ছায়াবর্ণ পর্ব-২৫

0
251

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৫

যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখলাম তিনি অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি। তার ফর্মাল লুক দেখে সকাল সকাল কয়েকটা হার্টবিট মিস করে বসলাম। আমাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি ভ্রু নাচালেন। হকচকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। বিছানার দিকে এগিয়ে এসে ঝুঁকে কপালে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলেন। এলোমেলো চুল এক হাতে গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন–

— আমি এখন বের হচ্ছি আর রাতে ফিরব। তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে কলেজ যাবে। আর রাতে আমার আসতে দেরি হলে অপেক্ষা করবে না, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। মনে থাকবে?

আমি মাথা দুলিয়ে বললাম–

— হু মনে থাকবে।

উনি স্মিত হেসে অফিস ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমি হাই তুলে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আন্টি আর নীলা আপুকে পেলাম। আন্টি মৃদু হেসে আমাকে বসতে বললেন। নীলা আপুর দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলাম তিনি চুপচাপ খাচ্ছেন, তবে তার কঠোর চোয়াল। হয়তো রেগে আছেন কোনো কারণে। খেতে খেতে আন্টি বললেন–

— বুঝলে ছায়া? আজ বাপ ছেলে একসাথে বের হয়েছে। দুজন এক সাথে ব্রেকফাস্ট করেছে। আমার যে কি ভালো লাগছিল।

আমি কিছু না বলে হাসলাম শুধু। আন্টি আবারও বললেন–

— আজ থেকে তো তুমি কলেজ যাবে, তাই না?

— হ্যাঁ আন্টি।

আন্টি মুখ গোমড়া করে বললেন–

— আন্টি? তুমি এখন আমার ছেলের বউ ছায়া। আমাকে আন্টি বলবে না। মামনি বলবে, কেমন?

— ঠিক আছে মামনি।

ব্রেকফাস্ট শেষে রেডি হয়ে নিলাম। মামনি কে বিদায় দিয়ে বের হলাম। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ভাবলাম সব কিছু ঠিকঠাক নিয়েছি কিনা আরেকবার দেখি। ব্যাগ হাতে নিয়ে বই খাতা দেখতে লাগলাম। আকস্মিক পেছন থেকে কেউ ধাক্কা দেওয়ায় নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আর্তনাদ করে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। হাত থেকে ব্যাগ ছিটকে পড়ে গেল। দুই তলা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়লাম। মাথায় তীব্র আঘাত লাগার ফলে দেহ অবশ হয়ে এলো, চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারালাম।

ডুবে যাচ্ছি সমুদ্রের গহ্বরে। হাজার চেষ্টা করেও ভাসতে পারছি না। হাত পা ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে চলেছি, তবুও আমি ডুবে যাচ্ছি। শ্বাস নিতে পারছি না। আমি কি তাহলে আর বাঁচব না? শেষ চেষ্টা করে বড় শ্বাস নিলাম। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম আমি পানিতে না, অন্য কোথাও আছি। তাহলে এতোক্ষণ নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাকে চোখ মেলতে দেখে একটা মহিলা হম্বিতম্বি শুরু করল। চোখের পলকে হাজির হলেন বর্ণ! অস্থির দেখালো তাকে, এলোমেলো চুল, রক্তিম চোখ জোড়া, শুকনো মুখ। বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হলো। তিনি আমার এক হাত মুঠোয় নিয়ে পাশে বসলেন। অনবরত ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ দিতে থাকলেন। আমার কন্ঠ যেন রোধ হয়ে এসেছে, অনেক কষ্টে দূর্বল কন্ঠে বললাম–

— আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? নিজের কি হাল করেছেন?

তিনি রক্তিম দৃষ্টি মেলে তাকালেন। ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন–

— ঠিক আছ তুমি? কষ্ট হচ্ছে কোথাও?

হঠাৎ করেই পুরো শরীরে ব্যথা অনুভব হলো। সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা। তবুও মুখে হাসি টেনে বললাম–

— আমি একদম ঠিক আছি। দেখুন আমার কিচ্ছু হয়নি।

তিনি ঢোক গিলে বললেন–

— আজ দুই দিন পর জ্ঞান ফিরেছে তোমার। গুরুতর আঘাত পেয়েছিলে মাথায়। আর ডান পা টা ভেঙে গিয়েছে।

তার কন্ঠ কেমন যেন কেঁপে উঠলো। আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। আমি তো একটু আগেই সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলাম। এর মধ্যে দুই দিন কীভাবে হয়ে গেল? বাবা মা সহ বর্ণের বাবা মা হুড়মুড় করে প্রবেশ করলেন। মা আমাকে দেখেই আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলেন। বাবার চোখও বর্ণের মতো রক্তিম। না জানি দুই রাত চোখের পাতা এক করতে পেরেছিলেন কিনা? আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম–

— কাঁদছ কেন মা? আমি একদম ঠিক আছি।

মা চোখ মুছে বললেন–

— তুই কীভাবে পড়ে গেলি ছায়া? একটু কি খেয়াল করে চলাফেরা করতে পারিস না?

আমি বললাম–

— আমি তো ঠিকই ছিলাম। তবে মনে হয়েছিল পেছন থেকে কেউ যেন ধাক্কা দিল। কিন্তু আমার মনের ভুলও হতে পারে।

বর্ণের চোয়াল শক্ত হলো। টু শব্দটি করল না। তারা সবাই আমাকে দেখে চলে গেলেন তাকে রেখে। বাবা স্নেহের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। আজই নাকি আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। হঠাৎ বর্ণ শক্ত কন্ঠে বললেন–

— তোমার মনের ভুল ছিল না। তোমার ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

আমি অবাক চোখে তাকালাম। আমার শত্রু কে? যে আমাকে মারতে চায়বে? বর্ণ ফের বললেন–

— তবে সে জানে না আমাদের ফ্লাটের সামনেই সিসি ক্যামেরা লাগানো। এবং তাতে সে ধরা পড়ে গিয়েছে। আমি ছাড়ব না তাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম–

— কে আমার ক্ষতি চায়বে?

— নীলা! ওকে তো আমি পুলিশে দেব। শুধু তোমাকে একবার বাড়িতে নিয়ে যায়।

আমি আঁতকে উঠলাম। নীলা আপু! নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম–

— আপনি নীলা আপুকে কিচ্ছু বলবেন না। আর না পুলিশে দেবেন।

বর্ণ ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললেন–

— কেন? তোমার কথা আমি কেন শুনব? আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত? আমি কি নিয়ে বাঁচতাম?

দুর্বল হাত বাড়িয়ে ওনার হাতের ওপর রাখলাম। বললাম–

— দেখুন আমার তো কিছু হয়নি। নীলা আপু একটা ভুল করে ফেলেছে। সে হয়তো এমনটা করতে চায়নি তবে হয়ে গিয়েছে। তাকে আরেকটি সুযোগ দিন। প্লিজ? আমার কথাটা রাখুন।

বর্ণ মুখ এগিয়ে এনে কপালে আদুরে স্পর্শ দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–

— তুমি রেস্ট করো। এসব বিষয়ে পরে ভেবে দেখব। অযথা মাথায় চাপ দিও না।

কোনো কথা না বলে চোখ বুজে নিলাম। নীলা আপু ওনার ওপর দূর্বল ছিলেন, সেই জন্য রাগের বশেই হয়তো কাজটা করে ফেলেছেন। তাকে অবশ্যই দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া উচিত।

সেদিনই আমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। হাঁটতে না পারার কারণে হাসপাতাল থেকে কোলে করে গাড়িতে তুলেছেন আবার গাড়ি থেকে সিড়ি বেয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠেছেন। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি মানুষটিকে। দুটো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন, তবুও তিনি থেমে নেই। একটু বিশ্রামও নেননি। তার যাবতীয় সময় আমাকে সঁপে দিয়েছেন। নতুন চাকরি, একদিন যেয়েই আমার জন্য ছুটি নিয়েছেন। নীলা আপুও বাড়ি চলে গিয়েছেন। আমার জেদের জন্য তিনি নীলা আপুকে কিছু বলেননি শুধুমাত্র শাসিয়েছেন আর কাউকে তার কীর্তির কথা জানানওনি।
দিনরাত এক করে আমার খেয়াল রাখেন। কোথাও যাওয়ার হলে, হয় ধরে নেন নাহলে একদম কোলে তুলে নেন। তবে মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর থেকে আমাকে একদম ছাড় দেননি। নিয়মিত পড়াচ্ছেন, আমার এখন তিনটা কাজ। খাওয়া, ঘুম আর পড়া।
অফিস তো আর বেশিদিন বন্ধ দেওয়া যায় না। তিনি অফিস যাওয়া শুরু করেছেন। তার অনুপস্থিতিতে মামনি নাহয় মা দু’জনের একজন আমার সাথে থাকবেই। এটা তাঁর কড়াকড়ি আদেশ। পা ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে। এবং দীর্ঘ একমাস পর আমি এখন পুরোপুরি হাঁটতে পারি। এতে আমার আনন্দের অন্ত নেই।

রাত আটটা বাজে, তিনি অফিসের কিছু ফাইল দেখছেন। শুক্রবার হওয়ায় বাড়িতে আছেন, অন্যান্য দিন দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারেন না। আমি মনের সুখে রুমে এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াচ্ছি। কখনও বা লাফাচ্ছি। তিনি ফাইল থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে বললেন–

— কি হচ্ছে?

আমি প্রফুল্ল কন্ঠে বললাম–

— দেখুন আমি কি সুন্দর হাঁটতে পারছি! একমাস বসে ছিলাম! ভাবা যায়? আমার তো মনে হচ্ছে এখন অলিম্পিকে অংশ নিলে জিতে যাব।

পুনরায় ফাইলে চোখ দিয়ে বললেন–

— সবে মাত্র ঠিক হয়েছে। বেশি লাফালে আবারও একমাস বসে থাকতে হবে।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। আমি গুটি গুটি পায়ে ওনার পাশে ঘেসে বসলাম। ওনার কোনো হেলদোল হলো না। উৎসুক কন্ঠে বললাম–

— আপনি জানেন কাল কি?

— কাল আবার কি?

আমি দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে বললাম–

— কাল আমার জন্মদিন।

তিনি নির্লিপ্ত। ভাবলেশহীন ভাবে বললেন–

— ওহ্!

আমার মুখ কালো হয়ে গেল। শুধু ওহ্? আর কিছু না? মিনমিন করে বললাম–

— আমার জন্মদিন আর আপনি শুধু ওহ্ বললেন!

তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন–

— তো আর কি করব? কাজ করছি তো নাকি? যাও তো, এখন আমাকে ডিস্টার্ব কোরো না।

চোখ ভরে এলো। আমার জন্মদিন! আর উনি কাজ দেখাচ্ছেন? আমার কোনো মূল্যই নেই ওনার কাছে। ধপাধপ পায়ে ঘর ছাড়তে ছাড়তে বললাম সকল স্ত্রীদের অসাধারণ বাক্যগুলো–

— আমি আর এখানে থাকব না। কালই বাপের বাড়িতে চলে যাব।

চলবে..