চৈত্রিকা পর্ব-১৫+১৬

0
307

#চৈত্রিকা (১৫)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৪০.
কাঠফাটা গরমে মানুষের বেহাল অবস্থা। এই রোদ্রের মধ্যেই চৈত্রিকা আর প্রহর দুপুরবেলা করে চলে এসেছে সাথীদের বাড়িতে। এখানে তাদের দুদিন থাকার নিয়ম কিন্তু একই গ্রামের হওয়ায় প্রহরের বাড়িতে যাতায়াত করতে কোনো সমস্যাই হবে না। সকাল থেকে এটা ওটা করতে করতেই দেড়ি হয়ে গেছে৷ তারপর তৈরী হতে হতে ১২ টা পার হয়েছে। প্রহর শুধু ভ্রু কুঁচকে দেখে গেছে সবটা। একবার তো বেশ গম্ভীর স্বরে বলেই বসেছে,

‘বাড়িতে যাওয়ার কি ইচ্ছে আছে?’

চৈত্রিকা শাড়ি ঠিক করতে করতেই বেশ অবাক সুরে বলে, ‘ইচ্ছে আছে মানে কি? ইচ্ছে না থাকলে কি তৈরী হতাম? আপনি কি আজকাল চোখে কম দেখেন নাকি জমিদার সাহেব?’

প্রহর উত্তর দেয় না। চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে এগোতে এগোতে বলে, ‘আর ৫ মিনিটের মধ্যে নিচে না আসলে মামার বাড়ি যাওয়ার আশা ছেড়ে দিও!’

চৈত্রিকার জবাবের অপেক্ষা না করেই প্রহর বেড়িয়ে গেছে। নিজের শাড়ি ছেড়ে কপালে ভাজ ফেলে প্রহরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকা। বিড়বিড় করে বলে,

‘আরো ৫ মিনিট কেন! ৫০ মিনিটেও আমার তৈরী হওয়া শেষ হবে না। কিভাবে আমাকে মামার বাড়ি যাওয়া থেকে আটকান আমিও দেখে নিবো!’

সত্যি সত্যি বেশ আস্তে ধীরে তৈরী হয় চৈত্রিকা। প্রহর বিরক্তিতে, রাগে ফেটে পড়লেও বাহিরে শান্ত স্বভাব ধরে রেখেছে। চৈত্রিকা নিজের কাপড় নিয়ে বেশ ধীরেই নেমে আসে হল রুমে। প্রহর প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকায়। চৈত্রিকা তা পাত্তা না দিয়ে বেশ ভদ্র গলায় বলে,

‘চলুন!’

প্রহর কিছু বলতে গিয়েও বলে না। চুপচাপ নিজের রাগ, জিদ, বিরক্তি পেটের মধ্যে চেপে রেখে পল্লবীর থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা লাগায়। চৈত্রিকা নিজেও পল্লবীকে ছোট করে বলে, ‘আসি!’

পল্লবী কোনো জবাব দেয় না। চৈত্রিকা বাড়ির সদর দরজা পেরোতেই ছুটে আসে নাসিমা। চৈত্রিকার হাত চেপে ধরে হাসি হাসি মুখে বলে, ‘এই বাড়ি থেকে বের হয়েছিস আর যেনো এবাড়িতে তোর পা না পড়ে!’

চৈত্রিকা হাসে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের রাস্তায় হাঁটা লাগায়। কন্ঠে বেশ রসিকতা মিশিয়ে বলে, ‘কি যে বলেন না কাকিমা! আমি হলাম এবাড়ির বড় বউ। আমি এই বাড়িতে পা না রাখলে কে রাখবে?’

নাসিমা চৈত্রিকার হাসির মানে বোঝে না। চৈত্রিকার ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখে ছিলো অন্যকিছু। যা নাসিমার চোখে না পড়লেও চোখ এড়ায়নি চৈত্রিকার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়ানো প্রহরের। চৈত্রিকা পাশাপাশি আসতেই প্রহর নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করে৷ চৈত্রিকা রোদটাও উপভোগ করতে করতে হাঁটছে আর গুনগুণিয়ে গান গায়ছে। প্রহর বুঝলো না চৈত্রিকার হঠাৎ এতো আনন্দের বিষয়টা! বেশ খটকা লাগলেও কোনো কথা বলে না। চৈত্রিকা নিজে থেকেই বলে,

‘আজকের রৌদ্রের তাপটা একটু বেশিই। তাই না জমিদার সাহেব?’

প্রহর চৈত্রিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার মনে কি চলছে! মুখের দিকে তাকিয়ে কি মনের মাঝে চলা ঘটনা টের পাওয়া যায়! হয়তো যায়। কিছু মানুষের চোখ দেখলে বোঝা যায় কিন্তু এই মেয়ের চোখের দিকে তাকালেও অতল গভীরে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই বোঝা যায় না। প্রহর দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মাথাটা ঝিম ধরে যায়। বড় বড় করে শ্বাস নেয়। মেয়েটার সৌন্দর্যর প্রখরতা এতো কেনো? তাকালেই মনে হয় হারিয়ে যাবে ভীষণ গভীরতায়। চৈত্রিকা আঁড়চোখে একবার প্রহরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে৷ প্রহরের উদ্দেশ্যে বলে,

‘জমিদার সাহেব সূর্যের দিকে যেমন তাকিয়ে থাকাটা দায় তেমনই চৈত্রিকার দিকেও তাকিয়ে থাকা দায়। চোখ ঝল’সে যাবে, মাথা ঝিম ধরে যাবে।’

প্রহরের চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। এই গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই আওড়ায়, ‘নারী সূর্যের মতো তেজী হয় না। এরা ছ’লনা’ময়ী হয়। রুপের তেজে পুরুষের শক্ত-সামর্থ্য হৃদয়কেও কাবু করে দেয় এরপর সেই রুপের পেছনের আসল রুপ দেখায়। এক পুরুষকে আঘাত করে, তার হৃদয়ে ক্ষ’ত করে আবার অন্য পুরুষের কাছে যায়।’

‘ঠিক যেমন মহুয়া বুবু করেছিলো আপনার সাথে! তাই না?’

প্রহর ভেতরে ভেতরে চমকালেও ওপরে তার ছিটেফোঁটাও টের পেতে দেয় না। রাগে, ক্ষো’ভে মাথার ভেতরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। মুখের গম্ভীরতার সাথে সাথে রাগে চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। হাঁটার গতি বাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,

‘নারী মমতাময়ী আবার নারীই ছ’লনা’ময়ী। নারীই পুরুষের সফলতার কারণ আবার নারীই পুরুষের ধ্বংসের কারণ। তেমন নারী নিজেই নিজের ধ্বংস, মৃ’ত্যুর কারণ। নারী সরল হোক তবুও সৎ হোক। ভুল করেও ছ’লনা’ময়ী হইও না চৈত্রিকা। তবে আমি তোমাকে তোমার নিজের ধ্বংস দেখাবো।’

৪১.
বাড়িতে প্রবেশ করতেই সাথী ছুটে আসে৷ চৈত্রিকাকে শেষ দেখেছিলো তাদের বউভাতের দিনে। আর একটিবারের জন্যও দেখা হয়নি। সনিয়া বেগম আর সাথী বেশ চিন্তায়ই ছিলো। আজ চৈত্রিকাকে সুস্থ দেখে দুজনেই বেশ শান্তি পেলো। পাশেই দাঁড়ানো গম্ভীর প্রহরকে দেখে চমকালোও। আজম আলী বাড়িতেই ছিলো। সাথী আর সনিয়া বেগমের আওয়াজ শুনে বেশ বিরক্তি নিয়েই একটা বি’শ্রী ভাষায় গালি দিতে দিতে ঘর থেকে বের হয়৷ সামনে দাঁড়ানো প্রহরকে দেখে ঘাবড়ে যায়। সনিয়া বেগম আর সাথী ততক্ষণে মাথা নত করে নিয়েছে। বাড়ির জামাইয়ের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা ভাবতেও পারেনি। প্রহর সবটা শুনেও এমন ভাব করলো যেনো সে কিছুই শোনেনি। চৈত্রিকা নিজেই পরিস্থিতি সামলাতে তাড়া দিলো সনিয়া বেগমকে। বেশ ক্লান্তি দেখিয়ে সনিয়া বেগমের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। প্রহর আর চৈত্রিকাকে একটা ছোট ঘরের সামনে এনে মাথা নিচু করে বলে,

‘জমিদার বাবা আমাদের তো ছোট্ট ঘর। আপনার হয়তো থাকতে সমস্যা হবে৷’

প্রহর কিছু বলার আগেই চৈত্রিকা বেশ উৎফুল্ল কন্ঠে বলে, ‘কি যে বলো না মামি! থাকতে সমস্যা হবে কেনো? উনি বিয়ে করেছে চাল চুলোহীন মেয়েকে তাই শ্বশুড়বাড়ি হিসেবে তোমরাই শেষ সম্বল। তাই তোমাদের এই ছোট্ট ঘরে থাকতে উনার একটুও সমস্যা হবে না৷ ঠিক না জমিদার সাহেব?’

প্রহর ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে তাকিয়ে রয় চৈত্রিকার দিকে৷ চৈত্রিকা দাঁত বের করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সনিয়া বেগম কিছু বলার আগেই চৈত্রিকা তাড়া দিয়ে সনিয়া বেগমকে অন্যদিকে পাঠায়। সনিয়া বেগম চলে গেলে চৈত্রিকা নিজে আরাম করে বসে নিজের বিছানায়। প্রহর ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পুরো ঘরটাকে। ঘরে তেমন কিছু নেই। একটা ছোট্ট চৌকি, ছোট্ট আলনা আর ছোট্ট একটা টেবিল। চৌকিটা তেমন বড়ও নয় আবার ছোটও নয়। দুজনের বেশ ভালো মতোই হয়ে যাবে। তবে পাশাপাশি ঘুমালে একজনের শরীর সহজেই অন্যজনের শরীর স্পর্শ করবে। প্রহর ঠোঁট কামড়ে কোমরে হাত রেখে কিছু ভাবে। তারপর চৈত্রিকার কাছে এগিয়ে এসে বলে,

‘আমি কিছু বলার আগেই পাকনামো করলে কেনো?’

‘মন চায়ছে তাই। এখন ইচ্ছে হলে হাত মুখ ধুয়ে আসেন নাহলে নিজের বাড়ির দিকে যান!’

প্রহর শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে চৈত্রিকার সাহসটুকু দেখে। এরপর কোনো রকম কথা না বাড়িয়ে এগোয় চৈত্রিকার কাছে। চৈত্রিকা প্রথমে টের না পেলেও পরে বুঝতে পারে। ততক্ষণে প্রহর তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। চৈত্রিকা কিছু বলার আগেই এক হাতে তাকে চেপে ধরে প্রহর। মুখ কানের কাছে নিয়ে এসে বলে,

‘জমিদার বাড়ির ছেলেকে তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছো এই ছোট্ট কুটির থেকে? সাহসটা বাড়াবাড়ি হচ্ছে না চৈত্রিকা? আর তুমি যেভাবে নিজের অধিকার খাটাচ্ছো তাতে আমি আমার সীমা লঙ্ঘন করলে তুমি সয়তে পারবে তো?’

৪২.
মাথার ওপরে ভনভন করে ফ্যান চলছে। এর মাঝেই ঘুমিয়ে আছে অর্থি। নিবিড় যে তাকে কিছুক্ষণ বাদেই পড়াতে আসবে তার বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই। দুপুরের খাবার খেয়েই ভাতঘুমে মত্ত হয়ে গেছে। পল্লবী এসে একবার ডেকে গেলেও সেই ডাক অর্থির কান অব্দি পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। অনেকক্ষণ পরও যখন অর্থির কোনো সাড়াশব্দ পায় না তখন পল্লবী ফের আসে। অর্থিকে আগের মতোই হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাতে দেখে বেশ রেগে যায়। ঘুমন্ত অর্থিকে ভালোমতো কয়েকবার ডেকেও যখন কোনো সাড়া পেলো না তখন অর্থির কান ধরে টেনে তোলে। অর্থি ঘুম ঘুম চোখেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে৷ আদুরে স্বরে বলে,

‘আম্মাজান আমার কানে ব্যাথা পাচ্ছি তো। ছেড়ে দেন না!’

পল্লবী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোকে কতবার ডেকেছি অর্থি? উঠিস না কেন? এখন কানে লাগছে! তুই আর এক মিনিটের মধ্যে না উঠলে তোর হাত, পা, পিঠ, নাক, চোখ, মুখ সব ব্যাথা করবে। জলদি ওঠ!’

অর্থি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘আচ্ছা ছাড়েন! উঠতেছি তো।’

পল্লবী না ছেড়ে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয় অর্থিকে। তারপর অর্থিকে গোসলখানায় নিয়ে চোখ মুখ ধুইয়ে দেয় নিজেই। এর মধ্যেই একজন এসে জানিয়ে যায় নিবিড় এসেছে। অর্থিকে কোনো রকমে তৈরী করে পড়ার ঘরে ঠেলে পাঠায় পল্লবী। অর্থি তখনো হাই তুলছে। ঘুমে ঢুলছে। তার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় নিবিড়। কিছু বলার আগেই বোকা অর্থি ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে চেয়ারে বসতে নিলে উল্টে পড়ে যেতে নেয়। আকস্মিক ঘটনায় কোনো রকমে নিবিড় অর্থির এক হাত টেনে ধরে। তারপর বেশ জোড়ে ধমক লাগায়। অর্থি চমকে ওঠে৷ চোখ বড় বড় করে নিবিড়ের মুখের দিকে তাকায়। ঘুম যেনো কোথায় পালিয়ে গেছে মুহুর্তেই। নিবিড় রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এই মেয়ে! চোখে দেখো না? এখনই তো উল্টে পড়ে কোমড় ভাঙতে। ঢুলছো কেনো? ঘুমাচ্ছিলে?’

অর্থি ঠোঁট উল্টায়। মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘আমি কি ইচ্ছে করে উল্টে পড়েছি? সব দোষ তো আপনার আর আম্মাজানের। আপনার জন্যই তো আম্মা আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো! আবার আপনিই আমাকে ধমকাচ্ছেন?’

নিবিড় হতাশ হয়ে অর্থির হাত ছেড়ে দেয়। অযথা আর কথা বাড়ায় না৷ বই খাতার দিকে ঈশারা করে বলে, ‘পড়া শুরু করো!’

অর্থি গাল ফুলিয়ে নিজের বই খাতা বের করে। খাতায় অঙ্ক কষতে কষতে বলে, ‘আপনি কি অসুস্থ হন না মাষ্টারমশাই?’

‘তোমার জেনে কাজ নেই। নিজের কাজ করো!’

অর্থি মুখ বাঁকায়। তারপর নিজের কাজে মন দেয়। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ফের বলে, ‘আপনি বিয়ে কবে করবেন মাষ্টারমশাই?’

নিবিড় বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলে, ‘আর একটা আজাইরা কথা বললে তোমার খবর আছে অর্থি।’

অর্থি অভিমানে গাল ফুলায়। আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ অঙ্ক করে। মনে মনে আটে অন্য এক বুদ্ধি।

৪৩.
স্মরণ আর অর্পিতার বিয়ের ডেইট কাছাকাছি চলে এলেও এখন পর্যন্ত একবারও কথা বলেনি কেউ কারোর সাথে। শিল্পা একপ্রকার জোড় করেই অর্পিতার ঘরে পাঠিয়েছে স্মরণকে। স্মরণ ইতস্তত মন নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে অর্পিতার অনুমতি সূচক শব্দ কানে আসতেই ঠোঁট প্রসারিত হয় তার। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে অর্পিতার মুখ। জানালার গ্রিল ধরে তার দিকে ফিরেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। স্মরণ মনে মনে হাসে। সোজা অর্পিতার বিছানার ওপর বসে বলে,

‘কি করছো?’

অর্পিতা বিরক্ত হয়৷ তবে তা প্রকাশ না করে বলে, ‘তেমন কিছু না৷ এমনিতেই দাঁড়িয়ে আছি।’

‘বাহিরে যাবে? আমি তো তোমাদের গ্রাম তেমন করে দেখিনি৷ ঘুরে দেখাবে?’

অর্পিতা কথা বাড়ায় না। একবার ভাবে মুখের ওপর না করে দেবে পরমুহূর্তেই ভাবে যার সাথে তার দুদিন পর বিয়ে তার সাথে না হয় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ছোট্ট একটা চেষ্টা করা-ই যায়! তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। স্মরণ বেশ খুশি হয়। খুশি মনেই অর্পিতাকে তৈরী হতে বলে নিজে বেড়িয়ে যায়। অর্পিতা শুধু নিজের চুলগুলো বেঁধে নেয়। তারপর নিজের শাড়ি ঠিক করে বের হয় ঘর থেকে। অর্থি পড়ছে বলে তাকে আর বিরক্ত করে না। শায়লাকে বলে স্মরণ আর সে বের হয় গ্রাম দেখতে। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে অথচ নিজেদের মাঝের নীরবতা একজনও ভাঙছে না। এই নীরবতা ঠিক সেই নদীর পাড়ে শেষ হয় যেখানে চিত্র অর্পিতাকে বলেছিলো ‘সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।’ জায়গাটা দেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্পিতা। স্মরণ বেশ নরম স্বরে বলে,

‘বিয়েতে তোমার কোনো আপত্তি আছে অর্পিতা?’

অর্পিতা বুঝতে পারে না কি উত্তর দেবে! হ্যাঁ বলবে নাকি না বলবে তা ভেবে পায় না। দৃষ্টি এদিক ওদিক করতেই পেছন থেকে ভেসে আসে পুরুষালী কন্ঠ। দুজনেই পেছনে তাকিয়ে দেখে চিত্র দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ কেমন যেনো অস্বাভাবিক! অর্পিতা বা স্মরণ কিছু বলার আগেই চিত্র কঠিন স্বরে বলে,

‘অর্পিতা এদিকে আয়! তোর সাথে আমার কথা আছে।’

চলবে..

#চৈত্রিকা (১৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

৪৪.
গত আধাঘন্টা যাবত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা আর চিত্র। চিত্র তখন ডেকে এনেছে ঠিকই তবে এখন অব্দি গলা দিয়ে একটা স্বরও বের করেনি। অর্পিতা নিজেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে চিত্রর মুখের দিকে। চিত্রর ডেকে এনে আবার চুপ করে থাকাটা হজম হলো না তার। তাই নিজেই বললো,

‘তুমি কি আসলেই কিছু বলার জন্য ডেকেছো চিত্র ভাই?’

চিত্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অর্পিতার দিকে। খ্যাক করে উঠে বলে, ‘না বললে কি তোকে এমনি ডেকেছি?’

অর্পিতা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়৷ সে রেগে যাওয়ার মতো কি বলেছে? চিত্র নিজেই তো আধাঘন্টা থেকে চুপ করে ছিলো বলে সে জিজ্ঞেস করেছে! হঠাৎ চিত্রর এমন ব্যবহারে অর্পিতা অবাক না হয়ে পারে না। অবাকতার রেশ ধরেই বলে,

‘তাহলে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ওখানে স্মরণ ভাইও তো একা দাঁড়িয়ে আছে!’

স্মরণের কথা শুনে রাগ হলো চিত্রর। তবে মুখে কিছু বললো না। শুধু গটগট করে উল্টে পথে হাঁটা লাগিয়ে বললো, ‘স্মরণ ভাইয়ের জন্য দরদ উতলে পড়ছে তাই না? উনার কাছেই যা। আমার কথা তোর শোনা লাগবে না।’

অর্পিতা হতভম্ব। কি হলো এটা? চিত্র তো এমন না৷ সে কথা বলে মেপে মেপে। প্রয়োজনের বাহিরে কথা বলে না আবার দেখা যায় অর্পিতার সাথে কখনোই রুডলি কথাও বলে না। কিন্তু চিত্রের কথা বার্তায় আজ সে বিশাল পরিবর্তন পেয়েছে। চিত্র কি তার ওপর রেগে ছিলো? ভাবতে ভাবতেই তাকিয়ে রইলো চিত্রর যাওয়ার পথে। নিমিষেই চিত্র উধাও হয়ে গেলে মাথা ভর্তি বিস্ময় আর প্রশ্ন নিয়ে ফিরে আসে স্মরণের কাছে। স্মরণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। অর্পিতাকে আসতে দেখে শান্ত স্বরে বলে,

‘আধাঘন্টা লেগে গেলো একটু কথা বলতে!’

হঠাৎ এহেন কথায় চমকালো অর্পিতা। মুখ ফুটে কিছু বললো না। স্মরণ বাড়ির পথে হাঁটা লাগিয়ে ছোট্ট করে বলে, ‘তুমি বা চিত্র কি একে অন্যকে ভালোবাসো?’

স্মরণের প্রশ্নে হা হয়ে যায় অর্পিতা। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে স্মরণের মুখের দিকে। স্মরণ ভীষণ স্বাভাবিক রয়েছে। এতো স্বাভাবিক, সহজ স্মরণকে হজম হলো না অর্পিতার। মনে মনে ভয় পেলো। এতো ঠান্ডা আবহাওয়া আবার ঝড়ের পূর্বাভাস না তো!

৪৫.
প্রহর সন্ধ্যার দিকে সাথীদের বাড়িতে চৈত্রিকার কাছে আসে। চৈত্রিকা তখন বসে বসে সনিয়া বেগম আর সাথীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। প্রহরকে আসতে দেখে সনিয়া বেগম চৈত্রিকাকে ঘরে পাঠায়। চৈত্রিকা কোনো কথা না বলেই ঘরে চলে আসে। গরমে প্রহরের হাল বেহাল। কোনোরকমে সিলিং এর নিচে বসে শার্ট খুলতে শুরু করে। সে সময় চৈত্রিকাকে ঘরে ঢুকতে দেখে প্রহর ক্লান্ত গলায় বলে,

‘গল্প ছেড়ে উঠে আসলে কেনো?’

চৈত্রিকা চোখ নামিয়ে নেয়। প্রহর তখন উদোম বুকে। চৈত্রিকা উল্টো ফিরে বলে, ‘আমাকে কি আপনার কোনো দরকার আছে?’

‘নাহ তো। দরকার থাকলে তো আমিই ডেকে নিতাম!’

‘তবে গেলাম আমি। আপনি হাওয়া খান বসে বসে।’

চৈত্রিকা বলেই ছুটে বেড়িয়ে যায়। প্রহর কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে চৈত্রিকার যাওয়ার পানে৷ এলোই বা কেনো আর গেলোই বা কেনো? পুরো ঘটনা বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসে প্রহর। টান টান করে শুয়ে কতক্ষণ আগে জিরিয়ে নেয়। তারপর উঠে অন্য একটা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে ঘর থেকে বের হয়। সোজা আজম আলীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে আজম আলী বেশ আয়েশ করে শুয়ে আছে। প্রহর গলা পরিষ্কার করতে করতে ঘরে ঢুকে। আজম আলী বিরক্তি নিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে প্রহরকে। লাফিয়ে উঠে বসে। প্রহর হেঁসে বিছানায় বসতে বসতে বলে,

‘আরে শ্বশুড়মশাই আমারে দেখে এতো লাফানোর কি আছে? আপনি শুয়ে থাকেন। আমি একটুও মাইন্ড করবো না।’

ফাঁকা ঢোক গিলে আজম আলী। প্রহর খানিকটা এগিয়ে এসে আজম আলীর কাঁধে হাত রাখে। হাসতে হাসতে বলে, ‘দুপুরে মামিজান আর আমার শালিকাকে কি বকা দিয়েছিলে আজম? আরেকবার আমার সামনে দাও তো!’

আজম আলীর হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। প্রহরের সামনে আমতা আমতা শুরু করে। প্রহর আজম আলীর কাঁধে তার ন’খ বসিয়ে দেয়। এতোটাই গভীর ভাবে নখ বসে যায় যে আজম আলীর কাঁধের মাংস ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়। আজম আলী আর্তনাদ করে ওঠে। অথচ প্রহরের চোখে ক্ষো’ভ আর ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি। যত সময় যায় একটু একটু করে আজম আলীর আর্তনাদ গভীর হয়। এক সময় প্রহর নিজেই ছেড়ে দেয়। আজম আলী নিজের কাঁধ আঁকড়ে নিয়ে ব্যাথায় ছটফট করতে থাকে। প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে ঘর থেকে বের হতে হতে বলে,

‘প্রহর রেনওয়াজের কথা অমান্য করার সামান্য একটু শা’স্তি।’

ঘরের বাহির থেকে এ দৃশ্যের পুরোটাই দেখে সাথী। ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে থাকে। প্রহর ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই সে লুকিয়ে পড়ে। এরপর কোনে রকম দৌড়ে যায় নিজের মা আর চৈত্রিকার কাছে। সাথীর হঠাৎ কাঁপা-কাঁপি আর অদ্ভুত আচরণ খেয়াল করে দুজনেই চমকায়। সাথী কোনোরকমে বড় বড় শ্বাস নিয়ে চৈত্রিকার হাত ধরে বলে,

‘চৈ-চৈত্র আব্বা!’

চৈত্রিকা ভ্রু কুঁচকায়। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে সাথীকে আগলে নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘ঠিক আছিস তুই? মামা কিছু বলেছে তোকে?’

সনিয়া বেগম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। সাথী কোনো রকমে বলে, ‘নাহ। জলদি ঘরে চল!’

চৈত্রিকা, সনিয়া বেগম আর সাথী আজম আলীর ঘরে গিয়ে দেখে আজম আলীর পুরো কাঁধ র’ক্তে ভেসে যাচ্ছে আর আজম আলী খাটের ওপর পড়ে ছটফট করছে। আজম আলীর হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় সবাই। আজম আলীকে নিয়ে মনের মধ্যে ঘৃ’ণা থাকলেও সবাই ছুটে যায়। চৈত্রিকা এক হাতে কাঁধ চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে। চৈত্রিকার পুরো শাড়ি ভিজে যায় তবুও রক্ত বন্ধ হয় নাহ। নিজের আঁচল তুলে চৈত্রিকা ভালো করে ক্ষত জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করে। কেউ যেনো মনের ক্ষোভ মিটাতে খুব যত্ন করে ছু’ড়ি দিয়ে কে’টে দিয়েছে কাঁধ! চৈত্রিকা দ্রুত চেপে ধরে। বাড়ির মধ্যে একটা হৈ হুল্লোড় পড়ে যায়। ৩ জনে মিলে কোনো রকমে ঘর থেকে বের করে আনে আজম আলীকে। এতোটা চিৎকার চেঁচামেচি শুনেও প্রহর নিশ্চিত মনে শুয়ে আছে নিজের ঘরে। সনিয়া বেগম ভ্যান ডাকতে গেলে আজম আলীর কথা শুনে কেউ এগিয়ে আসে না। চৈত্রিকা আজম আলীর ব্যাথায় নীলবর্ণ ধারণ করা মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

‘কতটা ঘৃ’ণিত ব্যাক্তি হলে গ্রামের একটাও মানুষ আপনার বিপদে এগিয়ে আসলো না তা কি বুঝেছেন মামা? এতোটাও পাপ করা উচিত না যতটা পাপ করলে মানুষও মুখ ফিরিয়ে নেয়!’

আজম আলী ব্যাথার্ত অবস্থাতেও চৈত্রিকার পুরো কথা শুনলো। হয়তো প্রথমবারের মতো মনে মনে ভীষণ আফসোস হলো প্রহরের কথা না শুনায়!

৪৬.
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। আজম আলীকে কোনো রকমে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। সনিয়া বেগম রাতে সেখানেই থাকবে। বাড়িতে থাকবে সাথী, চৈত্রিকা আর প্রহর। সাথী এখনো চৈত্রিকাকে পুরো বিষয়টুকু বলে উঠতে পারেনি তবে ঠিক করেছে বাড়ি গিয়ে যেভাবেই হোক বলবে। বাড়িতে ঢুকে চৈত্রিকা সাথীকে তার ঘরে যেতে বলে নিজে এগোয় নিজেদের ঘরের দিকে। প্রহর কোথায় তা দেখায় তার মূল উদ্দেশ্য। সে যদি খুব ভুল না হয় তবে মামার এই অবস্থা প্রহরই করেছে। চৈত্রিকা ঘরে ঢুকে দেখে প্রহর চোখ বন্ধ অবস্থায় শুয়ে আছে। এই অসময়ে যে প্রহর ঘুমাবে না তা খুব ভালো করেই জানে চৈত্রিকা। তাই সরাসরি প্রহরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এতো চিৎকার চেঁচামেচির পরও ঘর থেকে বের হননি কেনো?’

‘যে মা’রে সে কখনো সুস্থ করার জন্য মা’রে?’

প্রহরের সহজ ভাষায় স্বীকারোক্তি দেখে চেত্রিকা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। প্রহরের চোখ জোড়া তখনও বন্ধ। বন্ধ চোখেই ফের বললো,

‘এতো অবাক হওয়ার কি আছে? তুমি কি জানতে না কাজটা আমি ছাড়া করার মতো কেউ নাই!’

চৈত্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের মতো ঘুরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘাড় বাকিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়৷ প্রহরের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘জমিদারের ছেলেরা এসবে একটু বেশিই অভ্যস্ত। মানুষ মা’রা তো তাদের কাছে ডাল ভাতের মতো। আমি সাথীর সাথে ঘুমাবো দরজাটা লাগিয়ে নিজেও ঘুমান।’

‘জামাই আদর করবে কে শুনি? নতুন জামাই যে না খেয়ে আছে তার কি কোনো খোঁজ আছে? তোমার মামা তো এখনো ম’রেনি তাহলে আমার খাওয়া বন্ধ করতেছো কেনো?’

প্রহরের নির্বাক ভঙ্গিতে খাওয়ার কথা তোলা যেনো চৈত্রিকার কাছে আশ্চর্যজনক কোনো ঘটনা। এতোকিছু করে আবার বলছে তাকে জামাই আদর করতে! লোকটা কি পাগল নাকি মন বলতে কিছু নাই? চৈত্রিকার মনের প্রশ্ন গুলোর উত্তর অদ্ভুত ভাবে প্রহর নিজেই দেয়,

‘যখন মানুষ বার বার হৃদয়ে আঘাত পায় তখন আর মন, হৃদয় বলতে কিছু থাকে না। দয়া, মায়া বলতেও কিছু থাকে না। শুধু থাকে নি’ষ্ঠুরতা, পা’ষাণতা আর ভাঙা হৃদয়। যা পাথরের মতো শক্ত হয় তুলোর মতো নরম নয়।’

চৈত্রিকা অবাকের ওপর অবাক হয়। তার মনের কথা প্রহর বুঝলো কি করে? প্রহর কি বুঝালো? মাথার মধ্যে প্রশ্নের জট পেকে যায়। মাথার চিন্তা মাথাতে রেখেই রোবটের মতো বলে,

‘খেতে আসেন!’

ব্যাস! চৈত্রিকা বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। প্রহর উঠে বসে। চৈত্রিকার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘আমার পাথর হওয়া হৃদয়কে তুমি ফুলের মতো মসৃণ, সুন্দর করে দাও চৈত্র।’

৪৭.
খাওয়া দাওয়া শেষে চিত্র এসেছে তার বাবার ঘরে। পল্লবী তখন নীরার সাথে হল রুমে ছিলো। ঘরে ঢুকে চিত্র দেখে চয়ন বসে আছে। চিত্র কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলে চয়নের সামনে দাঁড়ায়। চয়ন ছোট ছেলেকে নিজের ঘরে দেখে বেশ স্বাভাবিক স্বরেই শুধায়,

‘কিছু বলবে চিত্র? এসময় আমার ঘরে যে!’

চিত্র দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। সে জানে সে যা বলতে এসেছে এই কথা শোনার পর তার আব্বাজান যে ঝড় তুলবেন তা ভ’য়ং’কর হবে। বুকে অনেকটা সাহস জুগিয়ে চিত্র একদমে বলে,

‘আমি অর্পিকে বিয়ে করতে চাই আব্বাজান!’

চয়ন রেনওয়াজ চমকায়। চোখ তুলে তাকায় ছেলের দিকে। চিত্রর দৃষ্টি তখনো মেঝেতে। হুট করেই তার গালে পড়ে এক বিশালাকার থা’প্পড়। ব্যাথায় টনটন করে ওঠে গাল। জ্বালা করে ওঠে মুহূর্তেই। চিত্র নিজের তাল সামলাতে না পেরে সরে যায় দু’পা। থা’প্পড়ের তালে মাথা হ্যাং মে’রে যায় কিছুক্ষণ। যখন মস্তিষ্ক ধরতে পারে তার সাথে কি হলো তখন সে অবাক চোখে তাকায় নিজের আব্বাজানের দিকে। চয়নের চোখে তখন আগুন জ্ব’লছে। রাগে, ক্ষো’ভে দাঁতে দাঁত চেপে চিত্রর উদ্দেশ্যে বলে,

‘তুমি কি বলছো তোমার কল্পনাতেও আছে? বয়স তোমার কেবল ২১। মানলাম তুমি বিয়ে করতে চাও তাই বলে অর্পিতাকে! তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি চিত্র।’

চিত্র নির্বাক হয়ে বলে, ‘অবাক কেনো হচ্ছেন আব্বাজান? আমি কি আপনাকে এর আগে বলিনি আমি অর্পিতাকে কতটা পছন্দ করি! আপনিই তো আমাকে বলেছিলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করলে আপনি নিজ দায়িত্বে অর্পিকে আমার হাতে তুলে দেবেন! আপনি কি আপনার দেওয়া কথা ভুলে গেছেন?’

চয়ন অপ্রস্তুত হলো। চিত্রর যে এখনো আগের বিষয়টা মনে আছে সে এটাই ভেবেই অবাক হলো। চিত্র যখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখনই অর্পিতারা গ্রাম ছেড়ে শহরে পা দেয়। চিত্র তখন সব পড়ালেখা ছেড়ে চয়নের কাছে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো ভয়ে। তখন চয়ন তাকে কথা দিয়েছিলো। অর্পিতাও যে চিত্রকে ভালোবাসতো এটা চিত্র ভালো মতোই জানতো কিন্তু অর্পিতার পড়ালেখা আর বয়স ভেবে নিজের থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলো আর এটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চয়ন কথা দেওয়ার সাথে সাথে জুড়ে দিয়েছিলো এক শর্ত। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিত্রর ভালোবাসা অর্পিতার কাছে প্রকাশ করা যাবে না। এমনকি অর্পিতার সাথে কোনোরকম যোগাযোগও রাখা যাবে না। পাগলাটে চিত্র সেদিন সব শর্ত মেনে নেয়। কথাও দেয় নিজের পিতাকে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে চয়ন তাকে এভাবে ঠ’কাবে জানলে কোনো কালেই সে চয়নের ওপর বিশ্বাস রাখতো না। ভরসা করতো না। চিত্রর ভাবনার মাঝেই চয়ন গম্ভীর স্বরে বলে,

‘তখন আমি তোমাকে শুধুমাত্র বোঝানোর জন্যই ওইসব বলেছিলাম। ভেবেছিলাম বয়স হলে সব ভুলে যাবে। তুমি এখনো ওইসব কথা ধরে বসে আছো কেনো চিত্র? তুমি জানো না আমি শায়লাকে পছন্দ করি না! আর যে শায়লাকে পছন্দ করি না সেই শায়লার মেয়েকেই পুত্রবধু করবো এটা কল্পনাতীত।’

‘কিন্তু অর্পি তো শুধু কাকিমার মেয়ে না আব্বাজান! সে তো এই জমিদার বংশেরই অংশ।’

‘এতো কিছু জানি না। তাছাড়া এখন অর্পিতার বিয়ে পাকা হয়ে গেছে তাই তোমার জন্য এটাই ভালো হবে পুরোনো সব কথা ভুলে নিজের পড়ালেখায় মন দাও।’

চিত্র হুট করেই চয়নের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বাচ্চারা যেমন করে তার পছন্দের জিনিস পাওয়ার জন্য কাঁদে তেমন করেই কাঁদে চিত্র। ভাঙা গলায় বলে,

‘আব্বাজান আমি আজীবন আপনার কাছে কিছু চাইবো না। আপনার অর্পিতাকে পছন্দ না হলে ওকে বিয়ে করে আমি দুরে চলে যাবো তবুও ওর বিয়ে অন্য কোথাও হতে দেবেন না। আপনি আমাকে যখন যেভাবে চলতে বলেছেন আমি চলেছি। জীবনে আম্মাজান আর অর্থির পর আমি একটিমাত্র নারীকেই মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসেছি তাকে এভাবে আমার থেকে কেড়ে নিবেন না। আমি আজীবন আপনার পায়ের নিচে পড়ে থাকবো কখনো আপনার কোনো কথা অমান্য করবো না শুধু আমার অর্পিকে আমার করে দিন। আমি তো আপনার ছেলে আব্বাজান। আমার থেকে অর্পিকে কেড়ে নিয়ে এভাবে ধীরে ধীরে মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েন না আব্বাজান।’

হুশ জ্ঞান হারিয়ে গেছে চিত্রর। নিজের আব্বাজানের সামনে বেহায়ার মতো নিজের ভালোবাসার দাবী করে যাচ্ছে। ছেলেরা নাকি কাঁদে না! অথচ একটা ২১ বছরের যুবক তার ভালোবাসা পাওয়ার তাগিদে হাউমাউ করে কাঁদছে। এই কান্না দেখেও মন গলে না চয়নের। নি’ষ্ঠুরের মতো পা ছাড়িয়ে নিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে,

‘এসব বলে কিছুই হবে না চিত্র। তুমি এক্ষুণি বের হও আমার ঘর থেকে!’

চিত্রর কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। শব্দ বের হয় না মুখ থেকে। বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে এলোমেলো পায়ে ঘর থেকে বের হয়। বাহিরে তখন পল্লবী দাঁড়িয়ে আছে। চিত্র নিজের শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বের হয়। পল্লবীর দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে যায়। পল্লবীর চোখে তখন আগুন জ্ব’লছে। ছোট ছেলের চোখের পানি দেখে ভেতরের জ্ব’লন বাড়ে। চোয়াল শক্ত করে বিড়বিড় করে বলে,

‘আমার জীবন আপনি খুব সুন্দর করে নিজের হাতে ধ্বং’স করেছেন চয়ন রেনওয়াজ কিন্তু আমার ছেলেকে ধ্বং’স করতে দিবো না। বয়সের সাথে সাথে দিনকে দিন আপনার পাপ বেড়ে যাচ্ছে আরো বেশি। আমার ছেলের একেক ফোঁটা চোখের জলের মূল্য চোকাতে হবে আপনাকে। কতটা কষ্টের হবে দিনগুলো শুধু আমি ভাবছি!’

চলবে..