#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৫
_____________
মিতুলের মুখ দেখে জোহানের দুশ্চিন্তা হলো। হঠাৎ করে মিতুলের মুখ এমন হয়ে গেল কেন? আর মমই বা কী বললো ব্রাদার, মিতুলকে নিয়ে?
মমের বলা বাংলা থেকে জোহান শুধু তিনটা শব্দই ধরতে পেরেছে। তা হলো, জায়িন, মিতুল এবং ঘর। জোহান আশঙ্কা করলো মম যাই বলুক না কেন, ভালো কিছু বলেনি। ভালো কিছু বললে মিতুলের চাহনি, চেহারা এমন হতো না। জোহান ওর পাশে থাকা নাবিলের দিকে কিছুটা মুখ এগিয়ে নিয়ে, আস্তে করে বললো,
“কী নিয়ে কথা হচ্ছে? ব্রাদার, মিতুল…কী বললো আমার মম?”
রেশমীর কথা শুনে নাবিল, মিলানও বিস্মিত। হঠাৎ করেই শুনলো এমন কিছু।
নাবিল নিজের বিস্ময়াভিভূত ভাবকে কিছুটা সামলে নিয়ে জোহানকে ইংলিশে বুঝিয়ে বললো,
“তোমার মম তোমার ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা বলছে।”
নাবিলও জোহানের মতো নিচু স্বরেই বললো কথাটা।
জোহানের স্বাভাবিক চোখ জোড়া হঠাৎ জ্বলে উঠলো। জোহান চকিতে মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুল এখনও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সেই আগের মতো। জোহান মিতুলের থেকে চোখ সরিয়ে মমের উপর দৃষ্টি ফেললো।
মমের মুখে মিটিমিটি হাসি। জোহানের চোখ মমের পাশে ব্রাদারের উপরও পড়লো। ব্রাদারের চেহারা একেবারে স্বাভাবিক। কোনো বিস্ময়ের ছাপ নেই।
জোহানের ভিতরটা হঠাৎ ক্রোধে জ্বলে উঠলো। আর নিশ্চুপ, স্থির বসে থাকতে পারলো না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বেশ জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ে মানে? এটা কোন ধরণের মজা চলছে এখানে? হঠাৎ করে ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা কোত্থেকে, কীভাবে উঠলো? যেখানে মিতুলের বিয়ের কথা হবে আমার সাথে, সেখানে ব্রাদার…কী করে সম্ভব এটা?”
লিভিং রুমে উপস্থিত থাকা সবার মুখ বিস্ময়ের কালো ছায়ায় ঢেকে গেল। রেশমীর কথা শুনে মিতুল এবং জোহান যতটা না অবাক হয়েছে, জোহানের কথা শুনে এবার তার থেকে অনেক বেশি অবাক হলো ওদের ফ্যামিলি।
রেশমী তো বিস্ময়ের ঘোরে দাঁড়িয়েই গেলেন,
“হোয়াট?”
মিতুলের ভিতর ভয়ের দানা ক্রমশ আরও দলা পাকিয়ে উঠছে। ভয়ে হাত, পা সব কাঁপছে ওর।
রেশমী বিস্ময়, অবিশ্বাসের জাল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইমাত্র ভুল শুনলেন মনে হচ্ছে। কিন্তু যা শুনলেন সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তার ছেলে ঠিক এই কথাটাই বলেছে। রেশমীর মন মানতে চাইছে না এটা। সে জানে জোহান এমন মজা করার ছেলে নয়। যেটা বলেছে সেটা সিরিয়াস। তারপরও তিনি মনকে বৃথা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
“দেখো জোহান, এমন একটা মুহূর্তে মজা করো না তুমি। এটা একটা সিরিয়াস বিষয়। পাগলামো করো না এখানে।”
জোহান অশান্ত গলায় বললো,
“পাগলামো? কে পাগলামো করছে? আমিও খুব সিরিয়াস হয়ে এই কথাগুলো বলছি মম। হঠাৎ করে কীভাবে ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা উঠতে পারে? ইট’স ইম্পসিবল! মিতুল আমার। ওর বিয়ে হলে আমার সাথে হবে। সেখানে তুমি ব্রাদারের সাথে ওর বিয়ের কথা বলছো কীভাবে?”
জোহানের কথায় লিভিং রুমে উপস্থিত সবাই আগের থেকে আরও বেশি চমকিত হলো। মাহিরা এবং নাহিদ তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতুলের দিকেও তাকাচ্ছে বার বার।
মিতুল উপলব্ধি করতে পারছে মা, বাবার দৃষ্টি ওর উপর এসে পড়ছে। কিন্তু নিজের একবার তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না।
রেশমীর স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে ছেলের কথায়। এসব কী শুনছে?
“তোমার কি মাথা ঠিক আছে? এসব কী বলছো তুমি?”
জোহান গলার স্বর আরও উচ্চ করে বললো,
“অবশ্যই আমার মাথা ঠিক আছে। মাথা তো খারাপ হয়েছে তোমাদের। কী করে তোমরা ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা ভাবতে পারলে? মিতুলকে ভালোবাসলাম আমি, অথচ বিয়ের কথা উঠলো ব্রাদারের সাথে? কী করে? হঠাৎ করে ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ের কথা ওঠার মানে কী? আমার চোখে তো কোনো মানেই ধরা দিচ্ছে না। কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মিতুলকে আমি ভালোবাসি, বিয়ে হবে আমার সাথে। এখানে ব্রাদার আসতে পারে না।”
রেশমীর সর্বাঙ্গে রাগ ছড়িয়ে পড়ছে। হাত মুঠো হয়ে আসছে রাগে। তিনিও চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
“অনেক হয়েছে জোহান। অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছো তুমি! নিজের উশৃঙ্খলতা আর দেখিও না এখানে।”
“আর কত মম? যখন যেটা করি সেটাই তোমার কাছে উশৃঙ্খলতা মনে হয়? এটা মোটেও উশৃঙ্খলতা নয়। আমি শুধু তোমাদের ভুলটা দেখিয়ে দিচ্ছি। মিতুলের সাথে ব্রাদারের বিয়ের কথা বলা তোমার ভুল হয়েছে। ব্রাদারের সাথে নয়, মিতুলের বিয়ে আমার সাথে হওয়া উচিত। বিকজ, আই লাভ হার!”
মিতুলের ফ্যামিলির প্রত্যেকে ঘোর বিস্ময়ে ডুবে আছে। এখানের কথাবার্তা সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে যেন। মাহিরা মিতুলের দিকে তাকালেন আবার। মিতুল মাথা নুইয়ে বসে আছে। মুখ তোলেনি একবারও।
লিভিং রুমে উপস্থিত সবার মাঝে বিস্ময়, উত্তেজনা থাকলেও জায়িনকে এর মাঝে খুবই শান্ত দেখালো। ও খুবই স্বাভাবিক। ও যে আগে থেকেই জানতো এমন হবে।
রেশমী এবার কিছু বললেন না জোহানকে, শুধু রাগে ফুঁসলেন।
জোহান রাগের মাঝেও নিজেকে শান্ত রেখে, শান্ত কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো,
“আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা তোমরা আগে থেকে জানতে না। আমি জানাতে চেয়েছিলাম খুব শীঘ্রই। মিতুলদের বাসায় থাকাকালীনই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল! যাক কোনো ব্যাপার না। তোমরা আগে জানতে না, এখন তো জানো। সুতরাং ব্রাদারের সাথে নয়, আমার সাথে মিতুলের বিয়ে ঠিক করো।”
রেশমী নিজের রাগ আর ধরে রাখতে পারছেন না। তিনি তারস্বরে বলে উঠলেন,
“অসম্ভব! ভুলে যাও ওসব। এমনটা কখনোই হবে না।”
জোহান কষ্ট করে যে শান্ত ভাব ধরে রেখেছিল নিজের মাঝে, আর সেটা পারলো না। বরং ওর রাগ আরও বেড়ে গেল। মমের মতোই তারস্বরে বললো,
“এমনটা কখনো হবে না কেন? সবটা জানার পরও কীভাবে এমন করতে পারো?”
“তোমার ওসব মানি না আমি। তোমার পাগলামির ভালোবাসায় কারো কিছু যায় আসে না।”
মমের কথায় হেসে উঠলো জোহান। শ্লেষপূর্ণ হাসি। বললো,
“এটাকে তোমার পাগলামির ভালোবাসা মনে হয় মম?”
জোহান মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুল এখনও মাথা নুইয়ে বসে আছে।
জোহান মিতুলের দিকে এগিয়ে এলো। কাছে এসে মিতুলের হাত ধরে দাঁড় করালো মিতুলকে।
আকস্মিক এমন ঘটনায় মিতুল আঁতকে উঠলো। তাকাতে না চাইলেও একবার চোখ পড়লো সবার উপর। মা, আব্বুর কঠিন মুখ দেখে ভয়ে মিইয়ে গেল মন। মা, আব্বুর কঠিন মুখে তাকানোর সাহস যে ওর নেই। মিতুল দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। ঢোক গিললো ভয়ে। বুক ধুকপুক করছে।
জোহান মিতুলের হাত ছাড়লো না। হাত ধরে রেখেই বললো,
“মিতুল, বলো সবাইকে, এটা কি আমাদের পাগলামির ভালোবাসা?”
মিতুল কী বলবে? ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। চোখ নিচু করে রাখা এবং ভয়ার্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। এতটাই ভয় করছে যে কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
জোহান মিতুলকে নিশ্চুপ দেখে ধরে রাখা হাতটায় মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বললো,
“মিতুল, বলে দাও তুমিও।”
মিতুল আবারও আঁতকে উঠলো। চোখ পড়ে গেল জোহানের চোখে।
জোহানের চোখে উত্তেজনা, কষ্ট, রাগ, ভয় সবকিছুর সংমিশ্রণ। সেই সাথে গভীর ভালোবাসা এবং ভরসাও দেখতে পেল চোখ দুটোতে। এই বাদামি চোখ জোড়ায় মিতুল এর আগে এতকিছু দেখেনি। এত কিছু দেখতেও চায়নি। যা দেখতে চেয়েছিল তা কেবল, আনন্দ, চঞ্চলতা আর ওর জন্য গভীর ভালোবাসা। আজ কেন এতকিছু দেখতে হচ্ছে?
মিতুল নিজের চোখে কিছুই দেখাতে পারলো না। জোহান ওর চোখে যেটা দেখতে পাবে, সেটা হলো শুধু ভয়।
জোহান মিতুলের চোখ পড়তে পারলো,
বুঝতে পারলো মিতুল কিছুই বলতে পারবে না। জোহান বললো,
“ঠিক আছে, তোমাকে বলতে হবে না।”
জোহান আবারও লিভিং রুমের সবার দিকে তাকালো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“আমরা একে অপরকে খুব করে ভালোবাসি। এ ভালোবাসার শুরুটা ছিল মিতুল কানাডা থাকতেই। আমরা দুজন রিলেশনশিপে আছি দীর্ঘ সময় ধরে। এটা শুধু নামেই রিলেশনশিপ নয়, আমরা বিয়েও করবো। আমি মমের কাছে এটা জানাতে চেয়েছিলাম। হয়তো আমাদেরই ভুল ছিল। আমরা জানাতে বেশি সময় নিয়েছি। কিন্তু এখন তো তোমরা সবটা জানলে। যেখানে মিতুল আমাকে ভালোবাসে, সেখানে আমার ব্রাদারকে বিয়ে করবে কীভাবে? মিতুল যাকে বিয়ে করবে সেটা আমি। ও শুধু আমাকেই ভালোবাসবে।
ব্রাদার নয়, আমার আর মিতুলের বিয়ের বন্দোবস্ত করো। সিনক্রিয়েট করো না আর।”
জোহানের কথার পর পরিবেশটা খুব নীরব হয়ে গেল। কেউ কিছু বললো না।
মাহিরা উঠে এলো মিতুলের কাছে। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“জোহান যা বললো তা কি সত্যি? তোমরা দুজন দীর্ঘ সময় ধরে রিলেশনশিপে আছো?”
মায়ের প্রশ্ন মিতুলকে আরও ভীত করে দিলো। বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটার শব্দটা আরও ভারী হলো। মিতুল মায়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ভয় গলা থেকে স্বর কেড়ে নিয়েছে। মিতুল শুধু মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
মাহিরা এর মাঝেই মিতুলকে এক হাত ধরে টেনে নিজের দিকে ফেরালো।
মিতুলের হৃদয়ে যেন বজ্রপাতের ঝমকা লাগলো। হাত পায়ের কাঁপন বেড়ে গেল। মাহিরার গলা কঠিন হলো,
“কিছু বলছো না কেন? যা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দাও। জোহান যা বললো তা সত্যি কি না?”
মিতুল কিছু বললো না। নিচের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
রেশমী জোহানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“মিতুল কানাডা থাকতে তোমাদের ভালোবাসার শুরু হয়েছিল। আর মিতুল কানাডা যাওয়ার আগে থেকেই আমি মিতুলকে জায়িনের বউ করবো ভেবে রেখেছিলাম। যদিও তখন এই ব্যাপারটা অতটা সিরিয়াস ছিল না। এ ব্যাপারে মাহিরার সাথে তখন আমার টুকটাক কথা হয়েছিল। মিতুলকে কানাডা ঘুরতে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, যাতে জায়িনের সাথে ওর চেনা পরিচয় হয়, আমাদের ফ্যামিলিকে ভালো করে চিনতে পারে, জানতে পারে, আমাদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে নিজেকে।
নাহিদ ভাই ওকে একা একটি মেয়েকে কানাডা ছাড়তে নারাজ ছিলেন। আমি অনেক বুঝিয়ে, ভরসা দিয়ে তাকে রাজি করিয়েছি। এসবের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? জায়িন এবং মিতুলের বিয়েটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।”
মিতুলের এতক্ষণ শুধু ভয় ছিল। ভয়ের সাথে এবার জন্ম নিলো রাগ আর ঘৃণাও। কানাডা ঘুরতে যাওয়া অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল ওর। আজ যাক, কাল যাক যেতই কানাডা। কিন্তু মা যখন ওর স্বপ্নটা অল্পতেই পূরণ দিয়েছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ওর স্বপ্ন পূরণের পিছনে এসব ছিল। ও জানতো, মা ওর স্বপ্ন পূরণ করছে। কিন্তু যদি জানতো কানাডা পাঠানোর পিছনে আসলে এসব গল্প আছে, তাহলে হয়তো কানাডা যাওয়া হতো না।
মা, আব্বু কী করে পারলো ওকে কিছু না জানিয়ে, ওর মতামত না নিয়ে এতদূর এগিয়ে যেতে? কেন জানালো না? আর কেনই বা এখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? এ ভুল কার? ওর আর জোহানের? না কি তাদের? কার ভুলের জন্য কাকে মাশুল গুনতে হবে এখন?
জোহানের কষ্ট হচ্ছে। গলা থেমে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি ঠিক না বানিয়ে, সবার ভুল না শুধরিয়ে ও থামবে না।
“মম, এই ভুলটা কার ছিল? ভুলটা কি তোমাদের ছিল না? তোমরা কি একবারের জন্যও জানিয়েছিলে ব্রাদারের সাথে মিতুলের বিয়ে ঠিক করে রেখেছো? জানাওনি।
তোমাদের ভুলের জন্য তো আমরা শাস্তি পেতে পারি না।”
রেশমী বললেন,
“হ্যাঁ, ভুলটা আমাদেরই। তোমাদের সবাইকে আগেই জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।
আমরা জায়িন আর মিতুলের বিয়ের ব্যাপারটা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছিলাম। সারপ্রাইজটা তোমাদের উদ্দেশ্যেই ছিল। কিন্তু যদি জানতাম এই সারপ্রাইজ রাখতে গিয়ে এমন কিছু হবে, তাহলে আগেই জানিয়ে দিতাম। আমার তো ধারণাতেই ছিল না তোমার আর মিতুলের মাঝে এমন কিছু হতে পারে। হ্যাঁ, দেখতাম, জানতাম তোমরা দুজন একটু বেশিই ঘোরাঘুরি করতে এক সাথে। কিন্তু তোমাদের মাঝে এমন কিছু হতে পারে সত্যিই ভাবিনি আমি। আমার মাথায় ছিল শুধু জায়িন এবং মিতুল। তাই তোমার ব্যাপারটা অতটা খেয়াল করিনি। আর এই খেয়াল না করার জন্যই তোমরা এতদূর চলে গিয়েছো। আমি চাই না এটা আর এতটুকু সামনে আগাক। তোমাদের দুজনের এই ব্যাপারটা এখানেই থামিয়ে দাও। তোমরা যেটাকে ভালোবাসা বলছো, ওটাকে ভালোবাসা বলে না। ওটা ছেলেমানুষি। আবেগে বশীভূত হয়ে আছো তোমরা। ওটা অল্পতেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে নড়বো না। জায়িনের সাথেই মিতুলের বিয়ে হবে। তোমরা তোমাদের মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে দাও। রিল্যাক্স, ফ্রেশ মুডে চলে আসো। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো, দেখবে সব ঠিকঠাক লাগবে।”
“তোমরা তোমাদের এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারো না! এ বিয়ে হতে পারে না, এ বিয়ে হতে দেবো না আমি।”
তীব্র রাগের সাথে কথা গুলো বলেই জোহান ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া দিলো।
কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে আবার থামলো। পিছন ফিরে সরাসরি মিতুলের দিকে তাকালো। মৃদু কণ্ঠে বললো,
“হেই মিতুল, মুখটা এমন করে রেখেছো কেন? কী ভাবছো এত? তুমি সবসময়ই আমার থাকবে। তুমি তো কেবল আমারই লিটল এঞ্জেল!”
জোহান আর দাঁড়ালো না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
এমন একটা মুহূর্তেও জোহানের কথা শুনে হৃদয়ে শুভ্র অনুভূতির পরশ অনুভব করলো মিতুল। মনে মনে জোহানের কথার প্রতিউত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, তোমার লিটল এঞ্জেল সবসময় তোমারই থাকবে!”
মিতুল দরজা থেকে চোখ সরিয়ে এনে সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। তারপর বললো,
“তোমরা ঠিক করছো না এটা।”
মাহিরা এতক্ষণ খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে সবকিছু শুনছিল। মেয়ের কথা শুনে সেটা আর পারলেন না। তার রাগ আর বাধ মানলো না। শক্ত করে চেপে ধরলো মিতুলের হাত। লিভিং রুম থেকে টেনে নিয়ে গেলেন মিতুলকে।
(চলবে)
#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৬
____________
মাহিরা মিতুলকে টেনে নিয়ে এসে, রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।
“জোহান যে কথাগুলো বলে গেল তা কি সত্যি? তুমি ভালোবাসো জোহানকে?”
মাহিরার কণ্ঠ ধীরে ধীরে আরও রুক্ষ হয়ে উঠছে।
মিতুলের মাঝে ভীতি ছায়া ছেয়ে আছে। মিতুল নিজের ভীতি, ভয়কে বাধ মানিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ।”
মেয়ের কথা শুনে মাহিরা জোরে একটা চড় মারলেন মিতুলকে। মিতুলের মুখ হেলে যায় অন্যদিকে। সেই সাথে চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুজল।
মাহিরা আক্রোশ পূর্ণ গলায় বললেন,
“এসবের জন্য কানাডা পাঠিয়েছিলাম তোমাকে? আমাদের মান সম্মান কিছু রাখলে না তুমি! সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো একেবারে। কানাডা গিয়ে প্রেম, ভালোবাসা করে বেড়িয়েছো? দীর্ঘ রিলেশনশিপ তোমাদের?”
মিতুল কাঁদছে। দু চোখ দিয়ে অনবরত ঝরছে অশ্রুধারা। বুকের ভিতর কষ্টে সব তিক্ত হয়ে যাচ্ছে। মিতুল নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। অশ্রুনির্গত চোখে মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। ভয় ভুলে গেল বেমালুম। অভিমান জর্জরিত রাগি, তিক্ত গলায় প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কী ভুল? জোহানকে ভালোবাসলে কী ভুল? হ্যাঁ আমি জোহানকে খুব বেশি ভালোবাসি। কানাডা গিয়ে প্রেম করে বেড়িয়েছি ওর সাথে। কী হয়েছে তাতে? তোমরা কি আগে থেকে বলে দিয়েছিলে কাউকে ভালোবাসা যাবে না, কারো সাথে রিলেশনে জড়ানো যাবে না? বলোনি তো। তাহলে এখন এত কী সমস্যা? আমি জোহানকে ভালোবাসি তাতে এত কী সমস্যা তোমাদের?”
মিতুল কথা বলা শেষ করতেই মাহিরা আরও জোরালো একটা চড় মারলেন মিতুলকে। মিতুলের গাল কিছুটা রক্তিম হয়ে গেল।
“তোমার এত অধঃপতন হয়েছে? তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো? ভুলে গেছো সব শিক্ষা দীক্ষা? এতকাল কী শেখালাম তোমায়?”
মিতুল চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে। দু চোখ অশ্রুসিক্ত, লাল। মায়ের মুখে রাগের প্রতিফলন মিতুলের অতটা ভয় লাগলো না আর। ভয়ডর সব ভুলে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“জোহানকে ভালোবাসলে যদি এতই সমস্যা হবে তোমাদের, তাহলে আগে কেন বলোনি? আগেই বলে দিতে কাউকে ভালোবাসা যাবে না, কারো প্রেমে পড়া যাবে না। বলোনি কেন? আর জায়িনের সাথে যে আমায় বিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা আগে থেকেই করে রেখেছো, সেটাই বা কেন জানাওনি? কানাডা যাওয়ার আগেই জানাতে এটা। তাহলে জোহানকে ভালো না বাসার যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম আমি। যেহেতু জানাওনি এই ভুলটা তোমাদের। আমার অথবা জোহানের নয়। আমাকে কিছু না জানিয়ে, আমার মতামত না নিয়ে হুট করে জায়িনের সাথে বিয়ের কথা বললেই তো আমি জায়িনকে বিয়ে করে নেবো না। আমি জোহানকে ভালোবাসি। ওর সাথেই বিয়ে হবে আমার।”
মাহিরা চাপা গর্জন করে ডেকে উঠলো,
“মিতুল!”
মিতুল আগের মতোই বললো,
“বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো।”
মাহিরার চোখে রাগের পাশাপাশি, অবিশ্বাসের ঘোরও লেগে আছে। তার মেয়ে তার মুখের উপর এরকম কথা বলতে পারে তা তার ধারণার বাইরে।
______________
“জায়িন, তোমার ভাই এসব কী বলে গেল? আমার তো পাগল পাগল ফিল হচ্ছে। কী বলে গেল ও এসব?”
রেশমী এখনও বিস্ময়ের জাল চিরে বেরোতে পারেননি।
জায়িন মমের হাত ধরে মমকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বললো,
“মম, কুল ডাউন!”
রেশমী শান্ত হতে পারলেন না। তার মুখ থামলেও, ভিতরের অস্থিরতা রয়ে গেল। এমন কিছু হতে পারে এটা আসলেই কল্পনাতে ছিল না তার। জোহান এবং মিতুলের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা সম্পর্কিত কিছু সৃষ্টি হতে পারে কখনো ভাবেননি তিনি। একসাথে মিতুল, জোহানকে ঘুরতে দেখেছে অনেক। তার খারাপ লাগতো জোহানের সাথে মিতুলের এত ঘোরাঘুরি। তাই বলে সেই খারাপ লাগাটা এমন ছিল না। তিনি মিতুলকে বেশিরভাগ সময় জায়িনের সাথে দেখতে চাইতেন। কিন্তু মিতুল জায়িনের সাথে বেশি সময় না কাটিয়ে, জোহানের সাথে থাকতো। এই ব্যাপারটা খারাপ লাগতো তার। তিনি মিতুলকে জায়িনের সাথে দেখতে চাইতেন। মিতুল জায়িনের সাথে বেশি কথা বলছে কি না, ঘুরছে কি না এসব যাচাই করতে গিয়ে, ওদিকে মিতুল এবং জোহানের মাঝে যে এমন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে সেদিকে একদম খেয়াল করেনি তিনি। তার মাথায় সবসময় ছিল জায়িন, মিতুল। আর তাছাড়া জোহানের যে মিতুলকে ভালো লাগতে পারে এমনটাও ভাবতে পারেনি। জোহান যেমন ছেলে, এত এত সুন্দরী মেয়ে ফ্রেন্ড যার, সে হঠাৎ মিতুলের প্রেমে পড়বে এটা ভাবাও যে একটু কষ্টকর। কিন্তু এই কষ্টকর জিনিসটাই একেবারে আসল কষ্ট হিসেবে এসে দাঁড়ালো। এখন এই ঝামেলার সমাপ্তি কী করে ঘটবে, সেটা সত্যিই বুঝতে পারছেন না। যে মেয়েকে বড়ো ছেলের বউ করে নেবে ভেবেছে, সেই মেয়েকে ছোট ছেলের বউ করে নেওয়াটা একেবারেই অসম্ভব! মিতুলের বিয়ে হলে জায়িনের সাথেই হবে।
লিভিং রুমে রেশমী, জায়িনের পাশাপাশি নাহিদ সাহেব, মিলান এবং নাবিলও এখন পর্যন্ত উপস্থিত। মিলান, নাবিল এখনও বাকরুদ্ধ হয়ে আছে।
নাহিদ সাহেবের মাথায় পুরো ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কাউকে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
মাহিরা যে মিতুলকে ওভাবে টেনে নিয়ে গেল সেদিকে হয়তো বিমূঢ়তায় কারো কোনো খেয়াল নেই। নাহিদ সাহেবের আছে। তিনি এখান থেকে এখন ওঠার তাগিদ অনুভব করলেন। আগে তার মেয়ের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা দেখা দরকার। নাহিদ সাহেব বসা থেকে উঠে ভিতরের দিকে গেলেন।
_____________
“তোমার মতো মেয়ের জন্য এমন একটা দিন দেখতে হবে ভাবিনি আমি। নম্র, ভদ্র একটা মেয়ে তৈরি করতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু তুমি ধীরে ধীরে একটা বেয়াদব হয়ে উঠলে!”
মাহিরার কথার মাঝেই দরজায় করাঘাত ও সেই সাথে নাহিদ সাহেবের গলা শোনা গেল,
“মাহিরা দরজা খোলো।”
বাবার উপস্থিতিতে মিতুলের হৃদপিণ্ডে ভয়ের ঝাপটা লাগলো আবারও।
মাহিরা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
নাহিদ সাহেব ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমেই দৃষ্টি ফেললেন মেয়ের উপর। মিতুল চোখ নিচু করে রাখলো। নাহিদ সাহেব এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মিতুলের কাছে। মিতুল ভয়ে ভয়ে আছে। নাহিদ সাহেব অবশেষে নিজের মুখ খুললেন,
“তোমার থেকে এটা মোটেই আশা করিনি।”
আব্বুর কথা বেশ করে লাগলো মিতুলের মনে। ভয় করছে ওর সেটা ঠিক, কিন্তু মুখ বুজে রইল না। ভয় পেয়ে মুখ বুজে থাকলে চলবে না ওর। মিতুল বললো,
“আমার কোনো দোষ নেই। এমনটাই হওয়ার ছিল।”
মাহিরা তেড়ে এলেন,
“কোনটা হওয়ার ছিল? জোহানের সাথে তোমার প্রেম, সেটাই? জোহানের সাথে তোমার প্রেমের বিষয়টা কি সঠিক মনে হচ্ছে? তোমাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম কি প্রেম করে বেড়ানোর জন্য? জোহানের সাথে প্রেম করে বেড়াও তুমি?”
“জোহানের জায়গায় জায়িনের সাথে প্রেম করে বেড়ালে তুমি খুব খুশি হতে, তাই না মা?”
মায়ের কথার প্রতিবন্ধকতা থেকে মিতুলের মুখ থেকে আপনা ভাবেই বেরিয়ে গেল কথাটা।
মাহিরার রক্ত গরম হয়ে গেল। তিনি আবারও মিতুলকে আঘাত করার জন্য এগিয়ে আসতে চাইছিলেন, কিন্তু নাহিদ হাত ধরে থামিয়ে দিলেন।
“মাথা গরম করো না মাহিরা।”
“মাথা গরম করবো না? তোমার মেয়ে যেসব বলছে, আর করছে তাতে মাথা গরম না করে উপায় আছে?”
মাহিরা মিতুলের দিকে তাকালেন,
“শোনো, যদি তুমি ভেবে থাকো ওই বাউন্ডুলে ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে দেবো, তাহলে সেটা ভুল। যে ছেলে মদ খায়, কারো কথা শোনে না, নিজের ইচ্ছা মতো চলে, মায়ের কথার প্রধান্য দেয় না, বেয়াদবি করে, তেমন ছেলের সাথে আমি মেয়ে বিয়ে দেবো না। নিজের চোখেই তো দেখলাম রেশমীর সাথে কেমন বেয়াদবি করলো। একটা কথা শোনানো গেল না ছেলেটাকে। জায়িন সবদিক থেকে পারফেক্ট। জায়িন ম্যাচিউর একটা ছেলে। ভালো জব করে, নম্র-ভদ্র। তোমার চোখে ওকে ভালো না লেগে, জোহানকে ভালো লাগলো?”
মিতুল বলে উঠলো,
“জায়িন ভদ্র না ছাই। আস্ত একটা অহংকারী! আর জায়িন যদি ভদ্র হয়েও থাকে তাহলেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি ওকে নিয়ে ভাবতেও চাই না।”
মেয়ের কথায় নাহিদ সাহেবের রাগ এবার একটু বাড়লো। তিনি বলেই ফেললেন,
“জায়িনকে নিয়ে না ভেবে, জোহানকে নিয়ে ভাবতে চাও?”
আব্বুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সাহস হলো না মিতুলের।
মাহিরা বললেন,
“তুমি বরাবরই বোকা ছিলে, এখনও আছো। তোমাকে সবসময়, সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয়। তুমি বোকামি ছাড়া আর কিছুই পারো না। সবথেকে বেশি বোকামিটা করছো এখন। তোমার এই বোকামির সিদ্ধান্তে সুখী হতে পারবে না কোনো দিন। তাই বোকামি ছাড়ো, সবকিছু ভালোয় ভালোয় মেনে নাও। তোমার যদি বিয়ে হয়, জায়িনের সাথেই হবে। নয়তো জায়িন, জোহান কারোর সাথেই নয়।”
মিতুল মায়ের কথার প্রতিবাদ করে উঠলো,
“অসম্ভব! ওই অহংকারীটাকে বিয়ে করার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারি না।”
“দুঃস্বপ্ন নয়, স্বপ্নেই ভাবতে হবে তোমার। তোমার সকল ভাবনার শেষপ্রান্তে জায়িনই থাকবে।”
মিতুলের কান্না একটু থেমেছিল। মায়ের এত কঠিন কথায় আবারও ঝর ঝর করে কেঁদে দিলো।
“আমি জায়িনকে বিয়ে করলে মরেই যাব। জোহানকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না আমি। জোহান আমার ভালোবাসা।”
নাহিদ সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“এই মেয়ের মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। বোঝাও ওকে, বোঝাও।”
নাহিদ সাহেব আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে চলে গেলেন।
মাহিরা মনোযোগ দিলেন মিতুলের দিকে।
“জোহানের প্রতি তোমার ওই ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। তুমি যেটাকে ভালোবাসা ভাবছো, ওটাকে ভালোবাসা বলে না। আমি রেশমীর সাথে কথা বলছি। তোমার বিয়ে হলে জায়িনের সাথে হবে, নয়তো দুই ভাইয়ের কারো সাথেই নয়। আজকে রাতটা ভাবার সময় দিলাম তোমায়। যত খুশি তত ভাবো। তবে ভাবনার শেষে যেন জোহান না থাকে। জোহানের মতো অমন একটা ছেলেকে নিয়ে তুমি বোকামি করতে পারো, আমরা পারি না। অবুঝ তুমি, আমরা তো নই। যেখানে ওর মা ওকে নিয়ে চিন্তায় থাকে সবসময়, কী হবে ওর, ওর ভবিষ্যৎ কী হবে, কারো কথা শোনে না, নিজের ইচ্ছা মতো চলে, নেশা করে বেড়ায়, সেখানে আমি মেয়ের মা হয়ে কী করে এরকম একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে পারি তোমাকে?
তুমি বুঝতে পারছো না। জোহানকে যদি তুমি বিয়ে করো, তাহলে তোমার জীবনটা কেমন হবে তোমার ধারণা নেই কোনো। তুমি অবুঝ। এসব বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। তাই বলছি, জোহানের চিন্তা বাদ দাও। জোহান তোমার পারফেক্ট নয়। আর যে তোমার পারফেক্ট নয়, তার সাথে তুমি সারাজীবন কাটাতে পারবে না।”
মিতুলের এই মুহূর্তে এতটাই অসহায় লাগলো যে মুখ থেকে একটা শব্দ বের করতে পারলো না। শুধু টলমল চোখে করুণ ভাবে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে।
মাহিরা আর দাঁড়ালেন না চলে গেলেন এখান থেকে।
একা হয়ে মিতুলের মাঝের কান্না সব উগড়ে উঠলো। চাপা একটা ক্রন্দন সুর ছড়িয়ে পড়লো রুমের আনাচে কানাচে। জোহানকে মনে পড়ছে। চিন্তা হচ্ছে জোহানের জন্য। কোথায় চলে গেল জোহান এই রাতে?
মাহিরা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই নাবিল, মিলান মিতুলের রুমে এসে উপস্থিত হলো। এতক্ষণ লিভিং রুমে বলতে গেলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বসে থাকতে হয়েছিল তাদের। রেশমী আন্টি, জায়িন ছিল লিভিং রুমে। অতিথিদের রেখে সবার চলে আসা তো একেবারে বেমামান।
ভাইদের দেখে মিতুলের কান্না যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
নাবিল কাছে এসে মিতুলের পাশে বেডের উপর বসলো। মিলান দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“জোহানকে খুব ভালোবাসিস, তাই না?”
ভাইয়ের প্রশ্নে মিতুলের আরও কান্না পেল, মুখে কিছু বলতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, ‘হ্যাঁ’।
মিলান একটু নিশ্চুপ থাকলো। তারপর বললো,
“কাঁদছিস কেন এভাবে? কী হয়েছে যে তোর এমন ভাবে কাঁদতে হবে? কান্না থামা বলছি।”
আদেশের সুরে বলে উঠলো মিলান।
কিন্তু মিতুলের সেই আদেশ মানার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। ওর কান্না অব্যাহত। মিলান কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বোনের এমন কান্না দেখে নিজের ভিতরটাও কেমন কেঁদে উঠছে।
নাবিল মিতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আশ্বাস দিলো,
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
_______________
রেশমী খুব টেনশনে আছে। জোহান কল রিসিভ করছে না। এই সময় তার দরকার জোহানকে, অথচ জোহানের কোনো খবরই নেই। কোথায় গেছে জোহান? কোনো কিছু মীমাংসা হতে পারলো না, বোঝাতে পারলো না কিছু জোহানকে, মাঝপথে চলে গেল জোহান। কোথায় গেছে তারও কোনো খোঁজ নেই। এমনিতেই বাংলাদেশ এসে একা একা চলতে পারে না, বাংলা বোঝে না। এরকম করে কোথায় চলে গেল?
বাড়িতে চলে যায়নি তো আবার? রেশমীর মাথায় এতক্ষণ এই কথাটা আসেনি। জোহান দাদা বাড়ি চলে যেতে পারে। সত্যিই যদি এখন দাদা বাড়ি যায়, আর এখানের ঘটনা সব জানিয়ে দেয় নিজের দাদিকে, তাহলে এই ঝামেলা তো কমবেই না বরং আরও বাড়বে। এই ঝামেলা সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়বে তখন। তার শাশুড়ি মা তো নাতি ছাড়া কিছু বোঝেন না। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সেটা না ভেবেই নাতির টানই টানবেন।
আর যদি যেতে পারে একটু জোহানের নানার কানে, তাহলে তো আরও। সবাই মিলে ভুলটা বেছে নিতে পারবে ভালো করে। সঠিকটা তাদের চোখেই পড়বে না।
রেশমী আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত শাশুড়ি মা’র কাছে ফোন করলেন। কয়েকটা রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো।
রেশমী শাশুড়ি মা’র কাছে থেকে জানলেন, জোহান এখন নেই ওর দাদা বাড়ি। যায়নি সেখানে। দাদা বাড়ি না থাকলে এখন কোথায় জোহান?
_______________
জোহানের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে মিতুল। কিন্তু জোহান আর ফেরেনি।
মোবাইল নিয়ে বসে থেকেছে। জোহানের একটা কল অথবা ম্যাসেজ আসেনি। নিজে কল দিয়েছিল, কিন্তু জোহান কল রিসিভ করেনি। ম্যাসেজও দিয়েছে, কিন্তু সিন হয়নি। জোহানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মিতুলের চোখে ঘুম নেমে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে মিতুল। তবে ঘুমটা অতটা জোরালো নয়। ভাসা ভাসা। আর এই ভাসা ভাসা ঘুমের কারণেই কপালে কিছুর স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল ওর।
আচমকাই বন্ধ চোখের পাতা খুলে যায়। চোখে আবছা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না মিতুল। তবে অনুভব করতে পারলো কেউ একজন ওর মাথায় হাত রেখেছে। মিতুলের হঠাৎই মনে হলো এই হাত জায়িনের! মিতুল কপালে থাকা হাতটা ছিটকিয়ে সরিয়ে দিয়ে, ধরফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে দূরে সরে গেল। আতঙ্কে হাত পা জমে গেল ওর। একটুতেই শরীর ঘেমে একাকার।
(চলবে)