জল-ফড়িঙের খোঁজে পর্ব-১১+১২

0
512

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১১
.
রিখিয়া একরাশ অস্বস্তি নিয়ে জ্যাকেটটা নিজের গায়ে জড়িয়ে নিল। প্রায় মধ্যরাত এখন। প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছে। লোকজনের তেমন ভীর না থাকলেও স্টেশন ফাঁকা নয়। বিহান বা রিখিয়া কেউ কিছুই বলছেনা। রিখিয়া এখনও খাওয়া শুরু করেনি। বিহান খেতে খেতে বলল,

” শীতের রাতে গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজা। আহা!”

এরপর রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” একি! তুমি খাচ্ছো না কেন? ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।”

রিখিয়ার বেশ বিরক্ত হলো। তুর্বীর টেনশনে ওর মাথা ছিড়ে যাচ্ছে আর এই ছেলে খাওয়া নিয়ে পরেছে। রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” আমার কতটা চিন্তা হচ্ছে আপনি বুঝতে পারছেন? আমার বান্ধবীকে পাওয়া যাচ্ছেনা। বুঝতে পারছেন আপনি?”

” আরে ডোন্ট ওয়ারি শী ইজ ইন সেফ হ্যান্ড”

বিহান আনমনে বলে ফেলল কথাটা। রিখিয়ার বিহানের কথাটা ঠিকভাবে ধরতে পারল না। তাই জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

” কিছু বললেন?”

” না। তাড়াতাড়ি খাও। আবার খুঁজতে হবে তো নাকি?”

রিখিয়া এবার রাগী কন্ঠে বলল,

” আমরা পুলিশ স্টেশনে কেন যাচ্ছিনা?”

” তোমার বান্ধবী বাচ্চা নয়, এডাল্ট একটা মেয়ে। আর কয় ঘন্টা হয়েছে ও নিখোঁজ? লজিক দিয়ে কথা বলো ভাই! এখন কথা না বারিয়ে চুপচাপ খাও।”

রিখিয়া মুখ গোমড়া করে খেতে শুরু করল। বিহান আড়চোখে একবার তাকাল রিখিয়ার দিকে তারপর গলা ঝেড়ে বলল,

” আচ্ছা, আমিতো আছি। ঠিক পেয়ে যাবো চিন্তা করোনা।”

রিখিয়া উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। খাওয়া শেষ করে ওরা ওখানেই বসল কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে। এরমধ্যেও রিখিয়া কয়েকবার তুর্বীকে কল করে ফেলেছে। কিন্তু ফোন বন্ধ। রিখিয়া কিছু না বলে চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ পর বিহান খেয়াল করল রিখিয়ার চোখ ছলছল করছে। বিহান রিখিয়ার কাঁধে হাত রাখতেই রিখিয়া কেঁদে দিল। কেন জানিনা বিহনের রিখিয়ার কান্না একেবারেই সহ্য হচ্ছেনা। মেয়েটার সাথে এই নিয়ে মোট চারবার দেখা হল। এই অল্প সময়ে ওর হাসি বা কান্নায় তো বিহানের কিছু যায় আসার কথা না। তাহলে কেন এমন হচ্ছে? এই অনুভূতি কেন? ও রিখিয়ার দিকে ঘুরে বসে আলতো হাতে ওর চোখ মুখে দিল। রিখিয়া রিতীমত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। বিহান ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে বলল,

” এভাবে কাঁদলে একটু পর স্টেশনের সবাই এসে আমাকে বেঁধে পেটাবে। ভাববে তোমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করেছি। তোমার বোকামির জন্যে একবার সারারাত লকাপে কাটিয়েছি। এবার কী মার খাওয়াবে?”

রিখিয়া মুখ ফুলিয়ে একপলক বিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সেদিন না হয় একটা ভুল করেছিল, তাই বলে এভাবে লজ্জা দিতে হবে? বিহান বাঁকা হেসে রিখিয়ার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” জানো? লজ্জা পেলে তোমার গাল দুটো পুরো লাল লাল হয়ে যায়? টমেটো টাইপ।”

রিখিয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল বিহানের দিকে। বিহান হেসে চোখ টিপ মারল। এতে তো রিখিয়ার একেবারে বিষম খাওয়ার যোগার। কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওর একটু হাসি পেল। হাসতে নিয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল। বিহান সেটা খেয়াল করে বলল,

” আ-আ-আ স্মাইল, স্মাইল। এটা ঠিক না, তুমি হাসছিলে। হাসো প্লিজ। আরে স্মাইল না!”

রিখিয়া এবার আর হাসি আটকে রাখতে পারল না। মুখের ওপর হাত রেখে হেসে দিল। বিহানও হাসল। রিখিয়া হাত নামিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

” আপনি সত্যিই পাগল।”

” ব্রো ও সেটাই বলে।”

” ব্রো কে?”

” আমার ভাই, বন্ধু, গার্ডিয়ান সব।”

রিখিয়া অবাক হল কারণ ও আন্দাজ করতে পেরেছে কার কথা বলছে । বাবা-মা কে ছেড়ে সমবয়সী একজনকে গার্ডিয়ান বলছে? কেন? কিছু একটা ভেবে শিউর হতে বলল,

” সেদিন থানায় আপনার সাথে যেই ছেলেটা ছিল সে?”

” হুম।”

রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” খুব ভালোবাসেন তাকে?”

” বাসতে বাদ্ধ। কারণ ও আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে।”

” আপনার বাবা-মা?”

বিহান চুপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

” চল, এগোনো যাক?”

বিহান যে রিখিয়ার কথা এড়িয়ে গেল সেটা রিখিয়া বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কী করবে? কারো ব্যাক্তিগত জীবণ নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানোর মত ম্যানারলেস ও নয়। আর হওয়া ঠিকও না।

________________

সৌহার্দ্য ওয়াসরুমে গেছে। তুর্বীর মনে হল এটাই বেস্ট টাইম পালানোর। এতক্ষণ তো সৌহার্দ্য পুরো চোখে চোখে রেখেছে ওকে। ওকে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত একটাই যা করেছে তার জন্যে সরি বলতে হবে, আর প্রমিস করতে হবে ওকে আর এরকম জ্বালাবে না। কিন্তু তুর্বী কী এত সহজে মেনে নেওয়ার মেয়ে? ওর একটাই কথা ও রাজি হবেনা। এই S.R. এর ভয়ে তো একেবারেই না। গায়ের জোরে একবার পালাতে গিয়েছিল কিন্তু সৌহার্দ্য সাথে পেরে ওঠে নি। তাই এখন এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়না ও। তুর্বী ধীরপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে টি-টেবিলের ওপর থেকে ছুরিটা নিয়ে নিল সেফটির জন্যে। দরজার কাছে গিয়ে দেখল দরজাটা লক করা। কয়েকবার ঠেলে, ধাক্কা দিয়েও কোন লাভ হল না। ও দরজার একটা লাথি মেরে বলল,

” দূর! লক করে রেখে গেছে।”

প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর। রাগে ছুরিটা দিয়ে দরজায় অকারণেই আঘাত করল কয়েকবার।

” শুধু শুধু আমার দরজার বারোটা কেন বাজাচ্ছো?”

তুর্বী চমকে পেছনে তাকালো। তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছে। মাস্ক পরে থাকায় চেহারার এক্সপ্রেশন দেখতে পাচ্ছেনা। সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে আসতেই তুর্বী ছুরিটা সৌহার্দ্যর দিকে তাক করে বলল,

” দেখুন। আমাকে যেতে দিন হ্যাঁ? নইলে কিন্তু…”

সৌহার্দ্য দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

” না হলে?”

” ছুরি চালিয়ে দেব কিন্তু।”

” এটা ছাড়া আর কিছু পারো?”

তুর্বী কিছু বলল না কিন্তু ছুরিটা আরো এগিয়ে ধরল। তুর্বীর ছুরিকে তোয়াক্কা না করে সৌহার্দ্য এগোতে এগোতে বলল,

” তোমার কী সত্যি মনে হয় তোমার এসব সিলি ট্রিক্ট কোন কাজের?”

বলে তুর্বীর হাত ধরে ছুড়িটা নিয়ে ওকে টেনে এনে আবার বেডে বসিয়ে দিল। তুর্বী একরাশ বিরক্তি নিয়ে পা উঠিয়ে বসে বলল,

” আপনি আমায় ছাড়বেন কী না? সেটা বলুন আগে।”

সৌহার্দ্য আলসেমি ঝেড়ে তুর্বীর পাশে বসে বলল,

” আগে আমি যা বলেছি তা মেনে নাও। ছেড়ে দেব।”

” কখনই না।”

” তাহলে এভাবেই থাকো।”

বলে সৌহার্দ্য আবার ফোন স্ক্রোলিং এ মনোযোগ দিল। তুর্বী চোখ মুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আড়চোখে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে, গলাটা একটু ঝেড়ে বলল,

” তা খোমাটা একটু দেখালে কী হয় ?”

সৌহার্দ্য অবাক কন্ঠে বলল,

” ‘খোমা’ কী জিনিস?”

” আরে মুখ, মানে চেহারা।”

সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বলল,

” সেটা সোজাভাবে বললেও হত। এসব কী ভাষা?”

” আপনি যে এত মূর্খ একটা মানুষ তা জানতাম না।’

সৌহার্দ্য একটা হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। ফোনটা সাইডে রেখে বলল,

” এমনিতে তো আমার ফেসবুক পেজে, কমেন্টে বড় বড় করে লিখতে আমাকে সামনে পেলে এই করবে, সেই করবে। এখন তো সামনেই আছি। বল কী করবে?”

তুর্বী গাল ফুলিয়ে হাত ভাজ করে বলল,

” তখন কী জানতাম নাকি যে আপনি এত ডেঞ্জারাস একটা মাল।”

সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,

” আবার এসব ভাষা!”

তুর্বী আরো রেগে গিয়ে বলর,

” একশবার বলব। কী করবেন আপনি?”

সৌহার্দ্য গেঞ্জির হাতা ফোল্ড করে তুর্বীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর দিকে ঝুকে বলল,

” দেখতে চাও কী করব?”

তুর্বী একটু পিছিয়ে তুতলিয়ে বলল,

” নাহ! আমি কিছুই বলিনি। আর বলবও না।”

” বেটার।”

বলে সৌহার্দ্য আবার ফোনটা হাতে নিল। তুর্বী নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছে। ও এই লোকটাকে হুটহাট ভয় কেন পেয়ে যাচ্ছে? না পেয়েও তো উপায় নেই। ও এখানে একা আছে। লোকটা চাইলেই যা খুশি করতে পারে ওর সাথে। তাই একটু সাবধান হতে হবে। সৌহার্দ্য বলল,

” এই ফার্মহাউজের ছাদটা খুব সুন্দর। যাবে?”

তুর্বী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্যর ব্যবহারে বেশ অবাকই হচ্ছে। ও মুখ বাঁকিয়ে বলল,

” বাহবা! আপনি কেমন কিডন্যাপার বলুনতো? যাকে কিডন্যাপ করেছেন তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখার বদলে ছাদের সৌন্দর্য দেখাতে চাইছেন? মতলব কী হ্যাঁ?”

সৌহার্দ্য নিজেই অবাক হয়ে গেল। ঠিকই তো! ও কেন করছে এসব? ও তো তুর্বীকে ভয় দেখিয়ে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিল যাতে ওকে অন্তত আর বিরক্ত না করে। কিন্তু ও এসব কেন করছে, তার উত্তর ও নিজেই জানেনা। কিন্তু কেন যেন তুর্বীর উপস্থিতি সৌহার্দ্যর খুব ভালো লাগছে। স‍ৌহার্দ গলা ঝেড়ে বলল,

” আমি তোমার মত অভদ্র নই। অন্যের সাথে ভালো ব্যবহার করতে জানি। এবার বল যাবে?”

তুর্বী কিছু একটা ভেবে বলল,

” আচ্ছা। চলুন। এখানে বসে বসে বোর হওয়ার চেয়ে বেটার।”

সৌহার্দ্য তুর্বীর হাত ধরল। তুর্বী অবাক হয়ে বলল,

” আরে? কী হচ্ছে কী?”

” তোমাকে দিয়ে কোন বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে দরজা খুললেই মিলখা সিং হয়ে দৌড় লাগাবে।”

তুর্বী একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তুর্বীর হাত ধরে নিয়ে গেল ছাদে। তুর্বীও চুপচাপ গেল সৌহার্দ্যর সাথে। ও এমনিতেও পালানোর চেষ্টা করত না। কারণ ওর কেন জানি মনে হচ্ছে সৌহার্দ্য ওকে সকালবেলা এমনিই যেতে দেবে।

ছাদের একপাশে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। দুজনেই চুপচাপ আছে। তুর্বীর বারবার পাশের ব্যাক্তির মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে তো মুখ দেখাতেই অনিচ্ছুক। নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,

” তোমাকে তুলে নিয়ে আসাতে তুমি তোমার বান্ধবীর চিন্তার কথা বললে। ফ্যামিলির কথা বললে না? তোমার বাবা-মা কোথায় থাকেন?”

তুর্বী খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” যেখানে আছে ভালোই আছে হয়ত।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে ফেলল। তুর্বী কথার মানে বুঝতে না পেরে ও বলল,

” মানে? তুমি জানোনা তারা কোথায়?”

” আমাকে কবে ছাড়ছেন?”

সৌহার্দ্যর কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কথাটা বলল তুর্বী। সৌহার্দ্য অদ্ভুত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তুর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” আমাকে এভাবে জ্বালিয়ে তোমার কী লাভ সেটা বল? ডোন্ট ইউ থিংক এটা ওয়েস্ট অফ টাইম?”

তুর্বী নড়েচড়ে বসে বলল,

” একদমই না। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর কেন দেবেন না। কেমন আর.জে. আপনি হ্যাঁ?”

সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বলল,

” আমি আর.জে. ওপরওয়ালা তো নই যে সব জানবো। হ্যাঁ আমি অনেকের সমস্যার সমাধান করে দেই এটা ঠিক কথা। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে আমি সব জানতা। আমি কোনোদিন সেটা দাবীও করিনি। তাহলে? আর ধর যদি তুমি আমাকে সবার সামনে অপমান করে, বা এটা ওটা বলে সবার সামনে ছোট করেও দিলে। এতে তোমার কী লাভ হবে? তোমার কী সব প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে? বরং তোমার সময়গুলো নষ্ট হবে। ঠিক নয় কী? এভাবে অকারণেই নিজের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার কী বোকামো নয়?”

তুর্বী ‘থ’ মেরে কিছুক্ষণ বসে রইল। সত্যিই তো! এভাবে তো ভেবে দেখে নি কখনও। তারমানে এতদিন এই S.R. এর পেছনে শুধু শুধুই সময় নষ্ট করেছে? একেবারে টোটালি লস হয়ে গেল? দূর! আগে কেন মাথায় এলোনা এসব? নিজের কাজের জন্যে নিজেরই এখন ভীষণরকম আফসোস হচ্ছে তুর্বীর। আর এদিকে সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে যে যাক, ওর কথাগুলো কাজে দিয়েছে হয়ত। কখনও কখনও যাকে শক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। এবার হয়ত মেয়েটাকে পিছু ছাড়াতে পারবে। এই মেয়েটার কাছ থেকে ছাড়া পাবে ভেবেই সৌহার্দ্যর বেশ শান্তি লাগছে।

______________

এদিকে বিহান এটা ওটা বলছে আর ড্রাইভ করছে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কোন রেসপন্স না পেয়ে বিহান পাশে তাকিয়ে দেখল রিখিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। বিহান কিছু বলবে তার আগেই রিখিয়ার মাথা ঢলে পরল ওর ওপর। ও একহাতে রিখিয়াকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে ভাবল য‍ে এখন যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন আর খোঁজার নাটক করার দরকার নেই, বরং একটা জায়গায় গাড়ি নামিয়ে রেস্ট করা যাক। বিহান গাড়িটা একটা ব্রিজের সামনে চায়ের দোকানের পাশে রাখল। দোকানটা এখন বন্ধ। চারপাশটাও অনেকটা নিরব। বিহান নিজের সিটটা একটু এলিয়ে নিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে রিখিয়ার মাথাটা নিজের বুকে রাখল। কয়েক ঘন্টা আগে রিখিয়া ওর বুকে মাথা রাখায় যেই প্রশান্তি পেয়েছিল, সেই শান্তি আবার অনুভব করতে চায় ও। পরম তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল ও। ঘুমের ঘোরে শীতের মধ্যে একটু উষ্ণতা পেয়ে বিহানকে আকড়ে ধরে ওর বুকে গুটিয়ে গেল রিখিয়া। কিছুক্ষণ পর বিহান চোখ খুলে তাকাল। রিখিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কত পবিত্র, কতটা নিষ্পাপ লাগছে এই মুখটা? ঘুমন্ত সুন্দরী! আনমনেই একটু হাসলো বিহান। রিখিয়ার মুখের ওপর পরা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো। নিজের অজান্তেই রিখিয়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়েও থমকে গেল। কী করছিল কী ও? কী হচ্ছে কী ওর সাথে? না এসব অবান্তর অনুভূতি নিজের মনে জায়গা দিতে পারেনা ও। একদম পারেনা। ও তো জানে এসব মেয়েদের ছলনা, সব ছলনা। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিল ও। কিন্তু অজানা কারণেই রিখিয়াকে নিজের বুক থেকে সরালোনা।বিড়বিড় করে বলল, ” না, এভাবে দুর্বল হওয়া আমায় মানায় না। এরা ভালোবাসতে জানেনা। শুধু ছলনা করতে জানে। নিজের স্বার্থের জন্যে অন্যকারো পুরো জীবনটা নষ্ট করে দিতেও এদের বিবেকে বাঁধে না। এই মেয়েও তাই করছে, নিজের মায়ার আমাকে ফাঁসাতে চাইছে। কিন্তু আমি দুর্বল হবোনা, নেভার!” বলে সিটে হেলান দিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল ও। বুকের মধ্যে তীব্র উথালপাতাল হচ্ছে। অদ্ভুতভাবে সেই তান্ডব থামাতে রিখিয়াকেই নিজের বুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বিহান।

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১২
.
তুর্বী ছাদে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ বসে আছে আর মাঝেমাঝে সৌহার্দ্যকে আড়চোখে দেখছে। আর সৌহার্দ্যও একমনে ফোন স্ক্রোল করছে। রাত সাড়ে তিনটা বাজে। ভোর হয়ে যাবে ঘন্টা দুই এর মধ্যেই। তুর্বী গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে যে সত্যিই ও এতদিন ধরে যা করছিল তার কোন মানে আছে কী না। অনেকটা সময় পর সৌহার্দ্য বলল,

” তো কী ঠিক করলে? আমাকে বিরক্ত করবে আর?”

তুর্বী দাঁত দিয়ে নখ করে কাটতে কাটতে বলল,

” একটা কথা ভাবলাম বুঝলেন?”

সৌহার্দ্য একটু হাসলো। ও জানে তুর্বী কী বলবে। তবুও গলা একটু ঝেড়ে বলল,

” কী কথা?”

তুর্বী একটু নড়েচড়ে বসে বলল,

” যেহেতু আপনি একটা ইউসলেস আর.জে। আর আমার প্রবলেম সলভ আপনি করতে পারবেন না। তাই আমি ডিসাইড করেছি যে আপনার পেছনে আমি আর আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। এমনিতেও আপনি কোন কাজের না। ”

সৌহার্দ্য শুধু শুনছে এই মেয়ের কথা। ওকে পুরো ইউসলেস বানিয়ে দিল! তুর্বী সৌহার্দ্যর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,

” কিন্তু তার মানে এটা ভববেন না যে আমি আপনার ভয়ে বা আপনার কথায় এমন করছি। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই করছি। বুঝলেন?”

সৌহার্দ্য এই কথায় ঠিক কী রিয়াকশন দেবে বুঝে উঠতে পারছেনা। মেয়েটা ভাঙবে তবু মচকাবে না টাইপ। তাই চুপ করেই রইল। তুর্বী আবার বলল,

” সো, বুঝতেই পারছেন আমি ঠিক করেই নিয়েছি যে আপনাকে আর জ্বালাবো না।”

হঠাৎ করেই সৌহার্দ্যর ভেতরে কেমন একটা করে উঠল। তুর্বী ওকে আর জ্বালাবে না?
আর মেসেজ করবে না? আর কখনও তুর্বীর এসব উদ্ভট কথাবার্তা শুনতে পাবেনা? ওর চঞ্চলতা দেখতে পাবেনা? কিন্তু ও তো এটাই চাইত। এইজন্যই তো তুর্বীকে এখানে তুলে নিয়ে এসছিল ওকে আর বিরক্ত না করে সেই ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এখন যখন তুর্বী নিজেই বলছে ওকে আর জ্বালাবে না। তখন ওর এত কষ্ট, এত খারাপলাগা তৈরী কেন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে ও? ওর এসব ভাবনার মাঝেই তুর্বী বলল,

” কী ব্যপার? চুপ করে গেলেন কেন?”

” অব্ না মানে তো তুমি আমাকে আর মেসেজ করে, পোস্ট করে বা শো-তে কল করে জ্বালাবেনা তো?”

” উমহুম। কেন জ্বালাবো। যেহেতু কোন লাভই হবেনা।”

কথাটা শুনে সৌহার্দ্য চুপ করে রইল। ওর তো এখন খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ও খুশি হতে পারছেনা একদমই। ওর মন খারাপ হওয়ার কারণ ওর নিজেরই অজানা। যেজন্য এতকিছু করল, জীবনে যেটা করবে বলে ভাবেওনি সেই কিডন্যাপিং ও করল তাও একটা মেয়েকে, সেটাই তো হচ্ছে। তাহলে ওর এরকম লাগার কারণ কী? তুর্বী তুরি বাজিয়ে বলল,

” হ্যালো মিস্টার? বললাম তো আর কিছু করব না। এবার তো ছাড়বেন না কী?”

সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্হির গলায় বলল,

” হুম কিন্তু সকাল হোক। তারপর যেও।”

তুর্বী আয়েশ করে পা দুটো তুলে গুটিয়ে বসে বলব,

” হ্যাঁ সকাল হলেই যাবো। এখন আমার ফোনটা দেওয়া যাবে? রিখু কে একটা ফোন করতাম মেয়েটা কী করছে কে জানে!”

সৌহার্দ্য নিজের পকেট থেকে তুর্বীর ফোনটা বের করে তুর্বীর দিকে দিল। তুর্বী ফোনটা নিয়ে সুইচড অন করে সোজা রিখিয়াকে ফোন করল। কিন্তু ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। তুর্বী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

” ফোন তুলছেনা। এটা কী হল? কী করছে ও?”

সৌহার্দ্য স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

” দেখো হয়ত ঘুমোচ্ছে।”

” আমি বাড়িতে নেই আর ও ঘুমোবে? আর ফোনের আওয়াজে তো ওঠা উচিত?”

” আরে ওও তো একটা মানুষ। হয়ত তোমাকে নিয়ে টেনশন করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছে। ফোন সাইলেন্ট হয়ত। তুমি একটা টেক্সট করে দাও।”

” ইয়া।”

তুর্বী রিখিয়ার ফোনে একটা মেসেজ করে দিয়ে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা হাই তুলল। সৌহার্দ্য চুপচাপ আকাশ দেখছে। তুর্বীর খুব ঘুম পাচ্ছে বেশ অনেক্ষণ যাবতই, কিন্তু সেটা সৌহার্দ্যকে বলে নি। সৌহার্দ্যও বুঝতে পারেনি কারণ ওর চোখ মুখ স্বাভাবিক ছিল। বেশ অনেকটা সময় পর তুর্বী ঢলে পরে যেতে নিলেই সৌহার্দ্য দ্রুত ধরে ফেলল। ব্যাপারটায় হকচকিয়ে গেল ও, বিড়বিড় করে বলল,

” পাগল নাকি এই মেয়ে? এমন কেউ করে? ঘুম পাচ্ছে আমাকে বললে কী হত? এক্ষুনি তো ছাদ থেকে পরত।”

তুর্বীকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রেখে কিছু একটা ভাবল সৌহার্দ্য। কিছুক্ষণ ভেবে তুর্বীর মাথাটা নিজের কোলের ওপর রেখে দিলো। তুর্বী সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। তুর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হেসে ফেলল সৌহার্দ্য। এই ঘুমন্ত দেখলে কে বলবে এই মেয়ে এত ছটফটে, এত চঞ্চল। আচ্ছা? কাল অবধি মেয়েটার ওপর ও বিরক্ত ছিল, খুব বেশিই বিরক্ত ছিল। কিন্তু আজকের এই রাতটাতে কী এমন করল ওই মেয়ে যে কাল থেকে ওর সংস্পর্শে থাকতে পারবেনা বলে ওর এত ফাঁকা লাগছে। এর উত্তর কী আদোও খুঁজে পাবে সৌহার্দ্য।

_______________

চোখে আলো অনুভব করে বিহানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভ্রু কুচকে উঠতে যাবে তখনই নিজের বুকের ওপর ভারী কিছু অনুভব করল। চোখ খুলে তাকিয়ে নিজের বুকের ওপর রিখিয়াকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চমকে গেছিল। পরে আস্তে আস্তে কাল রাতের কথা মনে পরতে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল ও। এই মেয়ে যখন জানবে অন্য একটা ছেলের বুকে এতক্ষণ লেপটে শুয়ে ছিলো তখন লজ্জায় মাথাই তুলতে পারবেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই রিখিয়ারও ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ আস্তে আস্তে খুলে হাত দিয়ে চোখ কচলে নিল। হঠাৎ ওর মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল যে ও কোথায় শুয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মাথা তুলে বিহানকে দেখে চমকে উঠল। একপ্রকার ছিটকে দূরে সরে গেল। অবাক হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ও। সবটা বুঝতে পারলেও বিহানের এত কাছে কীকরে গেল সেটা বুঝতে পারছেনা। হঠাৎ করেই কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি নিজের দিকে তাকিয়ে চেক করে নিল। পোশাক, ওড়না সব ঠিক আছে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। এরপর বিহানের দিকে তাকিয়ে দেখে বিহান হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রিখিয়ার একটা ঢোক গিলল। বিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ভ্রু নাচালো। রিখিয়া ইতস্তত করে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। বিহান বলল,

” রক্ষক হয়ে সারারাত তোমাকে পাহারা দিলাম আমি। সকালে উঠে তুমি আমাকেই ভক্ষক ভাবছ? কেসটা কী হল?”

রিখিয়া একটু লজ্জা পেল। ও সত্যিই ভয় পেয়েছিল নিজেকে বিহানের এতো কাছে দেখে। আজকাল আপন কারো ওপরই বিশ্বাস রাখা যায় না। সেখানে বিহান তো ওর চেনা কেউ না। তাই বিহান ওর ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে পারে সেটা ভাবা অন্যায় কিছু না। রিখিয়া আরো একবার নিজের দিকে তাকাল। বিহান শক্ত স্হির কন্ঠে বলল,

” সব ঠিক আছে দেখে খারাপ লাগছে? একটু এলোমেলো থাকলে কান্নাকাটি আর মেলোড্রামা করে আমায় ফাঁসানো যেত তাইনা?”

রিখিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” মানে?”

বিহানের হুস এল ও কী বলছে। না, এখন এসব বললে তো হবেনা। ও নিজেকে সামলে মুচকি হেসে বলল,

” আরে মজা করছিলাম আমি।”

” ওহ। না ম্ মানে আমি আপনার বুকে..”

বিহান শব্দ করে হেসে বলল,

” এইজন্য মুখের এই দশা? আসলে শেষরাতে ঘুমানোর আগে তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমালাম যাতে তোমাকে কেউ কিডন্যাপ করতে না পারে। বুঝলে?”

বলে বিহান আবার হেসে দিল। রিখিয়া কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে বিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও হেসে দিল। হঠাৎ তুর্বীর কথা মনে পরতেই ও তাড়াতাড়ি ফোন বের করল। দেখল যে তুর্বীর বেশ কয়েকটা মিসড কল, আর ওর ফোন সাইলেন্ট হয়ে আছে। নিউ মেসেজ দেখে সেটা চেক করে দেখল তুর্বী জানিয়েছে ও ঠিক আছে। রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুর ফোন করেছিল। মেসেজে জানিয়েছে ও ঠিক আছে।”

বিহান বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ বাপড়ে একরাতেই মেয়েটাকে সোজা করে দিল? ব্রো তো আমার চেয়েও ফাস্ট!” রিখিয়া বিহানকে হালকা ধাক্কা মেরে বলল,

” আপনি শুনছেন আমি কী বলছি?”

” অব্ হ্যাঁ তুমি কল কর এখন। সকাল হয়ে গেছে তো।”

রিখিয়া মাথা ঝাকিয়ে তাড়াতাড়ি তুর্বীকে ফোন করল।

এদিকে ফোনের আওয়াজে হুস এলো সৌহার্দ্যর। কখন সকাল হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। তুর্বীর ঘুমন্ত মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল ও। কী হয়েছে ওর নিজেই জানেনা। শুধু জানে অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে। ভীষণ অদ্ভুত কিছু। সৌহার্দ্য ফোন তুলে দেখে ‘রিখু’ নামে সেভ করা কারো ফোন। ও বুঝতে পারল এটা রিখিয়া। ও তুর্বীকে ডাকবে তার আগেই তুর্বী ভ্রু কুচকে বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে বলল,

” রিখু ইয়ার এলার্ম টা অফ কর না। কান ফেটে যাচ্ছে।”

বলে উল্টোদিকে ঘুরে সৌহার্দ্যর কোল হাতে জড়িয়ে ধরল। সৌহার্দ্য মুখে আবারও হাসি ফুটল। পাশে রাখা মাস্ক টা আবার মুখে পরে নিয়ে ও এবার আলতো কন্ঠে ডাকল,

” তুর্বী? তুর্বী?”

তুর্বী ঘুম কন্ঠে বলল,

” হুমম।”

সৌহার্দ্য বুঝল এই মেয়েকে এভাবে ডেকে কোন লাভ হবে না। তাই এবার একটু জোরেই ডাকল। তুর্বী হকচকিয়ে উঠে বসে বলল,

” ক-কে? কী? কোথায়? কী হয়েছে?”

” রিখিয়ার ফোন এসছে। ধরো।”

সৌহার্দ্যকে দেখে তুর্বী অবাক কন্ঠে বলল,

” এই কালা মাস্ক আবার কে? এই কে আপনি?”

সৌহার্দ্য তো আকাশ থেকে পরল। এই মেয়ে ঠিক কী পদার্থ দিয়ে তৈরী সেটাই বুঝতে পারছেনা সৌহার্দ্য। তুর্বীর এবার আস্তে আস্তে সবটা মনে পরল। ও ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” ওহ আপনি? সরি ভুলে গেছিলাম।”

সৌহার্দ্য কিছু না বলে তুর্বীর হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। দেখল রিখিয়া কল করেই যাচ্ছে। তুর্বী রিসিভ করে বলল,

” হ্যাঁ বল।”

” বল মানে? কোথায় তুমি? এরকম কেউ করে? জানো কত টেনশনে ছিলাম? হাউ ক্যান ইউ বি সো কেয়ারলেস তুর!”

” আরে ইয়ার আগে শ্বাস নে, লম্বা করে। তারপর আবার কনটিনিউ কর।”

” শাট আপ। কোথায় আছ?”

“আমি তো.. আছি, ঠিক আছি। এসে বলছি। তুই কোথায়?”

” আমিও এসেই বলছি সব। তাড়াতাড়ি এসো।”

এতক্ষণ বিহান হাত ভাজ করে সিটে হেলান দিয়ে দেখছিল রিখিয়াকে। ফোন রেখে রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” থ্যাংকস আমাকে হেল্প করার জন্যে। তুর ঠিক আছে আসছে বাড়িতে। আমি তাহলে আসি হ্যাঁ?”

বিহান মাথা দুলিয়ে বলল,

” নো। আগে এখন ব্রেকফাস্ট করব। আমার সকাল সকাল খাওয়ার অভ্যাস। আর আমার একা খেতে একদমই ভালো লাগেনা। সো আগে ব্রেকফাস্ট করব। এরপর তোমাকে তোমার বাড়িতে ড্রপ করে দেব।”

রিখিয়া ইতস্তত করে বলল,

” কিন্তু…”

” নো মোর কিন্তু, চলো।”

বলে গাড়ি স্টার্ট করল। রিখিয়াও আর কিছুই বলল না। এরপর দুজনেই একসাথে ব্রেকফাস্ট করার পর। বিহান রিখিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘোরালো। রিখিয়ার বাসার সামনে গাড়ি থামতেই রিখিয়া বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কাল রাত থেকে অনেক সাহায্য করেছেন। ধন্যবাদ।”

রিখায়া গাড়ি থেকে নামতে গেলেই বিহান বলল,

” ওয়েট, ওয়েট! শুকনো থ্যাংকস আমি নেব না।”

রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,

” মানে?”

” মানে, গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচালাম। সারারাত তোমাকে পাহারা দিলাম। তোমার বন্ধুকে খুঁজতে সাহায্য করলাম তার বদলে আমি তো কিছু পাই নাকি?”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” কী চাই আপনার?”

” একদিন কফি খাই একসাথে? এটা জাস্ট আমার অফার। বাকিটা তোমার হাতে।”

রিখিয়া কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলল,

” ভেবে দেখব।”

বিহান ঠোঁট কামড়ে হেসে পকেট থেকে ওর কার্ড বের করে দিয়ে বলল,

” এটা আমার কার্ড। যদি মনে হয় যে আমার সাথে কফি খাওয়া যায় তো কল করো।”

রিখিয়া কার্ডটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল। ওর মুখে যে মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে সেটা রিখিয়া নিজেও জানেনা। বিহান রিখিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। ও জানে রিখিয়া ফোন করবে, আর আসবেও। আসতেতো ওকে হবেই।

_________________

তুর্বী বেডে পা ঝুলিয়ে বসে কফি খাচ্ছে। একটু আগেই ব্রেকফাস্ট করেছে। সৌহার্দ্য অফার করার আগেই তুর্বী খাবার চেয়ে নিয়েছে। যাতে সৌহার্দ্য একটুও অবাক হয়নি। এই মেয়েকে দেখে অবাক হতে হতে এখন আর অবাক হতে পারছেনা ও। শুধু দেখে যাচ্ছে। কফি শেষ করে তুর্বী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” তো মিস্টার S.R. যাই এখন?”

সৌহার্দ্য বলল,

” আমার ড্রাইভার দিয়ে আসবে বাড়ি অবধি গাড়ি করে।”

” ওকে চলুন। দেখিয়ে দিন কোন গাড়িতে যাবো, কাদের সাথে যাবো।”

বলে হাটা দিল, সৌহার্দ্যও ওর পেছন পেছন গেল। ড্রাইভারকে বলে দেওয়ার পর তুর্বী গাড়িতে উঠতে নিয়েও থেমে গেল। পেছন ঘুরে বলল,

” চলেই তো যাচ্ছি মুখটা দেখান না?”

সৌহার্দ্য একটু এগিয়ে বলল,

” এর পরের বার যখন দেখা হবে। দেখাব। প্রমিস!”

” হুরর। আর দেখা হলেও কী চিনব? যাই হোক বাই!”

সৌহার্দ্য কিছু বলল না। তুর্বী গাড়িতে ওঠার পর সৌহার্দ্য ড্রাইভারকে বলতেই সে গাড়ি স্টার্ট করল। তুর্বী মাথা বের করে আরেকবার বাই বলল। সৌহার্দ্য এবারও রেসপন্স করল না। গাড়িটা চলে যেতেই ছোট্ট শ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। চলে গেল মেয়েটা! আবার কখনও দেখা হবে? আবার তুর্বীর এই চঞ্চলতা দেখতে পারবে? কী জানি? ভাগ্যে কী আছে কেউ জানেনা। দেখা যাক নিয়তি তার চাকা কোনদিকে ঘোরায়।

#চলবে..