চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
342

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৮
____________

মিতুল রুমের দরজা বন্ধ করেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। কষ্ট হচ্ছে বুকে। আজকে যে কষ্ট পেল, তা জীবনে আর কখনো পায়নি। আজকে যা দেখলো, যা শুনলো, আর যা জানলো, তাতে ওর হৃদয়ে এক মহাকাশসম হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। ওর পছন্দের মানুষটি আসলে সবসময় অন্য কারো ছিল। অন্য একটি মেয়ের ফিয়ন্সে সে। এসব ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃদয়ের ক্ষতগুলো আরও বিস্তৃত হয়। কার্ল একটি ভুল ছিল ওর জীবনে। ভুল ছিল কার্লের সাথে দেখা হওয়া। ভুল ছিল কার্লের প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি হওয়া। সবই ভুল ছিল। আজকে কার্ল ডেকে নিয়ে এমন একটা সত্য জানাবে জানলে, কার্লের কাছে যাওয়ার জন্য আর পা মাড়াতো না জীবনে।
ডেকে নিয়ে নিজেদের লাভ স্টোরি শোনালো ওকে? এতটা পাষাণ হলো কী করে কার্ল?
সাত বছরের প্রেম কার্লের। এক বছর হয়েছে এনগেজড হয়েছে ওদের। খুব শীঘ্রই বিয়ে। কার্ল-অলিভারের বিয়ে। ও থাকবে সেই বিয়েতে অতি সামান্য এক অথিতি। যে অথিতির মূল্য খুবই কম। মিতুলের কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ অভিমান হলো কার্লের প্রতি। কার্ল আগে কেন বললো না ও অলিভারকে ভালোবাসে? কেন বললো না যে ওর এনগেজড হয়ে গেছে অনেক আগেই? কেন বললো না এসব?
কার্লের প্রতি অভিমান করেও আবার অভিমানের খেই হারিয়ে ফেললো মিতুল। কার্লের উপর অভিমান করার অধিকার তো ওর নেই। কার্লের কী দোষ? কার্ল কি জানতো যে ও কার্লকে পছন্দ করে? কখনো বলেছে ও? তাহলে? কার্ল তো নিজের একজন বন্ধু ভাবতো ওকে, এর বেশি কিছু নয়। ওর মনে যদি লুকানো অনুভূতি থাকে, তাহলে সেটা কার্ল জানবে কীভাবে? কার্লের তো সেটা জানার কথা নয়। কার্লের তো কোনো ভুল নেই, কোনো দোষ নেই। দোষ তো নেই ওরও কোনো। সব দোষ জোহানের। জোহান যদি প্রথমে ওকে কার্লের রেস্টুরেন্টে না নিয়ে যেত, তাহলে এমন ঘটতো না। ওর হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হতো না। ওর সাথে এমনটা হওয়ার জন্য দায়ী একমাত্র জোহান। জোহান ওই রেস্টুরেন্টে না নিয়ে গেলে ওর জীবনে কার্লের সাথে দেখা হতো না। পরিচয় হতো না। কার্লের প্রেমে পড়তো না। এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হতো না কোনো দিন!
মিতুলের সব অভিযোগ একসূত্রে এবার জোহানের উপর উঠলো। তবে জোহানের প্রতি কেন যেন ওর রাগ হচ্ছে না।
ওর অসহ্য লাগছে এখন সবকিছু। এখানে বসে থেকে ঠিক ওর কষ্ট লাঘব হচ্ছে না। খুবই নিস্তব্ধ, নিরালা একটা জায়গা দরকার ওর এখন। যেই জায়গায় ও ওর মনের কষ্টগুলো মেলে বসবে সব। কোথায় পাবে এমন একটা জায়গা?

__________

বিকেলের শেষ ভাগ চলছে। গাছের ডাল পালার আড়াল থেকে এখনও চিকচিকে রোদ উঁকি দিচ্ছে। জোহান শেষ বিকেলের চিকচিকে রোদ টুকুকে গায়ে জড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে টাইম হাউজের দিকে। হাতে আছে একটা বিয়ারের বোতল। চলতে চলতে আনমনে চুমুক দিচ্ছে বিয়ারে। জঙ্গলের ওই প্রান্তে দূরে একজন প্রতিবেশীকে নজরে পড়ছে। জোহান একটু ভালো করে লক্ষ্য করতে বুঝলো মি. মাইকেল। জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করছেন বোধহয়।
জোহান বাঁক নিলো বামে। নিজের টাইম হাউজ চোখে পড়ছে। আরও একটু হেঁটে আসতেই জোহানের মনে হলো ওর টাইম হাউজের সামনের সিঁড়িতে কেউ বসে আছে। প্রথমে ভেবেছিল ক্যামিলা হবে। পরে দেখলো ক্যামিলা নয়। মিতুল! মিতুলকে দেখে জোহানের বিস্ময়ে ভ্রুকুটি হলো। অসময়ে মিতুল ওর টাইম হাউজে?
মিতুলের সামনে এসে একটু নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালালো জোহান। মিতুলের মুখ কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ও এসেছে টের পেয়েও একবার চোখ তুলে তাকায়নি।
জোহান মিতুলের এমন দশার মানে বুঝলো না। ঘণ্টা দুয়েক আগে তো শাড়ি পরে খুশিতে উড়তে উড়তে বাইরে গিয়েছিল। এখন আবার কী হলো? বাড়ি ফিরলো কখন? ড্রেস চেঞ্জ করলো কখন? আর এখানেই বা আসলো কখন?

মিতুলের পরনে ফতুয়া এবং প্লাজো। গলায় একটা ওড়না প্যাঁচানো। মুখে এখনও বাইরে বেরোনোর সময়কার মেকআপ। হাতে শাড়ির সাথে ম্যাচিং সেই চুড়ি।

জোহান মিতুলের পাশে এসে বসে বললো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

মিতুল জোহানের দিকে না তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়িয়ে বললো,
“নাথিং।”

জোহান আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। মিতুলের চেহারা দেখে খুব একটা ভালো লাগছে না ওর। জোহান চুপচাপ বোতলে সীপ দিচ্ছিলো।
একসময় শুনতে পেল মিতুল বলছে,
“জানো জোহান, কার্লের না গার্লফ্রেন্ড আছে!”
মিতুলের কণ্ঠ আনমনা। জোহানকে কী বলতে কী বলছে নিজেরই খেয়াল নেই। এখানে ওর মনের কষ্ট বলার মতো মানুষ নেই দেখে জোহানকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিলো ওর আনমনা মন।

জোহান বোতলে সিপ দিয়ে নির্লিপ্তকার ভাবে বললো,
“হুম, জানি আমি। তো কী করবো এখন আমি? সেলিব্রেট করবো?”

মিতুল প্রথম নিজের নিরাশ চোখ জোড়া জোহানের উপর ফেললো।
“জানো? কীভাবে?”

“ওকে ঘুরতে দেখেছিলাম একটা মেয়ের সাথে। শপিং মলে। তখন জানতাম না মেয়েটি সম্পর্কে কী হয়। তোমার কথা শুনে মনে হলো, ওই মেয়েটাই গার্লফ্রেন্ড হবে।”
জোহানের জানার মাধ্যম ভিন্ন। সেই মাধ্যমটা মিতুলকে বললো না। মিথ্যা বলেছে মিতুলকে। জোহান যে মিথ্যা বললো মিতুল সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না।

মিতুল চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমাকে বলোনি কেন?”

“তোমাকে বলবো কেন? কার্ল কার সাথে ঘুরছে, না ঘুরছে তা নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কীসের?”

মিতুল প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“তুমি একজন বড়ো অপরাধী জোহান। তোমার করা অপরাধে আজ আমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো!”

“কী?” গলায় রাজ্যের বিস্ময় ঢেলে প্রশ্ন করলো জোহান।

মিতুল আর কিছু বললো না। আবারও জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একেবারে নীরব হয়ে গেল।

মিতুলের নীরব, চুপসানো মুখটা দেখে হাসি পাচ্ছে জোহানের। এই তাহলে আসল কারণ? বিরহের সুরে ধরেছে মিতুলকে? জোহান মনে মনে হেসে চুমুক দিলো বোতলে।
কিছু সময় নীরবে কেটে যায়। মিতুল কষ্টভরা নিস্তেজ মন নিয়ে এক ধ্যানে বসেছিল। হঠাৎ আবার পাশে জোহানের দিকে তাকালো। জোহানের হাতের বোতলটা দেখে বললো,
“কী খাচ্ছ তুমি? বিয়ার?”

“হুম। কেন জিজ্ঞেস করছো? তোমারও খেতে মন চাইছে? বিয়ার খাবে তুমি?”

সত্যি কথা বলতে মিতুলের খেতে মন চাইছিল। কষ্ট ভুলে থাকতে উপকারে দিতো বোধহয়। কিন্তু ও বিয়ার খাওয়ার মতো এত স্পর্ধা দেখাতে পারে না। খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মিতুলের বলতে হলো,
“না, খাবো না। বিয়ার খেয়েছি জানলে বাংলাদেশে ফিরে আমার স্থান আর ঘরে হবে না। ফুটপাতে দিন গুনতে হবে আমার।”

জোহান হেসে ফেললো।
“কেন? তোমার ফ্যামিলি কি তোমার সাথে খুব কঠোর?”

মিতুলের মুখে বিরক্ত হওয়ার একটা চিত্র ফুঁটে উঠলো। বললো,
“বেশি কথা বলো না জোহান। আমি এখন তোমার সাথে কথা বলার মুডে নেই।”

বলে আবারও নিজের কষ্টগুলো পরখ করতে ব্যস্ত হলো মিতুল।

___________

দুটো দিন পার হয়ে গেল। এই দুই দিনে বলতে গেলে মিতুল প্রায় নীরব ছিল। জোহান মাঝে মাঝে উষ্কানিমূলক কথাবার্তা বলে উস্কে দিতে চাইতো ওকে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কার্লের দুঃখে এখন জোহানের উষ্কানিমূলক কথাগুলোও কানের উপর দিয়ে যায় বলতে গেলে।
এরই মাঝে আবার নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়ার কথা উঠেছে। মিতুল এখন নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়ার মুডে নেই। কেমন উদাস উদাস লাগে সারাদিন। তাও নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়ার সাথে হ্যাঁ মিলিয়েছে। এবারে নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাওয়ার ট্রিপে আর পুরো ফ্যামিলি যাবে না। যাবে কেবল ও এবং রেশমী আন্টি।

মিতুলের মোবাইলটা অনবরত বেজে যাচ্ছে, কিন্তু তুলতে ইচ্ছা করছে না। জোহানের নামটা দেখে তুলতে আরও বেশি অনিচ্ছা। এই তিনবার হলো কল দিয়েছে। আগের কল দুটো রিং হতে হতে কেটে গেছে। এবারও তাই হলো। কল রিসিভ করলো না মিতুল। এরপর দরজায় করাঘাতের শব্দ শুরু হলো। মিতুল না দেখেও বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলতে পারবে জোহান নক করছে। মিতুল গিয়ে দরজা খুললো না। কম্বলটা ভালো করে গায়ে টেনে নিয়ে বসে রইল।

ওদিকে জোহান অতিষ্ট কণ্ঠে বলে চলেছে,
“মিতুল, ওপেন দ্য ডোর। ওপেন দ্য ডোর ক্যুইকলি। হেই, ইউ ক্যান নট হীয়ার? ওপেন দ্য ডোর।”

মিতুল এরপরও খুললো না। জোহান এবার হুমকির সুরে বললো,
“দরজা খোলো। নয়তো দরজা ভেঙ্গে ঢুকবো কিন্তু। আর ঢুকলে দরজার সাথে সাথে তোমার নাকও ভেঙ্গে দেবো। খোলো দরজা।”

মিতুল জোহানের উদ্দেশ্যে উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“যা পারো তাই করো। আই ডোন্ট কেয়ার।”

“তাহলে তুমি দরজা খুলবে না?”

“না।”

“ঠিক আছে। আমি তোমার মমের কাছে কল করবো। তাকে বলবো, ম্যাম! আপনার মেয়ে খুবই অবাধ্য, বেয়াদব। সারাক্ষণ মানুষের সাথে বেয়াদবি করে বেড়ায়। ও কিছুতেই এখানকার মানুষের সাথে ভালো আচরণ করে না। বিশেষ করে এই আমি। আমি সবচেয়ে বেশি খারাপ আচরণের শিকার ওর। আপনি ওকে …”

জোহান এই পর্যন্ত বলতেই রুমের দরজা খুলে গেল।
মিতুল দরজা খুলেই সন্দ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি আমার মায়ের ফোন নাম্বার পেলে কোত্থেকে?”

“ওনার ফোন নাম্বার নেই তো আমার কাছে। তবে হ্যাঁ, জোগাড় করতে সময় লাগবে না। এটা আমার কাছে সেকেন্ডের ব্যাপার।”

“ব্ল্যাকমেইল করছো তুমি আমাকে?”

“তোমার বুঝি তাই মনে হচ্ছে? ঠিক আছে, ধরে নাও এটা ব্ল্যাকমেইল। তোমাকে মাত্র তিন মিনিট সময় দেবো। এর মাঝে রাস্তায় উপস্থিত হবে। নয়তো…উঁহু, তোমার মমের কাছে কল করবো না। নিজেই তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করবো। প্রথমে নাক, তারপর হাত, তারপর পা, সবশেষে গলা কেটে ফেলবো!”

“তুমি আমাকে হুমকি দিচ্ছ? গলা কাটার হুমকি ?”

“শুধু গলা বলছো কেন? সাথে নাক, হাত, পা যাবে কোথায়? মাত্র তিন মিনিট। এর মাঝে না এলে শিরশ্ছেদ করবো তোমার।”

বলে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে নিলো জোহান। এরপর স্মার্ট একটা লুক দিয়ে চলে গেল ।

মিতুল ছয় মিনিটের মাথাতেই বাড়ির সামনে রাস্তায় এলো। রাস্তার দুই পাশের ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। জোহানের গলা কাটার হুমকিতে ভয় পেয়ে এসেছে সেটা নয়। ও এসেছে ওর মায়ের জন্য। জোহানকে কোনো বিশ্বাস নেই। মায়ের ফোন নাম্বার জোগাড় করে ওর সম্পর্কে আজেবাজে কথা লাগাতে একটুও বাঁধবে না জোহানের।
জোহান পার্কিং সাইডে পার্ক করা গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে মোবাইল ঘাটছিল। মিতুল কাছে আসতেই মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বেশ আমদপূর্ণ গলায় বললো,
“সেই তো আমার হুমকিতে ভয় পেয়ে চলেই এলে তুলতুল।”

মিতুলের রাগ হলেও সেটা প্রকাশ করলো না।
শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে আসতে বললে কেন?”

“তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাব তাই।”

“কোথায়?”

“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা বড্ড বেশি প্রশ্ন করো। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো।”
কড়া আদেশ দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো জোহান। মিতুলের রাগ হচ্ছে। এমনিতেই কার্লের শোকে কাতর ও, এর মাঝে জোহানের এমন আচরণ ওর কাছে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

কফি শপে নিয়ে এসেছে জোহান।
মিতুল বোঝে না, জোহান রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ওকে নিয়ে যায়, আজকে আবার কফিশপেও নিয়ে এসেছে। কোথাও খেতে গেলেই ওকে কেন আনে নিজের সাথে?

কফি শপের ভিতরে প্রায় টেবিলগুলোই লোকজনে আটক। এর মাঝে দুই তিনটা টেবিল ছাড় আছে শুধু। মিতুল জোহানের সাথে একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। জোহান এখান থেকেই উচ্চৈঃকণ্ঠে নিজের অর্ডার জানালো। দুটো কোল্ড কফি অর্ডার করলো।
মিতুলের বিরক্ত লাগছে। এমনিতেই মন ভালো না, তার উপর এই কফি শপটা ভালো লাগেনি ওর। এর মাঝে আরও একটু বিরক্ত এড করলো জোহান। মোবাইলে একটা কল আসতেই ও কল রিসিভ করে ওয়াশ রুমের দিকে গেছে। মিতুলকে একা ফেলে রেখে গেল দেখে মিতুলের রাগ বাড়তে শুরু করেছে। নিজের সাথে এনে একা ফেলে রেখে একেক দিক চলে যায়!

দশ মিনিট কেটে গেল অথচ জোহানের আসার কোনো খবর নেই। মিতুলের মেজাজ চড়াও হচ্ছে। কার সাথে এত কথা বলছে? সেই নির্লজ্জ মেয়েটার সাথে? নির্লজ্জ মেয়ে মানে, জোহানকে সেদিন জড়িয়ে ধরা মেয়েটির কথা বোঝালো। হবে ওই মেয়েটাই। মেয়েটির সাথে তো জোহানের গলিত ভাব একেবারে। মেয়েটির সাথে কথা বললে যে এত তাড়াতাড়ি ওর কথা শেষ হবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি মিতুলকে অস্বাভাবিক করে তুলছে উচ্চ মাত্রায়। নিজের রাগ সংবরণ করাই কঠিন হয়ে পড়ছে ওর জন্য। জোহান কি ওকে মানুষ বলে মনে করে না? যে সময় ইচ্ছা নিজের সাথে আনবে, একা ফেলে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উধাও থাকবে! কী পেয়েছে কী?
দিনকে দিন…

“মিটুল!” একটি পুরুষালি কণ্ঠের ডাকে মিতুলের ভাবনায় ছেদ পড়লো। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো কালো চুলের এক কানাডিয়ান ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির মুখ হাস্যজ্জ্বল। মিতুলের চেনা চেনা লাগছে ছেলেটিকে। কোথায় যেন দেখেছে! কোথায় দেখেছিল?

কালো চুলের ছেলেটা বুঝতে পারলো মিতুল চিনছে না তাকে। তাই সে নিজেই স্মরণ করিয়ে দিলো।
“আরে মিটুল, আমাকে চিনছো না তুমি? এটা আমি। ফ্রেডি। জায়িনের বাড়িতে দেখা হয়েছিল। মনে নেই?”

মিতুলের এবার মনে পড়লো। মিতুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার মনে পড়েছে তোমাকে!”

মিতুল ফ্রেডিকে চিনতে পেরেছে বলে ফ্রেডি আনন্দিত হয়ে মিতুলকে হাগ করার জন্য এগিয়ে এলো।

সামনের বীভৎস দৃশ্য দেখেই জোহানের পা দুটো জায়গাতেই স্থির হয়ে গেল। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল একটা ছেলে মিতুলকে জড়িয়ে ধরেছে!

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৯
____________

রাগে জোহানের মুখ মন্ডল কেঁপে উঠছে। ও ছুটে এলো মিতুলের কাছে। এক টানে মিতুলের থেকে আলাদা করে ফেললো ফ্রেডিকে।
জোহানের এই কাজে চমকে উঠলো মিতুল। সেই সাথে ফ্রেডি। ফ্রেডির মুখ দেখে জোহানের আরও বেশি রাগ হলো। গলায় রাগ ধরেই বললো,
“তোমার সমস্যা কী ব্রো? তোমার তো মেয়েদের অভাব নেই। এত এত গার্লফ্রেন্ড তোমার, তাদের গিয়ে হাগ করো না। ওকে কেন জড়িয়ে ধরছো? আর কখনো ওর আশেপাশেও যেন না দেখি তোমাকে। ওর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকবে।”

বলেই জোহান মিতুলের এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। আরও একবার চোখ দিয়ে ফ্রেডিকে সতর্ক করে, মিতুলকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে।

ফ্রেডি এখনও বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে হলো কী জোহানের? মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

চলতি পথে কোনো কথা বললো না জোহান। কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল হচ্ছে না দেখে, একসময় গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। গাড়ি থেকে কতক দূর হেঁটে গিয়ে থামলো। অস্থির অস্থির লাগছে ওর। চোখের সামনে কীভাবে ফ্রেডি মিতুলকে জড়িয়ে ধরলো? দৃশ্যটা মনে উঠতেই সর্বাঙ্গ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।

মিতুল গাড়িতে বসে দূরে জোহানকে দেখছে। এমনিতেই কার্লের জন্য মন খারাপ ওর। এর উপর ফ্রেডির ওই কাজ! আর এখন আবার জোহানের এমন আচরণ মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত লাগছে।
ফ্রেডির জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠতেই মিতুলের গা ঘিন ঘিন করছে। ফ্রেডির কত বড়ো সাহস ওকে এইভাবে জড়িয়ে ধরে! এ দেশে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও, এটা ওর কাছে তো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অন্য একটা দেশের মেয়েকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে বিবেকে বাধলো না ওর? প্রথম দেখাতেই ধারণা করেছিল ফ্রেডি কেমন যেন। ঠিক কেমন সেটা বুঝে উঠতে পারেনি তখন। আজ হাতে নাতে প্রমাণ পেল। ফ্রেডি হলো একটা অসভ্য, ইতর! অবশ্য দোষ তো ফ্রেডির থেকে জোহানের বেশি। বেশি কী? সব দোষই তো জোহানের। এই ঘটনার উৎপত্তি তো জোহানের জন্যই হলো! জোহান কেন নিয়ে গিয়েছিল কফিশপে? ওই কফি শপে না নিয়ে গেলে কি আর এমন হতো? আর নিয়ে গিয়েছেই যখন, তখন একা রেখে চলে গিয়েছিল কেন? হ্যাঁ, এটাও মেনে নিলো। একটা ইম্পরট্যান্ট ফোন আসায় কথা বলার জন্য যেতেই পারে। কিন্তু আরও একটু আগে ফিরে এলো না কেন? ফ্রেডি জড়িয়ে ধরার পর ছাড়িয়ে দিলো, জড়িয়ে ধরার আগে এসে বাধা দিতে পারলো না? কেন পারলো না? অকর্মণ্য একটা! দুই দুইটা অপরাধ করেছে জোহান ওর সাথে। এক, কার্লের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল। দুই, আজ কফিশপে নিয়ে গেছে। এই দুইটা অপরাধের জন্য জোহানকে যেই শাস্তিই দেওয়া হোক না কেন, তাই কম হয়ে যাবে। ওর অপরাধের কোনো সাজা হয় না। মিতুল জোহানের সম্পর্কে এসব ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেল জোহান কারের দিকে এগিয়ে আসছে। মুখে রাগের গাঢ় প্রলেপ। জোহান উইন্ডোর কাছে এসে চেঁচিয়ে উঠলো মিতুলের সাথে,
“ছেলেরা জড়িয়ে ধরলে তোমার খুব ভালো লাগে, তাই না?”

মিতুলের ভিতরের রাগ সব জেগে উঠলো।
“ঠিক করে কথা বলো জোহান! লিমিট ছাড়িয়ে যেও না! এটা কোন ধরণের কথা বলছো তুমি? ফ্রেডি আমায় জড়িয়ে ধরলে আমি কী করবো? জড়িয়ে কি আমি ধরেছি? নাকি ও? এমন বিহেভ করার মানে কী তোমার?”

“কেন জড়িয়ে ধরলো ও তোমাকে? তুমি কী করছিলে? থামাওনি কেন ওকে?”
জোহানের গলায় তীব্র আক্রোশ।

“আরে আজব তো! একটা মানুষ জড়িয়ে ধরলে তাকে থামাবো কী করে? আমি কি আগে থেকে জানতাম ও জড়িয়ে ধরবে? ও কি আমাকে বলে করেছে কাজটা? আর ও আমাকে জড়িয়ে ধরলে তাতে তোমার এত কী? তুমি নিজে যখন অন্য মেয়েদের জড়িয়ে ধরো, তখন? তখন কিছু হয় না? নিজের গার্লফ্রেন্ডকে আমার সামনে যখন জড়িয়ে ধরেছিলে, তখন?”

জোহান আকাশ থেকে পড়লো,
“গার্লফ্রেন্ড?”

মিতুল আত্মবিশ্বাসের সুরে বললো,
“ন্যাকা সাজার চেষ্টা করো না। সবই বুঝি আমি। সেদিন রেস্টুরেন্টে যে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছিলে, তার কথা বলছি। না সান্ডা, আর না লেনি। তুমি আসলে ভালোবাসো ওই মেয়েটাকে। ওই মেয়েটার সাথে রিলেশন তোমার।”

“বাজে কথা বলে মেইন পয়েন্ট থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না আমাকে। ফ্রেডি জড়িয়ে ধরলো, আর তুমি ওকে জড়িয়ে ধরতে দিলে কেন? ওকে বাধা দিলে না কেন?”

“আবারও একই কথা বলছো তুমি! একটা লোক যদি আচমকা জড়িয়ে ধরে, তাহলে বুঝবো কী করে?”

জোহান কিছু বললো না। কয়েক সেকেন্ড তির্যক তাকিয়ে থেকে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি চালু করে গন্তব্যে নিয়ে যেতে লাগলো। রাগ কিছুটা হালকা হয়েছে। তবে অনেকটাই ঝেঁকে আছে এখনও। জোহান একসময় বললো,
“ফ্রেডিকে চেনো না তুমি। ও মেয়েদের খুবই পছন্দ করে।”

“তো সেটাই তো স্বাভাবিক। একটা ছেলে মেয়েদের পছন্দ করবে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? না কি ছেলেদের পছন্দ করলে সেটা স্বাভাবিক লাগতো তোমার কাছে?”

“উহ, তুমি বুঝতে পারছো না। আমি বলতে চাইছি ও মেয়েদের জন্য পাগল। কোনো মেয়ে দেখলেই সে মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যায় ও। কোনো মেয়ে দেখলেই তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে প্রথমে। তারপর বন্ধুত্বের থেকে একটু বেশি কিছু। এই রকম বেশি করতে করতে অনেক দূর এগিয়ে যায় ও। তুমি জানো এ পর্যন্ত কতগুলো গার্লফ্রেন্ড আছে ওর? কম করে হলেও দুইশ-তিনশ। ফ্রেডির ক্যারেকটার খুবই খারাপ। ওর ক্যারেকটারের জন্য ওকে আমার একদমই পছন্দ না। চরিত্রহীন অসভ্য একটা!”

“বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছো তুমি।”

“টান লাগছে তোমার ফ্রেডির জন্য? ওর সম্পর্কে এ কথা বলছি দেখে তোমার খারাপ লাগছে? যা বলছি এর একটা কথাও মিথ্যা নয়। আমার জানা মতে দুই-তিনশ মেয়ে আছে। এর বাইরে আরও কতগুলো আছে, সে তো আমার ধারণার বাইরে।”

দুইশ, তিনশ গার্লফ্রেন্ড? জোহানের কথা বিশ্বাস হলো না মিতুলের। ও ধীরে ধীরে উইন্ডো মুখী হলো।
কার্লের কথা মনে পড়ছে ওর। খুব শীঘ্রই বিয়ে কার্লের। অলিভারের সাথে! কার্লের বিয়ের দিনটি হবে ওর জীবনে সবচেয়ে দুঃখের দিন।

__________

নায়াগ্রা ফলস দেখতে শুধু ওর এবং রেশমী আন্টির যাওয়ার কথা থাকলেও, এর সাথে জায়িনও যোগ হয়েছে। হঠাৎ করে কেন আবার জায়িনের যাওয়ার কথা উঠলো ও জানে না। জায়িন না গেলেই ভালো হতো বলে ওর বিশ্বাস। আজকে টরোন্টো যাচ্ছে ওরা। একেবারে শেষ ফ্লাইটে যাবে। বিকেল ছয়টায় ফ্লাইট। সকালেই সব কিছু গোছগাছ করে নিয়েছে। মাত্র তিনদিন থাকবে টরোন্টো। টরোন্টো থেকে নায়াগ্রা ফলস যেতে মাত্র এক ঘণ্টা পনেরো কী বিশ মিনিট লাগে। নায়াগ্রা ফলসও দেখবে, সেই সাথে টরোন্টোর কিছু জায়গা ঘুরবে। মিতুল জোহানের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেল জোহান গান গাইছে। গানটা যে বেশ ফুরফুরা মেজাজে গাইছে সেটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। গানটা জোহানের লেখা নয়। এর আগেও শুনেছে এই গানটা। কার গাওয়া সেটা ভুলে গেছে। জোহানের রুমের দরজা ভেজানো ছিল। মিতুল একটু ঠ্যালা দিতেই দরজা খুলে যায়।

আচমকা দরজা খুলে যাওয়ায় ভয় পায় জোহান। বুকের উপর এক হাত রেখে বলে উঠলো,
“ওহ মাই গড!”

মিতুলকে দেখে বললো,
“নক করে ঢুকতে পারো না? একটা ছেলের রুমে হুট করে ঢুকে যাওয়া অন্যায়। প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে।”
বলে জোহান নিজের খালি গায়ে এই সবে পরতে নেওয়া টি-শার্টটা পরে নিলো।
জোহানকে এর আগে একদিন খালি গায়ে দেখে মিতুলের কেমন যেন লেগেছিল। কিন্তু আজ আর লাগলো না। ওর অনুভূতি ছিল একেবারে নিস্তেজ। জোহানের সামনে খোলা লাগেজ দেখে বললো,
“তুমি কোথাও যাচ্ছ?”

জোহান বিছানার উপর মেলে রাখা কতগুলো পোশাক আশাকের ভিতর থেকে একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট তুলে ভাঁজ করতে করতে বললো,
“হ্যাঁ যাচ্ছি।”

“কোথায়?”

“রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে।”

“কেন?”

“সাত দিন ব্যাপী পার্টি করবো আমরা পুরো ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে। ওর বাসাতেই হবে। ওর একার পক্ষে কি আর সব কিছু অ্যারেইনজমেন্ট করা সম্ভব হবে? তাই হেল্প করতে যাচ্ছি ওকে।”

“সাত দিন ব্যাপী পার্টি মানে?”

“একটানা সাত দিন পার্টি।”

“একটানা সাত দিন পার্টি করবে তোমরা?”

“হুম। এই সাত দিন বাড়ি থাকবো না আমি। মিস করো না আবার আমাকে। তুমি তো বড্ড বেশিই মিস করো আমাকে।”

মিতুল অবিশ্বাসের সুরে বললো,
“আমি? মিস করি? তোমাকে? ওহ, জোহান তুমি হাসিও না আমাকে।”

“করো না মিস?”

“না, করি না।” দৃঢ়তার সাথে বললো মিতুল।

“সত্যিই করো না? কীভাবে বিশ্বাস করবো তোমার কথা? তোমার মন খুলে দেখাও আমাকে। দেখি, ওই মনে আমাকে মিস করার কোনো হিস্ট্রি আছে কি না।”

জোহানের কথায় অকারণেই মিতুলের হৃদয় ঢিপঢিপ শুরু করলো। ও দাঁড়াতে পারলো না এখানে। কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল জোহানের রুম থেকে। জোহানের এই সামান্য কথায়ও এমন হচ্ছে ওর! কোনো রোগে পেল না কি ওকে?
জোহানের রুম থেকে একটা রুম রেখেই জায়িনের রুম। জায়িনের রুমের দরজা সাধারণত বন্ধই থাকে। আজকে খোলা দেখলো। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে জায়িন ব্যাগ গোছাচ্ছে। টরোন্টো যাওয়ার জন্য নিজের প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। মিতুল কতক্ষণ খোলা দরজা দিয়ে জায়িনের দিকে তাকিয়ে ছিল জানে না। হঠাৎ করে জায়িনের দৃষ্টি ওর উপর পড়তেই নিজের সম্বিৎ ফিরে পায় ও। চোখ নামিয়ে ফেলে। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে মিতুলের। চোরের মতো জায়িনকে দেখছিল? হায়রে! কী ভাববে জায়িন? মিতুল আড়চোখে দেখতে পেল জায়িন এগিয়ে আসছে। মিতুল কী বলবে মনে মনে প্রস্তুতি নিতে চাইলো। কিন্তু মাথাতে কিছু এলো না। জায়িন প্রায় দরজার কাছাকাছি এসে গেছে।
মিতুল চোখ তুলে তাকালো। কিছু একটা বলবে বলে মুখ খুলতে যাবে, এর মাঝেই জায়িন ওকে অপমানের সাগরে ঠেলে দিয়ে ওর মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জায়িনের অপমানে মিতুলের মুখ হা হয়ে গেল। ওর মাথায় কেবল ঘুরলো একটি শব্দ, সেটি হলো, ‘অপমান’। এই অহংকারী জায়িন আবার অপমান করেছে ওকে!

জোহান রুম থেকে বের হয়ে জায়িনের রুমের সামনে মিতুলকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এলো। মিতুলকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললো,
“স্ট্যাচু খাতায় নাম লিখলে কবে? আমাকে একটু খবরও দিলে না যে?”

জোহানের কথা কানে আসতে পাশ ফিরে তাকালো মিতুল। ওর মন যে কী পরিমাণ বিষাক্ত এখন তা কেবল ও জানে। এই বিষাক্ত মনের সৃষ্টি করেছে জায়িন। মিতুল জায়িনের রাগটা সম্পূর্ণ জোহানের উপর মেটালো। জোহানকে জোরে একটা ধাক্কা দিলো। জোহান দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলো।
মিতুল গটগট করে চলে এলো নিজের রুমে। আসতে আসতে পিছনে জোহানের বিরক্তি কণ্ঠ শুনতে পেল,
“হেই, তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? না কি হুটহাট করে আমাকে আঘাত করবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছো?”

___________

ঘড়িতে চারটা বাজতে না বাজতেই জোহান লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বের হলো। নিচে না গিয়ে প্রথমে এলো মিতুলের দরবারে। দরজা বন্ধ। জোহান নক করলো।
দরজা খুললো।

“হেই তুলতুল, তোমার কাছে একটা আইলাইনার হবে?”

মিতুল জোহানকে দেখছে। জোহানের মাথায় বাঁকা করে একটা কালো ক্যাপ পরা। গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট। পরনে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। তাও কালো। তবে কিছুটা ফ্যাকাশে। পিঠে একটা ব্যাগও আছে। ওর পাশেই আবার লাগেজ রাখা। মিতুল বললো,
“আইলাইনার দিয়ে কী করবে? চোখে ইউজ করবে?”

জোহান যেন মিতুলের উপর একটু বিরক্ত হলো।
“আমি আইলাইনার ইউজ করি না।”

“তাহলে কেন চাইছো আইলাইনার?”

“দরকার আছে তাই চাইছি। তুমি আনো।”

জোহান কী করবে তা দেখার জন্য মিতুল আইলাইনার এনে দিলো। জোহান যা করবে তা ওর ধারনাতেও ছিল না। পেন আইলাইনারটা জোহানকে দিতেই, জোহান মিতুলের এক হাত ধরে আইলাইনার দিয়ে নিজের নাম লিখে দিলো হাতের তালুতে।
মিতুল অবাক হয়ে জোহানের দিকে চাইলো।
জোহান বললো,
“ভিন্ন ধারায় তোমাকে নিজের সিগনেচার দিলাম। কলমে নয় আইলাইনারে। আশা করি মনে রাখবে কেউ তোমার হাতে আইলাইনার দিয়ে সাইন করেছিল। ফেমাস কেউ নয়। তবে ফেমাসের পথে। মনে রেখো কিন্তু। সবার জীবনে এমন বিস্ময়কর স্মৃতি থাকে না। আমি জন্ম দিলাম তোমার জীবনে একটি বিস্ময়কর স্মৃতির।”

মিতুল সিগনেচারটার দিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে বললো,
“এটা কেন করলে?”

“যাতে তুমি আমায় মিস করো সেজন্য। তুমি তো বলেছিলে তুমি না কি আমাকে মিস করবে না। যদিও আমি জানতাম তুমি আমাকে মিস করবে। তবুও মিসটা আরও কিছুটা গভীর করে দিলাম আমি। অনেক বেশি মিস করো কিন্তু আমায়। এবং নায়াগ্রা ফলস দেখার সময় মনে মনে বলো, ‘জোহানের সাথে এই মুগ্ধ, বিস্ময় প্রকৃতিতে হারিয়ে যাব আমি। আমার অবুঝ মনের আসল চাওয়া আমিও খুঁজতে পারি’।”

কথাটা বলে হেসে চলে গেল জোহান। ফেলে গেল নিজের ঝাপসা কথার গাঢ় ছায়া।

(চলবে)

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৩০
____________

আজকের দিন রোদ্রজ্জ্বল, ঝকঝকে। নায়াগ্রা ফলস দেখার জন্য এমন একটি দিনই সেরা। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখা গেছে আজকে সারাদিনই এমন রোদ থাকবে। মিতুল’রা দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়লো নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে। টরোন্টোর একটি হোটেলে উঠেছে ওরা। এখান থেকে নায়াগ্রা পৌঁছতে এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের মতো লাগলো। টরন্টো থেকে নায়াগ্রার অবস্থান প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে।
নায়াগ্রা এলাকায় প্রবেশ করার পর মিতুলের চক্ষু চড়কগাছ। জলপ্রপাত কোথায়? সারি সারি ভবন, ক্যাসিনো, হোটেল-মোটেল, নানা রঙ-বেরঙের আয়োজন চারপাশে। অন্য এক ঝকঝকে শহর। কিছুক্ষণের মধ্যে ভুল ভাঙলো ওর। জানতে পারলো, মূলত নায়াগ্রা ফলসকে কেন্দ্র করে আশেপাশে বিনোদন নগরী গড়ে উঠেছে।

প্রথমেই মিতুলরা গিয়ে দাঁড়ালো নায়াগ্রার সেই অংশের পাশে, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ঘনফুট জলরাশি প্রায় একশ নব্বই ফুট নিচে আছড়ে পড়ছে। নিচ থেকে এ জায়গাটির উচ্চতা তেরো তলা ভবনের সমান। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবস্থান কানাডা ও আমেরিকার মাঝখানে। একপাড়ে কানাডা, অন্যপাড়ে আমেরিকা। জলপ্রপাতের পানি পড়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল নদী তৈরি হয়েছে। সারাক্ষণ প্রচণ্ড বেগে ঝরনা ধারা চলছেই। আর পাহাড়ের মধ্যেই শহর। সুবিশাল এলাকায় কয়েক’শ ফুট উঁচু থেকে জলের ধারা নামছে।
মিতুল রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকালো। বিপুল জলরাশি নিচের পাথরে ধাক্কা খেয়ে অসংখ্য জলকণা সৃষ্টি করছে, যা আবার উপরে উঠে আসছে।
জলপ্রপাতটির পানির ধারার বেগ এতই যে, নদী থেকে ছিটকে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কুয়াশার মতো ভাসতে থাকে। দেখে মনে হয় যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলী। আর আশেপাশের এলাকায় বৃষ্টির মতো জল ঝরতে থাকে অবর্ণনীয়!
মিতুলরা যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি নায়াগ্রার তিনটি প্রবাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। এটির নাম, ‘হর্সসু’। হর্সসুয়ের বেশির ভাগটাই কানাডাতে পড়েছে।

মিতুলের হঠাৎ জোহানের কথা মনে পড়ে গেল। জোহানের কালকে বলা শেষ কথাটি এক বার মনে মনে আওড়ালো মিতুল,
‘জোহানের সাথে এই মুগ্ধ, বিস্ময় প্রকৃতিতে হারিয়ে যাব আমি। আমার অবুঝ মনের আসল চাওয়া আমিও খুঁজতে পারি।’
এই কথাই তো জোহান ওকে বলতে বলেছিল মনে মনে। কিন্তু কেন? কী মানে এই কথার? মিতুল কাল থেকে ভেবেও কোনো মানে দাঁড় করাতে পারেনি। ওর মনে হচ্ছে জোহান নিজেও জানে না নিজের এই কথার মানে। পাগলের মতোই একেক সময় আজব আজব কথা শোনায় ওকে। যেটার মানে জোহান নিজেই জানে না, সেটার মানে ওর খুঁজে বের করা তো ইম্পসিবল। মিতুল জোহানের কথা মাথা থেকে ঠেলে বের করে দিলো।

পাশেই মার্কেট এবং মিউজিয়াম রয়েছে। ওদিকে যাওয়ার আগ্রহ দেখা গেল না রেশমী আন্টি এবং জায়িনের মাঝে।
রেশমী আন্টি বললেন, মিউজিয়ামে আছে নায়াগ্রার ওপর তথ্য, ছবি ইত্যাদি।
চোখের সামনে প্রকৃতির অপার প্রাণময় সৌন্দর্য দেখে, তথ্যের জন্য মিউজিয়ামে যাওয়ায় মিতুলের মন টানলো না। ওর এসব তথ্য জানাজানিতে আবার ভীষণ অনীহা।
অনেকটা সময় ধরে মিতুলরা নায়াগ্রার পাশে থাকলো। যে জায়গাটায় পানি পড়ছে তার যতটা কাছে যাওয়া যায়, গেল। চেষ্টা করলো পানি পতনের শব্দ শুনতে।

সন্ধ্যার পরপরই হোটেলে ফিরলো মিতুলরা। ট্যাক্সি একেবারে হোটেলের সামনে এসে থেমেছে। সবার আগে ট্যাক্সি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে হোটেলে ঢুকে গেল জায়িন।
মিতুল লক্ষ্য করেছে জায়িন কেমন গম্ভীর ভাব নিয়ে থেকেছে সারাদিন। যদিও জায়িন একটু গম্ভীর স্বভাবেরই। তবে আজকে গাম্ভীর্য ভাবটা অন্য রকম ছিল। একটু বেশিই। শুধু আজকে না। কালকে থেকেই এমন করছে জায়িন। ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে অপমানও তো করলো কালকে। কালকের অপমানের কথা মনে পড়তেই মিতুলের মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে বার বার। আজকে সারাদিন কত কষ্টে যে জায়িনের সাথে ছিল, তা শুধু ও জানে। যে লোকটা ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে কালকে অপমান করেছে, সেই লোকটার সাথে আজকে ঘুরে বেড়ানো কোনো স্বস্তির বিষয় নয়। কিন্তু জায়িনের হঠাৎ এত গাম্ভীর্যের মানে কী সেটা ও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে কী হলো জায়িনের?

জায়িন রুমে এসেই উইন্ডোর কাছের আর্ম চেয়ারে বসে পড়লো। আজকের দিনটা বড্ড বাজে ভাবে কেটেছে ওর। টরোন্টোতে ওর কোনো কাজ নেই, অথচ নিজের অফিসের কাজ ফেলে টরোন্টো এসে বসে আছে। মম কীসের জন্য বলিয়ে, কইয়ে ছুটি নেওয়ালো? নিজেই তো মিতুলকে ঘুরিয়ে দেখাতে পারে সব। শুধু শুধুই ওকে এনেছে সাথে। ড্যাম ইট! জায়িন চেয়ার ছেড়ে উঠে জ্যাকেটটা খুলে রাখলো। ফ্রেশ না হয়েই গা এলিয়ে দিলো বিছানায়।
চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ গত কালকের কথা মনে পড়ে গেল। কালকে সকালে ফ্রেডি ফোন করেই জোহানের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছিল, জোহানের কিছু হয়েছে কি না। হঠাৎ করে জোহানের সম্পর্কে এমন প্রশ্ন করার কারণ জানতে চাইলেই ফ্রেডি বললো, জোহান আজব আচরণ করেছে ওর সাথে। কফিশপে গিয়েছিল ও। সেখানে হঠাৎ মিতুলের সাথে দেখা হয়ে যায়। তো, মিতুলের সাথে কথাবার্তা বলছিল। এর মাঝেই জোহান হুট করে কোত্থেকে এসেই উগ্র টাইপ আচরণ করেছে ওর সাথে। মিতুলকে ওর সামনে থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে।
ফ্রেডির কাছ থেকে খবরটা শুনেই প্রচণ্ড রকমের মাথা গরম হয়েছিল জায়িনের। যদিও জোহানকে এ নিয়ে কিছু বলেনি ও। জোহানের সাথে কথা বলতেও অনিচ্ছা হয় ওর। জোহান কী করে ওর ফ্রেন্ডের সাথে এরকম বিহেভ করে সেটা এখনও বুঝে আসছে না ওর। জোহান দিনকে দিন নিজের উগ্র আচরণ ওর ফ্রেন্ডসদের সাথেও দেখানো শুরু করেছে! কত বড়ো স্পর্ধা জোহানের!
আর মিতুল! মিতুলের সাথে জোহানের এত ঘোরাঘুরি, হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া, এসব তো মোটেই স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক! দৃষ্টিকটু। যেটা ওর দৃষ্টি অতিক্রম করে ওর মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে সরাসরি। মিতুলের সাথে জোহানের এত মেলামেশা, ঘোরাঘুরি অত্যাধিক খারাপ লাগে ওর। সহ্য হয় না! ধীরে ধীরে এই অসহ্যের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে আরও। কেন এমন হচ্ছে জানে না ও। শুধু জানে জোহানের সাথে মিতুলের মেলামেশা অপছন্দ ওর। অসহ্য লাগে এসব। জোহান এবং মিতুলের ব্যাপার যে স্বাভাবিক নয়, সেটা ভ্যাঙ্কুভার থাকতেই টের পেয়েছিল। যেদিন জোহান উইনিপেগ থেকে ভ্যাঙ্কুভার এসেছিল!

______________

তিন দিনের সফর শেষ হলে এডমন্টন ফিরে এলো মিতুল’রা। আজকের সকাল নয় টার ফ্লাইটে এসেছে। মিতুলের চোখে এখনও নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ঘোর লেগে আছে। কী বিস্ময়, মুগ্ধ ঘেরা প্রকৃতি। আসার আগে আরও একবার গিয়েছিল সেখানে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছাড়াও টরন্টোর আরও কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘুরেছে। আর্ট গ্যালারি অব অন্টারিও, হাই পার্ক, কাসা লোমা, টরন্টো জু ইত্যাদি জায়গায় ঘুরেছে।

বাড়ি ফিরেই বেশ উদাস উদাস অনুভব করছে মিতুল। টরোন্টো যাওয়ার পর জোহান একবারও কল দেয়নি ওকে। আর না দিয়েছে একটা ম্যাসেজ। জোহান কল, ম্যাসেজ দেয়নি দেখে রাগ করে ও নিজেও দেয়নি আর। বন্ধুদের সাথে সাত দিন ব্যাপী পার্টি করায় ওকে ভুলে গেল না কি জোহান? হ্যাঁ, যেতেই পারে। জোহানের দ্বারা এসব সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ও ভুলে যায়নি। ঠিকই মনে রেখেছে জোহানকে। শুধু মনেই রাখেনি, টরোন্টো থেকে গিফটও কিনে নিয়ে এসেছে ওর জন্য। আর এই গিফটা দেবে বলেই ওর মন এত আকুপাকু করছে। কবে বাড়ি ফিরবে জোহান? সাত দিন এখনও হয়নি?

সকাল কাটলো কেমন একাকীত্ব একাকীত্ব নিয়ে। দুপুরটাও তাই। বিকেলটাও তেমনই কাটছে এখন। মোবাইল সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু কোনো কলই আসছে না। হ্যাঁ, দুইবার এসেছিল। কিন্তু তা বাংলাদেশ থেকে আব্বু এবং ছোট মামনির ছিল। জোহানের নয়।
মিতুল শেষমেশ আর নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারলো না। ছুটে এলো ক্যামিলার কাছে।
ক্যামিলা এখন গার্ডেনে। আনারস কাটছিল। মিতুল এসেই বললো,
“জোহান কবে বাড়ি ফিরবে বলো তো?”

ক্যামিলা একবার চোখ তুলে তাকালো মিতুলের দিকে। তারপর আবার অনারস কাটায় মন দিয়ে বললো,
“জোহান কোথায় গেছে যে বাড়ি ফিরবে?”

মিতুল সন্দিহান দৃষ্টি মেলে চাইলো।
“মানে? জোহান রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে নেই? সাত দিন ব্যাপী পার্টি করছে না ওরা?”

ক্যামিলা একটু হেসে বললো,
“না নেই। গিয়েছিল পার্টির জন্য। কিন্তু ওদের পার্টি হয়নি। জোহান বাড়িতেই আছে। এ কদিন বাড়িতেই ছিল। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠে টাইম হাউজে গেছে ও।”

মিতুল হা হয়ে ক্যামিলার কথা শুনলো। জোহান বাড়িতে ছিল? একটু আগেও নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিল? এর মাঝে ও টের পায়নি? সেই সকাল থেকে বাড়িতে, অথচ এক বারও দেখা হয়নি জোহানের সাথে? জোহান একবার দেখা করতেও আসলো না? এতটা বেইমান জোহান?
মিতুল দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে এলো।
ছোট একটা বক্স নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ফেরত এলো গার্ডেনে। না, গার্ডেনে আসেনি। টাইম হাউজে যাবে বলে এসেছে।
মিতুল জোহানের জন্য আনা গিফট নিয়ে জঙ্গলের পথে চলে গেল।

ক্যামিলা মিতুলের কাণ্ড দেখে নিঝুম হাসলো পিছনে বসে।

মিতুল টাইম হাউজের কাছাকাছি আসতেই জোহানকে দেখতে পেল। সিঁড়িতে গিটার নিয়ে বসে আছে। একেবারে কাছে এসে দেখলো সাথে পেপার, পেনও আছে।

মিতুল এসেই বলে উঠলো,
“তুমি কি মানুষ? তুমি এই চার দিনে একটা বারও কল দিলে না আমায়। একটা ছোট ম্যাসেজও দাওনি। বাড়িতে বসে থেকে, রিকার্ডোর ফ্ল্যাটে আছো এমন মিথ্যা বুঝে রেখেছো আমাকে। এমন কেন করেছো তুমি?”

জোহান নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
“কল? ম্যাসেজ? আমি কি এমন কোনো ওয়াদা করেছিলাম যে তোমাকে প্রত্যেক দিন কল, ম্যাসেজ দেবো?”

মিতুল থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু দমলো না।
“না আমার কাছে কেন এমন ওয়াদা করবে? কেনই বা আমার কাছে কল দেবে? গার্লফ্রেন্ড আছে না? গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেই পুরো দিন পার করবে।”

মিতুলের কথায় বিরক্ত হয়ে এবার জোহান সিঁড়ি থেকে উঠে এলো।
“লিসন, ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। একটা কথা বার বার কেন বলতে হয় তোমাকে?”

“আবারও ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছো?”

“ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করছি না। আমি ইনোসেন্টই। কার্লের মতো ইনোসেন্ট সাজার অভিনয় করি না।”

কার্লের কথা গায়ে লেগে গেল মিতুলের।
“কথায় কথায় কার্লকে কেন টানো? কে বলেছে তোমাকে কার্ল ইনোসেন্ট সাজার অভিনয় করে? ও ইনোসেন্টই। অভিনয় করতে হয় না ওর। যা অভিনয় করার তা তো তুমি করো। অবশ্য তাও পারো না।”

“বাহ, কখনো ফ্রেডির জন্য টান লাগে তোমার, কখনো কার্লের জন্য। এদের জন্য এত টান অনুভব করো কেন তুমি? কী এমন বিশেষত্ব আছে ওদের মাঝে?”

“ফ্রেডির সাথে কার্লকে মিলাবে না। ফ্রেডির কোনো যোগ্যতা নেই কার্লের মতো হওয়ার। কার্ল অনন্য।”

“কী? অনন্য?” মুখ টিপে হাসলো জোহান।
যা খুব করে গায়ে লাগলো মিতুলের।
ইতোমধ্যে মিতুলের হাতের ছোট বক্সটি নজরে এসেছে জোহানের। জোহান এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
“এটা কী?”

মিতুলের মন মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। মিতুল বক্সটা উঠিয়ে বললো,
“এটা? এটা তোমার জন্য।”

জোহান বিস্ময়ের সাগরে ডুবে গেল।
“আমার জন্য?”

মিতুল হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ইয়াহ, ইট’স ইওর।”

মিতুল বক্সটা খুললো। একটা কলম দেখা গেল ভিতরে।
জোহান বললো,
“পেন?”

মিতুল কলমটা তুলে নিলো। জোহানের এক হাতে কলমটা দিতে দিতে বললো,
“হুম পেন। নিজে গিয়ে কিনেছি তোমার জন্য। টরন্টোর শপ থেকে। যখন তুমি ফেমাস হবে, তখন অটোগ্রাফ দেবে এটা দিয়ে। ভেবো না যে সস্তায় কিনেছি। অনেক দামি এটা। জীবনে এত দামি পেন কিনিনি কারও জন্য। নিজের জন্যও না। ফেমাস হলে তো অবশ্যই দামি পেন দিয়ে অটোগ্রাফ দিতে হবে তোমার। সে কথা চিন্তা করে অনেক দাম দিয়েই পেনটা কিনেছি তোমার জন্য।”

জোহান একবার হাতের পেন দেখলো, আরেকবার মিতুলকে।
মিতুল হঠাৎ কেমন নিস্তেজ কণ্ঠে বললো,
“তুমি যখন ফেমাস হবে, তখন তো আমি থাকবো না এখানে। আমি তো মাত্র তিন মাসের জন্য এখানে এসেছি। নয়তো ফেমাস হওয়ার পর প্রথম অটোগ্রাফটা আমিই নিতাম।”
মিতুল একটু থামলো। হঠাৎই আবার হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“থাক, কোনো ব্যাপার না। প্রথম অটোগ্রাফ আমি নিতে পারবো না তো কী হয়েছে। আমার দেওয়া পেন দিয়ে তুমি অটোগ্রাফ দেবে সেটা তো অনেক আনন্দের হবে, তাই না? আমার দেওয়া পেন দিয়েই কিন্তু অটোগ্রাফ দিও। ফেমাস হয়ে যাওয়ার পর আবার আমার পেনকে তুচ্ছ করে ফেলে রেখো না।”
বলে যাওয়ার পথ ধরলো মিতুল।

জোহান পিছন থেকে তাকিয়ে রইল।
মিতুল বেশ কয়েক পা দূরে চলে যাওয়ার পর জোহান পিছন থেকে ডাকলো,
“হেই তুলতুল!”

জোহানের ডাক কানে আসার সাথে সাথে মিতুলের পা থেমে গেল। পিছন ফিরে তাকালো ও।
জোহান ঠোঁটে মৃদু হাসি ধরে রেখে এগিয়ে এলো ওর কাছে। কাছে এসে দুই হাতে মিতুলের চিবুক ধরে বললো,
“ফেমাস হওয়ার পর আমার প্রথম অটোগ্রাফ আমি তোমাকেই দেবো। তুলতুলের দেওয়া কলমেই অটোগ্রাফ দেবে জোহান। আর এই জোহান যখন ফেমাস হবে, তখন তুলতুল ওর সাথেই থাকবে। শুধু ফেমাস হয়ে যাওয়ার সময়েই নয়, তুলতুল সবসময়ই এই জোহানের সাথেই থাকবে।”

(চলবে)