চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-২+৩

0
537

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০২
_____________

রেশমী আন্টিদের বাড়ির পিছনে যে এত সুন্দর গার্ডেন আছে সেটা আগে দেখেনি মিতুল। ফ্রেশ হয়ে হলরুমে নামার পর ব্যাক ডোরে চোখ পড়তে কী ভেবেই যেন বের হয়েছিল। বের হয়ে যা দেখলো তাতে মন অনেকখানি ভালো হয়ে গেছে। গার্ডেনের বেশির ভাগ জায়গাই ফুল গাছে ভরা। বসন্ত তাই সব গাছেই ফুল ধরে আছে। অনেক ফুলের নাম অজানা মিতুলের।
গার্ডেনে আছে অনেক ফল ও শাক-সবজির গাছও। আপেল, স্ট্রবেরি, চেরি, কমলা, আঙ্গুর, গাজর, আনারস, লেবু, বাঁধাকপি, লেটুস, পালং, সুইস চার্ড আরও কত কী। ওদিকে গার্ডেনের শেষ প্রান্তে বড়ো একটা পাইন গাছের ডালে দড়িতে এক টুকরো কাঠ ঝুলছে। দোলনাটা অনেক আগের তৈরি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে আবার দোলনায় দোল খায় কে?
গার্ডেনের পিছন দিকটা ঝংলা টাইপের। বিশাল জঙ্গল বোধহয়। একটা সরু রাস্তার মতো দেখা যাচ্ছে। যেটা সোজা জঙ্গলের অন্ধকার রাজ্যের দিকে চলে গেছে। মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাস্তাটার দিকে। ওই জঙ্গলের মধ্যে মানুষ যায়?
রেশমী আন্টির ডাক কানে এলো। সম্ভবত ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাকছেন। মিতুল ঘরে চলে এলো। ডাইনিং রুমে রেশমী আন্টি বসে আছেন। মিতুলকে দেখে হাসলেন তিনি। মিতুলও হাসলো মৃদু। রেশমী আন্টি অহংকারী হলেও তার হাসিটা বরাবরই প্রাণবন্ত মনে হয়। ওই হাসিতে কোনো অহংকারের ছোঁয়া নেই।

ক্যামিলা খাবার রাখছে টেবিলে। ব্রেড, জ্যাম, কফি, কেক, দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরণের পানীয় এবং স্পেশাল একটা খাবার। স্পেশাল খাবারটির নাম জানা নেই মিতুলের। এর আগে দেখেনি কখনও। দেখে অনেক সুস্বাদু মনে হচ্ছে।
মিতুল রেশমী আন্টির সাথে ব্রেকফাস্ট সারতে লাগলো। আর কাউকে দেখা গেল না ডাইনিং রুমে। মিতুল একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, এই বাড়ির কারোর খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই। যার যে সময় ইচ্ছা, সে সেই সময় খায়। এক সাথে বসে খায় না সবাই। যেমন, আজকে সকালের মতোই কালকে রাতে ডিনারের সময় ডাইনিং টেবিলে কেবল ও আর রেশমী আন্টিই ছিল। বাকিরা হয় আগে খেয়েছে, নয়তো পরে।

রেশমী খাওয়ার এক পর্যায়ে বললেন,
“ভাবছি, আজকে তোমায় নিয়ে ঘুরতে বের হবো। গত কালকে জার্নি করে এসেছিলে, ভাবছিলাম রেস্টে থাকো। আজকে বের হবো বাইরে। ব্রেকফাস্ট শেষে রেডি হয়ে থেকো।”

মিতুলের মন ভালো হয়ে গেল। আনন্দ হাওয়া বইল মনে। এটাই তো চায়। কানাডা এসেছে কি ঘরে বসে থাকার জন্য? ঘুরে বেড়াবে বলেই তো এসেছে। মিতুল নিজের উত্তেজনা, উদ্দীপনা চেপে রেখে, ভদ্র কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে।”

মিতুল হোয়াইট কালারের কাপড়ের উপর হোয়াইট সুতোর এমব্রয়ডারি করা একটা শর্ট টপস এবং নেভি ব্লু রঙের জিন্স পরলো। আর গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিলো। চুলগুলো খোলা রেখেছে। মিতুলের চুল তেমন লম্বা নয়। চুলগুলো কোনো রকম কাঁধ বেয়ে একটু নিচে নেমেছে। ইচ্ছা করেই চুল লম্বা রাখে না। লম্বা চুল ভালো লাগে না ওর।
মিতুল নতুন কেনা এক জোড়া বুট পায়ে দিয়ে, কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আসার সময় ওর রুম থেকে একটা রুম রেখে, পরে যে রুমটা রয়েছে, সে রুমের বন্ধ দরজার আড়াল থেকে গানের সাউন্ড ভেসে এলো কানে। উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে। এই রুমটা কার? ওই বদমাইশের হতে পারে।
মিতুল ক্যামিলার কাছ থেকে জেনেছে, কালকে ওকে ‘ননসেন্স, ইডিয়ট, সিক গার্ল’ বলা মদখোর ছেলেটা রেশমী আন্টির ছোট ছেলে। একটা জিনিস মিতুল কিছুতেই বুঝতে পারছে না, রেশমী আন্টির ছোট ছেলে বিদেশিদের মতো দেখতে কেন? বাবা, মা দুজনই তো বাংলাদেশি, তাহলে সে ওরকম দেখতে কেন? সার্জারি করেছে? চুলে কালার করেছে? মিতুল আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে হলরুমে নেমে এলো।

রেশমী আন্টির পরনে খয়েরি রঙের লং গাউন এবং মাথায় খয়েরি হিজাব। রেশমী আন্টিকে দেখতে ইয়াং লাগছে। মনে হচ্ছে বয়স বাড়েনি। বয়স যেন ত্রিশের কোঠায় আটকে আছে। অথচ ওনার বড়ো ছেলের বয়সই আঠাশ বছর। রেশমী আন্টির মুখে চিন্তার ছাপ উপস্থিত। মিতুল নিস্তেজ গলায় বললো,
“আন্টি, এনিথিং রং?”

মিতুল যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেননি রেশমী। তাই হঠাৎ করে মিতুলের কণ্ঠ ওনাকে চমকে দিলো। রেশমী শুকনো মুখে বললেন,
“একচুয়্যালি, আমার কাজিন হিমানি অসুস্থ। আমাকে ফোন করে জানিয়েছে এইমাত্র। ওরা ক্যালগারিতে থাকে। আমাকে সেখানে যেতে হবে এখন। তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির উপস্থিতি ওদের ভালো লাগবে না। ওরা আসলে এমনই। আর তাছাড়া তোমারও সেখানে থাকতে বোরিং ফিল হবে।” রেশমী খানিক বিরতি নিলেন।

মিতুলের মনে হলো রেশমী আন্টি পেঁচিয়ে কথা বলতে জানেন না। যা বলার সরাসরিই বলেন। তা না হলে এমন একটা কথা কিছুতেই এত সহজ ভাবে বলতে পারতেন না। মিতুলের একটু মন খারাপ হলো। কোথায় ভেবেছিল আজকে একটু ঘুরতে বের হবে। কিন্তু সেটা আর হলো না!

আবারও রেশমী আন্টির গলা শোনা গেল,
“তুমি চিন্তা করো না। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একজন মানুষ দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।”

“গুড মর্নিং মম!” সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে মমের দিকে উইশ ছুঁড়লো জায়িন। তারপর হলরুমে পা রেখে মিতুলকেও গুড মর্নিং জানালো।
মিতুলও প্রতিউত্তরে হেসে গুড মর্নিং জানায়।

“আমার একটা কাজ করে দাও মাই বেবি!” রেশমী বিনয় নিয়ে বললেন ছেলেকে।

“কী কাজ?”

“মিতুলকে একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাও।”

জায়িন অবাকের তুঙ্গে উঠে বললো,
“তোমার কি মাথা খারাপ মম? আমি কীভাবে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাব ওকে? আমি পারব না…”

জায়িনের কথা গায়ে লাগলো মিতুলের। অপমান বোধ করলো জায়িনের এমন কথায়। এই পরিবারের মানুষ প্রত্যেক কথায় বোধহয় মানুষকে অপমান করার ক্ষমতা রাখে। এদের প্রত্যেক কথায়ই কেমন যেন একটা ভাব থাকে। মানুষকে যেন মানুষ বলে মনে হয় না এদের।

“আমার অফিস আছে। অফিস বাদ দিয়ে কাউকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার নেই। তাছাড়া আজকে রাশিয়ান ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং আছে। সো, আমার হাতে বাড়তি কোনো সময় থাকবে না।” জায়িন পরাপর কথাগুলো শুনিয়ে গেল মমকে।

রেশমী খুব করে চাইছিলেন জায়িনের সাথে মিতুলকে পাঠাতে, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তাই রেশমীর মন খারাপ হলো।
কেউ কোনো কথা বললো না মধ্যমে।

জায়িনকেই আবার বলতে শোনা গেল,
“একটা কাজ করো। জোহানের সাথে পাঠিয়ে দাও ওকে। জোহান তো সারাদিন ঘুরেই বেড়ায় বাইরে বাইরে। ওর সাথে গেলেই ভালো হবে…আসছি আমি। আবার দেখা হবে।” জায়িন বেরিয়ে গেল।

জোহান নামটা অপরিচিত মিতুলের কাছে। জোহান কে? জায়িনের ছোট ভাই? মানে, ওই বদমাইশটা?

জোহান গুনগুন করে গলায় ইংলিশ গানের সুর তুলে, আঙুলের চরকায় কারের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে নেমে আসছিল। মিতুলকে এবং মমকে দেখেও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আনমনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চললো দরজার দিকে। দরজা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই রেশমী ডাক দিলেন।

“জোহান!”

জোহানের পথ চলা থামলো। সেই সাথে থামলো আঙুলের চরকায় ঘোরানো গাড়ির চাবিও। জোহান নির্বিকার ভাবে পিছনে ফিরে বললো,
“হোয়াট?”

রেশমী ইংরেজদের মতো গলায় টোন তুলে জোহানের বোধগম্য ইংলিশে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছ? ফ্রেন্ডসদের সাথে টাইমপাস করতে?”

“মম, আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, আমার ফ্রেন্ডস সার্কেলের সবাই গ্রামের ওদিকে পিকনিকে গেছে। ওরা কেউ নেই এখানে। শুধু আমি ছাড়া। কি বলিনি?”

মিতুল লক্ষ্য করলো, জোহানের কথা বলার মাঝে কেমন যেন এক বিরক্তির সুর ফুঁটে ওঠে। যেন ওই সুরটা ছাড়া কথা বলতে পারে না সে। আর মিতুল কালকে জোহানকে পরিচিত মনে হওয়ার কারণটা ধরতে পেরেছে। জোহানের চেহারায় কিছুটা রেশমী আন্টির প্রতিফলন। যার কারণে কাল জোহানকে চেনা চেনা লাগছিল।

“ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি আমি। এখন আমায় একটি বিষয়ে সাহায্য করো।”

“হোয়াট’স দ্যাট?” আবারও নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করলো জোহান।

“ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাও এবং শহরটি ঘুরিয়ে দেখাও।” রেশমী হাত দিয়ে মিতুলকে দেখিয়ে দিলো।

জোহান মমের হাত অনুসরণ করে তাকালো মিতুলের দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবলো একটু। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“ও কে, নো প্রবলেম। লেট’স গো!” শেষের ‘লেট’স গো’ কথাটি মিতুলের উদ্দেশ্যে বললো। তারপর আঙুলে চাবি ঘোরাতে শুরু করে, গুনগুন করতে করতে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।

মিতুল যতক্ষণে গ্যারেজে এসে পৌঁছলো, ততক্ষণে জোহান ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্টও বেঁধে ফেলেছে। মিতুল পিছনের সিটে বসার জন্য গাড়ির পিছনের দরজা খুললো। সামনে থেকে জোহান গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,
“হেই, এটাকে কি ট্যাক্সি পেয়েছো তুমি? সামনে এসে বসো।”

জোহানের এহেন আচরণে মিতুলের মেজাজ খারাপ হলো। এমনিতেই গত কালকের রাতের ঘটনাটা মিতুলের চোখে এখনও জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মিতুল খোলা দরজাটা জোরে শব্দ করে বন্ধ করলো। বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোহানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললো,
“বদমাইশ বেক্কল!”

মিতুল গাড়ির পিছন ঘুরে গিয়ে জোহানের ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসলো। মিতুল সিটবেল্ট ঠিক মতো বাঁধতেও পারলো না, তার আগেই জোহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গ্যারেজ থেকে ড্রাইভওয়েতে নামিয়ে ফেললো। মিতুল কোনো রকম সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি।

কোলাহলহীন শান্ত রাস্তায় জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে ধীর গতিতে। মিতুল ব্যস্ত উইন্ডো থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে। আশেপাশে শুধু রঙিন ফুলের ছড়াছড়ি। অনেক গাছ আছে যাতে কোনো পাতাই নেই, আছে শুধু ফুল। যেগুলো নিজেদের সৌন্দর্যের বাহার ছড়াচ্ছে।

কারের ভিতরে চলছে নীরবতা। গাড়িতে ওঠার পর কোনো কথা হয়নি দুজনের। জোহান রাস্তার বাম দিকে বাঁক নিয়ে প্রথম মুখ খুললো,
“হেই গার্ল, হোয়াট’স ইওর নেম?”

জোহানের প্রশ্নে মিতুল বাইরে থেকে দৃষ্টি এনে জোহানের মুখে নিক্ষেপ করলো। জোহানের বাদামি চুলগুলো কপাল জুড়ে পড়ে আছে। বাদামি চোখ জোড়া ঢাকা সানগ্লাসে। মিতুল চোখ সরিয়ে নিলো। সামনের গ্লাসের ভিতর থেকে সামনের দৃশ্যমান রাস্তাটাকে দেখতে দেখতে বললো,
“মিতুল দিলরাবা।”

“হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে? তুলতুল?”

মিতুলের শান্ত চোখ জোড়া হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। তুলতুল? ওর এত সুন্দর নামটাকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করলো? কেমন মানুষ এরা? এরা কি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে কেবল মানুষকে অপমান করার জন্য? মিতুলের দাঁতে দাঁত লেগে এলো। ভিতরটা প্রস্তুত হলো কয়েকটি কঠিন কথা শোনানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না। মায়ের কথা মনে পড়লো। মায়ের কানে কিছু গেলেই খবর হয়ে যাবে ওর। মিতুল নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। কঠিন বুলি ছুটতে চাওয়া মুখটি খুব ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“তুলতুল নয়। মিতুল। মি…তুল।”

“ওহ আচ্ছা, মি-তুল! নট ব্যাড। তুলতুলের থেকে ভালো আছে।”

মিতুল সন্দ্বিগ্ন চোখে তাকালো। ‘নট ব্যাড’ এবং ‘তুলতুলের থেকে ভালো আছে’ কথা দ্বারা কী প্রমাণ করতে চাইলো? ওর নামটা খারাপ?
হুহ্! এমন একটা ভাব করছে যেন নিজের নাম কত ভালো! নিজের নাম কী? নিজের নাম তো জোহান। যে নাম বাপ-দাদার জন্মেও শোনেনি কখনো। নিজে একটা অহেতুক নাম নিয়ে চলছে, আবার সে আসছে অন্যের নামকে ব্যঙ্গ করতে! মিতুল জোহানের অগোচরে ভেংচি কাটলো ওকে।

“কী করো তুমি?” আবারও জোহানের প্রশ্ন।

“কিছু না, লেখাপড়া করছি।”

“বাংলাদেশ থেকে এসেছো, তাই না?” কেমন গা ছাড়া ভাবে জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ।”

জোহান এমন একটা ভঙ্গি করলো যেন, বাংলাদেশ থেকে আসাটা নিছক একটা উটকো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। জোহান বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললো,
“এই বাংলাদেশি মানুষদের আমি একদমই পছন্দ করি না। এখানে অনেক বাংলাদেশি থাকলেও কোনো বাংলাদেশি বয়-গার্লদের আমি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে ঢুকাইনি। বাঙালিরা বোকা এবং নিষ্কর্মা হয়। এই জন্যই ওদের পছন্দ নয় আমার। অপছন্দ করি ওদের। আর সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি বাঙালি মেয়েগুলোকে। ওরা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি বোকা হয়। গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করলে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না বোধহয়।”

জোহানের কথায় মিতুলের গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠলো। কথাটি যে বিশেষ করে ওকে ইঙ্গিত করে বলেছে, সেটা বুঝতে ওর এক সেকেন্ডও লাগলো না। এরকম কথা শোনানোর জন্যই বোধহয় এক বাক্যে নিজের সাথে ঘুরতে আনতে রাজি হয়েছে? মিতুল তীব্র ক্রোধের সাথে গর্জে উঠলো,
“হ্যাঁ, বাঙালি মেয়েরা তো গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না। তুমি তো স্বয়ং বুদ্ধির ডিব্বা একটা। তুমি গিয়ে নিজের মগজ বিক্রি করে কোটিপতি হও না, কে নিষেধ করেছে তোমায়?”

মিতুলের চ্যাঁচানো কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে তাকালো জোহান।
“হ্যাঁ? কী? কী বলছো তুমি?”

মিতুল নিজের হুঁশে ফিরলো। এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে, বাংলা ভাষা বলে ফেলেছে? অবশ্য এতে স্বস্তি অনুভব করলো মিতুল। যাক, বাংলাতে বলায় কিছুই বুঝতে পারেনি মনে হয়। বাংলা ভাষায় অবগত নয় হয়তো। যদি অবগত হতো, তাহলে ওর কপালে ভোগ নেমে আসতো। মিতুল দুই পাশে মাথা নেড়ে, হাসার চেষ্টা করে বললো,
“নাথিং।”

জোহান চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“বাংলাদেশের মানুষদের যেমন অপছন্দ করি, ঠিক তেমনি অপছন্দ করি বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটাকেও। বাজে ল্যাঙ্গুয়েজ একটা। ফ্যামিলি থেকে এই বাজে ল্যাঙ্গুয়েজটাই আবার বাধ্যতামূলক করেছে। ড্যাম ইট! সব সময় টপার স্টুডেন্ট ছিলাম। হাইয়েস্ট মার্ক ছিল সব কিছুতে। কিন্তু এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটা আমার সকল ইমেজ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এই চব্বিশ বছর লাইফের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ সময়টা আমি ছুটেছি এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজের পিছনে। কিন্তু কী হলো? পাজি ল্যাঙ্গুয়েজটা কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে আমার আয়ত্তে এলো না। সামথিং যা শিখেছি তাও চর্চা না করলে ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতেও আমার এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মাত্র কয়েক মাস লেগেছিল শিখতে। অথচ এই স্টুপিড ল্যাঙ্গুয়েজটা…”

মিতুলের হাত, পা রাগে নিশপিশ করছে। খুব করে ইচ্ছা করছিল, জোহানের কথার মাঝে ওর দু গালে চব্বিশ মণ ওজনের দুটো চড় মারে। কিন্তু নিজের গাল দুটোর কথা ভেবেই আবার ইচ্ছা দমে যায়। জোহানের গালে চড় মারলে, নিজের গাল দুটোও চড় খেয়ে লাল টমেটো হয়ে যাবে। মায়ের হাতের জোরের কথা মনে আছে। সেই ক্লাস ফাইভে বাংলায় কম মার্ক পাওয়ার কারণে চড় খেয়েছিল মায়ের হাতে। সে যে কী ব্যথা ছিল! মনে হতেই মিতুলের গা শিরশির করে উঠলো।

গাড়ি এসে চেরি ব্লসমের রাজ্যে প্রবেশ করলো। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু চেরি ব্লসম ট্রি।
বাতাসের তালে তালে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে চেরি ব্লসম পাপড়ি। আহ, কী মনোরম! কী নয়নাভিরাম!
মিতুল মুগ্ধ নয়নে চেরি ব্লসম ঝরে পড়া দেখছিল উইন্ডো থেকে। শখও জেগেছিল হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিক একটু পাপড়িগুলো। কিন্তু সেই সুযোগ ও পেল না। তার আগেই উইন্ডো কাঁচ ধীরে ধীরে উপরে উঠে, উইন্ডো বন্ধ করে দিলো। কী হলো ব্যাপারটা? মিতুল চকিতে চাইলো জোহানের দিকে।
জোহান কণ্ঠে বিরক্তি ঝরিয়ে বললো,
“একদম ভালো লাগে না এই ঝরা ফুল। এত ধীর গতিতে ঝরে যে, জাস্ট বিরক্তিকর!”

মিতুলের নাক রাগে ফুলে উঠলো। ওর বুঝতে বাকি নেই, আসলে ফ্যামিলির মধ্যে সবচেয়ে অহংকারী, হিংসুটে, পাজি মানুষটি হলো এই জোহান!

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৩
_____________

আকাশে হাজার তারার মেলা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সেই সাথে ঝরছে কিছু চেরি ব্লসমের পাপড়ি। মিতুল একটা চেরি ব্লসম গাছের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। রেশমী আন্টি ক্যালগারি থেকে বাড়ি ফেরেননি। কালকে ফিরবেন। মিতুলের ভাবনা তা নিয়ে নয়। ও ভাবছে এই ফ্যামিলির মানুষগুলোর কথা। ফ্যামিলির ভিতরে কেবল একজন মানুষকেই নিরহংকারী এবং ভালো মনে হয়েছে ওর কাছে। আর সেই মানুষটি হলো, সাদাত আঙ্কল। বাকি প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু না কিছু সমস্যা আছেই। বেশি সমস্যা হলো দুই ভাইয়ের মাঝে। এক ভাই তো সকাল বেলা খুব দাপট দেখিয়ে চলে গিয়েছিল অফিস, মিটিংয়ের ছুতো দিয়ে। আরেকজন ভাই কী করলো? গাড়ির ভিতরে বসে যা অপমান করার তা তো করলোই, আবার ঘোরানোর নামেও অষ্টরম্ভা। শুধু রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে গেছে, আর ওকে পাশের সিটে বসিয়ে রেখেছে। সবশেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় যেতে চাও?’। আচ্ছা এই শহরে কি সে থাকে, না কি ও? তাহলে এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন? যেকোনো একটা জায়গায় নিয়ে গেলেই তো হতো। আহাম্মক একটা!

এখানে আসা যে কী পরিমাণ ভুল ছিল সেটা এখন হারে হারে টের পাচ্ছে মিতুল। এই বাড়িতে ওঠা ছিল জীবনের সবথেকে বড়ো একটা ভুল। হোটেল রেখে কেন এই বাড়িতে থাকতে এসেছে? আব্বুর কথাই শোনা উচিত ছিল। আব্বু পই পই করে বলেছিল, ‘এখন কানাডা যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বিয়ের পর বরের সাথে যাবে’।
এখানে আসার পর যে অপমান হতে হয়েছে, তা বোধহয় আব্বুর কথা না শোনার শাস্তি!

হাতের বাহুতে হঠাৎ কিছুর আঘাতে ব্যথায় হাত দিয়ে বাহু চেপে ধরলো মিতুল। আঘাতের উৎস খুঁজতে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ক্ষুদ্র এক টুকরো গোলাকার, মসৃণ পাথর দেখতে পেল। এখানে পাথর এলো কোত্থেকে? মিতুল এদিক-ওদিক পাথর নিক্ষেপের উৎস খুঁজতে লাগলে, জোহান দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললো,
“হেই, আই অ্যাম ইন হিয়‍্যার।”

মিতুল কণ্ঠস্বর অনুসর করে বারান্দায় তাকালো। জোহান হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
“এদিকে এসো।”

মিতুলের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পাথরটা জোহান ছুঁড়ে মেরেছে? আঘাত করে এখন আবার অর্ডারও দিচ্ছে! ওর কথা মতো কেন যাবে বারান্দায়? নিজের দাস মনে করছে?

মিতুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জোহান হাঁক পেরে বললো,
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? হারি আপ।”

মিতুল যাবে না যাবে না করেও কী ভেবেই যেন আবার পা বাড়ালো।

জোহান বারান্দার আর্মচেয়ারে আরাম করে বসে আছে। হাতে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। মাঝে মাঝে সিপ দিচ্ছে বোতলে। মিতুলের মুখ বারান্দায় সদৃশ্যমান হতেই জোহান বললো,
“তোমরা বাংলাদেশের মেয়েরা এত স্লো কেন? নিচ থেকে এখানে আসতে এত সময় লাগে?”

“কেন ডেকেছো আমায়?”

জোহান প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর পাশের আর্মচেয়ার দেখিয়ে বললো,
“সিট হিয়্যার।”

মিতুল চুপচাপ বসলো।

জোহান বোতলে সীপ দিয়ে বললো,
“ওখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”

“ভূতের মতো মানে?”

“তা নয়তো কী? মনে হচ্ছিল একটা পিচ্চি মেয়ে ভূত দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। আচ্ছা, তুমি এত খাটো কেন?”

“আমি আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি আমায় খাটো বানাবেন কী লম্বা বানাবেন সেটা একান্ত তার মর্জি। এখানে মানবজাতির এত মাথাব্যথা না থাকলেও চলবে।” ফটাফট কথার জবাব দিলো মিতুল।

জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে চুমুক দিলো বোতলে। কয়েক চুমুকে বোতল প্রায় খালি হয়ে এলো। জোহান হঠাৎ শূণ্য প্রায় বোতলটা মিতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি এটা পান করতে চাও?”

মিতুল একবার বোতল, আরেক বার জোহানকে দেখছে। একটা এঁটো খাওয়া জিনিস, যা কি না আবার তলানিতে পড়ে আছে, সেটা খাওয়ার জন্য অফার করছে ওকে? এটাও কি তাদের অপমান করার একটা টেকনিক? টেকনিক কি না জানে না, তবে মিতুল অপমানিত বোধ করছে।

“কী হলো? চাও না এটা?”

“আমি কারো খাওয়া জিনিস খাই না।”

জোহান শব্দ করে হেসে ফেললো।
“কারো খাওয়া জিনিস খাও না? পৃথিবীর সব খাবারই তো মানুষের খাওয়া। তাহলে তুমি কি খাবার না খেয়ে থাকো?”

মিতুলের জবাব দিতে মনে চাইলো না। জবাব দিতে গেলে চরম ঝগড়া বাঁধতে পারে এখানে।

এক চুমুকে বোতলে থাকা তরল বস্তুটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ালো জোহান। চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু আবার কী ভেবে যেন থামলো খানিক দূরে গিয়ে। পিছন ফিরে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই!”

মিতুল তাকাতেই, ‘ক্যাচ ইট’ বলে হাতের খালি বোতলটা মিতুলের দিকে ছুঁড়ে মারলো।
মিতুল দুই হাতে ক্যাচ ধরলো। যদি না ধরতো তাহলে বোতলটা সোজা ওর মুখ বরাবর এসে লাগতো।
জোহান বললো,
“আমার মনে হয় তোমার ওই বোতলটা খাওয়া উচিত। ওটা খাওয়ার রেকর্ড এখন পর্যন্ত গড়েনি। ওটা কেউ খায় না। ওটাই তোমার জন্য উপযুক্ত খাবার।”

মিতুল অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে দেখলো জোহানকে।
জোহান আর দাঁড়ালো না, চলে গেল।
মিতুল অগাধ বিস্ময়ে হাতের বোতলটা দেখলো। হে আল্লাহ! এ কোন অপমানের রাজ্যে এসে পড়েছে? এখানে কেউ তো ওকে মানুষ বলেই ভাবছে না। মিতুল বোতলটা খুব জোরে ফ্লোরে পতিত করলো। কাচের বোতলটা ভেঙ্গে গিয়ে তিন টুকরো হলো।
অপমানে জর্জরিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো মিতুল।
প্যাসেজ ওয়ে ধরে হেঁটে নিজের রুমের দিকে আসছে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। পদে পদে অপমানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এত অপমান সহ্য করে একটা মানুষ থাকে কী করে? মিতুলের শরীর রাগে কাঁপছে, সেই সাথে কান্না পাচ্ছে। এই কানাডার মাটিতে কি অপমান কুঁড়াতে এসেছে? কেন এত অপমান এখানে? রুমের দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেল রুমে মোবাইল বাজছে।
মিতুল দ্রুত রুমে ঢুকে মোবাইল রিসিভ করলো। ওপাশের কলারকে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“হাই মা।”

“এই পাঁচ বার কল দিলাম তোমায় আমি। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”

“আমি? আমি তো বারান্দায় ছিলাম। মোবাইল সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্যরি আমি।”

“হয়েছে স্যরি বলতে হবে না। তোমার রেশমী আন্টির কাছে ফোন দিয়ে শুনলাম সে ক্যালগারিতে আছে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার। কারো সাথে মিস বিহেভ করোনি তো আবার?”

‘তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার’ বাক্যটা শুনে মিতুল মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিল। কিন্তু শেষের বাক্যটা ওর খুশি আর ধরে রাখতে পারলো না। মা আসলে ওকে নিয়ে চিন্তিত ছিল না। কারো সাথে মিস বিহেভ করেছে কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিল। মিতুলের সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে এখন। কেন ওকে ঘিরে চারদিকে এত নির্মমতা?

_______________

মিতুলের যখন ঘুম ভাঙলো তখন এডমন্টনে কেবল ভোর হয়েছে। ভোরের দিকটায় শীতল অনুভব হচ্ছে। মনে হয় যেন শীতকাল চলছে। কিন্তু রোদ উঠে গেলেই দেখা যাবে আসলে শীতকাল নয়, বসন্ত চলছে। গাছে গাছে ফুঁটে থাকা রঙিন ফুলই তার প্রমাণ।
মিতুল ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নীরব এখন। নীরবতার জাল চিরে কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে শুধু। ক্যামিলা ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত বোধহয়।
মিতুল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ম্যাপল গাছের পিছন থেকে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক। ঝোপের মাঝে ফোঁটা হলুদ ফুলগুলো মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে। মিতুল নিঃশ্বাসের সাথে ফুলের সুবাস টেনে নিলো কিছুটা।
সাদাত আঙ্কলকে ছোট্ট গেটটি অতিক্রম করতে দেখা গেল। জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছেন উনি। বোধহয় জগিংয়েই বের হয়েছিলেন সকাল সকাল। সাদাত আঙ্কল কাছাকাছি আসলে মিতুলকে ‘গুড মর্নিং’ জানালো। মিতুলও গুড মর্নিং জানালো।
সাদাত আঙ্কল পায়ে মৃদু দৌঁড় অব্যহত রেখেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
এর একটু সময় পর দেখা গেল জোহানকে। সাদাত আঙ্কলের মতো জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছে। পরনে ট্রাউজার এবং টি শার্ট। মিতুল জোহানকে এক নজর দেখে আর তাকালো না ওর দিকে। মাথা নিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে রইল।
জোহান মিতুলকে দেখে এক ঝলক হাসলো। নিচু করে রাখা মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট মিতুলের। নাকের ছিদ্র দুটো স্বাভাবিক থেকে কিছুটা বড়ো আকার ধারণ করেছে ওর। জোহান মনে মনে বললো,
“নাক ফুলো মেয়ে তুলতুল!”

জোহান মিতুলের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিতুলকে ধাক্কা দিলো। হঠাৎ করে এমন হওয়ায় মিতুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল মাটিতে।
মিতুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েও জোহান একবার পিছন ফিরে দেখলো না। কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই সোজা চলে গেল ঘরে।
মিতুল কোথাও ব্যথা পেল না। কিন্তু জোহানের আচরণ ওর মস্তিষ্কে যন্ত্রণা ধরিয়ে দিলো। কোন সাহসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ওকে? ওকে কি মানুষ মনে হয়নি? একটা মশা ভেবে তোয়াক্কা না করে চলে গেছে এভাবে? মিতুলের মুখ রক্তিম হয়ে উঠছে রাগে। মনে মনে খুব বাজে ভাবে গালি দিলো জোহানকে। তারপর উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্ধুদ্ধ হলে, ওর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাত চোখে পড়লো। হাতটা অনুসরণ করে মানুষটিকে দেখে অবাক হলো মিতুল। জায়িন!
জায়িন ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এই দুই ভাইকে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ওর। এরা ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আসলে পিছনে অহংকারী শয়তান! মিতুলের মোটেও জায়িনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু হাত ধরে উঠে না দাঁড়ালে সেটা অভদ্রতা হবে।
মিতুল জায়িনের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো। সৌজন্যস্বরূপ ধন্যবাদ জানালো জায়িনকে।
জায়িন প্রতি উত্তরে কিছু না বলে ঘরে চলে গেল।

“হেই তুলতুল!” দূর থেকে জোহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে।
মিতুল তীব্র আক্রোশের সাথে তাকালো জোহানের দিকে। জোহান দোতলার বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো। মিতুলকে দেখে হাসছে।

“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা তো দেখছি হালকা বাতাসে আকাশে উড়ো। একটু ধাক্কাতে কেউ এইভাবে পড়ে যায়?” জোহানের হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।

মিতুলের কান থেকে উত্তাপ বের হচ্ছে রাগে। কথায় কথায় বাংলাদেশি মেয়ে বলে হেয় করে কথা বলা যেন জোহানের নেশা হয়ে গেছে। কীসে এই নেশা ছাড়বে ওর? দুই গালে কয়েকটা থাপ্পড় পড়লেই এই নেশা বাপ বাপ করে কেটে যাবে। মিতুল পারলে এখনই জোহানের গাল থাপড়ে লাল করে দেয়। কিন্তু সেটা বোধহয় এই ইহজনমে পারবে না!
মিতুল অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কটমট করে বললো,
“তোকে আমি পুকুরে চুবিয়ে মারবো বদমাইশ!”

“হোয়াট?” জোহান মিতুলের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল না।
“হোয়াট ডিড ইউ সে? ডিড ইউ স্পিক বেঙ্গলি এ্যাগেন?”

মিতুল রক্তচক্ষুতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হনহন করে ঘরে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে আসে।

_______________

মিতুল ঠিক করেছে আজকে একা একাই বাইরে বের হবে। ও তো আর ছোট বাচ্চা নয় যে বাইরে বের হলে হারিয়ে যাবে। তাছাড়া একা বের হলে যে আনন্দটুকু উপভোগ করা যায়, সেটা অন্য কারো সাথে বের হলে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, ও একাই বের হবে। এটা কালকেও ভাবা উচিত ছিল। কেন একজন লোক নিয়ে বাইরে বের হতে হবে? তাও আবার এই অহংকারী ফ্যামিলির!

ঠক ঠক করে দরজা নক করার শব্দ হলো। দরজা নক করছে কে? ক্যামিলা? মিতুল জানালার কাছের টুল ছেড়ে দরজা খুললো। দরজা খানিক খুলতেই জোহানের মুখ দেখা গেল।
মিতুল খোলা দরজাটা আবার বন্ধ করার জন্য উদ্যত হলো, কিন্তু পারল না। জোহান হাত দিয়ে টেনে ধরলো দরজাটা। জোহানের প্রতি রাগ যাও একটু কমে এসেছিল, তাও আবার বেড়ে গেল।
জোহানের কণ্ঠে থাকা তার সবসময়ের বিরক্ত সুরে বললো,
“শোনো, বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো না। আগেই বলেছি তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা হলে আনস্মার্ট। যা একটু স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো, ওগুলো সব উপরে উপরে। ওগুলো কোনো কাজের নয়। দশ মিনিট…না পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি তোমায়। এর মধ্যেই গ্যারেজে উপস্থিত থাকবে। নয়তো রুমে এসে তুলে নিয়ে যাব তোমায়। আর আমার যদি এখানে দ্বিতীয় বার আসার প্রয়োজন পড়েই, তাহলে কিন্তু শুধু তুলে নিয়ে যাব না, মেরে হাড্ডিও ভেঙে দেবো। সো বি কেয়ারফুল। অ্যান্ড বি এ গুড গার্ল, ও কে?”

জোহান নিজের হাসি মুখখানা দেখালো একবার।

(চলবে)