চিরকুট পর্ব-০১

0
287

#চিরকুট (প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
আজ সৃজাকে মনের কথা বলবে গৌরব অবশেষে। এই স্টেট ব্যাঙ্কের কোন্নগরে অফিসে চাকরি করছে দুজন প্রায় এক বছর হলো! কিন্তু যেদিন থেকে সৃজাকে ও প্রথম দেখেছিল অফিসে, সেদিন থেকে যেন ভালো লাগার শুরু হয়েছিল মনে। সৃজার মিষ্টি ব্যাবহার, হাসি খুশি স্বভাব, সবই যেন ভীষণ আলাদা লাগতো গৌরবের। মেয়েটা প্রত্যেকটা কাস্টমারের সাথে সমান ভাবে ধৈর্য্য রেখে কথা বলে, বয়স্ক লোকদের কাজ আগে করে দেয়ার চেষ্টা করে নিজে থেকে, প্রচণ্ড রকম এফিশিয়েন্ট নিজের কাজের ব্যাপারে, এই সব গুণগুলোই আসলে খুব ভালো লাগতো গৌরবের। যদিও এই অফিসে ওর প্রচুর দ্বায়িত্ব। প্রবেশনারি অফিসার যেহেতু। কিন্তু তার মধ্যেই সময় বার করে গৌরব অল্প অল্প করে আলাপ জমিয়েছে সৃজার সাথে। মানে কখনো কাজ শেষ করে বিকেলের পর একসাথে স্টেশন যাওয়ার পথে, তো কখনো লাঞ্চ টাইমে, সৃজার সাথে কাজের বাইরে টুকরো কথা বলতো ও নিজে থেকেই! যেমন এখনও মনে পরে সেই দিনটা, খুব বৃষ্টি শুরু হয়েছিল কোন্নগরে
বিকেলের পর। এদিকে ট্রেনের তার ছিঁড়ে হাওড়া যাবার গাড়ি বন্ধ। এক ঘন্টা পর হয়তো চলবে ট্রেন। সৃজা সেদিন বেশ টেনশনেই একা দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনে। এত জোর জোর বাজ পড়ছে, মেঘ ডাকছে যে এমনিই কেমন বুকটা কেঁপে উঠছে যেন! ছোট থেকেই ওর এই বাজের আওয়াজে ভীষণ ভয় আসলে। তার মধ্যে আজ ছাতাটাও নেই ব্যাগে! এতটা রাস্তা ফিরতে হবে এখনো! সেই বেহালা। এইসবই ভাবছিল আনমনে, তখনই ভাবনার ভিড়ে গৌরব এসে হাজির হঠাৎ এই ভেজা স্টেশনে। ও দূর থেকে খেয়াল করছিল সৃজার থমথমে মুখটা। তাই নিজে থেকে এসেই জিজ্ঞাসা করেছিল,
——” এনি প্রব্লেম? তুমি কি টেনশন করছো ট্রেনের গন্ডগোলের জন্য? ডোন্ট ওরি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার চালু হয়ে যাবে ট্রেন। ”
এই কথায় সৃজা একটু জড়োসড়ো হয়ে বলেছিল,
——” না, আসলে সেই জন্য না! আমার এই বাজ পড়ার আওয়াজে একটু ভয় লাগে। আর কতটা রাস্তা ফিরতে হবে এখনো! তার মধ্যে ছাতাটা ও আনিনি আজ। তাই! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল সৃজা। কিন্তু এই বাজের আওয়াজে ভয় লাগে কথাটা শুনে গৌরব হেসে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। তার মানে মেয়েটা এখনও মন থেকে বাচ্চাই। নইলে এরকম ভয় পেত না! যাইহোক, সেদিন গৌরব এবার কিছুটা সহজ ভাবে বলেছিল,
——-” বুঝলাম। চিন্তা কোরো না। হাওড়ায় নেমে আমি তোমায় বাসে তুলে দেব। আর এই পুরো রাস্তাটা তো সাথে আছিই। ”
কিন্তু এই কথায় সৃজা না না করে বলে উঠেছিল,
——” সে কি! আপনি তো নিউটাউনে থাকেন। আপনার তো বালি নেমে যাওয়ার কথা। আমার জন্য আবার হাওড়া যাওয়ার দরকার নেই এই বৃষ্টির মধ্যে! আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। ”
এই কথার উত্তরে গৌরব আলতো হেসে শুধু বলেছিল,
——-” সে দেখা যাবে। ”
তবে এরপর কিন্তু গৌরব কিছুতেই আর সৃজাকে একা ছাড়েনি। নিজে হাওড়া অব্দি গিয়ে ওকে বাসে তুলে দিয়েছিল। এমনকি নিজের ছাতাটাও দিয়ে দিয়েছিল মেয়েটাকে। সৃজা যদিও অনেক আপত্তি করেছিল। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে ওকে ছাতা দিয়ে দিলে গৌরব নিজে বাড়ি অব্দি ভিজে ফিরবে! কিন্তু এইসব কোন কথাই শোনেনি গৌরব। বরং সৃজা কে উল্টে বলেছিল,
—–” আমার এটুকু ভেজা অভ্যাস আছে। কিছু হবে না। তুমি ছাতার চিন্তা বাদ দিয়ে সাবধানে বাড়ি ফেরো। ”
এই কথাগুলো শুনে সৃজা ঠিক কি বলবে আর ভেবে পায়নি। কিন্তু সত্যিই এই বৃষ্টির দিনে ছেলেটা ওকে যেভাবে হেল্প করলো, তাতে থ্যাঙ্ক ইউ শব্দটাও ভীষণ ছোট হয়ে যায়! তাই গৌরবের সাথে বন্ধুত্বটা হয়তো সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ওর নিঃশব্দে। কিন্তু এরপরের দিন ছেলেটাকে ব্যাঙ্কে হাঁচ্ছ হাঁচ্ছো করতে দেখে খারাপ লেগেছিল ভীষণ। তাই আজ নিজে থেকেই ছাতাটা ফেরৎ দিতে গিয়ে বলেছিল,
——” দেখলেন তো, কি হলো! আমাকে হেল্প করতে গিয়ে নিজে ভিজে এরকম সর্দি বাঁধিয়ে ফেললেন। ইশ, আমার যে কি খারাপ লাগছে!”
এই কথায় গৌরব সেদিন দুবার নাক টেনে বলেছিল,
——” আরে, এরকম অল্প আধটু সর্দি কাশির আমার অভ্যাস আছে। এই নিয়ে একদম ভাববে না। ইটস নট আ প্রব্লেম..”
কথাটা শুনে সৃজা আর কি বলবে ঠিক ভেবে পেল না! শুধু ভালো লাগলো খুব। নিজের কষ্টটা আড়াল করে কত সহজে ছেলেটা ওর জন্য ভেবেছে কাল! তাই আজকের পর থেকে সৃজাও নিজে থেকে টুকরো কথা বলতো গৌরবের সাথে। কখনো একসাথে টিফিন শেয়ার করে খাওয়া, তো কখনো ট্রেনে গল্প করতে করতে ফেরা; সিনেমা থেকে পলিটিক্স সব রকমের আলোচনার মধ্যে কবে যে একে অপরের ভালো লাগাগুলো মিলতে শুরু করেছিল; আর ওরা ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ, সেটা নিজেরা কেউই বোঝেনি ঠিক।

তবে গৌরবের কাছে এটা শুধুই বন্ধুত্ব না। তার থেকে বেশি কিছু। গৌরব ফিল করে সৃজার জন্য। মেয়েটার কথা শয়নে স্বপনে জাগরণে সব সময়ই মনে হয় ওর। সৃজার মিষ্টি স্বভাব, নম্র কথাবার্তা, শান্ত দুটো চোখ, টোল পড়া গাল, মিষ্টি হাসি, সবই যেন কিরকম অকারণে মন ভালো করে দেয় গৌরবের হাজার কাজের টেনশনের মধ্যেও। যাইহোক, আজ অবশেষে গৌরব সাহস করেছে মনে মনে, এই মেয়েটাকে ‘ ভালোবাসি ‘ , এই কথাটা বলবে। সেই মতন সেদিন অফিস শেষ হয়ে যখন ওরা একসাথে বেরিয়েছিল স্টেশন যাবে বলে, সেদিন গৌরব হঠাৎ বলেছিল সৃজা কে,
——” কোন্নগর স্টেশনের সামনে একটা কফিশপ আছে। যাবে ওখানে আজ আমার সাথে? ”
এই কথায় সৃজা ঠিক কি বলবে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারছিল না। তবে মাথাটা হালকা ধরেছে ওর সারাদিনের কাজের চাপে। তাই এক কাপ কফি খেলে মন্দ হয় না! কথাটা ভেবে ও আলতো হেসে বললো,
——-” হ্যাঁ, যাওয়াই যায়। চলো। ”
এই কথায় গৌরবের মুখে হাসি। তারপর কিছুটা সময়ের ভিড়ে ওরা হাজির হয়েছিল কোন্নগর স্টেশনের সামনের ক্যাফেটায়। তবে এবার যেন গৌরব একটু উস্কো খুস্ক হয়ে গেছিল নিজে। কিভাবে যে মনের কথা বলবে, বুঝতে পারছিল না। কাল রাত থেকে যদিও অনেক প্র্যাকটিস করেছে আয়নার সামনে! তাও আজ কেমন এলোমেলো লাগছিল হঠাৎ। তবে এইভাবে ছেলেটাকে চুপ থাকতে দেখে সৃজা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ওকে,
——–” এনি প্রব্লেম? তুমি কিছু বলছো না যে! কি এত চিন্তা করছো?”
এই প্রশ্নে গৌরব যেন কিছুটা বেসামাল হয়েই বলে ফেলেছিল,
——–” তোমার কথাই তো চিন্তা করি সারাক্ষণ!”
সৃজা এটা শুনে কয়েক সেকেন্ড থমকে গেছিল যেন। তবে গৌরব এবার চিন্তার ঘোরটা কাটিয়ে বলেছিল,
——-” সরি, মানে আমি খারাপ ভাবে কিছু বলিনি! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড.. আসলে আমি লাইক করি তোমাকে। মানে ভালোবাসি। ”
সৃজা এবার অবাক চোখেই বলেছিল ওকে,
——” কি সব বলছো তুমি! আই থিঙ্ক আমাদের ওঠা উচিত। ট্রেন মিস হবে নইলে। ”
কথাটা বলেই সৃজা এই পরিস্থিতি টা থেকে বেরোনোর জন্য উঠতে যাচ্ছিল গৌরবের সামনে থেকে, তবে গৌরব এই মুহূর্তে ওর হাতটা ধরে একটু কাতর স্বরেই বললো,
——–” প্লিজ কোথাও যেও না! আমি তোমাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলতে চাইনি! কিন্তু আসলে এই কথাগুলো না বললে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আই রিয়ালি ফিল ফর ইউ.. বিয়ে করতে চাই তোমাকে। মন থেকে ভালোবাসি। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবের গলাটা যেন ধরে এসেছিল কেমন। তবে সৃজা এখন সত্যিই নিরুত্তর হয়ে বসেছিল ওর সামনে। কোন শব্দই আসছিল ঠিক। যদিও গৌরব কে এতদিন দেখে মানুষ হিসেবে ভালো লাগে ওর। কিন্তু হঠাৎ এইসব বেহিসেবী কথা এক্সপেক্ট করেনি ও ছেলেটার থেকে। আর সৃজার তো নিজেরও একটা সত্যি আছে! সেই সত্যিটা জানার পর কি গৌরব এত জোর গলায় বলতে পারবে ভালোবাসি! কথাগুলো ভেবেই সৃজা আর দাঁড়ালো না। উঠে দাঁড়ালো গৌরবের সামনে। তারপর স্থির গলায় বললো,
——” আমার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্টেশন যেতে হবে। ”
কথাটা শেষ করেই ও আর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেল কফি শপটা থেকে। তবে গৌরব কেমন নিস্তেজ শরীরে বসে রইলো ক্যাফেটায় একা, অনেকক্ষণ!
< ২>
এইসবের পর তিনটে সপ্তাহ কেটে গেছে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে। এই সময়ে গৌরব আর সৃজার মধ্যে অদ্ভুত একটা নিঃস্তব্ধতার দেয়াল তৈরি হয়েছে যেন। আসলে সেদিনের পর থেকে সৃজা গৌরবকে দেখলেই এড়িয়ে যায় কেমন। কাজের বাইরে একটাও কথা বলে না আর। ছুটির পর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে,যাতে এই ছেলেটার মুখোমুখি হতে না হয় কখনো।
তবে এইভাবে সৃজার অচেনা মানুষ হয়ে যাওয়া খুব হার্ট করেছে গৌরবকে। ওর কি দোষ ছিল! শুধু নিজের ফিলিংস গুলোই তো বলেছিল সৃজা কে! এর উত্তরে ‘ না ‘ ই বলে দিতে পারতো সৃজা। এইভাবে ইগনোর করার কি আছে! এইভাবে একদিনে বন্ধুত্বটাকে শেষ করে দিয়ে কি পেল ও! সেদিনের পর তো গৌরব কতবার ফোন করেছে, মেসেজ করেছে ওকে; কিন্তু সৃজা একবারও কল রিসিভ করেনি গৌরবের। একটা মেসেজেরও রিপ্লাই দেয়নি নিজে থেকে। ভেবেই এই মাঝের দিনগুলো যেন কেমন অন্ধকারে কাটছিল ছেলেটার! মন খারাপের ভিড়েই দিন থেকে রাত হচ্ছিল গৌরবের। তার মধ্যেই আজ একটা ফাইলের গন্ডগোল করে ফেলেছিল ব্যাংকে। আসলে সব সময় এতটা আনমনে থাকে ও, বিশেষ করে একই অফিসে সৃজার সাথে রোজ মুখোমুখি হয়েও যখন একটা শব্দ কথা হয় না দুজনের, তখন খারাপ লাগে ভীষণ! তাই কাজে ঠিকভাবে মন বসাতে পারে না ও। তবে এই নিয়ে ব্যাংকে গৌরবকে আজ খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ম্যানেজারের কাছে অনেকগুলো কথাও শুনতে হয়েছে মাঝখানে। সেই জন্য টিফিনটাও খাওয়া হয়নি ওর।
যাইহোক, অবশেষে ফাইলের সফ্ট কপিটা কম্পিউটারের রিসাইকেল বিন থেকে উদ্ধার করে প্রিন্ট আউট বার করে যখন ঝামেলাটা মিটলো, তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। তবে এরপর যেন মাথাটা ঝিমঝিম করছিল ওর। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল হঠাৎ! তাই রাস্তায় বেরিয়ে চারিদিকটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্ধকার হয়ে গেছিল কেমন। গাড়ির আওয়াজ, হর্নের শব্দ, লোকের ভিড়, সব যেন মিলে মিশে মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল গৌরবের। সেই সময় রাস্তার মাঝে থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ও কয়েক মিনিট। চারিদিকটা আসলে আবছা হয়ে আসছিল ওর। তবে গৌরব খেয়াল করেনি পিছন থেকে একটা টাটা সুমো গাড়ি হর্ন মারতে মারতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে! সেদিন আর একটু হলে গাড়িটা ওকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যেত; যদি না সৃজা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে রাস্তার মধ্যে এই দৃশ্যটা দেখে ছুটে যেত গৌরবের কাছে! সৃজা সেই মুহূর্তে গৌরবের হাতটা ধরে টেনে ওকে সরিয়ে দিয়েছিল গাড়িটার সামনে থেকে। তারপর ভীষণ ঘাবড়ে চেঁচিয়ে বলেছিল,
——–” পাগল হয়ে গেছ না কি তুমি! আর একটু হলে গাড়িটা এসে ধাক্কা দিয়ে দিত তো! ”
কথাগুলো বলেই ও খেয়াল করেছিল গৌরবের ফ্যাকাসে চেহারাটা! ছেলেটা কেমন শুকনো মুখে মাথায় হাত দিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে হালকা টলছে! ব্যাপারটা দেখেই সৃজা বলেছিল,
——-” ঠিক আছো তো তুমি? শরীর খারাপ করছে? ”
এই প্রশ্নে গৌরব খুব ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
——-” মাথাটা ঘুরছে খুব। ”
সৃজা এটা শুনে কেমন অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——-” কি! মাথা ঘুরছে! খাওনি কিছু তুমি? ”
এই প্রশ্নে গৌরব অল্প কথায় বলেছিল,
———” না। চাপ ছিল খুব আজ ব্যাংকে! খাওয়া হয়নি। ”
সৃজা এই উত্তরে সাথে সাথেই বলেছিল,
——” মানে! সারাদিন কিছু না খেয়ে আছো! এক্ষুণি চলো আমার সাথে। খেতে হবে কিছু। ”
কথাটা বলেই ও গৌরবের হ্যাঁ না এর অপেক্ষা না করেই রাস্তার মাঝে একটা টোটো কে হাত দেখিয়ে দাঁড় করে উঠে বসেছিল। তারপর গৌরব কে নিয়ে এসেছিল সেদিনের সেই স্টেশনের সামনের কফি শপটায়। তারপর দুটো স্যান্ডুইচ কফি অর্ডার করে বলেছিল,
——–” হাজার কাজের চাপ থাকলেও, এইভাবে না খেয়ে থাকতে আছে! যদি আজ রাস্তার মাঝে মাথা ঘুরে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেত! তাহলে কি হতো! ”
এই কথাগুলো শুনে গৌরব এবার কিছুটা সময় নিয়ে থমকে থাকা গলায় বলেছিল,
———-” আমাকে নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই। আমার মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত। নইলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে! আর এতদিন যেরকম অচেনা ছিলে; আজ আমার শরীর খারাপের জন্য সেই নিয়মটা ভাঙার দরকার নেই। ”
কথাগুলো যে খুব অভিমান থেকে গৌরব বলেছিল আজ, সেটা সৃজা বুঝেছিল এই মুহূর্তে। তবে আর ও চুপ থাকতে পারেনি। গৌরবকে জোর করে অদেখা করে দূরে সরে থাকতে পারেনি। ছেলেটার সত্যিই শরীর খারাপ। এর মধ্যে আর শব্দহীন হয়ে থাকা সম্ভব না। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,
———” আমার মা বাবা কে আমি জানি না গৌরব! আমাকে জন্মের পর চন্দননগর হসপিটালের বাইরে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায় কেউ! সেখান থেকে মা খুঁজে পায় আমাকে। মা চন্দননগর হসপিটালের নার্স ছিল। মায়ের ছেলে মেয়ে কেউ ছিল না, হাজবেন্ডও কদিন আগে মারা গেছিল, তাই আমাকে পেয়ে ফেলে আসতে পারেনি আর! বরং খুব ভালোবেসে এডপ্ট করেছিল। বাড়ি নিয়ে এসেছিল নিজের। তারপর থেকে আমি মায়ের কাছেই মানুষ। যদিও মায়ের এই ডিসিশন এর জন্য অনেক আত্মীয় স্বজনই অনেক কথা শুনিয়েছে। আজ অব্দি তো কেউ কেউ যোগাযোগই রাখে না! যার রক্তের কোন ঠিক নেই, জাত বংশের ঠিক নেই, সেরকম একটা মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসে নিজের সন্তানের মতন মানুষ করাটাকে ভালো চোখে দেখেনি তারা। তবে মা এইসব নিয়ে ভাবেনি কখনো! খুব ভালোবেসে যত্ন করে আমাকে বড় করে তুলেছে। কিন্তু আমি নিজের সত্যিটা কখনো ভুলি না! এবার বলো, পারবে এরকম একটা মেয়েকে ভালোবাসতে; যার জাত ধর্ম রক্ত কোন কিছুর কোন ঠিক নেই! যার আসল মা বাবার পরিচয় টুকু সে জানে না! পারবে এরকম একটা মেয়েকে বাড়ির বউ করতে?”
প্রশ্ন গুলো কেমন গৌরবের চোখের দিকে চোখ রেখে করেছিল সৃজা। তবে গৌরব এসব শুনে চুপ ছিল কিছুক্ষণ। শব্দহীন হয়ে ছিল ওর সামনে। সৃজা এটা দেখে বুঝেছিল গৌরবের উত্তরটা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলেছিল,
——-” আমি আসছি। ”
তবে ও উঠে দাঁড়াতেই গৌরব ওর হাতটা শক্ত করে ধরেছিল হঠাৎ। তারপর ভীষণ স্থির গলায় বলেছিল,
———” এই জন্য তুমি এতদিন আমার সাথে কথা বলছিলে না! এতটা সস্তা মনে হয় আমার ফিলিংস গুলোকে তোমার? আমি ভালোবাসি তোমাকে। এটাই আমার কাছে সব থেকে বড় সত্যি। এরপর আর আমার কিছু জানার নেই। তোমার বংশ, তোমার জাত, এইসব নিয়ে আই এম নট ইন্টারেস্টেড… আমার কাছে শুধু তুমি ইম্পর্টেন্ট.. তুমি এজ আ পার্সন.. ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবের চোখ দুটো ভিজে এসেছিল হঠাৎ। সৃজা এই জল দেখে কেমন থমকে গেছিল যেন। গৌরবের চোখে ও সত্যিই নিজেকে দেখতে পেয়েছিল আজ। বুঝতে পেরেছিল এই ছেলেটা মন থেকে নিজের সবটা দিয়ে শুধু ভালোবাসে ওকে। তাই আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি এরপর গৌরব কে ও। আগের দিনের মতন হাতটা ছাড়িয়ে চলেও যেতে পারেনি আর একা। বরং খুব নিঃস্তব্ধ হয়ে ওর সামনে বসেছিল আবার। তারপর আলতো স্বরে বলেছিল,
——- ” খেয়ে নাও স্যান্ডুইচ গুলো। আজ থেকে আবার একসাথে ট্রেনে ফিরবো। ”
এই কথাটা শুনে গৌরবের ভেজা চোখের ভিড়েও হাসি চলে এসেছিল একটা। সৃজা যে ‘ ভালোবাসি ‘ না বলেও ভালোবেসে ফেলেছে ওকে, এটা বুঝেছিল গৌরব নিঃশব্দে। তাই ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরেছিল সৃজার হাতটা এই মুহূর্তে। তারপর নতুন স্বপ্নের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল সেই বিকেলে।
( ক্রমশ )