চলো রোদ্দুরে পর্ব-০২

0
734

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_2

এই মধ্য রাতেই হেঁটে চলেছে দুজনে। এক মুহুর্তের মধ্যে সব কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। বিয়ে , সাজসজ্জা সব কেমন এলোমেলো। বিয়ের কথা ছিলো তবে সেটা তো অন্য একজনের সাথে। মৃদু ছন্দ তুলে দুজনে গ্রামের পথ পেরিয়ে আসে বড় সড়কে। চোখের পানি এখনো শুকোয় নি। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মনে হতেই বুকে ব্যাথা অনুভব হয়। মিনমিনিয়ে ভোর বলে
_কাজ টা ঠিক হলো না ডাক্তার সাহেব। আপনি হুট করে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহন করে নিলেন।

_কিছু বললে ভোর ? উফ স্যরি তুমি করে বলে ফেললাম।

_ সেটা ঠিক আছে। তবে বিয়ে টা করা উচিত হয় নি। আপনার পরিবার কখনোই এটা মেনে নিবে না।

উত্তর করে না রাদ। সে নিজে ও জানে কাজ টা ঠিক হয় নি। তবে সেই মুহূর্তে ভোর কে নিজের সাথে নিয়ে আসাই বেটার মনে হয়েছে। এমন অনৈতিকা সম্পূর্ন মানুষ দের কাছে মেয়েটা কে রেখে আসলেই অতি শীঘ্রই শোনা যেন আত্মহত্যা করেছে ভোর। কিংবা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষ হয়ে গেছে। সেই দৃশ্য কল্পনা হতেই গাঁয়ের প্রতি টা শিরা উপশিরা জেগে উঠে। এখনো কিছু মানুষ উক্ত কুসংস্কারের মেতে আছে। অবশ্য শুধু বাবা মা নয় ছেলে মেয়েরা ও একি পথের যাত্রী। বৃদ্ধ বাবা মা কে ঘরে না রেখে বৃদ্ধাশ্রম কে কাঁধে তুলে দেয়। এমন কিছু অনৈতিক মানুষের জন্য ই বাবা মা ও সন্তান সকলেই কলঙ্কিত হচ্ছে। দোষ একজন করলে ও এর প্রভাব পুরো জাতির উপর পরে।
মাথা নত করে আছে ভোর। দু চোখের কোনে এখনো মুক্ত দানার মতো চিক চিক করছে পানি। নিজের সিদ্ধান্ত যেমনি হোক মেয়েটা কে গড়ে তুলতে হবে এটাই রাদের উদ্দেশ্যে।
_ গাড়ি তে উঠো।

_আমি যাবো না ডাক্তার সাহেব।

_মানে !

_আপনি চলে যান। আমাকে নিয়ে অনেক সমস্যায় পরতে হবে। দয়া করে চলে যান।

_কিন্তু ভোর।

হাত দুটো এক সঙ্গে মিশিয়ে অনুনয়ের স্বরে ভোর বলল
_দয়া করে চলে যান আপনি। আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। প্লিজ ডাক্তার সাহেব প্লিজ।

দু বার নিশ্বাস ফেলে রাদ। ভোরের দিকে তাকিয়ে গাড়ি তে উঠে বসে। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ধোঁয়া উঠিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। যতো টা এগোয় ঠিক ততোটাই কষ্ট অনুভব হয়। নিজের বলা প্রতি টা কথা মনে পরে যায়। গাড়ি থামিয়ে দেয়। কোনো দিকে না তাকিয়ে পেছনে ছুট লাগায়। সিক্ত নয়নে সামনে আগাচ্ছে ভোর। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। পিছু ডাকে রাদ। চিৎকার করে বলে
_ভোর।

পেছন ফিরে তাকায় মেয়েটা। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে
_ডাক্তার সাহেব!

ভোরের কাছে এসে হাঁটু তে হাত দিয়ে হাঁফাতে থাকে। ভোর যেন আকাশ থেকে পরেছে। একটু থেমে নিয়ে ভোরের হাত ধরে রাদ বলে
_চলো

_কোথায় ?

_রোদ্দুরে।

_কিন্তু আপনার ফ্যামিলি।

_সব কিছু বাদ দাও। তোমাকে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে এসেছি আমি। সবাই কে দেখাতে হবে তো। আমি যে এই অন্ধকার থেকে তোমাকে রোদ্দুরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। আমার প্রতিশ্রুতি এটা।

_কিন্তু ডাক্তার সাহেব।

_আরে আসো তো।

ভোরের কথার তোয়াক্কা না করে ওর হাত ধরে নিয়ে যায় রাদ। নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। সত্যি ই কি অন্ধকার থেকে রোদ্দুরে নিয়ে যাচ্ছে রাদ। নাকি সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছে আরো বড় কোনো অন্ধকার।

সামনের দিকে চোখ নিমজ্জিত রেখেই রাদ বলল
_কি হয়েছে?

_কিছু না।

_তুমি চিন্তাগ্রস্ত তাই না?

_কিছু টা।

_ডোন্ট ওরি। আমি তোমাকে সব ভাবে সাহায্য করবো। তোমার পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। শহরে গিয়ে তোমাকে হোস্টেলে ভর্তি করে দিবো। দুদিন পর আমার আরেক টা মেডিকেল ক্যাম্পিন আছে। দ্যান তোমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো।

_আচ্ছা।

গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দেয় ভোর। বিয়ে নিয়ে প্রতি টা মেয়ের কতো স্বপ্ন থাকে। ওর ও ছিলো। তবে সে স্বপ্নের প্রতি আজ আগ্রহ নেই। আছে শুধু সস্তার কিছু আবেগ আর দীর্ঘশ্বাস ।
.

_মরশুমি ম্যাম দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে।

_উফ নিতু আমার নাম মরশুমি না মৌশুমি।

_ঐ একি তো হলো।

_কি হয়েছে বলো।

_দেখুন এই শাড়ি টা আজ ই কিনেছি। ভালো দেখতে তাই না?

_হুম ভালো।

নিতুর অহেতুক কথা বার্তা একদম ই পছন্দ নয় মৌশুমির। মেয়েটা আস্ত এক গোবরে ঠাসা। যেখানেই যাবে নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে আসবে। আর তৎক্ষনাৎ পরে সেলফি শুরু করবে। নিজের প্রশংসা তো করবেই।

_মরশুমি ম্যাম।

_নিতু প্লিজ। কাজ করছি আমি। তোমার সাথে কেন যে ডিউটি পরে।

মুখ বাঁকায় নিতু। নিজেকে দেখতে থাকে এপাশ ওপাশ করে। সাত সকালে গোসল করেই নতুন শাড়ি পরেছে। বয়স টা একটু বেশি হলে ও সাজ সজ্জা একদম বাচ্চা দের মতো।
_নিতু এই ফাইল টা রেডি করো। স্যার এসেই আমাদের ইচ্ছে মতো ঝাড়বেন।

_উফফ মরশুমি ম্যাম আপনি অহেতুক চিন্তা করেন।

_ধ্যাত।

ফাইল নিয়ে চলে আসে মৌশুমি। তিন টে বছর ধরে নিতুর মরশুমি ম্যাম মরশুমি ম্যাম শুনতে হচ্ছে। বয়স নয় নয় করে ত্রিশ পেরোলে ও এখনো বিয়ে করে নি। এর পেছনে অদ্ভুত কারন রয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে বড় রকমের ছ্যাঁকা প্রাপ্ত হয়েছে। শপথ করেছিলো ঐ ছেলে কেই বিয়ে করবে। সেই শপথ রক্ষার্থে এখনো বিয়ের পিরিতে বসা হলো না নিতুর। হসপিটালের মেইন ডোর দিয়ে রাদ কে আসতে দেখে জড়োসড়ো হয়ে যায় মৌশুমি। সামান্য ঝুঁকে বলে
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং। ড্যাড এসেছে?

_নো স্যার। এম ডি স্যার তো দশটার আগে হসপিটালে আসেন না।

_ওহ তাই তো। এনি ওয়ে আমার কিছু টাকা লাগবে তাই হসপিটাল থেকে নিয়ে যাচ্ছি। ড্যাড আসলে বলবেন আমার কার্ড টা লক হয়ে গেছে।

_জি স্যার।

ম্যানেজার এর কাছে আসে রাদ। কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন তিনি। ভদ্রতার খাতিরে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করে। ইমরান বলেন
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং আঙ্কেল। একাউন্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিন আমায়। একটু আর্জেন্ট।

_ওকে। আপনি সাইন করে দিন আমি নিয়ে আসছি।

_জি

সাইন করে দেয় রাদ। ইমরান কিছু টা অবাক হোন। যতো দূর জানেন কাল রাতেই বাসায় ব্যাক করার কথা ছিলো। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে এখন আসলো। চমশা টা নাকের ডগায় চলে এসেছে। নিতু বলে
_একি স্যার আপনার চশমা নাকে চলে এসেছে কেন? আজকাল নাকে চশমা পরা কি স্টাইল।

_নিতু।

ইমরানের ধমকে চমকে যায় নিতু। তুতলে বলে
_জি স্যার।

_রাদ স্যার এসেছেন দ্রুত পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দাও। আর হ্যাঁ ফালতু কথা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দাও।

_ইয়েস স্যার।

পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল তুলে দেয় নিতু। ইমরান চলে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ড এখনো উঠা নামা করছে।

ইমরানের থেকে টাকা নিয়ে চলে আসে রাদ। গাড়ি তে বসে আছে ভোর। ওকে দেখেই মাথা টা উঁচু করে বসে। হোস্টেলে গিয়েছিলো , তবে কার্ড কাজ না করায় ভোর কে ভর্তি করাতে পারে নি। তাছাড়া এতো গুলো টাকা ক্যাশ ও ছিলো না ওর কাছে।
_আমার জন্য শুধু শুধু এতো গুলো টাকা খরচ করে যাচ্ছেন।

_আপনার মোহরানা দেওয়া হয় নি এখনো। আমি আপনার কাছে এক প্রকার ঋনগ্রস্ত।

_এই বিয়ে টার কোনো মানে নেই ডাক্তার সাহেব। অহেতুক আপনার জীবনে কাঁটা হয়ে গেলাম আমি।

_ভালো কাজ করা কোনো দোষের নয়। বিয়ের বিষয় টা পরে দেখা যাবে। আপাততো আপনাকে হোস্টেলে ভর্তি করানো টাই কাজ।

_কিন্তু এতো গুলো টাকা।

_মোহরানা তে বিশ লাখ টাকা। সেই টাকা দেওয়ার জন্য কিছু টা সময় দিতে হবে। আমার কার্ড টা লক হয়ে আছে ।

রাদের কথা তে ভ্রু কুঁচকে যায় ভোরের। মোহরানা তে বিশ লাখা টাকা লিখেছে। কথা টা শুনেই মাথা ভন ভন করে। এক লাখ টাকার জন্য ওর বিয়ে টা ভেঙে গেছে। আর এখানে মোহরানা বিশ লাখ টাকা। ভোরের দিকে তাকিয়ে রাদ বলে
_তুমি কি কোনো ভাবে আপসেট?

_আমার বিয়ে টা এক লাখ টাকার জন্য ভেঙে গেছে। আর আপনি মোহরানা তে বিশ লাখ টাকা দিয়েছেন।

_এটা বিষয় নয় ভোর। অতো গুলো মানুষের সামনে আমি আপনাকে গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ করে এসেছি। এটাই ফেক্ট , বাকি সব কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা মাত্র।

_ আপনার এক বার ও মনে হচ্ছে না অজানা অচেনা মেয়ের প্রতি বেশিই সহানুভূতি হয়ে যাচ্ছে।

_তা একটু হচ্ছে। তবে অজানা অচেনা হলে ও ধর্ম মতে আপনি আমার স্ত্রী।

স্ত্রী শব্দ টি যেন ভোরের অস্তিত্ব নাড়িয়ে দেয়। সত্যি ই তো রাদ তো ওর স্বামী। বিয়ে টা যেই কারনেই হোক সম্পর্ক টা তো মিথ্যা নয়। গাড়ি থেমে যায়। সিটবেল খুলে বাইরে নেমে আসে রাদ। ভোর নামছে না দেখে রাদ বলে
_দ্রুত নেমে আসো।

_ হুমম।

হোস্টেলের ফি প্লাস এডভান্স দিয়ে দেয় রাদ। একটা ফর্ম পূরন করতে দেয় ওকে। পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিছু টা বিব্রত হয়ে যায় ছেলেটা। ভোরের পরিচয় কি দিবে সেই চিন্তা তেই থম মেরে থাকে। কাউন্টারের মেয়ে টার ডাকে ধ্যান ভাঙে। বলে
_স্যার ফর্ম টা এখনো পূরন হয় নি। আপনাদের সর্ম্পক দিতে হবে।

_সর্ম্পক।

_জি। ওনি আপনার কি হয়?

ভোরের দিকে তাকায় রাদ। কি লিখবে এখন। অনেক ভেবে চিন্তে বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী সম্পর্ক টা লিখে দেয়। ফর্ম দেখে মেয়েটা বলে
_আপনার স্ত্রী কে নিয়ে আসুন স্যার। আমি ওনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।

_জি।

স্ত্রী শব্দ টি নেহাত ই মন্দ নয়। বেশ ভালোই লাগলো ওর কাছে। বেঞ্চে বসে আছে ভোর। গাঁ থেকে কাঁচা হলুদ মিশ্রিত ঘ্রান নাকে এসে লাগছে। সুভাস টা বেশ দারুন। হলুদ কাপড়ে ভোর কে সূর্যের সেই হলুদ রোদ্দুর ই মনে হয়। যেন তাকানো দায়। চোখ ঝলসানো রূপ।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে