ছায়া সঙ্গিনী পর্ব-২০

0
316

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-২০
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা ছয় জন।ঢাকায় কোয়ার্টারে আসার পর রাহাতের কলিগ এবং তাদের ব‌উ’রা ট্রিট এর জন্য ধরে রাহাত কে। বিয়ে করেছে এতো মাস হয়ে গেছে অথচ তাদের মিষ্টি পর্যন্ত খাওয়ায়’নি রাহাত,সে নিয়ে তাদের অনেক অভিযোগ।তাই আজকে বের হ‌ওয়া।
অতঃপর,
ক্যান্টনমেন্ট এর কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় আসলাম।ওয়েটার মেনু কার্ড নিয়ে এলে, রাহাত তার কলিগ, হাসান আর সৈকত ভাই এবং তাদের স্ত্রী নাইমা আর মহুয়া ভাবীদের দিলেন তারা কি খাবেন অর্ডার করার জন্য। আমাকে কি খাবো জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম,
– ডিমের স্যান্ড‌উইচ আর ফ্রুট কাষ্টার্ড। রাহাত বললো আমি যা খাবো সেও তাই খাবে।

তারপর তারা খাবার অর্ডার করলো,

হাসান ভাইয়া,
– লাজানিয়া,ক্রয়স্যান্ট।

সৈকত ভাইয়া,
– ওনিয়ন রিং,প্যানকেক।

নাঈমা ভাবী,
– স্প্রিং রোল,মিটবল।

মহুয়া ভাবী,
– পিজা,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।

খাবার আনতে আনতে আমরা সবাই গল্প শুরু করি।কার ব‌উদের সাথে কিভাবে পরিচয় হলো তারপর বিয়ে হলো এগুলো নিয়ে।এর মধ্যে সৈকত ভাইয়া আর মহুয়া ভাবীর বিয়েটা ছিল ইন্টারেস্টিং। সৈকত ভাইয়া যেমনটা বললেন,
– সৈকত ভাইয়া যখন ট্রেনিং এ কোন এক গ্রামে যায় এবং সেখানে তাঁবু বানিয়ে থাকে তখন ঐ গ্রামের সুন্দরী বালিকা মহুয়া কে দেখে পছন্দ হয় তার। কিন্তু সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী তাদের চাকরিতে জয়েন করার ছয় বছর পর বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই কারণে চাইলেও বিয়ে করতে পারে না মহুয়া কে। তবে গোয়েন্দা লাগিয়ে ঠিকই মহুয়ার খবর রাখে।এর চার বছর পর বিয়ে ঠিক হয়ে মহুয়ার। সেই খবর শুনে সৈকত ভাই বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় মহুয়া দের বাড়ি! মহুয়ার বাবা কিছুই রাজি নন। মহুয়ার বাবা তার পাটনার এক কাপড়ের ব্যবসায়ির সাথে বিয়ে ঠিক করে তিনি। পাত্রের বয়স ত্রিশের উর্দ্ধে! অথচ মহুয়ার বয়স পনেরো! মহুয়া প্রথম থেকেই এই বিয়েতে রাজি নয়।তাই বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে এবং সৈকত কে দেখে পালিয়ে আসে সৈকতের সাথে! সৈকত বিয়ে করে নেয় মহুয়া কে! তবে সৈকতের পরিবার ছাড়া বিয়ের কথা কাউকে জানানো হয়নি।যখন সৈকতের অফিস থেকে বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়, তখন আবার নতুন করে বিয়ে করে তারা। বিয়ে করে অফিসে পেপার্স জমা দেয়।

এখন শুনেছি মহুয়া ভাবীর বাপের বাড়ির সবাই মেনে নিয়েছে বিয়েটা। আলহামদুলিল্লাহ।
______
ওয়েটার খাবার নিয়ে আসে, সবাই খাবার খেতে শুরু করলাম।প্রত্যেক স্বামী ব‌উরা একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে। পরিবেশটা খুবই আনন্দময় হয়ে উঠেছে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটার মতো সুখ আর হয়না। একে অপরের প্রতি,মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস,কেয়ার, শেয়ার সবকিছু থাকে তখন সুখের কমতি হয় না।
খাবার খাওয়া শেষে বসে বসে বিভিন্ন ধরনের মশলা চিবোচ্ছি তখন মহুয়া ভাবী বললেন,
– ওই লোকটা যে আর আসছে না?

নাঈমা ভাবী বললেন, কোন লোক?
– আরে ঐ যে খাবার দিয়ে যায়।
– একটু পর আসবে হয়তো।

তারা ফিসফিস করে কথা গুলো বলছিল তখন আমি শুনতে পেলাম।যাই হোক ওয়েটার আসে দশ মিনিট পর। তারপর রাহাত বিল দিতে গেলে মহুয়া ভাবী বলে উঠলো,
– ভাই এই লোক তো আমার বাকি খাবার দিল‌ই না!আপনি এখনি টাকা দিয়ে দিচ্ছেন? এখন দিবেন না, দিলে আমার বাকি খাবার দিব না।

ওয়েটার সহ আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, তখন ওয়েটার বললো,
– ম্যাম আমি তো আপনাদের অর্ডার করা সমস্ত খাবার সার্ভ করেছি।আপনারা তো মোট দশ আইটেম খাবার অর্ডার করেছেন,সব গুলোই তো দেওয়া হয়েছে।

মহুয়া ভাবী রেগে মেগে বললেন,
– কি বলছেন আপনি? আপনি তো আমার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ই দিলেন না! আবার বলছেন সব দিয়েছেন?

এদিকে মহুয়া ভাবীর কথা শুনে আমরা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাহাত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বিল মিটিয়ে ওয়েটার কে বিদায় করলো। তারপর সৈকত ভাইয়া বললেন,
– মহুয়া তোমার পিজা আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তো দেওয়া হয়েছে। তাহলে তুমি এসব কি বলছো? লোকটা এখন কি ধারণা করবে বলোতো?

– আমি এতো কিছু জানি না, তুমি দেখনি? আমাকে শুধু আলু ভাজি আর পিজা দিলো! ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কখন কোথায় দিল?

মহুয়া ভাবীর এরকম কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমরা।তাই ফল স্বরুপ জর্জর করে হেসে দিলাম সবাই।আর সৈকত ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। নাঈমা ভাবী হাসতে হাসতে বললেন,
– ভাবী ঐ আলু ভাজি ই হচ্ছে গিয়ে আপনার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই!

তখন মহুয়া ভাবীর মুখশ্রী বেলুনের মতো ফাঁকা হয়ে গেল। সৈকত ভাইয়া বললেন,
– যেই কারণে আমি এতো দিন তোমাকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়াইনি। আমি জানতাম তুমি এগুলো কে আলু ভাজি বলবে আর আমাকে বলবে রেস্তোরাঁয় তোমাকে আলু ভাজি খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসি। এখন দেখছি আমার ই ভুল তোমাকে একবার খাইয়ে দেখানোর উচিৎ ছিল আমার।

বুঝলাম ভাইয়া রেগে গিয়েছেন, তাই বললাম থাক ভাইয়া বাদ দিন। আমার একজন স্যার বলতেন, মানুষ ভুল না করলে কি গরু ছাগল ভুল করবে?তাই মানুষ মাত্রই ভুল। তাছাড়া পৃথিবীতে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তা’আলা এতো নেয়ামত সৃষ্টি করেছেন যা এখনো আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এবং আমরা কখনো চোখেও দেখেনি।তাই এরকম হ‌ওয়া স্বাভাবিক,বিষয়টা অস্বাভাবিক ভাবে না নিলেই হয়।
আমার সাথে সবাই একমত পোষণ করলেন। তারপর বাসায় ফিরে এলাম সবাই।
_______

এক সপ্তাহ পর,
মাকে সঙ্গে করে ঢাকায় ফিরে এসেছি আমরা।এখন থেকে আমি রাহাত মা এখানেই কোয়ার্টারে থাকবো। রাহাত অফিসে চলে গেছে,আর আমি পেট ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছি খনে খনে। তবে আজকে পেটের ব্যাথা থেকে মনের ব্যাথাটা বেশি!যার কারণে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার।
রাহাত অফিসে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর পিরিয়ড শুরু হয় আমার।পেট ব্যথা সবসময় ই হয় নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমি যে কতো আশা করে ছিলাম,”আসবে আমার ঘরে একটা ছোট্ট সোনা, ভরিয়ে দিবে খুশির আলোয় তার জোছনা”।(দুটো বাক্য গান থেকে নেওয়া) সেই আশা মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল আমার।
আমার একটা বান্ধবী বলেছিল, আর্মিদের কঠোর ট্রেনিং এর কারণে তাদের শারীরিক সমস্যা হয় যার ফলে অনেকের বেবি হয় না!
এসব কথা আজ খুব মনে পড়ছে আমার,তাই আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। আমি যে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চাই আল্লাহ।ইয়া আল্লাহ আমাকে তুমি দয়া করো, আমি ছাড়া তো তোমার অনেক বান্দা আছে কিন্তু তুমি ছাড়া তো আমার কোন মাবুদ নেই। তোমার এই পাপি বান্দা কে রহম করো আল্লাহ।

বালিশে পেটে চেপে ধরে কাঁদছি, শ্বাশুড়ি মা এসে বললেন,
– ব‌উ তোমার মোবাইল বাজতাছে,ধরো না ক্যান?এই নাও।

আমি দ্রুত চোখের পানি মুছে, ফোন হাতে নিয়ে দেখি আপু কল করেছে বিদেশ থেকে। আমি কল বেগ করলাম।আপু কল রিসিভ করে বললো,
– কিরে কি করছিস তুই? কতোবার কল করলাম। রিসিভ ই করছিস না।

– আসসালামু আলাইকুম।
কেমন আছো আপু?

– ওয়ালাইকুমুস সালাম।
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কি অসুস্থ আয়রা? কথা কেমন যেন শুনাচ্ছে!

– ঐ সব সময়ের মতো পেট ব্যথা করছে। সাফা আর মার‌ওয়া কেমন আছে? কোথায় ওরা?

– আয়রা তুই কি প্রেগন্যান্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য,,,

– না আপু সেরকম কিছু নয়, এমনিতেই পিরিয়ড শুরু হয়েছে।আপু আমার কি কখনো বেবি হবে না?

– হোপ!কিসব অলোক্ষুনে কথাবার্তা বলছিস তুই? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর, আল্লাহ তা’আলা এর ফল দিবেন ইনশা আল্লাহ।
এসব নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা করিস না। সাফা আর মার‌ওয়া ওদের বাবার সাথে বাহিরে বের হয়েছে। শোন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবি,এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করিস না। প্রথম প্রথম এরকম হয়, কয়েক মাস পর ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

– আচ্ছা আপু দো’আ ক‌ইরো তোমার কথা যেন সত্যি হয়।পরে কথা বলবো ভালো থেকো।
আল্লাহ হাফেজ।

– আচ্ছা তুই ও ভালো থাকিস, আল্লাহ হাফেজ।
_____
আমাকে অসুস্থ দেখে মা সব রান্না বান্না করেন। দুপুরে রাহাত আসে, আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– কি হয়েছে আয়রা? শরীর খারাপ? তুমি কি কান্না করেছো?

আমি শুধু বললাম,পেট ব্যথা করছে সকাল বেলা থেকে।ও বললো ঔষধ খেয়েছি কিনা? আমি বললাম, এই সময় পেইনকিলার না খাওয়াই ভালো।ও ওঠে কোথায় যেন গেল, আমি আগের মতই শুয়ে রইলাম।এর কিছুক্ষণ পর গরম দুধ গ্লাসে করে নিয়ে এলো।এই সময় গরম খাবার খাওয়া উচিৎ। বিশেষ করে গরম পানি,দুধ, চা,কফি। এগুলো খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়, বিশেষ করে পেট ব্যথার জন্য।
আমাকে ধীরে ধীরে বসিয়ে দিয়ে, বললো নাও সবটা দুধ খেয়ে নাও ভালো লাগবে। আমি বললাম, তুমি খেয়ে আমাকে দাও কিন্তু সে মানলো না। তা-ও আমি কিছুটা খেয়ে বললাম নাও এবার খাও‌।ও একটু খেয়ে আবার আমাকে সবটা খাইয়ে দিল।

তারপর বললো, শাওয়ার নিয়েছো?
আমি মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম। সে বললো চলো শাওয়ার নিবে। আমি বললাম শাওয়ার না নিলে হয় না? ভালো লাগছে না উঠে গিয়ে শাওয়ার নিতে,,,,,

#চলবে,,, ইনশা আল্লাহ।