#চৈত্রিকা
#সূূচনা_পর্ব
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
১.
-তোর বিয়ে পাকা হয়ছে চৈত্র। জমিদারের বড় ছেলের সাথে। ওই যার বউটা ম’রলো না! পরবর্তী জমিদার প্রহর রেনওয়াজ।’
মামাতো বোন সাথীর কথায় চোখ পিটপিট করে তাকায় চৈত্রিকা। বেশ অবাকই হয়েছে বটে সে। তার বিয়ে কি না বিবাহিত পুরুষের সাথে! তার বয়স কেবল ১৭ আর তার জানামতে জমিদারের সে ছেলে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী। যেমন রাগী তেমন গম্ভীর, তেজী, অহং’কারীও বটে। সে ছেলেকে পুরো গ্রাম ভয় পায়। জমিদার চয়ন রেনওয়াজের দয়া মায়া থাকলেও প্রহর রেনওয়াজের মধ্যে দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও নেই। নেই মানুষকে বোঝার ক্ষমতা। সুদর্শন এই পুরুষের মনে কোনো নারী দাগ টানতে না পারলেও তার বউ মহুয়া ভীষণ করে দাগ টেনেছিলো। সে বউয়েরও মৃ’ত দেহ উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৩ মাস আগে। চৈত্রিকা নিজের হাতে চুলগুলো আলগোছে খোঁপা করে নিলো। বারান্দা ছেড়ে উঠে নিজের মাটিতে গড়াগড়ি করা শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে অনুভূতিশূণ্যের মতো বললো,
‘বিয়েটা কি মামা ঠিক করলো!’
সাথী মাথা নাড়ায়। চৈত্রিকা আর কিছু না বলে নিজ জায়গা ত্যাগ করে। সাথী জানে এই নিশ্চুপতার কারণ৷ সে জানে এই বিয়েটা চৈত্রিকা করবে। দীর্ঘশ্বাস নেয় সে। চৈত্রিকার ভাগ্যের কথা ভেবে আফসোসও করে। এই তো গতবছর বাবা মা হারালো মেয়েটা। এই মেয়ের সৌন্দর্যের জন্য তার ফুপিমনিরা কতবার যে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। যেখানেই যাক না কেনো! হা’য়নারা সবসময় উৎ পেতে থাকে। মায়াবী চোখে যখন মেয়েটা তাকায় তখন মনে হয় এ চোখেই ডুবে ম’রা যাবে৷ নামের মতোই তার তেজ। মেয়েটার দিকে তাকালে মনে হয় চৈত্র মাসের উত্তপ্ত রৌদ্রের মতো চোখ ঝলসে যাবে। অথচ মেয়েটা কি ভীষণ শীতল স্বভাবের। মেয়েটা বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়া স্বত্বেও এখানে পড়ে থেকে তাকে অ’ত্যা’চা’র সহ্য করতে হয়। জমিদারের সুপুত্রকে বিয়ে করাটা অনেক মেয়ের কাছে সৌভাগ্য হলেও চৈত্রিকার জন্য তা ভ’য়ং’কর। আর যদি হয় তা প্রহর রেনওয়াজ তাহলে যেকোনো মেয়ে তার ভ’য়ং’কর রুপের কথা জানে। হঠাৎ তাদের নজর চৈত্রিকার দিকে পড়ার কারণ কি!
চৈত্রিকা এলোমেলো পায়ে মামার ঘরে আসে। ঘরের বাহির থেকে টোকা দিয়ে বললো, ‘আসবো মামা!’
ভেতর থেকে চৈত্রিকার কন্ঠ শুনে আজম আলী লাফিয়ে উঠলেন। চকচক করা চোখ দুটো নিয়ে দ্রুত কন্ঠে বললো, ‘আয় চৈত্র।’
চৈত্রিকা নিজেকে শক্ত করে নেয়। আশে পাশে তাকিয়ে হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের শাড়ি ঠিক করে নেয়। আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে ঘরের মধ্যে পা রাখে। আজম আলী দৌড়ে এসে চৈত্রিকার বাহুতে হাত রেখে বললো, ‘বোস এখানে!’
তার হাতদুটো শুধু ধরে রাখাতে নেই। হাত ততক্ষণে স্লাইড করা শুরু করেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসলেও স্বাভাবিক ভাবেই মামার হাত সরিয়ে দিতে নিলে আজম আলী সে হাতই চেপে ধরে। চৈত্রিকা চমকে হাত সরাতে সরাতে বলে,
‘হাত ছাড়েন মামা! আমি কিন্তু প্রহর রেনওয়াজকে সব বলে দিবো!’
প্রহরের কথা আসতেই আজম আলী ভ্রু কুঁচকায়। হাতটা ছেড়ে দিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে, ‘প্রহর রেনওয়াজকে বলে দিবি মানে? কি বলবি? আর সে তোর কথা শুনবে? ‘
চৈত্রিকা মৃদু হাসে। হাতের মুঠোয় রাখা সেফ্টিপিনটা হাতেই ঘুরাতে ঘুরাতে উত্তর দেয়, ‘আপনিই না আমার বিয়ে পাকা করে এসেছেন! তা প্রহর রেনওয়াজের হবু বউয়ের গায়ে হাত লাগলে বুঝি উনি আপনাকে ছেড়ে দেবে?’
আঁতকে ওঠে আজম। কি বললো এটা চৈত্রিকা! প্রহর আর চৈত্র! হিসাবটা গড়মিল হলো। কোনো কিছু হাতড়েও খুঁজে পেলো না। অবশেষে চৈত্রিকাকেই বেশ ব্যস্ত কন্ঠে শুধালো,
‘তোকে কে বললো আমি বিয়ে পাকা করেছি!’
চৈত্রিকা উত্তর দিলো না। শুধু বললো, ‘তাদের বলে দিবেন আমি রাজী।’ এটুকু বলেই ঘর ছাড়ে চৈত্রিকা। আজম আলী মাথাায় হাত দিয়ে বসে পড়েন। তিনি যা ভাবছেন তা যদি হয় তবে ধ্বং’সের খেলা শুরু হয়ে যাবে। একের পর এক পাপ ধীরে ধীরে শেষ হবে। শেষ হবে জমিদারের একেকটা পাপ। তার এই জমিদারী বেশিদিন কুলোবে না। ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে ছুট লাগালেন জমিদার বাড়ির দিকে। চৈত্রিকা মামার ব্যস্ত পায়ে যাওয়াটা দেখে হাসলো। গুণগুণ করে গান ধরে। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এসে সাথীর কাছ ঘেষে দাঁড়ায়। সাথী কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুই তাহলে বিয়েটা করছিস!’
‘না করার কি আছে! কোনো মেয়ে কি চাই এতো ভালো সম্বন্ধ ছেড়ে দিতে! তাও আবার আমার মতো বাপ-মা ম’রা মেয়ে!’
‘অন্তত আমাকে বুঝ দিস না চৈত্র। আমি তোকে চিনি৷ আমি জানি তোকে। তুই কতটা ঘৃ’ণা পুষে রেখেছিস ওই জমিদারদের জন্য তা তো আমার থেকে ভালো কারোর জানার কথা না! কিন্তু তাই বলে বিয়ে?’
চৈত্রিকা একটা কথারও জবাব দিলো না। শুধু চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে অথচ ওপরটা কত শান্ত। এটাই কি চৈত্রিকার বৈশিষ্ট্য! যে মেয়ের রুপে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাকে এক নজর দেখলে সহজেই মায়ায় পড়ে যাওয়া যায় সে মেয়ের মনে ভেতর এতো জ্বলন্ত আগুন কেন? কেউ কি এই মায়াবী চেহারা দেখে ঘুনাক্ষরেও টের পাবে মেয়েটার ভেতরের দহন!
সাথী কয়েক পল তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আব্বার রুমে কেনো গেছিলি?’
চৈত্রিকা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। সাথীর হাতের ফাঁকে হাত গলিয়ে এগোতে এগোতে বলে, ‘কেনো আবার! আমি যে বিয়েতে রাজি তা বুঝি বলবো না!’
সাথী আর কিছু বলে না৷ চৈত্রিকার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। চৈত্রিকা হাঁটতে হাঁটতে মুখে একটা কাপড় বেঁধে নেয়। সাথী জানে এটার মানে। তাই সে নিজেও মুখটা বেঁধে নেয়৷ দুজনে শাড়ি ঠিক করে ফের হাঁটতে শুরু করে৷ হাঁটতে হাঁটতেই চৈত্রিকা শুধায়,
‘মামী কোথায় রে সাথী? সকাল থেকে একবারও দেখলাম না যে!’
‘আম্মা একটু নানার বাড়ি গেছে। কি যেনো কাজ আছে তাই সকালেই বেড়িয়ে গেছে।’
চৈত্রিকা আর প্রশ্ন করে না। তবে কাপড়ের নিচে থাকা তার মুখের কোণে লেগে থাকে অদ্ভুত হাসি। কিছুটা পথ যাওয়ার পর বলে, ‘কোথায় যাবি চৈত্র?’
‘তোর হবু দুলাভাই অর্থাৎ জমিদারের বড় পুত্র প্রহর রেনওয়াজের সাথে ছোট্ট একটা সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি।’
থেমে যায় সাথীর পা। আঁতকে উঠে দু পা পিছিয়েও যায়। আতঙ্কিত চোখে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর মাথা ঠিক আছে? ওদিকে যাওয়া তো আমাদের জন্য নিষেধ। মা কি বলেছে মনে নেই তোর?’
‘মামী আমাদেরকে জমিদারের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে। আমরা কি জমিদারের বাড়ি যাবো নাকি গা’ধী?’
‘ তাহলে কোথায় যাবি?’
‘চল! এখন যেখানে তাকে পাওয়া যাবে সেখানেই যাবো। শুধু ছোট্ট একটা সাক্ষাৎ দিয়ে উধাও হয়ে যাবো।’
সাথী চৈত্রিকার কথার মানে বুঝলো না। তবে ভয় পেলো ভীষণ। যাবে না যাবে না করেও চৈত্রিকার জিদের সাথে হার মেনে সে যেতে রাজি হলো। সাথীর এতো ভয় পাওয়াটা মোটেও তার পছন্দ হয়নি। তবে এ ভয়ের কারণ তার কাছে অজানা নয়। দুজনে একটা বাগান পেড়িয়ে পুকুরপাড়ে আসে। একটা বড় গাছের পেছনে লুকিয়ে আশে পাশে দৃষ্টি দিতেই সাথী আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,
‘চৈত্র রে আর এগোনোটা ঠিক হবে না রে। সামনে এগোনো মানেই বিপদ নিজের দিকে টেনে আনা। এমন ভুল করিস না।’
চৈত্রিকা জবাব দেয় না। আশে পাশে ভালো করে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায়। কেউ দেখে ফেলার চান্স নেই ভেবেই সাথীর হাত টেনে এগোতে নেয়। সাথী না এগিয়ে করুণ কন্ঠে বলে,
‘যাস না চৈত্র। বিপদ হবে।’
‘কিছু হবে না। আমার ওপর ভরসা নেই তোর?’
‘আছে। তবুও?’
চৈত্রিকা থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘তবুও টবুও আর কিচ্ছু না। প্রহর রেনওয়াজের কাছে আমার জবাব চাই।’
‘তুই না বললি ছোট্ট একটা সাক্ষাৎ দিয়ে বাড়ির পথে যাবি। তবে কিসের জবাব?’
চৈত্রিকা ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। সাথী দেখে না সে হাসি৷ সে তখনো আতঙ্কিত চোখে আশে পাশে তাকাচ্ছে৷ তার বারংবার মনে হচ্ছে বিপদ কাছে অথচ চৈত্রিকা এসব কিছু মানতেই নারাজ। শেষমেশ চৈত্রিকার কাছে হার মেনে সে চৈত্রিকার হাত চেপে মেপে মেপে পা ফেলে। গাছের আড়াল দিয়ে এগিয়েই একটা এক তলার পাকা, টিনশেড বাড়ির পেছনদিকে দাঁড়ায়। আরো একবার আশে পাশে ভালো করে দেখে নিয়ে জানালার ছোট্ট কপাটে চোখ রাখে। সাথীও একপাশ দিয়ে চোখ রাখতেই চমকে ওঠে। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
‘আব্বা!’
সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরে চৈত্রিকা। ফিসফিস করে বলে, ‘চুপ! কথা বলবি না। দেখ কি হয়!’
সাথী কেঁপে কেঁপে ওঠে। চৈত্রিকার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে তাকায় ঘরের ভেতর। সেখানে প্রহর রেনওয়াজের জায়গায় তার বাবা চয়ন রেনওয়াজ আর চৈত্রিকার মামা আজম আলী বসে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। আজম আলী জমিদারের উদ্দেশ্যে বললো,
‘জমিদার সাহেব আমি কখনো আপনার কথার ওপর কথা বলিনি। যখন যা বলেছেন, যা অর্ডার করেছেন সবটাই তো করেছি কিন্তু এ কেমন প্রস্তাব? চৈত্রকে কেন পুত্রবধূ করতে চাচ্ছেন? জানেন না ‘ও’ কার মেয়ে?’
চয়ন রেনওয়াজ বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমি সবই জানি। কিন্তু এখানে আমার কিছু করার নেই। তাছাড়া তোমার বোন আর বোনজামাই তো ম’রেই গেছে।’
‘তবুও একবার ভেবে দেখবেন। ওই মেয়ে কিন্তু এতোটাও সরল না যতটা আমরা ভাবি। ওই মেয়ে ভ’য়ং’কর। চৈত্র মাসের উত্তপ্ত রৌদ্রের মতো তার তেজ, তার স্বত্তা।’
‘ভেবো না আজম আলী। তোমার ভাগ্নী একবার জমিদার গৃহে প্রবেশ তো করুক তারপর দেখবে কিভাবে প্রহর তার বি’ষ দাঁত ভেঙে দেয়!’
আজম আলী সন্তুষ্ট হলেন না। মনে মনে কয়েকটা বি’শ্রী ভাষায় গা’লি দিলো। তারপর বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বললো, ‘শা’লা বুড়ো! তুই আর তোর ছেলে যখন নিজ ইচ্ছায় ম’রণ ডেকে আনতে চাস তখন ম’র। ভেবেছিলাম সুন্দরী ভাগ্নীটাকে কাছে রেখে আনন্দ করবো এখন তো আর তাও হবে না। এই দুই শা’লার জন্য আমার বারা ভাতে সবসময় ছাই পড়ে।’
চৈত্রিকা নিজের মামার যাওয়ার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কবে যেন সে নিজ হাতে এইটাকে খু’ন করে দেয়। শুধুমাত্র মামী আর সাথীর জন্যই এখনো সে চুপচাপ। এদের জন্য পাকাপোক্ত ভাবে কিছু করতেই হবে। সাথী ফ্যালফ্যাল করে নিজের আব্বার যাওয়ার দিকে তাকায়। তার আব্বার চরিত্র সম্পর্কে সে খুব ভালো করেই জানে। লোকটাকে তার আব্বা বলতেও ভীষণ ঘৃ’ণা করে। অথচ বাস্তব সত্য এই লোকটাই তার জন্মদাতা। নিজেকে সামলে চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘জমিদারের বড়পুত্র তো এখানে নেই চৈত্র। এখন!’
চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকায়। আসলেই তো! আজকে প্রহর এখানে নেই কেনো? ভাবতে না ভাবতেই তাদের বক্ষ কাঁপিয়ে এক কন্ঠ ভেসে আসে,
‘কে ওখানে? কি করছো ওখানে দাঁড়িয়ে!’
চলবে..