে আসুন!

রবীন চমকে উঠে এগিয়ে এলেন, কাঁধের ব্যাগ সিট এর ওপরে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,

একা যাচ্ছো নাকি? জামাই কোথায়?

অপর্ণা হাসলো,

হ্যাঁ একাই যাচ্ছি, ওর ছুটি নেই তাই আসতে পারে নি! আপনি মাল নিয়ে ফিরছেন বোধহয়?

রবীন ঘাড় কাত করলেন,

হ্যাঁ, এখন তো আমিই যাই, আর কারো ওপরে ভরসা করিনা! যা হলো!

অপর্ণা একটু চুপ করে থেকে বললো,

পুলিশ আর কিছু করলো না, তাই না কাকু?

রবীন ঘাড় নাড়লেন,

নাহ! হলো কই! কেউ পেছনে লেগে থাকার লোক নেই! বাড়ির ঠিকানাও দিয়েছিলাম, একবারও খোঁজ নিতেই যায়নি বোধহয়!

বাড়িতে গিয়েও বা কি করবে পুলিশ, ওর তো কেউ ছিলো না!

মৃদু গলায় বললো অপর্ণা, রবীন সহমত হলেন,

তা ঠিক! পুলিশ কে দোষ দিয়েও কিছু লাভ নেই, মাঝখান থেকে অতগুলো টাকা হাপিস হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম তো নগদ দিতাম না সবটাই চেকে লেনদেন করতাম, কিন্তু তারপরে সম্পর্কটা এমন হয়ে গেলো যে মাঝে মাঝে তাড়া থাকলে নগদ দিয়ে দিতাম! ওটাই ভুল হয়েছে! তাও জানো তো মা, ছেলেটার জন্যেও খারাপ লাগে খুব, ভালো, পরোপকারী ছেলেটা শুধু মাত্র অতগুলো টাকা সঙ্গে থাকায় খুন হয়ে গেলো।

ধুৎ মশাই! পরোপকারী! ওই ভুল ধারণা নিয়েই থাকুন আপনি! ছেলেটা একটুও সোজা ছিলো না বুঝলেন আমারও অনেকগুলো টাকা চোট গেছে!

অপর্ণা চমকে তাকালো, উল্টো দিকের জানলায় বসা মাঝ বয়সী ভদ্রলোক বেশ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন কথাগুলো, রবীন বাবুও ঘুরে তাকালেন,

আপনিও জামা কাপড়ের ব্যবসা করেন নাকি? দেখিনি তো আপনাকে আগে কখনো! কোথায় থাকেন?

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন,

নাহ! আমি ওসব ব্যবসা ট্যাবসা করিনা দাদা, নিতান্তই ছাপোষা মানুষ! আপনাদের দুটো স্টেশন পরেই থাকি। আমার মেয়ে আর তার বন্ধুরা কলেজে যেতো, সেখানে ওই লোকটার সঙ্গে পরিচয়। সে নাকি চাকরি খুঁজে দেবে তাদের, এই বলে তো বেশ কিছু হাতিয়েছে। এখন তো চাকরিও গেলো, টাকাও গেলো! ঠগবাজ লোক একটা!

অপর্ণার কান গরম হয়ে যাচ্ছিলো, সমরের নামে এসব কথা শুনতে তার একটুও ভালো লাগছিলো না, তাই অনেকটা নিজের অজান্তেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো,

এতে ছেলেটা সোজা ছিলো না, সেটা কি করে বোঝা গেলো! খুন না হলে তো চাকরি জোগাড় করেই দিতো হয়ত! মৃত্যুর ওপরে তো কারোর হাত নেই! এর জন্যে ওকে ঠগ বলা উচিত নয়!

ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন,

কতো টুকু জানো ওকে, যে ওর হয়ে সাফাই গাইছো! এইসব নগদ কারবার কারা করে জানো? যারা লোকের টাকা মারতে চায়! এসব লোকেরা নিজেরাই ফাঁদে পড়ে, এরকমই আরো কিছু করতে গিয়ে খুন হয়েছে দেখো! আর বুঝি না আপনারা দোকানদাররা কি করে এই ভাবে নগদে লেনদেন করেন, আসলে আপনাদেরও তো অনেক কালো টাকা সাদা হয় এভাবে!

অপর্ণা চুপ করে গেলো, কিন্তু নগদ টাকার খোঁটা দেওয়া টা রবীন সহ্য করলেন না, তিনি গম্ভীর মুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই আরেকজন পেছন দিক থেকে সামনে উঠে এলেন। উনিও রসুলপুর বাজারের ব্যবসায়ী, কালো টাকা সাদা করার কথায় রীতিমত অপমানিত হয়েছেন, রবীন বাবু আগে লক্ষ্য করেন নি তাকে, এখন লক্ষ্য করলেন। তিনি সামনের সিটে বসে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন,

কি বললেন? ব্যবসা মানেই আমরা কালো টাকা সাদা করি নগদে লেনদেন করে? সব ব্যবসায়ীরা এক নাকি? ওই সমর মরেছে নিজের দোষে, একটা এমন মেয়ের সঙ্গে ফেঁসে ছিলো, যার পেছনে স্বপনের মতো একটা গুন্ডা পড়ে আছে! তো অতো সাহস দেখাতে গেলে তো ওরকমই হবে, তাই না? এতে আমাদের সঙ্গে নগদ লেনদেন এর কোনো সম্পর্ক নেই।

অপর্ণার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো, আবার কি নতুন করে উঠবে, সেই পুরোনো হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গ গুলো! এককালে এর জ্বালায় তো কম জ্বলেনি অপর্ণা, এমনকি শ্বশুর বাড়িতে ভুলবশতঃ গুন্ডার কথা বলে ফেলায় তাকে কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। সেই ভয়েই তো মা কিছুতেই কোনো সম্বন্ধের সময় সমরের কথা জানতে দিতে চায়নি, প্রতিবেশীদের কাছেও বিয়ের কথা অনেকদিন পর্যন্ত লুকিয়ে গিয়েছিলো। রবীন বাবু অপর্ণার অন্য মনস্ক ভঙ্গি লক্ষ্য করছিলেন, রসূল পুরের অন্য লোকেদের মতো তিনিও বিষয়টা জানতেন, তবে তিনি অপর্ণা কে চিনতেন যেটা অন্য ভদ্রলোক চিনতেন না। পাছে তিনি অপর্ণা কে না চিনে আরো কিছু বিরূপ মন্তব্য নিজের অজান্তে করে ফেলেন তাই রবীন বাবু তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ থামিয়ে দিলেন,

আহা! থামো তো বিজন! আর ওসব নতুন করে শুরু করো না! সবারই কিছুনা কিছু ক্ষতি হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেসব আজ না হলেও একদিন আমরা ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবো। কিন্তু একটা প্রাণ তো আর কখনো ফিরে আসবে না, তাই ওসব আলোচনা এখন থাক!

এরপর আপাতত সেই আলোচনায় ইতি পড়লো, রবীন বাবু সঙ্গে থাকায় অপর্ণার রসূল পুরে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না আর! ওখানে পৌঁছে বিয়ে বাড়ি পর্ব মিটে যাওয়ার পরে অপর্ণা আবার একাই ফেরত যাওয়ার জন্যে তৈরী হলো, এই নতুন ব্রাঞ্চে এসে এতোটাই চাপে থাকছিল সৌমিক যে তার পক্ষে কিছুতেই অপর্ণা কে আনতে যাওয়া সম্ভব হলো না।

তবে রসূল পুরের মফস্বলের জীবনে অপর্ণার এই বার বার বর ছাড়া আসা নতুন করে আলোচনার খোরাক জাগালো। অপর্ণা ফেরত যাওয়ার দিন দুয়েক আগে এক দুপুরের আড্ডায় সুপর্ণা অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন, মনার মা যদিও অতি নিরীহ প্রশ্ন দিয়েই শুরু করলেন,

অপর্ণার মা! মেয়ে তোমার শ্বশুর বাড়ি ফিরবে কবে?

পরশু!

সুপর্ণা উত্তর দেবার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় প্রশ্ন ধেয়ে এলো,

একাই ফিরবে নাকি জামাই আসবে নিতে?

সুপর্ণা একটু দুঃখিত হলেন,

না গো! তার তো ছুটি নেই, ওই জন্যেই তো অপর্ণা একাই এলো!

মনার মা সোজা হয়ে বসলেন,

একটা কথা বলি অপর্ণার মা, কিছু মনে কোরো না! বার বার তোমার মেয়ে একা আসছে কেনো বলতো? নতুন বিয়ে হয়েছে, এখনো বছর ঘোরে নি, এর মধ্যেই জামাই আসা ছেড়ে দিলো! মাকে সব কিছু নজরে রাখতে হয় বুঝলে! মেয়েকে শুধাও ভালো করে, জিজ্ঞেস করো তার জামাই এর সঙ্গে কিছু হয়েছে নাকি! বিয়ের পরে এতো অল্পদিনের মধ্যে তো এসব হওয়া উচিত নয়, এখন তো তার বউয়ের পেছনে পেছনে ঘোরার কথা, এখনই সে বউকে একা পাঠিয়ে দিচ্ছে কেনো! তবে হ্যাঁ অপর্ণা কিন্তু ভাগ্য করে শাশুড়ি পেয়েছে, সৃজার মা বলছিলো ওর বাবা নাকি কথা বলেছে ওনার সঙ্গে, উনি তো নাকি খুব ভালো মানুষ!

সুপর্ণা কোনো উত্তর দিলেন না, কিন্তু তাঁর মুখে পলকে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো, আরো কিছুক্ষন বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামতের পরে সুপর্ণা নিশ্চিত হলেন যে অবশ্যই অপর্ণার সঙ্গে সৌমিকের কিছু সমস্যা হয়েছে, তাই সৌমিক আর শ্বশুর বাড়ি আসছে না! বিকেলে বাড়ি ফিরে তিনি সেকথা সরাসরি মেয়েকে না জিজ্ঞেস করে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করলেন, স্ত্রী কে রমেন বাবু চিনতেন, মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর ইচ্ছে তাঁর না থাকলেও স্ত্রী শুনবেন না এটা যেমন তিনি জানতেন তেমনই তাঁর মেয়েকেও তিনি খুব ভালো করে চেনেন, মেয়ে যে এধরনের ব্যক্তিগত কথা বলতে একেবারেই আগ্রহী নয় সেটাও তাঁর জানা ছিলো। তাই দুপক্ষের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে তিনি স্ত্রী কে থামিয়ে নিজেই মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন বলে ঠিক করলেন। সেই মতো সন্ধ্যের চায়ের আসরে অপর্ণাকে বললেন,

তোকে কি একাই ফিরতে হবে, সৌমিক কিছুতেই আসতে পারবে না? কতদিন দেখা হয়না, দেখ না বলে একবার ওকে!

অপর্ণা ঘাড় নাড়লো, বিরক্ত গলায় বললো,

কি বলি বলো তো বাবা, ওর সত্যি ছুটি নেই! এই অফিস টা কাছে হয়েছে ঠিকই কিন্তু দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে! চেষ্টা তো ও করেছে কিন্তু পারে নি! কতো আর জোর করবো বলো!

রমেন বাবু কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না, স্বামী কে ইতস্তত করতে দেখে সুপর্ণা আর ধৈর্য্য রাখতে পারলেন না,

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওই যে তোর শ্বাশুড়ি বলেছিলো না সৌমিক এখানে থাকতে পারে না, ওটাই আসলে ঠিক! সৌমিক মুখে কিছু বলেনা হয়তো কিন্তু এই ছোটো জায়গায় ওর এসে থাকতে অসুবিধা হয়।

অপর্ণা মায়ের ওপরে বিরক্ত হলো,

তুমিও না, পারো বটে! আমি যখন পরীক্ষা দিতে এসে ছিলাম, তখন ও কতোবার আসতো এখানে, কখনো কোনো অসুবিধার কথা বলেনি! এখন ওর সত্যি অসুবিধা মা!

সুপর্ণা গলা অভিমানী হলো,

সে আসতো হয়তো, তখন তো শীত ছিলো তাই অসুবিধা হয়নি! এখানে এসি নেই, এখন হয়তো গরমে অসুবিধা হয়। ওকে বলিস আমরা তো ছোটো জায়গায় থাকি অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়, কলকাতার মতো পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে পরিচয় নেই এমনটা তো নয়! এরপর থেকে তোকেও বলছি যখন সৌমিক আসতে পারবে তখনই তুইও আসিস, নাহলে আর আসিস না!

রমেন বাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই অপর্ণা তাঁকে থামিয়ে দিলো,

থাক বাবা! মাকে কিছু বলো না, মা হয়ত ঠিকই বলেছে! এর আগের বার যখন মা বিয়ের জন্যে জোর করছিলো তখন আমি বুঝিনি কিন্তু পরে বুঝেছিলাম মাকে সবার কাছে কতো কথা শুনতে হয়। আসলে এটা মা ঠিকই বলেছে কলকাতার পরিবেশের সঙ্গে রসুলপুর কে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, ওখানে সত্যি পাশের বাড়ির সঙ্গেও আমার শাশুড়ি কথা বলেন না! এই যে বিয়ের সময় আমি সারারাত বাইরের প্যান্ডেলে বসে রইলাম কেউ জানতেই পারলো না, অথচ এটাই এখানে হলে গোটা রসূলপুর জেনে যেতো একদিনে। তবে বাইরের লোকজন যাই বলুক তোমরা চিন্তা করো না সৌমিকের সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা হয়নি, পরের বার ওকে সঙ্গে নিয়েই আসবো আমি।

সুপর্ণা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন,

কোনো মেয়েকে বাপ, মায়ের কাছে আসিস না বলতে মায়ের যে কতো কষ্ট হয় সে আর কি বলবো বল! মা হ আগে তখন নিজেই বুঝবি সেটা! সৌমিক কে বল না একবার শুধু একটা দিনের জন্যে আসতে, শনিবার রাতে এসে নাহয় রবিবার চলে যাবে, আমার নাম করে বলবি নাহয়!

অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, কিন্তু মনে মনে স্থির করলো যেভাবেই হোক না কেনো ও সৌমিক কে রাজি করাবেই। মায়ের আড়ালে ফোন করে বললো সব কথা, তার না আসার জন্যে যে মাকে কথা শুনতে হয়েছে এটা শুনে সৌমিক আরো বিরক্ত হলো,

অদ্ভুত লোকজন তো সব! এদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই নাকি! এতো সময় পায় কোথায় এরা! তুমি মা কে ফোন দাও, আমি বুঝিয়ে বলছি ওনাকে!

অপর্ণা বিরক্ত হলো,

তোমাকে বললাম না, মা জানে না আমি তোমাকে আসতে ফোন করেছি! তুমি পারবে কিনা বলো, যদি পারো তবে মায়ের সঙ্গে কথা বলো।

সৌমিক খানিকক্ষন চুপ করে থেকে বললো,

বিশ্বাস করো অপর্ণা, যদি খুব ফোর্স করো তাহলে যেতে হবে হয়তো, কিন্তু একদিনও গেলেই আমার ভীষণ অসুবিধা এখন। রবিবার রাতে ফিরে সোমবার অফিসে যেতে খুব কষ্ট হয়, রসুলপুর থেকে ফিরতেই সব এনার্জি শেষ হয়ে যায়। দেখো না একটু ম্যানেজ করে প্লিজ, পরের বার শিওর যাবো।

অগত্যা অপর্ণা মাকে ম্যানেজ করে একাই ফিরলো, আসার আগে কথা দিয়ে এলো এর পরের বার সে সৌমিক কে নিয়েই ফিরবে। বাড়িতে ফিরেই রাতে বিছানায় সৌমিকের মুখোমুখি হলো অপর্ণা,

তুমি ঠিক কতদিন পরে আমাকে সঙ্গে নিয়ে রসুলপুরে যেতে পারবে বলোতো? তোমার জন্যে ওখানে মায়ের কতো সমস্যা হচ্ছে জানো! সবাই ভাবছে আমার সঙ্গে তোমার গন্ডগোল চলছে কিছু, তাই তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছো না!

সৌমিক অপর্ণা কে জড়িয়ে ধরলো, হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ বন্ধ করতে করতে বললো,

আর চারটে মাস সময় দাও, এর মধ্যেই ফ্রি হয়ে যাবো, সবটা বুঝতে সময় লাগছে একটু। তারপরে শিওর তোমার সঙ্গে রসুলপুরে যাবো, এর মধ্যে একদিনও ছুটি নিতে বোলো না, আমি যদি মরেও যাই তাহলেও আমার ভুত কে অফিস যেতেই হবে!

অপর্ণা সৌমিকের মুখে হাত চাপা দিলো,

কি সব কথা! এতো বাজে কথা বলো না তুমি!

সৌমিক মুখের ওপর থেকে অপর্ণার হাত সরিয়ে দিয়ে ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট রাখতে রাখতে বললো,

শুধু বাজে কথা বলি না, এমনিতেও আমি খুব বাজে!

অপর্ণা হেসে ফেললো,

হুঁ! সেটা তো বুঝতেই পারছি এখন!
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৩
অপর্ণা রসুলপুর থেকে ফিরে আসার পরে মাস খানেক কেটে গেলো, ইতিমধ্যেই দীপা বাড়িতে আসায় অনেকটা সুবিধা হয়েছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মোটামুটি সব দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে ও। রীনা খুশি হয়েছেন, প্রথম দিকে একটু চোখে চোখে রাখলেও এখন অনেকটাই ছেড়ে দিয়েছেন, দীপা তাঁরও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে তাড়াতাড়ি। কিন্তু রত্না মোটামুটি বরের সব দায়িত্ব দীপার ওপরে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকছে বলে কিছুতেই দীপা বাকিদের কাজে খুব বেশি সাহায্য করতে পারে না। সেই নিয়ে অনিন্দিতা আর অপর্ণা প্রায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। তারা মোটামুটি ঠিক করেই নিয়েছে মাস তিনেক পরে রত্না চলে গেলেও দীপা কে তারা ছাড়াবে না, নিজেদের কাজে রাখবে। অনিন্দিতা একটু অবশ্য চিন্তায় পড়েছে,

মা যা! রাখতে দেয় কিনা দ্যাখ!

অপর্ণা অবশ্য ভেবেই রেখেছে শাশুড়ি রাজি না হলে ও সৌমিকের সঙ্গে কথা বলবে, কারণ এই কাজের জন্যেই সৌমিকের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ওর মনোমালিন্য হচ্ছে! এখন এ বাড়িতে দায়িত্ব ভাগ হয়েছে, রাতের রান্নার দায়িত্ব পুরোটাই অপর্ণার, আর সেই দায়িত্ব যেকোনো সময় করা যায় না। অপর্ণা লক্ষ্য করেছে সৌমিক বাড়িতে ঢোকার পরেই রীনা ওকে রাতের রুটি তরকারি করতে যেতে বলেন। সৌমিক সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে চায় কিছুটা সময় অপর্ণা ওর সঙ্গে কাটাক, কিন্তু সেটা যেহেতু অপর্ণার পক্ষে সম্ভব হয়না তাই মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়ে যায় ইদানিং। কাল রাতেও এই নিয়েই কিছুটা মান অভিমান হয়েছিলো ওদের মধ্যে, অপর্ণা খানিকটা রাগের গলায় বলেছিলো,

তুমি প্রতিদিন আমার ওপরে রাগ দেখাও কেনো? এগুলো তোমার মাকে বলতে পারো তো? আমি যে নিজের মতো সময়ে করে রাখবো সেটা তো উনি করতে দেন না, বলেন খাবার আগে রুটি গরম চাই!

সৌমিক বিরক্ত হয়েছিলো,

সব কথা আমাকে বলতে হবে কেনো? নিজে মাকে একটু ম্যানেজ করে নিতে পারো না? বৌদি কে দেখো, কি সুন্দর সবটা ম্যানেজ করে চলে। কই দাদা অফিস থেকে এলে তো মা ওকে আটকে রাখে না? আর তাছাড়া এখন তো দীপা দি আছে, ওকে বলবে তোমার কাজে হেল্প করতে!

অপর্ণা শ্লেষের হাসি হেসেছিল,

দীপা দি? সেতো তোমার দিদির ব্যক্তিগত! আমাদের কাজে হেল্প করার সময় কোথায় তার, তোমার দিদি তাকে ছাড়লে তবে তো আমাদের সাহায্য করবে! আর হ্যাঁ, দিদিভাইয়ের মতো মেয়েই তো মা চায়! চাকরি ছেড়ে ঘরে বসে আছে মায়ের জন্যে! তো যে এতকিছু মেনে নেবে তাকে ওইটুকু ছাড় তো দেওয়াই যেতে পারে তাই না? তাও তো তাকে প্রায় মাঝ রাতে উঠতে হয় রান্নার জন্যে, বাড়িতে এতগুলো লোক কেউ উঁকি দিয়েও দেখে না কিভাবে এত কিছু একা হাতে করে ও!

সৌমিক উঠে দাঁড়িয়েছিলো, বিরক্ত মুখে আলনা থেকে গেঞ্জি টেনে গলাতে গলাতে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলেছিলো,

সব কিছুর পেছনে তোমার কোনো কথা থাকবেই! কোনো কোনো সময় তর্ক করা বন্ধ রেখে সমাধান খুঁজলে বোধহয় ভালো থাকতে! এটাই তুমি বুঝলে না! আমি বেরোলাম, তুমি রুটি করো নিশ্চিন্তে!

সৌমিক বেরিয়ে যাওয়ার পরে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো অপর্ণার, নিজের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো, সৌমিকও বুঝছে না ওকে! ওর কি ইচ্ছে করেনা সন্ধ্যেটা সৌমিকের সঙ্গে কাটাতে কিন্তু তার উপায় কোথায়! এই সন্ধ্যের রান্নার সময়টা এমন যে নিজের পড়াশোনা করতেও ওর বেশ অসুবিধা হয়। দু একবার এই নিয়ে ও অনিন্দিতার সঙ্গে আলোচনা করেছে, ভেবেছে সন্ধ্যের দায়িত্ব অনিন্দিতা কে দিয়ে ও নিজে সকালের টা নেবে রীনা সেটাও ওকে করতে দেন নি!

খুব বেশি অশান্তি এখনও হয়নি সৌমিকের সঙ্গে কিন্তু এরকম চলতে থাকলে যে কিছুদিনের মধ্যেই সেটা বড়ো অশান্তির চেহারা নেবে এটা অপর্ণা এখনই বুঝতে পারছে। তাহলে কি ও ছেড়েই দেবে পড়াশোনা এটাও কাল রাতে বেশ খানিকক্ষন ধরে ভেবেছে ও। বেশ অনেকটা রাতে শেষ পর্যন্ত কাল বাড়ি ফিরেছিল সৌমিক, এসে একটা কথাও বলেনি, অপর্ণারও রাগ হয়েছিলো, খেতে বসেও কোনো কথা বলেনি ও। রাতে শুতে গিয়ে ভেবেছিলো অন্যান্য দিনের মতোই সৌমিক আজও নিজের থেকেই কাছে ডাকবে ওকে কিন্তু কিছুক্ষন পরে সৌমিকের নিশ্বাসের আওয়াজে ও বুঝেছিলো সৌমিক ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু মন খারাপ নিয়েই এক সময় অপর্ণা নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলো কারণ সারাদিনের অত্যধিক ক্লান্তির পরে চোখ জুড়ে আসছিলো ওরও। যদিও নতুন নতুন বিয়ের পরের এই টুকটাক রাগ অভিমান মিটে যায় খুব শীঘ্রই, তাই অপর্ণা নিশ্চিন্ত ছিলো কাল অফিসে বেরোনোর আগেই সব মিট মাট হয়ে যাবে!

প্রায় মাঝ রাতে ফোনটা একটানা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো কিছুক্ষন পরে তাও অপর্ণার ঘুম ভাঙলো না। রসুলপুরে ওদের ঘরে এসি ছিলো না, এখানে এসে এসির হাওয়ায় বেশ ঠাণ্ডা লাগে অপর্ণার, তাই একটা পাতলা কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকে ও। ফোনটা দ্বিতীয় বার বাজতে শুরু করতে অপর্ণা লাফ দিয়ে কম্বল ছেড়ে উঠলো, এতক্ষনে মনে হলো এটা মাঝ রাত আর এতো রাতে কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন করে না।

টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে তুলে দেখলো একটা অচেনা নম্বর, ঘুম জড়ানো চোখে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরিচিত মহিলা কণ্ঠ খুব উদ্বেগের গলায় বললো,

অপর্ণা?

হ্যাঁ! কে বলছেন?

মহিলা কণ্ঠ একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় বললো,

আমি পারমিতা, ঋজুর বন্ধু, চিনতে পারছো?

অপর্ণার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেলো, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,

হ্যাঁ, পারছি! এতো রাতে ফোন করলে?

আমি না খুব বিপদে পড়ে গেছি গো! বাবা হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে খুব, কেউ নেই বাড়িতে মা ফোন করে বললো, তোমার কথাই মনে পড়লো তখন। একটু ঋজু কে বলতে পারবে আমাদের বাড়িতে যেতে?

অপর্ণা কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে নিজেকে সামলে নিলো,

হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি দাঁড়াও! তুমি চিন্তা করো না, কিছু একটা ব্যবস্থা করছি আমি!

ফোনটা রেখে অপর্ণা দ্রুত বিছানার কাছে এগিয়ে এলো ঘুমন্ত সৌমিক কে ধাক্কা মেরে বললো,

অ্যাই, শুনছো! মিতা দির বাবা না খুব অসুস্থ হয়েছেন, মিতাদি দিল্লি থেকে ফোন করেছে আমাকে, একটু যাবে প্লিজ!

সৌমিক ধড়মড় করে খাটে উঠে বসতে বসতে অবাক গলায় বললো,

কার বাবা? মিতার? ও তোমাকে ফোন করেছে?

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

হুঁ! আমি ওকে নম্বর দিয়েছিলাম, তোমাকে বলেছিলাম তো, ভুলে গেছো বোধহয়!

সৌমিক দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলো, যাবার সময় বলে গেলো যাতে মা জানতে না পারে সেটা অপর্ণা কে দেখতে, অপর্ণা পেছন পেছন নেমে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এলো আস্তে আস্তে, যাতে শাশুড়ি টের না পান। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাশের বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স আসার আওয়াজ পাওয়া গেলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌমিক আর মিতার মা কে অ্যাম্বুলেন্স করে বেরিয়ে যেতে দেখলো অপর্ণা।

সৌমিক বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে অপর্ণার আর ঘুম এলো না, এসি বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ও। রাত প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছে আর কিছুক্ষন পরেই অনিন্দিতা রান্না ঘরে ঢুকবে, কিন্তু এখন মাঝ রাতে বেরিয়ে যে সৌমিক কখন ফিরবে কে জানে, এসেই অফিস যাবে তাড়াহুড়ো করে, কথা বলার আর সময় থাকবে না তখন।

অপর্ণার মনটা একটু খারাপ হতে লাগলো, ইস! সৌমিকের সঙ্গে মিটমাট হলো না যাবার আগে, কাল তো আর রাতের আগে কথা বলার সময় নেই। কিন্তু ওর তো কিছু করার ছিলো না, মিতার বিপদের কথা শুনেও যদি ও সৌমিক কে না ডাকতো তাহলে তো ও নিজেকেই ক্ষমা করতে পারতো না কখনো। ভাবনার মধ্যেই অনিন্দিতার ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো, অপর্ণা বুঝলো রান্না শুরুর সময় হয়ে গেছে। আরো মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থেকে অপর্ণা নিচে নামলো, রান্নাঘরে তাকে এতো সকালে ঢুকতে দেখে অনিন্দিতা অবাক হলো,

আজ এতো সকালে চা করবি? ঋজু কোথাও যাবে নাকি?

অপর্ণা গলা নিচুতে নামালো,

না গো, চা করবো না! ও তো বেরিয়েছে, মিতাদির বাবা খুব অসুস্থ ফোন করেছিলো আমাকে, তাই! ওর বাবাকে তো অ্যাম্বুলেন্স করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো, সঙ্গে ওর মাও ছিলো! মাকে বলে দিও না যেনো, শুনলেই রাগারাগি করবে!

অনিন্দিতা অবাক হলো,

মিতা তোকে ফোন করেছিলো? কেনো? রবি থাকতে তোকে কেনো?

অনিন্দিতার কথায় হটাৎ করে অপর্ণার কেমন যেন ধাক্কা লাগলো, সত্যিই তো! রবি দা থাকতে ওকে ফোন করলো কেনো মিতা! অনিন্দিতা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো, অপর্ণা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলো,

রাতে রবিদার ফোন বন্ধ ছিলো হয়ত! আর আমিই তো ওকে বলেছিলাম দরকারে ফোন করতে তাই আমাকেই করেছে বোধহয়!

অনিন্দিতা ততোক্ষনে গ্যাসে কড়া চাপিয়ে দিয়েছিলো, পেছন ফিরে তেল ঢালতে ঢালতে বললো,

অপর্ণা! ফোন নম্বর দেওয়ার আগে মনে হয় তোর মাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো! এই শুরু হলো, এবার মাঝে মাঝেই ডাকবে! জানিস তো মা ওকে পছন্দ করেন না! তুই কতদিন লুকিয়ে রাখবি, মা জানতে পারলেই অশান্তি হবে! আর ঋজু যেতে রাজি হলো? এটাও আমার অবাক লাগছে!

অপর্ণার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা অশান্তি হতে লাগলো, তাও জোর করে ও মুখে হাসি টেনে আনলো,

কি যে বলো দিদিভাই! রোজ রোজ করবে কেনো? দরকার পড়েছে তাই করেছে! আর ও না গিয়েই বা কি করবে বলতো? বাড়িতে করার মতো কেউ নেই, এটুকু তো ভদ্রতা!

অনিন্দিতা কড়াতে তরকারি নাড়তে নাড়তে মৃদু গলায় বললো,

কি যে বলিস! মিতার মা তো দিব্যি সুস্থ সবল মানুষ, মায়ের সঙ্গে তো কোমর বেঁধে ঝগড়া করেছিলো তখন! আর এটা কলকাতা শহর, এখানে ফোন করলেই অ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে আসে, হাতে টাকা থাকলে আর সঙ্গে যাওয়ার মতো একজন থাকলেই চিকিৎসা হয়, পাশের বাড়ি থেকে লোক ডাকতে হয় না! আর তুই তো নিজেই বললি ওর মাও সঙ্গে গেছেন, তাহলে আর ঋজু কে টানার কি ছিলো!

অপর্ণা আর কথা এগোলো না, নিচে বসে পড়ে তরকারির ঝুড়ি টেনে নিয়ে বললো,

কি কাটবো বলো? আমার এখন আর ঘুম আসছে না!

অনিন্দিতা পেছন ফিরে শাশুড়ির ঘরের দিকে তাকালো, নিচু গলায় বললো,

থাক! রেখেদে তুই! মা বুঝতে পারলেই অশান্তি হবে! এই সকাল সকাল ভালো লাগে না এসব!

অপর্ণা বিরক্ত হলো,

তুমি না দিদিভাই! মাঝে মাঝে তোমার ওপরে বড্ড রাগ হয় আমার! এতো ভয় পাও কেনো মা কে? যেকোনো ব্যাপারে অশান্তি করলেই হলো নাকি! সারাজীবন ভালো বউ হয়ে থেকে নিজের জীবনের সব কিছু তো শেষ করে ফেলছ!

অনিন্দিতা ম্লান হাসলো,

আমার বর তো আর তোর বরের মতো নয় যে মায়ের কথার প্রতিবাদ করবে! তাই আমাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়! মিছিমিছি অশান্তি করে লাভ কি যদি সেই অশান্তির পরে তোকেই হার মেনে নিয়ে সেই কাজটাই আবার করতে হয়! তোর দাদা তো মাকে কিছু বলবেই না উল্টে ঘরের মধ্যে আমার সঙ্গেই অশান্তি করবে, তার চেয়ে এই ভালো! তুই বরং আটাটা মেখে দে, ওটা তো রাতে তোরই মাখার কথা, ধরা পড়লে বলবি রাতের কাজ এগিয়ে রাখছিস!

অপর্ণা হেসে ফেললো,

এটা ভালো বলেছো! জানতো দিদিভাই এই নিয়ে প্রায় তোমার দেওরের সঙ্গে আমার ঝগড়া হচ্ছে! এবার থেকে এটাই করবো তাহলে রাতে কিছুটা হলেও কাজ কম থাকবে!

অপর্ণার আটা মাখা, অনিন্দিতার রান্না সব হয়ে গেলো, কিন্তু বেলা বেশ গড়িয়ে গেলেও সৌমিক ফিরলো না, সকালে চায়ের টেবিলে বসে রীনা ছেলের খোঁজ করলেন, অপর্ণার মুখে ভয়ের ছায়া পড়লো, আর কোনো উপায় না দেখে ও নিচু গলায় বললো,

পাশের বাড়ির কাকুর শরীর খারাপ হয়েছিলো তাই ও হাসপাতালে গিয়েছে, মিতাদি ফোন করেছিল!

রীনা তৎক্ষণাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন,

ওই মেয়েটার এতো বড়ো সাহস, আমার ছেলে কে ডেকে পাঠায়!

রত্না পাশেই বসেছিলো, খাটে হেলান দিয়ে বসে থাকা রজতের দিকে তাকিয়ে বললো,

দেখেছো কেমন শয়তান মেয়ে! অসভ্যতা করবে আবার দরকারে সব সুযোগ সুবিধা নেবে! তোর একটুও লজ্জা করলো না ভাই কে ডাকতে! আর ভাই কেও বলিহারি যাই মা, ওই লোকটা কতো অপমান করেছিলো ভাই কে, তার পরেও ভাই গেলো! ওর কি কোনো মান অপমানের বোধ নেই!

রজত বউয়ের কথা শুনে অপর্ণার দিকে তাকালো,

তুমি ঋজু কে যেতে দিলে কেনো? ওকে আটকাতে পারতে তো!

অপর্ণা না জানার ভান করে নন্দাই এর মুখের দিকে তাকালো,

আমি কি করে জানবো ওর বাবা সৌমিক কে অপমান করেছিলেন? আপনারা তো কেউ এসব বলেন নি আমাকে, জানলে তো যেতে দিতাম না!

রজত চুপ করে গেলো, মুখ ফস্কে বলে ফেলা কথাগুলো কে রীনা তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন,

তোমার আর দোষ কি! আমাদেরই ভুল হয়েছে তোমাকে বলা হয়নি! সামান্য কথা কাটাকাটি হলো দু বাড়ির মধ্যে তাতেই ওনার কি বড়ো বড়ো কথা! সাধে ওদের দু চক্ষে দেখতে পারিনা আমি! আর মেয়েটাও হয়েছে তেমন, পাড়ায় তো নাকি কতো চেনাশোনা, দরকারে তো সেই আমার ছেলেকেই ডাকতে হয়! কিন্তু ও ফোন কি করে করলো ঋজু কে, ঋজুর ফোন তো রাতে বন্ধ থাকে!

অপর্ণা মনে মনে প্রমাদ গুনলো,

ওই আমিই দিয়েছিলাম আমার নম্বরটা, তখন তো জানতাম না আপনারা ওদের সঙ্গে কথা বলেন না!

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, রত্না বিরক্ত হলো,

কি যে করো না অপর্ণা! যেকোনো কাজ করার আগে মাকে একটু জিজ্ঞেস করে নেবে তো! আর ফোন করলেই বা কি, তুমি ভাই কে ডাকতে গেলে কেনো, যাবে না বলে দিলেই হতো!

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

না দিদি, সেটা পারবো না! একজন অসুস্থ জেনে ফোন রেখে দেবো, কিছু করবো না এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুতেই!

রীনা ফিরে তাকালেন, অপর্ণা কে কড়া গলায় বললেন,

সব দয়ার সাগর একেক জন, যেমন আমার ছেলে তেমন তার বউ! ফোন করো ওকে, ধরে দাও আমাকে আমি কথা বলবো!

অপর্ণা ফোন ধরে এগিয়ে দিলো, ছেলের গলা শুনেই রীনা রাগের গলায় বললেন,

তুমি মিতার বাবা কে নিয়ে গেছো শুনলাম, আর কেউ ছিলো না নাকি? যাইহোক কখন বাড়ি ফিরবে সেটা বলো? অফিস যাবে না তুমি?

সৌমিক এর গলা শুনতে পেলো অপর্ণা,

নাহ! আজ আর যাবো না, ওনার কন্ডিশন ভালো নয়! ফিরতে দেরি হবে আমার! বারবার ফোন করো না এখন, বাড়ি গিয়ে সব বলবো!

শাশুড়ি আর কিছু বলার আগেই সৌমিক ফোন নামিয়ে রাখলো, ফোন রেখে রীনা গজগজ করতে থাকলেন। মিনতি সবে মাত্র বাড়িতে ঢুকে রান্নাঘরের বাসনে হাত দিয়েছিলো, কথাবার্তার আওয়াজে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, সৌমিক ফোন রাখার পরে বললো,

মা টা কখন ঘরে ফিরে এসেছে দেখো আর ঋজু টাকে হসপিটালে বসিয়ে রেখেছে গো! পরের ছেলে বলে কি একটুও মায়া দয়া থাকবে নে!

রীনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

কি বললে? মিতার মা ফিরে এসেছে! দাঁড়াও তো! ভেবেছে টা কি ও! আমার ছেলে কে নিয়ে যা খুশি করবে আর আমি চুপ করে থাকবো!

রত্না তাড়াতাড়ি মাকে সামলানোর চেষ্টা করলো,

মা খবরদার কিছু বলতে যেওনা, ভাই কিন্তু ফিরে শুনলেই রাগারাগি করবে! ও নিজেই থাকতে চেয়েছে হয়ত, ছেলেতো তোমার কম গুণধর নয়!

রীনা নতুন করে চেয়ারে বসে পড়লেন, ছোটো ছেলেকে তিনি মনে মনে যথেষ্টই ভয় পান। অপর্ণা ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেলো, মনের মধ্যে সৌমিকের বলা কথা গুলো ফিরে ফিরে আসতে লাগলো তার।

ও তো সব সময় বলে আগাম না জানিয়ে ছুটি নেওয়া সম্ভব হয়না এখন, এমনকি চার মাসের আগে ও মরে গেলেও একদিনও ছুটি নিতে পারবে না বলেছিলো অপর্ণা কে মাত্র কিছুদিন আগেই, তাহলে আজ কি করে সম্ভব হলো সেটা! হাসপাতালে ভর্তি করার পরে কিই বা করার থাকতে পারে আর! আর এতো ব্যস্ততা যে শাশুড়ি ফোন না করলে তো ও জানতেই পারতো না সৌমিক আজ অফিস যাবে না! অফিস না গিয়ে ওখানে থেকে যাওয়ার কথা তো অপর্ণা কে নিজে থেকে ফোন করে বলা উচিত ছিলো ওর! তাহলে কি দিদিভাইই ঠিক! মিতা কি ইচ্ছে করেই রবি কে না জানিয়ে সৌমিক কে ফোন করলো! মনের মধ্যে একটা অপমানের এবং অস্বস্তির কাঁটা খচ খচ করতে লাগলো অপর্ণার, বেরিয়ে আসা কান্না চেপে রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনের মধ্যে যুক্তি এবং বিরুদ্ধ যুক্তির কাটাকুটি খেলতে লাগলো অপর্ণা।
ক্রমশ

#ঘষা কাঁচের দেওয়াল
#পর্ব ২৪
দুপুর গড়িয়ে গেছে, এর মধ্যে একবারের জন্যেও বাড়িতে ফোন করেনি সৌমিক। সবার খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, অন্য দিন রীনা অপেক্ষা করেন ছেলের জন্যে আজ খানিকটা রাগেই তিনিও খেয়ে নিয়েছিলেন, একমাত্র অপর্ণা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌমিকের অপেক্ষা করছিলো। একেক বার সৌমিক কে ফোন করতে ইচ্ছে করছিলো, বলতে ইচ্ছে করছিলো ও অপেক্ষা করছে খাবার জন্যে কিন্তু গতকালের মান অভিমান আর আজকের সৌমিকের ফোন না করা দুটো মিলিয়ে ফোন করা হয়ে ওঠেনি আর। তবে মনে মনেই অপর্ণার আশা ছিলো সৌমিক নিশ্চয়ই খেতে ফিরবে দুপুরে।

বেলা তখন প্রায় তিনটে বাড়ির সামনে একটা উবের এসে থামলো, অপর্ণা ঝুঁকে দেখলো গাড়ির দরজা খুলে প্রথমে সৌমিক বেরিয়ে এলো পেছন পেছন মিতা! সৌমিক বেরিয়ে এসে পেছনের ডিকি থেকে জিনিসপত্র বার করতে লাগলো, মিতা মুখ তুলে ওপর দিকে তাকাতেই অপর্ণার সঙ্গে চোখাচোখি হলো, ওকে দেখে মিতা হাসলো,

থ্যাংক ইউ অপর্ণা! ভাগ্যিস তোমার ফোন নম্বরটা দিয়েছিলে তখন!

অপর্ণা একটু হাসলো,

কাকু কেমন আছেন? তুমি কখন এলে?

মিতা ঘাড় নাড়লো,

খুব ভালো না গো! তাই তো চলে এলাম, ঋজু এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এলো আমাকে এখন! দেখি বিকেলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি! আসি গো, পরে কথা হবে!

মিতা ওর বাড়িতে ঢুকে গেলো, সৌমিক ওর লাগেজ বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির গেটে খুলছে দেখে অপর্ণা দরজা খুলতে নিচে নেমে এলো, মনের মধ্যে সেই সকাল থেকেই একটা অস্বস্তি হচ্ছে। সৌমিক ওপরে উঠে এলো, সবাই নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করার মতো কেউ ছিলো না। অপর্ণা পেছন পেছন উঠে এলো,

যাও, স্নান করে নাও আমি ভাত বাড়ছি! সারাদিন কি খেয়েছো কে জানে! আমিও খাইনি তোমার জন্যে বসে আছি!

সৌমিক থমকে দাঁড়ালো,

আমার জন্যে বসে ছিলে কেনো? এতো বেলা পর্যন্ত আমি কি না খেয়ে থাকবো নাকি! তুমি খেয়ে নাও, মিতা আর আমি এয়ারপোর্টে লাঞ্চ করে এসেছি!

অপর্ণার হটাৎ করে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, সৌমিক খেয়ে নিয়েছে, ওকে একবার বলেও নি! খানিকটা রাগের গলায় বললো,

বাবা! এদিকে বাবা নাকি অসুস্থ! তার তখন রেষ্টুরেন্টে বসে খেতে ইচ্ছে হলো! জানিনা বাবা এরা কিরকম, মেয়ে হোটেলে খাচ্ছে, মা বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছে, একমাত্র তোমাকেই দেখছি মাঝরাত থেকে দৌড়ে বেড়াচ্ছ! বাবা টা যে কার মিতার না তোমার বোঝা মুশকিল!

সারাদিন পরে বাড়িতে ঢুকেই এই ধরনের কথায় সৌমিকের মেজাজ গরম হয়ে গেলো,

কি বাজে কথা বলছো? বাবা অসুস্থ বলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ থাকবে নাকি! আর ওর মা বয়স্ক মানুষ সারারাত কি হসপিটালে বসে থাকবেন নাকি, আমিই বলেছি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে!

খালি পেটে রাগটা বোধহয় একটু বেশিই হয় অপর্ণা তাই আরো বেশি রেগে গেলো,

ও কি একা কোনোদিনও আসেনি এয়ারপোর্ট থেকে? প্রথম বার এলো এখানে? ওকে আবার আনতে যাওয়ার কি ছিলো তোমার? এই কাজটা আবার কোন দরদ দেখাতে করতে গেলে?

আসতে কেনো পারবে না, ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত ছিলো তাই গিয়েছি। তুমি জানো অপর্ণা আমি এতো কৈফিয়ত দিতে পছন্দ করিনা, তবু এসব বলছো! মিছিমিছি বাড়ি ঢুকেই অশান্তি কোরো না, যাও খেয়ে নাও গিয়ে!

অপর্ণা এসি চালিয়ে দিয়ে খাটে শুয়ে পড়লো কম্বল মুড়ি দিয়ে,

আমার খাওয়া নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! যাও তুমি হসপিটালে গিয়ে বন্ধু কে নিয়ে বসে থাকো!

সৌমিক খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো,

তোমার মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে! যা খুশি বলছো!

সৌমিক যখন বাথরুম থেকে ফিরে এলো অপর্ণা তখনও শুয়ে ছিলো, সৌমিক বারান্দায় টাওয়েল মেলতে মেলতে ডাকলো,

খেয়ে নাও, আমার ওপরের রাগ খাওয়ার ওপরে কেনো?

অপর্ণা কোনো উত্তর দিলো না, সৌমিকের একটু একটু খারাপ লাগছিলো, অপর্ণা কি ঠিকই বললো, ওর বোধহয় এয়ারপোর্টে মিতা কে আনতে যাওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে!

মিতা ভোর বেলা ওর মায়ের ফোনে ফোন করেছিলো, উনি ফোন টা সৌমিক কে এগিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন

ও বললো তোমাকে ফোন করে পাচ্ছে না, কথা বলো একটু!

সৌমিক জানতো ও মিতাকে ব্লক করে রেখেছিলো তাই কথা না বাড়িয়ে ফোন ধরেছিলো,

বল!

মা বললো, ডাক্তার নাকি বলেছেন অবস্থা ভালো নয়, আমি কি চলে আসবো? তোর কি মনে হয়? মা তো বলছে চলে আসতে!

সৌমিক উত্তরে হ্যাঁ বলেছিলো, তারও মনে হয়েছিলো মিতার চলে আসা উচিত। ফোন নামিয়ে রাখার আগে মিতা বলেছিলো,

একটা কথা বলবো, কিছু মনে করিস না, ব্লকটা খুলে দিস প্লিজ! প্রয়োজন ছাড়া ফোন করবো না তোকে!

তারপরে একটু বেলার দিকে ফোন টা মিতাই করেছিলো ওকে,

দুপুরের ফ্লাইটে আসছি, নিতে আসবি একটু? অনেক লাগেজ আছে!

যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলো সৌমিক, বেরিয়েই মিতা বললো সেভাবে কিছু খাওয়া হয়নি সকাল থেকে, চল খেয়ে নিই কিছু! খিদে ওরও পেয়েছিলো তাই খুব একটা আপত্তি জানায়নি সৌমিক কিন্তু একবারের জন্যেও মনে হয়নি অপর্ণা না খেয়ে বসে থাকতে পারে, তাহলে ও একটা ফোন নিশ্চয়ই করে দিতো!

কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থেকে সৌমিক অপর্ণার গায়ে হাত রাখলো,

অপর্ণা প্লিজ খেয়ে নাও! ভুল হয়ে গেছে, আমার আসলে খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিলো তাই খেয়ে ফেলেছিলাম, বুঝিনি তুমি বসে থাকবে!

অপর্ণা কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো, খিদে তারও পেয়েছিলো, অভিমান করে বেশিক্ষন বসে থাকার ক্ষমতা ছিলো না আর। সৌমিক এর দিকে তাকিয়ে বললো,

একটা ফোন তো করতে পারতে! সকাল থেকে তো একবারও আমার কথা তোমার মনেই পড়েনি! পুরনো বন্ধু পেয়ে সব ভুলে গেছো!

সৌমিক হেসে ফেললো,

তো সেই পুরনো বন্ধুকে ফোন নম্বরটা দিয়েছিলো কে? আপনিই তো? যদি না দিতেন তাহলে তো এসব হতো না! যান দয়া করে খেয়ে আসুন!

অপর্ণাও হেসে ফেললো, সে এসি বন্ধ করে, জানলা খুলে নিচে খেতে চলে যাওয়ার পরে সৌমিক শুয়ে পড়লো, ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো তার। অপর্ণা ফিরে দেখলো সৌমিক ঘুমিয়ে গেছে, তাকে না ডেকে একটু আগে খুলে দিয়ে যাওয়া জানলাটা আজ নিজেই আবার বন্ধ করে দিলো ও। ঘুমন্ত সৌমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো, একটু আগেই বলা কথাগুলোর জন্যে খারাপ লাগতে লাগলো একটু একটু।

সবাই কে বিকেলের চা দিয়ে যখন সৌমিকের চা নিয়ে অপর্ণা সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল তখন রীনা তাকে ডাকলেন,

ঋজু ফিরেছে? ওকে চা খেয়ে পরে আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে বোলো।

অপর্ণা ঘাড় কাত করলো,

আচ্ছা!

চা নিয়ে গিয়ে সৌমিক কে ডাকতে সৌমিক উঠে বসলো, হাত বাড়িয়ে কাপ হাতে নিয়ে অপর্ণার দিকে তাকালো,

ঘুমাও নি তুমি দুপুরে?

অপর্ণা মাথা নাড়লো,

নাহ! ঘুম এলোনা! মা তোমাকে ডাকছেন, চা খেয়ে নিচে যাও!

সৌমিক মুখে বিরক্তির আওয়াজ করলো,

আবার ওই এককথা শুরু করবে! সব ব্যাপারে এতো ঢুকে পড়ে, বোঝেই না সবার নিজের মতামত থাকে!

অপর্ণা পাশে বসলো, সৌমিকের ডান হাতটা বাম হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো,

সরি! কাল রাতে খুব রাগ হয়ে গিয়েছিলো, অনেক কিছু বলে ফেলেছি!

সৌমিক হাসলো,

ঠিক আছে, আমিও ভুলই বলেছিলাম আসলে! সত্যিই তো তোমার কাজকর্ম, পড়াশুনা সব কিছু নিয়েই তো তোমাকে চলতে হবে! এর জন্যে রাগ দেখানোর কোনো মানে হয়না! আসলে সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে তোমাকে এতো ব্যস্ত দেখলে রাগ হয়ে যায়, মনে হয় এগুলো তো আগেও করে রাখতে পারতে! কিন্তু মা যদি করতে না দেয় তোমারই বা কি করার আছে!

অপর্ণা গলা নিচু করলো,

বাড়িতে সবাই রেগে গেছে, আমি যে মিতাকে ফোন নম্বর দিয়েছিলাম এটা মায়ের কাছে বলতে হলো শেষে! রাতে তো তুমি ফোন বন্ধ রাখো, তাই মা বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন।

সৌমিক হাসলো,

মা কি খুব রেগে আছে নাকি? যাকগে! কি আর করা! সব কিছু তো ইগনোর করা যায়না, যাই হোক না কেনো ওর আমরাই সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী! তাই এটুকু তো করাই উচিত!

অপর্ণা সৌমিকের দিকে তাকিয়ে, নিচু গলায় বললো,

আমার একটু অদ্ভুত লাগছে, দিদিভাইও বলছিলো সকালে! আচ্ছা ও কেনো রবি দাকে ডাকলো না একবারও! রবি দা পুলিশে আছে, ওর তো সোর্স অনেক বেশি!

সৌমিক অপর্ণার চোখে চোখ রাখলো,

তোমার কি খুব খারাপ লেগেছে আমি গেছি বলে? ফোন নম্বরটা কিন্তু তুমিই দিয়েছিলে! রবি কে কেনো ডাকেনি সেটা বলতে পারবো না, জিজ্ঞেস করিনি অতো কিছু! তবে তুমি এটা বলতে পারো আমি এয়ারপোর্ট এ গেলাম কেনো! সত্যি বলতে কি অতো কিছু ভেবে করিনি, ও বললো অনেক লাগেজ আছে তাই চলে গেলাম! হয়ত সত্যি সেটা আমার উচিত হয়নি, সেটা নিয়ে তোমার এতটা ক্ষোভ হবে বুঝলে যেতাম না হয়তো!

অপর্ণা লজ্জিত হলো, নিচু গলায় বললো,

এমা! না, না আমিও অতো কিছু ভেবে বলিনি তোমাকে! আসলে আমি অপেক্ষা করেছিলাম তো তাই তুমি খেয়ে নিয়েছো শুনে হটাৎ রাগ হয়ে গিয়েছিলো। তবে এটা ঠিক যে তুমি একটা ফোন করতে পারতে, হসপিটালে ভর্তি করে দেবার পরে আর তো নিশ্চয়ই সেরকম ব্যাস্ত ছিলে না।

সৌমিক মাথা নাড়লো,

সত্যি ব্যাস্ত ছিলাম, অনেক ফর্মালিটি থাকে। তুমি যেহেতু ফোন করেছিলে তাই পরে আর করিনি তোমাকে, নাহলে একটু ফ্রি হয়ে করতাম। তবে ওনার অবস্থা সত্যিই ভালো নয়, তাই মিতা কে চলে আসতে বললাম।

অপর্ণা আর কোনো কথা বলার আগেই সৌমিকের ফোনটা বাজলো, হাতে নিয়ে মিতার নাম দেখে ফোনটা সৌমিকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,

তুমি ওকে ব্লক করেছিলে না? আবার খুলে দিয়েছো নাকি!

সৌমিক হ্যালো বলতে বলতে ঘাড় কাত করলো,

হুঁ!

হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে মিতা জিজ্ঞেস করলো,

মা বললো আটটা নাগাদ ডাক্তার কথা বলবেন, তুই কি একটু যাবি আমার সঙ্গে?

সৌমিক অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলো,

একটু পরে জানাচ্ছি তোকে!

অপর্ণা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, সৌমিক ফোন রেখে রবি কে ফোন করলো,

মিতার বাবার খবর শুনেছিস?

রবি অবাক হলো,

না তো! কি হয়েছে?

সৌমিক সব কিছু বলার পরে জিজ্ঞেস করলো,

তোকে মিতা কিছু বলেনি?

রবি হাসলো,

নাহ! সেই যে আমার বাড়িতে এসে ঝগড়া করে গেলো আর কথা বলেনি তো! তারপরে দিল্লি গিয়ে আর দেখা করার সময় পাইনি, তাই বাবুর গোঁসা হয়েছে! এখন কেমন আছেন কাকু?

সৌমিক খাটে উঠে বসলো,

খুব একটা ভালো না! শোন না, তোকে সেই জন্যেই ফোন করেছিলাম, ডাক্তার কথা বলবেন আটটায়! সারাদিন পরে একটু আগেই ফিরেছি আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। তুই একটু মিতার সঙ্গে যেতে পারবি কি তাহলে আমি একটু রেস্ট নিতাম!

রবি হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গে সৌমিক ফোন রেখে দিল, রাখার আগে বললো,

মিতার সঙ্গে একটু কথা বলে নে তাহলে, আর রাতে ফিরে আমাকে একটু ফোন করিস ওই অপর্ণার সেই রসূল পুরের বন্ধুর ব্যাপারে তোর সঙ্গে একটু কথা বলবো!

ফোন নামিয়ে রেখে অপর্ণার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো সৌমিক,

আর বেরোব না, খুব টায়ার্ড লাগছে! সবে তো সন্ধ্যে তোমার নিশ্চয়ই রুটি করার সময় হয়নি এখনও!

মিতার সঙ্গে গেলো না সৌমিক! সকালের রাগ, অভিমান একমুহূর্তে দূর হয়ে গেলো, মনের মধ্যে একরাশ খুশি চেপে রেখে অপর্ণা হাসলো,

না! এখনো অনেক দেরি আছে!
ক্রম