চিরকুট পর্ব-০৭

0
94

#চিরকুট ( সপ্তম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পরে গৌরব যখন বাড়ি গিয়ে মা বাবাকে এই এডপশনের ব্যাপারে বলেছিল, ওরা কিরকম টলে গেছিল হঠাৎ ভিতরে ভিতরে। শেষে একটা নাম পরিচয়হীন বাচ্চা ওদের বংশে জায়গা পাবে! ওদের সারনেম নিয়ে বড় হবে! যার কোন রক্তের ঠিক নেই, জাতের ঠিক নেই, সে গৌরবকে বাবা বলে ডাকবে! এইসব যেন মানতে পারছিল না ওরা কিছুতেই। তাই আজ ভীষণ রাগ থেকেই সমীরণবাবু বলেছিল,
——–” শেষে এই দিনটাই দেখার বাকি ছিল! প্রথমে একটা রাস্তার মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ির বউ করলি, এরপর একটা কূলজাতহীন বাচ্চাকে তুলে এনে মানুষ করবি! আর কিছুই বলার নেই আমার। ”
কথাটা শুনে গৌরব এবার বাবাকে থামিয়েই বললো,
——–” প্লিজ.. সৃজা কে নিয়ে একটাও খারাপ কথা আমি শুনবো না আজ। ”
কথাটায় অনন্যা এই সময় বেশ ঝাঁঝিয়েই উত্তর দিল,
——–” হ্যাঁ রে, দুদিনের আসা ওই মেয়েটাই তোর কাছে সব হলো? আমার, তোর বাবার চাওয়া পাওয়া ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন দাম নেই তোর কাছে? ”
এর উত্তরে গৌরব এবার কিছুটা বুঝিয়েই বলার চেষ্টা করলো,
——–” মা, সৃজা সিভিয়ার ডিপ্রেশনে আছে। ওর মধ্যে সুইসাইডাল টেন্ডেনসি গ্রো করছে। ও এইভাবে এই ট্রমা টা কে নিয়ে আর বাঁচতে পারছে না! তাই সাইকোলজিস্ট সাজেস্ট করেছে একটা বাচ্চা এডপ্ট করতে। আর আমার কাছে সৃজার জীবনটা সব থেকে বেশি দামী। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল গৌরব। কিন্তু এসব শুনে সমীরণ বাবু আজ ভীষণ স্থির গলায় উত্তর দিল,
———” তুই আর এই বাড়ি আসিস না বাবু। এরপর সত্যিই আমরা তোর সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না। তোর জীবন, তুই যা ভালো বুঝিস কর। শুধু আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখিস না। ”
কথাগুলো বলেই সমীরণ বাবু সেদিন চলে গেছিল নিজের ঘরে। এই মুহূর্তে গৌরবের চোখটাও ভিজে এসেছিল হঠাৎ! জানতো আসলে, মা বাবা কোনভাবেই ওর এই ডিসিশনটা মেনে নেবে না। তবে এই মুহূর্তে অনন্যা কেঁদে উঠে নিজের মনেই বলেছিল ,
——” ওই একটা মেয়ের জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল। একমাত্র ছেলে এইভাবে দূরে চলে গেল আমাদের কাছ থেকে! আমি কোনদিন ওই মেয়েকে ক্ষমা করবো না! কোনদিন না। ”
শেষ কথাটা কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো অনন্যা। কিন্তু গৌরব এই মুহূর্তে আর কোন উত্তর করলো না ঠিক। আসলে কিছু কিছু সময় খুব ক্লান্ত
লাগে আজকাল। সৃজার মতন ও মা বাবাকেও ভালোবাসে ভীষণ। কিন্তু সেই মা বাবাই কোনদিন ওর পরিস্থিতি, ওর কষ্টগুলো বোঝার চেষ্টা করলো না! সব সময়ই উল্টে সৃজাকে দোষ দিয়ে গেল! আর এই এডপশনের ডিসিশনটাও গৌরবের মনে কেমন পাথরের মতন চেপে বসেছে। ও জানে না,যাকে নিয়ে আসবে তাকে কোনদিন মন থেকে নিজের ভাবতে পারবে কি না! ভালোবেসে নিজের সন্তানের জায়গাটা দিতে পারবে কি না! শুধুমাত্র সৃজার বেঁচে থাকার জন্যই সবটা মেনে নিচ্ছে, ব্যাস। কথাগুলো ভেবেই ও আজ নিঃস্তব্ধতার ভিড়েই বাড়ি ছাড়লো নিজের। তারপর কলকাতার ভিড় শহরে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো ধীরে ধীরে।
<১৩>
তবে এই হারিয়ে ফেলার ভিড়ে একটা ফিরে পাওয়া আনন্দ নিয়ে এসেছিল চিরকুট সৃজার জীবনে। অনেকদিন বাদে সৃজা মন খুলে হেসেছিল, খুশি হয়েছিল। হ্যাঁ, চিরকুট নামটা যদিও একটু অদ্ভূত। অনাথ আশ্রমে যখন এই তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটাকে প্রথম দেখেছিল, তখন এই চিরকুট নামটা শুনে সৃজা আর গৌরব দুজনেই অবাক হয়েছিল। কিন্তু তারপর ওই অরফানেজ এর ইন চার্জ এর মুখে জানতে পারলে মেয়েটাকে কেউ ওই অনাথ আশ্রমের বাইরে ফেলে রেখে গেছিল একটা চিরকুট সমেত, যখন ওর বয়স হয়তো দু তিন সপ্তাহ হবে! সেই চিরকুটে লেখা ছিল, —–” আপনারা দেখবেন মেয়েটাকে দয়া করে। ”
তারপর থেকেই এই আশ্রমে ওর নাম হয়ে যায় চিরকুট। ফর্সা, টুকটুকে, বড় বড় চোখ, মিষ্টি একটা মুখ দেখলে যে কেউ বলবে চিরকুট কোন ভালো বাড়ির সন্তান ছিল হয়তো! সৃজার তবে মেয়েটাকে প্রথম দেখেই কেমন মায়া জন্মে গেছিল যেন ওর ওপর। তাই গৌরবকে বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এডপশনের সমস্ত ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে ও বাড়ি নিয়ে এসেছিল চিরকুটকে। যদিও ছোট্ট এই মেয়েটা প্রথম প্রথম এই নতুন বাড়িতে এসে কেমন যেন চুপ হয়ে থাকতো বেশিরভাগ সময়! আশ্রমের পরিবেশের সাথে তো বাড়ির পরিবেশ একদম আলাদা। সৃজা আর গৌরবও ওর কাছে ভীষণ অচেনা! তাই থমকে থাকতো যেন চিরকুট। সেই জন্য সৃজা যখন প্রথম ওকে বাড়িতে এনে বলেছিল,
——–” আমি তোমার মা হোই চিরকুট। আমাকে একবার মা বলে ডাকো!”
কথাটায় চিরকুট কোন উত্তর দেয়নি। সৃজার সেটা দেখে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছিল। তবে গৌরব সৃজাকে সেই মুহূর্তে বুঝিয়ে বলেছিল,
——–” ওর মনে হয় একটু সময় লাগবে। নতুন পরিবেশ তো!”
কথাটায় সৃজা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে ও প্রত্যেকটা সময় চেষ্টা করতো চিরকুটের মা হয়ে ওঠার! সকালে ওকে আদর করে ঘুম থেকে তোলা থেকে ওর জন্য নিজের হাতে রান্না করা, খাইয়ে দেয়া, অফিস থেকে ফিরে এসেই চিরকুটকে নিয়ে পার্কে খেলতে যাওয়া, সন্ধ্যে বেলা স্লেট পেন্সিল নিয়ে ওকে অ আ ক খ শেখানো, সব কিছু করতো সৃজা নিজে। যত রকম ভাবে এই মেয়েটার মনে নিজের জায়গা তৈরি করা যায় তার সব রকম চেষ্টা করতো সৃজা প্রত্যেকটা মুহুর্তে। চিরকুটের সাথে পুতুল খেলা, রান্না বাটি খেলা, ওকে পছন্দের জামা কিনে দেয়া, একসাথে বসে টিভিতে কার্টুন দেখা, এইসব করতে করতে আস্তে আস্তে সৃজা চিরকুটের সব থেকে কাছের বন্ধু হয়ে গেছিল। তবে এই দু মাসে এসবের পরও ও চিরকুটের মুখ থেকে মা ডাকটা শোনেনি একবারও; যার জন্য ওর মনটা ছটফট করতো সব সময়। তবে সেদিন বিকেলে পার্কে খেলতে গিয়ে চিরকুট কিছুটা বেসামাল হয়ে পরে গেছিল স্লিপ থেকে। সেদিন হঠাৎ মেয়েটা মা বলে চিৎকার করে উঠেছিল ভয়ে। সৃজা সেই সময় দৌড়ে চিরকুটের কাছে গেলে চিরকুট ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরেছিল ওকে। আর এই প্রথম মা ডাকটা শুনে সৃজার মনটা তৃপ্তি পেয়েছিল যেন। অনেকদিনের মা ডাক শোনার পিপাসা মিটেছিল আজ।
সেদিনের পর চিরকুট সৃজার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। ওর সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, সেই অন্ধকারে ঢাকা কালো সময়টা মুছে দিয়েছিল জীবন থেকে। গর্ভের সন্তান না হয়েও আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল মেয়েটার সাথে সৃজার। এখন সৃজার জীবনে আর কোন দুঃখ, কোন আফসোস নেই। মেয়েকে নিয়ে ও ভীষণ সুখী।
এইভাবেই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু এই আবহমান সময়ের মাঝে সৃজা একটা জিনিস খেয়াল করেছিল। গৌরব কেমন চুপ হয়ে গেছে যেন এই দিনগুলোতে। চিরকুট আসার পর থেকে ও কখনো নিজে থেকে চেষ্টা করেনি ওর সাথে সম্পর্ক তৈরি করার, কিছু সময় কাটানোর! এখনো মনে আছে প্রথম দিন সৃজা যখন চিরকুটকে নিয়ে ওদের শোবার ঘরে এসেছিল, গৌরব কিরকম আড়ষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——-” ওকে এখানে নিয়ে এলে কেন? ওর জন্য তো আলাদা ঘর আছে! ”
কথাটায় সৃজা বেশ অবাক হয়েই বলেছিল,
——-” ও মাত্র তিন। এইটুকু বয়সে আলাদা ঘরে একা ঘুমোবে কি করে! মেয়েটার তো ভয় লাগবে!”
এটা শুনে গৌরব আর কোন উত্তর করেনি। শুধু নিজের বালিশটা নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেছিল। সৃজা এটা দেখে কেমন স্থির হয়ে গেছিল যেন! তাহলে গৌরব কি চিরকুটকে মন থেকে একসেপ্ট করেনি! সেদিন সারা রাত ধরে ভেবেছিল এইসব। তবে পরেরদিন গৌরবকে এই প্রশ্নটা করলে ছেলেটা খুব শান্ত গলায় বলেছিল,
——–” আমার একটু সময় লাগবে সব কিছু একসেপ্ট করতে। আসলে এতদিন এই ফ্ল্যাটে শুধু দুজন ছিলাম! এরপর হঠাৎ করে একটা বাচ্চা চলে এলো! তাই অন্য রকম লাগছে সব কিছু। কিন্তু আমি খুশি। তুমি খুশি তাই আমি খুশি। ”
কথাগুলো বলে কিছুটা জোর করেই হেসেছিল গৌরব সৃজার সামনে। কিন্তু সৃজা এই ফ্যাকাসে হাসির মধ্যে একটা মন খারাপ খেয়াল করেছিল। যেটা দিনের পর দিন গৌরবের মধ্যে দেখতে পায় ও আজকাল। ছেলেটা এখন অফিস থেকে দেরিতে ফেরে। একদিন তো অল্প ড্রিঙ্ক করে অব্দি এসেছিল গৌরব। সৃজা এসব দেখে ভীষণ রেগে গেছিল সেদিন। যদিও গৌরব কিছু শোনার অবস্থায় ছিল না সেই সময়। তবে পরেরদিন সকালে সৃজা নিজের রাগটাকে আড়াল না করেই বলেছিল,
——–” তুমি কাল কিভাবে বাড়িতে ড্রিঙ্ক করে ফিরলে গৌরব! বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে। তুমি তার বাবা। ও কি শিখবে তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে! ”
কথাটায় গৌরব কোন উত্তর করেনি। শুধু চোখ দুটো নামিয়ে ছিল নিজের। আসলে এখন গৌরব এত কম কথা বলে যে সৃজাও এই নিঃস্তব্ধতায় হাঁফিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু আজ ও চুপ না থেকে বলেই উঠলো,
———” কি হয়েছে তোমার? প্লিজ বলবে। কেন এত চুপ থাকো আজকাল! চিরকুটের আমাদের লাইফে আসার জন্য তুমি খুশি নয়? ”
কথাগুলো খুব ক্লান্ত স্বরে বলেছিল সৃজা। তবে গৌরব এইসব শুনে আস্তে গলায় উত্তর দিয়েছিল,
——–” কাল আমার ড্রিঙ্ক করে আসাটা উচিত হয়নি। আই এম সরি ফর দ্যাট.. এরকম আর কোনদিন হবে না। আর আমি খুশি, তোমার জন্য খুশি। তুমি যে চিরকুটকে পেয়ে আবার আগের মতন হয়ে গেছ, এটা দেখে আমার সত্যি খুব রিলিভড লাগে আজকাল। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গৌরব আর থাকলো না সৃজার সামনে। উঠে চলে গেল বাথ রুমে ফ্রেশ হতে। কিন্তু সেই মুহূর্তে সৃজার মনে একটা প্রশ্নই ছিল! গৌরব তো একবারও নিজের কথা বললো না! চিরকুটের জন্য ও যে বাবা হওয়ার আনন্দ পেয়েছে জীবনে, সেটা তো বললো না! তাহলে কি ও মন থেকে খুশি না! চিরকুটকে পেয়ে গৌরবের জীবনে কোন স্যাটিসফেকশন নেই! কথাগুলো যেন না চাইতেই মনে এসে উঁকি দিল সৃজার।
আর ভাবনাটা কেমন মিলে যেতে থাকলো বাস্তবের সাথে। চিরকুট এই বাড়িতে এসেছে এখন দেড় বছর হয়ে গেছে প্রায়। কিন্তু গৌরবের সাথে ওর কোন কনেকশনই তৈরি হয়নি এই দিনগুলোতে। যদিও চিরকুট গৌরবকে বাবা বলেই ডাকে। অনাথ আশ্রমের স্মৃতি গুলো ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এসেছে মেয়েটার জীবনে। এখন ও মা বাবা বলতে গৌরব আর সৃজাকেই চেনে। কিন্তু এই চেনার বাইরে গৌরবের সাথে ওর কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি মনের। আর হবেই বা কি করে! গৌরব তো নিজে থেকে সহজ হয়ই না চিরকুটের সাথে। এই যেমন বেশ কদিন আগে গৌরব অফিস থেকে ফেরার পর চিরকুট একটা বল নিয়ে গেছিল ওর কাছে। তারপর আলতো স্বরে বলেছিল,
——-” বাবা, একটু খেলবে আমার সাথে? ”
কথাটায় গৌরব একটু ইতঃস্তত হয়ে অল্প কথায় বলেছিল,
——-” আমি খুব টায়ার্ড আজ। তুমি একা একা খেল। ”
কথাটা বলেই ও ড্রইং রুম থেকে নিজের ঘরে চলে এসেছিল। চিরকুট যদিও কিরকম ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গৌরবের চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ! তারপর নিজে নিজেই খেলতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরপরও চিরকুট মাঝে মাঝে যেত গৌরবের কাছে। কখনো নিজের আঁকা এলোমেলো হাতের কোন ছবি নিয়ে, তো কখনো সৃজার কিনে দেয়া নতুন জামা, পুতুল এইসব নিয়ে দেখাতে। কিন্তু গৌরব প্রত্যেকবারই খুব ওপর ওপর দেখে শুধু একটা ‘ বাহ, ভালো হয়েছে। ‘ বলে নিজের কাজ করতে শুরু করে দিত কেমন। কিন্তু কোনদিনই এই মুহূর্ত গুলোতে ও চিরকুটকে কোলে তুলে আদর করেনি, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেনি। আসলে চিরকুটের ভালো লাগায় কোনদিন খুশি হওয়ার চেষ্টাই করেনি গৌরব। এমনকি দেড় বছর পর যখন চিরকুটের প্রথম স্কুল এডমিশন ছিল, গৌরব সেখানেও যায়নি সৃজার সাথে। আর এই সমস্ত ছোট বড় ঘটনাগুলোই খেয়াল করছিল সৃজা নিঃশব্দে। বুঝতে পারছিল খুব বড় একটা ফাঁক আছে ওই ছোট্ট মেয়েটার জন্য গৌরবের মনে, যেটা গৌরব মুখে বলে না কখনো।
<১৪>
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। এর মধ্যে চিরকুটের স্কুলে সেদিন একটা ছোট্ট প্রোগ্রাম ছিল। সব বাচ্চাদের মা বাবাদেরই ইনভিটেশন ছিল সেখানে। চিরকুট প্রথম সেই প্রোগ্রামে একটা ডান্স পারফরমেন্স করবে। সেই জন্য সৃজা বেশ কদিন ধরে ভীষণ এক্সসাইটেড ছিল। রোজ ব্যাংক থেকে ফিরে চিরকুটকে নাচ প্র্যাকটিস করাতো সৃজা। কথাটা ও গৌরবকে বলেছিল নিজে থেকে। চিরকুট এর প্রথম স্টেজ প্রোগ্রাম বলে কথা! সৃজা চেয়েছিল ভীষণ ভাবে সেই দিনটায় গৌরব থাকুক ওদের সাথে। সেই মতন পনেরোই ফেব্রুয়ারি বুধ বার দিন সৃজা ব্যাঙ্ক থেকে ছুটি নিয়েছিল। গৌরবকে ও মনে করিয়ে দিয়েছিল সকালে বার বার। আজ ঠিক দুপুর একটার মধ্যে স্কুল পৌঁছতে হবে। গৌরব সেদিন যদিও ছুটি নেয়নি ব্যাংক থেকে, তবে বলেছিল সৃজাকে, হাফ ডে নিয়ে চলে আসবে স্কুল। কথাটা ড্রইং রুম থেকে চিরকুট শুনেছিল ওদের, আর মনে মনে খুশি হয়েছিল ভীষণ। ওর অন্য বন্ধুদের বাবারা অনেক সময় তাদের স্কুলে ছাড়তে আসে, বা ছুটি হলে বাড়ি নিতে আসে, আইসক্রিম খাওয়ায়, কত মজার মজার কথাও বলে! সেখানে ওর বাবা তো চিরকুটের সাথে গল্পই করে না কখনো! এইসব নিয়ে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় খুব। তবে আজ বাবা এলে স্কুলে পিঙ্কি, রুচিকা, নেহা সবার সাথে আলাপ করিয়ে দেবে চিরকুট। সবাই দেখবে চিরকুটের বাবাকে কেমন দেখতে! এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে সেদিন বেশ আনন্দ নিয়েই গেছিল মেয়েটা প্রোগ্রামে। তবে বেশিক্ষণ সেই আনন্দ থাকেনি ওর মনে; কারণ ঘড়ির কাঁটা দুপুর তিনটে ছোঁয়ার পরেও গৌরব আসেনি সেদিন স্কুল। সৃজা যদিও তিন বার ফোন করেছিল গৌরবকে। কিন্তু ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে গেছিল প্রত্যেকবার। কিন্তু ততক্ষণে চিরকুটদের নাচটাও শেষ হয়ে গেছিল স্টেজে। মেয়েটা এরপর খুব থমথমে মুখে ব্যাক স্টেজ থেকে সৃজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” মা, বাবা কেন এলো না আজ? আমার সব ফ্রেন্ডস দের বাবা এসেছে। শুধু আমার বাবাই এলো না! বাবা কি আমাকে লাইক করে না? ভালোবাসে না আমাকে?”
কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে উঠেছিল চিরকুট। কিন্তু সৃজা সেই মুহূর্তে কি বলবে সত্যিই বুঝতে পারেনি ঠিক। মেয়ের কান্না দেখে ওর চোখেও জল এসে ভিড় করেছিল হঠাৎ, আর উত্তরহীন হয়েই কেটে গেছিল সময়টা।
তবে সেদিন গৌরব অফিস থেকে ফেরার পর সৃজা চুপ থাকেনি। ভেজা চোখেই গৌরবকে বলেছিল,
——–” এত করে বলার পরও তুমি এলে না আজ! জানো চিরকুটের কতটা খারাপ লেগেছে! মেয়েটা কেঁদেই ফেলেছিল আজ তোমার জন্য। আসলে প্রোগ্রাম দেখতে সবার বাবা মা এসেছিল। শুধু ওরই!”
না, কথাটাকে আর শেষ করতে পারলো না সৃজা। মনে মনে থমকে গেল কেমন। কিন্তু গৌরবের এই মুহূর্তে খারাপ লাগছিল খুব। নিজের ওপরই বিরক্ত লাগছিল যেন। সত্যি, যদি এটা নিজের মেয়ে হতো তাহলে কি প্রোগ্রামে না গিয়ে থাকতে পারতো গৌরব! হাজার কাজ ফেলেও যেত ঠিক। কিন্তু যেহেতু চিরকুটকে ও নিজের ভাবেই না, তাই হঠাৎ ব্যাঙ্কে কাজ চলে আসার পর বেরোনোর চেষ্টা করেনি কোন। কথাগুলো ভেবে ও খুব আস্তে গলায় বললো,
——-” আই অ্যাম সরি সৃজা। আসলে বেরোনোর সময় লাস্ট মোমেন্ট এ এমন কাজ চলে এলো হঠাৎ! হেড অফিসে কয়েকটা আর্জেন্ট মেল করতে হতো ব্যাঙ্ক থেকে। সেইসব করতে গিয়েই আর বেরোতে পারলাম না! ”
কথাগুলো থেমে থেমে বললো গৌরব। কিন্তু এইসব শুনে সৃজা ভীষণ স্থিরভাবেই বললো,
———-” সরি আমাকে না, পারলে চিরকুটকে গিয়ে বলো। তুমি না আসার জন্য ও আজ সব থেকে বেশি হার্ট হয়েছে। ”
কথাটা শেষ করেই সৃজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আসলে এই সময় গৌরবের মুখোমুখি থাকতেও ইচ্ছে করছে না ঠিক। তবে সেদিন গৌরব বুঝেছিল ও নিজের অজান্তেই ওই বাচ্চা মেয়েটাকে খুব হার্ট করে ফেলছে খুব। গৌরব ওকে মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি এটাতে তো চিরকুটের কোন দোষ নেই! ওই ছোট্ট সাড়ে চার বছরের মেয়েটা তো এত জটিলতা বোঝে না মনের। ও তো গৌরবকেই নিজের বাবা ভাবে। কথাগুলো ভেবে সেদিন রাতে একটা চকলেট হাতে গৌরব গেছিল চিরকুটের কাছে। ও তখন এক মন দিয়ে নিজের পুতুলের চুল বাঁধতে ব্যাস্ত ছিল। সেই সময় গৌরব ওর পাশে বসে বলেছিল,
——–” আই অ্যাম সরি.. আজ আমি আসতে পারিনি স্কুলে। ভুল হয়ে গেছে আমার। আমি কান ধরে সরি বলছি এর জন্য। ”
কথাটা বলে গৌরব চিরকুটের সামনে নিজের কানে হাত দিয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে। চিরকুট এই সময়ে একটু আনমনে বললো,
——” কান তো আমি আর আমার ফ্রেন্ডসরা ধরি ভুল করলে বাবি। তুমি তো বড়। তুমি কেন ধরছো কান!”
কথাটা শুনে গৌরব খুব সহজ হয়ে বললো,
——” বড় তো কি হয়েছে! ভুল করলে বড়োদেরও কান ধরা উচিত। ”
কথাটায় চিরকুট একটু সময় নিয়ে বললো,
——–” আজ সবার বাবা এসেছিল ফাংশনে। শুধু আমারই! ”
কথাটা বলতে বলতে চিরকুট কেমন নিজের মনে চুপ করে গেল। সেই সময় গৌরব আর চুপ না থেকে ওর হাতে চকলেটটা দিয়ে বললো,
———” আই এম রিয়ালি সরি বেবি.. সত্যি সরি.. তবে আমি মায়ের কাছে শুনেছি তুমি কত ভালো ডান্স পারফরমেন্স করেছো! এই জন্য আমি তোমার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছি। দ্যাখো। ”
এই সময় চকলেটটা পেয়ে চিরকুট আর মুখ ভার করে থাকতে পারলো না কিছুতেই! এক গাল হেসে আলতো স্বরে বলে উঠলো ও,
——–” কিটক্যাট! এটা তো আমার খুব ভালো লাগে! থ্যাঙ্ক ইউ বাবি..কিন্তু এরপরের বার প্রোগ্রামে তুমি যাবে আমার সাথে স্কুলে। প্রমিজ করো? ”
কথাটায় গৌরব এবার নিজেও আলতো হেসে বললো,
——-” প্রমিজ.. নেক্সট বার আর মিস হবে না। নিশ্চয়ই যাবো। ”
এটা শুনে চিরকুট এবার আনন্দে জড়িয়ে ধরলো গৌরবকে সেই মুহূর্তে। আসলে বাচ্চাদের মন তো এরকমই হয়! অনেকটা পাহাড়ি আকাশের মতন। এই মেঘে ঢাকা, তো এই রোদ ঝলমলে!
কিন্তু সেদিন এই দৃশ্যটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সৃজা, আর মনে মনে স্বস্তি পেয়েছিল একটা। যাক, গৌরব চিরকুটের ভালো খারাপ লাগা নিয়ে কিছু তো ভাবলো! এই একটা চকলেটই মেয়েটার মন খারাপটাকে দূর করে দিল এক সেকেন্ডে। ভেবে ভালো লাগলো বেশ।
( চলবে)