চাদর জড়ানো চিরকুট পর্ব-০১

0
785

গল্পঃ- চাদর জড়ানো চিরকুট।
পর্বঃ- ০১
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।

ট্রেনে বসে বসে স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের সিটের ছেলেটা ঘুমের মধ্যে লতার ঘাড়ে মাথা রাখলো। লতা বেশ বিরক্ত হয়ে গেল, তার মনে হচ্ছে সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে।

তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– দয়া করে বসতে দিয়েছি বলে এখন সরাসরি গায়ে পরে শুয়ে যাচ্ছেন কেন?

– স্যরি, আসলে সারারাত ঘুমাতে পারিনি তাই তন্দ্রা লেগে গেছে।

– আপনার নামটা যেন কি?

– রাফসান মাহমুদ।

– তা মাহমুদ সাহেব, আপনি যদি নিজেকে খুব বেশি চালাক মনে করেন তাহলে কিন্তু ভুল। কারণ ছেলেদের এসব অভ্যাস জানি বলেই একাই দুই সিট নিয়েছিলাম। কিন্তু কেন যে তখন দয়া করতে গেলাম, আর এখন আমার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন।

– ছেলেটা কে?

– কোন ছেলে?

– মোবাইলের গ্যালারিতে যার ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।

– আমার হাসবেন্ড।

– কবে মারা গেছে?

– মারা যাবে কেন, আশ্চর্য!

– তাহলে এভাবে মরা কান্নার দরকার কি?

– আপনি কিন্তু আপনার লিমিট ক্রস করছেন। আর একবার ফালতু কথা বললে আমি আপনাকে সিট থেকে উঠিয়ে দিতে বাধ্য হবো।

– আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন যে কিছুক্ষণ আগেই আমি এই সিটের ভাড়া আপনাকে পরিশোধ করে দিয়েছি।

– হা হা হা সমস্যা নেই টাকা ফেরত দিয়ে দেবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে আর কোনো কথা বলবো না।

ছেলেটা সত্যি সত্যি চুপ করে রইল। লতা কিছুক্ষণ বাহিরে তাকিয়ে আছে। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সে যখন ট্রেনে উঠে বসে তার কিছুক্ষণ পরেই মাহমুদ এসে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

– কেমন আছেন?

লতা অবাক হয়ে বললো,
– কে আপনি?

– আমাকে আপনি চিনবেন না, আসলে আমার খুব জরুরি কাজে চট্টগ্রামে যেতে হবে। তাই আমি ট্রেনে সিট না পেয়েও উঠে গেলাম, যেভাবে হোক আমাকে এই ট্রেনে চট্টগ্রাম যেতে হবে।

– তো এসব আমাকে কেন বলছেন?

– কারণ আমার মনে হচ্ছে আপনার পাশের সিটে কেউ নেই। নিশ্চয়ই আপনি একাই দুটো টিকিট সংগ্রহ করেছেন।

– কীভাবে বুঝলেন?

– খুব স্বাভাবিক, আপনার আপনার ব্যাগপত্র এক সিটে রেখেছেন আর নিজে একটাতে বসেছেন। বসার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে দুটো সিটই আপনার কিন্তু মানুষ আপনি একজন।

– আপনার ধারণা সম্পুর্ণ সত্যি এবং আপনার বুদ্ধি বেশ ভালো মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে সেই বুদ্ধির পুরষ্কার হিসেবে আমি আমার সিটে বসতে দিতে পারবো না।

– আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি আপনার পাশে বসতে চাই?

– গায়ে পরা স্বভাব দেখে।

– দেখুন আমার বোন খুব অসুস্থ তাই আমাকে চট্টগ্রাম যেতেই হবে। আমি আপনার এক সিটের ভাড়া আপনাকে পরিশোধ করে দেবো।

বলাই বাহুল্য, অনেক তর্কের পরে লতা তার পাশের সিটটা তাকে দিল। কারণ এতটুকু কথা বলে তাকে ফাজিল মনে হয়েছে ঠিকই কিন্তু খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।

কিন্তু একটু আগে ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার কারণ বেশ বিরক্ত হয়ে গেছে লতা। ট্রেনের এক স্টাফ কফি নিয়ে এসেছে। মাহমুদ লতার দিকে তাকিয়ে বললো,

– কফি খাবেন?

অনিচ্ছা সত্ত্বেও লতা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। তারপর কফি হাতে নিয়ে দুজনেই চুপচাপ কফি খেতে লাগলো। কফি খেতে খেতে লতা বললো,

– আপনার বোন কি চট্টগ্রামে থাকে?

– না ঢাকাতেই।

– তাহলে সে চট্টগ্রামে কি বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছে নাকি অন্য কিছু।

– আমার বোন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছে এখন।

– তাহলে বললেন যে বোন অসুস্থ তাই আপনাকে চট্টগ্রামে যেতেই হবে।

– হ্যাঁ বোনের জন্যই যাবো। আমার বোনের অবস্থা ভালো না, যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। কিন্তু তার একটা শেষ ইচ্ছে আছে, আমিও তাকে কথা দিয়েছিলাম।

– কি কথা দিয়েছেন?

– বলেছি আমি যেভাবেই হোক তার ওই ইচ্ছেটা আমি পূরণ করবো। কিন্তু কিছুদিন আগে আমার বোন সুইসাইড করার চেষ্টা করে। বিষাক্ত একটা কেমিক্যাল খেয়ে ফেলেছে, কোত্থেকে যোগাড় করেছে জানি না। পেটের মধ্যে পঁচন ধরতে শুরু করেছে, চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। তবুও সুস্থ হবার সম্ভাবনা মাত্র ১০%

ছেলেটার সঙ্গে এতক্ষন ফাজলামো জাতীয় কথা হলেও এখন মোটামুটি করুণা হচ্ছে লতার। খুব ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা কত স্বাভাবিক ভাবে বর্ননা করছে মাহমুদ নামের এই ছেলে।

– লতা বললো, আপনার বোনের বিয়ে হয়েছে?

– না, বিয়ে হয়নি।

– বোনের শেষ ইচ্ছে রাখার জন্য আরও আগে কেন চট্টগ্রামে গেলেন না? তাছাড়া কি এমন ইচ্ছে যেটা চট্টগ্রামে গিয়ে পূরণ করতে হবে।

– ট্রেন থেকে নামার সময় আপনাকে বলবো। আপাতত ওর প্রসঙ্গটা বাদ দেন।

– বোনের জন্য কষ্ট হচ্ছে তাই না?

– হুম। মা-বাবা কেউ নেই, একমাস বোন সেও চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে। কষ্ট তো হবেই।

– আপনি বিয়ে করেননি?

– না।

লতা আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ বসে থেকে কিছুক্ষণ পর বললো,
– আপনার বোনের চিকিৎসার জন্য কত টাকার দরকার?

– অনেক টাকা।

– যদি আমি টাকা দিতে চাই তাহলে আপনার কি সেই টাকায় তার চিকিৎসা করাতে পারবেন?

– না, প্রথমত টাকায় কোনো কাজ হবে না তাহলে আমি আগেই টাকা ব্যবস্থা করতাম। তাছাড়া এই স্বল্প পরিচয়ে আপনি কেন টাকার প্রসঙ্গে চলে গেলেন বুঝতে পারছি না।

– দেখুন টাকাটা যদি আমি দেই তাহলে অবশ্যই ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে দেবো। আমার বাবা সারাজীবন শুধু টাকা আয় করেছেন আর আমি খরচ করেছি।

– এতো টাকা আপনার তাহলে আমার কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিলেন কেন?

– সেটা তো আপনি জোর করে দিলেন।

– ঠাট্টা করলাম। আপনি চট্টগ্রামে কেন যাচ্ছেন?

– খুঁজতে।

– হাসবেন্ডকে খুঁজতে যাচ্ছেন?

– হ্যাঁ।

– যেখানে ভালোবাসা থাকে না সেখানে খুঁজে বের করে কি লাভ বলেন? তারচেয়ে আপনার উচিৎ যে ছেড়ে চলে গেছে তাকে তার মতো থাকতে দেয়া।

– আমি তার সঙ্গে একটা বার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই, চাইলে থানা পুলিশ করতে পারি। সামান্য কিছু টাকা খরচ করলে তাকে দুদিনের মধ্যে আমি চোখের সামনে পাবো৷ কিন্তু আমি সেটা চাই না।

মাহমুদ আর কিছু বললো না। সিট থেকে উঠে বগি থেকে বের হয়ে গেল। লতা ভাবলো হয়তো সে ওয়াশরুমে গেছে। কিন্তু রাফসান মাহমুদের মনের মধ্যে যে খুব নোংরা নিকৃষ্ট একটা পরিকল্পনা আছে সেটা মাহমুদ ছাড়া কেউ জানে না।

মাহমুদ কি করতে ট্রেনে উঠেছে আর তার মনের মধ্যে কি আছে সেটা যদি লতা জানতো তাহলে সে এতক্ষণে কি করতো সেটা ধারণার বাইরে।

ট্রেনের ওয়াশরুমের সামনে ফাঁকা জায়গায় এসে মাহমুদ তার পরিচিত একটা নাম্বার কল দিল।
সবকিছু ঠিক আছে কিনা আরেকবার নিশ্চিত হয়ে মোবাইল কল কেটে দিয়ে সিটে চলে গেল।

★★

ফেনি স্টেশন পার হয়ে লতা ঘুমিয়ে গেল। লতা ঘুমিয়ে যাবার পরে বেশ সুবিধা হলো মাহমুদের। পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে লতার জন্য একটা চিরকুট লিখে শেষ করলো। আর কিছু সময় পরে সে চট্টগ্রামে পৌঁছে যাবে৷

ট্রেনের মধ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা রয়েছে সেটা শেষ করে অনেক আগেই নেমে যেতে পারতো। কিন্তু তাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে, বাকি কাজটা করতে হবে চট্টগ্রামে। তাই ট্রেন থেকে নামার আগ মুহূর্তে সে ট্রেনের কাজটা শেষ করবে।

চিরকুট লিখে আবারও ওয়াশরুমে গেল মাহমুদ। সিরিঞ্জ ভর্তি কেমিক্যাল বিষ ভর্তি করে সেটা সাবধানে পকেটে ভরে নিল। আরেকবার পাশের বগিতে গিয়ে শিকারকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিল।

সীতানকুন্ড পার হবার পরে মাহমুদ লতাকে ঘুম থেকে জাগ্রত করলো। লতা বললো,

– চলে এসেছে?

– হুম কাছাকাছি তবে আপনি যদি ওয়াশরুমে যেতে চান তাই আগেই ডেকে তুললাম।

– আচ্ছা।

আরও খানিকক্ষণ কাটলো। এরমধ্যে মাহমুদ উঠে গেল, তারপর মিনিট দশেক পরে আবার ফিরে এসে বসলো। একটু পরে পকেট থেকে চিরকুট বের করে লতার হাতে দিয়ে বললো,

– ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট পরে আপনি এটা পড়া শুরু করবেন।

লতা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। মাহমুদ তার ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে লতার গাল স্পর্শ করে বললো,

– আপনার সঙ্গে আবারও দেখা হবে। আজকের এই দেখা কাকতালীয় নয় এটা পরিকল্পনা। আমি আপনাকে চিনি, নিজের প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করবো। সাবধানে থাকবেন।

মাহমুদ চলে গেল। লতা অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি চিরকুট পড়তে লাগলো।

ম্যাডাম,

আমি একজন কন্ট্রাক্ট কিলার। টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করা হচ্ছে আমার পেশা। আপনি যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, আপনার সেই স্বামীকে খুন করার জন্য আমি ট্রেনে উঠেছি। আমি জানি আপনার গর্ভে তার সন্তান, তবুও তাকে খুন করা ছাড়া উপায় ছিল না।

আমার যে বোনটা মৃত্যুর মুখে আছে সে আমার আপন বোন নয়। তার মৃত্যুর জন্য আপনার স্বামী দায়ী। আপনি আপনার স্বামীর আসল পরিচয় জানেন না। জানলে হয়তো তার জন্য এভাবে আপনি ছোটাছুটি করতেন না।

সতেরো দিন ধরে আমি আপনাদের দুজনকে ফলো করছি। মাঝখানে সপ্তাহ খানিক ধরে সে আমার চোখের আড়াল হয়ে যায়। তারপর থেকে পুরোপুরি আপনাকে নজরে রাখতাম কারণ আমি জানি আপনার মাধ্যমে তাকে পাবো।

আপনার প্রতি নজরদারি করতে গিয়ে আমি আপনার তিনজন শত্রু সনাক্ত করেছি। প্রতিনিয়ত তারা আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কিন্তু সময় সুযোগের অপেক্ষা। আপনাকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাবার জন্য তো আপনার স্বামী দায়ী তাই না?

সেই তো আপনাকে বলেছে চট্টগ্রামে গেলে তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন তাই না? কিন্তু এটা আপনার জন্য একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে। আমি চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করতে। কিন্তু আপনার স্বামীকে খুন করার পর আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়।

আমার গোলাপি চাদরটা রেখে গেলাম। যদি দেখা করতে ইচ্ছে করে তাহলে সন্ধ্যা বেলা নিমতলা বিশ্বরোড অপেক্ষা করবেন। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন আপনার জন্য বিপজ্জনক। স্টেশনে নেমে কিন্তু পুলিশের সহোযোগিতা নিবেন।

আপনার স্বামী আমাদের পিছনের বগিতে W 43 নাম্বার সিটে বসে আছে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়ে গেছে, সেই কৃতিত্ব আমার।

সাবধানে থাকবেন।
আপনার আগত সন্তানের পিতাকে হত্যা করার জন্য ক্ষমা করবেন। আমি বোনের শেষ ইচ্ছার জন্য এটা করতেই হতো। বাকি কিছু জানার যদি ইচ্ছে করে তাহলে দেখা করিয়েন।

রাফসান মাহমুদ।

ট্রেন থেমে গেছে, সেই সঙ্গে থেমে গেছে লতা। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এই চিঠি। সবাই ততক্ষণে ট্রেন থেকে নেমে গেছে। লতা তার ব্যাগটা নিয়ে পিছনের বগিতে গেল। মাহমুদের বলা সিটের কাছে গিয়ে হতবাক হয়ে গেল লতা। তার স্বামী চোখ বন্ধ করে সিটে বসে আছে, মাস্ক পরা হলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি লতার।

লতা হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করে ধাক্কা দিতেই মৃত শরীরটা একদিকে ঢলে পড়ে গেল।

চলবে….