ছদ্মবেশ পর্ব-৮২+৮৩ এবং শেষ পর্ব

0
667

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৮২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

ফারিহাকে ফোন হাতে সোফায় বসে থাকতে দেখে তুষার চার পাশে একবার চেয়ে ধীরে পায়ে ফারিহার পাশে গিয়ে বসে। ফারিহা আড় চোখে তুষারের দিকে তাকালে গাল টেনে একটা হাসি দেয় তুষার। ফারিহা আমার এক মনে ফোনের দিকে নজর দেয়।
পাশ থেকে তুষার কথা বলার জন্য বলে,
– কি করছেন?
ফারিহার তার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে,
– লুডু খেলছি। আপনি খেলবেন?
যদিও তুষারের এমন আহম্মকি প্রশ্নে ফারিহা বিরক্তি প্রকাশ করতে কথাটা বলেছিলো। তবুও তুষার সিরিয়াস মনে করে বলে,
– লুডু খেলতে পারেন? যদিও আমি শুনেছি মেয়েরা অনেক ভালো লুডু খেলে।
ফারিহা এবার বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে কিছুটা হেসে দিয়ে বলে,
– হুম পারি।
ফারিহার হাসি দেখে তুষার তৎক্ষনাৎ বলে,
– আমাকে হারাতে পারবেন? যদিও আপনাকে দেখে এতোটাও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে না। তবে হারে যাওয়ার ভয় পেলে খেলার দরকার নেই।

তুষার কথাটা এমন ভাবে বললো, এখন না খেলেও ভেবে নিবে ভয় পেয়েছি। এমনিতেও ইনি ডিরেক্টলি বুদ্ধিহীন বললো।
নিজের মাঝে এই ভাবনার উদ্বয় হলে ফারিহার মাথায়ও জেদ চেপে বসে। ফোন এক পাশে রেখে এবার জেদ ধরে ডিলে আসে। তুষারের দিকে চেয়ে ফারিহা শক্ত গলায় বলে,
– জিতলে লাভ কি? যদি আমি জিতে যাই তাহলে কি দিবেন আমায়।
তুষার কিছুটা ভেবে বলে,
– সেটা পরে দেখা যাবে। তবে দিবো মুল্যবান কিছু একটা।
ফারিহা তুষারের দিকে আঙুল ধরে বলে,
– শিউর তো?
তুষারও ভাব নিয়ে বলে,
– হুম শিউর। তবে আমি জিতলে কি দিবেন?
ফারিহা বলে,
– যদি আপনি জিততে পারেন তাহলে আপনার সবচেয়ে পছন্দের খাবার আমি নিজে আপনাকে রান্না করে খাওয়াবো।
তুষার হাতের তুড়ি বাজিয়ে বলে,
– ওকে ডিল ফাইনাল।

ফারিহা এবার ফোনে লুডুর এ্যাপ্সটা ওপেন করে। সোফায় দুইজনের মাঝখানে ফোন রেখে দুজন দুই পাশে বসে খুব মনোযোগ সহকারে খেলায় মন দিলো।
খেলার মাঝ পথে তুষার অনেকটাই এগিয়ে। ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
– আমার পছন্দর খাবার হলো বিরিয়ানি। আমার জন্য কিন্তু স্পেশাল ভাবে রান্না করতে হবে।
ফারিহা গুটির দিকে চেয়ে থেকে বলে,
– খেলার এখোনো অনেকটা বাকি আছে। আগে শেষ হোক, দেখি কে জিতে।

দেখতে দেখতে আরো কিছুক্ষন কেটে গেলো। হুট করে ফারিহা ফোন হাতে জিতার খুশিতে লাফিয়ে উঠে। অপর দিকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে তুষার। খেলার মোড় তার দিক পরিবর্তন করেছে।
ফারিয়া হাস্যজ্জল মুখে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
– দেন এবার আপনার মুল্যবান জিনিস টা দেন।
তুষার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে অতঃপর উঠে দাড়িয়ে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
– আল্লাহ আপনার ভাগ্যে আমার মতো একটা ভালো মনের ছেলেকে স্বামী হিসেবে কবুল করুক।

ফারিহাও জয়ের উত্তেজনা বসত বলে উঠে,
– আমিন, এখন আমার পাওনাটা দেন।
তুষার ভ্রু কুচকে বলে,
– দিলাম তো।
ফারিহাও অবাক হয়ে বলে,
– কোথায়?
তুষার স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– এই যে দোয়া করে দিলাম।
ফারিহা মুহুর্তেই হ্যাপি মুড থেকে বেড়িয়ে রাগী মুডে তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
– এসব চিটিং এর কোনো মানে হয়?
তুষারও যুক্তি দেখিয়ে বলে,
– আপনিই বলুন, দোয়ার উপর কোনো মুল্যবান উপহার আছে? সেই হিসেবে আমি তো একটা মুল্যবান উপহারই দিলাম আপনাকে।
ফারিহা এবার রাগে কটমট করতে করতে বলে,
– এমন চিটিং করবেন জানলে কখনোই আপনার সাথে খেলতে বসতাম না। শুধু ভাইয়ার বন্ধু দেখে আপনাকে কিছু বললাম না। নয়তো ধরে নিয়ে খালের পানিতে চুবাতাম। খবিশ একটা।
তুষার বলে,
– মেহমান হওয়ার স্বত্বেও আমাকে বার বার অপমান করা হচ্ছে এখানে আসার পর থেকে। আমিও শুধু নিবিড়ের বোন দেখে কিছু বললাম না। নয়তো,,,,
ফারিহা এবার দুই হাত কোমড়ে রেখে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
– নয়তো কি করতেন হুম?
তুষার এবার শান্ত হয়ে ফারিহার দিয়ে চেয়ে বলে,
– ভালোই তো গায়ে পরে ঝগড়া করতে পারেন। তবে রাগলেও কিন্তু আপনাকে সুন্দরই লাগে।

একে তো চিটিং করলো, এখন আবার ঝগড়াটে বললো। ফারিহা এবার রাগে ফোঁস ফোঁস করে হাটা ধরে সেখান থেকে। তুষার অনেক কষ্টে নিজের হাসিটা চাপিয়ে রেখে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
– রাজ-রুশান এরা কিছুক্ষন আগে বাইরে গেলো। আমিও একটু বাইরে যাচ্ছি, দরজাটা লক করুন।
বলেই ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই ফারিহা এসে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো ভেতরে।
বাইরএসে হুট করে শরির ঝাঁকিয়ে হেসে উঠে তুষার। অনেক্ষন হাসি আটকিয়ে রাখার পর হুট করে যেভাবে আচমকাই হেসে উঠে মানুষ। হাসতে হাসতে অস্থির অবস্থা তার।
,
,
এদিকে ছাদের দোলনাটায় বসে রাতের আকাশে চন্দ্র বিলাশ করতে ব্যাস্ত নিবিড় ও নীলা। নিবিড় বসে আছে হেলান দিয়ে। তার কাধে নীলার মাথা। চুপটি মেরে বসে বসে নিবিড়ের বকবক শুনছে। সাথে চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে তাদের মাঝে। চাঁদের আলোয় মানুষকে স্বাভাবিক আলোর চেয়ে কিছুটা ভিন্ন দেখায়। সেটা আবার নির্ভর করে বিপরিত মানুষটা কতটা প্রিয় বা তার সাথে ঘনিষ্ঠতা কতটুকু। মানুষটা যত প্রিয় হয়, মুহুর্তটাও ততো মন-মুগ্ধকর হয়ে উঠে।

এর মাঝে বিরিয়ানিতে এলাচির মতো করে নিবিড়ের ফোনে টুং করে একটা মেসেজ ভেষে আসে। দেখে তুষারের মেসেজ। নীলার সাথে একটু শান্তিতে একাকি কথা বলার সময় প্রতিবারই এই তুষার কোনো না কোনো ভাবে তাদের মাঝখানে এসে ঢুকে পরে। হোক সরাসরি বা হোক ফোনে।
“তোদের বাসায় নিয়ে এসেছিস। তো এখন গার্লফ্রেন্ডের কোল থেকে উঠে এসে আমাদেরও তো সময় দিতে পারিস ভাই। একটা গার্লফ্রেন্ড আছে বলে কতো রং তামাশা দেখাবি আর?”
মেসেজ পড়ে নিবিড়ের হাসি আসলেও তা থামিয়ে রিপ্লাই দিলো,
– ছাদে আয়, আমা ছাদেই আছি।
তুষার রিপ্লাই দেয়,
– আমি একটু মার্কেটে আসছি।
– কেন?
– একটু দরকার ছিলো তাই।
– এই রাতের বেলায় মার্কেটে কখন গেলি, আমাকে তো বললিও না।
– তোকে বলবো কিভাবে? তুই তো তোর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে তোদের সাংসারিক ডিমে ‘তা’ দিচ্ছিস।
– হা হা, প্রেমে পরলে বা বিয়ে করলে তখন বুঝবি। আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয় বাসায়।

নিবিড় ফোন অফ করে আবার রেখে দিলে নীলা বলে,
– কে ছিলো।
– তুষার।
নীলা মুখে একটু বিরক্তি নিয়ে বলে,
– তার কি খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই? সেই আমাদের পরিচয়ের প্রথম থেকেই খেয়াল করছি সব সময় আমাদের মাঝখানে পরে থাকে। এমন কেন সে?
নিবিড় একটু মুচকি হেসে বলে,
– তুষার কেমন তা ব্যাখ্যা করে বলতে পারবো না আমি। তবে সে আর বাকিরা না থাকলে হয়তো জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলতাম আমি। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই তুষারের কারণেই তুমি আর আমি পুনরায় একসাথে এভাবে বসে কথা বলতে পারছি। সো কখনো আমার বন্ধুদের কোনো কিছু নিয়ে আমার কাছে বিরক্তি প্রকাশ না করলেই আমি খুশি হবো। আমার ফ্যামিলি ও তোমার মতো তারাও আমার জীবনের একটি অংশ। কাউকেই বিন্দু মাত্রও কম করে ভাবতে পারবো না আমি। সকলেই আমার লাইফের ইম্পর্টেন্ট পার্সন।
,
,
রাতের খাবার শেষে সকলে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজ-রুশান এক জয়গায়, নিবিড় ও তুষার এক জায়গায়, ফরিদা আন্টি ও নীলা অন্য জায়গায়। তাদের সাথে আবার ফারিহাও এড হয়েছে। আজ হবু ভাবির সাথে থাকবে সে।

রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতির মুহুর্তে ফারিহাকে আড়ালে ডেকে একটা ছোট গিফ্ট বক্স হাতে তুলে দিলো তার। সাথে মুচকি হেসে বলে,
– আমি কথা দিলে কখনো সেই কথার বরখেলাপ করি না।

এই মুহুর্তে নেওয়ার জন্য মোটেও ইচ্ছে নেই ফারিহার। কারণ গিফ্টের মুড টা সন্ধা বেলার ঝগড়াতেই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তুষারকে কিছু বলতে গেলে তুষার তার আগেই ফারিহার হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
– রাগলে সুন্দর লাগে আপনাকে। প্রথম দিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম তা। তাইতো অজথাই আপনাকে রাগিয়ে দিতে ভালো লাগে। ভাববেন না বাড়িয়ে বলছি। আপনি যতটুকু ডিজার্ব করেন ততটুকুই বলছি। এখন এটা হাতে নিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলে এর চেয়েও বেশি কিউট দেখাবে।

বলেই একটু মুচকি হেসে চলে গেলো তুষার। সাথে যেন প্রথম নতুন কাউকে কেন্দ্র করে অকারণেই হেসে উঠে ফারিহাও।

তুষারের দেওয়া গিফ্ট টা হাতে নিয়ে রুমে যাওয়ার সময় ফরিদা আন্টি সামনে পরলে চট করে তা লুকিয়ে ফেলে ফারিহা। খেলায় জিতে গিফ্ট পেলেও তা কাউকে দেখাতে প্রচুর লজ্জাবোধ করছে সে। কিন্তু ফরিদা আন্টির চোখের আড়াল হলো না তা।
একটু মুচকি হেসে ফারিহাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করলে সত্যটাই বলে সে। ফরিদা আন্টি একটু ভ্রু-কুচকে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
– তুষার আমাদের সাথে কতোদিন একসাথে ছিলো। তুষারকে তো জীবনেও কাউকে গিফ্ট দিতে দেখলাম না। তুমি কিভাবে কিছু আদায় করলে তার থেকে? কাহিনি কি?
,
,
সকালে নাস্তা শেষে নিজ হাতে বিরিয়ানি তৈরি করে ফারিহা। সকাল সকাল গরম গরম বিরিয়ানির তাদের সামনে রাখা হলে নিবিড়ের পাশের চেয়ারে বসে তুষার। নিবিড়ের কানে কানে বলে,
– ভাই, তুই তো জানিস বিরিয়ানি আমার কতো পছন্দের। তার উপর তোদের বাড়িতে এসেছি। চাইলেও মন মতো খেতে পারবো না। তাই এক কাজ করবি তুই, আমার প্লেটে শেষ হলেই শুধু দিতে থাকবি। আমি তোকে বলবো, ভাই আর দিস না, আমি খেতে পারবো না। তবুও তুই জোড় করে আমার প্লেটে তুলে দিবি। আর বিশেষ করে মাংসের দিকটা খেয়াল রাখবি।

খাওয়া শুরু হলে নিজেদের মতো খাচ্ছে সবাই। তুষারের প্লেট খালি হতেই নিবিড় চামচ নিয়ে তার প্লেটে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে তুষার বলে,
– বেশি খেতে পারবো না অল্প করে দে।
নিবিড়ও হেসে বলে,
– আরে চুপচাপ খা, লজ্জা পাওয়ার কি আছে?

এরপর ঐটাও শেষ হলে পা দিয়ে নিবিড়ের পায়ে টাচ করলে নিবিড় আবার দিতে প্রস্তুত হলে তুষার বলে,
– ভাই আর খেতে পারবো। প্লিজ আর দিস না।
নিবিড় আবারও বলে,
– চুপচাপ খা, লজ্জা পাওয়ার কি আছে?

পরপর তিন প্লিট শেষ হলে এবার সত্যিই পেট ভরে যায় তুষারের। চাইলেও আর খেতে পারবে না। তবুও তার প্লেটে বিরিয়ানি তুলে দিতে লাগলো নিবিড়। তুষার নিবিড়ের দিকে চেয়ে বলে,
– ভাই, পেটে আর একটু জায়গা অবশিষ্ট নেই। আর খেতে পারবো না।
নিবিড় আবারও একই কথা বলে,
– আরে সবাই আমরা আমরাই তো। এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তুই শুধু চুপচাপ খেয়ে যা।

এই মুহুর্তে তুষার কি করে নিবিড়কে বুঝাবে যে, এবার আর সত্যিই খেতে পারবে না সে। কিন্তু বললেও তো নিবিড় সেই প্রথম বারের মতোই বুঝে নিচ্ছে। খাওয়ার সাথে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। এদিকে নিবিড় পুনরায় তার প্লেট ভর্তি করে দিলো। পাশ থেকে ফারহাও বলে,
– দিয়েই যখন ফেলেছে, কষ্ট করে এটাও খেয়ে নাও বাবা। খাবার অপচয় করতে নেই।

এদিকে তুষারেরও কিছু বলার নেই। ছল ছল নয়নে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে নিবিড়ের দিকে।

খাওয়া শেষে সোফায় বসে আছে তুষার। হেটে রুম অব্দি যাওয়ার শক্তি নেই তার। জীবনের মতো বিরিয়ানি খাওয়ার স্বাদ মিটে গেছে আজ। সেই মুহুর্তে ফারিহা তার পাশে এসে বলে,
– দুই জনের খাবার তো একাই খেয়ে ফেললেন। যাই হোক, আপনার প্রিয় খাবার বলে কথা। আর হ্যা, আমিও আবার কাউকে কথা দিলে তার বরখেলাপ করার মতো মেয়ে না। রান্না করে খাওয়াবো বলেছিলাম, এখন খাইয়েছি। মেহমান মানুষকে খাওয়াবো বলে, না খাওয়ালেও কেমন দেখায় বলুন তো।
তুষার জোড় পূর্বক একটু হেসে বলে,
– রান্না অনেক ভালো হয়েছে। খেয়েও অনেক মজা পেয়েছি। আমিও অনেক খুশি হয়েছি। আল্লাহ্ আপনার ভালো করুক।
কথাটা বলেই আবার মনে মনে বিরবির করে বলে,
“তোর ভাই আমাকে জীবনের মতো বিরিয়ানি খাওয়ার স্বাধ মিটিয়ে দিছে বোন।”

খাওয়া শেষে কিছু সময় কাটিয়ে নিজেদের ব্যাস্ততার জন্য বেড়িয়ে পরতে হয় রুশান ও রাজ দুজনকেই। বাকিরাও তাদের ব্যাস্ততার দিকটা বুঝতে পেরে খুব একটা জোড় করলো না। ফরিদা আন্টি, নীলা ও তুষার হয়তো দু’একদিন থাকবে এখানে।
,
,
বিকেলে রাজকে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়িতে তুলে নিলো অরিণ। দুর থেকে রাজের গার্ড গুলো কিছু বলতে চাইলে হাতের ইশারায় তাদের থামিয়ে দেয় রাজ।

ড্রাইবিং করতে করতে অরিণ বলে,
– এখন সিট বেল্ট বাধা শিখেছো নাকি এখনো আগের মতো ক্ষেতই আছো?
রাজ একটু মুচকি হেসে বলে,
– ঐ দিন শিখিয়ে দিয়েছিলে না? মনে আছে।
অরিণ একটু হেসে রাজের দিকে কয়েকটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলে,
– আমার বিয়ের কার্ড। তোমাদের সব বন্ধুদের ইনভাইট করলাম। এর মাঝে রুশান তো দেখলাম অনেক বড় মাপের লোক। ইনভাইট করেও নিয়ে আসা যাবেনা এখন। হয়তো তমরা বললে অবশ্যই আসবে।
রাজ বলে,
– বর কি করে? আমার মতো ছোট লোক না নিশ্চই?
অরিণ একটু ভাব নিয়ে বলে,
– দেশে নাম করা RJ Cowdhury Group and Ind. এ জব করে। নাম শুনেছো কখনো? শুনবেই বা কি করে? গ্রামেই তো বড় হয়েছো। শহরে আসলে কয়দিন হলো?
অরিণের কথায় অহংকারের ছাপ স্পষ্ট। তার ইন-ডিরেক্টলি অপমান টা রাজ এক সাইডে ফেলে দিয়ে বলে,
– তোমার এবারের গাড়িটা কিন্তু খুব সুন্দর। নতুন নিয়েছো নাকি?
অরিণ হেসে বলে,
– এটা সাজিদ মানে আমার হবু বরের গাড়ি। এমন দুইটা আছে তার। একটা আমি নিয়ে এসেছি। তাকে অফিস থেকে গিফ্ট করেছে ব্যবহারের জন্য।

অরিণের এতো অহংকার ভাব দেখে একটু হাসলো রাজ। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে এক হাত বের করে আঙুলের ইশারা করলে পেছন থেকে লম্বা সারিবদ্ধ ভাবে এক এক করে গাড়ি আসতে শুরু করে। একের পর এক গাড়ি গুলো সারিবদ্ধ ভাবে রাস্তা দখল করে চলছে। রাজের বাবা, রাজের ভাই ও এখন রাজ। সবাই একসাথে বের হওয়ায় কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল। অরিণও বিষয়টা জানে যে, নাম করা পলিটিসিয়ান রাজু চৌধুরি ও তার বাবা সাথে ঐ কম্পানির অর্নার, সবাই বের হওয়ায় আজ কিছু সময়ের জন্য এই রাস্তায় যান চলাচল নিষিদ্ধ।

এর মাঝে অরিণ লুকিং গ্লাসে পেছন পেছন আসা কালো কালারের অনেক গুলো গাড়ি দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হলেও মনে মনে ভাবে, হয়তো সাজিদ পাঠিয়েছে অরিণকে সিকিউরিটি দেওয়ার জন্য। তবুও বার বার লুকিং গ্লাসে তাকালে পাশ থেকে রাজ বলে,
– ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওটা তোমার সেই বিখ্যাত RJ Cowdhury Group and Ind. এর মালিকের পার্সোনাল সিকিউরিটি।
বলেই সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো রাজ। আর অরিণ গাড়ি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাজের দিকে।
অবাক ভঙ্গিতে বলে,
– তুমি কিভাবে জানো?
রাজ স্বাভাবিক থেকে একটা হাসি দিয়ে বলে,
– আরো কিছুটা সামনে চলো। তখন তোমার হবু স্বামী সাজিদের কাছ থেকেই জেনে নিও।

To be continue………….

#ছদ্মবেশ (৮৩ শেষ পর্বের প্রথম অংশ)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষন রাজের দিকে চেয়ে থাকে অরিণ। তার কথার ধরণ কিছুই বুঝতে না পেরে একটা নিশ্বাস ছেরে সামনের দিকে চেয়ে বলে,
– কোথায় নামবে তুমি?
রাজ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– একটু আগে যেই কোম্পানি টার নাম বললে, সেখানে নিয়ে চলো।
অরিণ হেসে বলে,
– সেখানে গিয়ে তুমি কি করবে? তাছারা সাজিদের কাছে শুনেছি আজ তাদের অফিসের মালিক প্রথম তাদের সামনে আসবে। তিনি নাকি দেশের বাইরে থাকতো। হয়তো সব মিলিয়ে আজ উৎসব উৎসব একটা ভাব থাকবে সেখানে। তুমি অজথা সেখানে গিয়ে কি করবে?
রাজ পূণরায় স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– এতোক্ষন একটা কারণ ছিলো। এখন দুইটা কারণে সেখানে যাবো।
অরিণ একটু ভ্রু উচু করে বলে,
– কি কি কারণ?
রাজ বলে,
– প্রথমত তোমার হবু স্বামীকে দেখার প্রবল ইচ্ছে জেগেছে। যাকে তুমি এতো গর্ব করছো। তারপর সেখানে কয়দিন আগে আমার ছোটখাটো একটা জব হয়েছে। কোনো ভাবে চলার মতো। এখন চুপচাপ নিয়ে চলো সেখানে।

রাজের কথায় অরিণ মনে মনে কি ভেবে হেসে উঠেছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারেনি রাজ। তাই পুনরায় সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো।
কিছুক্ষন পর সেখানে পৌছে গেটের থেকে অনেক দুরে গাড়ি থামায় অরিণ। রাজ অবাক হয়ে বলে,
– এখানে থামালে কেন? এতদুর যেহেতু নিয়ে এসেছো, গেটের সামনে গিয়ে নামিয়ে দাও।
অরিণ তার দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে বলে,
– পা’গল হয়েছো তুমি? গেটের সামনে দেখছো না কতগুলো মানুষ ভিড় করে আছে? আর ভেতরটাও কতো ঝাক ঝমক ভাবে সাজিয়েছে। হয়তো তারা নতুন বসকে বরণ করতে এমন আয়োজন করেছে। তো এতো মানুষের মাঝে গিয়ে মার খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
রাজ মুচকি হেসে বলে,
– মা’র খেতে হবে না। যা বলছি তাই করো।
আজ রাজের এমন কথা বার্তার কিছুই বুঝতে পারছেনা অরিণ। পেছনে রাস্তা ব্লক করে কতোগুলো গাড়ি দাড়িয়ে। সে সামনে গেলে তারাও সামনে আসে। দাড়িয়ে থাকলে তারাও দাড়িয়ে যায়।
আবার সামনে এমন ভিড়। সব মিলিয়ে একটা প্যাচের মাঝে আটকে গেলো সে। অবাক করার বিষয় হলো কেউই তাদের গাড়ি দেখেও কিছু বলছে না। উপায় না পেয়ে, মনে কিছুটা ভয় নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো অরিণ।
গেটের সামনে গিয়ে দাড়ালে রাজ বলে,
– নামো গাড়ি থেকে। আজ তুমিও আমার গেস্ট।
অরিণ আবারো অবাক হয়ে বলে,
– তোমার গেস্ট মানে?
রাজ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– নামলে সবটা বুঝতে পারবে।
এদিকে অরিণের মনে কিছুটা ভয় ঢুকে গেলো। এখানে সাজিদ তাকে দেখলে আবার ভুল বুঝবে না তো?

এর মাঝে রাজ গাড়ি থেকে নামলেই চারপাশ থেকে ফুল ছিটিয়ে পরে তার উপর। অরিণ অবাক হয়ে চেয়ে আছে সেদিকে। হিসেব কিছুতেই মিলছেনা তার। সবাই রাজের সাথে এমন করছে কেন?
ভাবতে ভাবতে সেও বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে। গেটের সামনে সাজিদকেও দেখতে পায় সে।
ইকবাল সানি রাজের কাছে এগিয়ে এলে রাজ তাকে বলে,
– এখানে সাজিদ কে? যাকে অফিস থেকে সব সুজুগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ইকবাল সানি বলে,
– স্যার, শুধু সাজিদ না কম্পানির বড় বড় পর্যায়ে থাকা লোক গুলো এমন সুজুগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অনেকে আছে এর মাঝে।
রাজ কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলে,
– সবই আমার জানা আছে। তোমাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করিনি আমি। সাজিদ কে সেটাই জানতে চেয়েছি।

ইকবাল সানি সাজিদের কাছে খবর পাঠালে রাজের সামনে এসে উপস্থিত হয় সাজিদ। রাজের পাশে অরিণকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও এই মুহুর্তে কিছু বলছেনা সে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়ালো সেখানে। তার মনেও কিছুটা ভয় জেগে উঠলো। নতুন স্যার এসেই কেন তাকে খোজ করছে এটা ভেবে।
রাজ অরিয়ের দিকে চেয়ে ইশারা করলে অরিণ উপরে নিচে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, এটাই তার হবু স্বামী।

রাজ পকেটে হাত গুজে সাজিদের সামনে দাড়িয়ে বলে,
– তুমিই সাজিদ তাই তো?
সাজিদ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– জ্বি স্যার।
রাজ একটু মুচকি হেসে বলে,
– অফিসে কেমন চলছে সব কিছু? সব ঠিকঠাক?
সাজিদ বলে,
– জ্বি স্যার।
রাজ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– ভেরি গুড। কেরি অন।

বেশি কথা না বলে সানগ্লস পরে ভেতরের দিকে হাটা ধরলো রাজ। গেট পেড়িয়ে ভেতরে গেলে সারিবদ্ধ ভাবে দুই পাশে দাড়িয়ে ফুল ছিটাচ্ছে তার দিকে।
এদিকে অরিণের এক মনে দাড়িয়ে থাকলে সাজিদ তার সামনে এসে বলে,
– এখানে কি করছো তুমি? স্যার তোমার সাথে একই গাড়িতে আসার মানে কি?
অরিণ এবার সাজিদের দিকে চেয়ে বলে,
– তার আগে বলো, তুমি রাজকে এভাবে স্যার স্যার বলছো কেন? সে তো বললো, সে এখানকার একজন সামান্য কর্মচারি।

সাজিদ অবাক হয়ে বলে,
– মাথা খারাপ তোমার? কার সম্পর্কে কি বলছো? ওনি কর্মচারি হতে যাবেন কেন? সম্পূর্ণ গ্রুপটাই তো তার নিজস্ব। নামের আগে RJ এটা হলো স্যারের নামেরই দুইটা লেটার।
অরিণ এবার হা করে তাকিয়ে আছে সাজিদের দিকে। সাজিদ পূনরায় বলে,
– তার আগে বলো, তুমি স্যারকে কিভাবে চেনো। গতকাল অব্দি আমি নিজেও চিনতাম না তাকে। আগে কখনো তার চেহারা দেখেনি। গতকালই প্রথম দেখেছি তাকে। সে নিজেকে সব সময় আড়াল করে রেখেছিলো। তাহলে তুমি চিনলে কি করে?

অরিণ এখনো সেই অবাক দৃষ্টিতে সাজিদের দিকে চেয়ে বলে,
– যাকে আমি ছোট লোক সহ আরো কতো কিছু বলে অপমান করেছিলাম, আর তুমি তারই গ্রুপের একজন কর্মচারি?
সাজিদ কিছু না বুঝে বলে,
– মানে কি?
অরিন আর সেখানে না দাড়িয়ে বলে,
– কিছু না। বাসায় চলে যাচ্ছি আমি। এখানে দাড়িয়ে থাকতে আর এক মুহুর্তও ভালো লাগছে না আমার।
বলেই গাড়িতে উঠে চলে গেলো অরিণ। সাজিদ কিছুই বুঝতে না পেরে হা করে চেয়ে আছে। অরিণের কর্ম-কান্ডে হয়তো সে নিজেও হতভম্ব।
,
,
কেটে গেলো আরো কয়েক মাস। মোটামুটি সব কিছুই স্যাটেল করে নিয়েছে রাজ। ইকবাল সানিকে বলে, তুষার ও নিবিড় দুজনকে অফিসিয়াল কাজের উপর ৬ মাসের স্পেশাল ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করে সে। যেন সবকিছু ঠিকঠাক ভাবেই পরিচালনা করতে পারে তারা। তার মাঝে কয়েকমাস গেলো মাত্র। এখনো পুরোপুরি ট্রেনিং শেষ হতে এখনো বাকি আছে অনেকটা।

রাজ ও রুশান দুজন দুই দিকে চলে গেলেও সবার সাথে যোগাযোগ টা আছে আগের মতোই। এর মাঝে পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ কয়েকদিন ধরে ফরিদা আন্টি ও নীলার বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করালো তারা।
এর মাঝে কাছাকাছি থাকা সব সময় প্রয়োজনে কথা হওয়ার মাঝেও একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছিলো নিজেদের মাঝে।
সব মিলিয়ে প্রায় তিন মাস লেগে গেলো তাদের বিয়ে পর্যন্ত পৌছাতে।

ফরিদা আন্টির কোনো ছেলে না থাকায় তার পূর্বের স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, তার বর্তমান মেয়ের হবু জামাই মানে নিবিড়কেই দিয়েছে সে। পড়াশুনা শেষ হলে নতুন করে সবকিছু শুরু করবে সে। এর মাঝে রাজও আশ্বাস দিলো তাকে, যে প্রয়োজনে সব হেল্প করবে যে কোনো প্রয়োজনে। আপাতত পড়াশুনাটা শেষ করে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করায় ব্যাস্ত নিবিড়। সেই সাথে তুষারের সাথে রাজের দেওয়া ট্রেনিং-এ পড়াশুনার পাশাপাশি সবটায় ধারণা তৈরি হচ্ছে তারও।

শীতের সকাল। জ্যাকেট গায়ে গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে সে। সাথে তুষারও এসে দাড়ালো সেখানে। ঠান্ডায় হাত দুটু ঘষাঘষি করছে সে। রাজের সাথে গাড়িতে উঠে কোথায় যাচ্ছে তা এখনো বুঝতে পারেনি সে। রাজকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেও রাজ এই বিষয়ে কিছু বলেনি তাকে। সারপ্রাইজ হিসেবেই নিয়ে যাচ্ছে তুষারকে। সকালের মিষ্টি আলো চারপাশটায় ফুটে উঠলো। সেই সাথে ধীরে ধীরে শীতলতাও কমছে একটু একটু করে।

কিছুক্ষনের মাঝে একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ায় তারা। শরির থেকে জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে তুষারের পাশে এসে দাড়িয়ে বাড়িটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
– বাড়িটা কেমন লাগছে তোর কাছে?
তুষার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে দুইটা গাড়িও আছে সেখানে। সেই সাথে সুন্দর একটা বাড়ি। তবে কিছু বুঝতে না পেরে বলে,
– কার বাসায় নিয়ে আসলি এই সকাল সকাল।
রাজ হেসে বলে,
– এক বন্ধুর বাসা। চল ভেতরে গিয়ে দেখে আসি।

কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে বাড়িটার সম্পর্কে রাজ জিজ্ঞেস করলে, তুষার মুগ্ধতা নিয়ে বলে,
– খুবই সুন্দর বাড়িটা। তবে তোর বন্ধু কোথায়? তাকে দেখছিনা যে?
রাজ এবার একটু হেসে বলে,
– তোর ছোট বোনের না একটা স্বপ্ন ছিলো, এমন একটা বাড়িতে থাকার?
তুষার অবাক হয়ে বলে,
– সেটা তুই জানলি কি করে?
রাজ বলে,
– বাদ দে ওসব। এই নে চাবি, আজ থেকে এখানে যা যা চলে পরছে সবটাই তোর। আন্টিকে ও ছোট্ট বোনটাকে নিয়ে দ্রুত উঠে পর এখানে।

তুষার এবার অবাক হয়ে চেয়ে আছে রাজের দিকে। একটু হেসে বলে,
– মজা করছিস আমার সাথে? শুধু শুধু এতো বড় বাড়িটা কেন দিবি আমায়? সাথে গাড়ি গুলোও। আর এতো কিছু এমনিতেই তোর থেকে কেন নিবো আমি?
রাজ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– বড় পজিশনে থাকা স্টাফদের থাকার জন্য ফ্লাট ও চলাচলের জন্য গাড়ি দেওয়া হয় অফিস থেকে। সেই হিসেবে তুইও পাচ্ছিস। যদিও তোরটা একটু বেশিই স্পেশাল। আশা করি এবার কোনো ভঙিতা করবিনা।

তুষার আবার বলে,
– কিন্তু আমি তো তোর অফিসের কোনো স্টাপই না। তাহলে আমায় কেন দিচ্ছিস?
রাজ এবার তার কাধে হাত রেখে বলে,
– পড়াশুনার পাশাপাশি তোকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে কি এমনি এমনি? তবে বন্ধু মানুষ দেখে একটু বেশিই সেক্রিফাইজ করা হলো তোর ক্ষেত্রে। এখন অজথা প্যাচাল না করে সবকিছু বুঝে নে। আর খুব দ্রুতই আন্টি আর আমার ছোট্ট বোনটাকে নিয়ে উঠে পর এখানে। দেখবি অনেক খুশি হবে তীসা।

তুষার চুপচাপ চেয়ে আছে রাজের দিকে। কিছুক্ষনের মাঝেই চোখ দুটু ছলছল করে উঠলে আচমকাই রাজকে জড়িয়ে ধরে খুব শক্ত করে। সেই সাথে হেসে উঠে রাজও। একজন অজানা এক কারণে চোখের জল ফেলছে অন্যজন তা দেখে হাসছে।
,
,
আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। তুষার তার মাকে ও বোনকে নিয়ে এলো ঢাকায়। প্রথমে ফরিদা আন্টিদের সাথে একদিন কাটালো। নতুন বাড়ির সম্পর্কে কিছুই বুঝতে দিলোনা তাদের।

পরদিন সন্ধায় সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মা ও তীসার চোখে কাপর বেধে বাড়ির সামনে নিয়ে এলো তাদের। সাথে রাজ, নিবিড়, ফারিদা আন্টিরা সহ সবাই আছে। লাইটিং করে সন্ধার পর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে চারপাশে।

বাড়ির সামনে এনে মা ও তীসার চোখ খুললে, পরিস্থিতি বুঝে উঠতে কিছুক্ষন সময় নিলো তীসা। চার পাশে তাকিয়ে এতো সাজ দেখে বলে,
– কার বিয়ে আজ?
পাশ থেকে নিবিড় হেসে বলে,
– আমাদের তীসা মনির বিয়ে। আরেক জনকে পাঠিয়েছি আমাদের তীসার জন্য একটা জামাই খুজে আনতে।
পাশের সবাই হেসে উঠলেও তীসার মনটা বিষণ্ন হয়ে এলো। করুন দৃষ্টিতে একবার তাকালো তুষারের দিকে। মনে মনে ভাবছে, ভাইয়া কি সত্যিই তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে?

যা লক্ষ করে ফরিদা আন্টি নিবিড়েরে দিকে কড়া চোখে চেয়ে বলে,
– শুধু শুধু বাচ্চা মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন নিবিড়?
ফরিদা আন্টির কথায় কিছুটা ভয় কেটে তীসাও এবার রাগী লুক নিয়ে তাকালো নিবিড়ের দিকে। যেন মস্ত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে নিবিড়।

সবাইকে নিয়ে ভেতরে গেলো রাজ। তীসাকে চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে তুষারকে ফিসফিসিয়ে বলে,
– ভাইয়া, এখানে কেউ নেই কেন?
তুষারও বলে,
– কারণ এটা যে আজ থেকে আমাদের তীসা মনির বাসা। তো অন্য কেউ কেন থাকবে?
তিসা অবাক হয়ে বলে,
– আমার বাসা মানে?
– আমার বাসা মনে হলো, আজ থেকে এটা তীসা মনির নতুন বাসা। সে তার মা ও ভাইয়াকে নিয়ে আজ থেকে এখানে থাকবে।
তীসা মুহুর্তেই চোখে মুখে হাস্যজ্জল ভাব নিয়ে বলে উঠে,
– সত্যি এটা আমাদের বাসা? এখানে আমরা থাকবো আজ থেকে?

পাশ থেকে রাজ হেসে বলে,
– তুমি না তোমার ভাইয়াকে সব সময় বলতে, সুন্দর একটা বাসার কথা? তাই তোমার ভাইয়া তোমার ইচ্ছে পূরণ করেছে আজ। এবার একটা থ্যাংক ইউ দাও ভাইয়াকে।

তীসা পুনরায় চার পাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা তাদের নতুন বাড়ি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আচমকাই তুষারের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
– থ্যাংক ইউ ভাইয়া। তুমি এই পৃথিবীর সব থেকে ভালো ভাইয়া।
তুষারও এবার হাটু গড়ে বসে তীসার দিকে তাকালো। দেখে মুহুর্তেই তীসার চোখে জল জমে এসেছে। হয়তো আচমকাই এমন খুশি হওয়াতে এমন হয়েছে। আঙুল দিয়ে সেই জল মুছে দিতেই তীসা আবার তুষারের গলা জড়িয়ে ধরে।

পাশ থেকে চুপচাপ দাড়িয়ে সবটা দেখে চলছে রাজ। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে তার মাঝে। কিছু ভালোবাসা দেখতেও মনে মাঝে খুব করে প্রশান্তি জেগে উঠে।

To be continue………………

#ছদ্মবেশ (শেষ পর্বের শেষ অংশ)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

শীতের সকালে বেলকনিতে বসে এক মনে কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতির দিকে চেয়ে আছে রাজ। ঠান্ডার শরিরটা বার বার কেপে উঠলে চাদরটা আরো ভালো করে পেচিয়ে নেয় সে। রুম থেকে বেড়িয়ে বেলকনিতে পা রাখে আরোহি।
বিয়ের আজ দুই মাস পার হলো তাদের। তবুও প্রতিটা সকালই যেন নতুন মনে হয় তার কাছে। মনে হয়, এই যে আজই তো তার সাথে প্রথম দিন। আমাদের নতুন জীবনের সূচনা।

আরোহি কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে চেয়েও পারলো না। ঠান্ডায় রাজকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অনেকটা অধীকার নিয়ে বলে উঠে,
– এভাবে ঠান্ডায় বসে আছেন কেন? ঠান্ডা ধরে যাবে তো। ভেতরে এসে বসুন।
আরোহির কথায় রাজ চুপচাপ তার দিকে চেয়ে বলে,
– ভালো লাগছে খুব।
আরোহি আবার বলে,
– ঠান্ডা ধরলে তখন সব ভালো লাগা বের হয়ে যাবে।
রাজ পূনরায় বলে,
– এমন বৌ থাকতে ঠান্ডায় ধরার চান্স নাই।
আরোহি কিছুটা ভ্রু-কুচকে বলে,
– কিভাবে?

আরোহির এমন প্রতিক্রিয়া দেখে মৃদু হাসলো রাজ। মুখে হাসির ভাবটা রেখে বলে,
– এক কাপ চা নিয়ে আসতো বলো। তারপর বলছি।
আরোহি যাচ্ছি বলে পা বাড়ালে রাজ আবার পিছু ডেকে বলে,
– শুনো, তুমি বরং আজ নিজ হাতেই ভালো করে বানিয়ে নিয়ে আসো।
আরোহি মুখে কিছুটা হাসির আভাস ফুটিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। রাজ পূনরায় নিশ্চুপ হয়ে কুয়াশা ভরা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইলো রাজ।

কিছুক্ষণ পর এক কাপ চা হাতে বেলকনিতে পা রাখে আরোহি। রাজের হাতে এক কাপ দিয়ে বলে,
– এবার ভেতরে চলুন। এখানে প্রচুর ঠান্ডা।
রাজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
– বেশি ঠান্ডা লাগছে?
আরোহি মাথা নাড়িয়ে বলে,
– কিছুটা।

বিয়ে হলেও বাচ্চামো এখনো ছাড়েনি আরোহিকে। রাজ কাপটা এক পাশে রেখে বলে,
– কাছে এসো, তোমার ঠান্ডা দুর করে দিই।
বলেই গায়ের চাদরটা খুলে দু’হাতে মেলে ধরলো সে। বিষয়টা কিছুটা বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জার ছাপ ফুটে উঠে আরোহির মাঝে। কিছুটা না চাইতেই প্রকাশ হয়ে গেলেও ভেতরটায় একরাশ লাজুজতা নিয়ে রাজের খুব কাছে গিয়ে ধাড়ালো। পরিচিতি যতই পুরোনে হোক, অনুভূতি গুলো যেন মাঝে মাঝে নতুনত্বের ছোয়া পায়।

আরোহিয়ে এক হাতে কাছে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো রাজ। লাজুকতা পুরোপুরি ঘিরে ধরলে রাজের বুকে মিশে কিছুক্ষণ চোখ দুটু বুঝে থাকে সে।
এই শীতল সকালটায় একই চাদরের মাঝে লুকিয়ে আছে দুজন। সেই সাথে একে অপরের এক কাপ চায়ের ভাগিদার।
চায়ের কাপ এক পাশে রেখে একই চাদরে লুকিয়ে কুয়াশায় আচ্ছন্ন প্রকৃতিকে উপভোগ করছে দুজন।
আরোহির ঘারে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালে শরির জুড়ে কিছুটা শিহরণ বয়ে যায় তার। তবুও চোখ বুজে চুপ করে আছে সে। অনুভব করতে ব্যাস্ত এই সুন্দর সকালটাকে।

রাজ কিছুটা স্বাভাবিক গলায় ডেকে উঠে,
– আরোহি।
আরোহিও তৎক্ষনাৎ বলে,
– হুম।
রাজ ট্রাউজারের পকেট হয়ে একটা কাগজ বের করে তা আরোহির দৃষ্টির আড়ালে রেখে বলে,
– আমাকে দেওয়া তোমার সেই প্রথম গিফ্ট-এর কথা মনে আছে?
আরোহি মাথা ঘুড়িয়ে রাজের দিকে দৃষ্টি রেখে ভ্রু-কুচকে বলে,
– কোন গিফ্ট!
রাজ বলে,
– যেই গিফ্টের জন্য তোমাকে কাঁদতেও হয়েছিলো। দেখোতো মনে করতে পারো কিনা?

আরোহির এবার কিছুটা গোমড়া মুখে বলে,
– হুম মনে পরেছে। অনেক যত্ন করে আঁকা সেই ছবিটা সেদিন ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলেন আপনি।
রাজ কিছুটা আদুরে গলায় বলে,
– খুব যত্ন করে এঁকেছিলে, তাই না?
আরোহি মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হুম।
রাজ কিছুটা মৃদু হেসে আরোহির দিকে সেই ছবিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– তাহলে তোমার যত্ন করে তৈরি করা উপহারটা আমি কিভাবে অযত্ন করে ছিড়তে পারি বলো। আমারও যত্ন করে রাখা উচিৎ নয় কি? তাছাড়া ভালোবাসা কি অযত্ন করে রাখার জিনিস?

আরোহি এক পলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে পূণরায় মুগ্ধ নয়নে তাকায় রাজের মুখের পানে। একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে আছে দুজনকে। সময়টা সুন্দর, তবে মানুষটা অদ্ভুত।
,
,
এদিকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসলো রিমা। ভার্সিটি ভর্তির জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে সে। সকাল ৯ টার পর আবার কোচিং-এর উদ্দেশ্য বের হতে হয় তাকে।
সবে বাজে সকাল সাড়ে ৭ টা। ওদিকে কাজের মেয়েটে ও আরশি মিলে নাস্তা তৈরি করায় ব্যস্ত।
এই শীতের সকালটা তাদের সাথে মিলেমিশে কাজ করলেও সুন্দর কাটতো। নয়তো কম্বল মুড়িয়ে শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারলে। কোনোটাই হচ্ছে না তার। যেটা হচ্ছে, তা হলো বই সামনে রেখে এক রাশ বিরক্তি প্রকাশ।

তার পাশেই খাটে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে নিশ্চিন্তে ফোন টিপছে রুশান। আর একটু পর পর আড়-চোখে রিমার দিকে তাকাচ্ছে। ফাকি দেওয়ারও সুজুগ নেই।
এই মুহুর্তে রিমার প্রচুর ইচ্ছে হচ্ছে কম্বলের নিচে গিয়ে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দিতে। তাও হচ্ছেনা এই রুশানের জন্য।
রিমা কিছুটা সুজুগ খুজতে বলে,
– এই শুনেছেন? আন্টি মনে হয় আমায় ডেকেছে। আমি একটু দেখে আসি কেন ডাকছে।
রুশান তার দিকে চেয়ে বলে,
– কই আমি তো শুনতে পাই নি।
রিমা তৎক্ষনাৎ বলে,
– এই মাত্র ডেকেছে আপনি বোধ হয় ফোনের দিকে মনোযোগ থাকায় শুনতে পান নি।

রুশান এবার দরজার দিকে উকি দিয়ে মাকে ডেক দিলে আরশি এসে হাজির হয় কিছুক্ষনের মাঝে। রুশান মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– রিমাকে ডেকেছিলে?
আরশি বলে,
– কই না তো? আর এভাবে ডাকছিলি কেন?
রুশান আর কিছু না বলে একবার রিমার দিকে তাকালো। ছোটখাটো একটা ঢোক গিলে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে লাগলো রিমা। রুশান পূনরায় মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
– এটাই জানতে ডেকেছিলাম।

মনে মনে রুশানোর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে রিমা। তার কয়েকজন বান্ধবিকে বিয়ে দেওয়ার পর তারা এখন কতো সুন্দরে পড়াশুনা বাদ দিয়ে নিজের সংসার সামলাচ্ছে।
যা দেখে মা বাবার এক কথাতেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলো সে। যে অন্তত পড়াশুনা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু হলো তার উল্টোটা।
নতুন বিয়ের পর কই ভেবেছিলো শীতের সকালে রুশানের বুকে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাবে। রুশানের কি আবেগ অনুভূতি কিছু নেই। শীতের সকালে কই একটু রোমেন্স করবে তা না। পড়ার প্যারা নিয়ে আসছে আরামের ঘুমটা হারাম করতে। এমনটা হবে জানলে বিয়েই করতাম না তাকে।
নিজের মাঝে বিরবির করতে করতে বইয়ের দিকে তাকায় রিমা।
রিমার বিরবির একটু একটু কানে আসলেও কি বলছে তা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেনা রুশান। ভেতর ভেতর মুচকি হাসলেও তা প্রকাশ না করে চুপচাপ ফোন হাতে শুয়ে আছে সে।
,
,
ফোন কলের শব্দে ঘুম ভাঙে তুষারের। ফোন হাতে দেখে পরপর ৩ টা কল দিয়েছিলো ফারিহা। জ্বিভে কামড় কেটে পুনরায় কল ব্যাক করে তুষার। মনে একটা ভয় সব সময় কাজ করে তার। অনেক বছর অপেক্ষা করে একটা গার্লফ্রেন্ড জুটলো তার। এখন কোনো ভুল করে এটা হারানো যাবে না কোনো ভাবে।

পূনরায় কল ব্যাক করে টানা ১০-১২ বার একের পর স্যরি বলে গেলো তুষার। ওপাশ থেকে ফারিহা কিছুটা রাগি ভাব নিয়ে বলে,
– কয়বার ফোন দিয়েছি তোমায়?
তুষার আবার বলে,
– আমি সত্যিই দেখতে পাইনি। সকাল বেলার ঘুম বুঝোই তো। প্লিজ রাগ করোনা তুমি।
ফারিহা আবার বলে,
– বিয়ের আগেই তুমি আমাকে ইগনোর করে চলছো, তাহলে বিয়ের পর কি করবে?
তুষার আবার বলে,
– আমি সত্যিই যেনে শুনে তোমায় ইগনোর করিনি।
ফারিহা রেগে বলে,
– তার মানে, না যেনে ইগনোর করছো?
তুষার জ্বিব কামড়ে বলে,
– এই না না, কি বলি আর কি বুঝো। আমি তোমাকে ইগনোরই করিনি। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তাই ধরতে পারিনি ফোন।
ফারিহা এবার বিরক্তি নিয়ে বলে,
– আচ্ছা বায়, রাখি আমি।
তুষার অস্থিরতা দেখিয়ে বলে,
– এই শুনো শুনো প্লিজ। রাগ করেছো তাই তো? ওকে ফাইন। এখন কি করলে তোমার রাগ ভাঙবে তা বলো। আমি সেটাই করবো।
ফারিহা এবার স্বাভাবিক ভাবে বলে,
– যা বলবো তাই করবে তো? তাহলে খাট থেকে নেমে নিচে দাড়াও। এরপর ভিডিও কল দিয়ে ফোনটা সামনের একটা টেবিলে কিছুর সাথে হেলান দিয়ে লম্বালম্বি ভাবে রেখে ১০ বার কা’ন ধরে উটবস করবে। তাহলেই আমার রাগ ভাঙবে।
তুষার কিছুটা আহত গলায় বলে,
– প্লিজ এই কা’ন ধরার টা বাদ দিয়ে অন্য কিছু দাও।
ফারিহা বলে,
– ওকে ফাইন, আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ।
তুষার আবারো অস্থির হয়ে বলে,
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, এই যে আমি ১০ বার কা’ন ধরে উট-বস করছি।
বলেই কল কেটে ভিডিও কল দেয় তুষার। ফোনটা সামনে রেখে একে একে কান ধরে উটবস করছে সে। ওপাশ থেকে ফারিহা এক দুই করে গননা করছে। আর পাশে নীলাকে ইশারায় দেখাচ্ছে। দেখো ভাবি তোমার দেবরকে কিভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছি আমি।
নীলা তা দেখে বলে,
– বেচারাকে এই সাজ-সকালে এভাবে কা’ন ধরানোটা কি ঠিক হচ্ছে বলো।
ফারিহা হেসে বলে,
– একটু টাইট দিয়ে না রাকলে আবার অন্য মেয়ের দিকে মোড় কাটতে পারে। তাই মাঝে মাঝে এমন পানিসমেন্ট দিই তাকে।

এর মাঝে তুষারের রুমে এসে প্রবেশ করে তার ছোটবোন তীসা। তুষারকে এভাবে কান ধরে উটবস করতে দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। পেছন থেকে বলে উঠে,
– ভাইয়া তুমি এভাবে কা’ন ধরে উটবস করছো কেনো?
তুষার থেমে গিয়ে পেছন ফিরে তীসাকে দেখে কিছুক্ষন কথা খুজে আচমকাই বলে উঠে,
– তোকে কে বললো কা’ন ধরছি? আমি তো সকাল সকাল উঠে ব্যায়াম করছি। একবার উঠি একবার বসি এটাই ব্যায়াম। তুই ছোট মানুষ এগুলো বুঝবি না।
তীসা এবার সামনে টেবিলে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তাহলে ফোনে ঐ মেয়েটা কে? যে প্রতিবার এক দুই করে গুনছিলো।
তুষার আবার কিছুটা কথা সাজিয়ে বলে,
– আরো ওটাতো আমাদের টিচার। তোদেরকে যেমন টিচাররা পড়ায়, আমাদেরকেও তেমন টিচাররা ব্যায়াম করায়।

এর মাঝে তুষারের মা আসলো রুমে। টেবিলে নাস্তা রেখে অনেক্ষন আগে তীসাকে পাঠিয়েছিলো তুষারকে ডেকে দিতে। এখন তীসারও খবর নেই তাই তিনি নিজেও আসলেন রুমে।
ভাই বোন দুজনকে এমন কথা বলতে দেখে তিনি কারণ জিজ্ঞেস করলে তীসা বলে উঠে,
– ভাইয়া কা’ন ধরে উটবস করছিলো। আর একটা মেয়ে ফোনে এক দুই করে গুনছিলো।
তুষার জ্বিভ কামড়ে বলে,
– না না মা, ও আসলে বুঝেনি বিষয়টা। আমি আসলে ব্যায়াম করছিলাম। সকাল বেলা তো ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই না?
তুষারের মা বলে,
– তাহলে কোন মেয়ের কথা বললো?
তুষার বলে,
– মা সে হলো আমাদের অনলাইন টিচার।
তুষারের মা কিছু না বুঝে বলে,
– অনলানে যে কিভাবে পড়াশুনা করিস এতোকিছু বুঝিনা আমি। এখন নাস্তা করতে আয়।
বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো সে। একটা স্বস্থির নিশ্বাস ছাড়লো তুষার। পাশ থেকে তীসা মুচকি হেসে বলে,
– ভাইয়া আমি কিন্তু বুঝে গেছি সব।
,
,
সুন্দর সময় গুলো কেটে গেলো এক এক করে। সেই ব্যাচেলর লাইফের ইতি টেনে একে একে কেটে গেলো পাঁচটা বছর। আজ সবাই নিজেদের মতো জীবন নিয়ে ভাবতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। সেই সাথে নিজেদের পরিবারকে স্ত্রী-সন্তানদের হাসি খুশি রাখতে ব্যস্ত।

তাদেরও একটা সুন্দর ব্যাচেলর লাইফ ছিলো তা আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসে এক কাপ চায়ের সাথে দীর্ঘশ্বাসের একটা গল্প হয়ে দাড়ালো।
সেই মুহুর্ত গুলো জীবন থেকে চলে গেলেও রয়ে গেলো স্মৃতি হয়ে। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বটা রয়ে গেলো এখনো আগের মতো।

আজ একটা বিশেষ দিন। রাজ তার তিন বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। অপর দিকে রুশানের মেয়ের বয়স আজ দুই বছর। তুষার পড়াশুনা শেষে বিয়ে করেছে সবে দেড় বছর হলো। সন্তান নিয়ে তারা এখনো তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না।
রাজ তার ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে রুশানকে ফোন দিয়ে বলে,
– বের হয়েছিস?
রুশান ওপাশ থেকে বলে,
– হুম, নিবিড়, তুষার তারা কতটুকু প্রস্তুতি নিলো?
রাজ বলে,
– তারাও বের হচ্ছে।
বলেই ফোন কেটে দিলো তারা। আজ যে খুব একটা বিশেষ দিন।

নিবিড় বের হওয়ার আগে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো নীলার কপালে। হাটু গড়ে বসে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নীলার পেটেও একটা চুমু এঁকে দিলো। মাঝে মাঝে যাকে নিয়ে পাগলামিতে মেতে উঠে সে। কখনো নিশ্চুপ হয়ে অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলে সে,
‘খুব জলদি বাবার কাছে চলে আসো সোনা। বাবা তোমায় খুব ভালোবাসে।’
সেই মুহুর্তে নীলাও হেসে বলে,
– বাবু একটা উত্তর দিয়েছে সেটা শুনেছেন তো?
নিবিড় বলে,
– কই না তো।
নীলা বলে,
– বলেছে, আমি শিগ্রই তোমার কাছে আসছি। তুমি শুধু মাকে দেখে রেখো। আর মায়ের কেয়ার করো।
বলেই এক সাথে হেসে উঠে নিবিড়-নীলা দুজনই।

সকাল ৮ টায় এক জায়গায় এসে একত্রিত হলো তারা চারজন। আজ দিনটা হলো নিলয়ের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকি। রক্তের সম্পর্ক ব্যাতিত অন্য কোনো সম্পর্ক হারিয়ে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে ভুলে যায় মানুষ। তবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো কোনো রক্তের সম্পর্ক না। তবুও কেন তার কথা আজ পাঁচ বছরেও একটু ভুলেনি কেউ?
চারজন একসাথে নিলয়ের ক’বর জিয়ারত শেষে কিছু সময় চুপচাপ কাটিয়ে দিলো সেখানে।
প্রতি বছর আজকের এই দিনটায় এই জায়গায় এসে দাড়ালে প্রতিবারই মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠে তাদের। অতিতের স্মৃতি যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নতুন করে।

তারা চারজন বিষণ্ন মনে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে এক পাশে। অন্য পাশে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে নিলয়। খুবই নিরবতা এই জায়গায়। একাকি ঘুমিয়ে আছে সে। মাখে মাঝে মনে হয় সে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
– এই জায়গায় আসলে প্রতিবারই তোরা এমন বিষণ্ন হয়ে থাকিস কেন বল তো। সব সময় তোরা আমার সামনে বিষণ্ন থাকলে আমার কি তা ভালো লাগে বলতো। আমি না হর দুরে চলে গেলাম। ভালোবাসাটা তো তোদের প্রতি আগের মতোই রয়ে গেছে। এভাবে বিষনণ্নতায় নয়, তোদের হাসি মুখে দেখতেই আমার খুবই ভালো লাগে। দুনিয়াতে আপন বলতে শুধু তোরাই ছিলি। তোরা এমন বিষণ্ন থাকলে আমি কি করে ভালো থাকি?

এমনটা মনে হলেও কবরটা নিশ্চুপ। হাজার চেষ্টা করেও প্রিয় বন্ধুটার মুখ দিয়ে আর একটু শব্দও বের হবে না। যা হবে তা শুধুই কল্পনার জগতে। তার অস্তিত্ব টাও এতো দিনে বিলিন হয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে স্মৃতি আর ভালোবাসা।
নিরবতা ভেঙে রাজ বলে উঠে,
– আমরা এখানে কয়জন আছি?
পাশ থেকে তুষার বলে,
– চার জন।
রাজ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
– নিলয় তো এই মুহুর্তেও আমাদের খুব কাছেই ঘুমিয়ে আছে। তো আমাদের সেই পুরোনো ছদ্মবেশী বন্ধুমহল আজ পরিপূর্ণ নয় কি?

-সমাপ্ত……………..