চলো রোদ্দুরে পর্ব-০৩

0
703

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_3

হোস্টেল এর বাইরের দিক টা যেমন সুন্দর তাঁর থেকে বেশি সুন্দর ভেতরে। কিছু টা থ্রি স্টার রেস্তারার রুমের মতোই। হবেই না কেন ? মান্থলি পনেরো হাজার টাকা ফি। যেন তেন রুম তো কোনো কালেই সম্ভব নয়। রুমের এক পাশে গুটিয়ে রাখা কম্বল দেখে রাদ বলল
_এক্স কিউজ মি।

_ইয়েস স্যার।

_কম্বল টা সরানোর ব্যবস্থা করুন প্রয়োজনীয় সব আমি এনে দিবো।

_ওকে স্যার।

মেয়েটা চলে যায়। ভোর বলে
_এটা না সরালে ও হতো।

_উহুহ ব্যবহার করা জিনিস গাঁয়ে তুলবে না। ফ্রেস টা এনে দিবো। তাছাড়া তোমার কস্টিউম ও লাগবে।

_ এতো ভাববেন না ডাক্তার সাহেব।

_এতো ভাবছি না ভোর। তোমাকে দায়িত্বের সাথে নিয়ে এসেছি। ভালো মন্দ দেখা আমার নৈতিকতার মধ্যে পরে। আর এস অ্যা ফিউচার ডক্টর আমি তোমার হাইজিন এর উপর পুরোপুরি খেয়াল রাখবো এটাই স্বাভাবিক। এন্ড এটার মানে একজন ডক্টর হওয়ার গুন আমার মাঝে একটু হলে ও রয়েছে।
জানো , বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক জনের ব্যবহার করা জিনিস অন্য জন ব্যবহার করা উচিত নয়। অনেকের অনেক রকম রোগ থাকে। আই নো দ্যাট ঐ টা ওয়াস করা তবে দরকার কি রিক্স নেওয়ার।

ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ভোর। রাদের বাচন ভঙ্গিমা ওকে মুগ্ধ করে। যে কোনো ফাংশনে বিনা প্রস্তুতি তে বক্তব্য করতে পারবে ছেলেটা। ভোর কে তাকাতে দেখে রাদ বলে
_ফ্রেস হয়ে আসো আমরা বের হবো।

_বেশি ভালো কিন্তু ভালো নয় ডাক্তার সাহেব।

_মানে।

_কিছু না।

ওয়াসরুমে চলে যায় ভোর। মেয়েটার বলা কথাতে কিছু একটা ছিলো। কিন্তু কি ছিলো?
কোনো ভাবে ভোর কি ওকে অবিশ্বাস করছে। গ্রামের মানুষের উটকো চিন্তা ধারনার মতোই কি ভোর ও চিন্তাগ্রস্ত। শীতের মাঝে ও চিকন ঘাম হয় ছেলেটার। ভোরের অবিশ্বাস মাখা কথা যেন কিছু তেই হজম হচ্ছে না। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আসে ভোর। মাথার ব্যান্ডেজ টা ভেদ করে রক্ত নেমেছে কিছু না। সেই রক্ত পরিলক্ষিত হতেই ব্যস্ত হয়ে পরে রাদ। কাবাড থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে সেটা থেকে তুলো আর মলম নিয়ে বসে। ভোরের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়ে যেন শ্বাস ফেলে। তাঁতে ও যেন বিশাল প্রশ্ন বাঁধায় ভোর। তাঁর চাহনি আবারো মনে করিয়ে দেয় ‘ ডাক্তার সাহেব বেশি ভালো কিন্তু ভালো নয় ‘

কিছু টা ছিটকেই সরে যায় রাদ। উন্মাদ পাগলের মতোই লাগছে নিজেকে। ভোরের একটা কথা যেন ওকে টেনে ধরে প্রতি পদক্ষেপে। কিছু তো আছে এই কথাতে। কিন্তু কি বোঝাতে চেয়েছে ভোর। এক বার কি জিজ্ঞেস করবে ওহ? না এই কথা টা টেনে হিঁচড়ে ধরে জিজ্ঞাসা করার বিষয় নয়। তবু ও কেন মনে শান্তি মিলছে না।

_আমরা কি এখন বের হবো?

_হুমম। তুমি রেডি হয়ে গেছো?

_আমার আর কি। চুল টা বেঁধে নিয়েছি শুধু।

_এই তুমি খোঁপা বেঁধেছো কেন?

_প্রচন্ড ঝট হয়ে আছে।

_ওহ আচ্ছা আসো তাহলে।

একটা শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে এসে বেশ বিপাকে পরে ভোর। এতো বড় শপিং মলে আসা তো থাক কখনো চোখেই দেখে নি। বছরে এক বার নিজের উপজেলার ছোট খাটো শপিং মলে আসা যাওয়া হতো। সেই শপিং মলে গেলে নিজেকে কার্টুন কার্টুন লাগতো। কেন না সেখানে ও বড় সড় মানুষ দের আসা যাওয়া। আর ওদের পরা কাপড় হতো মলিন আর অগোছালো। বছরে এক বার দু বার কাপড় আয়রন করতো সে। তা ও স্কুলের অনুদান থেকে ত্রিশ টাকা বাঁচিয়ে। বন্ধু দের সাথে নিয়ে বাজারে টাক্কু কাকার দোকান থেকে। সে যে কি অনুভূতি বোঝানো দায়। আসার পথে মাতব্বরের ভিটা থেকে তেঁতুল চুরি। সেই কাঁচা তেঁতুল নুন হলুদ দিয়ে মাখিয়ে সকলে সমান ভাগে ভাগ করে খেতো ওরা। ভাবতেই চোখ দুটো কেমন করে উঠে। আহা সে যে অন্য রকম স্বাদ।

কিছু টা এগিয়ে গিয়ে আবারো ফিরে আসে রাদ। ভোরের বাহু তে স্পর্শ করতেই তুতলিয়ে বলে
_ কে, কে?

_তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি বিকেলের মধ্যে বাসায় না গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

_কেন?

_কাল কে রাতেই ফেরার কথা ছিলো।ড্যাড আর মম বিকেলে এক সাথে নাস্তা করে। সেই সময়েই তাঁরা আমার কথা তুলবে। দ্যান কি যে হবে আল্লাহ জানেন।

রাদের ভয়ার্ত বিবরনের সাথে মুখের পাংশুটে ভঙ্গিমা হাসাতে বাধ্য করে। ফিক করে হেসে দেয় মেয়েটা। এই প্রথম ভোরের মুখের তৃপ্তিকর হাসি দেখে। কিছু টা থমকেই যায়। যখন ঘোর কাঁটে তখন বুঝতে পারে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় শপিং মলে। আবারো সেই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে ভোর। এই হাত ধরার মাঝে আলাদা অধিকার বোধ দেখতে পায়। কেন যেন মনে হয় রাদ ওর খুব আপন। সত্যি ই কি খুব আপন?

লিফ্ট এর ঝাঁকুনি হতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ভোর। রাদের ব্লেজারের হাতা টা খিচে ধরে। নখের দাগ লেগে যায় ব্লেজারে। হঠাৎ এমন অহেতুক ভয় পাওয়ার কারন বুঝে উঠে না রাদ। পরক্ষনেই মনে পরে ভোরের অবস্থান। গ্রামের শেষ প্রান্তে অবহেলায় বড় হওয়া মেয়ে টা শহরের সাথে কতো টা মানানসই। ভোর করে সঙ্গ দিতে ওর হাতে হালকা করে স্পর্শ করে। লিফ্ট ওপেন হতেই চোখ খুলে ভোর। নিজের অবস্থান ধারনা হয়। কিছু টা দূরে গিয়ে হয় জড়োসড়ো। মেয়েলি কস্টিউম সম্পর্কে একদম ই কাঁচা রাদ। কখনো কেনা হয় নি যে। মায়ের জন্মদিনে কিংবা ম্যারেজ এনিভার্সারি তে ও কখনো কস্টিউম গিফ্ট করে নি সে। এমন কি কখনো মেয়েলি কস্টিউম কেনার সময় ও ছিলো না সাথে। বলতে গেলে ভারে মা ভবানী। চিন্তা গ্রস্ত রাদ হঠাৎ নখ কামড়ে ধরে। ভোর বলে
_নখ কামড়ানো হাইজিনিং তাই না?

_হুম।

কয়েক সেকেন্ড পরেই চমকে যায় রাদ। নখ ছেড়ে তুতলিয়ে বলে
_আসলে হয়ে ছে কি, আমি মানে নখ কামড়ানো একটা বাজে হেবিট।

মুখ টিপে হাসে ভোর। এমন ভাবে চমকে যাবে ভাবে নি মেয়েটা। ভোর কে সাথে নিয়ে ফুড কর্নারে ঢুকে পরে। কিছু খাবার অর্ডার করে নেটে সার্চ করে। সেখানে অহরহ ডিজাইন করা কস্টিউম। তবে চুজিং এর বিষয় তো নিজেকেই করতে হবে। ভোরের উপর ও বিশ্বাস রাখতে পারে না ছেলেটা। গ্রামের মানুষ যেমন কস্টিউম পরে তাঁর একটা ও আশে পাশে নেই। সব টপস কিংবা কুর্তি অথবা জিন্স এর মডেলিং জামা কাপড়। যেগুলোর সাথে অভ্যস্ত নয় ভোর।

রনিত এর কথা মনে হতেই চোখ চকচক করে। বলে
_আমি ট্রেরেস এ আছি। তুমি খাও।

_আচ্ছা।

ট্রেরেস এ এসে রনিত কে কল করে। এক বার দু বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে রনিত। বলে
_কি রে তোর গ্রাম্য পরিবেশ দেখা হলো নাকি এখনো পরে আছিস।

_না হয়েছে। এখন শোন তুই তো ইনায়া কে মাঝে মাঝেই ড্রেস গিফ্ট করিস।

_হুম তো।

_একটা হেল্প লাগবে। ধর একদম সাধারন স্টাইলিশ না এমন মেয়ের জন্য কোন ধরনের কস্টিউম চুজ করা যায়।

_তুই হঠাৎ মেয়েদের কস্টিউম নিয়ে পরলি কেন? তা ও আবার সাধারন স্টাইলিশ না এমন মেয়ের কস্টিউম।তোর মতলব কি বল তো। গ্রামের পরিবেশের সাথে সাথে গ্রামের কোনো মেয়ে কে ও বিয়ে করে নিলি না তো?

_আশ্চর্য! তোকে যা বলছি তাই বল।

রাদের ধমকে মজা থেকে বেরিয়ে আসে রনিত। অনেক ভাবনা আসলে ও সেই সব পাত্তা দেয় না। বলে
_গার্লস কালেকশন এ যাবি দেখবি সেখানে মেয়ে আছে। তাঁদের থেকে হেল্প নিয়ে পছন্দ আর কমফর্টেবল মতো কিনে নিবি।

_ওহ ওকে।

ফোন রেখে স্বস্তির দম ফেলে। গার্লস কালেকশনে ভোর কে নিয়ে গেলেই মানা সই কিছু একটা কিনে নিবে। এতো প্যারা নিয়ে লাভ নেই।

লেডিস সাইটে এসে বাদে আরেক বিপত্তি রাদের ভাবনাই ঠিক। এখানে থাকা কোনো কস্টিউম ই ভোরের পছন্দ হয় না। পছন্দ নয় বলতে সে অভ্যস্ত নয় এমন পোশাকে। বেশ বিরক্ত হচ্ছে শপের মেয়েটা। এতো শত জামা কাপড় দেখানোর পর ও কোনো টা তেই সায় মিলে নি। কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় ভোর। এই সব কাপড়ের সাথে কোনো উড়না নেই। সে কি করে পরবে এসব ?

ভোরের অবস্থা কিছু টা আচঁ করতে পারে রাদ। সে নিজে ও বুঝতে পারে কেন না বোধক উত্তর করছে মেয়েটা। যদি ও কুর্তির সাথে মানিয়ে নিবে ভোর। তবে এর সাথে কিছু একটা লাগবে। ভারী সাজে সজ্জিত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে যেন অস্থির লাগে। তবু ও নরম কন্ঠে বলে
_মিস আপনি কুর্তি প্যাক করে দিন।

_ওকে স্যার।

_কিন্তু ডাক্তার সাহেব আমি তো

পুরো কথা বলতে পারে না ভোর। মাথা টা নিচু করে নেয়। আড়ষ্টতায় ধরেছে ওকে। রাদ বলে
_এটার সাথে দোপাট্টা তো যাবে না। বাট মাফলার যাবে।

_মাফলার?

_ঐ যে আছে না কি যেন। ওয়েট, এক্স কিউজ মি মিস।

_ইয়েস স্যার।

_লুক ঐ যে মেয়েটা জিন্স এর শার্ট এর সাথে গলায় ঐ টা কি পরেছে মাফলার এর মতো?

_স্কাফ স্যার।

_ইয়েস স্কাফ। কুর্তির সাথে মেচিং করে স্কাফ দিয়ে দিন। আর সাথে কিছু জিন্স টাওজার এন্ড লেডিস মডেলের প্যান্ট দিয়ে দিন। আই মিন কুর্তির সাথে মানান সই।

_ওকে স্যার।

_এবার কোনো অসুবিধা হবে না।

_থ্রি পিস নিলে হতো না?

_এই শপে থ্রি পিসের একটা পার্ট ও নেই। অন্য যেসব লোকাল শপ আছে সেগুলো তে দর করো, দ্যান ঠেলাঠেলি। আই জাস্ট হেট দ্যাট।

মেয়েটা প্যাক করে দেয়। কাউন্টারে এসে বিল পে করার পর কিছু মাথায় আসে। কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ভোর। কাউন্টারে গিয়ে রাদ বলে
_আপনি ওকে সাথে নিয়ে আর যা যা লাগবে প্যাক করে দিন।

বুদ্ধি সম্পূর্ন মেয়েটা চট করেই বুঝে যায়। ভোর কে সাথে করে নিয়ে যায় সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাদ। একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে কখনোই একা বাঁচা সম্ভব নয়। তাঁর প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু সে বলতে পারবে না আর এটাই স্বাভাবিক। যদি ও রাদের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে তবে ওদের সম্পর্ক টা তো তেমন নয়। এই সম্পর্ক টা একটা চ্যালেঞ্জ, একটা দায়িত্ব। যাঁর ভবিষ্যত সম্পর্ক কোনো ধারনাই করতে পারে না দুজনে। নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনো হয়ে উঠে নি। থাকা না থাকা দুটোই আকাশ কুসুম কল্পনা। দুজনের জীবন একই রোদ্দুরে ছুটলে ও গতি পথ ভিন্ন।

জয়েন করুন Fatema’s story discussion

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে