চলো রোদ্দুরে পর্ব-০৫

0
605

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_5

জানালায় মাথা এলিয়ে আছে ভোর। হোস্টেলে এসে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বই কি। গিজার ব্যবহার করতে জানে না মেয়েটা। তিন বার দেখার পর শিখেছে। এর জন্য কেউ কিছু না বললে ও ওর ওপর যে বিরক্ত তা বেশ ভালোই বোঝা যায়। তবে সেই কারনে ওর মন খারাপ নয়। মন খারাপের কারন টা হলো নিজের পরিবার। বাবা মা আর ছোট ভাই কে ছাড়া ভালো নেই ওহ। এক জনের ভুলের শাস্তি ওকেই কেন পেতে হবে?
মেয়ে বলে কি মানুষ নয়। চোখ ভেঙে যেন সলিল নেমে যায়। নাকের আগা টা ধারন করেছে কেমন লাল বর্ন। চোখ দুটো অদ্ভত ঘোলাটে। পাড়ার কিছু মানুষের জন্য ই কুলছুম ওর উপর তিক্ত ছিলেন। বিশেষ করে রাহিলা। ছোট থেকেই ওকে সহ্য করতে পারেন না তিনি। নিজের মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন সর্বদা। অহেতুক ওর নামে বদনাম করা যেন ওনার নিত্য দিনের অভ্যাস। সুন্দরী হওয়াতে প্রশংসা ছিলো বেশ। তবে তাঁতে ও যেন রাহিলা জ্বলে উঠেন। নিষ্পাপ ভোর কে কলঙ্কিত করার জন্য উঠে লাগেন। যদি ও অধিক সফলতা পান নি। তবে বদনাম হয়েছিলো বেশ। সেই কারনে ভোরের কোনো কথাই বিশ্বাস করেন না কুলছুম আর তাফাজ্জাল।হাতের আঙুলে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই দু হাত পিছিয়ে যায়। বুকে থু থু দিয়ে সামনে তাকায়। রাদ কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকায়। কিছু টা তুতলানো স্বরে বলে
_আপনি !

_আগে ব্যলকনির ডোর খুলো। লেডিস হোস্টেল এর প্যারা যে এতো হিউজ হবে তা ভাবতে ও পারি নি।

_কিন্তু কেন?

এমন কথাতে কপালে দুটো ভাঁজের সৃষ্টি হয়। এই মুহুর্তে পৃথিবীর সব থেকে গাঁধা আর নিষ্ঠুর প্রানী মনে হচ্ছে ভোর কে। নিচে তাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। বহু কষ্টে চার তলায় উঠে এসেছে। একবার পা পিচলে গেলেই সোজা উপরে। এ দিকে রয়েছে ভোরের ভয় মাখানো প্রশ্ন। চোখ পাকায় রাদ। ভোর বলে
_খুলছি।

ব্যলকনির ডোর খুলতেই জানালা থেকে ব্যলকনিতে চলে আসে ছেলেটা। চুলে হালকা ভেজা শিশির কনা মুক্ত দানার মতো লেগে আছে। ঠান্ডায় যা তা অবস্থা। দরজা লাগিয়ে দেয় রাদ। কিছু টা চমকালে ও কিছু বলে না ভোর। টেবিলে কেটলি দেখে যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি অনুভব করে। কেটলি তে গরম পানি বসিয়ে দম ফেলে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ভোর কে দেখে হয় অসীম রাগ। এক প্রকার ধমকেই বলে
_এই তোমার কোনো বুদ্ধি নেই? যদি আমি পরে যেতাম। খালি প্রশ্ন করো।

_দুঃখিত।

_নো ফর্মালিটিস। এখন শোনো একটা বিশেষ কারনে এই রাতের বেলা এসেছি।

_ওহহ।

_লুক। এই যে এটা তোমার ফোন।

ফোন টা হাতে তুলে নেয় ভোর। ভালো করে দেখে বলে
_স্মার্ট ফোন ! এটা দিয়ে আমি কি করবো। আমি তো এর ব্যবহার জানি না।

_রিলাক্স স্মার্ট ফোন এর ব্যবহার কোনো আহামরি কঠিন নয়। এদিকে আসো আমি শিখিয়ে দিচ্ছি।

কিছু বেসিক জিনিস শিখিয়ে দেয় রাদ। ফোন টা বেশ সুন্দর। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ওহ। বলে
_শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলেন। আমার প্রয়োজন ছিলো না।

_কলেজে যাবে যখন, তখন নিশ্চয়ই প্রয়োজন পরবে। তাছাড়া কোনো কিছুর জন্য যোগাযোগ করবে কি করে? আমি তো তোমার সাথে থাকছি না।

_তবু ও।

_বেশি কথা বলো না। বেশি কথা ও কিন্তু ভালো নয়। আর একটু ফার্স্ট করো। আমাকে যেতে হবে। গার্ড কে দাঁড় করিয়ে এসেছি।

_মানে?

_আরে রাত দশটার পর কারো সাথে দেখা করতে দেয় না। সেই কারনেই গার্ড কে পেমেন্ট দিয়ে এই দিক দিয়ে উঠে এসেছি।

রাদের আচারন টা নেহাত ই বেশি বেশি লাগছে। কাল সকালে ও আসা যেত। তবু ও ভালো লাগলো ভোরের কাছে। কপালের ডান পাশ টা চুলকে বলে
_শোনো ঐ খামে কিছু টাকা আছে দরকার হতে পারে। আর তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?

মাথা নাড়িয়ে না বলে ভোর। ঘরের চারপাশ টা তাকিয়ে দেখে রাদ। বলে
_ওয়েল। রাতে খেয়েছো?

_জি।

_আচ্ছা। আমার নাম্বার সেভ করা আছে। প্রয়োজন হলেই কল করবে।

_আচ্ছা।

আর কি বলবে বুঝতে পারে না রাদ। বিদায় নেওয়া টাই শ্রেয় মনে হয়। দ্রুত কফি শেষ করে সে চলে যায়। নিচে নামা অব্দি ঝুঁকে তাকিয়ে থাকে ভোর। একটু এদিক সেদিক হলেই প্রানের সংশয় হবে। রাদের গাড়ি টা চোখের আড়াল হতেই ঘরে আসে ভোর। ফোনের দিকে তাকিয়ে কিছু টা হাসে। তবে সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অন্তকর্নে জ্বালা টা বোধহয় বেড়েছে। তবে কেন এই ব্যাথা?

ছেলেকে এতো রাতে বাসায় ফিরতে দেখে কিছু টা চিন্তিত হলেন ইফতিহার। রামিসা কে কিছু বলা যাবে না। না হলে মাথা খারাপ করে দিবে।

টি শার্ট টা পরেছে মাত্র। তৎক্ষনাৎ ডোরে নক হয়। ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত বারো টা বাজে। এতো রাতে এ বাসার কেউ ই জেগে থাকে না। সোজা নিয়ম ফলো করে সকলে। দশটার পর ই গভীর ঘুম। আর সন্ধ্যা সাত টার মধ্যে ডিনার। যদি ও ব্যতিক্রম নিয়মে আছে রাদ। আবারো দরজা তে নক পরে। গায়ের শার্ট টা ঠিক করে ডোর খুলে দেয়। ইফতিহার কে দেখে চমকায় না। নিজের ভাবনা টা ই সঠিক।তাই আগেই উত্তর গুছিয়ে নিয়েছে রাদ। সামান্য হাসতেই ইফতিহার বলেন
_অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম না তো?

_একদম ই নয়। ভেতরে আসো ড্যাড।

কাউচে বসে পরেন ইফতিহার। কেটলি থেকে হট ওয়াটার নিয়ে তাঁতে কড়া করে কফি পাউডার মিক্স করে। ইফতিহারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই লুফে নেন তিনি। প্রচন্ড ভালোবাসেন ব্ল্যাক কফি। দুজনে পাশা পাশি বসে কফি কাপে চুমুক দেয়। রাদ বলে
_আই নো ড্যাড তুমি কেন এসেছো। আমার একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো সেই কারনেই গিয়েছিলাম।

_ওকে। তুমি যখন চাচ্ছো না আমি এতে ইন্টারফেয়ার করি তো করছি না। বাট মনে রেখো কোনো রকম অনৈতিকতার সাথে জড়াবে না।

_মনে রাখবো।

দুজনেই চুপ হয়ে যায়। কফি শেষ করে উঠে যান ইফতিহার। কিছু একটা মনে হতেই রাদের কাছে আসেন। ছেলের দুই বাহু তে স্পর্শ করে ভালো করে পরখ করে নেন। অধর কোনে হাসে রাদ। বাবা কে জড়িয়ে বলে
_আই নো দ্যাট। তুমি মনে রেখো তোমার ছেলে কখনো অন্যায় কে প্রশ্রয় দেয় না। বরং প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালায়।

_আই নো ইয়াং মেন। ওহ হ্যাঁ তোমার কার্ড লক হওয়ার কারন আমাদের একাউন্ট টা লক করে দেওয়া হয়েছে। বছর তো শেষের দিকে একটা হিউজ এমাউন্ট এন্ট্রি করা হবে। বাট কোম্পানির হিসাব টা করা শেষ হয় নি এখনো। ক্যাশ লাগলে হসপিটাল থেকে নিয়ে নিও।

_ওকে।

_আচ্ছা আসছি আমি। অনিয়ম করো না, ঘুমিয়ে পরো।

মৃদু হাসে রাদ। ইফতিহার চলে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।ভোর কে নিয়ে ভীষন চিন্তিত। এই রাতের বেলা যাওয়ার একটাই লক্ষ্য মেয়েটা কতো টা মানিয়ে নিতে পেরেছে। না হলে এই উম্মাদের মতো কেউ ছুটে যায়?
.

মিসেস কাজী আশা অত্যন্ত চতুর মহিলা। তাঁর ব্যক্তিত্ব অসাধারন। তাই তো তখন রাদ কে কোনো রখম প্রশ্ন করে বিব্রতের মাঝে ফেলে দেয় নি। কিছু টা অবাক হয়েছিলো বটে তবে মানুষ মানুষের জন্য। ইফতিহার রাদ এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটু হলে ও ধারনা আছে। সেক্ষেত্রে ভোর এর মতো মেয়ে গার্লফ্রেন্ড হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে স্ত্রী নামক পদবি টা কিছু তেই মানতে পারছেন না তিনি। ইফতিহার খান এর মতো ধারালো মানুষ কখনোই নিজের ছেলের বিয়ে লুকিয়ে দিবেন না। তাছাড়া দিলে ও হোস্টেলে থাকা কোনো মতেই সম্ভব নয়। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেন তিনি। ভোরের ফর্ম টাই বেশ মনোযোগে দেখছিলেন তিনি। রুমে কারো উপস্থিতি অনুভব হতেই ফর্ম টা রেখে দেন। কিছু টা নরম সুরেই বলেন
_সিট।

কাঁপা শরীরে চেয়ার টেনে বসে ভোর। আশা কে কেন যেন ভয় হয় প্রচুর। তখন কেমন দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিলো যেন। কিছু টা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে। পানির গ্লাস টা ওকে টানছে। মৃদু হেসে আশা বলেন
_পানি টা খাও।

_জি।

ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় পানি টা লুফে নেয় মেয়েটা। ঢক ঢক করে নিমিষেই পানি টুকু খেয়ে ফেলে। আশার দিকে তাকিয়ে মাথা টা নিচু করে ফেলে। টুক টাক কিছু প্রশ্ন করেন আশা। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। এখান কার পরিবেশ কেমন। কেউ কিছু বলে কি না। প্রতি টা প্রশ্নের হ্যাঁ না এর থেকে বেশি উত্তর করে নি ভোর। মেয়েটা চালাকির পরিচয় দিচ্ছে বেশ ভালোই বুঝতে পারেন আশা। তবে কিছু টা ভয় ও যে ফুটে উঠেছে।
কেবিন থেকে বেরিয়ে বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নেয় ভোর। ভদ্র মহিলার তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর চতুরতা ওকে মুগ্ধ করেছে। তবে বেশি কথা বলা একদম ই অনুচিত। রাদের কল্যানে থাকছে ওহ। সবাই ঠিক কতো টুকু জানে তা সম্পর্কে অবগত না হওয়াতে প্রতি পদক্ষেপে বেশ ভাবতে হচ্ছে। সারাক্ষণ চাঁপা ভয় কাজ। যদি কিছু ভুল হয়ে যায়।

করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় কারো সাথে ধাক্কা লাগে। পায়ে সামান্য ব্যাথা পায়। সম্ভবত মেয়েটি এখানকার কর্মচারী। ভোর কে তুলে দিয়ে নত জানু হয়ে বলে
_স্যরি ম্যাম।

_আচ্ছা ঠিক আছে।

_ভেরি স্যরি ম্যাম। প্লিজ কমপ্লাইন্ট করবেন না।

_আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি কিছুই করবো না। তাছাড়া দোষ টা আমার ই।আমি যদি অন্যমনস্ক না হতাম তা হলে এমন টা হতো না। আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।

_থ্যাংকস আ লট।

জোড় পূর্বক হাসে ভোর। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে চলে যায়। যেন বাঘের মুখ থেকে ফিরেছে। এক পা আগাতেই হাতে থাকা ফোন টা বেজে উঠে। মুখের সামনে নিয়ে দেখে ‘ ডাক্তার সাহেব ‘ নামের আগন্তুক। তৎক্ষনাৎ হাসি ফুটে উঠে। রাদের প্রতি কৃতঙ্গ হয়। তাঁর বলা ডাকেই নিজের নাম্বার টা সেভ করেছে। ফোন রিসিভ করতে যাবে তখনি কল টা কেঁটে যায়। কর্পূর এর ন্যায় মুখের হাসি টা বাতাসে মিলিয়ে যায়। আবারো ফোন বাজে। দ্রুত বেগে রিসিভ করে বলে
_হ্যালো।

_ ফোন রিসিভ করতে দেরি হলো কেন? এক মুহুর্তের জন্য চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম।

_স্যরি।

_নো ফরমালিটিস। এখন কাজের কথা শোনো। কাল থেকে আমার ক্যাম্পেইন শুরু। সাত দিনের জন্য হবে। তাই আর দেখা হচ্ছে না।তো আজ সন্ধ্যা তে একটা পার্টি তে যাবো। বিকেলে ফ্রি টাইম নেই। তাই দুপুরে লাঞ্চ করে তৈরি হয়ে থেকো তোমাকে কিছু বই কিনে দিবো। আর আশ পাশ টা ঘুরে দেখাবো।

_আচ্ছা।

_ওকে বাই। টেক কেয়ার।

বাতাসের গতি যেন বেড়ে যায়। দমকা হাওয়ার মতো এলো মেলো লাগে। কেন যেন চাঁপা কষ্ট হয়। কষ্ট নয় অভিমান উহু অন্য কিছু। ভীষন ভাবে ক্ষিপ্ত হয় মন। রাদ কে জ্ঞান হীন মনে হচ্ছে আর প্রচুর পরিমানে দায়িত্বহীন। এই ক্যাম্পেইন কিছু তেই মন মানছে না। মনে হচ্ছে সাগরে আঁচড়ে পরা টেউরের মতো। কিছু টা বিরক্তিকর। তবে কেন এমন মনে হচ্ছে? এর বিশেষ তো কোনো কারন নেই।অনাকাঙিক্ষত আশংকা সব সময় ই বাজে ভাবে আঘাত করে ভোর কে। এবার ও কি আঘাত হানবে?
রোদ্দুরে যাওয়ার পূর্বেই কি আষ্ঠে নিবে অন্ধকার। নাকি এই অহেতুক আশংকা নামে মাত্র ই আঁধার।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে