জল-ফড়িঙের খোঁজে পর্ব-২৭+২৮

0
494

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৭
.

তুর্বী আর রিখিয়া একটা রেস্টুরেন্টে চুপচাপ বসে আছে। তুর্বী তখন থেকে পা দুলিয়েই যাচ্ছে। রিখিয়া ওর পায়ে একটা পাড়া দিল। তুর্বী ‘আউচ’ শব্দ করে উঠল। বলল,

” এভাবে পা দোলাচ্ছো কেন? ভদ্র মেয়ের মত চুপচাপ বসা যায় না?”

তুর্বী মুখ একটু ফুলিয়ে বলল,

” তাই বলে এইভাবে পাড়া মারবি?”

” ওরা এখনও আসছেনা কেন?”

” দুই ভাই-ই লেট লতিফ।”

রিখিয়া কপাল কুচকে তাকাল তুর্বীর দিকে। আর তুর্বীতো নিজের ধ্যানে আছে। আসলে আজ ওদের চারজনেরই লাঞ্চ করার কথা একসাথে। ওরা এসে বসে থাকলেও সৌহার্দ্য আর বিহান কেউই আসেনি। এরমধ্যেই রিখিয়ার দেখল বিহান আর সৌহার্দ্য আসছে। রিখিয়া বলল,

” ঐতো এসে গেছে।”

তুর্বী মাথা তুলে তাকাল ওদের দিকে। সৌহার্দ্য আর বিহান এসে ওদের বিপরীতে বসল। তুর্বী বলল,

” এতো লেট করে আসে কেউ? কতক্ষণ যাবত বসে আছি ইয়ার।”

বিহান বলল,

” সরি মিস জ্যামে পরে গেছিলাম।”

সৌহার্দ্য বলল,

” অনেকক্ষণ ওয়েট করছ তাইনা?”

তুর্বী রাগী কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ অনেকক্ষণ?”

রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,

” মিথ্যে কেন বলছ তুর? খুব বেশিক্ষণ হয়নি আমরা এসছি।”

সৌহার্দ্য আর বিহান হেসে দিল ওদের কথায়। বিহানের তুর্বীর চঞ্চলতার কথা শুনতে ভালোই লাগে। এই নিয়ে দুবার দেখেও নিল। এরপর খাবার ওর্ডার করে ওরা একে ওপরের সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগল। যেহেতু বিহান আর রিখিয়ার অনেক স্বভাব আচরণই একরকম। তাই ওদের মধ্যে ভাবটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। ওরা নিজেদের মত কথা বলছে, হাসাহাসি করছে এদিকে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া বোকার মত ওদের তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বিহার আর তুর্বী তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া চুপচাপ বসে আছে। তুর্বী বলল,

” কী হল? তোমরা চুপচাপ বসে আছো কেন?”

সৌহার্দ্য লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” তোদের শেষ?”

রিখিয়ার দৃষ্টিও এখন বোকা বোকা। তুর্বী আর বিহান একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ফিক আওয়াজ করে হেসে দিল। সৌহার্দ্য আর রিখিয়াও হেসে দিল। তুর্বী বলল,

” সৌহার্দ্য, তোমার এই ভাই কিন্তু একদম সলিড। মানে এরসাথে আড্ডা দিয়ে মজা পাওয়া যায়। ওপরদিকে তুমি? এক নম্বরের একটা গোমড়া মুখো। শেখো নিজের ভাইয়ের থেকে কিছু।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বলল,

” এর থেকে?”

রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” না ভাইয়া! আপনি যেমন আছেন একদম পার্ফেক্ট আছেন। এদের মত লেজ ছাড়া বাদর হওয়ার দরকার নেই।”

বিহান আর তুর্বী একসঙ্গে বলে উঠল,

” আমরা লেজ ছাড়া বাদর?”

সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে হাসলো। আর রিখিয়া একটু বিরক্তি নিয়েই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। দুটো এতো চঞ্চল কেন? আবার এটা ভেবেও মনে মনে হাসল যে এইজন্যই তো দুজনই ওর এত প্রিয়।এভাবে কিছুক্ষণ খুনশুটির পর ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেড় হয়ে একটা পার্কে গেলো। ওখানে সৌহার্দ্য-তুর্বী, বিহান-রিখিয়া আলাদা আলাদা হয়ে হাটছে। সৌহার্দ্য আজ তুর্বীকেই দেখছে। একটা সাদা লং শার্ট আর কালো জিন্স, পিঠের মাঝামাঝি ছুই ছুই লেয়ার কাট দেওয়া খোলা চুল যা বাতাসে হালকা উড়ছে। মেয়েটার এটিটিউটের সাথে সাথে রূপেরও প্রেমে পরছে আস্তে আস্তে। এখন ও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে যে তুর্বীকে ছাড়া ওর জীবন অসম্পূর্ণ। এই মেয়েকে ওর জীবনে প্রয়োজন। হঠাৎই হাত তুর্বীর হাত ধরে আটকে নিল সৌহার্দ্য। তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কী?’। সৌহার্দ্য তুর্বীর একটু কাছে গিয়ে ওর কপালের চুল সরাতে সরাতে বলল,

” তোমাকে দেখতে দাও একটু।”

তুর্বী সৌহার্দ্যর চোখে চোখ রাখল। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি গভীর। একটু বেশিই গভীর। তুর্বীরও একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সৌহার্দ্যর ওমন দৃষ্টি গ্রাস করতে চাইছে ওকে। কিন্তু ওর চঞ্চল মন সেই অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

” এভাবে দেখার কী আছে? আর দেখতে পাফেন না?”

ব্যাস সৌহার্দ্যর মুডের বারোটা বেজে গেল। ও তুর্বীর দিকে হতাশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

” কিছুনা চলো।”

যাওয়ার সময় আইসক্রিম খাওয়ার কথা উঠতে বিহান বলল ও নিয়ে আসছে। তখন তুর্বীও যেতে চাইল ওর সাথে। তাই বিহান আর তুর্বী গেল আইসক্রিম আনতে। সৌহার্দ্য আর রিখিয়া বসল বেঞ্চে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,

” তুর্বীর সাথে তোমার ছোটবেলার আলাপ?”

রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” না তো। এই শহরে এসেই আলাপ হয়েছে দুজনের।”

আবারও কিছুক্ষণ চুপ রইল দুজনে। এরপর রিখিয় বলল,

” তুর্বী কিন্তু একটু বেশি চঞ্চল। ওকে জোর করে কিছু করানো যায় না। ও ওর ইচ্ছেতে চলে। তাই ওকে কিন্তু ওর মত করেই সামলাতে হবে। এমনও মুহূর্ত আসতে পারে যে আপনি অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কিন্তু তখন রেগে গেলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে।”

” কথাটা মাথায় থাকবে।”

বলে মুচকি হাসল সৌহার্দ্য। এদিকে আইসক্রিম হাতে নিয়ে সাইড দিয়ে হাটতে হাটতে বিহান বলল,

” তোমাদের দুজনের বন্ধুত্ব আমায় অবাক করে জানো? ওমন শান্ত, স্হির একটা মেয়ের বান্ধবী এমন হয়?”

তুর্বী হেসে বলল,

” তোমার আর সৌহার্দ্যরও তো তাই।”

” তা ঠিক। কিন্তু আমরা ভাই। ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। কিন্তু তোমরা তো তা নও।”

তুর্বী একইভাবে হাসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” রিখিয়াকে ভালোবাসো?”

কথাটা শুনে থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল বিহান। রিখায়াকে ভালোবাসার কথাতো ও স্বপ্নেও ভাবেনি। আর তুর্বীর দ্বারা এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক সেটাও জানে ও। কিন্তু ‘রিখিয়াকে ভালোবাসো?’ বাক্যটা সোজা ওর হৃদপিণ্ডে গিয়ে লাগল। এমন মনে হল যেন ওর হৃদয়, মনও ওকে একই প্রশ্ন করল একইসঙ্গে। কিন্তু তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তরে শুধু লাজুক টাইপ একটা হাসি দিল। যেটা দেখে তুর্বীও হেসে দিল।

____________

দেখতে দেখতে বেশ অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এরমধ্যে রিখিয়া আর বিহানের মধ্যে বন্ডিংটা দৃঢ় হয়ে উঠছে আরও। ওপরদিকে সৌহার্দ্য তুর্বীর প্রতি দিন দিন চরমভাবে দুর্বল হয়ে পরছে। এমন মনে হয় যেন তুর্বীকে ছাড়া ও বাঁচবেই না। তুর্বী ছাড়া সবটাই ওর কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে একটাই তুর্বীর কাছে এখনও এটা একটা এক্সপিরিমেন্টই। কিন্তু সৌহার্দ্য এখন তুর্বীকে চায়, ভালোবেসে চায়, লোক দেখানো এক্সপিরিমেন্টাল সম্পর্ক আর চাইছেনা ও। ও চায় অন্যরা যেভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসে সেভাবেই তুর্বীকে ভালোবাসতে। কিন্তু সেরকম কোন মুহূর্ত এলেই তুর্বী এড়িয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে বোঝা যায় যে এই সম্পর্কটা ওর কাছে কতটা অবহেলার। শুরুতে ধৈর্য্য ধরে সৌহার্দ্য ব্যাপারটা মানিয়ে নিচ্ছিল ঠিকই কিন্তু আর পারছেনা। ওর মনে হত একসময় না একসময় তুর্বী বুঝবে। তুর্বীও ভালোবাসবে ওকে। কিন্তু এতোগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরেও তুর্বীর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অনুভূতির ইঙ্গিতও পায়নি ও। যেটা এখন আর সৌহার্দ্যর সহ্য হচ্ছেনা। সমস্ত ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে ওর নিজেকে।

শুক্রবার তাই আজ ছুটির দিক। তুর্বী কানে হেডফোন গুজে একমনে S.R. এর ‘প্রভাতের আলো’ শো শুনছে। ইদানীং শুনতে ভালোই লাগে ওর। কিন্তু শুরু থেকে সৌহার্দ্যর সাথে S.R. এর কন্ঠের অনেকটা মিল পায় ও। হুবহু মিল পায়নি তাই কো-ইন্সিডেন্স ভেবে পাত্তা দেয় নি।

এদিকে রিখিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল বাড়ি থেকে ফোন এসছে। এমন সময় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে অবাক হল। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর মা কেঁদে দিয়ে বলল যে ওর বাবার শরীরটা ভালো নেই। ওকে যেতে বলছে। ওকে দেখতে চাইছে ওর বাবা। কথাটা শুনে রিখিয়া কী করবে বুঝতে পারছেনা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ও আজকেই
আসছে। ফোন রেখে রুমে এসে কেঁদে দিল ও। ওর পৃথিবীতে বাবা মাই তো আছে। বাবার অসুস্থ আর ও এতো দূরে। রিখিয়ার কান্নার আওয়াজে তুর্বী দ্রুত বেডরুমে এল। এভাবে কাঁদতে দেখে বলল,

” কী হয়েছে রিখু! কাঁদছিস কেন?”

রিখিয়া তুর্বীকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করল। এরপর সবটাই খুলে বলল। সবটা শুনে তুর্বী বলল ওকে বিকেলের ট্রেনে তুলে দেবে। নিজেই সব প্যাকিং করে দিল। আর বারবার তুর্বীকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

___________

রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে বিহান, রিখিয়া, সৌহার্দ্য আর তুর্বী। রিখিয়াকে ট্রেনে তুলে দিতেই এসছে ওরা। রিখিয়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে এল। বিহান রিখিয়ার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল,

” একদম চিন্তা করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। সাবধানে যাও। আর নিজের খেয়াল রেখো।”

রিখিয়া মাথা নাড়ল। তুর্বী এসে জড়িয়ে ধরল রিখিয়াকে। দুজনের চোখেই পানি চিকচিক করছে। রিখিয়াকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার পর। রিখায়া বিহান আর তুর্বীর দিকে তাকাল। কয়েকটা দিন তুর্বীকে দেখতে পাবেনা ভাবলেই কষ্ট হয় ওর, বিহানের জন্যেও কী হচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। তুর্বী ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইল যাওয়ার দিকে। বিহান লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” তোরা আয়। আমি গাড়িতেই আছি।”

বলে চলে গেল। সৌহার্দ্য তুর্বীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

” মন খারাপ করোনা, চলে আসবে ও তাড়াতাড়ি।”

তুর্বী এমনিতে মাথা নেড়ে নিজেকে সামলালেও মন ভালো নেই ওর। রিখিয়া যে ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। কয়েকটা দিন ওকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবলেই কান্না পাচ্ছে ওর। কিন্তু কিছু করার নেই না চাইতেও অনেক সময় আপনজনের থেকে দূরে থাকতে হয়।

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৮
.

সকাল আট’টা বাজে। গ্রামের খোলামেলা পরিবেশের কারণে এতো সকালেও রোদ এসে চারপাশে জ্বলজ্বল করছে। চারটা রুমের, বহু পুরোনো দাগ পরা একতলা একটা দালান ঘরেই থাকে রিখিয়ারা। তবে ছোট বাড়িগুলো সুন্দর। আলো, বাতাসে মুখরীত হয়ে থাকে, খুলে নিশ্বাস নেওয়া যায়। আর বড় বাড়িতে এত শান্তিতে থাকা যায় না। কেমন যেন প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। মনে হয় কোন এক কৃত্রিম জগতের কৃত্রিমতায় প্রকৃতিকে হারিয়ে ফেলেছি।
রিখিয়া গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে আছে ওর বাবা রেজাউল ইসলামের দিকে। বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন উনি। মাঝেমাঝে কাশছেন। শরীর খুব বেশি ভালো নেই তার। কিন্তু আপাতত রিখিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। কারণ কাল ওর আসার খবর পেয়ে আজ সকালেই ওর ভাই রায়হান চলে এসছে। এসছে সেটা বিরক্তির কারণ না। বিরক্তির কারণটা হল রায়হান ওদের ওখানকার এম.পির ছেলে শাফিনের সাথে রিখিয়ার বিয়ের কথা বলতেই এসছে। কিন্তু শাফিনকে মোটেও পছন্দ না রিখিয়ার। এমন না যে ছেলেটা খারাপ। এমনিতে কোন খারাপ ট্রাক রেকর্ড নেই। কিন্তু পাঁচ বছর যাবত রিখিয়ার পেছনে পরে আছে। রিখিয়া এতোবার না করার পরেও শাফিন শোনেনি। ওর একটাই কথা ‘প্রেম করতে না চাইলে করোনা, কিন্তু বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? এমনতো না যে তোমার বিয়ের বয়স হয়নি? বিয়ে যখন করবেই তো আমায় করো।’ কিন্তু রিখিয়াতো বিয়ে করবেনা। ও জানে ওর বিয়ে হয়ে গেলে ওর ভাই বাবা-মার দিকে ফিরেও তাকাবেনা। এখনই তাকায়না। ওনাদের এভাবে একা ফেলে স্বার্থপরের মত বিয়ে করে ফেলতে পারবেনা। যদিও শাফিন রিখিয়ার বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা জানেনা। কিন্তু হঠাৎ ওর ভাইর ওর বিয়ে নিয়ে মাথা কেন ঘামাচ্ছে বুঝতে পারছেনা। রিখিয়া বলল,

” ভাইয়া, আমি আগেও বলেছি যে আমি বিয়ে করব না।”

রায়হান এর একটু রাগ হল। এই মেয়ের এত কথা শুনতে ভালোই লাগেনা ওর। তবে এখন ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটাকে সামলে নিতে হবে। তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

” দেখেছ বাবা? কী বোকার মত কথা বলে? আরে বাবা এতো বড় ঘর থেকে সম্বন্ধ রোজ রোজ আসেনা। আমাদের মত পরিবারে তো নাই। এটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে! এরকম বোকামোর মানে হয়?”

” হ্যাঁ সেই, চালাক তো তুমি। যে কি-না বিয়ের পরপরই আলাদা হয়ে গেলে তো গেলে, একটাবার বাবা-মা বেঁচে আছে না মরে গেছে জানার প্রয়োজন মনে করো না।”

” দেখ বেশি বলছিস তুই এখন। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস বিয়ে না করে বাঁচতে পারবি?”

রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি তোমার বউ বাচ্চা সামলাও। আর আমাকে নিয়ে হঠাৎ এতো ভাবছো কেন বলোতো? নিজের স্বার্থ ছাড়াতো তুমি কিছুই করোনা। এখানে কী স্বার্থ আছে তোমার বলোতো?”

প্রতিটা কথা নিচু গলাতেই বলেছে রিখিয়া কারণ ও বড়দের সাথে উচু গলায় কথা বলতে পারেনা। রায়হান এতক্ষণ রাগটা চেপে রাখলেও এবার আর পারলোনা। একটু চেচিয়ে বলল,

” এতো দেমাগ কীসের রে? তোর কপাল ভালো শাফিনের মত ছেলে তোকে বিয়ে করতে চায়। ভালোয় ভালোয় বলছি রাজি হয়ে যা নইলে কিন্তু মার একটাও মাটিতে পরবে না।”

রেজাউল ইসলাম এবার একটু ধমকের সুরে বললেন,

” রায়হান! খবরদার ওর গায়ে হাত তুলবে না। আমার মেয়েকে আমি তখনই বিয়ে দেব যখন ও চাইবে। কারো জবরদস্তি মানবো না। এতো অভাবের সংসারেও ওকে পড়িয়েছি একদিন এভাবে জোর করে ঘর থেকে বিদায় করার জন্যে না।”

” কিন্তু বাবা..”

” দেখ রায়হান আমি তোমার ইনকামে চলি না। আমার পেনশনের টাকা আর আমার মেয়ের টাকাতেই আমার জীবন চলে। আমার মেয়ের কথা শুনতে আমি বাধ্য হতে পারি, কিন্তু তোমার না। ”

বলে একটু কেশে নিলেন রেজাউল। রিখিয়া উত্তেজিত হয়ে বলল,

” বাবা তোমাকে এতো উত্তেজিত হতে হবেনা। আমি বলছিতো কথা। তুমি বিশ্রাম কর। ভাইয়া প্লিজ, এসব বাদ দাও।”

রায়হান রেগে বেড়িয়ে গেল। রিখিয়ার মা এবার রান্নাঘর থেকে এসে বলল,

” তোমরা কী শুরু করেছ বাপ বেটি মিলে? এতো আবেগ দিয়ে জগত চলে না? মেয়ে ও? বিয়ে না করে জীবন চলবে?”

” তুমিও শুরু করলে? ও মেয়ে আমাদের বোঝা না যে এভাবে বিদায় করব। তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেল নাকি?”

” হ্যাঁ হ্যাঁ মেয়েতো শুধু তোমার আমার না। একে সংসারের এই অবস্থা। দিনকাল কেমন তাতো জানোই। তোমার শরীর ভালো নেই। আমার হাফানি ইদানিং বাড়ছে। আমরা যতদিন আছি ততদিন না হয় চলল। এরপর? মেয়েটার কী হবে ভেবেছ?”

রেজাউল এবার সত্যিই ভাবনায় পরলেন। কথাটা একেবারেই যে ফেলনা তাও না। কিন্তু তবুও মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সে যাবেনা।

রায়হান হনহনে পায়ে হাটছে। রাগ মাথায় চড়ে আছে ওরআসলে ওর এতো আগ্রহ দেখানোর একটাই কারণ, টাকা! শাফিন ওকে বলেছে যে যদি রিখিয়াকে রাজি করাতে পারে তো দশ লাখ টাকা দেবে। আর এই টাকার লোভেই এতোকিছু করছে রায়হান। কিন্তু ওর বোনতো রাজিই হচ্ছেনা। কিন্তু শাফিনের মনে খারাপ কিছু নেই। ও শুধু রিখিয়াকেই চায়। ও খোঁজ নিয়ে জেনেছে রিখিয়ার কারো সাথে প্রেম নেই। হয়তো কোন কষ্ট আছে মনে তাই বিয়ে করতে চায়না। বিয়ের পর ভালোবেসে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে কিন্তু বিয়ে ও করবেই।

____________

তুর্বীর মেজাজ একদমি ভালো নেই। এমনিতেই রিখিয়া ছাড়া ওর কিছুই ভালো লাগেনা। তারওপর ওর স‍ৎ মা নামক মহিলা আজও ফোন করে টাকা চেয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে। এই মহিলা কী ভাবে? ও এটিএম? উনি বুঝতেই চায়না যে ও একটা চাকরী করে, সেখানে নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট বেতনই দেওয়া হয়। তুর্বীও যে ছেড়ে দেয় তা না। মাঝে মাঝে কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু ফেলে দিতে পারেনা। ‘মা’ বলে ডেকেছে তো। যেমনই হোক মা বলে ডাকারতো কেউ আছে। ঐ মহিলা না থাকলেতো ‘মা’ ডাকটাও ওর জীবনে থাকবেনা। মাঝেমাঝে বাবা-মা দুজনের ওপরই রাগ হয় ওর, এভাবে স্বার্থপরের মত একা ফেলে চলে গেল কেন?

সন্ধ্যার পর একটা আর্জেন্ট মিটিং ছিল আজ। মিটিং এর সময় সৌহার্দ্য খেয়াল করেছে তুর্বীর মুড অফ। মায়ের ব্যাপারটা না জানলেও রিখিয়ার ব্যাপারটা তো জানে ও। তাই ও ভেবে রেখেছে অফিস থেকে বেড়িয়ে তুর্বীকে নিয়ে ঘুরে আসবে। মনটা ভালো হবে ওর। যদিও তুর্বীকে নিয়ে সৌহার্দ্য ইদানীং খানিকটা বিরক্ত। এতো ডোন্ট কেয়ার ভাব কার ভালো লাগে? দুদিন আগের কথা,

তুর্বী আর সৌহার্দ্য একটা পার্কের রোড দিয়েই হাটছিল। হঠাৎ করেই একটা মেয়ে এসে সৌহার্দ্যর হাত ধরে বলল,

” সৌ? হোয়াট আ সারপ্রাইজ! এভাবে তোমাকে দেখব ভাবতেই পারিনি।’

সৌহার্দ্যও অবাক হয়ে বলল,

” তুমি? কেমন আছো?”

এরপর দুজনেই সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলল। কথার মাঝে মেয়েটা বলল,

” বিয়ে করোনি যখন। আমার এখনও একটা চান্স আছে বল? কলেজ লাইফে প্রেম করবেনা বললে ঠিক আছে। কিন্তু এখন বিয়ে তো করতেই পারো আমায়।”

এটা শুনে সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে তাকিয়ে দেখল ও ফোন স্ক্রোল করছে। ওদের কথায় না ওর কোন ভাবান্তর আছে আর না কোন আগ্রহ। সৌহার্দ্য কোনমতে মেয়েটাকে বিদায় দিয়ে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” ওর নাম হচ্ছে রিয়া। আমার ক্লাসমেট ছিল।”

তুর্বী ফোন দেখতে দেখতে বলল,

” ওহ।”

“পছন্দ করত আমায়। ইভেন এখনও করে।যদি এখন বলি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই সোজা টেনে কাজী অফিসে নিয়ে যাবে।”

তুর্বী ফোনের দিকে তাকিয়েই হালকা হেসে বলল,

“মজার তো।”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,

” তোমার জেলাস ফিল হয়না? রাগ হয়না?”

তুর্বী একটু অবাক হয়ে ফোন থেকে মুখ তুলে বলে,

” রাগ হতে যাবে কেন? এন্ড হোয়াই শুড আই বি জেলাস? তোমার আমার মধ্যে কোন কমিটমেন্ট নেই। আর আমি কোথায় আর তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি? সো তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে বা ভালোবাসলে আমার জেলাস হওয়ার কোন কারণ আছে কী?”

সৌহার্দ্য হতাশ চোখে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ছোট শ্বাস ফেলে বলল,

‘” নাহ।”

” সেটাই।”

এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী চলে এলো। সৌহার্দ্য দিকে তাকিয়ে বলল,

” কোথায় যাবে বলছিলে চলো?”

” হুম চলো।”

মোটামুটি বেশ রাত হয়ে। মাঝরাত বলা যায়। সেই মাঠটাতে ঘাসের ওপর বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। তুর্বী বিয়ার খাচ্ছে। সৌহার্দ্য বারণ করেছিল। কিন্তু জোর করেই খাচ্ছে তুর্বী। নেশাও হয়ে গেছে। তুর্বী পিটপিট চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে বোতল এগিয়ে ইশারা করে জানতে চাইল ‘খাবে?’ সৌহার্দ্য মাথা নেড়ে না বলল। তুর্বী হেসে বলল,

” তুমিনা খুব ভালো! ভদ্র টাইপ একটা ছেলে। ঐ যে আমি বলিনা হাদারাম। একদমই না। পার্ফেক্ট! তবে তোমার একটাই দোষ। জাস্ট একটা! একটুখানি দোষ। এইযে এতুটুকু।”

দুই আঙ্গুল দিয়ে হাফ ইঞ্চি গ্যাপ দেখিয়ে বলল তুর্বী। সৌহার্দ্য বলল,

” সেটা কী?”

তুর্বী মাতাল কন্ঠে বলল,

” তুমি একটু বেশিই সিরিয়াস। এতোটাও দরকার নেই বুঝলে। মাঝেমাঝে লাইফের মজা নিতে হয়। তবে বাকি সব ভালো।”

” এতো ভালো দিয়ে কী লাভ? তুমিতো ভালোবাসোনা আমায়।”

তুর্বী হেসে দিয়ে বলল,

” ভালোবাসা? হুমহ! ইউ নো হোয়াট। নাথিং ইজ ইটার্নাল ইন দা ওয়ার্লড। ইভেন লাভ। আজ আপনি কাউকে ভালোবাসলেও যে কালও বাসবেন তার কোন মানে নেই। গ্যারান্টিও নেই। সবকিছুই বদলে যায়, মানুষ, স্বভাব, ভালোবাসা। নাথিং ইজ ইটার্নাল, নাথিং। আর ভালোবাসার সঙ্গাতেই বলে যে ভালোবাসতাম বলে নাকি কিছু হয়না। তাহলে মানে কী দাঁড়ালো? ভালোবাসা বলে কিচ্ছু নেই। দেয়ার ইজ নো সাচ থিং এজ লাভ। সবটাই সাময়িক মায়া। কারোটা বেশিদিন থাকে কারোটা কমদিন। এটাই পার্থক্য। সবকিছুই একসময় অতীত হয়ে যায়। আপনারা যেটাকে ভালোবাসা বলেন না, সেটাও।”

বলে সৌহার্দ্য বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। সৌহার্দ্যও তুর্বীকে জড়িয়ে ধরল। তুর্বীর এসব জটিল কথায় অনেক অবাক হল ও। এই চঞ্চল মেয়েটাও নিজের মধ্যে কত কথা চেপে রেখেছে, কত অনুভূতি, কত না পাওয়া, কত আক্ষেপ, ভালোবাসার প্রতি একরাশ অবিশ্বাস। না ওকে বলে দেওয়া উচিত সৌহার্দ্যর মনের কথা। সৌহার্দ্য তুর্বীকে বলতে নেবে তখন খেয়াল করল তুর্বী ঘুমিয়ে পরেছে। সৌহার্দ্যর আর উঠতে ইচ্ছা হলোনা। ওখানেই তুর্বীকে বুকে নিয়ে খোলা মাঠে শুয়ে পরল।

তুর্বী সকালে চোখ খুলে দেখল সৌহার্দ্যর বুকে আছে। সৌহার্দ্য জেগে গেছে। কিন্তু অবাক হলোনা। এই মেয়ের মধ্যে অবাক হওয়ার ক্ষমতা হয়তো কম। তুর্বী উঠে হাই তুলে বলল,

” সরি হ্যাঁ। আসলে ডোসটা বেশি পরে গেছিল তাই ওভাবেই ঘুমিয়ে গেছি।”

সৌহার্দ্য উঠে বসে তুর্বীকে আবারও বুকে টেনে কপালে চুমু দিয়ে বলল,

” আমার জন্যে তো শ্রেষ্ঠ রাত ছিল। কারণ সারারাত তুমি আমার বুকে ছিলে।”

তুর্বী এবার অবাক দৃষ্টিতে তাকাল সৌহার্দ্যর দিকে। হ্যাঁ অবাক হয়েছে। কারণ আজ প্রথম ওর মনে হল সৌহার্দ্য শুধুই টাইমপাস করছে না। হয়ত সৌহার্দ্যর মনে কিছু চলছে। পরক্ষণেই এটাকে নিজের মনের ভুল ভেবে সৌহার্দ্যর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল,

” আমি গাড়িতে আছি, তুমি এসো।”

বলে উঠে চলে গেল। নিজে নিজেই তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিল সৌহার্দ্য। হয়ত বেশি আশা করে ফেলে ও তুর্বীর কাছে, তাই তুর্বী বারবার ওকে নিরাশ করে। তুর্বীরও দোষ দেওয়া যায়না এতে। ও তো বলেই দিয়েছিল আগে যে এটা শুধুই এক্সপিরিমেন্টের জন্যে। ও তো ভেবেছিল আর যাই হোক এইরকম একটা মেয়ের প্রেমে অন্তত পরবে না। আগে যদি জানতো এই শুধুমাত্র এক্সপিরিমেন্টের জন্যে করা সম্পর্কটার মায়ায় ও এভাবে জড়িয়ে যাবে। ওর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী, চিন্তাধারার মেয়েটাকে এভাবে, এতোটা ভালোবেসে ফেলবে। কখনও রাজি হতোনা। কখনও না।

#চলবে…