ছায়া বিহীন পর্ব-০১

0
1903

গল্পঃ #ছায়া_বিহীন (প্রথম পর্ব)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

গায়ে হলুদের রাতে একটা প্রতারকের মিথ্যে আশ্বাসে পালিয়ে যাওয়াটাই ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ!
আজ ২৫ টা বছর পেরিয়ে আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে গেছে। অথচ আজ কেন এই অভিশপ্ত মুখটা আমাকে দেখতে হলো? এই মুখ তো বেঁচে থাকতে আর দেখতে চাইনি আমি!

চোখের চশমাটা আধ খোলা অবস্থায় জোহানা তার প্রাক্তন প্রেমিক রুমানের ছবির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলেন।
নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এই বাড়িতে এসেছেন তিনি। ঘরের কর্তার জন্য ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছিলেন বেশ খানিক্ষণ হলো, হঠাৎই তার চোখে পড়ে ২৫ বছর আগের খুব চেনা একটা মুখের দিকে, সেটা ছিল পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে একটা বাঁধাই করা ফ্রেম ৷ জোহানার বুঝতে বাকি রইলো না, এটা রুমানের পরিবার! এবং ভুলক্রমে আজকে তার বাড়িতেই সে পা রেখেছে।

বুঝতে পারার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো, না না এইখানে এক মূহুর্তও নয়। কোনো প্রতারকের বাড়িতে তার ছেলের বিয়ে হতে পারেনা।
জোহানা নিজের হাতব্যাগটা সোফা থেকে নিয়ে পেছনে ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন৷ তখন রুমানের স্ত্রীর ডাক,
___ এই আপনি কোথায় যাচ্ছেন? এইতো উনি এসেছেন।

রুমানের স্ত্রীর সাথে রুমানও একটু এগিয়ে এসে বললো,
___ কি মিসেস রসিদ,খুব তাড়া মনে হচ্ছে? সে যাই হোক, এসেছেন যেহেতু আজকে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে, আলাপ আলোচনা সুষ্ঠুভাবে করার পর তবেই যাবেন। এদিকে আমার মেয়ে প্রায় এক মাস ধরে বলতেছে ইনামের মা কথা বলতে আসবে। আপনি কিনা এসে কথা না বলেই চলে যাওয়ার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন? আসুন আসুন, বসুন।

বলেই রুমান গিয়ে সোফায় বসলো তার তার স্ত্রীকে বললো,
___আমাদের হবু বেয়াইন সাহেবা আর আমার জন্য দু কাপ কফি নিয়ে এসো, তারপর দুপুরের খাবার আয়োজন করো। উনি খেয়ে যাবেন।

রুমানের কথায় মাথা নেড়ে তার স্ত্রী চলে গেলো, জোহানাও চলে যেতে চাইলো, তারপর ভাবলো সে তো চোর নয়, সে কেন পালাবে? সেটাও কিনা একটা অপরাধীর থেকে!
জোহানা ফিরে তাকালো। দেখলো রুমান সাহেব পেপারের দিকে তাকিয়ে আছেন। জোহানা বিপরীত পাশের সোফার উপর ব্যাগটা রেখে বসলেন, উপস্থিতি টের পেয়ে রুমান সাহেব পেপারটা নামিয়ে
বললেন,
___ তারপর কি সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে….

বলতে গিয়েও রুমান সাহেব থেমে গেলেন। জোহানার দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের চোখ কচলেন, তড়িঘড়ি করে টেবিল থেকে নিজের চশমাটা চোখে দিয়ে, অস্পষ্ট স্বরে ফিসফিস করে বললো,
___ জুহি তুমি? এখানে কীভাবে? মানে তুমি, তুমি রসিদ সাহেবের …

জোহানা চেহেরা টানটান করে বললো,
___ হ্যাঁ আমি মিসেস জোহানা রসিদ! মনে আছে তাহলে আমার কথা?

রুমান সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে গেলো, নিজের পুরনো স্মৃতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠছে। তিনি কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, কোনো রকম বললেন,
___ আমার মেয়ে তাহলে ইনাম, মানে তোমার ছেলেকে তিন বছর ধরে ভালোবাসে? এটা কীভাবে সম্ভব জুহি?

জোহানা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
___ আমি যদি জানতাম, আমার ছেলে ইনাম আপনার মতো একটা প্রতারকের মেয়ের সাথে এতদিন সম্পর্ক রেখে আসছে, তাহলে আমি কবেই এর ইতি টানতাম। এই সম্পর্ক মেনে নেওয়া অসম্ভব।
বলে দিয়েন আপনার মেয়েকে।

রাগে আর জেদে জোহানার নাক লাল হয়ে গেছে, চোখ দুটোতে সেই ঘৃণাগুলো চিকচিক করছে। জোহানা এক মূহুর্তও আর দাঁড়ালো না, দরজা খোলে দরজাটা একটু ধাক্কাটা দিয়ে লাগাতে যাবে তখন খেয়াল করলো, রুমান হাত উঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছে জুহি দাঁড়াও। কিন্তু সেটার সুযোগ না দিয়েই মুখের উপর দরজাটা আওয়াজ করে বন্ধ করে চলে আসলো।

রুমানের স্ত্রী কফি হাতে এসে রুমানকে জিজ্ঞাসা করলো,
___কোথায় উনি? আর দরজা এতো জোরে লাগিয়েছিলো কে? বুঝতে পারছিনা, উনি চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন কেন? শেষ পর্যন্ত কিনা চলেই গেলো।

তার কোনো কথার জবাব দিলোনা রুমান। কফি হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার বললো,
___ কিগো বিয়ের ব্যপারে কিছু বললো?

রুমান সাহেব কিছু বলতে যাবে, তখনি তার মেয়ে ঊষা আস্তে আস্তে লাজুক চেহেরায় এসে দাঁড়ালো।
তিনি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিরব হয়ে গেলেন।
রুমান সাহেবের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তার মেয়ের স্বপ্ন আশা ভরসাগুলো বিসর্জন দিয়ে পূরণ হবে তিনি সেটা কল্পনাও করতে পারেননি। কিছুক্ষণ চুপ করে আছে সবাই, ঊষা আস্তে আস্তে আবার নিজের রুমে চলে গেলো। রুমান সাহেব এখনো চুপ! বিরক্ত হয়ে তার স্ত্রীও চলে গেলো।

এদিকে রসিদ সাহেব ও ইনাম জোহানার জন্য অপেক্ষারত। সে বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে ইনাম দৌঁড়ে এসে মায়ের ব্যাগটা নিয়ে পেছনে পেছনে আসতে লাগলো।
জোহানা গিয়েই বিছানায় হেলে পড়লেন। তার কপালে ঘামের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ ইনাম ড্রয়ার খুঁজে এসির রিমোট বের করে এসি চালু করলো। যেহেতু শীতকাল তাই এসিরও দরকার নেই, তাই রিমোটও সামনে ছিল না। নিজের মাকে এভাবে অস্থির অবস্থায় দেখে ইনামের কলিজায় কেমন যেন মুচড় খাচ্ছে, ঊষা আর তার বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি তো? সেসময় ইনামের বাবাও রুমে প্রবেশ করলেন। বিছানায় বসে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

___জুহি তুমি ঊষাদের বাসায় গেলে আর তোমার ছেলে এই সময়ের মধ্যে ৫০ বার বাড়ির গেইটে গেছে আর আসছে।

বাবার কথা শুনে ইনাম লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো। তার বাবা আবারও বললো,

___ এর আগে আমি তাদের সাথে কথা বলেছিলাম বলে এবার আমাকে না নিয়ে নিজে একাই গেলে, তা কি বলে আসলে শুনি?

ইনামও বাবার কথার সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে মনযোগী হলো মায়ের কথা শুনতে। কিন্তু জোহানা চোখ বন্ধ করে কাঁথাটা এগিয়ে দিতে বললো। ইনাম অবাক হয়ে বললো,
___ আম্মু কি হয়েছে তোমার? এখনি ঘামছিলে আর এখনি তুমি ঠান্ডায় কাঁপছো? কি হয়েছে ঊষাদের বাড়িতে? ওরা কি রাজী হয়নি?

জোহানা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
___ইনাম প্লিজ মাকে একটু একা ছেড়ে দাও। তোমাকে পরে সব বলবো।

ইনাম বিমর্ষ চেহেরায় উঠে চলে গেলো। নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে জোহানার এখন ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি সারাজীবন ভেবে এসেছেন, নিজের ভালোবাসার মানুষকে তিনি পাননি, তাই উনার সন্তানের ভালোবাসাকে কখনো হারাতে দিবেন না। সত্যিই দিতেন না, ঊষা যদি একটা রাস্তার মেয়েও হতো তিনি মেনে নিতেন৷ কিন্তু যার জন্য জোহানার জীবনটার বেহাল দশা হয়েছে, যার জন্য নিজের পরিবার তাকে অস্বীকার করেছে, নিজের পিতার মৃত্যুর দায়ভার কাঁধে নিয়ে ২৫ টা বছর নিজের মা’কেও দেখার সুযোগ হারিয়েছে, সে তার মেয়েকেই কি করে নিজের ছেলের বউ করবে?

চলবে….