জৈষ্ঠ্যের প্রেম পর্ব-০৪

0
261

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-৪)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৮.
ভোর পাঁচটায় বাড়ির সব বড়রা জেগে গেছে। ছোটরা সারারাত নিজেদের মতো হৈ চৈ করে এখন ঘুমে কাঁদা। যদিও বড়রা সবাইও দেরিতে শুয়েছে তবুও তারা যেহেতু বড় তাদের দায়িত্বও বড়। তাই সকলে সেই ভোরবেলা থেকে কাজে লেগে পড়েছে।

মৌসন্ধ্যার রাতে ঠিকভাবে ঘুম হয়নি। নানান সব আজগুবি চিন্তা ভাবনা করে করে শেষ রাতে একটু শুয়েছিল। সকাল আটটায় তার এই শান্তির ঘুমটা এপ্রিল এসে ন’ষ্ট করে দিল। সে বর্ষা আর মৌসন্ধ্যার রুমে ছুটে এসে গলা ফাঁটিয়ে বলতে লাগল,
-‘মৌ আপু, বর্ষা আপু! উঠো, জুন আপু ডাকে।’
বর্ষা নড়ে চড়ে এপ্রিলকে ধ’ম’কে বলল,
-‘এই! তুই যা তো! এত সকালে কী কাজ?’
-‘কাজ কোথায়? জুন আপু বলল রঙ খেলা হবে। সবাইকে ছাদে ডাকছে।’
বর্ষা এবার উঠে বসল। তারপর চোখ ডলে নিয়ে বলল,
-‘সত্যি নাকি রে!’
-‘হ্যাঁ। বলেছে ঝটফট তৈরি হতে। জুন আপু তোমাদের দুইজনের জন্য এই সালোয়ার কামিজ গুলো পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এগুলো পড়ে আসো। আমি যাই। আমাকে জুন আপুর ফ্রেন্ড নোভা আপু সাজিয়ে দিবে বলেছে।’

এপ্রিল যেমন ছুটতে ছুটতে এসেছিল তেমনিই ছুটতে ছুটতে বের হয়ে গেল। বর্ষা প্যাকেট দুইটা নেড়ে চেড়ে দেখল। তার মনে পড়ে জুন সবাইর বডির সাইজ নিয়েছিল দুই সপ্তাহ আগেই। বর্ষাকেই তো কল করে বলেছিল সবারটা যোগাড় করে রাখতে। তবে এটা বলেনি যে এরকম কিছু করবে। বর্ষা হেসে দিল। জুন আপুটা অন্যরকম। মনে হয় শক্ত মনের কিন্তু আদৌতে সে তুলোর মতো নরম। বর্ষা মৌসন্ধ্যাকে ঠেলতে থাকে।
-‘মৌ ওঠ। রঙ খেলতে যাব, চল।’

————-
মৌসন্ধ্যা হাতে সালোয়ার কামিজটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা আয়নার সামনে বসে সাজছে। মৌসন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-‘কীরে! রেডি হচ্ছিস না কেন? দেরি হয়ে গেছে এমনিতেও। জুন আপু বকবে।’
মৌসন্ধ্যা বিছানায় বসল। তারপর বর্ষাকে বলল,
-‘এভাবে গোসল না দিয়ে সাজতে আমার ভালো লাগেনা।’
-‘ওহ প্লিজ! ভুলেও এখন গোসলের কথা ভাবিস না। এই মুহূর্তে একবার গোসল করবি তারপর রঙ মাখার পর আরেকবার করবি, মাথা খা’রা’প নাকি? এমনিতেও শীতকাল। কেউই এখন গোসল করেনি। রঙ খেলা শেষ হলে সবাই গোসল করবে।’

মৌসন্ধ্যা বর্ষার কথা শোনার পর আর ভাবল না। আসলেও তো! একটু পর রঙ মেখে তো এমনিতেও গোসল করতে হবে। সে ব্যাপারটা খেয়াল করেনি।

হালকা পাতলা সেজে বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা ছাদে গেল। তাদের সবার পরণে এখন সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ। কেবল ওড়না হলো নানান রঙের। ছাদে কয়েকটা টেবিল সাজিয়ে রাখা আছে। আর রাতের হলুদ অনুষ্ঠানের সাজসজ্জাটা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন চারিদিকে রঙ বেরঙের কাপড়, কাগজ দিয়ে সাজানো। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। জুন একটা সাদা হাফ সিল্ক শাড়ি পরে আছে। তাকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে! মৌসন্ধ্যা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কেবল জুনকেই দেখছিল।

রঙ খেলা মেয়েরা মেয়েরা খেলবে এমনটাই ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু শ্রাবণ, মুকিত, সাবাব এরা ভেজাল করছে। তারা চাইছে সবাই খেলবে। জুনকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করাতে পেরে তারা বেশ আনন্দিত। জুন আপত্তি করল না কারণ বাড়িতে বাহিরের কোনো ছেলে নেই। কেবল আছে আহরার। আর আহরার হলো তার ভাইয়ের বেশ পুরোনো বন্ধু। আহরারের সাথে তাদের সবারই ভালো সম্পর্ক। আহরারকে সবাই আপনই ভাবে। তাই তার উপস্থিতিতে সমস্যা নেই কারো।

ছেলেরা সবাই পারমিশন পেতেই কোনো রকমে জামা কাপড় বদলে ছাদে হাজির হয়। সবার সাদা পাঞ্জাবী সাথে ছিল না তাই কেউ কেউ টি শার্ট আর কেউ কেউ অন্যান্য রঙের পাঞ্জাবী পরেই হাজির। একমাত্র আহরার সাদা রঙটা পরেছে। তবে পাঞ্জাবী নয়, সে পরেছে টি শার্ট। শ্রাবণ তার ইংরেজীতে বড় বড় করে লেখা ‘STUPID’ টি শার্টটা পরে ছাদে আসে। তা দেখে মেয়েরা তাকে নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে।

জুন ফটোশ্যুট করার পরপরই শ্রাবণ আর মুকিত মিলে এলোমেলো ভাবে এর গায়ে ওর গায়ে রঙ ছোড়া শুরু করে। মুহুর্তেই একটা ছোট্ট রঙ খেলা ধারণ করল যু’দ্ধের রূপ। মেয়েরা সবাই এত আশা নিয়ে এসেছিল কিন্তু তাদের সেই আশায় বালি ঢেলে দিল এই পাঁজি ছেলেগুলো। পাঁচমিনিটেই রঙ শেষ। এবং পুরো ছাদের বিভৎ’ষ অবস্থা।

শ্রাবণের মতিগতি মৌসন্ধ্যা শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল। তাই সে শ্রাবণ রঙের থালা হাতে নিতেই দৌঁড়ে গিয়ে ছাদের এক কোণায় লুকিয়ে পড়ে। বিরাট বড় এই ছাদে সেই জায়গাটা লুকানোর জন্য বেশ উপযুক্ত। ধীরে ধীরে তা’ণ্ড’ব থামতেই সে বের হলো। সবার দিকে খেয়াল করতেই দেখল বর্ষার আর এপ্রিল কাঁদো কাঁদো মুখ করে জুনের কাছে বিচার দিচ্ছে আর জুন শ্রাবণ আর মুকিতকে তাদের কাজের জন্য বকছে। মৌসন্ধ্যা যেন স্বস্তি পেল। এই রঙের ঝড় থেকে বাঁ’চ’তে পেরে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। মৌসন্ধ্যাকে অক্ষ’ত অবস্থায় দেখে শ্রাবণ হা হুতাশ করতে থাকে। তারপর সে হঠাৎ করেই টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু রঙ মুষ্টিবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে আসতেই মৌসন্ধ্যা এক দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। শ্রাবণও পেছন পেছন আসছিল। মৌসন্ধ্যা দোতলায় এসে একটা রুমের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। শ্রাবণ বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক খুঁজেও তাকে পেল না। মৌসন্ধ্যা লুকিয়েছিল খাটের পেছনে। শ্রাবণ একবার এই রুমে আসে তবে একবার তাকিয়েই চলে যায়। কারণ এই রুমে শরৎ আছে বর্তমানে। আর শরৎ দেখলে এতক্ষণে চিৎকার চেঁচামেচি করে ভরিয়ে ফেলতো। শ্রাবণ ব্যর্থ হয়ে চলে গেল। মৌসন্ধ্যা শ্রাবণ যাওয়ার পর ধীরে সুস্থ্যে উঠে দাঁড়ায়। তারপর খাটের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ দরজার ডানপাশে থাকা ডিভাইনটার দিকে তাকাতেই সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। শরৎ শুয়ে আছে লম্বা হয়ে। তার গায়ে কমফোর্টার আর হাতে একটা বই। আরেকটু ভালো ভাবে তাকাতেই বইয়ের নাম দেখা গেল। ‘দ্য আর্ট অব থিঙ্কিং ক্লিয়ারলি’ বইটি খুব মনযোগ দিয়ে সে পড়ছে। নিঃশব্দেই পড়ছে, একমনে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে তাকাচ্ছেনা। মৌসন্ধ্যা তাড়াহুড়ো করে ঢোকার সময় শরৎকে তখন দেখেইনি। সে ভাবে, শরৎও কী তাকে দেখেনি? যদি দেখে থাকে তবে তো এতক্ষণে ধ’ম’কা ধ’ম’কি শুরু করে দিত।

মৌসন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই শরৎ বেশ গর্জে উঠে বলল,
-‘যাচ্ছিস না কেন? শ্রাবণ তো চলে গেছে। এখনও দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী!’

মৌসন্ধ্যা কেঁপে উঠল। শরৎ প্রথমেই খেয়াল করেছে। অবশ্য খেয়াল না করার তো কিছু নেই। সে জাগ্রত ছিল আর কেউ তার রুমে প্রবেশ করে ছুটোছুটি করে লুকালো সে টের পাবেনা! তবে আসল কথা হলো শরৎ কেন শ্রাবণকে বলল না সে এখানে লুকিয়েছে আর কেন সে মৌসন্ধ্যাকে রুমে ঢোকার সময় বকল না! তার যে স্বভাব, তাতে তো শুরুতেই মৌসন্ধ্যার দুই গালে দুইটা চ’ড় মে’রে বের করে দেওয়ার কথা ছিল। মৌসন্ধ্যাকে এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শরৎ এবার সরাসরি তার দিকে তাকালো। বলল,
-‘তোরে বলছিনা বের হতে। বে’য়া’দ’ব।’
মৌসন্ধ্যা অভিমান করে বলল,
-‘যাচ্ছি তো! এত বার বলা লাগে?’

মৌসন্ধ্যা চলে গেল। শরৎ আগের মতো বই পড়ায়
মনযোগ দিল। গতকাল রাতে ঠান্ডা পানিতে গোসল করাতে তার জ্বর এসেছিল। তাই সে রুমেই শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়াও সব রুমেই করছে। বিয়েতে যাবে কীনা সেই ব্যাপারেও ছেলেটা বেশ দ্বিধা- দন্দে আছে। জুন তার আপন বড় বোনের মতো। সে তো ঠিক করেছিল আর কারো বিয়ে মিস দিলেও জুনের বিয়ে সে কোনোভাবেই মিস দিবেনা। এখন হঠাৎ যে এমন জ্বরে কাবু হবে সে কী ভেবেছিল!

মৌসন্ধ্যা শরৎ এর রুম থেকে বের হতেই তার ভাই মাহতিমকে দেখল। ফোন হাতে সে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আর তার কাছে এসেই মৃদু ধ’ম’ক দিয়ে বলল,
-‘ফোন কোথায় থাকে তোর? বাবা যে কল দিচ্ছেন দেখিস নাই?’
-‘ছাদে ছিলাম আমি।’
-‘ধর, বাবা কল দিয়েছে কথা বল। কথা শেষ হলে ফোনটা আম্মুর কাছে দিয়ে আসবি।’
-‘আচ্ছা।’

মৌসন্ধ্যা ভাইয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বাবার সাথে কথা বলল। তার বাবা জানালো হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ে যাওয়াতে তিনি আর আসতে পারছেন না। ব্যাপারটা যেন তার মাকে সে বুঝিয়ে বলে। মৌসন্ধ্যা বাবাকে আশ্বাস দিল যাতে চিন্তা না করে। সে মাকে বুঝিয়ে বলবে। কথা শেষ করে সে তার মাকে ফোনটা দিয়ে আসে। আর তার বাবার আসতে না পারার কারণটা বুঝিয়ে বলে। তারপরেও মৌসন্ধ্যার মা তার স্বামীর কাজে বি’র’ক্ত হলো। সে এখন বাবা ভাইকে কী বলবে! তিনি বেশ রে’গেই গেল। তবে ঝামেলা করল না।

মৌসন্ধ্যা তার মায়ের রুম থেকে বের হয়ে গ্রীষ্মকেও দেখতে পেল সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। সাথে আছে তার ছোট মামা। দুজনে কথা বলতে বলতে আসছে। ছোট মামা নিচে নানুর রুমের দিকে গেল। আর গ্রীষ্ম সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখে মুখে বেশ ক্লান্তি। মৌসন্ধ্যা ভাবে ছোট বোনের বিয়েতে বড় ভাইদের বুঝি অনেক খাটা খাটুনি করতে হয়! তারপর ভাবল তার বিয়েতে মাহতিমকেও হয়তো অনেক পরিশ্রম করতে হবে। নিজের বিয়ের কথা ভাবতেই তার ঠৌঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।

৯.
বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা রুমে বসে নাস্তা করছে। বর্ষা পরোটা ছিড়তে ছিড়তে বলল,
-‘তুই কাজটা ঠিক করলি? আমাদের ওই অবস্থায় ফেলে নিজে লুকিয়ে বেঁচে গেলি।’
-‘আরে তুই তো আমার সাথেই ছিলিনা। চৈত্রকে নিয়ে ছবি তুলছিলি তখন। আমি শ্রাবণ ভাইয়ের শ’য়’তা’নি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই লুকিয়ে পড়েছি। আচ্ছা স্যরি!’
-‘হুহ।’

নাস্তা করার পর দুজন মিলে নিচে নামে। মেজো মামানি অর্থাৎ বর্ষার মা দুজনের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ফেল তাড়াতাড়ি। দুই ঘন্টার মধ্যে রেডি হতে হবে সবাইকে।’
-‘এত তাড়াতাড়ি!’ বর্ষা বলল।
-‘ওমা তাড়াতাড়ি কোথায়? এখন এগারোটা বাজতে চলল। তোদের সাজগোজ করতে লাগে দুই ঘন্টা, তারপর কমিউনিটি সেন্টারে যেতেও তো এক ঘন্টা লাগবে। এখানে যা ট্রাফিক জ্যাম! এদিকে বড় ভাই বলল সবাইকে একটার মধ্যে কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত থাকতে। আমরা মেয়ে পক্ষ। যত দো’ষ সব আমাদেরই তো হবে।’
বর্ষার মা চলে যেতেই বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা হল রুমের সোফায় গিয়ে বসল। তারপর বর্ষা আফসোসের সুরে বলল,
-‘বিয়েটা রাতের বেলা হলেই ভালো হতো।’
-‘হুম।’ মৌসন্ধ্যা সাথে তাল মেলায়।

চা শেষ করে দুইজন উঠে পড়ল। মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘চল একটু বাহিরে যাই। রোদে দাঁড়ালে ভেজা চুলও শুকিয়ে যাবে আর একটু ভিটামিন ও নেওয়া হবে। শীতের রোদ ভারি মিষ্টি।’
-‘চুল শুকাবে মানলাম, ভিটামিন পাবো মানলাম। কিন্তু রোদ মিষ্টি, এটা মানতে পারলাম না। তুই কী টেস্ট করেছিস নাকি!’
-‘বর্ষা!’
মৌসন্ধ্যার চোখ রাঙানো দেখে বর্ষা হেসে বলল,
-‘মজা করছিলাম। রা’গিস কেন?’

বাড়িতে মানুষ বলতে তেমন কেউ নেই। জুনের মায়ের দিকের আত্মীয়রা কাল রাতে হলুদ অনুষ্ঠানের পরই চলে গেছে। কেননা তারা সবাই ঢাকাতেই বসবাস করে। তাদের প্রায় সবারই বাসার দূরত্ব আধা ঘন্টার মতো। জুনের এক খালা রাজশাহী থাকেন কেবল তিনি আর তার মেয়ে এই বাড়িতে আছে। আর জুন আর গ্রীষ্মের বন্ধু বান্ধব সবাই নিজ নিজ বাসায় চলে গেছে। বন্ধুদের মধ্যে কেবল জুনের বেস্টফ্রেন্ড নোভা আর গ্রীষ্মের বন্ধু আহরার রয়েছে।

মৌসন্ধ্যা আহরারকে সকালে এক পলক দেখেছিল। এর পর আর তার দেখা পায়নি। অবশ্য কেন যেন তার দেখতে ইচ্ছা করছেনা। আর কাল সে কীনা ভেবেছিল সে আহরারের প্রেমে পড়েছে। বর্ষাকে জানাতেই বর্ষা বলল এটা জাস্ট ক্রাশ ছাড়া কিছু না।

মৌসন্ধ্যাও সেটাই মেনে নিল। আসলেই তো! প্রেমে পড়া আর ক্রাশ তো এক হয় না। দু’টোই আলাদা এবং প্রচুর তফাৎ দু’টোর মধ্যে। আহরারকে তার চোখের দেখায় ভালো লেগেছে। তবে অন্য কোনো অনুভূতি আসছেনা। মৌসন্ধ্যা ঠিক করল সে আর ভাববেনা আহরারকে নিয়ে। সে শুনেছে আহরার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। মধ্যবিত্ত মৌসন্ধ্যার সাথে তাকে মানায় না। মৌসন্ধ্যা সবসময় চায় সে যেন তার সমতূল্য জীবন সঙ্গী পায়। সে মধ্যবিত্ত এবং সে চায় ও একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ যে কীনা তাকে বুঝবে। কেননা মধ্যবিত্তই মধ্যবিত্তর ক’ষ্ট, স্বপ্ন, শখ চিনে ও বুঝে। দরকার কী অমন সোনার হরিণ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার? যা কখনো হওয়ার নয় তা নিয়ে ভেবে বর্তমান ন’ষ্ট করার কী কোনো মানে আছে?

বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা গার্ডেনে ঘুরছে। তখনিই মাইকিং শুনতে পেল ‘আইসক্রীম, আইসক্রীম’। আর তাতে দু’জনেই খুশিতে লাফিয়ে উঠল। গেইটের সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখল আইসক্রীমের ভ্যানটা আসছে এদিকে। দুজনে কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। আইসক্রীম খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু টাকা নেই সাথে। বর্ষা বলল,
-‘মৌ তুই লোকটাকে দাঁড় করা। আমি টাকা নিয়ে আসছি।’

বর্ষা বাড়ির ভেতর ছুটে গেল। মৌসন্ধ্যা আইসক্রীম ওয়ালাকে দাঁড় করালো। বর্ষা দরজা দিয়ে ঢুকতেই সাবাবকে দেখতে পায়। দেখে বলল,
-‘এই সাবাব! তোর কাছে টাকা আছে?’
সাবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘থাকবেনা কেন? আমি কি তোর মতো গরীব!’
বর্ষা কথাটা শুনে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘আচ্ছা বড়লোক হলে তো ভালো। দেন বড়লোক ভাই আমাকে পাঁচশ টাকা দেন।’

সাবাব পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল বর্ষার হাতে। বর্ষা বলল,
-‘বিটলা! তুই নাকি বড়লোক! মাত্র একশ টাকা দিলি?’
-‘তো তুই কী ভাবছিলি পাঁচশ দিব? জানিস পাঁচশ টাকা কত বেশি? একশ নিলে নে। নইলে ফেরত দে।’

বর্ষা কটমট করে সাবাবকে দেখে নিয়ে একশ টাকা নিয়েই বের হয়ে আসে। তারপর মৌসন্ধ্যাকে বলল,
-‘কী খাবি?’
-‘কোণ নে।’
বর্ষা আইসক্রীমওয়ালাকে বলল,
-‘মামা দুইটা কোণ দেন।’
-‘জ্বে মামা দিতাছি। কোন ফ্লেভার দিমু?’
মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘চকলেট।’
-‘আমাকে দিবেন ভ্যানিলা।’

লোকটা আইসক্রীম বের করতে নিলেই চৈত্র আর এপ্রিল দোতলার বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠল। এত দূর থেকেও ওদের গলা স্পষ্ট। চৈত্র বলছে,
-‘এই মৌপু, বর্ষাপু আমরাও খাব। আমাদের জন্য নাও!’

বর্ষা দেখল আছে কেবল একশ টাকা। এতে তো দুইটাই হবে। সে আইসক্রীমওয়ালাকে বলল,
-‘মামা মিনি কোন গুলো আছে?’
-‘না মামা। নাই।’
মৌসন্ধ্যা বলল,
-‘বর্ষা এক কাজ কর, চকোবার নিয়ে নে।’
-‘কিন্তু আমার তো চকোবার ভালো লাগেনা।’
-‘আমারও তো লাগেনা। কিন্তু ওরা যেহেতু বলছে নিয়ে নে।’
-‘আচ্ছা। এই মামা আপনি চারটা চকোবার দেন।’

আইসক্রীম ওয়ালা চকোবার দিল। বর্ষা টাকা দিতেই বলল,
-‘মামা, আরো বিশ টাকা লাগবো।’
-‘বিশ টাকা কেন?’
-‘চকবার এহন তিরিশ টাকা হইয়া গেছে।’
-‘কী! পঁচিশ টাকা থেকে ত্রিশ টাকা হয়ে গেল?’
-‘জ্বে।’

বর্ষার মনটাই ভেঙে গেল। সে ভাবল একটা রেখে দেবে নয়তো বাড়ির ভেতর গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। তখনিই গ্রীষ্মের গলা শোনা গেল। গ্রীষ্ম বলল,
-‘মামা, বিশটা কোণ আর দশটা চকোবার দিন।’
এতগুলো আইসক্রীমের কথা শুনে আইসক্রীমওয়ালার মুখে হাসি ফুঁটে উঠল। সে বলল,
-‘এই তো মামা! এক্ষণি দিতাছি।’

বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা অবাক হয়ে গ্রীষ্মের দিকে তাকিয়ে আছে। বর্ষার তো খুশিতে চোখে পানি চলে আসার মতো। আইসক্রীম গুলো নিয়ে গ্রীষ্ম টাকা পরিশোধ করে দিল। আইসক্রীম ওয়ালা মৌসন্ধ্যাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘আমনেরা কী নিবেন না?’
বর্ষা ঝটফট জবাব দিল,
-‘আর নিব কেন? ত্রিশটা আইসক্রীম কী কম নাকি!’
-‘তিরিশটা কী আপনাগো নাকি? এই মামা নিতেছে।’
-‘এই মামা আমার বড় ভাই। বুঝছেন?’
-‘ওহ আইচ্ছা আইচ্ছা বুজছি।’

আইসক্রীম ওয়ালা ভ্যান নিয়ে চলে গেল। তারা গেইট পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো। বর্ষা বলল-
-‘তুমি কী ভালো ভাইয়া! আমাদের জন্য আইসক্রীম কিনলে।’

গ্রীষ্ম হাসে, বর্ষার মাথায় আলতো চাটি মা’রে। মৌসন্ধ্যা এক ঝলক গ্রীষ্মের হাসি দেখে চোখ সরিয়ে নেয়। মনে মনে ভাবে পুরুষ মানুষের হাসি এত সুন্দর হবে কেন? তারপরই নিজের ভাবনার জন্য ল’জ্জা পায়।

গ্রীষ্ম বর্ষার হাতে আইসক্রীম ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘সবাইকে যার যার আইসক্রীম বুঝিয়ে দিস। যারা কোণ খায় তাদের কোণ দিস যারা চকোবার খায় তাদের চকোবার দিবি। কম পড়লে জানাইস। আনিয়ে নিব আবার।’
-‘আচ্ছা।’

বর্ষার মাথায় শ’য়’তা’নি বুদ্ধি এসে গেল। সে ঠিক করল তারা চারজন দুইটা দুইটা খাবে। সাবাবকে তার টাকা ফিরিয়ে দিবে। আইসক্রীম দিবেনা। আর গ্রীষ্ম এমনিতেও বেশি আইসক্রীম নিয়েছে। কারণ এই ঠান্ডায় তার মা চাচী কেউ আইসক্রীম খাবেনা। আর এত মানুষও নেই। মৌসন্ধ্যা বর্ষার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দিল না। সে হিসেব করে সবাইকে যার যার পছন্দ মতো আইসক্রীম দিয়ে বাকি গুলো সে গিয়ে সোজা ছোট মামীর হাতে দিয়ে এলো। তিনি ফ্রিজে রেখে দিলেন। আর বললেন,
-‘তোরা রাতে ফিরলে না হয় খাবি। তবে তোদের আম্মারা যেন না জানে। পরে ঠান্ডা লেগে গেল আমাকেই কথা শুনতে হবে।’
মামীর কথা শুনে দুইজন মাথা নেড়ে সায় জানালো। নিজেদের আইসক্রীম নিয়ে আসার সময় মৌসন্ধ্যা বর্ষাকে বলল,
-‘বর্ষা শোন?’
-‘কী!’
-‘গ্রীষ্ম ভাইয়াকে একটা আইসক্রীম দিয়ে আসলে ভালো হয় না? উনিই তো কিনে দিলেন।’
-‘ভাইয়া খাবে বলে মনে হয়না।’
-‘না খেলে না খাবে। তুই সাধতে তো পারিস।’

অতঃপর তারা গ্রীষ্মের জন্যও একটা আইসক্রীম নিয়ে তার রুমে গেল। বর্ষাই গিয়ে দিয়ে আসল। গ্রীষ্ম বলল,
-‘আমাকে দিচ্ছিস কেন? তোদের কম পড়বে তো!’
-‘উফ ভাইয়া! তুমি এমনিতেও বেশি কিনেছ। ফ্রীজে আরো আছে।’
-‘আমার জন্য আনতে গেলি কেন শুধু শুধু? আমি তো খাব না।’
-‘আমি তো জানতাম তুমি খাবেনা। মৌ বলল তাই আনলাম।’
-‘কে বলল?’
-‘মৌসন্ধ্যা।’
-‘জৈষ্ঠ্য?’
বর্ষা হেসে বলল,
-‘ও যদি এখন শুনতো তুমি তাকে জৈষ্ঠ্য বলেছ তাহলে খবর করে ছাড়ত।’
-‘ওহ।’
-‘তাহলে তুমি খাবে না তাই তো!’
-‘না খাব। দে!’
-‘তোমার এক মুখে দশ কথা! নাও ধরো।’

বর্ষা গ্রীষ্মের হাতে আইসক্রীম দিয়ে চলে এলো। আর গ্রীষ্ম আইসক্রীমটা হাতে নিয়ে মুঁচকি হাসে।
এরপর একটু আইসক্রীম মুখে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘উফ! আইসক্রীমটা গরম, জৈষ্ঠ্যের মতো।’

#চলবে।