#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৪
সকালের আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেল। নিশ্চয়ই কেউ জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। আলতো চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমি কোথায় আছি? কিছু মুহূর্ত পর সবটা মস্তিষ্কে ধরা দিল। চোখ বড় বড় করে লাফিয়ে উঠে বসলাম। আমি তো বর্ণ ভাইদের বাড়িতে আছি। রাতে ওনার মাথা চাপতে চাপতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কে জানে? আশে পাশে তাকিয়ে দেওয়ালে ঘড়ি আবিষ্কার করলাম। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা আট এবং মিনিটের কাটা কুড়িতে। আমার চোখ কপালে। আমি এতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম? তাও আবার শশুর বাড়ির প্রথম দিন? না জানি আন্টি কি মনে করছেন!
আমি যখন আহাজারি করতে ব্যস্ত তখন ওয়াশ রুম খুলে বের হলেন উনি। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। আমি হাহাকার করে বললাম–
— বর্ণ ভাই! এত দেরি হয়ে গেল! আপনি আমাকে ডাকলেন না কেন?
তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। থমথমে কন্ঠে বললেন —
— আবার বর্ণ ভাই? আমি তোমার কোন জন্মের ভাই লাগি?
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আবারও ওনাকে ভাই ডেকে ফেলেছি, কি মুশকিল! মিনমিন করে বললাম–
— হয়ে যায়। কি করব?
উঠে দাঁড়ালাম। উনি সামনে এগিয়ে এসে বললেন–
— আমার নাম ধরে ডেকো।
তোয়ালে হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম–
— আমি পারব না। এতো বড় একটা মানুষের নাম ধরে ডাকা যায় নাকি?
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তবুও হার মানলেন না। বললেন–
— আমাকে যা খুশি বলো কিন্তু ভাই ডেকো না প্লিজ। বউ এর মুখে ভাই ডাক শোনা সত্যিই অদ্ভুত! এখন যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। রাতে খাওনি, সকালেও খাওয়ার ইচ্ছে নেই?
হঠাৎ করেই আমার খেয়াল হলো আমার পরনে ওনার জামা কাপড়। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম, টি শার্টের গলা কাঁধ বেয়ে নেমে আছে। ট্রাউজার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চুল তো পাখির বাসা! এভাবে বাইরে যাব কীভাবে? বললাম–
— আমি এই অবস্থায় বাইরে যাব কীভাবে?
উনি সবে মাত্র ফোন হাতে নিয়ে বসেছিলেন। আমার কথা শুনে মুখ তুলে তাকালেন। মশকরা করে বললেন–
— কেন? ভালোই তো লাগছে। এভাবেই যেও সমস্যা নেই।
চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম–
— নাহ!
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। আমি ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি উঠে বেলকনি থেকে আমার জামাকাপড় নিয়ে এলেন। হাতে দিয়ে বললেন–
— এই নাও। শুকিয়ে গিয়েছে। চেঞ্জ করে এসো।
নিজের জামাকাপড় পেয়ে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। অবশেষে ওনার এই দৈত্য মার্কা জামাকাপড় থেকে মুক্তি পাব। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে বের হলাম। চুলটা আঁচড়ে ওনার সাথে বের হলাম। আন্টি রান্না ঘরে ছিলেন। টেবিলের ওপর পরটা রেখে মুখে হাসি টেনে বললেন–
— উঠেছিস তোরা? তোর বাবা সকালে খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে আর তার সাথে আমিও খেয়ে নিয়েছি। এবার তোরা খেয়ে নে। ছায়া! তোমার জন্য পরটা করেছি, খাও।
আন্টি রুমে চলে গেলেন। খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার, শাশুড়ি ছেলের বউকে রেঁধে খাওয়াচ্ছে! উনি চেয়ার টেনে বসে খেতে শুরু করলেন। বললেন–
— কি হলো? খাও।
আমি ধপ করে বসে পড়লাম। একটা পরটার অর্ধেক খেতে খেতে ওনার খাওয়া শেষ। আমাকে টুক টুক করে খেতে দেখে বললেন–
— একটা পরটাও এখনও শেষ করতে পারলে না! দেখি এদিকে দাও।
আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরলেন। বললেন–
— খাও।
চুপচাপ মুখে নিলাম। ওনার হাতে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আগে থেকেই আছে আমার। খেতে খেতে বললাম–
— আমি বাসায় যাব না?
— হ্যাঁ যেও।
— আপনি যাবেন না?
— না।
মন খারাপ করে বললাম–
— কেন?
উনি পরটা মুখে পুরে দিয়ে বললেন–
— আমার একটু কাজ আছে বাইরে। আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। তুমি যেও আর কাল চলে এসো।
পরটা চিবিয়ে গিললাম। মুখ গোমড়া করে বললাম–
— বিয়ের পর শুনেছি বর বউ মিলে বউ এর বাড়িতে বেড়াতে যায়। আর আমার ক্ষেত্রে কি হলো? বিয়ের পরদিন শশুর বাড়িতে আসলাম।
কিছু বললেন না। আমার কথায় ওনার কোনো যায় আসলো না। কিন্তু আমার তো একটা দিন ওনাকে ছাড়া থাকতে ভীষণ যায় আসবে। পানি খেয়ে বললাম–
— আচ্ছা, আমি এখন যেয়ে বিকেলে আবার চলে আসব। আর সব জামাকাপড়ও গুছিয়ে নিয়ে আসব।
ইতোমধ্যে ওনার খাওয়ানো শেষ। হাত ধুয়ে উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন–
— তোমার যেটা ভালো লাগে সেটা করো।
চলে গেলেন। আমি আন্টিকে বলে বাসায় গেলাম।
নিজের বাসায় গিয়ে মনে হলো না জানি কত জনম পর এসেছি। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম–
— মা! বিয়ে হলো কি হলো না, তোমরা আমাকে পর করে দিলে? আমাকে ফেলে রেখে চলে এলে?
মা মুখ কুঁচকে বললেন–
— ভাবটা এমন করছিস যেন তোকে অন্য দেশে বিয়ে দিয়েছি। আছিস তো নিচের তলাতেই, যখন খুশি চলে আসবি। আর আমিও যখন খুশি তোকে দেখে আসব।
আমি মাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললাম–
— আমি কিন্তু থাকতে আসিনি। যারা আমাকে ফেলে রেখে চলে এসেছে তাদের বাসায় থাকবও না। জামাকাপড় গুলো নিয়েই চলে যাব। আমি এখন আমার রুমে যাচ্ছি।
রুমে চলে এলাম। আমার অভিমান দেখে মা মৃদু শব্দে হাসলেন।
—
এ বাড়ি অর্থাৎ আমার শশুর বাড়িতে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এসেই চমকে গেলাম। নীলা আপু সোফায় বসে আছেন। আমার আওয়াজ শুনেই তীক্ষ্ম দৃষ্টি আমার ওপর ফেললেন। তার দৃষ্টিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। আন্টি নিশ্চয়ই তাকে সব বলেছেন। আমি এগিয়ে বললাম–
— কেমন আছেন আপু?
আপু জবাব দিলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে রুমে চলে গেলাম, যেটা বর্তমানে আমার এবং বর্ণের রুম। ওনার আসতে দেরি হবে। রুমে ঘুরঘুর করেই কিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম।
রাতে আন্টি খেতে ডাকলেন। আমি বের হয়ে দেখলাম আংকেল এবং নীলা আপু বসে খাচ্ছেন। ডাইনিং টেবিলে কাছে গিয়ে বললাম–
— আন্টি আপনারা খেয়ে নিন। উনি এলে আমি খেয়ে নেব।
নীলা আপু মুখ কুঁচকে বিড়বিড় করে বললেন–
— হুহ! ন্যাকা!
কেউ না শুনতে পেলেও আমি পেলাম। আন্টি বললেন–
— বর্ণ কখন আসবে তার ঠিক নেই। তুমি খেয়ে নাও ছায়া।
— না না আন্টি ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব, সমস্যা নেই।
আন্টি আর কিছু বললেন না। সকলে খেয়ে এক এক করে চলে গেল। নীলা আপু রাগে এক প্রকার ফোঁস ফোঁস করতে করতে গেলেন। আমি খাবার গুলো ভালো করে ঢেকে সোফায় বসে ওনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। আমি ধরফড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম–
— ভূ ভূমি’কম্প হচ্ছে! ভূমি’কম্প! আন্টি!
রাম ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেলাম। বর্ণ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–
— চুপ! কি আবোল তাবোল বলছ? কোথায় ভূমি’কম্প?
আমি চোখ বড়বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। কিছু মুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম যে ওনার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর উনি এসে আমাকে ধাক্কিয়ে ডাকছিলেন। তাই ভেবেছি ভূমি’কম্প হচ্ছে! উনি আবারও বললেন–
— এখানে ঘুমিয়ে আছ কেন? রুমে জায়গা নেই?
আমি হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে এগারোটা বাজে। ডাইনিং টেবিলে ওনার খাবার প্লেটে বেড়ে দিয়ে বললাম–
— খেয়ে নিন। আপনার জন্য বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গিয়েছি।
উনি এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন–
— তুমি খেয়েছ?
প্রচুর ঘুম আসছে আমার। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। চোখ টেনে টুনে মেলে বললাম–
— না, খাব না। খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।
উনি ভ্রু কুঁচকে হাত ধরে টেনে বসালেন। খাবার মুখে ঠুসে দিলেন। না চাইতেও খেতে হলো। নিজে খেলেন পাশাপাশি আমাকেও খাওয়ালেন। রুমে গিয়েই আমি ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। উনি ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমাকে টেনে বুকে নিলেন। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন–
— কাল থেকে কলেজ যাবে। আবার পড়াশোনা কনটিনিউ করতে হবে। বিয়ে হয়েছে বলে পড়াশোনা লাটে তুলবে যদি ভেবে থাকো, তাহলে সে চিন্তা বাদ দাও। আমারও কাল থেকে অফিস। সকালে বের হবো আর রাতে ফিরব। বুঝেছ?
আমি ঘুমের ঘোরে ‘উমম’ শব্দ করলাম। উনি বুঝে নিলেন যে আমি ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছি। মৃদু হেসে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন।
চলবে..