ছদ্মবেশে লুকানো ভালোবাসা পর্ব-০৭

0
880

#ছদ্মবেশে_লুকানো_ভালোবাসা
#মৌমি_দত্ত
#পর্ব_৭
#ধামাকা_৩

– তোমার মাস্ক আর উইগ আমার কাছে মিস্টার ইনায়াত!! উপস,, সরি,, মিস বা মিসেস ইনায়াত।
ফাঁটাফাঁটা চোখে ইনায়াত তাকিয়ে রইলো আফিমের দিকে। আফিম সব জেনে গেছে এটা মানতে যেন বড্ড কষ্ট হচ্ছে ইনায়াতের।
– বুঝতে পারছো না কি হলো বা কিভাবে হলো?? তাহলে চলো,, ফ্ল্যাশব্যাক দেখে আসি,,
ফ্ল্যাশব্যাক,,,
– এই ছেলেটার এতো কিসের লজ্জা আমি বুঝি না?? লজ্জা থাকবে মেয়েদের। গাধার মতো যদি মুখে মাস্ক আর মাথায় হুডি লাগিয়ে ঘুমায় তাহলে এসি রুমেও গরমে ঘামাবে।
আফিম এসব বলতে বলতে এগিয়ে গেলো ইনায়াতের দিকে। ইনায়াতের মুখের মাস্ক খুলে নিলো। ইনায়াতের মুখের মাস্ক খুলতেই ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো আফিমের।
– ওহ মাই গড!! ইনুকে তো দেখতে জান্নাতী হুরপরীদের থেকেও বেশি সুন্দর। এরকম মেয়েলি দেখতে বলেই মেবি ও লজ্জা পায় মুখ দেখাতে।
এসব ভেবেই পেট চেপে হেসে ফেললো আফিম। এরপর হাসতে হাসতেই ইনায়াতের হুডি ধরে টাব মেরে খুলতেই হা হয়ে গেলো আফিমের মুখ। ইনায়াতের হুডি খুলে গেছে। কিন্তু তার সাথে আফিমের হাতে উঠে এসেছে ইনায়াতের উইগ।
– হোয়াট দা হ্যাল!!!
মৃদু চিৎকারেই বলে উঠলো আফিম। ইনায়াত হালকা বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে ফিরে গেলো,, আফিমের দিকে পিঠে দিয়ে। ইনায়াতের কালো লম্বা চুলগুলো কাটা দিয়ে খোপা করে বাঁধা। অবিশ্বাস্য চোখে সেকেন্ড খানেক তাকিয়ে রইলো আফিম। এরপর শুকনো একটা ঢোক গিলে খোপাটাও টেনে খুলে নিলো। সাথে সাথেই ইনায়াতের লম্বা লম্বা চুলগুলো ট্রেইনের। মেঝেতে গিয়ে পড়লো। আফিম কাঁপা কাঁপা পায়ে ধুপ করে নিজের সিটে বসে পড়লো। এক এক করে মিলে যেতে লাগলো এই কঠিন অংকের সমীকরণ।
( ইনায়াতের মাস্ক আর হুডি খুলতে না চাওয়া)
( কখনো মদ বা সিগারেট না খাওয়া)
( মেয়েদের প্রতি কোন আগ্রহ না দেখা)
( খালি গায়ে আফিমের দিকে না তাকানো)
( গতকালকে হঠাৎ শোনা ঐ মেয়ের গলার স্বর)
– ইনায়াত একটা মেয়ে??
নিজেকেই নিজে বিড়বিড়িয়ে প্রশ্ন করলো আফিম
.
.
বর্তমানে,,
ইনায়াতের অবস্থা বুঝতে পেরে আফিম উঠে এসে ইনায়াত মুখের সামনে চুটকি বাজালো। ইনায়াত হকচকিয়ে তাকালো সেকেন্ড খানেক। এরপর অপরাধবোধে মাথা নিচু করে ফেললো। তখনই আফিম একদম ইনায়াতের দিকে ঝুঁকে এসে ইনায়াতের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,,
– লিসেন বেবী ডল!! আমার চরিত্রটা অনেকটাই লুস!! ঢিলা ঢালা আরকি!! এখন এই পুরো বগীতে আমি আর তুমি একা। আমার শক্তির সাথে তুমি পেরে উঠবে না যদি আমি তোমাকে কাছে টেনে নিতে চাই।
এটুকু শুনেই ঝট করে তাকালো ইনায়াত আফিমের দিকে। ইনায়াতের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সবটা। আফিম ডেভিল হেসে বললো,,
– তবে তুমি বেঁচে যেতে পারো!! যদি তুমি আমাকে সবটা ক্লিয়ারলি বলো!!
আফিম এটুকু বলে উঠে দাঁড়ালো। নিজের সিটে গিয়ে স্টাইল নিয়ে বসলো। ইনায়াত কিছুক্ষন আফিমের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে জল জমতে লাগলো ইনায়াতের। তবে আফিম তা পাত্তা দিলো না। ইনায়াত মাথা নিচু করে বলতে শুরু করলো তার ভয়ংকর অতীতের কথা।
– আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস টেনে উঠেছি। সেদিন ছিলো আমাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমি। অনুষ্ঠান শেষে একা একা ফিরছিলাম। কখনো কোন বন্ধু বান্ধবী রাখিনি আমি। কারণ বাবা নিষেধ করেছে। আমার বাবা নামকরা ব্যবসায়ীদের একজন,, ইরশাদ মির্জা। বাবা ছাড়া আমার আর কেও নেই। মা ছোটবেলায় মারা যায়। তাই বাবার সব কথাই আমি মেনে চলি। সেও আমাকে অনেক ভালোবাসে। গাড়িতে চড়তে ভালো লাগে না আমার। সিম্পলভাবেই চলতে ভালো লাগে। যেমন,, ফুচকা খাওয়া,, রিক্সায় ঘুরা ইত্যাদি। সেদিন একা একা ফিরবার পথে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। শর্টকাটে ঢুকে পড়লাম ইচ্ছে করেই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে তাই। আর শর্টকাট রাস্তায় গাড়ি চলাচল হয় না,,, করে না কেও। দুইদিকে ভালো করে চেয়ে দেখে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম নিজের মতো করে। খেয়ালই করিনি কখন সেখানে দানবটা চলে এসছে। তাহজিব খান,,, আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন নামকরা মাফিয়া। হঠাৎ একটা মানুষ চোখে পড়তেই চমকে উঠেছিলাম খুব। দ্রুত পা চালিয়ে চলেই আসবো। কিন্তু তখনই মানুষটা পথ আটকে দিলো। কিছুই বললো না মুখে। শুধু কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে সড়ে দাঁড়ালো পথ থেকে। সেকেন্ড দেরি না করে পা চালিয়ে চলে এলাম বাসায়। কিন্তু আমার ভাগ্যতে তাহজিব নামের কালো ছায়া পড়েই গেলো। প্রতিদিন স্কুল গেইটের সামনে ঢুকবার সময় আর বের হবার সময় তাকে জিপে বসে থাকতে দেখতাম। স্কুলের টিচাররা,,, কোচিংয়ের স্যাররা আমাকে ভয় পেতো। উঠতি বয়সী ছেলে মেয়ে সবাই,, তাই কৌতুহলও বেশী। আস্তে আস্তে সবার মাঝে ছড়িয়ে গেলো আমার সাথে তাহজিব খানের সম্পর্ক আছে। কেও কেও এই গল্পটার ভালো একটা সুন্দর দিক বানাতো। কেও কেও খুব বিচ্ছিরি ভাবে বর্ণনা করতো। এভাবেই সহ্য করতে লাগলাম স্কুল পার হয়ে কলেজ শেষ করা পর্যন্ত। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতেই আর থাকতে না পেরে আমি বাবাকে সবটা জানালাম।
এটুকু বলেই থেমে মুখ দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো ইনায়াত। আফিম চোখ বন্ধ করে রাখলো সেকেন্ড খানেক। এরপর পানির বোতল নিয়ে ইনায়াতের পাশে গিয়ে বসলো। ইনায়াত নিজের পাশে কারোর অস্তিত্ব অনুভব করে চোখ খুলে তাকালো। আফিম পানির বোতল এগিয়ে দিলো। ইনায়াত পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করলো। পানি খেয়ে ইনায়াত যেন কান্নায় ফেঁটে পড়লো। আফিম ইনায়াতের এক হাতের উপর নিজের হাত রেখে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বললো। ইনায়াত শান্ত হতে পারলো না। তবুও বলতে লাগলো।
– বাবা সবটা দেখে নেবে বললো। বাবা আর তাহজিব বাবার অফিসে দেখা করলো। কি কথা হয়েছে জানা সম্ভব ছিলো না কেননা আমাকে নেওয়া হয়নি। তবে বাবা বাসায় এসে জানালো তাহজিব বাবার গায়ে হাত তুলেছে। মানুষটাকে ভয় লাগতো। এখন আরো বেশি ভয় আর ঘৃণাও লাগে। এরপরের দিন কোন কারণ ছাড়াই পার্কে গেলান ঘুরতে। কেননা আমি জানি পার্কেও সে অপেক্ষা করবে। সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তাহজিবকে। আমি ভেবেই এসেছিলাম কি করবো না করবো আজকে। তাই এগিয়ে গেলাম তাহজিবের দিকে। তাহজিব প্রচন্ড অবাক হয়েছিলো আমাকে তার দিকে আগাতে দেখে। আমি এগিয়ে তাহজিবের জীপে উঠে বসলাম। সেও অবাক হয়ে উঠে বসলো। আমি তাকে বললাম যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন উনার বিশাল বাসায়। এরপর পাগলের মতো আমাকে দেখাতে লাগলেন সব রুম,,, আমার জন্য সাজানো রুম,, ফটোগ্রাফার দিয়ে লুকিয়ে তোলা আমার ছবি। এরপর,,,,
ইনায়াত চুপ করে গেলো। আফিম উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো। না পারতে আফিম জিজ্ঞেস করলো,,
– এরপর কি ইনায়াত??
– আমাকে রুমে বন্দী করে কাজী ডাকিয়ে আনলেন। আমার বাবা নাকি ভালো মানুষ না। আমাদের বিয়ে না হলে আমার বাবা নাকি আমারই ক্ষতি করবে। এমনই সব উল্টোপাল্টা কারন দেখিয়ে আমাকে বিয়ের জন্য জোড় জবরদস্তি করতে লাগলেন। নিজের ভয় আর রাগের জন্য আমি তাকে চড় মেরে বসলাম। ওটাই আমার ভুল ছিলো মেবি। আমাকে নিজের রুমেই বন্দী করে রাখলো সে। বাবা আর বাবার পিএ রানা আংকেলকে তুলে আনা হলো। আমাকে শাস্তি স্বরুপ উনি নিজের সাথে রাখতো। যদিও কখনো স্পর্শ করেনি উনি। এরই মাঝে উনাকে দেশের বাইরে যেতে হলো কোন কাজের জন্য। উনি দেশের বাইরে গেলেন। আর এও বলে গেলেন ,,, ফিরে এসে আমার বাবার সত্যি নাকি আমাকে দেখিয়ে দেবে আর আমাকে বিয়েও করে নেবে। জোচ্চোর কোথাকার!!
কান্না থেমে গিয়ে রাগে ফোসফাস করতে লাগলো ইনায়াত। আফিম নিজের মুখ চেপে ধরলো দুই হাত দিয়ে।
– বাবা আর রানা আংকেল আমাকে পালাতে সাহায্য করলো। এখানে রানা আংকেলেরই একটা দুতলা বাসায় উঠলাম। আংকেল টাকা পাঠালো কিছু। তবুও জব একটা খুঁজতে লাগলাম। তাহজিবের ভয় এই শহরেও পিছু ছাড়লো না। নিজের মেয়ে হয়ে জন্মানোটা অভিশ্বাপ মনে হলো। তাই এখানে যেদিন আসলাম,, সেদিন থেকেই ছেলের রূপে চলাফেরা করি। এরপর আপনার সাথে দেখা। বাবা আর রানা আংকেলের সাথে যোগাযোগ হয়নি আর। জানিনা তাহজিব তাদের কি অবস্থা করেছে এতোদিনে। কিন্তু আমি বাবার মাথা ছুঁয়ে বলেছি আমি আর তাহজিবের সামনে পড়বো না। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবোই।
এটুকু বলেই ইনায়াত কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আফিম কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ইনায়াতকে এক টানে বুকে এনে ফেললো। কান্নায় ব্যস্ত ইনায়াতের হুশ হলো না। উল্টো আফিমের বুকের গুটিশুটি হয়ে মুখ গুঁজেই কাঁদতে লাগলো।
– কান্না করছো কেন ইনায়াত?? যা হওয়ার হয়ে গেছে!! এখন তো আর তুমি তাহজিবের কাছে নেই। চিন্তা করো না,,, কেঁদো না। আমি আছি তো। আমি আছি তোমার সাথে। তোমার সাথে আমি নীলার মতো কিছু হতে দেবো না। কখনোই না,,, আই প্রমিজ।
কান্নায় ব্যস্ত ইনায়াত হয়তো খেয়ালই করেনি আফিমের বলা কোন কথা।
.
.
মিনিটখানেক সেভাবে থাকার পর ইনায়াত শান্ত হতেই বুঝতে পারলো সে কি করছে। তড়াক করে লাফিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে বসলো ইনায়াত।
– আই এম সরি স্যার!! আমি অসহায় ছিলাম বলেই এতো বড় একটা মিথ্যে নিয়ে আপনাদের সাথে থাকতে হলো। এছাড়া আমার কোন কুমতলব ছিলো না।
আফিম নিজের সিটে গিয়ে বসলো। ইনায়াত একবার গম্ভীর মুখে থাকা আফিমের দিকে তাকিয়ে জানলার দিকে তাকালো। রাতের জন্য কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। জানলার দিকে তাকিয়ে আনমনেই বললো,,
– আমার মায়ের ভালোবাসা আমি পাইনি৷ লাবিবা আন্টির মাঝে আমি মায়ের মমতা ও স্নেহ পেয়েছি। জোসেফ আংকেল আমাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিয়েছে। অথচ তাদের সাথে আমি এতো বড় একটা অন্যায় করেছি। যদিও কোনটাই ইচ্ছে করে নয়। তবে অন্যায়ই তো। চিন্তা করবেন না স্যার!! আমি আজকে গিয়ে সবটা সত্যি বলে দিয়ে অন্য শহরে চলে যাবো। আই প্রমিজ।

উইমা!! ইনায়াতকে তো দেখে নিলো আফিম!! এখন কি আফিমের কালো নজরের শিকার হবে ইনায়াত?? নাকি গল্পের নতুন কোন মোড় আসতে চলেছে?? আর তোমাদেরকে অনেক ভালোবাসা আপি আমাকে এতোটা সাপোর্ট করার জন্য। সাথে থেকো এভাবেই সবসময়। আমি সবসময় চেষ্টা করবো তোমাদের মনে এইভাবে জায়গা ধরে রাখার। বাই দা সমুদ্র,, ধামাকা এখনো শেষ হয়নি কিন্তু। আর হ্যাঁ!! ” নীলা কে,, আফিম আগে থেকে বাজে বলা হয়েছে শুরুতে তাহলে এখন কেন ভালো দেখাচ্ছি,,, তাহজিব ইরশাদের ক্ষতি করেছে কেন,,, ” এইসবগুলোর উত্তর পাবে আপু ও ভাইয়ারা। এত্তোগুলো ভালোবাসা তোমাদের জন্য।

চলবে,,,