#চৈত্রিকা (১৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
৪৮.
পরেরদিন সকালে আজম আলীকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসে সনিয়া বেগম। বেলা তখন ১০ টা। আজম আলীর কাঁধে ব্যান্ডেজ। ব্যাথার ইনজেকশনের জন্য তাও ব্যাথাটা নেই। সনিয়া বেগম আজম আলীকে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বের হয় তখন প্রহর বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে সিগারেট ফুঁকছে। চৈত্রিকা আর সাথী ঘরের সব টুকটাক কাজ শেষ করছে। আজম আলী প্রহরকে দেখে ভয় পায়। প্রহর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। সিগারেট ফেলে দিয়ে পায়ে পিষে সিগারেটের আগুন নেভায়। তারপর এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
‘মামাশ্বশুড়ের অবস্থা কি? হাসপাতালে মজা পাইছেন তো মামা? বেশি কষ্ট হয়নি তো?’
আজম আলীর শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে যায়। সনিয়া বেগম স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সবটা দেখে। আজম আলীর প্রতি তার মনে যতটা ক্ষো’ভ আছে তাতে আজম আলীর এই অবস্থা দেখে সে এতটুকুও ব্যাথিত নয়। উল্টো কেউ তো জা’নো’য়া’রটাকে পিষে দিয়েছে এটাই শান্তি। আজম আলীকে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। প্রহর শরীর টানটান করে হাসে৷ হাক ছেড়ে ডাকে চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা কলপাড় থেকে বের হয়ে আসে ভ্রু কুঁচকে। বেশ রাগী কন্ঠে বলে,
‘চেঁচান কেন? কি সমস্যা?’
‘আরেহ বউ তোমার মামা আয়ছে হাসপাতাল থেকে। যাও যাও তার সেবা করো!’
‘আপনার মন চাইলে আপনি করেন। আমার কাজ আছে।’
প্রহর পাত্তা দেয় না চৈত্রিকার কথা। নিজের মতো বাড়ি থেকে বের হতে হতে বলে, ‘বিকেলে তৈরী হয়ে থাকবা আমরা আজ বাড়ি যাবো।’
চৈত্রিকার কপালের ভাজ দৃঢ় হয়। প্রহরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে। সে সময় ঘর থেকে বের হয় সনিয়া বেগম। চৈত্রিকা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কন্ঠস্বর নরম করে বলে,
‘সারা রাত তোমার কিছু খাওয়া হয়নি মামি। চলো কিছু খেয়ে নাও! মামাও তো খাবে তাই না?’
সনিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। বলে, ‘সাথী কোথায়? কিছু খেয়েছে ‘ও’?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে। তারপর সনিয়া বেগমের হাত টেনে নিয়ে যায় খাবার ঘরে। সনিয়া বেগমকে খেতে বলে নিজে খাবার নিয়ে যায় আজম আলীর ঘরে। আজম আলী তখন ঘাড় বাকিয়ে শুয়ে ছিলো। চৈত্রিকা খাবার নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
‘ঘাড় বাঁকা মামা! জমিদার জামাই তাহলে হাসপাতালের স্বাদও খাইয়ে দিলো!’
আজম আলী চমকে তাকায়। চৈত্রিকার দিকে তাকাতেও ভয় পায়৷ চৈত্রিকা খাবার রেখে বলে, ‘আপনাকে এতো ঘৃ’ণার পরও আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার কারণ কি জানেন মামা? একেবারে ম’রে গেলে আপনার পাপের শা’স্তি কম হয়ে যাবে। আপনাকে তো মা’রবো তিলে তিলে। যেনো সমস্ত পাপের জন্য আপনার আক্ষেপ শেষ না হয়!
৪৯.
স্মরণ সকালেই জানিয়েছে বিয়েটাতে সে দেড়ি করতে চায় না। প্রহর আর চৈত্রিকা বাড়িতে ফিরলেই তাদের আকদের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। এতে কেউ সামান্যও আপত্তি করেনি। চয়ন নিজেও রাজি হয়ে গেছে। শুধু ভেতর ভেতর পু’ড়ছে চিত্র আর অর্পিতা। চিত্র একবার ভাবে সে সরাসরি অর্পিতা আর শিমুলের সাথে কথা বলবে আবার ভাবে এতে যদি হীতে বিপরীত হয়! কি করবে আর কি করবে না ভেবেই প্রায় পাগল পাগল অবস্থা চিত্রর। সারাটাদিন ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে শুয়ে ছিলো। পল্লবী কয়েকবার এসে দরজা থেকেই ঘুরে গেছে। চিত্র দরজা খোলেওনি কিচ্ছু খাইওনি। অর্পিতা নিজেও ঘর থেকে বের হয়নি। বাড়ির এতো সব ঝামেলার মধ্যে অর্থির কোনো হেলদোল নেই৷ সে তো আর জানে না তার প্রাণের ভাইয়ের কি অবস্থা! বিকেলে নিবিড় পড়াতে এসেছে। অর্থি আজ আগেই অঙ্ক করে রেখেছে। সেই অঙ্ক দেখে নিবিড় অবাক হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো অর্থির মুখের দিকে। তারপর গোল গোল চোখ নিয়ে বলে,
‘তুমি অঙ্কও করতে পারো মেয়ে? এতো ট্যালেন্টেড তুমি?’
অর্থির চোখ চকচক করে ওঠে। মুখটা খানিকটা এগিয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, ‘তাই না? আপনি শুধু শুধু এতোদিন আমাকে গা’ধা বলতেন মাষ্টারমশাই! দেখেছেন আমি কতো ট্যালেন্টেড!’
গর্বে বুক ফুলিয়ে খুশি খুশি মুখে তাকায় অর্থি। নিবিড় একবার খাতার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকায় অর্থির দিকে। অর্থির চোখ মুখ দেখে নিবিড়ের চোয়াল দ্বিগুণ শক্ত হয়। রাগে কিড়মিড় করতে করতে রাম ধমক লাগিয়ে দেয়। অর্থি ভয়ে চমকে ওঠে। চেয়ার থেকে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে ভোলা ভালা মেয়ের মতো তাকায়। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তুমি শুধু গা’ধা না তুমি আস্ত একটা গা’ধী, ব’লদ। মানুষ কি পর্যায়ের ব’ল’দ হলে করা অঙ্কও ভুল করে! আবার বলো যে তুমি ট্যালেন্টেড!’
অর্থি কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বলে, ‘আপনিই তো বললেন আমি ট্যালেন্টেড! এখন আবার বকা কেনো দিচ্ছেন মাষ্টারমশাই?’
‘তোমাকে এই অঙ্ক আমি করাইনি?’
অর্থি মাথা নাড়ে৷ নিবিড় রেগে বলে, ‘তাহলে ভুল করলে কেমন করে? এই পৃষ্ঠা উল্টে এপাশের অঙ্ক দেখে করলেও তো অন্তত অঙ্কটা সঠিক হতো!’
‘মাষ্টারমশাই আমি ভালো মেয়ে। ওসব বা’ট’পা’রি করি না আমি।’
‘তোমার মতো মেয়ে বা’ট’পা’রি করতেও পারবে না। বা’ট’পা’রি করতেও বুদ্ধি লাগে যা তোমার মাথায় ছিটেফোঁটাও নেই।’
অর্থি কাঁদো কাঁদো মুখ করে মাথা নিচু করে নেয়। নিবিড় বড় বড় শ্বাস নেয়। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে, ‘আচ্ছা আমি তোমাকে একটা কথা বলি! শোনো!’
অর্থি তাকায় নিবিড়ের দিকে। নিবিড় বেশ শান্ত স্বরে বলে, ‘দেখো আর মাত্র ২ মাস পরই তোমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। অথচ তুমি কিন্তু কিছু পারো না। এমন করলে কি তুমি পাশ করতে পারবে? আর তুমি যদি পাশ করতে না পারো তাহলে কি তোমার মান সম্মান থাকবে? লোকে যখন বলবে জমিদারের মেয়ে মাধ্যমিক ফেইল তখন কি তোমার ভালো লাগবে নাকি তোমার বাড়ির কারো ভালো লাগবে?’
‘নাহ।’
‘তাহলে কি তোমার উচিত না পড়ালেখা করা?’
অর্থি মাথা নাড়ায়। নিবিড় ভাবে অর্থি বোধহয় বুঝেছে কিন্তু নিবিড়কে হতাশ করে অর্থি বেশ উৎফুল্ল স্বরে বলে, ‘কিন্তু আমি তো কিছু পারি না মাষ্টারমশাই! আর এতো কষ্ট করে পড়ালেখার থেকে তো ভালো আমি ফেইল করে বিয়ে করে ফেলবো!’
নিবিড়ের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। টেবিলের নিচে বেত ছিলো৷ কোনো কিছু না ভেবেই ওই বেত তুলে নিয়ে সরাসরি অর্থিকে বলে, ‘হাত পাতো!’
অর্থি ভয়ে হাত আগায় না। ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে রাখে। নিবিড় রাগে নিজেই অর্থির হাত টেনে এনে ঠা’স করে দুটো বা’রি লাগিয়ে দেয়। ব্যাথায় অর্থির চোখ মুখ নীলবর্ণ ধারণ করে। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘অঙ্ক না পারার শা’স্তি এগুলো। এখন থেকে অঙ্ক না পারলে এভাবেই প্রতিটা অঙ্কের জন্য দুইটা করে বা’রি খাবা।’
ব্যাথায় অর্থির চোখ বেয়ে জল গড়ায়। মাথা নত করে হাত আগলে নিয়ে অন্য হাতে কাঁপা কাঁপা ভাবে কলম নেয়। অভিমানে আর একবারও চোখ তুলে তাকায় না নিবিড়ের দিকে।
৫০.
রাত তখন প্রায় ১০ টার মতো। যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রহর আর চৈত্রিকা আজ ফেরেনি। চিত্র সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখলেও রাতের বেলা হঠাৎ করেই ঘর থেকে বের হয়। মাথায় চেপে বসেছে নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জিদ। চয়ন তাকে ঠ’কিয়েছে তার মানে এই না সে নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে আরামে ঘুরে বেড়াবে। রাগ, জিদ, হিং’স্রতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ ধুপধাপ পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে হাঁটা লাগায় অর্পিতার ঘরের উদ্দেশ্যে। অর্পিতা তখন জেগেই ছিলো। মেঝেতে বসে জানালার বাহিরে তাকিয়ে ছিলো অন্যমনষ্ক হয়ে। হঠাৎ করেই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে ওঠে৷ নিচু স্বরে শুধায়,
‘কে?’
প্রথমেই চিত্র জবাব দেয় না। বড় বড় শ্বাস নিয়ে বেশ অনেকটা সময় পর স্বাভাবিক স্বরে বলে, ‘আমি চিত্র। দরজা খোল!’
অর্পিতা চমকায়। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে৷ এতো রাতে হঠাৎ করে চিত্র এ ঘরে কেনো? হৃদপিণ্ডের উঠানামা বেড়ে যায়। কোনো রকমে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে দরজা খুলে দেয়। দরজায় দাঁড়ানো চিত্রর চোখ মুখ দেখে বেশ ভয় পায়। লাল হওয়া চোখ মুখে চিত্রকে কোনো হিং’স্র প্রাণীর থেকে কম কিছু লাগছে না। বার কয়েক ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় আওড়ায়,
‘এতো রাতে তুমি এখানে কেনো চিত্র ভাই? কিছু বলবে?’
চিত্র জবাব না দিয়ে বাহু টেনে ধরে অর্পিতার। শক্ত করে চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘তুই শুধু আমার অর্পি। আমি কোনোমতেই তোকে অন্যের হতে দেবো না। যা করছি বা করবো তার জন্য ক্ষমা করিস!’
অর্পিতা কিছুই বুঝলো না। ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে রইলো চিত্রর মুখের দিকে। চিত্র কয়েকবার বড় বড় শ্বাস নিয়ে হুট করেই হাত দেয় অর্পিতার শাড়িতে। অর্পিতা আঁতকে ওঠে। চিল্লিয়ে উঠে চিত্রের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,
‘চিত্র ভাই দোহায় লাগে তোমার! আমার শাড়ি ছাড়ো। কি করতেছো এইটা তুমি?’
অর্পিতার চেঁচানোর পরও চিত্র ছাড়ে না। শাড়ি একটানে খুলে ফেলে। অর্পিতার চেচামেচি বেড়ে গেছে। চিত্র তখন ভাালোবাসা পাওয়ার লোভে অন্ধ হয়ে গেছে। তার মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরছে কিভাবে অর্পিতাকে পাওয়া যাবে! বোকা চিত্র রাগের মাথায় কত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তা বোধহয় একবারের জন্যও ভাবে না। অর্পিতা কান্না শুরু করে দিয়েছে। চিত্র অর্পিতার ব্লাউজের এক অংশ ছি’ড়ে ফেলে। অর্পিতা হাউমাউ করে কান্না করছে আর বার বার চেঁচিয়ে নিষেধ করছে চিত্রকে। কিন্তু চিত্র নিজের মাঝে নেই। অর্পিতার চেঁচামেচির শব্দে শায়লা, শিমুল, শিল্পা আর স্মরণই প্রথমে দৌড়ে আসে। এপাশের উল্টোদিকে চয়ন পল্লবী আর পিয়াস নীরার ঘর। তারা চেচামেচির আওয়াজটা স্বল্প পায়। শায়লা, শিমুলের ঘর অর্পিতার ঘরের এক ঘর পরে হওয়ায় তারাই প্রথমে ছুটে আসে। অর্পিতা আর চিত্রকে এ অবস্থায় দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। শায়লা মাথায় হাত দিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। শিমুল এসে অর্পিতার থেকে চিত্রকে দুরে সরিয়ে থা’প্পড় বসিয়ে দেয়। চিত্র থা’প্প’ড় খেয়ে সরে যায়। অর্পিতাকে আগলে নেয় শায়লা আর শিল্পা। স্মরণ এগোয়ও না। অর্পিতা লজ্জায়, ভয়ে শব্দ করে কাঁদছে। ততক্ষণে চয়ন, পল্লবী, পিয়াস, নীরা সবাই এসে গেছে। অর্পিতাকে এমন অবস্থায় দেখে সবাই হা হয়ে যায়। শিমুল ততক্ষণে চয়নকে সবটা বলেছে। চয়ন রাগে এসে চিত্রর গালে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো যে চিত্রর বুঝেও আসলো না কি থেকে কি হলো!
৫১.
এতোরাতেও হল রুমে বাড়ির সবাই বসে আছে। অর্পিতা এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। শায়লা মুখে আঁচল চেপে বিলাপ করে কাঁদছে। পল্লবী বেশ স্বাভাবিক আছে। পিয়াসের এসব কিছুতেই মাথা ব্যাথা নেই। চয়ন, শিমুল, প্রহর গম্ভীর হয়ে আছে। শিল্পা বোনকে সামলালেও স্মরণ বসে আছে। তার মনে কি চলছে তা বোঝা দায়। চৈত্রিকা, অর্থি অর্পিতার পাশে বসে আছে। যদিও অর্থিকে কয়েকবার ঘরে যেতে বলেছে কিন্তু অর্পিতার কান্না দেখে অর্থি আর যায়নি। এই রাতের বেলাতেই প্রহর আর চৈত্রিকাকে খবর পাঠিয়ে বাড়িতে এনেছে চয়ন। সাদিক, নাসিমাও বসে আছে৷ চিত্র সবার থেকে খানিকটা দুরে এক কোণায় মাথা নিচু করে আছে। রাগে, জিদে মানুষ যে অন্যায় করে বসে তার উদাহরণ চিত্র। সে কখনো যেটা ভাবেওনি সেই কাজই করে বসেছে। এতো সহজ পথ থাকতে সে সবচেয়ে ঘৃ’ণ্য একটা কাজ করেছে। অনুশোচনায় তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বি’ষিয়ে যাচ্ছে। বেশ অনেকটা সময় পর প্রথমে মুখ খোলে চয়ন। বেশ গম্ভীর স্বরে বলে,
‘দেখো যা হওয়ার তা হয়ে গেছে! চিত্র যা করেছে তার শা’স্তি সে পাবে। চিত্র যা করেছে আজ তারপর আমার মনে হয় না অর্পিতাকে আর এই বাড়িতে রাখা উচিত! ওর বিয়েটা যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে দাও!’
সবাই তাকায় স্মরণের দিকে। চিত্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নিচু করে রাখে। অর্পিতার এসবে কোনো হেলদোল নেই৷ তার চিত্র ভাই এটা কি করলো! এটুকু ভেবেই তার সকল অনুভূতিরা বি’ষা’ক্ত হয়ে যাচ্ছে। সবার ভাবনার মাঝেই স্মরণ বেশ স্বাভাবিক, সাবলীল ভাবে বলে,
‘সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেনো? আপনাদের কি মনে হয় আমি এমন চরিত্রহীনা মেয়েকে বিয়ে করবো? মানে বিয়ের আগে ফুলসজ্জা করবে একজন আর আমি ফাউ ফাউ বিয়ে করে বউ ঘরে তুলবো!’
কান ঝা ঝা করে ওঠে অর্পিতার। চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। শিমুল মাথা নিচু করে নেয়। চৈত্রিকা বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘বড়দের সামনে কি বলছেন তা ভেবে বলবেন! আর ফুলসজ্জা বলতে কি বোঝাতে চাচ্ছেন? সবাই জানে এমন কিছুই হয়নি তবুও আপনি অযথা এসব কেনো বলছেন? আপনার বিয়ে করতে ইচ্ছে হলে করুন নয়তো স্ব-সম্মানে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারেন৷ সদর দরজার রাস্তাটা ওদিকে!’
শিল্পা আর স্মরণ ক্ষেপে ওঠে। চৈত্রিকাকে যা তা বলতে শুরু করে। মুহুর্তেই পুরো হলরুমে যা তা কান্ড শুরু হয়ে যায়। প্রহর বেশ শান্ত হয়ে উঠে আসে। স্মরণের সামনাসামনি এসে ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে বলে,
‘জমিদার বাড়িতে দাঁড়িয়ে সেই বাড়িরই মেয়েকে, বউকে যা তা বলছিস! গলা কাঁপছে না স্মরণ? আমি কাঁপাবো?’
স্মরণ আঁতকে ওঠে। প্রহরের সামনে বসে সে ঠান্ডা মাথায় এতো বড় ভুল কেমন করে করলো সেইটা ভেবেই গলা শুকিয়ে আসে। প্রহর চয়নের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘স্মরণ অর্পিতাকে কি রিজেক্ট করবে? আমরাই ওকে রিজেক্ট করলাম। ওর মতো স’স্তা মানসিকতার ছেলে আমাদের অর্পিকে ডিজার্ভ করে না।’
‘তোর ভাইয়ের জন্য আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা প্রহর! এখন আমার মেয়েকে কে বিয়ে করবে? স্মরণ নিজের মানুষ হয়েও মেয়েটাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করলো সেখানে অন্য কেউ ওকে কেনো বিয়ে করবে?’
শিমুলের কথার পিঠে প্রহরের স্বাভাবিক জবাব, ‘যার জন্য এতো কিছু হলো সেই করবে! চিত্র বিয়ে করবে অর্পিকে।’
চিত্র এতক্ষণে মাথা তুলে তাকায় প্রহরের দিকে। অর্পিতার শিরা উপশিরা কেঁপে ওঠে। চয়ন চমকে উঠে বলতে নেয়, ‘কিন্তু এটা..’
‘আপনি চুপ থাকুন আব্বাজান! আজ যা হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আপনি। জমিদাররা নাকি কথার খেলাপ করে না তবে আপনি নিজে নিজের পুত্রের সাথে এমন কথার খেলাপ কেনো করলেন? আপনার জন্যই, শুধুমাত্র আপনার জন্যই চিত্র এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা শুধু ভুল না অন্যায়ও। ভালোবাসা পাওয়ার আশায় অ’ন্ধ হয়ে গিয়ে কতটা নিচু কাজ করতে গেছিলো তা কি ‘ও’ নিজেও জানে? আপনি জানতেন চিত্র ঠিক কতটা ভালোবাসে অর্পিকে অথচ আপনি নিজের দাম্ভিকতা ধরে রাখতে দুজনের জীবনটায় ন’ষ্ট করে দিলেন। তাই এই ক্ষেত্রে আপনি চুপ থাকলেই ভালো হয়।’
প্রহর কথা শেষ করতেই চৈত্রিকা খানিকটা অবাক চোখে তাকায়। পাশ থেকে অর্পিতা কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘কিন্তু আমি বিয়েটা করতে পারবো না বড় ভাইজান!’
সবাই অর্পিতার দিকে তাকায়। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে অর্পিতা নিজেই বলে, ‘আমি তোমাকে এমন ভাবিনি চিত্র ভাই। তুমি যদি শুধু একটা বার বলতে তুমি আমাকে ভালোবাসো! আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলো আসতাম তোমার কাছে। কিন্তু তুমি এমনটা করোনি! উল্টো আমার সম্মানে হাত দিয়েছো। তুমিও জানো আমিও জানি আমার গায়ে ক’লঙ্ক নেই তবুও আমি আজ তোমার জন্য ক’লঙ্ক পেয়েছি। তুমি আমার বিশ্বাসের জায়গা, ভরসার জায়গা একদম ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছো চিত্র ভাই। যতটা ভালো আমি তোমাকে বেসেছি ততটাই তুমি তোমাকে ঘৃ’ণা করার কারণ দিয়েছো। তোমাকে ২য় বারের মতো বিশ্বাস, ভরসা করার মতো কোনো কারণ নেই আমার কাছে। যে মানুষটা এতো যত্ন করে আমার গায়ে ক’লঙ্ক লেপ্টে দিলো তাকে কিভাবে বিয়ে করে নিবো? স্বামী হিসেবে মেনে নিবো?’
চলবে..
#চৈত্রিকা (১৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
______________
৫২.
সারা রাত অর্পিতার সাথেই ঘুমিয়েছে চৈত্রিকা আর অর্থি। ওদের দুজনকে ছাড়া অবশ্য অর্পিতাই কাউকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি। চৈত্রিকার অনেক অনুরোধ আর বোকা সোকা অর্থির কান্নার কাছে হার মেনে ওদেরকে ঢুকতে দিয়েছে৷ সারাটা রাত অর্পিতা চৈত্রিকাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে গেছে। এই কান্নার বিপরীতে কিছুই বলতে পারেনি চৈত্রিকা। জীবনে কিছু কঠিন সময়, খারাপ সময় আসে যখন এভাবে আগলে ধরে রাখার বা কারো বুক পাওয়া যায় না যার বুকে মাথা গুজে কান্না করে নিজেকে হালকা করা যাবে। অর্থি কান্না করার ফলে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কিন্তু চৈত্রিকা সারা রাতে দু চোখের পাতা একটুও এক করেনি৷ মূলত ভয় পাচ্ছিলো না জানি অর্পিতা নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে! এবাড়ির মানুষগুলোর প্রতি তার আকাশসম ক্ষো’ভ থাকলেও এই নিষ্পাপ দুটি মেয়ের ওপর তাার কোনোরুপ ক্ষো’ভ নেই৷ বরং মেয়ে দুটির ওপর তার অল্প কিছুদিনেই একটা ভালোবাসার জায়গা তৈরী হয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চৈত্রিকা। বিড়বিড় করে বলে,
‘জীবন বড্ড নি’ষ্ঠুর অর্পিতা আপু। সাজানো, গোছানো স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যায় এক নিমিষেই। কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ ভাবতেও পারে না। আমি কি কখনো ভেবেছি নিজের চোখের সামনে নিজের প্রিয় আব্বুকে পু’ড়তে দেখবো! তবুও দেখতে হয়েছে। মা নামক এক নি’ষ্ঠুর মহিলার জন্য আমি পাড় ভাঙা ঢেউ।’
চৈত্রিকার বিড়বিড় আওয়াজ ঘুমন্ত অর্পিতা শুনতে পায় নাহ। চৈত্রিকা অর্পিতার মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে আলগোছে শুইয়ে দেয়। পাশেই অর্থি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। এক পলক দুজনের দিকে তাকিয়েই চৈত্রিকা ঘর থেকে বের হয়। মাথার আঁচল টেনে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগায়। একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসতেই পা দুটো আপনা আপনি থেমে যায়। কান খাঁড়া করে আবারও বোঝাার চেষ্টা করে এটা ঠিক কিসের শব্দ ছিলো! কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারে এটা নুপুরের শব্দ। চৈত্রিকা পাশের ঘরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কোনো রকম শব্দ না করে একদম ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় দরজার কাছ ঘেঁষে। কাকতালীয় ভাবে ঘরের দরজাটা শুধু ভেড়ানো ছিলো আটকানো ছিলো না। তাই স্পষ্ট ভেতরের কথা গুলো শুনতে পেলো চৈত্রিকা। আশে পাশে নজর বুলিয়ে দরজায় কান পাততেই তার কানে ভেসে আসে,
‘চিত্রর মতো ভদ্র ছেলের কি আর অতো ক্ষমতাা আছে যে নিজের চিন্তা ভাবনায় এসব করবে! আমিই তো উ’স্কালা’ম। যদিও চিত্রর ঘরে শুধু দুটো চিঠিই রেখে এসেছিলাম। কিন্তু বোকা চিত্র যে সত্যিই রেগে গিয়ে আমাদের প্ল্যানমতো কাজ করবে তা কি আর জানতাম! খুব অ’হং’কার না ওদের! এবার সব ধুলোতে মিশবে। আমাদের অ’পমা’ন করেছিলো তাই না!’
চৈত্রিকা স্পষ্ট বুঝলো ভেতর ঘরে থাকা মানুষগুলোর ক্ষো’ভ। ভেতরের প্রতিহিংসা যে মানুষকে মানুষ থেকে অমানুষ করে দেয় তারই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ পেলো চৈত্রিকা। চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে মুহুর্তেই। চোয়াল শক্ত করে আওড়ায়,
‘এর শা’স্তি আপনারা পাবেন শিল্পা খালা।’
৫৩.
চৈত্রিকা নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। ঘরে এসে বার বার পায়চারি করছে আর কি থেকে কি করবে তা ভাবছে! একবার হাতের তালুতে হাত ঘষছে তো আরেকবার শাড়ি প্যাচিয়ে আঙুলে গিট্টু দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মাথায় কিছু আসছে না। ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস ছাড়ে। পুরোটাই ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রহর দেখে। হঠাৎ চৈত্রিকা এমন করছে কেনো তা সে বুঝলো না। তবে মুখটা গম্ভীর করে ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে এগিয়ে আসলো চৈত্রিকার কাছে। একদম চৈত্রিকার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ভীষণ শীতল কন্ঠে বলে,
‘চর্কির মতো ঘুরছো কেনো? কি হয়েছে?’
হঠাৎ কথা বলায় চৈত্রিকা চমকে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে পেছনে তাকাতে নিলে সরাসরি ধাক্কা খায় প্রহরের বুকে। এতে প্রহর এক চুল পরিমাণও নড়ে না কিন্তু চৈত্রিকা লাফিয়ে সরে যায়। কপালে ভাজ ফেলে বলে,
‘আপনি কি নিজের ভাইয়ের মতো হচ্ছেন নাকি? মেয়ে দেখলেই কাছে ঘেঁষতে মন চায়?’
প্রহরের চোখ মুখ গম্ভীর থেকে আরো বেশি গম্ভীর হয়ে যায়। সিনা টান টান করে বসে খাটের ওপর। শক্ত গলায় বলে, ‘আমার ভাইয়ের মতো হচ্ছি বলতে কি বুঝালে? চিত্র কিন্তু ওরকম ছেলে না। হয়তো আবেগ, রাাগ, জিদের বশে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মানে এই না ‘ও’ চরি’ত্রহীন!’
চৈত্রিকার কপালের ভাজ আরো দৃঢ় হয়। গটগট করে প্রহরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনাদের সমস্যা কি বলেন তো? মানে জমিদার বাড়ির ছেলেদের ৪ লাইন বেশি বুঝতেই হবে? শোনেন আমি চিত্র ভাইকে কিছু বলিনি। আপনার পিয়াস ভাইকে বলেছি!’
প্রহর হুট করেই কোমড় জড়িয়ে ধরে চৈত্রিকার। কয়েকদফা চমকায় চৈত্রিকা। চোখ বড় বড় করে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে নিলে মুখ গুজে দেয় উদরে। অদ্ভুত কন্ঠে বলে, ‘৪ লাইন যখন বেশি বুঝি তখন তুমি সঠিক বুঝটা দাও!’
চৈত্রিকা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। প্রহরের সামনে আমতা আমতা বা কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলা মানেই প্রহরকে প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু সে তো প্রহরকে প্রশ্রয় দেবে না। তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখ বন্ধ করে। সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের পু’ড়তে থাকা বাবার মুখ। চট করে চোখ মেলে বড় বড় শ্বাস নেয়। প্রহর অনেকক্ষণ চৈত্রিকার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওই অবস্থাতেই ভ্রু কুঁচকে নেয়। কিন্তু তার ভাবনা সঠিক করে মুহুর্তেই চৈত্রিকার চোয়াল শক্ত করা কন্ঠে ভেসে আসে,
‘হুটহাট এভাবে স্পর্শ করে নিজের বাপ ভাইয়ের মতো নিজের চরিত্রটাও আর প্রকাশ করবেন না। ছাড়ুন আমাকে!’
প্রহর নিঃশব্দে হেঁসে আবার নিজেকে গম্ভীর করে ছেড়ে দেয় চৈত্রিকাকে। চৈত্রিকা যেভাবে শব্দ করে কাছে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই দুরে সরে গেলো। আলমারি থেকে নিজের শাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে গোসলখানার দিকে যায়। পেছন থেকে প্রহর বলে,
‘নিজের বউকে হুটহাট স্পর্শ করাতে যদি আমার বাপ ভাইয়ের মতো চরিত্র প্রকাশ পায় তবে আমি এমন চরি’ত্রহীন আজীবন হতে চাই চৈত্রিকা।’
চৈত্রিকা কোনো রকম নিজেকে দমিয়ে গোসলখানায় ঢোকে। রাগে কয়েক বালতি পানি নিজের মাথায় ঢেলে বের হয়ে আসে। পুরো ঘরে আর প্রহরকে নজরে আসে না। হয়তো নিচে গেছে নয়তো কোনো কাজে বাড়ির বাাহিরে গেছে। এদের আবার কাজ! অ’নৈতিক কাজ ছাড়া এরা আর পারেই বা কি! চুলগুলো ভালো করে মুছে তোয়ালে আর ভেজা কাপড় শুকাতে দেয় ব্যালকনিতে। রোদ এসে সরাসরি পড়ে মুখের ওপর। গোসলের পর রোদে দাঁড়াতে মন্দ লাগে না চৈত্রিকার। তাই মন ভালো করতে হালকা রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে। গোসলের পরে স্নিগ্ধ রুপের সাথে মুখের ওপরের হালকা রোদে কি ভীষণ স্নিগ্ধ আর মায়াময় লাগছে তা কি এই সপ্তদশী কন্যা জানে? উহু জানে না। তার এই রুপে আটকে আছে ২ জোড়া চোখ। একটা তার স্বামীর। যার ভীষণ ভাবে অধিকার আছে তার ওপর। আর অন্যটা এক প’শুর। যার লালসার দৃষ্টি পড়েছে চৈত্রিকার ওপর। চৈত্রিকা বিষয়টা খেয়াল না করলেও নিচে দাঁড়ানো প্রহর ঠিকই খেয়াল করে। চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। চোখ দুটো মুহুর্তেই লাল টকটকে হয়ে যায়।
৫৪.
চৈত্রিকা নিচে এসে দেখে খাবার টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে নীরা। চৈত্রিকা কোনো রকম শব্দ না করে নিজেও এসে সেখানে দাঁড়ায়। চৈত্রিকার উপস্থিতি টের পেয়েও নীরা কোনো রকম শব্দ করে নাহ। মনের মাঝে জ্ব’লতে থাকা আগুন বাড়ে। মেয়েটা একটু বেশিই সুন্দর আর এজন্যই তার স্বামীও পাগল প্রায় এই মেয়েটার জন্য। মেয়েটাকে এতো সুন্দর হতে কে বলেছে? আগে তো তাও পিঠপিছে যত ন’ষ্টামি ছিলো পিয়াসের আর এখন তার সামনেই হা করে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার দিকে৷ নীরার মুখ ভঙ্গি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না তার মনের ভাবনাগুলো। চৈত্রিকা তবুও বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলে,
‘বুবু আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো?’
‘বুবু’ ডাক শুনে চমকে ওঠে নীরা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার মুখের দিকে। চৈত্রিকা নীরার তাকানো দেখে হেঁসে দেয়। নীরার হাতে হাতে কাজ করতে শুরু করে নিজে থেকেই বলে,
‘আপনি আমার সম্পর্কে ছোট হলেও বয়সে বেশ খানিকটা বড়। তাই বুবু বলছি৷ মেজো বউ বা নাম ধরে ডাকতে আমার একটু অস্বস্তি হয়। বুবু ডাকলে সমস্যা হবে কি বুবু?’
নীরা চেয়ে চেয়ে দেখলো চৈত্রিকার হাসি। মেয়েটার হাসিতে যেনো সে নিজেই মুগ্ধ হলো৷ ভুলে গেলো ক্রো’ধ, হিং’সা, রাগ, ক্ষো’ভ সবকিছুই। শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনলো মেয়েটির কথা। চৈত্রিকা এক হাতে সব গুছিয়ে নিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কোনো মেয়ে অসুন্দর হওয়াটা যেমন দোষের না তেমনই সুন্দর হওয়াটাও দোষের না বুবু। দোষ সেই পুরুষের দৃষ্টির যে পুরুষ নারীর সৌন্দর্যকে লা’লসার চোখে দেখে! আচ্ছা বুবু সত্যিই কি আমার দোষ আছে আপনার স্বামীর এমন দৃষ্টি নিয়ে তাকানোতে? কখনো কি ভেবেছেন! আমি তো তার বড় ভাবীজান অথচ সে তাকায় কেমন করে! আমি কি কখনো এমন কিছু করেছি যাতে তার এমন দৃষ্টি পড়ার কারণ আছে? আসলে কি জানেন বুবু? কিছু পুরুষই হয় এমন যারা কোনো মেয়েকেই ভালো চোখে দেখে না। যাদের চরিত্রে রয়েছে আকাশসম দোষ কিন্তু আমরা বাঙালী নারীরা সেই স্বামীর জন্যই অন্য নারীর ওপর ক্ষো’ভ, হিং’সা পুষি।’
নীরা মাথা নিচু করে নেয়। চৈত্রিকা হাসে। এর মধ্যেই হুট করে অর্থির গলা পাওয়া যায়। অর্থির চেচামেচিতে নীরা আর চৈত্রিকা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছুট লাগায়। অজানা আশঙ্কায় চৈত্রিকার বুক কাঁপে। কোনো ভাবে অর্পিতা নিজের ক্ষ’তি করেনি তো? ঠিক আছে তো অর্পিতা? যত দ্রুত সম্ভব নীরা আর চৈত্রিকা অর্পিতার ঘরের সামনে আসে। ঘরের বাহির থেকে দেখতে পায় মেঝেতে র’ক্তের ছড়াছড়ি। অর্পিতার বুক কেঁপে ওঠে। অর্থি কান্না জুড়ে দিয়েছে। মেঝেতে অর্পিতার দেহটা পড়ে আছে আর চারপাশটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। অর্থি ভয় পেয়েছে বুঝেই নীরা আগে অর্থিকে আগলে নেয়। অর্থি নীরার বুকে মুখ গুজে দিয়ে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। চৈত্রিকা কাঁপা কাঁপা হাতে চৈত্রিকার হাত স্পর্শ করে৷ পালস বুঝতে না পেরে চট করে সরে যায়। কি মনে করে অর্পিতার শাড়ির আঁচল দিয়েই ওর হাতটা চেপে ধরে। অর্থির কান্নার আওয়াজে আর ৩ জনের চেচামেচিতে বাড়ির বাকি সবাই ছুটে আসে। শায়লা মেয়ের এমন নি’থর অবস্থা দেখে জোড়ে জোড়ে কাঁদতে শুরু করে। পল্লবী আর চৈত্রিকা মিলে অর্পিতাকে ধরে বিছানার ওপর শুইয়ে দেয়৷ কে’টে যাওয়া হাতটা ভালো মতো চেপে ধরে যাতে রক্ত না পড়ে। কিন্তু হাতের শি’রা কি আর শুধুমাত্র এটুকু বাঁধ মানে! ততক্ষণে খবর পেয়ে গেছে জমিদার বাড়ির সকল পুরুষ। চিত্র অর্পিতার এই অবস্থা দেখেই মেঝেতে বসে পড়েছে। অনুভূতি শূণ্যের মতো শুধু চেয়ে আছে অর্পিতার রক্তশূণ্য মুখের দিকে। বাড়িতে হৈ হুল্লোড় পড়ে যায়। প্রহর সাবধানে নিজ হাতেই সবটা সামলায়। অর্পিতাকে পাজাকোলা করে নিয়ে ছুটে যায় বাড়ির বাহিরে। উদ্দেশ্য হাসাপাতাল! একে একে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। অর্পিতার ঘরে শুধু বসে থাকে চিত্র আর চৈত্রিকা। চৈত্রিকা যেতে চেয়েও চিত্রের দিকে তাকিয়ে আর যায়নি৷ অর্পিকা বোকামি করেছে এবার এই একই বোকামি যদি চিত্রও করে তবে বিষয়টা যে খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে! চৈত্রিকা ধীরে পায়ে এগিয়ে আসে চিত্রর কাছে। চিত্রর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘চিত্র ভাই! আপনি যাবেন না? উঠুন!’
চিত্র উঠলোও না, তাকালোও না। শুধু রোবটের মতো বললো, ‘আপনি যান ভাবীজান। মেয়েটা আমার জন্যই নিজের সাথে এমনটা করলো! আমি কিভাবে যাবো ওর কাছে?’
চিত্রর দৃষ্টি তখনো মেঝেতে। অর্পিতার শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দিকে। মনে মনে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো চৈত্রিকার। কেনো সে অর্পিতাকে একা ছেড়ে চলে গেলো! কেনো সে একবারও অর্পিতা কি করছে তা দেখে গেলো না! নিজের রাগ নিজের ভেতর রেখে অনেক ইতস্তত করেও বড় ভাই মনে করেই চিত্রর হাত ধরে চৈত্রিকা। জেদি কন্ঠে বলে,
‘উঠুন চিত্র ভাই! আমাদের আগে অর্পিতা আপুর কাছে যাওয়া উচিত।’
চিত্র কিছু বলার আগেই ঘরের বাহির থেকে শব্দ আসে মহিলা কন্ঠের। চিত্র আর চৈত্রিকা দুজনেই তাকিয়ে দেখে শিল্পা দাঁড়িয়ে আছে। শিল্পা বেশ বিদ্রুপ করে বলে,
‘কিগো চিত্র! আমাদের অর্পিতার জীবনটা ন’ষ্ট করে কি ক্ষ্যান্ত হওনি নাকি জমিদার বাড়ির ছেলেদের সমস্যাই এসব! বড় ভাবীর সাথে অ’বৈধ সম্পর্ক!’
চৈত্রিকা জ্বলে ওঠে। চোখ দুটো রাগে লাল হয়। চিত্রর হাত ছেড়ে গটগট করে সামনে এসে দাঁড়ায় শিল্পার। রেগে গলা চে’পে ধরে শিল্পার। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আমার ইচ্ছে করছে আপনার গালে ক’ষিয়ে কয়েকটা থা’প্পড় বসিয়ে দেই কিন্তু আমি ময়লা ছুঁয়ে হাত অপরিষ্কার করতে চাই না। আপনি কি করেছেন তার হিসাব বাড়ি এসে মিলাবো।’
শিল্পার দম আটকে যাওয়ার উপক্রম। কল্পনাও করেনি চৈত্রিকা এমন কিছু করতে পারে! চৈত্রিকা তার হাত ধরে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। তারপর চিত্রের হাত টেনে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা আটকে দেয়। শিল্পা অবাক হয়ে দরজার কাছে ছুটে আসে। দরজা ধাক্কাতে থাকে অনবরত। কিন্তু চৈত্রিকা দরজা খোলে না বরং অদ্ভুত কন্ঠে বলে,
‘পাপ বেশি হয়ে গেছে আপনাদের তাই এবার শা’স্তি পাবার সময় এসেছে।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম৷ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)