জল-ফড়িঙের খোঁজে পর্ব-২৯+৩০

0
503

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৯
.

উঠোনের ঠান্ডা বাতাসে একটা চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে বাইরের পরিবেশটা দেখছিল রিখিয়া। তুর্বী আর বিহান দুজনের কথাই খুব মনে পরছে ওর। তুর্বীর সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে। মেয়েটা পুরো বাচ্চাদের মত অভিযোগের সুরে বলছিল, ‘রিখু ইয়ার খুব বেশি মিস করছি তোকে প্লিজ চলে আয় না। দেখ তোকে ছাড়া আমি ব্রেকআপ হওয়া, ছ্যাকা খাওয়া দেবদাসীর মত হয়ে যাচ্ছি।’ তুর্বীর বলা ওসব কথা ভেবেই ফিক করে হেসে দিল রিখিয়া। মেয়েটা আসলেই খুব বেশি চঞ্চল। এই মেয়েটার সাথে হয়ত সারাজীবন থাকতে পারবেনা। কিন্তু যেদিন ছেড়ে আসতে হবে সেদিন কীকরে আসবে? কীকরে থাকবে পাগলী মেয়েটাকে ছেড়ে?
আবার বিহানের কথাও ভাবছে। ইদানিং বিহানকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। বিহানের থেকে দূরে থেকে টানটা আরও বেশি অনুভব করছে। এটাই কী তবে ভালোবাসা? ভালোবাসে বিহানকে। ‘ভালোবাসেনা’ এই কথাটাও তো জোর দিয়ে বলতে পারছেনা। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে নিজের মনেই মুচকি হাসল রিখিয়া। হয়তো বিহানের মনেও ওর জন্যে কিছু আছে। অবশ্যই আছে, না থাকলে এতো সময় দেওয়া, মাঝেমাঝে ওভাবে কথা বলা, এতো কেয়ার করা, এসব নিশ্চয়ই করত না। নিজের মনে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখে বিহানের ফোন এলো। রিখিয়া স্ক্রিনে নামটা দেখেই দ্রুত রিসিভ করে বলল,

” হ্যালো।”

” ভালো আছো?”

” হ্যাঁ।”

” আঙ্কেল কেমন আছে এখন?”

” আগের চেয়ে অনেকটাই বেটার।”

এরপর দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে বিহান বলল,

” কবে আসবে?”

” দুদিন পর।”

” মিস করছি তোমাকে।”

রিখিয়ার খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে যে ‘আমিও আপনাকে মিস করছি’ কিন্তু বলতে পারল না। কিছুক্ষণ দুজনে টুকিটাকি কথা বলার পর ফোন রেখে দিল ওরা।

ফোন বিহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের অন্ধকারের দিকে। মন ভালো নেই ওর। একদমই ভালো নেই। সবকিছুই অসহ্য লাগছে। সেটা কেনো তার কারণ ওর জানা নেই ওর। রিখিয়া কে মিস করছে? না, সেরকম হওয়ার তো কোন কারণ নেই। রিখিয়ার প্রতি তো ওর মনে কোন অনুভূতিই নেই। সবটাই তো নাটক ছিল। হ্যাঁ বন্ধুত্ব করা, এতো ফ্রেন্ডলি মেলামেশা, এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা সবটাই একটা ড্রামা ছিলো। সেদিন রিখিয়া মিডিয়া, এতো নামিদামী বিজনেস ম্যানের সামনে ওকে চড় মেরেছিল, কিছু না জেনেই মিথ্যে অপবাদ দিয়েছিল, সারারাত লকাপে ছিল, ওর বাবা-মার ওর প্রতি আরও বেশি খারাপ ধারণা জন্মালো। যেখানে ওর কোন দোষই ছিলোনা। মেয়েদের প্রতি এমনিতেই ওর রাগ ছিল। তারওপর রিখিয়ার এই কাজে ওর রাগ বেড়ে গেছিল। ওর মনে হয়েছিল রিখিয়া সেইরকমই জঘন্য কোয়ালিটির মেয়ে, যারা সিমপ্যাথি, এটেনশন আর টাকার জন্যে একটা মানুষের জীবন নষ্ট করতেও দুবার ভাবে না। তাইতো রিখিয়াকে শিক্ষা দেবে ভেবেছিল। প্রথমে রিখিয়াকে ওর প্রতি প্রচন্ডভাবে দুর্বল করে দেবে। এরপর মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে যাতে, রিখিয়া চরম কষ্ট পায়। যাতে এটা বুঝতে পারে যে মন নিয়ে খেলা করা আসলে কী হয়। প্রচন্ড রেগে ছিল রিখিয়ার ওপর। তাইতো প্লান করে রিখিয়ার মনে নিজের জায়গা তৈরীর চেষ্টায়। কিন্তু যতদিন গেল রাগটা আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করল। রাগ কখনই চিরস্থায়ী হয়না। এখন আর প্রতিশোধের সেই তীব্র ইচ্ছা জাগছেনা মনে। এটাকী রাগ পরে গেছে সেইজন্য না-কি রিখিয়ার সাথে মিশে বুঝতে পেরেছে ও সেরকম না সেইজন্য সেটা বুঝে উঠতে পারছেনা। কিন্তু এটাও ঠিক যে রিখিয়ার প্রতি ওর মনে কোন অনুভূতির খোঁজ ওর মতে ও পায়নি। এখন কী করা উচিৎ ওর? সব সত্যিটা বলে দিয়ে রিখিয়ার থেকে সরে আসাটাই ভালো হয়ত। কিন্তু কীকরে বলবে?

___________

দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল। তুর্বী ড্রয়িং সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে সেন্টি মার্কা চেহারা করে চিপস খাচ্ছিল আর রিখিয়ার কথা ভাবছিল। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ পেয়েই চমীএ উঠল তুর্বী। খুশি হয়ে চিপসের প্যাকেট ফেলে দিয়ে দৌড় দিল। দরজাটা খুলে সামনে রিখিয়াকে দেখেই জাপটে ধরল। রিখিয়া হেসে জড়িয়ে ধরল তুর্বীকে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে বলল,

“ইয়ার এতদিন থাকে কেউ? দম বন্ধ হয়ে আমি মরেই যেতাম। উফফ।”

রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” হয়েছে এবার একটু শ্বাস নাও। আর আমাকে ভেতরে যেতে দাও।”

তুর্বী সরে দাঁড়ালো। রিখিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে সোফায় বসে বলল,

” একয়েকদিনেই এই হাল হয়েছে? যদি পার্মানেন্টলি চলে যাই? তখন কী করবে?”

তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,

” দেখ রিখু একদম ফালতু বকবিনা।”

রিখিয়া হেসে দিল। দুজনেই বেশ অনেক্ষণ আড্ডা দিচ্ছে প্রায় এক সপ্তাহ পর দেখা হল তাই।

___________

সময় নিজের গতিতে চলছে। কয়েকটা দিনও কেটে গেছে। এরমধ্যে ওরা চারজন প্রায়ই দেখা করেছে গল্প-অাড্ডা করেছে। ঐদিনের পর থেকে এরমধ্যে তুর্বী কয়েকবারই খেয়াল করেছে যে সৌহার্দ্যর মনে ওর প্রতি কিছু আছে। ও সিরিয়াস না হলেও সৌহার্দ্য ভীষণ সিরিয়াস। প্রথমে মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিলেও এখন আর সেটা ভাবতে পারছেনা ও। যদি সেরকম হয় তাহলেতো মুসকিল। কারণ ও তো সৌহার্দ্যকে ভালো বাসেনা। আর নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেনা ও। আর যত দিন যাচ্ছে সৌহার্দ্য তুর্বীর জন্যে ততই পাগল হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। না পারছে বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।
ওপরদিকে বিহান ভাবছে কীকরে রিখিয়াকে সত্যিটা বলবে। কোন অঘটন ঘটার আগেই সব বলে দেওয়া উচিত। আর রিখিয়া এতোদিনে মোটামুটি শিওর হয়ে গেছে যে ও বিহানকেই ভালোবাসে। কিন্তু কাউকে বলেনি এখনো।

আজ বিহানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ওরা রিখিয়া, বিহান, সৌহার্দ্য, তুর্বী চারজন মিলে রেস্টুরেন্টে এসছে। বিহান ট্রিট দেবে আজ ওদের। বিহানের তেমন বিশেষ কোন বন্ধু নেই তাই ওদের নিয়েই এসছে। ওখানেই সৌহার্দ্য একটা ছোট কেকের আয়োজন করেছে। খাওয়াদাওয়া করতে করতে চারজনই জমিয়ে আড্ডা দিল। দুজনেই গিফ্ট দিয়েছে কিন্তু রিখিয়া আলাদা করে একটা গোলাপের বুকেও দিয়েছে। খাওয়া শেষে সামনের মাঠেই জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হাটছিল ওরা। বিহান হাটতে হাটতে বলল,

” তোমাদের বাড়ির অবস্থা কী? সুস্থ আছেন তো আঙ্কেল এখন?”

” হ্যাঁ এখন ঠিকই আছে। একটু চিন্তায় থাকে আমাকে নিয়ে এই আরকি।”

” ওনাদের চিন্তা মুক্ত করতে একটা বিয়ে করে নিলেই পারো।”

রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” আমি বিয়ে করে নিলে আমার বাবা-মাকে দেখার কেউ থাকবেনা।”

বিহান একটু অবাক হয়ে বলল,

” মানে? তোমার ভাইয়া আছে না?”

” ভাইয়া এখনই ঘুরে তাকায়না। আবার আমার বিয়ের পর। সংসারে আমি টাকা দিলে সংসারটাই চলবে না। কিন্তু আমি চলে গেলে যেটুকু পরে আছে সেটুকুও ভাইয়া শুষে খাবে। আর যাই হোক স্বার্থপরের মত ওনাদের ফেলে যেতে পারবনা।”

বিহান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এই মেয়েটাকে কষ্ট দেবে বলে এতো কিছু করছিল ও? নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন ওর। রাগের মাথায় সেদিনের নেওয়া সিদ্ধান্তটা একদমই ঠিক হয়নি। ভূল ভেবেছিল ও। রিখিয়া সেরকম মেয়ে নয় যেরকম ও ভেবেছিল। এরকম একটা মেয়েকে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবলোই বা কীকরে? তাও এতো নিখুঁত প্লান করে এভাবে আঘাত করতে চেয়েছে? ছিঃ।

এদিকে হাটতে হাটতে রাস্তায় চলে এসছে সৌহার্দ্য তুর্বী। দুজনে টুকটাক কথা বলতে আর হাটছে। হঠাৎ করেই তুর্বী দেখতে পেল হাওয়াই মিঠাই হাতে নিয়ে একটা বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছে একটা গাড়ি সেদিকেই আসছে। দেখেই তুর্বীর কলিজা শুকিয়ে গেলো। দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে একটানে সরিয়ে দিলেও নিজে সরতে পারলনা ভাগ্যিস গাড়িটা ব্রেক করেছে তাই তুর্বী বেঁচে গেছে। কিন্তু গাড়িটার সাথে হালকা ধাক্কা লেগে পরে গেছে তুর্বী যার ফলে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে গেছিল এই ঘটনায়। হুস আসতেই দৌড়ে গেল তুর্বীর কাছে। গিয়ে ওর গালে হাত গালে হাত রেখে হাপানো বলল,

” তুমি ঠিক আছো।”

তুর্বী ঠিক আছে বলার আগেই সৌহার্দ্য ওকে পাগলের মত পুরোটা চেক করতে লাগল আর বিড়বিড় করে বলছে ‘কোথায় লেগেছে দেখি’। তুর্বী অবাক হয়ে দেখছে সৌহার্দ্যকে। ও একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়াতেই সৌহার্দ্য জড়িয়ে ধরল ওকে। কিছুক্ষণ জড়িয়ে রেখে ওকে ছেড়ে দুই বাহু ঝাকিয়ে বলল,

” সবসময় এমন কর কেন তুমি? নিজেকে সুপার ওমেন ভাবো? যা খুশি করতে পারো তুমি? জানো কত ঘাবড়ে গেছিলাম। আরেকটু হলে মরে যেতাম। আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তাহলে আমার কী হত হ্যাঁ? বল আমার কী হত?”

তুর্বী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। এখন ও শিওর হয়েই গেছে যে সৌহার্দ্য ওকে ভালোবাসে। আর সেটা বুঝতে পেরে ওর সব থেমে গেছে। এরকমটা আশা করেনি ও। ও তো সৌহার্দ্যকে ভালোবাসেনা। ও সৌহার্দ্যকে সেটা দিতে পারবেনা যেটা সৌহার্দ্য ওর কাছ থেকে চায়।

_____________

রাতে তুর্বী আর রিখিয়া পাশাপাশি শুয়ে আছে। দুজনের চোখেই ঘুম নেই। তুর্বী ভাবছে যে ও চিন্তাও করেনি সৌহার্দ্য ওকে ভালোবেসে ফেলবে। ও তো এইজন্যই আগে থেকে বলে দিয়েছিল এই সম্পর্কে কোন কমিটমেন্ট থাকবেনা। কিন্তু ও তো ভালোবেসে ফেলল। না, সৌহার্দ্য অনেক ভালো একটা ছেলে। ও অনেক ভালো কাউকে ডিসার্ব করে, আরও ভালোবাসা ডিসার্ব করে। তুর্বীতো ওকে ভালো বাসিনা, ভবিষ্যতেও বাসতে পারবে কি-না জানেনা। তাই সৌহার্দ্যকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবেনা। ওই সম্পর্কে থাকলে, কাছাকাছি থাকলে সৌহার্দ্যর টান আরও বারবে। তাই কালকেই ও গিয়ে এই সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ে আসবে। দূরে থাকলে সৌহার্দ্য এমনিই সব ভুলে যাবে। হ্যাঁ ও এটাই করবে। এটাই করা উচিত। একটা ছেলের ইমোশন নিয়ে এভাবে খেলার অধিকার নেই ওর। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুর্বী। রিখিয়া বলল,

” কী ভাবো?”

” কিছুনা।”

” আমি ঠিক করে নিয়েছি জানো।”

” কী?”

” আমি কালকেই বিহানকে বলে দেব যে আমি ওকে ‘ভালোবাসি’।”

তুর্বী রিখিয়ার দিকে ঘুরে শুয়ে বলল,

” ওয়াও! ফাইনালি। কিন্তু ও রাজি হবে?”

রিখিয়া লাজুক হেসে বলল,

” আমার মন বলছে হবে। এতোগুলো দিন ওর ব্যবহারগুলোতেই বোঝা গেছে ও আমায় চায়।”

” তাহলে আর কী বলে দে।”

” হুম। না বলে পারবনা। এসব বাদর টাইপ ছেলে কোনকালেই ভালো লাগতোনা আমার। কিন্তু দেখ ঐ বাদরটাকে না চাইতেও ভালোবেসে ফেললাম। একটু বেশিই ভালোবেসে ফেললাম।”

তুর্বী হেসে জড়িয়ে ধরল রিখিয়াকে। কিন্তু মন ঠিক নেই তুর্বীর। ওর সিক্স সেন্স বলছে কাল কিছু একটা হতে চলেছে। বেশ বড়সর কিছু। কিন্তু কী সেটা বুঝতে পারছেনা। যেহেতু নিজেই ক্লিয়ার না কিছু তাই রিখিয়াকেও কিছুই বলল না।

এদিকে সৌহার্দ্য আর বিহান ছাদে খোলা হাওয়ায় বসে আছে। বিহান রং সিলেক্ট করছে। আর সৌহার্দ্য ল্যাপটপ খুলে সামনে রেখে কাজ ভাবছে কিছু। বিহান রং দেখতে দেখতেই বলল,

” কী এতো ভাবছিস? কিছু ডিসকভার করে ফেলবি না-কি?”

সৌহার্দ্য ভাবুক কন্ঠে বলল,

” কাল তুর্বীকে বলে দেব আই ওয়ান্ট টু ম্যারি হার।”

বিহান অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল,

” তোর মনে হয় ও মানবে? যা বিচ্ছু মেয়ে।”

” কেন মানবেনা? ও প্রেমটাকে সিরিয়াসলি নেয়না মানলাম। বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? চির কুমারী থাকবেনা নিশ্চয়ই? পাত্র হিসেবে আমি কী খুব খারাপ না-কি?”

” সেটা না। দেখ রাজি হয় কি-না। বেস্ট অফ লাক।”

সৌহার্দ্য লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” ওকে ছাড়া আমি একদম অচল রে। কখনও ভাবিনি ওরকম একটা মেয়েকে এতো ভালো বাসব। কিন্তু বেসে ফেললাম। ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি। একদম না।”

বিহান একটু হাসল কিছু বলল না। ও ভাবছে কাল ওকেও এক কাজ করতে হবে। রিখিয়াকে সব সত্যিটা বলে দিয়ে ওর কাছ থেকে সরে আসতে হবে। রাগের বসে ভুল পথ বেছে নিয়েছিল ও। কিন্তু সত্যিতো এটাই ওর মনে রিখিয়ার জন্যে কোন অনুভূতি নেই। থাকলে নিশ্চয়ই ফিল করত, কই ফিলতো করছেনা। তাই মেয়েটাকে শুধু কষ্ট দেওয়া বোকামি হবে এখনও তো দেরী হয়ে যায়নি। রিখিয়া নিশ্চয়ই এখনও এতটাও দুর্বল হয়নি বা ভালোবেসে ফেলেনি। ফেললে তো ওকে বলত বা ও বুঝতে পারত। তাই সেরকম কিছু হয়ে যাওয়ার আগেই কাল রিখিয়াকে বলে দিয়ে এইসব কিছু এখানেই শেষ করে দিয়ে আসতে হবে। না হলে পরে আরও মায়ার জড়িয়ে গেলে মেয়েটা বেশি কষ্ট পাবে। তাই এখানেই সবকিছুর ইতি টেনে দেওয়া ভালো।

মানুষ অনেক বিচিত্র একটা প্রাণী। আর মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্র যে দুইটি জিনিস আছে সেটা হলো রাগ আর আবেগ। আর এই দুটোর বশবর্তী হয়ে মানুষ যে সিদ্ধান্ত নেয় বা যা করে বেশিরভাগই ক্ষতিকর এবং ভুল হয়। যেমন ওরা চারজন করেছে। ছোট বাচ্চারা খুঁজে পাবে কি-না সেই অনিশ্চয়তা নিয়েও যেমন জলফড়িং খুঁজতে বেড় হয়। আর খুঁজে পেলেও জলফড়িংকে ধরতে পারবে কি-না সেই অনিশ্চয়তায় থেকে চেষ্টা করতে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিফল হয় ভাগ্য সহায় হলে মাঝেমাঝে সফল হয়। ঠিক তেমনই ওদের চারজনের বেছে নেওয়া পথটাই ছিল অনিশ্চয়তার পথ। ঠিক জলফড়িং খোঁজার মত।আর এই একটা ভুল চারজনের জীবনকে কোথায় নিয়ে দ্বার করায় সেটাই এবার দেখার।

#চলবে…

#জল-ফড়িঙের খোঁজে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩০
.

পার্কের নিরব পরিবেশের একটা বেঞ্চে রিখিয়া আর বিহান দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। সবসময় এই পার্কে বসেই সময় কাটাতো ওরা। দুজনেই চুপ করে আছে, দুজনেই দুজনকে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কী দিয়ে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা। রিখিয়াতো মনে মনে লজ্জায় মরে যাচ্ছে একপ্রকার। কীকরে বলবে বিহানকে ভালোবাসার কথা? বিহান কতটা অবাক হবে? খুশি হবে? কতটা খুশি হবে? আর অন্যদিকে বিহান অপরাধবোধে ভুগছে। ও যা করেছে ভয়ংকর অন্যায় করেছে। এখন সত্যিটা কীকরে বলবে রিখিয়াকে? মেয়েটা এমনিতেই নরম মনের, সাদামাটা। মানতে পারবেতো এই সত্যি? তবে এখনও যে ও বিহানকে ভালোবেসে ফেলেনি এটাই স্বস্তির। বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কিছু বলবে বলছিলে?”

বিহানের কথায় নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো রিখিয়া। তারপর অনেকটা ইতস্তত করে বলল,

” আপনি আগে বলুন।”

বিহান চুপ আবার হয়ে গেল, রিখিয়াও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার বিহান বলল,

” রিখিয়া! আমি তোমাকে এখন কিছু কথা বলব। জানিনা এগুলো শোনার পর তোমার কী রিঅ্যাকশন হবে বা তুমি আমার কী মনে করবে। হয়ত আমাকে খুব বাজে ছেলে ভাববে, ঘৃণাও করবে। কিন্তু এখনও যদি তোমাকে সব সত্যিটা না বলে দেই তাহলে অনেক দেরী হয়ে যাবে।”

রিখিয়া প্রথমে অবাক হলেও পরে ভাবল বিহান হয়ত ওকে প্রপোজ করবে। তাই এসব বলছে। বিহানও ওকে ভালোবেসে ফেলেছে? ভাবতেই কেমন খুশি আর লজ্জা দুটোই লাগছে ওর। তবে ভালোই হবে যদি বিহান আগে বলে দেয়। তাই মাথা নিচু করে কাঁপা কন্ঠে বলল,

” বলুন না।”

বিহান কয়েকসেকেন্ড আবার চুপ থেকে বলল,

” তোমার ঐদিনের কথা মনে আছে যেদিন তুমি আমাকে সবার সামনে চড় মেরেছিলে, অপমান করেছিলে? লকাপে পাঠিয়েছিলে?”

রিখিয়ার সেদিনের কথা মনে পরতেই অনেকটা মন খারাপ হল। লজ্জিত কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ। আসলে আমি না বুঝেই রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছিলাম। শুধু শুধুই সাফার করতে হয়েছে আপনাকে। আ’ম সরি ফর দ্যাট। কিন্তু আজ আপনি এসব কেন বলছেন?”

” কারণ আছে। রিখিয়া সেদিনের আগে তোমার সাথে দুষ্টুমি করলেও সেদিনের পর তোমার ওপর আমার ভীষণ রাগ জন্মায়। এমনিতেই আমি মেয়েদের সহ্য করতে পারতাম না। সব মেয়েকে স্বার্থপর, লোভী, ছলনাময়ী মনে হতো। সেই ঘটনার পর আমার ধারণা দৃঢ় হয়ে গেল। তোমার প্রতি তীব্র রাগ আর ঘৃণা ছিল। তুমি যখন আমায় বলেছিলে ‘আমি মেয়েদের মন নিয়ে খেলি’। সেই কথাটাই কানে বাজছিল। এতোই রাগ হচ্ছিলো যে মনে প্রতিশোধের নেশা জেগে ওঠে। মনে হচ্ছিল তোমাকে শিক্ষা দেওয়াটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।”

রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। বিহান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ আর সেদিন থেকেই রাগের বসে আমি এই জঘন্য কাজ করা শুরু করি। বারবার তোমার সাথে দেখা হওয়া, তোমাকে হেল্প করা, তোমার সাথে ফ্রাঙ্ক হওয়া সবটা কাকতলীয় ছিলো না। দেখা হয়েছিল কারণ আমি চেয়েছি। তবে হ্যাঁ ঐ আশ্রমের বাচ্চাগুলোর সাথে যেই দুবার তুমি আমাকে দেখেছ সেটা আমার প্লানে ছিলোনা। ওটা কাকতলীয় ছিল। কিন্তু বাকী সবটাই আমার সাজানো ছিল। তোমার সাথে ইচ্ছে করেই এতো ফ্রেন্ডলী মিশেছি আমি। হ্যাঁ আমি কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ডদের সাথে মেলামেশা অফ করিনি। শুধু তোমাকে জানতে দেইনি। প্রতিনিয়ত তোমার কাছে গেছি তোমাকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্যে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে।”

রিখিয়া জলভর্তি চোখে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। ওর সব আওয়াজ যেন গলাতেই আটকে আছে। বিহান আবারও কয়েকসেকেন্ড নিরব থেকে বলল,

” আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল তোমাকে আমার প্রতি দুর্বল করে দেওয়া। এতোটাই দুর্বল করে দেওয়া যখন আমি তোমাকে ছেড়ে দেব তখন যাতে তুমি প্রচন্ড কষ্ট পাও। তোমাকে প্রচন্ডরকম কষ্ট দেওয়াটাই আমার উদ্দেশ্য ছিল ”

রিখিয়া ধরা গলায় বলল,

” তা সফল হয়েছে আপনার উদ্দেশ্য?”

বিহান রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল। চোখ লাল হয়ে আছে মেয়েটার। নিচের ঠোঁটটা কাঁপছে। মেয়েটা কী খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে? বিহান কাঁপা গলায় বলল,

” না। যত সময় যেতে লাগল এমনিতেই আমার রাগটা আস্তে আস্তে কমে এলো। আর রাগটা কমে আসতেই প্রতিশোধের ইচ্ছেটাও কমতে লাগল। আর তখন বুঝতে পারলাম তুমি সেরকম মেয়ে নও যেরকমটা আমি ভেবেছিলাম। কাল সেটা আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। যদিও অনেকটাই সময় চলে গেছে তবুও আমার মনে হল খুব বেশি দেরী হওয়ার আগে আমার তোমাকে সব সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত। কারণ আমাকে ভালোবেসে ফেললে তুমি আরও বেশি কষ্ট পেতে। এমনিতেই অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আর দিতে চাইনি। কারণ আমিতো তোমাকে ভালোবাসিনা। ভালোবাসা তো দূর সেরকম কোন অনুভূতিও নেই। তাই তোমার মনে ভালোবাসা জন্মানোর আগেই সবটা বলে দিলাম।”

রিখিয়া লম্বা শ্বাস নিল। চোখের জল আটকে রাখা যে কত কষ্টের সেটা আজ বুঝতে পারছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে কন্ঠস্বর শক্ত করে বলল,

” আপনার বলা শেষ?”

বিহান করুণ গলায় বলল,

” রিখিয়া প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও। আমি জানি আমি যেটা করেছি সেটা অন্যায়, জঘন্য অপরাধ। কিন্তু রাগের মাথায় করে ফেলেছি। তুমি আমাকে যা শাস্তি দিতে চাও দিতে পারো। আমি সবটা মাথা পেতে নেব।”

রিখিয়া কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। তারপর বলল,

” আপনাকে কোন শাস্তি দেওয়ার অধিকার আমার নেই। খোলা মাঠে বিছিয়ে রাখা শস্য যদি কাকে খেয়ে ফেলে দোষটা কাকের না চাষীর। বোকা আমি ছিলাম। আর আপনি আমার বোকামির সুযোগ নিয়েছেন। তাই দোষটা আপনার না আমার ছিল।”

” রিখিয়া আমি..”

” আমি আসছি।”

বলে রিখিয়া উঠে উল্টো ঘুরে হাটা দিল। বিহান আটকালো না। সেই অধিকার নেই ওর। মাথা দুহাতে চেপে ধরে বসে আছে। আজ প্রথম ও ওর কোন কাজে অনুতপ্ত, ভীষণ অনুতপ্ত। কেন যেন ভেতর থেকে কান্না আসতে চাইছে ওর। কিন্তু চোখে জল আসছে না। বুকে চাপ দিচ্ছে এক অসহ্য ব্যাথা।
রিখিয়ার দ্রুতপদে হাটছে। ওর শ্বাস আটকে আসছে। বুকে ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ। এতোক্ষণ আটকে রাখা চোখের জল এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। একপ্রকার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিখিয়া। সিএনজি তে উঠে মুখে হাত দিয়ে চেপে একপ্রকার আওয়াজ করেই কাঁদছে। ড্রাইভার বারবার তাকাচ্ছে ওর দিকে। রিখিয়ার খেয়াল নেই সেদিকে। সারারাস্তা কেঁদেই পার করেছে। আজ ওর মন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। প্রথম কোন ছেলেকে ভালোবেসেছিল ও। আর সেই ওকে ঠকালো। ওর স্বপ্ন ছিল জীবনে একজনকেই ভালোবাসবে আর তাকেই সারাজীবন ভালোবেসে যাবে। কিন্তু ওর সব শেষ হয়ে গেল! সব। এতো কষ্ট এর আগে কোনদিন হয়নি। এরচেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল হয়ত।

____________

সৌহার্দ্যর কেবিনে বসে তুর্বী আর সৌহার্দ্য কাজ করছে কিন্তু দুজনেই অস্হির হয়ে আছে। দুজনেই দুজনকে কিছু বলার জন্যে ছটফট করছে কিন্তু কাজে মন দিতে পারছেনা কেউই। সৌহার্দ্য বারবার আড়চোখে তুর্বীকে দেখছে, তুর্বীও তাই করছে। মাঝেমাঝে চোখাচোখিও হয়ে যাচ্ছে। তখন আবার কাজে মন দিচ্ছে। এভাবে সকাল থেকে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। হাফ টাইম অফিস করে ওরা একটা কফিশপে ঢুকলো। দুজনেই চুপচাপ বসে কফি খাচ্ছে। তুর্বী ভাবল যে না এরকম করলে বলাই হবেনা। তাই নিজেকে শক্ত করে বলল,

” সৌহার্দ্য আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”

সৌহার্দ্য চোখ তুলে তাকাল। ও জানে তুর্বী সারাদিনই উদ্ভট কিছু না কিছু বলতেই থাকে। তাই হাসি মুখে বলে,

” আজ আবার নিশ্চয়ই উদ্ভট কিছু বলে মাথা খাবে? তার আগে আমার কথা শোন। আমি সিরিয়িসলি তোমাখে বলতে চাই।”

” হ্যাঁ বলো।”

সৌহার্দ্য একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুর আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই। আমি চাই আমাদের সম্পর্কের একটা নাম হোক। তাও বৈধ। সো উইল ইউ ম্যারি মি?”

তুর্বী চরম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর দিকে। তারপর আবাক হয়েই বলল,

” হোয়াট?”

” হ্যাঁ তুর। বিয়ে করবে আমায়?”

তুর্বী কিছুক্ষণ অনেকটা শকের মধ্যে থেকে এরপর গম্ভীর মুখে সৌহার্দ্যকে বলল,

” সৌহার্দ্য আমাদের রিলেশনটায় কোন কমিটমেন্ট ছিলোনা, আর না আমরা সিরিয়াস ছিলাম। পুরোটাই একটা এক্সপিরিয়েন্সের জন্যে। আর সেইরকম কথাই আমাদের মধ্যে হয়েছিল। রাইট?”

সৌহার্দ্য একটু টেনস হলেও বলল,

” আই নো। বাট আমিতো রিলেশনের কথা বলছিনা। বিয়ের কথা বলছি। প্রেমটা নাই করলে। কিন্তু বিয়েতো তুমি করবে তাইনা। কাউকে না কাউকে সেটা আমি হতে সমস্যা কোথায়? এমন তো না তোমার বিয়ের বয়স হয়নি বা তুমি চিরকুমারী থাকবে।”

” পাগল হয়ে গেছো তুমি?”

” এখানে পাগল হওয়ার কী আছে? আমি ছেলে হিসেবে খারাপ?”

” সৌহার্দ্য প্রশ্নটা তুমি ভালো নাকি খারাপ সেটা নয়। প্রশ্নটা হল আমি কেমন? আমি বিয়ের জন্যে রেডি কি-না। যেখানে আমি রিলেশনে কমিটমেন্টের জন্যে তৈরী না। সেখানে বিয়ে কীকরে? বিয়ে মানেই তো দুটো মানুষের সারাজীবন একসাথের থাকার কমিটমেন্ট। এন্ড আ’ম নট রেডি ফর দিস।”

তুর্বীর এসব কথা শুনে সৌহার্দ্যর মনে ধাক্কা লাগল। ও এই ভয়টাই পাচ্ছিল। তবে তুর্বী এতোকিছুর পরেও এভাবে না করে দেবে সেটা ভাবতে পারেনি। পাগল পাগল লাগছে ওর নিজেকে। ও ডেসপারেট হয়ে বলল,

” আচ্ছা ঠিকাছে। তোমার যদি বিয়ের পর কোনদিন মনে হয় আমার সাথে থাকতে পারছ না। বা আমার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কন্টিনিউ করা তোমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। দেন আমি কথা দিচ্ছি তুমি চাইলেই আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। যখন চাইবে। জাস্ট একটা সুযোগ দাও।”

তুর্বী চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

” বিয়েতো সারাজীবনের একটা সম্পর্ক সৌহার্দ্য। এটা কোন ছেলেখেলা নয়। এটা জীবন। কোন থার্ডক্লাস টাইপের মুভি, সিরিয়াল বা গল্প না যেখানে যখন ইচ্ছে হুটহাট যার তার সাথে বিয়ে হয়ে যাবে, আবার হুটহাট করেই ডিবোর্স হয়ে যাবে, আবার আরেকটা বিয়ে হবে। বিয়ের কোন ভ্যালুই থাকবেনা? আজ একজনকে ভালোবাসবে তার সাথে থাকা সম্ভব হয় নি বলে কাল হুট করেই আরেকজনকে ভালোবেসে ফেলবে। এটা হয়? সবকিছু এতোই সহজ? আর আপনার মত একজন মানুষ যে সম্পর্ক, জীবন নিয়ে এতো সিরিয়াস তার মুখে এসব মানায় না।”

সৌহার্দ্য আজ সত্যিই নিজের মধ্যে নেই। ভালোবাসাকে পাওয়ার নেশায় ও ওর ব্যাক্তিত্ব থেকেই বেড়িয়ে গেছিল। সৌহার্দ্য নিজেকে সামলে বলল,

” জানি। কিন্তু কী করব বল? ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। আই ওয়ান্ট ইউ ইয়ার।”

” বাট আমি আপনাকে ভালোবাসিনি। আর পরেও বাসতে পারব কি-না তার কোন গ্যারান্টি নেই সৌহার্দ্য। আর এই ওয়ান সাইডেট লাভ দিয়ে সংসার বা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না। আর আমি ফিল করেছি যে আপনি দুর্বল হয়ে পরেছেন। যেটা আমি ভাবতেও পারিনি। তাই আমাদের মধ্যে যেই সম্পর্কটাই আছে সেটা এখানেই শেষ করা উচিত। আপনিও ভুলতে পারবেন আমায়। দুজনের জন্যে এটাই ভালো হবে। আমার সাথে এরকম সম্পর্কে থাকলে আপনিই অতিষ্ঠ হয়ে যাবেন। ”

সৌহার্দ্য গলা কাঁপছে। নাক চোখ লাল হয়ে গেছে। ও অনেক কষ্টে বলল,

” তুর আমার জন্যে ভাবতে হবেনা। তুমি তোমার কথা বল।”

” সৌহার্দ্য আমি একেবারে অন্যরকম। সমুদ্রের ঢেউ দেখেছেন? একেকটা ঢেউ একেকরকম সাইজের হয় আর তাদের জার্নিটাও আলাদা আলাদা হয়। কখন কোন ঢেউটার সাইজ কেমন হবে কেউ জানেনা। আমার লাইফটাও এরকম। কখন কী হয়? কী করি? কী ভাবি? কেন ভাবি? কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই। সবটাই এলোমেলো বাট আমার কাছে ইন্টারেস্টিং। আমি খুব এক্সপিরিমেন্টাল। এসব ভালোবাসা, ফিলিংস, কমিটমেন্ট করার জন্যে যেই স্হির মেন্টালিটি, লাইফস্টাইল, পয়েন্ট অফ ভিউ লাগে সেট আমার নেই। আর এই তিনটে ছাড়া সম্পর্ক বা সংসার কোনটাই টেকেনা। তাই আপনি সুখি হবেন না আমার সাথে। উল্টো ফেড আপ হয়ে যাবেন আমার ডোন্ট কেয়ার কার্যকলাপে। যেরকমটা এই কমাসের সম্পর্কে বারবার হয়েছেন। সারাজীবন কীকরে?”

সৌহার্দ্য ঠান্ডা গলায় বলল,

” তুর ডোন্ট ডিসাইড ফর মি। তুমি কী চাও সেটাই বল।”

তুর মুখে হাত দিয়ে শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল,

” আমি চাই আমাদের মধ্যে যাই ছিল এখানেই শেষ করতে।”

” এটাই তোমার শেষ কথা?”

” হুম।”

সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে গেল ওখান থেকে আসলে নিজের চোখের জলটা তুর্বীকে দেখাবেনা। আজ কতদিন পর কাঁদছে জানা নেই সৌহার্দ্যর কিন্তু অবাধ্য কান্নাগুলো আজ বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসছে খুব করে। তুর্বী ওখানেই ঠায় বসে আছে। চোখদুটো টেবিলের দিকে। অকারণেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে ওর। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে গেল। অনেক দূরে হারিয়ে গেল। আর পাওয়া যাবেনা। খেয়াল করল ওর চোখের কোণেও কারণ ছাড়াই সামান্য নোনাজল জমা হয়েছে।

#চলবে…