চাদর জড়ানো চিরকুট পর্ব-০৬

0
216

#চাদর_জড়ানো_চিরকুট।
#পর্বঃ- ০৬

লোকটা মোবাইলে কথা বলা বন্ধ করার পর হঠাৎ করে সব চুপচাপ হয়ে গেল। লতা কি করবে বুঝতে পারছে না, কিন্তু চোখ দুটো ঠিকই অনবরত পানি ঝড়াচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানিক পরে পাশের ঘরে কথা শুনতে পেল লতা৷

– ভাই আপনি এখানে?

– লতা চৌধুরী কোথায়?

– পাশের ঘরে আছে, অজ্ঞান।

– রুমের দরজা খুলে দাও। কিন্তু তাহলে তো সে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে আপনি তাকে কিডন্যাপ করেছেন।

– কিছু করার নেই, কারণ লতার বাবা চট্টগ্রাম পুলিশের কাছে জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ এখন লতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাই এখন লুকোচুরি করে লাভ নেই। সরাসরি কাজ করতে হবে।

– রবিউল ভাই।

– হ্যাঁ বলো। কিন্তু এমন কিছু বলবা না যেটা এখন রাখতে পারবো না।

রবিউল! লতা রবিউলের কণ্ঠ শুনে চিনতে পারল কিন্তু কি লাভ চিনতে পেরে? সে কি কিছু করতে পারবে এখন?

★★

কৌতূহল নিয়ে লতার নাম্বারে কল দিলেন সাজু, কিন্তু নাম্বার বন্ধ। একটু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করার স্থান নেই। মোবাইল রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লেন তিনি। শরীরে তাপমাত্রা ১০২°। এটা সাজুর শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা তাই এসব নিয়ে বিচলিত নয় সাজু ভাই।

আজকের সম্পর্ক ঘটনা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। রাতে আবার যখন ঘুম ভেঙ্গে যায় তখন রাত তিনটার মতো বেজে গেছে। সাজু মোবাইল বের করে ডাটা চালু করলো। একটা অপরিচিত এড্রেস থেকে মেইল এসেছে, অনেক লম্বা একটা মেইল।

সবার নিচে লেখা আছে, ” আপনি সাবরিনার কাছ থেকে লতা চৌধুরীর স্বামীকে হত্যার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আপনার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম, আশা করি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আর লতা চৌধুরী এখন আমার কাছে। ”

সাজু এবার সম্পুর্ন মেইলটা পড়তে শুরু করলো। যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে।

সাজু ভাই,
কিছু মাস আগের কথা। আমি একটা খুন করার জন্য প্রায় তিনমাস গার্মেন্টসে চাকরি করি। লোকটা অফিসে একটা গোপন ফ্ল্যাট তৈরি করে রেখেছিল। অফিস থেকে কখনো বের হতো না। তাই তাকে খুন করার জন্য গার্মেন্টসে চাকরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

ভালো আয়রন করতে পারতাম। গার্মেন্টসে আমি আয়রনম্যান হিসেবে চাকরি নিলাম। সভ্য মানুষ কি বলে আমি জানি না, কিন্তু অফিসে সবাই তো আয়রনম্যান বলে ডাকতো।

কারখানার কাছেই একটা কলোনির মধ্যে একটা রুম ভাড়া নিলাম। কারো কাছে যেন সন্দেহের সৃষ্টি না হয় তাই একদম সহজ স্বাভাবিক জীবন। আর সেই কলোনির মধ্যে পরিচয় হয়েছে আমার এই অসুস্থ বোর তিথিদের সঙ্গে।

“তিথিদের” বললাম কারণ তারা দুই বোন ছিল। আপন নয় চাচাতো বোন। তিথির চাচাতো বোন ছিল বিথি। তিথির মা-বাবা মারা যাবার পর থেকে সে বিথিদের সঙ্গে থাকতো। বিথি বয়সে অনেক বড় ছিল।

তিথি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতো। পাশাপাশি দুটো রুমের মধ্যে আমরা থাকতাম। তিথি বিথি আর বিথির মা ও ছোটভাই, চারজন একটা রুমে থাকতো। বিথির বাবা থাকতো মিরপুরে।

আমি তিনবেলা হোটেলে খাবার খেতাম। কিন্তু প্রায় সময় তিথি আমাকে খেতে দিতো। বিথির আচরণ ছিল প্রেমভাবাপন্ন, তার সকল চালচলন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। কিন্তু বিথির সঙ্গে আমার কথা হতো না। তিথি বিথি আর বিথির মা একই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। আমি ছিলাম অন্য গার্মেন্টসে।

একদিন বিকেলের ঘটনা।
অফিসে নতুন কাজ শুরু হয়েছে তাই সেদিন ওভারটাইম না করেই পাঁচটার দিকে অফিস ছুটি হয়ে গেল। আমি প্রায় প্রতিদিনই অফিস ছুটির অনেক পরে বের হতাম। কেন দেরি করতাম সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, বুঝবেন কারণ আপনি বুদ্ধিমান মানুষ।

পাঁচটার দিকে কলোনিতে ফিরে দেখলাম বাড়ির মালিকের স্ত্রী আরো ৩/৪ জন মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে একটা মেয়েও আছে। মেয়েটারও পাঁচটার দিকে ছুটি হয়েছে তাই সে এসে মাত্র দাড়িয়েছে। আমাকে দেখে বাড়ির মালিকের স্ত্রী বললো,

– কি ব্যাপার বাবা, এতো তাড়াতাড়ি আজকে ছুটি হয়ে গেল?

– হ্যাঁ আন্টি, লাইনে নতুন কাজ শুরু হয়েছে তাই আগে আগে ছুটি দিয়ে দিল।

– তুমি এক কাজ করবা, ভালো অপারেটর দেখে তার সঙ্গে খাতির জমাবে। তারপর তার মাধ্যমে মেশিন চালানো শিখবে। অপারেটর হতে পারলে তো অনেক বেতন পাওয়া যায়।

– হ্যাঁ আন্টি সেটাই করবো।

সেই মুহূর্তে ওই মেয়েটা বলে উঠলো,
– আমাদের অফিসে হলে আমি এক সপ্তাহের মধ্যে শিখিয়ে দিতে পারতাম।

ঠিক এমন সময় বিথি অফিস থেকে এসেছে। সে পিছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে আমি জানতাম না। আমি শুধু দেখলাম রাক্ষসীর মতো আগুন জ্বলে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে গেল কিন্তু তার সেই চোখের দৃষ্টি আমি আন্দাজ করতে পারি। তার চোখের ভাসা বলে দিচ্ছিল,

” রুমের মধ্যে আসো, তোমার মেশিন চালানো আমি ভালো করে শেখাবো। ”

হাহাহা।
সাজু ভাই বিরক্ত হচ্ছেন না তো? খুন করতে গিয়ে একটা রোমান্টিক ঘটনার জন্ম হয়ে গেল। তবে সবটা বলছি কারণ নাহলে আপনি বুঝতে পারবেন না খুন কেন করলাম।

আমি আস্তে করে রুমের সামনে গেলাম। গিয়ে দেখি দুটো রুমের মাঝখানে কোমড়ে হাত দিয়ে বিথি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাশ কাটিয়ে আমার রুমের দরজা খুলতে গিয়ে দেখি সেখানে দুটো তালা ঝুলছে। একটা তো আমি সকালে লাগিয়ে গেছিলাম কিন্তু আরেকটা তালা কে দিল?

আমি বিথির দিকে তাকালাম। সে বললো,
– এই রুমে আসার দরকার নেই। যার কাছে গিয়ে মেশিন চালানো শিখবেন তার কাছে চলে যান। অফিসে তো সম্ভব না তাই বাসায় বসে নাহয় শিখে নিবেন।

আমি সামান্য হাসলাম। আপনার আমার বয়স তো প্রায় সমান, তাই না সাজু ভাই? তবে বিথিে বয়স তখন বাইশ বছর রানিং। বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সেই স্বামী মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে। তিথির বয়স আনুমানিক ১৬/১৭ হবে, তবে শরীরের গঠন ভালো ছিল তাই চাকরি করতে পারতো।

যাইহোক। বিথি দেখতে অনেকটা আপনার সেই রামিশার মতো। তবে রামিশা আপুর মতো ভাগ্য তো আর সবার হয় না, তাই না? তার ভাগ্য ভালো সে পেয়েছে আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ। আর বিথির ভাগ্য খারাপ তাই সে জড়িয়ে গেছে আমার মতো একটা খুনির সঙ্গে।

সেদিন আমি হাসলাম তাই বিথি বললো,
– সারাদিন তো গার্মেন্টসে মেয়েদের মধ্যে থাকেন তাহলে বাসায় ফিরে কি না বললে হয় না?

– বললাম, কেন কি হয়েছে? তার সঙ্গে তো নিজ থেকে কথা বলতে যাইনি। পরিস্থিতিতে পরে কথা হয়ে গেছে, আমি তো উত্তর দেইনি।

– এতটুকুও বলবেন না। সোজা রুমের মধ্যে এসে ঢুকবেন আর বের হবেন না।

– ঠিক আছে তাই হবে।

আরেকদিনের ঘটনা।
পরদিন শুক্রবার তাই আমি আমার ল্যাপটপ বের করে রাত দুটোর দিকে নাটক দেখছি। বাসার কেউ জানতো না আমার ল্যাপটপ আছে। তো ল্যাপটপে একটা ইংলিশ মুভি দেখছিলাম, তারপর প্রকৃতির বেগ আসে। আমি সেভাবেই ল্যাপটপ রেখে দরজা খুলে বের হয়ে ওয়াশরুমে গেলাম।

কিন্তু সেই মুহূর্তে বিথি বের হয়েছে তার রুম থেকে। আমার দরজা সামান্য খোলা দেখে সে উঁকি দেয় রুমের মধ্যে। আর দেখতে পায় ল্যাপটপে নায়ক নায়িকার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। ইংলিশ মুভিতে এসব বিষয় একটু স্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরে তাই অনেকে সেটাকে প/র্ণ মনে করতে পারে।

বিথি এক পলক দেখে আবার দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি সেই মুহূর্তে ওয়াশরুম থেকে এসে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে।
বললো,
– ছিহ রাত জেগে এসব দেখতে লজ্জা করে না?

আমি থ হয়ে গেলাম, বিথি দরজা বন্ধ করে তাদের রুমের মধ্যে চলে গেল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হচ্ছিল। সকাল দশটার দিকে তিথি আমাকে ডাকাডাকি করতে লাগলো। বিথি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

– সারারাত তোর ভাই যা দেখেছেন তাতে করে আজ সারাদিন ঘুম ভাঙ্গবে না। ডাকিস না।

আমি চুপচাপ সব শুনলাম। মনে মনে হাসলাম। এইতো এরকমই হাসিখুশি ভাবে সহজসরল ওই তিথি বিথির সঙ্গে পরিচয়। তিথি বোন হলেও বিথি বউ হতে চাইতো৷

দাদাজানের কথা মনে আছে সাজু ভাই?
তিনি আমাকে মারার জন্য তৎপর হয়ে গেছেন। আমার পিছনে লোক লাগানো ছিল আমি জানি। কিন্তু সেই কারণে তিথি বিথির ক্ষতি হবে আমি কোনদিনই ভাবিনি।

দাদাজান আমার সন্ধান পেয়ে গেল। ফিরোজসহ আরো তিনজনকে পাঠানো হলো আমাকে শেষ করার জন্য। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো না খারাপ জানি না তবে সেদিন আমি অফিস থেকে আর বের হলাম না। কারণ যাকে খুন করার জন্য আমি গার্মেন্টসে চাকরি নিছি তাকে সেদিনই শেষ করার টার্গেট ছিল। তাছাড়া ওইদিন রাত একটা পর্যন্ত ডিউটি করার কথা ছিল আমার। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সেদিন সারাদিন ধরে অনবরত বৃষ্টি পড়ছিল। চারিদিকে আবহাওয়া একদম ঠান্ডা।

ফিরোজ আরও তিনজনকে নিয়ে আমাদের সেই কলোনির মধ্যে গেল। আমাকে না পেয়ে পাশের রুমে তিথি বিথির উপর নজর দেয়। নেশাখোর ওই পিশাচ গুলো সারারাত তিথি বিথির সঙ্গে…..

নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, বুঝবেন কারণ আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। [ বাক্যটা দ্বিতীয়বার বললাম কারণ আপনি সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান। ]

বিথির মা আর আর ছোটভাইকে হাতপা বেঁধে অস্ত্র ধরে জিম্মি করে রাখে। আর আমার রুমের তালা ভেঙ্গে সেই রুমে ওদের দুজনকে নিয়ে ওরা নিজেদের ইচ্ছে পূরণ করে।

টিনের চালের সেই কলোনি। আলাদা আলাদা সব রুম। গ্রাম অঞ্চলের সেই স্থানে ঝড়বৃষ্টির সেই রাতে আশেপাশের কেউ জানতেই পারলো না। সারাদিন গার্মেন্টস করে সবাই বাসায় ফিরে ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনি তিথি আর বিথি।

আমি সেই রাতে গার্মেন্টসের খুনটা করি৷ এমন ভাবে করেছি যে হার্ট অ্যাটাক বলে সবাই ধারণা করে নিয়েছিল। মনের মধ্যে একটা আনন্দের অনুভূতি ছিল কিন্তু বাসায় ফিরে আমার সব আনন্দ হারিয়ে যায়। শেষ রাতের দিকে ফিরজরা যখন চলে গেল তখনই ওরা দুজন মিলে ওই বিষাক্ত কেমিক্যাল বিষ খেয়ে ফেলে।

আমি জানি ওগুলো কোথায় ছিল। হাসপাতালে বিথি মারা গেল, তিথির চিকিৎসা চলে ঠিকই কিন্তু পেটে পচন ধরতে শুরু করে। আমি খুঁজে বের করলাম কে করেছে এই কাজ?

কারণ আমাকে মারার জন্য গেছে সেটা তো বুঝতে পেরেছিলাম সাজু ভাই। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে জানতে পারি ফিরোজদের কথা। তারপর থেকে ফিরোজকে নিয়ে পরিকল্পনা। বাকি ঘটনা আপনি অনেক কিছু জানেন।

আপনি সাবরিনার কাছ থেকে লতা চৌধুরীর স্বামীকে হত্যার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। আপনার ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলাম, আশা করি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না। আর লতা চৌধুরী এখন আমার কাছে।

এটা একটা দোকান থেকে মেইল করেছি তাই এটা খুঁজে সময় নষ্ট করবেন না। আমার বেশ কিছু টাকার দরকার সাজু ভাই। লতাকে ব্যবহার করে সেই টাকা আমার দরকার তাই এছাড়া আর উপায় নেই।

ইতি
রবিউল ইসলাম।

চলবে…
💙💙💙💙💙💙💙

মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।