চাদর জড়ানো চিরকুট পর্ব-০৭

0
204

#চাদর_জড়ানো_চিরকুট।
#পর্বঃ- ০৭

রবিউল দরজা খুলে লতার রুমে প্রবেশ করলো। হাত-পা বেঁধে রাখা লতার চেহারা কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। রবিউলের প্রথমে কিছুটা মায়া লাগে, তারপর সে লতার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

লতা বললো,
– আপনার কি লজ্জা করে না?

রবিউল স্বাভাবিক কণ্ঠে পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– কিসের জন্য?

লতা একদলা থুতু ফেলে বললো,
– কি দোষ করেছি আমি? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। আপনি আমার স্বামীকে খুন করেছেন। আমার বাবার নামে মিথ্যা কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন।

– আর?

লতা যেন আরো অসহায় হয়ে গেল। যার স্বামী মারা গেছে দুপুরের দিকে, স্বামীর লাশ এখনো হাসপাতালে পড়ে আছে। যে নিজে এখন বাঁচবে কি মারা যাবে তার ঠিক নেই, সে আর কি বা বলতে পারে।
তবুও কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
– আপনি জানেন আমার গর্ভে সন্তান আছে। তবু কেন এমন পশুর মতো ব্যবহার করছেন? আমি আপনার যতো টাকা লাগে দেবো কিন্তু দয়া করে আমাকে মুক্তি দেন৷

– আপনার বাবার সঙ্গে আমার ছোট্ট একটা পুরনো হিসাব বাকি আছে। তাই আপনার মুক্তির বিনিময়ে টাকা নিয়ে তাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। সে এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।

– আমি আমার স্বামীর লাশ দেখতে যাবো।

– স্যরি ম্যাডাম, সেটা অসম্ভব।

– আপনি আপনার এক ছোটবোনের মিথ্যা অসুস্থ হবার গল্প বলে আমাকে ইমোশনাল করেছিলেন। আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম বলে আজ আমার এই পরিণতি।

– এটা ঠিক যে আমরা পৃথিবীতে বিশ্বাস করেই সবচেয়ে বেশি হেরে যাই। কিন্তু এটাও সত্যি যে বিশ্বাস ছাড়া কিন্তু অনেক কিছু অর্জন করা যায় না ম্যাডাম।

– আপনার কতো টাকা দরকার?

– আপাতত দশ কোটি টাকা হলেই চলবে।

– আমার বাবাকে দরকার নেই। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ঢাকায় গিয়ে আপনার সম্পুর্ণ টাকা পরিশোধ করে দেবো। বিশ্বাস রাখতে পারেন কারণ আমি বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।

– পাগল নাকি আমি? আপনি তো নিজেই আমার কাছে বলেছিলেন যে আমাকে আপনি কোনদিনই ছাড়বেন না। ফিরোজকে হত্যা করার প্রতিশোধ আপনি যেভাবেই হোক নিবেন।

– সেটা রাগের মধ্যে বলেছি। বিশ্বাস করুন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ফিরোজের কাছে যাবো।

– ফিরোজ সাহেব খুব জঘন্য মানুষ, তার লাশের সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই।

– আপনিও তো জঘন্য মানুষ।

– হ্যাঁ আমিও জঘন্য। তো কি হয়েছে?

লতা তার বাধাঁ হাত দুটি জড়ো করে বললো,
– প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। সারাজীবন আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

– আপনার স্বামীকে খারাপ বলার কারণ জানতে চান আপনি?

– আচ্ছা বলেন। কিন্তু দয়া করে মিথ্যা বলবেন না, কারণ আপনি অনেক মিথ্যা বলেন।

– না মিথ্যা বলবো না। একই ঘটনা আমি সাজু ভাইকেও বলেছি। বলিনি, তবে মেইল করে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় সে এখন ঘুমিয়ে গেছে। নাহলে এতক্ষণে মেইল পড়ে তিনি নিশ্চয়ই কিছু করতেন।

– বলেন কেন মেরেছেন ফিরোজকে?

রবিউল আস্তে আস্তে সাজুর কাছে মেইলে যেটা বলেছে সেটা সম্পুর্ণ লতার কাছেও বললো। বলার সময় মিজান তার দিকে বারবার তাকিয়ে রইল। রবিউল সেদিকে নজর না দিয়ে লতার দিকে তাকিয়ে আছে।

সব শুনে লতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

– আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে আমার স্বামী ফিরোজই সেদিন গিয়েছিল।

– কলোনির মধ্যে থাকার সময় আমার দাদাজান যাকে আমার পিছনে লাগিয়েছিল তাকে আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি। কিন্তু তাকে বেশি গুরুত্ব দেইনি কারণ নিজে সতর্ক হয়ে চলতাম। আর গার্মেন্টসের লোকটার সঙ্গে দাদাজানের কোনো সম্পর্ক নেই।
সেই রাতের ঘটনার পরে আমি ওই নজরদারি করা ছেলেটাকে খুঁজে বের করলাম। জীবন বাঁচাতে গিয়ে সে চারজনের নাম বলে। কারণ সেই রাতে ফিরোজ মিজান আর বাকিদের ওই লোকটাই কলোনিতে নিয়ে যায়।

– ফিরোজ সম্পর্কে এসব কথা আমি বিশ্বাস করি না রাফসান মাহমুদ।

– রাফসান মাহমুদ নামটা কি আপনার কাছে ভালো লাগে নাকি? নাহলে আমার আসল নামটা জানার পরও আপনি আমার বানিয়ে বলা নামটা ডাকলেন।

– তিথি কেমন আছে?

– সন্ধ্যা বেলা মারা গেছে।

– কিহহ।

– হ্যাঁ সেজন্য তো আমি আর ঢাকায় ফেরত যাইনি। নাহলে তো অবশ্যই যেতাম। কিন্তু মৃত্যুর পরে চিরনিদ্রায় ঘুমন্ত মুখটা দেখতে ইচ্ছে করবে না আমার। সবসময় প্রতি মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি।

– তাহলে আপনার কেন অন্যে প্রিয় মানুষকে খুন করেন? আপনজন হারানোর বেদনা আপনি তো ভালো করে জানেন তাই না?

– আমি নিরপরাধ কাউকে মারি না।

– তাহলে আমি?

– আপনাকে মারবো না, টাকা পেলেই আপনাকে আমি ছেড়ে দেবো।

– বললাম তো আপনি টাকা পাবেন।

– আচ্ছা ঠিক আছে আপনার বাবা টাকা নিয়ে আসুক তাহলে আপনি মুক্ত।

– আপনি যে বলেছিলেন তিন কোটি টাকার জন্য আমার স্বামী আমাকে খুন করতে চায়। তারপর আপনাকেও আমার বাবা খুনের জন্য কন্ট্রাক্ট করতে চেয়েছে। সবকিছু মিথ্যা তাই না?

– হা সবকিছুই মিথ্যা। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আপনার?

– স্টেশনের বাইরে কি আপনিই আমাকে গুলি করেছেন?

– হ্যাঁ আমিই গুলি করেছি। ভেবেছিলাম নিজেকে আড়াল করে কাজ করতে কিন্তু মুখোশ যখন খুলে গেছে তখন আর লুকিয়ে কি হবে?

– ছিহহহ,
আবারও লতার কান্না।

কোনকিছু না বলে রবিউল রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় লতার পায়ের বাঁধন খুলে দিল।

★★★

এসআই নিজাম উদ্দিন এখন চট্টগ্রাম রেলস্টেশন এর কাছেই বসে আছে। সাজুর কাছ থেকে সন্ধ্যা বেলা বিদায় নিয়ে সে প্রথমে থানায় গেল। তারপর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করতে বসবে তার আগেই থানা থেকে কল পেল। কোনমতে খাবার খেয়ে আবারও বেরিয়ে গেল থানার উদ্দেশ্যে।

ঢাকা থেকে নাকি লতার বাবা রিপোর্ট করেছে যে তার মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে। হাসপাতাল থেকে তার বন্ধুর সাথে বের হলেও তারপর থেকে আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

টাকার ক্ষমতা অনেক বেশি। নাহলে সেই ঢাকায় বসে তিনি সম্পুর্ন চট্টগ্রামের পুলিশ সজাগ করে ফেলেছেন। যেভাবেই হোক তার মেয়েকে তিনি খুঁজে বের করতে বলেছেন।

বাসা থেকে থানায় যেতে যেতে এসআই ভাবছিল যে এটা হয়তো লতার বাবার নাটক হতে পারে। কারণ সাজুর কাছ থেকে যতটুকু জেনেছে তাতে মনে হচ্ছিল লতার বাবা তার মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। এখন হয়তো নিজেই অপহরণ করে মিথ্যা নাটক করছেন।

সন্ধ্যা বেলা এসআই সাহেব সাজুে নাম্বার নিজের কাছে নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে এখন লতার অপহরণের বিষয়টি সাজুকে জানালো না। কারণ সাজু প্রথমে ব্যাপারটা নিজের কাছে গোপন করে। তাই এসআই নিজেও ব্যাপারটা গোপন করতে চায়, হালকা প্রতিশোধ।

থানায় এসে এসআই নিজাম ভালোই ধমক হজম করলেন। তারপরই দলবল নিয়ে চলে এসেছেন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। রবিউল নামের সেই ছেলে নাকি লতার বাবার কাছে কল করেছে। তারপর তার কাছে দশ কোটি টাকা দাবি করেছে এমনকি সেই টাকা নিয়ে আসতে হবে স্বয়ং চৌধুরী সাহেব নিজে।

স্টেশনে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেই সিসি ক্যামেরা চেক করার জন্যই স্টেশনে এসেছে তারা।

সবকিছু চেক করা হলো কিন্তু কাকে যে রবিউল বলে সন্দেহ করবে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু চারজন লোককে বেশ কিছু সময় ধরে এদিক সেদিক ঘুরতে দেখা গেছে। বারবার মোবাইলে কথা বলে তারা। এদের মধ্যে কি কেউ রবিউল হতে পারে?

এসআই মনে মনে ভাবলো এই সময় সাজু ভাই থাকলে ভালো হতো। তিনি তো রবিউলকে আগে দেখেছেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করলো এসআই নিজাম উদ্দিন। ভিডিও ফুটেজ চেক করতে করতে রাত অনেক পেরিয়ে গেছে। প্রায় চারটা বেজে গেছে।

মোবাইল বের করে দেখেন সাজুর নাম্বার থেকে আগেই কতগুলো কল এসেছে।
সঙ্গে আছে দুটো মেসেজ।

(১) স্যার লতাকে রবিউল কিডন্যাপ করেছে। তার ক্ষতি হবার আগেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আপনি কোথায়?

(২) মোবাইল হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কলব্যাক করবেন।

এসআই মনে মনে ভাবলো, এই লোকটা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলো নাকি? সেও জেনে গেছে। নাকি রবিউলের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। তাড়াতাড়ি সাজুর কাছে কলব্যাক করলেন,

– হ্যালো সাজু সাহেব।

– স্যার আপনি কোথায়?

– আমি তো রেলস্টেশনে, আপনি কোথায়?

– আমি হোটেল থেকে বের হলাম, আপনার কাছে কল দিলাম ধরছেন না।

– ভিডিও ফুটেজ দেখার সময় মোবাইল সাইলেন্ট করেছিলাম তাই বুঝতে পারিনি।

– লতার বাবা কিছু জানিয়েছে?

– হ্যাঁ, তিনি তো চট্টগ্রামের সব পুলিশ জাগ্রত করে ফেলেছে, ভয়াবহ অবস্থা। ওই রবিউল তো ঠাণ্ডা মাথায় বাটপারি করেছে বুঝতে পারেন কিছু?

– হা বুঝতে পারছি, আমাদের এখন লতাকে খুঁজে বের করতে হবে। রবিউলের আসল উদ্দেশ্য টাকা নয় সেটা মাথায় রাখবেন। ঢাকায় ওর পুরনো এক শত্রু ছিল, তার সঙ্গে লতার বাবার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানিনা।

– আপনি রেলস্টেশনে আসেন। আমরা চারজন লোককে সন্দেহ করছি কিন্তু এরমধ্যে রবিউল কে সেটা বুঝতে পারছি না। আপনি রাস্তায় বের হয়ে দেখেন দু একটা সিএনজি পাওয়া যেতে পারে।

– ঠিক আছে কিন্তু আপনারা এতো রাতে কীভাবে ফুটেজ চেক করলেন? কেউ ছিল সেখানে?

– ছিল না ভাই, ছিল না। কিন্তু বললাম যে লতা চৌধুরীর বাবা সব তোলপাড় করছেন। তাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাকে কাকে যেন কল দিয়ে ব্যবস্থা করে দিলেন৷

– আচ্ছা আমি আসছি।

★★★

রবিউল আসার আগে দুটো বিদেশি মদের বোতল নিয়ে এসেছিল। লতার পাশের রুমে বসে বসে এখন সবাই মদ খাবার আয়োজন করছে। মিজান মুখ কালো করে সারাক্ষণ বসে আছে। তার ধারণা রবিউলের কথামতো কাজ করলেও রবিউল তার বোনের জন্য ঠিকই কিছু একটা করবে।

রবিউল বললো,
– খাও মিজান, চিন্তা করো না।

– ভাই আমি আপনার কাছে বারবার কিন্তু ক্ষমা চেয়েছি। আমি ফিরোজ ভাইয়ের সঙ্গে গেছিলাম।

– আচ্ছা।

– আমার মায়ের কোনো ক্ষতি করবেন না তো?

– না করবো না। একটা কথা বলো তো, স্টেশনে বসে তুমি বেশ কয়েকবার একটা নাম্বারে কল দিয়ে কথা বলছো সেটা কার নাম্বার?

– আমার একটা বন্ধু।

– বন্ধুর সাথে এতো কিসের কথা? নাকি আমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল তখন।

– কিযে বলেন ভাই।

মিজান চমকে উঠল। তার সঙ্গের বাকি তিনজন রক্ত বমি করতে শুরু করেছে। মিজান রবিউলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার ঠোঁটের কোনে হাসি।

রবিউল বললো,
– আমার বোন যে কেমিক্যাল খেয়ে মারা গেছে সেই কেমিক্যাল মদের বোতলে দিছিলাম। এরা সবাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে মারা যাবে, কারণ আমি এখানে দুটো কেমিক্যাল ব্যবহার করেছি।

মিজানের গলা শুকিয়ে গেছে। তার এখনো কিছু হয়নি। সে বললো,
– ভাই আমাদের অপরাধ?

– আমি বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখি না। তুমি কদিন আগে দাদাজানের হয়ে কাজ করতে, এখন করো আমার কাজ।

– সেটা কি আমার দোষ?

– না তোমার অপরাধ হচ্ছে আমার বোনের মৃত্যুর দায়ে ফিরোজের সঙ্গী তুমিও ছিলে৷ এটাই তোমার জন্য মৃত্যুর বার্তা নিয়ে এসেছে।

চোখের সামনে তিনজন কাতরাতে কাতরাতে শেষ হয়ে গেল। সাজু তার পকেট থেকে পিস্তল বের করে মিজানের কপালে ঠেকালো। মিজান নিজের কোমড়ে হাত দিতে গিয়ে সেখানে পিস্তল পেল না। রবিউল তার সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল দিয়ে দুটো গুলি করলো। একটা ছোট্ট চিৎকার দিয়ে মিজান লুটিয়ে পড়লো।

লতা চিৎকার শুনে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো। রবিউল দরজা খুলে দিলে লতা পরপর চারটা লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কঠোর ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকে।

– ওদের কেন মারলেন?

– টাকার ভাগ দিতে হবে না তাই।

লতা কাঁদতে লাগলো। রবিউল তাকে বললো,

– আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে যেতে হবে। আপনার বাবার কারণে এ শহরে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। শহর থেকে বের হবার আগে আপনার পেটের বাচ্চাটা নষ্ট করতে হবে।

লতা আৎকে উঠলো।
– আমার সন্তানের দিকে নজর দিচ্ছেন কেন?

– কারণ এটা ফিরোজের রক্ত, আর ফিরোজের সন্তান পৃথিবীতে আসুক সেটা আমি চাই না।

|
|

চলবে…

মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।